শাস্ত্রে কেন বিষ্ণু ও শিবকে অভেদ বলা হয়েছে?!
- শাস্ত্রে যেমন গুরুকে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর বলা হয়েছে,
- শাস্ত্রে যেমন অতিথিকে নারায়ণ বলা হয়েছে,
- শাস্ত্রে যেমন ব্রাহ্মণকে সাক্ষাৎ বিষ্ণু বলা হয়েছে,
- শাস্ত্রে যেমন সন্ন্যাসীকে নারায়ণতুল্য বলা হয়েছে,
………..ঠিক তেমনি শিবজী এ জড়জগতে ভগবান বিষ্ণুর প্রতিনিধি রূপে কার্যনির্বাপন করেন, তাই তাকে শ্রীহরির সাথে অভেদ বলা হয়েছে৷
অনেকটা এরকম, আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী যদি প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতে আসেন, তবে তাকে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সমতুল্য মর্যাদা দেওয়া হয়। কারণ তিনি প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
শ্রীল জীবগোস্বামিপ্রভু প্রমুখ বৈষ্ণবাচার্য্যগণ লিখিয়াছেন-
“শুদ্ধভক্তাঃ শ্রীগুরোঃ শ্রীশিবস্থ্য চ ভগবতা সহ অভেদদৃষ্টিং তং প্রিয়তমত্বেনৈব মন্যন্তে।”
– ভক্তি সন্দর্ভ ২১৪।
অর্থাৎ, “যেহেতু শ্রীগুরু ও শ্রীশিবের ভগবানের অতি প্রিয়তম স্বরূপ, তাই শুদ্ধভক্তগণ ভগবানের সাথে তাদের অভেদ দৃষ্টিতে জানেন।”
স্কন্দপুরাণেও বলা হয়েছে-
বাসুদেবস্য ভক্তস্য ন ভেদো বিদ্যতেহনয়োঃ।
বাসুদেবস্য যে ভক্তাস্তেষাং বক্ষ্যামি লক্ষণম।।
[স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুখন্ড-পুরুষোত্তমমাহাত্ম্যম, ১০।৯৫]
অনুবাদ: বাসুদেব ও তাঁর ভক্তের মধ্যে কিছুমাত্র ভেদ নেই। ভক্তের সেবা করলেই বাসুদেবের সেবা হয়।
যথা বিষ্ণুস্তথাচায়ং নান্তরং বর্ত্ততে ক্বচিৎ।
ইতি জ্ঞাত্বা তু ভো বৎস সর্ব্বদা পূজয়েদবুধঃ।।
[পদ্মপুরাণ, উত্তরখন্ড, ৬৮।১৯]
বঙ্গানুবাদ: যেমন বিষ্ণু, তেমনই বৈষ্ণব, উভয়ের ভেদ কোথাও নেই। বৎস! ইহা বুঝিয়া বিজ্ঞগণ সর্বদা বৈষ্ণবের পূজা করিবেন।
সমস্ত শাস্ত্রে ঘোষিত হয়েছে, শিবের তুল্য শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব আর নেই:
- ‘ বৈষ্ণবানা যথা শম্ভু’ – শম্ভুই সর্বশ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব( শ্রীমদ্ভাগবতম ১২।১৩।১৬)
- ‘বৈষ্ণবানাং যথা রুদ্র’ – রুদ্রের সমান বৈষ্ণব নেই(স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুখন্ড, বেঙ্কটাচলমাহাত্ম্যম ১৭।১৫)
- “শঙ্করের সমান কোনো বৈষ্ণব নেই” (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, ব্রহ্মখন্ড ১১।১৬)
- ”বিষ্ণুই সর্বেশ্বর ও সর্ব দেবোত্তম। শিব হলেন আদিগুরু।”(নারদপঞ্চরাত্র ৪।৩।২১০)
- সদাশিব স্বয়ং ‘রাধাকৃষ্ণ যুগল” মন্ত্রে দীক্ষিত। (পদ্মপুরাণ পাতালখন্ড অধ্যায় ৫১)
কিন্তু একটা বিষয় কি জানেন তো, আজকাল পিডিএফ পড়ুয়া সাধারণ মানুষ শাস্ত্র সম্পূর্ণ না পড়ে মাঝখান থেকে একটা দুইটা বাক্য দেখেই লাফিয়ে উঠে। ওসব অতি পন্ডিত বাঁদরেরা তাই শাস্ত্রের প্রকৃত অর্থ না জেনে দোষারোপ করে। শাস্ত্র বিচার করার ক্রাইটেরিয়া জানতে হয়।
কোন শাস্ত্রের মূল সিদ্ধান্ত কি তা বিচারের জন্য সবচেয়ে সহজ ক্রাইটেরিয়া হলো সে শাস্ত্রের শুরুর ও শেষের বাক্য পর্যালোচনা করে।
বৃহন্নারদীয় পুরাণের একেবারে প্রথম শ্লোকগুলোতেই বলা হয়েছে শিবজী শ্রীকৃষ্ণের অংশমাত্র। দেখুন-
“কমলার প্রীতিভাজন পরম প্রভু প্রভূত-করুণাসম্পন্ন বৃন্দাবনবিহারী পরমানন্দস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা করি। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর প্রভৃতি যাঁর অংশ, ত্রিভুবনের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়-কর্তা, সেই পরমবিশুদ্ধ চিৎস্বরূপ আদিদেব শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করি।”
[ বৃহন্নারদীয়পুরাণ,অধ্যায় ১, শ্লোক ১-২ ]
অতএব, শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণ, শিব তাঁর অংশ। অংশ কখনো পূর্ণ হয় না। ব্রহ্মসংহিতায় ব্রহ্মা বলেছেন, শ্রীকৃষ্ণের বিকার হলেন শিব। দুধ থেকে যেরূপ দই হয়, কিন্তু দই থেকে দুধ হয় না, ঠিক একইভাবে শ্রীকৃষ্ণ থেকে শিবের প্রকাশ, শিব হতে কৃষ্ণ হতে পারে না।
শ্রীশিব যেহেতু পরম বৈষ্ণব, তাই বিষ্ণু-বৈষ্ণব অভেদ জ্ঞানে তাকে অভেদ বলা হয়েছে, ঠিক যেরূপে গুরুকে পরমব্রহ্ম বলা হয়, অতিথিকে নারায়ণ বলা হয় ইত্যাদি।
অনেক জায়গায় দেখা গেছে ভগবানের সব অবতারেই শিবের পূজা করতে।এবং শিবের পূজা করতে ভক্তদের উপদেশ দিতে। What about that?!?
এটা হরি ও হরের একটা প্ল্যান। পদ্মপুরাণে আছে।
পুরাণানি চ শাস্ত্ৰাণি ত্বয়া সত্ত্বেন বৃংহিতাঃ। কপালচৰ্ম্মভস্মাস্থিচিহ্নাসমরসৰ্ব্বশঃ। ৩০
ত্বমেব ধৃতবান্ লোকান্ মোহয়ম্ব জগত্ৰয়ে ।
তথা পাশুপতং শাস্ত্ৰং ত্বমেব কুরু সৎস্কৃতঃ ॥৩১
কঙ্কালশৈবপাষণ্ডমহাশৈবাদিভেদতঃ।
অলক্ষ্যঞ্চ মত সম্যগ্বেদবাহ্যং নরাধমাঃ ॥ ৩২
ভস্মাস্থিধারিণঃ সর্ব্বে ভবিষ্যন্তি হচেতসঃ।
ত্বাং পরত্বেন বক্ষ্যন্তি সৰ্ব্বশাস্ত্রেষু তামসাঃ ॥৩৩
তেষাং মতমধিষ্ঠায় সর্ব্বে দৈত্যাঃ সনাতনাঃ।
ভবেয়ুস্তে মদ্বিমুখাঃ ক্ষণাদেব ন সংশয়ঃ ॥৩৪
অহপ্যবতারেষু ত্বাঞ্চ রুদ্র মহাবল।
তামসানাং মোহনার্থং পূজয়ামি যুগেযুগে।
মতমেতদবষ্টভ্য পতস্ত্যেব ন সংশয়ঃ ॥৩৫
~ [ পদ্মপুরাণ, উত্তরখন্ড, অধ্যায় ২৩৫, শ্লোক ৩০-৩৫, শ্রীহরি উবাচ ]
বঙ্গানুবাদঃ শ্রীহরি শিবকে বললেন- “হে শিব! তুমি সংকোচ পরিত্যাগ করে জগতে তামসিক পুরাণ ও অন্যান্য তামসশাস্ত্রের প্রচার করো। তুমি কপাল, চর্ম্ম, ভস্ম ও অস্থি চিহ্ন ধারণ করে ত্রিজগতের অখিল লোককে মোহিত কর। তুমি পাশুপাত্ শাস্ত্ৰ প্রণয়ন করে তা প্রচার কর। তুমি কঙ্কাল, শৈব, পাষণ্ড ও মহাশৈব প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত করে বেদবিরুদ্ধ মত অলক্ষ্যে প্রবর্তিত কর। এইরূপ করলে সকলে ভস্মাস্থিধারণ করে অধম হবে ও জ্ঞানহীন হয়ে যাবে। তখন তারা তামসিক হয়ে তোমাকেই সকল শাস্ত্রে শ্রেষ্ঠ বলে কীৰ্ত্তন করবে। (যারা বিষ্ণুভক্তির ছল করে ত্রিলোকে উৎপাত সৃষ্টি করে) সে সকল সনাতন দানবগণ এ বেদবিরুদ্ধ মত গ্রহণ করে ক্ষণকাল মধ্যে নিঃসংশয় বিষ্ণুবিমুখ হয়ে যাবে। হে মহাবল রুদ্র ! আমিও যুগে যুগে অবতার পরিগ্রহ করে তামসিক লোকদের মোহিত করার জন্য তোমার পূজা করব। তা দেখে দানবেরাও সেই মতের অনুবর্তী হইয়া নিঃসংশয় পতিত হইবে।
।।হরে কৃষ্ণ।।
।।হর হর শম্ভু।।