সরস্বতী দেবীঃ
সরস্বতী দেবী হলেন বিষ্ণুপত্নি।তাঁকে বিদ্যা ও বুদ্ধির দেবী বলা হয়।তিনি চিন্ময় জগতের গোলক বৃন্দাবনে পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন।তাঁর চারটি হস্ত।চারহস্তের মধ্যে দুই হস্তে মাতা সরস্বতী বীণাবাদনে রত,আর এক হস্তে পুস্তক শোভমান এবং অন্য হস্তে জপমালা।
মাতা সরস্বতীর আবির্ভাবঃ
বেদ, পুরাণ,মহাভারত, রামায়ন সহ সমগ্র সনাতনী শাস্ত্রে অম্বি বা মাতা,নদী,এবং দেবীরুপে মাতা সরস্বতীর মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবতে সরস্বতী মাতাকে প্রণতি নিবেদন করে বক্তা শ্রীল সূত গৌস্বামী শৌনকাদি ঋষিদের প্রশ্নের উত্তররুপ শ্রীমদ্ভাগবতের জ্ঞান প্রদান শুরু করেন…
নারায়ণং নমস্কৃত্য নরং চৈব নরোত্তমম্।
দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদীরয়েৎ ।। ৪ ৷৷
-(শ্রীমদ্ভাগবত ১/২/৪)
অনুবাদঃ সংসার-বিজয়ী গ্রন্থ শ্রীমদ্ভাগবত উচ্চারণ করার পূর্বে পরমেশ্বর ভগবান নারায়ণ, সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ নর-নারায়ণ ঋষি নামক ভগবৎ-অবতার, বিদ্যাদেবী সরস্বতী এবং ব্যাসদেবকে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।
সমগ্র সনাতনী শাস্ত্রে বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী মাতা সরস্বতীর চিন্ময় জগত এবং জড় জগত এই দুই স্থানে আবির্ভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। চিন্ময় জগতে মাতা সরস্বতী পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের মুখ অথাৎ জিহ্বা থেকে আবির্ভূত হন।এবং জড় জগতে নদীরুপে, ব্রহ্মার পত্মিরুপে (প্রকৃত সরস্বতীর অংশ প্রকাশ)আবির্ভূত হয়েছিলেন ।নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হল…
১/চিন্ময় জগতে সরস্বতী দেবীর আবির্ভাবঃ
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ শাস্ত্র অনুসারে চিন্ময় জগত গোলক বৃন্দাবন ধামে পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে মাতা সরস্বতী আবির্ভূত হন।
আবির্ব্বভূব তৎপশ্চান্মুখতঃ পরমাত্মনঃ।
একা দেবী শুক্লবর্ণা বাণী পুস্তকধারিণী ॥ ৫৩
কোটিপূর্ণেন্দুশোভাঢ্যা শরৎপঞ্চজলোচনা।
বহ্নিশুদ্ধাংশুকাধানা রত্বভূষণভূষিতা ॥ ৫৪
সম্মিতা সুদতী শ্যামা সুন্দরীনাঞ্চ সুন্দরী।
স্রষ্ট্রী শ্রুতীনাং শাস্ত্রাণাং বিদুষাম জননী পরা ॥৫০
বাগধিষ্ঠাতৃদেবী সা কবীনামিষ্টদেবতা।
শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপা চ শান্তরূপা সরস্বতী ॥ ৫৬
গোবিন্দপুরতঃ স্থিত্বা জগৌ প্রথমতঃ সুখম।
তন্নামগুণকীর্ত্তিশ্চ বীণয়া সা ননর্ত্ত চ॥ ৫৭
-(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণঃ ব্রহ্মখন্ড,৩/৫৩-৫৮)
অনুবাদঃ তারপর পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের মুখ হতে বীণাপুস্তকধারিণী শুক্লবর্ণা এক দেবী অবির্ভূত হন। তাঁর সৌন্দর্য্য কোটিপূর্ণচন্দ্রের সদৃশ, এবং চক্ষুদ্বয় শরৎকালীন পদ্মপুষ্প তুল্য। তিনি রত্বভূষণে ভূষিতা। তাঁর পরিধান অগ্নির ন্যায় বিশুদ্ধ, তিনি সুন্দরীদিগের মধ্যে অতিশয় সুন্দরী ও ঈষৎ হাস্য- বিশিষ্টা। তাঁর দন্তপক্তি অতি সুন্দর এবং অঙ্গসকল গ্রীষ্মে সুখশীতল ও শীতসময়ে সুখোঞ্চ। তিনি শ্রুতি(বেদ) ও অন্যান্য শাস্ত্র এবং জ্ঞানীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। সেই শান্তরূপা শুদ্ধসত্ত্ব-স্বরূপা জগদ্ধাত্রী দেবতাই কবিদিগের ইষ্টদেবতা এবং যিনি সরস্বতী নামে প্রসিদ্ধ। সেই সরস্বতী দেবী প্রথমেই গোবিন্দের(শ্রীকৃষ্ণ) সম্মুখবর্তিনী হয়ে বীণাবাদনপূর্ব্বক সুখে তাঁর নাম, গুণ ও কীর্তি গান করতে লাগলেন।
২/ জড় জগতে সরস্বতীর আবির্ভাবঃ
মহাগঙ্গা, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী মহাবৈকুন্ঠে ভগবান শ্রীবিষ্ণু নারায়ণের নিত্য পত্নী। একবার দৈবযোগে গঙ্গা ও সরস্বতীর মধ্যে বাকবিতন্ডা হলে গঙ্গা সরস্বতীকে অভিশাপ দেন তিনি যেন ভূভাগে পতিত হন।এ অবস্থায় ভগবান নারায়ণ বিধান দেন যে মহাসরস্বতী মহাবৈকুণ্ঠেই নিত্য বিরাজিতা থাকবে। কিন্তু জড়জগতে তাঁর একটি অংশ সাবিত্রী বা বাকনাম্নীরুপে ব্রহ্মার পত্নী হয়ে বিরাজ করবে ও অন্যটি নদীরুপে পতিত হবে।এরপর পরমেশ্বর বিষ্ণুর বিধান অনুসারে সরস্বতীর একটি অংশ জড় জগতের পৃথিবীতে সরস্বতী নদীরুপে প্রকাশমান হয় এবং ব্রহ্মার পত্নিরুপে ব্রহ্মার শরীর থেকে আবির্ভূত হন।
পূর্বোক্ত আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল,সরস্বতী সরাসরি ব্রহ্মার পত্নী নন বরং তাঁর অংশ বাক বা সাবিত্রীই ব্রহ্মার পত্নী। স্বয়ং সরস্বতী বরং ব্রহ্মার দীক্ষাগুরু। এছাড়াও কোনো কোনো কল্পে যখন ব্রহ্মার নির্দিষ্ট আয়ুষ্কালের পূর্বেই মৃত্যু হয় তখন বিষ্ণুই ব্রহ্মারুপে অবতীর্ণ হন এবং তাঁর কার্য সম্পাদন করতে ও তখন সেই অর্থে সরস্বতী ব্রহ্মার সরাসরি পত্নী হন।
শ্রীমদ্ভাগবত ৩/১২/২৮-৩৪ শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ী,নারীর মোহময়ীরুপ এতই আকর্ষণীয় যা জ্ঞানী এবং সাধু ব্যক্তির মনকেও জোরপূর্বক বিষয় মুখে প্রবিষ্ট করতে পারে।তাই সাধু এবং জ্ঞানী ব্যক্তির কর্তব্য সর্বদা একাকী অবস্থান না করে সাধুসঙ্গে অবস্থান করা,এ বিশেষ একটি শিক্ষা জড় জগতের বদ্ধ জীবদের বাস্তবে প্রদান করার জন্য চিন্ময় জগতের বিষ্ণুপত্নি সরস্বতী পূর্ব দৈববিধান অনুসারে তাঁর একটি অংশরুপে কোন এক কল্পে ব্রহ্মার শরীর থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ( পুরাণ অনুসারে, কল্প মানে ব্রহ্মার ১ দিন ও রাত্রিকে বুঝানো হয়। প্রতি কল্পান্তে ব্রহ্মার মৃত্যু হয় এবং নতুন কল্প শুরু হয়,তখন ব্রহ্মা বিষ্ণুর নাভিকমল থেকে আবির্ভূত হন। ব্রহ্মার এক দিনে ১৪ জন মনু রাজত্ব করেন।)।
এ বিষয়ে লক্ষনীয় বিষয় হল ব্রহ্মার মতো মহাত্মা, যিনি চতুঃষ্কুমার, নারদ,মরীচি প্রমুখ ঋষিগণের পিতা, তিনি কখনো মায়ার প্রলোভনে আকৃষ্ট হতে পারেন না।তথাপি দৈববিধান অনুসারে জড় জগতের বদ্ধ জীবদের শিক্ষা প্রদান করার জন্য তিনি তাঁরই শরীর থেকে সৃষ্ট সরস্বতীর একটি অংশ সাবিত্রী বা বাকনাম্নীর দেহসৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং তাঁর প্রতি কামে উন্মত্ত হয়ে তাঁকে অভিলাষ করেছিলেন।তখন মরীচি প্রমুখ ব্রহ্মার পুত্রেরা এইভাবে তাঁদের পিতাকে বিভ্রান্ত হয়ে অনৈতিক আচরন করতে দেখে,গভীর শ্রদ্ধা সহকারে তাঁকে বুঝানোর চেষ্টা করছিলেন।
এরপর ব্রহ্মা তাঁর মরীচি প্রমুখ পুত্রদের কথা শ্রবণ করে অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছিলেন এবং তৎক্ষণাৎ তিনি তাঁর শরীর ত্যাগ করেছিলেন।কোন এক সময় যখন ব্রহ্মা চিন্তা করছিলেন,কিভাবে তিনি বিগত কল্পের মতো বিশ্ব সৃষ্টি করবেন,তখন তাঁর চার মুখ থেকে বিবিধ জ্ঞান সমন্বিত চতুর্বেদ প্রকাশিত হয়েছিল। “
হরে কৃষ্ণ।জয় মা স্বরস্বতী
স্বধর্মম: Connect to the inner self.
 
								 
															 
					 
					 
					 
					 
					 
															 
															 Views Today : 204
 Views Today : 204 Total views : 119085
 Total views : 119085 Who's Online : 0
 Who's Online : 0 Your IP Address : 216.73.216.53
 Your IP Address : 216.73.216.53