শ্রীকৃষ্ণ কে? মত্যলোকে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব বা দিব্য জন্মলীলা সম্পর্কে আলোচনা করুন। (২য় পর্ব)

১ম পর্বের পর-

তারপর শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩/১- ৫৩ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ী ” ভগবানের আবির্ভাবের শুভক্ষণে সমগ্র ব্রহ্মান্ড সত্ত্বগুন,সৌন্দর্য এবং শান্তিতে পূর্ন হয়েছিল।তখন রোহিনী,অশ্বিনী আদি নক্ষত্রগণ আবির্ভূত হয়েছিল।সূর্য,চন্দ্র এবং অন্যান্য সমস্ত গ্রহ ও তারকাগণ শান্তভাব ধারন করেছিল।সেসময় সাধু ও ব্রাহ্মণেরা অন্তরে প্রসন্নতা অনুভব করেছিলেন এবং স্বর্গলোকে যুগপৎ দুন্দুভি বাজতে লাগল।কিন্নর এবং গন্ধর্বরা মঙ্গলগীত গাইতে লাগলেন,সিদ্ধ এবং চারণেরা স্তব নিবেদন করেছিলেন, এবং অপ্সরাগণ সহ বিদ্যাধরেরা আনন্দে নৃত্য করতে শুরু করেছিলেন।সেসময় দেবতা এবং ঋষিরা আনন্দে পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন,এবং আকাশে মেঘেরা সমুদ্রের তরঙ্গের ধ্বনির অনুকরনে মন্দ মন্দ গর্জন করতে লাগল।তখন-

 নিশীথে তমউদ্ভূতে জায়মানে জনাদর্নে।
দেবক্যাং দেবরুপিণ্যাং বিষ্ণুঃ সর্বগুহাশয়।
আবিরাসীদ্ যথা প্রাচ্যাং দিশীন্দুরিব পুষ্কলঃ।।

-(শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩/৮)

অনুবাদঃ অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রে সচ্চিদানন্দ স্বরুপিনী দেবকীর গর্ভ থেকে সমস্ত জীবের হৃদয়ে বসবাসকারী সেই ভগবান শ্রীবিষ্ণু পূর্বদিকে উদিত পূর্ণচন্দ্রের মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন।

তখন বসুদেব সে শিশুটিকে চতুর্ভুজ বালক রুপে দর্শন করেছিলেন-

তমদ্ভুতং বালকমম্বুজেক্ষণং
চতুর্ভুজং শঙ্খগদাদ্যুদায়ুধম্।
শ্রীবৎসলক্ষ্মং গলশোভিকৌস্তুভং
পীতাম্বরং সান্দ্রপয়োদসৌভগম্।।
মহাহর্বৈদূর্যকিরীটকুন্ডল
ত্বিষা পরিষ্বক্তসহসস্রকুন্তলম।
উদ্দামকাঞ্চ্যঙ্গণাদদিভির্বিরোচনমানং
বসুদেব ঐক্ষত।।

(শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩/৯-১০)

অনুবাদঃ বসুদেব তখন দেখলেন যে,সেই নবজাত শিশুটির নয়নযুগল পদ্মের মতো।তার চার হাতে শঙ্খ,চক্র,গদা এবং পদ্ম।তার বক্ষে শ্রীবৎস চিহ্ন এবং গলদেশে কৌস্তুভ মনি বিরাজমান।তাঁর পরণে পীত বসন,তাঁর অঙ্গকান্তি নিবিড় মেঘের মতো শ্যামল,তারঁ কেশদাম উজ্বল এবং তাঁর মুকুট ও কর্নকুন্ডল বৈদূর্য – মনিচ্ছটায় অস্বাভাবিকভাবে উজ্বল। সেই শিশুটি অত্যন্ত দীপ্তিশালী মেখলা,কেয়ূর,বলয় প্রভৃতি অলঙ্কারে শোভিত।

বসুদেব তাঁর এই অসাধারণ পুত্রকে দর্শন করে নয়নযুগল বিস্ময়ান্বিত হয়েছিল।চিন্ময় আনন্দে মগ্ন হয়ে তিনি মনে মনে ব্রাহ্মণদের দশ হাজার গাভী দান করেছিলেন।তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই শিশুটি কোন প্রাকৃত শিশু নয়,এই শিশুটি হলেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণু।

বসুদেব সেই শিশুটির উদ্দেশ্য প্রণতি নিবেদন করে করজোড়ে স্তব করতে লাগলেন।এরপর দেবকীও ভগবানকে প্রণতি নিবেদন করে স্তব করতে লাগলেন।সে স্তবের শেষের দিকে দেবকী ভগবানকে বলেন যে, হে ভগবান আমি আপনার আবির্ভাবের ফলে কংসের ভয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছি।তাই কংস যাতে বুঝতে না পারে যে,আপনি আমার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছেন,কৃপাপূর্বক আপনি তার উপায় করুন।এরপর দেবকী ভগবানকে তাঁর চতুর্ভুজ শিশুরুপ সংবরন করে মনুষ্যাকার রুপ ধারন করতে অনুরোধ করেন।এর কারন হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন,এরুপ চতুর্ভুজ অদ্ভুত বালক রুপ দর্শন করে লোকেরা বিশ্বাস করতে চাইবে না যে, আপনি আমার গর্ভে আবির্ভুত হয়েছেন। এর ফলে তারা আমাকে উপহাস করবে।

তখন ভগবান দেবকী মাতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, হে সতী,স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে তোমার পূর্বজন্মে তুমি পৃশ্নি নামে জন্মগ্রহণ করেছিলে,এবং বসুদেব ছিল অতি পুণ্যবান প্রজাপতি সুতপা।তোমরা ব্রহ্মার নির্দেশে প্রজা সৃষ্টির জন্য ইন্দ্রিয় সমূহ সংযত করে ১২ হাজার দিব্য বৎসর কঠোর তপস্যা করেছিলে( শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩/৩৬)।তোমাদের কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে আমি তোমাদের সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে, তোমাদেরকে আমার কাছ থেকে বর প্রার্থনা করতে বলেছিলাম।তোমরা তখন আমার মতো পুত্র লাভের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলে।তখন আমি তোমাদের বাসনা পূর্ণ করার জন্য তোমাদের পুত্র পৃশ্নিগর্ভ নামে জন্মগ্রহণ করেছিলাম।

পরবর্তী যুগে তোমরা যখন পুনরায় অদিতি এবং কশ্যপরুপে আবির্ভূত হয়েছিলে,তখন আমি তোমাদের পুত্র উপেন্দ্র এবং বামন নামে বিখ্যাত হয়েছিলাম।হে সতী!সেই আমিই এখন তৃতীয়বার তোমাদের পুত্ররুপে জন্মগ্রহণ করেছি।আমার এই বাক্য সত্য বলে জানবে।

আমার পূর্ব জন্মের কথা স্মরন করানোর জন্যই আমি তোমাদের এই বিষ্ণুরুপ প্রদর্শন করিয়েছি।তা না হলে,আমি যদি একটি নরশিশুরুপে আবির্ভূত হতাম,তবে তোমরা বিশ্বাস করতে না যে,বিষ্ণুরুপে আমি তোমাদের পুত্ররুপে আবির্ভূত হয়েছি।

যুবাং মাং পুত্রভাবেন ব্রহ্মভাবেন চাসকৃৎ।
চিন্তয়ন্তৌ কৃতস্নেহৌ যাস্যেথে মদগতিং পরাম্।।

– শ্রীমদ্ভাগবতঃ১০/৩/৪৫

অনুবাদঃ তোমরা উভয়েই তোমাদের পুত্ররুপে নিরন্তর আমার কথা চিন্তা কর,কিন্তু তোমরা জান যে,আমি ভগবান।এইভাবে স্নেহপূর্বক নিরন্তর আমার চিন্তা করে পরম সিদ্ধি লাভ করবে,অথাৎ ভগবদ্ধাম প্রাপ্ত হবে।

এরপর শ্রীল শুকদেব গৌস্বামী পরীক্ষিৎ মহারাজকে বলতে লাগলেন-

ইত্যুক্ত্বাাসীদ্ধরিস্তূষ্ণীং ভগবানাত্মমায়য়া।
পিত্রোঃ সম্পশ্যতোঃ সদ্যো বভূব প্রাকৃতঃ শিশুঃ।।

-(শ্রীমদ্ভাগবতঃ১০/৩/৪৬)

অনুবাদঃ এইভাবে ভগবান তার পিতা মাতাকে উপদেশ দিয়ে নীরব হয়েছিলেন।তাঁদের সম্মুুখে তিনি তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তির দ্বারা নিজেকে একটি প্রাকৃত শিশুতে রুপান্তরিত করেছিলেন।( অথাৎ,তিনি নিজেকে তাঁর আদি স্বরুপে রুপান্তরিত করেছিলেন – কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম্)

তারপর শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩/৪৭-৫২ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুসারে,”ভগবানের অনুপ্রেরণায় বসুদেব যখন নবজাত শিশুটিকে কোলে নিয়ে কারা সূতিকাগৃহ থেকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছিলেন,ঠিক সেই সময় ভগবানের চিন্ময়ী শক্তি যোগমায়া মাতা দুর্গা নন্দ মহারাজের পত্নীর কন্যারুপে জন্মগ্রহণ করেন।

যোগমায়ার প্রভাবে সমস্ত দ্বাররক্ষীগন গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়েছিল।সূর্যের উদয়ে যেমন অন্ধকার আপনা থেকেই দূর হয়ে যায়,তেমনই শ্রীকৃষ্ণকে কোলে নিয়ে বসুদেব সমাগত হওয়া মাত্রই লৌহ খিলকযুক্ত শৃঙ্খলের দ্বারা আবদ্ধ বিশাল কপাটগুলি আপনা থেকেই উন্মুক্ত হয়েছিল।তখন মেঘ মন্দ মন্দ গর্জন সহকারে বারি বর্ষণ করেছিল বলে ভগবানের অংশ অনন্তশেষনাগ দরজা থেকেই বসুদেব এবং তাঁর চিন্ময় শিশুটিকে সেই বৃষ্টিপাত থেকে রক্ষা করার জন্য তাঁর ফণা বিস্তার করে বসুদেবের অনুগমন করেছিল।

নিরন্তর বর্ষণে যমুনা নদী ভয়ানক হয়ে উঠেছিল।কিন্তু সমুদ্র যেভাবে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে সেতুবন্ধন করতে দিয়ে পথ প্রদান করেছিল,যমুনা নদীও সেইভাবে বসুদেবকে নদী পার হওয়ার পথ প্রদান করেছিল।

নন্দ মহারাজের গৃহে পৌঁছে বসুদেব দেখলেন যে,সমস্ত গোপেরা গভীর নিন্দ্রায় নিদ্রিত।তিনি তখন তাঁর পুত্রটিকে যশোদার শয্যায় স্থাপন করে যোগমায়া রুপিনী তাঁর কন্যাকে গ্রহণপূর্বক পুনরায় কংসের কারাগারে ফিরে এসেছিলেন।

বসুদেব সেই কন্যাটিকে দেবকীর শয্যায় স্থাপন পূর্বক তাঁর পায়ে লৌহশৃঙ্খল বন্ধন করে পূর্বের মতো আবদ্ধভাবে অবস্থান করলেন।

এদিকে পরিশ্রান্তা যশোদাদেবী গভীর নিন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়েছিলেন এবং তাই তিনি বুঝতে পারেননি যে তাঁর পুত্র হয়েছিল,না কন্যা হয়েছিল।”- ভাগবত১০/৩/৫৩

শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৪/২ – ১৪ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ী, “এদিকে প্রহরীরা নবজাত শিশুর ক্রন্দন শুনতে পেয়ে জেগে উঠেছিল।সাথে সাথে দেবকীর সন্তান জন্মদানের সংবাদ প্রহরীগণ কংসকে জানান।কংস তখন অতি শীঘ্র তার শয্যা থেকে উক্তিত হয়ে চিন্তা করেছিল,”এটি হচ্ছে কাল যে আমাকে বধ করার জন্য জন্মগ্রহণ করেছে, এভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে কংস সুতিকা গৃহে উপস্থিত হয়েছিল।

অসহায় দেবকী কাতর ভাবে কংসের কাছে আবেদন করেছিল, হে ভ্রাতাঃ তোমার কল্যাণ হোক, এই কন্যাটিকে হত্যা করো না,স্ত্রী হত্যা করা তোমার উচিত নয়। এভাবে প্রার্থনা করলেও কংসের মনের পরিবর্তন হয় নি।পরন্তু কংস দেবকীকে ভর্ষণা করে তার হাত থেকে কন্যাটিকে বলপূর্বক ছিনিয়ে নিয়েছিল। সেই তখন সদ্যোজাতা ভগিনীকে যুগলে তার পায়ের তলায় ধারণ করে সবলে শিলাপৃষ্টে নিক্ষেপ করেছিল। সেই কন্যাটি অর্থাৎ ভগবান শ্রীবিষ্ণুর কনিষ্ঠ ভগ্নি যোগমায়া দেবী দুর্গা কংসের হাত থেকে উর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হয়ে আকাশে অস্ত্র যুক্ত অষ্ট মহাভুজা দুর্গা দেবীরুপে প্রকাশিত হয়েছিল।

তখন দুর্গা দেবী কংসকে বলেছিল,ওরে মূর্খ কংস!আমাকে বধ করে তোর কি লাভ হবে? তোর চিরশত্রু ভগবান যিনি অবশ্যই তোকে বধ করবেন তিনি ইতিমধ্যেই অন্যত্র জন্মগ্রহণ করেছেন। অতএব নিরর্থক দীন শিশুদের হত্যা করিস না।

কংসকে এই কথা বলে,মাতা দুর্গা বা যোগ মায়া বারাণসী প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে অন্নপূর্ণা, দুর্গা, কালী,ভদ্রা আদি বিবিধ নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। মাতা দুর্গা দেবীর সে বাণী শ্রবণ করে কংস অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছিল। সে তখন তার ভগ্নি, ভগ্নিপতি বসুদেবকে বন্ধন মুক্ত করে দিয়েছিল।”

পরিশেষে ভগবদগীতা ৪/৬-৯ নং শ্লোক অনুযায়ী, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যদিও অজ বা জন্মহীন, তথাপি দুষ্টের দমন, সাধুর রক্ষা এবং ধর্ম সংস্থাপন করার জন্য তিনি যুগে যুগে কূর্ম,বরাহ,নৃসিংহ,রাম,
বলরাম ইত্যাদি নানা অবতার রুপে আবির্ভুত হন।সে সে অবতারে ভগবানের জন্ম ও তার কর্ম দিব্য বা অপ্রাকৃত বা চিন্ময়। যিনি তা জানেন তাকে পুনরায় এ জড় জগতে জন্মগ্রহণ করতে হয় না।তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্য চিন্ময় গোলক বৃন্দাবন ধাম প্রাপ্ত হন।

হরে কৃষ্ণ।প্রনাম

Sadgun Madhav Dash

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments