শ্রীকৃষ্ণ কে ? মত্যলোকে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব বা দিব্য জন্মলীলা সম্পর্কে আলোচনা করুন।(১ম পর্ব)

শ্রীকৃষ্ণঃ

বেদ/শ্রুতি, স্মৃতি,মহাভারত,শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ব্রহ্মসংহিতা,শ্রীমদ্ভাগবত সহ অষ্টাদশ পুরান ইত্যাদি সনাতনী শাস্ত্র অনুসারে, শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরমেশ্বর ভগবান।তার নিত্য নিবাস চিন্ময় জগতের গোলক বৃন্দাবন ধাম।তিনি নিজেকে বিষ্ণুরুপে প্রকাশ করেন।

           গোলোক এব নিবসত্যখিলাত্মভূতো

গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।।৩৭।।

-( ব্রহ্মসংহিতা ৫/৩৭, ব্রহ্মা)

অনুবাদঃ অখিলাত্মভূত শ্রীগোবিন্দ নিত্য স্বীয় গোলোকধামে বাস করেন, সেই আদিপুরুষকে আমি ভজনা করি।।৩৭।।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৪/৬-৯ নং শ্লোকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “পরমেশ্বর ভগবানরুপে যদিও আমি অজ বা জন্মহীন, তথাপি দুষ্টের দমন, সাধুর রক্ষা এবং ধর্ম সংস্থাপন করার জন্য আমি যুগে যুগে আবির্ভুত হই(সম্ভবামি)।” ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এরুপ আবির্ভাবকে দিব্য জন্ম বলা হয়(গীতা৪/৯)।শ্রী জগদীশ চন্দ্র ঘোষ কৃত শ্রীগীতা গ্রন্থে ” দিব্য” বা চিন্ময় বা অপ্রাকৃত শব্দের  অর্থ করা হয়েছে, ” প্রাকৃতজনের জন্ম হয় কর্মফলে, কিন্তু ভগবানের জন্ম হয় স্ব ইচ্ছায়। প্রাকৃত জনের ন্যায় ভগবানের গর্ভাদি ক্লেশ নাই।”

অথাৎ এরুপ জন্ম এ পৃথিবীতে কোন দেহধারী জীবের পক্ষে সম্ভব নয়।কেননা  কোন দেহধারী জীব তাঁর স্বইচ্ছায় কোন মাতৃজঠরে প্রবেশ এবং সেখান থেকে বের হতে পারেন না।কিন্তু পরমেশ্বর ভগবানরুপে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর স্বইচ্ছার প্রভাবে কোন মাতৃগর্ভে প্রবেশ করে যথাসময়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারেন।ভগবানের এরুপ আবির্ভাবে দেহধারী জীবের মতো মাতৃগর্ভে কোনপ্রকার ক্লেশ বা যন্ত্রনা পেতে হয় না।

অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন্ ।
প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া ।।৬।।
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ।।৭।।
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।৮।।
জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ।
ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন।।৯।।

-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণঃগীতা৪/৬-৯)

অনুবাদঃ যদিও আমি(শ্রীকৃষ্ণ) জন্মরহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময় রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই। হে ভারত ! যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যূত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই।সাধুদের পরিত্রাণ করার জন্য এবং দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।হে অর্জুন! ‍আমার জন্ম ও কর্ম দিব্য (চিন্ময়/অপ্রাকৃত)।যিনি যথাযথভাবে তা জানেন, তাঁকে আর দেহত্যাগ করার পর পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না, তিনি আমাকে অথাৎ আমার নিত্য ধাম গোলক বৃন্দাবন লাভ করেন।

গীতা ৪/৯ নং শ্লোকে বর্ণিত” দিব্য” বা চিন্ময় বা অপ্রাকৃত শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যার অর্থ হল প্রাকৃতজনের জন্ম হয় কর্মফলে, কিন্তু ভগবানের জন্ম হয় স্ব ইচ্ছায়। প্রাকৃত জনের ন্যায় ভগবানের গর্ভাদি ক্লেশ নাই।

 মত্যলোকে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব  বা দিব্য জন্মলীলাঃ

শ্রীমদ্ভাগবত পুরান শাস্ত্রের দশম স্কন্দের ১ম -৪র্থ অধ্যায় পর্যন্ত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত আবির্ভাব বা জন্মলীলা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

শ্রীমদ্ভাগবত ১০/১/১৭-৬৬ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুসারে,”পরীক্ষিৎ মহারাজ যদুবংশে জন্মগ্রহণ কারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত মহিমা শ্রবণ করতে ইচ্ছা করলে ভগবানের শক্ত্যাবেশ অবতার ব্যাসদেব তনয় শ্রীল শুকদেব গৌস্বামী বলেন যে, “দ্বাপর যুগের শেষ ভাগে মাতা বসুন্ধরা পাপীর পাপের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। মাতা বসুন্ধরা তখন গো- রূপ ধারণ করে ক্রন্দন করতে করতে ব্রহ্মার সম্মুখীন হয়ে তার দুর্ভাগ্যের কথা নিবেদন করেন। তারপর মাতা ধরিত্রীর দুঃখের কথা শ্রবণ করে ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতাগণ সহ মাতা ধরিত্রীকে নিয়ে ক্ষীর সমুদ্রের তীরে গমন করেছিলেন । সেখানে দেবতারা ক্ষীরোধকশায়ী বিষ্ণুকে পুরুষ সুক্তের মাধ্যমে উপাসনা করেছিলেন।

সে সময় ব্রহ্মা সমাধি মগ্ন অবস্থায় আকাশে ধ্বনিত ভগবান শ্রীবিষ্ণুর বাণী শ্রবন করে দেবতাদের বলেছিলেন, “হে দেবগন,আমরা ভগবানকে নিবেদন করার পূর্বেই ভগবান পৃথিবীর কষ্ট অবগত ছিলেন। তাই ভগবান যতদিন তার কাল শক্তির দ্বারা পৃথিবীর ভার হরণ করার জন্য পৃথিবীতে বিচরণ করবেন ততদিন তোমরা তার পুত্র ও পৌত্ররুপে যদু বংশে অবতীর্ণ হও। সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং বসুদেবের পুত্ররুপে আবির্ভূত হবেন।অতএব হে দেবপত্নিগন ভগবানের প্রসন্নতা বিধানের জন্য সেখানে জন্মগ্রহণ করুন।ভগবানের অংশ সঙ্কর্ষণ,তিনি ভগবানের আবির্ভাবের পূ্র্বে আবির্ভূত হবেন।এইভাবে দেবতাদের উপদেশ প্রদান করে এবং বসুন্ধরা মাতাকে আশ্বস্ত করে ব্রহ্মা ব্রহ্মলোকে প্রত্যাবর্তন করেন।

কিছুকাল পর,দেববংশীয় ( অথবা শূরবংশীয়)
বসুদেব দেবকীকে বিবাহ করে তার নববিবাহিত পত্নীসহ গৃহে প্রত্যাবর্তন করার জন্য রথে আরোহন করেছিলেন। কংস তখন সে রথের সারথি( চালক) হয়েছিলেন।

পথি প্রগ্রহিণং কংসমাভাষ্যাহাশরীরবাক।
অস্যাস্ত্বামষ্টমো গর্ভো হন্তা যাং বহসেহবুধ।।

– শ্রীমদ্ভাগবত ১০/১/৩৪

অনুবাদঃ কংস যখন অশ্বের রজ্জু( দঁড়ি) গ্রহণ করে রথ চালনা করছিল,তখন পথের মধ্যে তাকে সম্বোধন করে একটি দৈববাণী হয়েছিল,”ওরে মূর্খ! তুই যাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছিস, তার অষ্টম সন্তান তোকে হত্যা করবে।

সে দৈব বাণী শ্রবন করে তৎক্ষনাৎ কংস বাম হাত দ্বারা দেবকীর কেশ ধারন করে খড়গ উত্তোলন করে তার মস্তক ছেদন করতে উদ্যত হয়েছিল।কংসের এরুপ উগ্র কর্ম দর্শন করে বসুদেব কংসকে বলেছিলেন,আপনি ভোজবংশের গৌরব।আপনার মতো একজন গুনবান ব্যাক্তি কিভাবে বিবাহ উৎসবে তার ভগ্নি এক অবলা স্ত্রীকে হত্যা করতে পারে?

বসুদেব যখন দেখলেন,কংস তার ভগ্নীকে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর,তখন বসুদেব কংসের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন, আপনার ভয়ের কোন কারন নাই,দেবকীর যত সন্তান জন্ম হবে, জন্ম হওয়ার সাথে সাথে আপনাকে তা দিয়ে দিব।বসুদেবের মুখে এরুপ কথা শ্রবণ করে,বসুদেব ভগ্নিবধ থেকে নিবৃত্ত হন।এরপর বসুদেব ও দেবকীসহ নিজ গৃহে ফিরে আসেন।

এরপর বসুদেব তার প্রথম পুত্রটি জন্ম হওয়ার পর প্রতিজ্ঞা অনুসারে কংসের কাছে প্রদান করেন।বসুদেবের এরুপ আচরনে কংস খুশি হন,বসুদেবকে বলেন যে তোমার অষ্টম পুত্রের দ্বারা আমার মৃত্যু নির্দিষ্ট রয়েছে। সুতারাং তোমার এই শিশুটিকে নিয়ে তুমি ঘরে ফিরে যাও। কংসের এরূপ কথা শুনে বসুদেব ঘরে ফিরে গেলেন।

একসময় ভক্ত প্রবর নারদ কংসের কাছে গিয়ে বলেছিলেন কিভাবে পৃথিবীর ভারস্বরূপ অসুররা নিহত হবে। তার ফলে কংস অত্যন্ত ভীত এবং সংশয়াচ্ছন্ন হয়েছিল। নারদ চলে যাওয়ার পর কংস দেবকীর গর্ভসম্ভূত সন্তানদের তার মৃত্যুর কারণ বিষ্ণু বলে মনে করে দেবকী এবং বসুদেবকে বন্দী করে শৃঙ্খলাবন্ধ করেছিল। বিষ্ণু তাকে হত্যা করবেন সেই ভবিষ্যদ্বাণী শুনে, কংস দেবকীর একের পর এক ছয়টি পুত্রকে বিষ্ণু বলে মনে করে হত্যা করেছিল।”

শ্রীমদ্ভাগবত ১০/২/৮- ৪২ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুসারে, “এদিকে ভগবান বিষ্ণু যোগমায়া দূর্গাকে নির্দেশ দেন,

 দেবক্যা জঠরে গর্ভং শেষাখ্যং ধাম মামকম্।
তৎ সন্নিকৃষ্য রোহিণ্যাং৷ উদরে সন্নিবেশয়।।
অথাহমংশভাগেন দেবক্যাঃ পুত্রতাং শুভে।
প্রাপ্স্যামি ত্বং যশোদায়াং নন্দপত্ন্যাং ভবিষ্যসি।।

শ্রীমদ্ভাগবত ১০/২/৮-৯

অনুবাদঃ দেবকীর গর্ভে সঙ্কর্ষণ বা শেষ নামক আমার অংশ বিরাজ করছেন, অক্লেশে তাকে রোহিনীর গর্ভে স্থানান্তরিত করো। এই সর্বমঙ্গল যোগমায়া!তখন আমি আমার পূর্ণ ষড়ৈশ্বর্য সহ দেবকীর পুত্ররুপে আবির্ভূত হব এবং তুমি নন্দ মহারাজের মহারানী মা যশোদার কন্যা রুপে আবির্ভূত হবে।

ভগবানের দ্বারা এইভাবে আদিষ্ট হয়ে, যোগমায়া মাতা দূর্গা সে অনুযায়ী কার্য সম্পাদন করেছিলেন।

এরপর-

ভগবানপি বিশ্বাত্মা ভক্তানামভয়ঙ্করঃ।
আবিবেশাংশভাগেন মন আনকদুন্দুভে।।

-শ্রীমদ্ভাগবতঃ১০/২/১৬

অনুবাদঃ সমস্ত জীবের পরমাত্মা এবং ভক্তদের সমস্ত ভয় বিনাশকারী ভগবান তাঁর সমস্ত ঐশ্বর্য সহ বসুদেবের চিত্তে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

ততো জগন্মঙ্গলমচ্যুতাংশং
সমাহিতং শূরসুতেন দেবী।

শ্রীমদ্ভাগবতঃ১০/২/১৮

অনুবাদঃ সমস্ত জগতের মঙ্গল বিধানকারী ভগবান তাঁর অংশ সহ বসুদেবের চিত্ত থেকে দেবকীর চিত্তে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন।

এরপর দেবকীর অন্তরে ভগবান বিরাজমান থাকায় দেবকীকে আনন্দময়, শুদ্ধ এবং হাস্যোজ্বল দর্শন করে কংস মনে মনে বিচার করলেন আমার প্রাণনাশক প্রবেশ করেছেন। কারণ পূর্বে দেবকী কখনো এরকম আনন্দময়ী এবং প্রভাবতী ছিল না। তাই কংস ভেবেছিল এখন আমার কি করা কর্তব্য? ভগবান তো তার বিক্রম পরিত্যাগ করবেন না।দেবকী একজন স্ত্রী, সে আমার ভগ্নী এবং অধিকিন্তু সে গর্ভবতী। আমি যদি তাকে বধ করি,তাহলে আমার যশ,ঐশ্বর্য, আয়ু নিশ্চিতরুপে বিনষ্ঠ হবে।এভাবে বিচার করে কংস ভগবানের প্রতি বৈরীভাব পোষণ করতে বদ্ধপরিকর হওয়া সত্ত্বেও ভগ্নীবধরুপ জঘন্য কার্য থেকে বিরত হয়েছিল।সে স্থির করেছিল যে,ভগবানের জন্ম হওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করবে এবং তারপর যা করনীয় তা করবে।

এরপর থেকে কংস সিংহাসনে অথবা তার ঘরে উপবেশন করার সময়, শয্যায় শয়ন করার সময়, ভোজন করার সময়, অথবা বিচরণ করার সময়, সর্বদায় ভগবান ঋষিকেশকে(বিষ্ণু) কেবল দর্শন করেছিল।

এদিকে ভগবান দেবকীর হৃদয় থেকে গর্ভে আবির্ভুত হয়েছেন তা জানতে পেরে..

ব্রহ্মা ভবশ্চ তত্রেত্য মুনিভির্নারদাদিভিঃ।
দেবৈঃ সানুচরৈঃ সাকং গীর্ভিবৃষণমৈড়য়ন।।

(শ্রীমদ্ভাগবত-১০/২/২৫)

অনুবাদঃ ব্রহ্মা,শিব(ভব), নারদ আদি মুনিগন সহ দেবতা এবং তাদের অনুচরগণসহ ভগবানের প্রসন্নতা বিধানের জন্য স্তব করতে লাগলেন।

স্তব সমাপ্ত হলে সমস্ত দেবগন ব্রহ্মা ও শিবকে অগ্রভাগে রেখে স্বর্গলোকে ফিরে গিয়েছিলে।(পরবর্তী অংশ ২য় পর্বে দ্রষ্টব্য) 

হরে কৃষ্ণ। প্রনাম

 

Sadgun Madhav Dash

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments