ভক্ত জড় জগতের ত্রিতাপ দুঃখে জর্জরিত হয়ে কখনও বা বলেন “ভগবান কেন আমার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না?“।
— এই প্রশ্নের উত্তর ভগবান স্বয়ং প্রদান করছেন শ্রীমদ্ভাগবতমে।
প্রেক্ষাপটঃ রাসলীলা’র সময় ভগবান ব্রজগোপীকাদের ‘অহং’ ভাবের জন্য তাঁদের পরিত্যাগ করেছিলেন। তখন গোপীরা কৃষ্ণ-বিরহে বিলাপ করছিলেন এবং শ্রীকৃষ্ণের নাম-রূপ-গুণ-লীলা অনুস্মরণ করছিলেন। পরে শ্রীকৃষ্ণ যখন তাঁদের কাছে ফিরে আসলেন তখন গোপীকা’রা শ্রীকৃষ্ণের কাছে এই প্রশ্ন করেছিলেন যে, তাঁদের আকুল আবেদন সত্ত্বেও ভগবান কেন সাড়া দেন নি। তখন ভগবান স্বয়ং এর উত্তর প্রদান করেছেন নিম্নোক্ত শ্লোকে।
নাহং তু সখ্যো ভজতোহপি জন্তূন্
ভজাম্যমীষামনুবৃত্তিবৃত্তয়ে।
যথাধনো লব্ধধনে বিনষ্টে
তচ্চিন্তয়ান্যন্নিভৃতো ন বেদ ৷৷
শ্রীমদ্ভাগবতঃ ১০/৩২/২০
অন্বয়ঃ -করি না; অহম্-আমি; তু-অপরপক্ষে; সখ্যঃ-হে সখীগণ; ভজতঃ-পূজা করে; অপি-এমন কি; জন-জীবের সঙ্গে; ভজামি- ভাব বিনিময়; আমীষাম্- তাদের; অনুবৃত্তি- প্রবৃত্তি (শুদ্ধ প্রেমের জন্য); বৃত্তয়ে- চালিত করার জন্য; যথা-ঠিক যেমন; অধনঃ- এক ধনহীন মানুষ; লব্ধ- প্রাপ্ত হয়ে; ধনে- ধন; বিনষ্টে- এবং তা বিনষ্ট হলে; তৎ- তার; চিন্তয়া- উদ্বিগ্ন চিন্তাতেই; অন্যৎ- অন্য কোন কিছু; নিভৃতঃ- ব্যাপৃত; ন বেদ-জানে না।
অনুবাদঃ জীব যখন আমাকে ভালবাসে, এমন কি তারা যখন আমার পূজাও করে, আমি তৎক্ষণাৎ সাড়া দিই না, তার কারণ হে গোপীগণ, আমি তাদের প্রেমময় ভক্তিকে তীব্রতর করতে চাই। লব্ধ ধন নষ্ট হওয়া নির্ধন ব্যক্তি যেমন সেই ধনের চিন্তাতেই উদ্বিগ্ন থাকে, অন্য কোন কিছুরই চিন্তা করতে পারে না, তখন তারা তেমনি হয়ে ওঠে।
তাৎপর্য
ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন ‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম’- “যারা যেভাবে আমার প্রতি আত্মসমর্থন করে, আমি তাদের সেভাবেই পুরস্কৃত করি।” তবুও কেউ যদি ভক্তি সহকারে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন, ভক্তের প্রেম তীব্রতর করার জন্য ভগবান তৎক্ষণাৎ সম্পূর্ণ সাড়া না দিতেও পারেন। কার্যত, ভগবান কিন্তু যথাযথভাবেই সাড়া দিচ্ছেন। কারণ একজন ঐকান্তিক ভক্ত সকল সময়েই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছেন, “দয়া করে তোমাকে শুদ্ধভাবে ভালবাসার জন্য আমাকে সাহায্য কর।” সুতরাং ভগবানের তথাকথিত অবহেলা আসলে ভক্তের প্রার্থনা পূরণ করা। দৃশ্যত নিজেকে আমাদের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রতি আমাদের ভালবাসা আরও তীব্র করে তোলেন আর তার ফলস্বরূপ বস্তুত আমরা যা চাই সেটি আমরা লাভ করি- পরমতত্ত্ব শ্রীকৃষ্ণের জন্য প্রগাঢ় প্রেম। এইভাবে শ্রীকৃষ্ণের দৃশ্যত অবহেলা, প্রকৃতপক্ষে তাঁর সুচিন্তিত সাড়া দেওয়া আর আমাদের গভীর ও শুদ্ধ আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতা লাভ।
আচার্যবর্গের মতানুসারে, শ্রীকৃষ্ণ যখন এই শ্লোকটি বলতে শুরু করলেন, তখন গোপীরা তাঁদের মুখের হাসি চেপে একে অপরের দিকে আড়চোখে দেখছিলেন। এরপরও শ্রীকৃষ্ণ যখন বলে চললেন, গোপীগণ হৃদয়ঙ্গম করতে শুরু করলেন যে, শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের প্রেমময়ী সেবার পরম পূর্ণতার স্তরে আনয়ন করছেন।