গুরুদেব কে?
যিনি অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলো প্রদান করে আমাদের চক্ষু উন্মোচিত করেন তিনিই গুরুদেব। গুরুদেব পরমতত্ত্ব পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি। গুরুদেব ভগবানের মতোই পূজনীয় কিন্তু তিনি ভগবান নন।
গুরুদেব নির্বাচন প্রত্যেক মনুষ্য জীবের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মনুষ্য জীবন অত্যান্ত দূর্লভ। জীবাত্মা অনেক ভাগ্যের ফলে মানুষ্য শরীর প্রাপ্ত হয়।
এ সম্পর্কে শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে –
নৃদেহমাদ্যং সুলভং সুদুর্লভং প্লবং সুকল্পং গুরুকর্ণধারম্।
ময়ানুকূলেন নভস্বতেরিতং পুমান্ ভবান্ধিং ন তরেৎ স আত্মহা।।
[ শ্রীমদ্ভাগবত ১১।২০।১৭ ]
বঙ্গানুবাদ:
জীবনের সর্ব কল্যাণপ্রদ অত্যন্ত দুর্লভ মনুষ্য দেহ, প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে আপনা থেকেই লাভ হয়ে থাকে। এই মনুষ্যদেহকে অত্যন্ত সুষ্ঠুরূপে নির্মিত একখানি নৌকার সঙ্গে তুলনা করা যায়, যেখানে শ্রীগুরুদেব রয়েছেন কাণ্ডারীরূপে এবং পরমেশ্বর ভগবানের উপদেশাবলীরূপ বায়ু তাকে চলতে সহায়তা করছে, এই সমস্ত সুবিধা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি তার মনুষ্য জীবনকে ভবসমুদ্র থেকে উত্তীর্ণ হতে উপযোগ না করে, তাকে অবশ্যই আত্মঘাতী বলে মনে করতে হবে।
অর্থাৎ এই দূর্লভ মনুষ্য দেহ নৌকা স্বরুপ আর গুরুদেব সেই নৌকার কাণ্ডারী। জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্যে সফল হতে হলে, প্রত্যেক মনুষ্য জীবের অবশ্যই সদ্গুরুদেবের শরণাপন্ন হতে হবে। তাই সদ্গুরুদেব নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
.
সদ্গুরুদেবের লক্ষণ কি?
সদ্গুরুদেবের লক্ষণ সমন্ধে অথর্ববেদীয় মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে-
তদ্বিজ্ঞানার্থং স গুরুম্ এবাভিগচ্ছেৎ।
সমিত পাণিঃ শ্রোত্রিয়ম্ ব্রহ্মনিষ্ঠম্।।
[ মুণ্ডক উপনিষদ ১।২।১২ ]
বঙ্গানুবাদ:
গুরুদেব হবেন বৈদিক জ্ঞান সম্পন্ন এবং ব্রহ্মনিষ্ঠম্ অর্থাৎ পরম-পুরুষোত্তম ভগবানের সেবায় নিষ্ঠাবান, পরম সত্যের প্রতি সুদৃঢ় ভক্তিযুক্ত।
বিশ্লেষণ:
শ্রীকৃষ্ণই পরমব্রহ্ম যে কথা অর্জুন গীতায় (১০/১২) তে বলেছেন,“পরং ব্রহ্ম অর্থাৎ তুমিই পরমব্রহ্ম” এবং শ্রীমদ্ভাগবতে (১/২/১১) তে বলা হয়েছে, “ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগবানিতি শব্দতে, অর্থাৎ সেই পরমতত্ত্ব শ্রীকৃষ্ণকেই মানুষ ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান বলে থাকে”। তাই এই মন্ত্রে ব্রহ্মনিষ্ঠম্ বলতে যিনি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় অনুরক্ত তাকেই বুঝতে হবে।
.
এ সম্পর্কে শ্রীমদ্ভাগবতে আরো বলা হয়েছে-
তস্মাদ্ গুরুং প্রপদ্যেত জিজ্ঞাসুঃ শ্রেয় উত্তমম্ ।
শাব্দে পরে চ নিষ্ণাতং ব্রহ্মণ্যুপশমাশ্রয়ম্ ।।
[ শ্রীমদ্ভাগবত ১১।৩।২১ ]
বঙ্গানুবাদ:
যথার্থ সুখশান্তি এবং কল্যাণ আহরণে পরম আগ্রহী যেকোনো ব্যক্তিকে সদগুরুর আশ্রয় গ্রহণ এবং দীক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে তাঁর কাছে আত্মনিবেদন করতেই হবে। সদগুরুর যোগ্যতা হলো এই যে, গভীরভাবে অনুধ্যানের মাধ্যমে তিনি শাস্ত্রাদির সিদ্ধান্ত উপলব্ধি করেছেন এবং অন্য সকলকেও সেসব সিদ্ধান্ত সম্পর্কে দৃঢ়বিশ্বাসী করে তুলতে সক্ষম। এ ধরনের মহাপুরুষ, যিনি পরমেশ্বর ভগবানের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন এবং সকল জাগতিক বিচার-বিবেচনা বর্জন করেছেন, তাকেই যথার্থ পারমার্থিক সদগুরুরূপে বিবেচনা করা উচিত।
.
এ সম্পর্কে পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে –
ষটকর্ম নিপুণ বিপ্র মন্ত্র তন্ত্র বিশারদঃ।
অবৈষ্ণবঃ গুরু ন স্যাৎ বৈষ্ণবঃ শ্বপচঃ গুরু।।
বঙ্গানুবাদ:
কোন ব্রাহ্মণ যদি ব্রাহ্মণের ছয়টি কর্মে নিপুন হয় এবং মন্ত্রতন্ত্রে বিশারদও হয়, কিন্তু সে যদি কৃষ্ণভক্ত না হয়, তাহলে সে গুরু হতে পারে না। পক্ষান্তরে চন্ডাল কুলে উদ্ভুত ব্যক্তিও যদি শুদ্ধ কৃষ্ণ ভক্ত হয় তাহলে সেই গুরু হতে পারে।
.
সদ্গুরু-কে এ সম্পর্কে পদ্মপুরাণে প্রভু সদাশিব বলেছেন-
বিমৎসরঃ কৃষ্ণে ভক্তোহনন্য প্রয়োজনঃ।
অনন্যসাধনঃ শ্রীমান্ ক্রোধলোভবিবর্জিতঃ।।
শ্রীকৃষ্ণরসতত্ত্বজ্ঞঃ কৃষ্ণমন্ত্রবিদাংবরঃ।
কৃষ্ণমন্তাশ্রয়ো নিত্যং মন্ত্রতক্তঃ সদা শুচিঃ॥
সদ্ধৰ্ম্মশাসকো নিত্যং সদাচারনিয়োজকঃ।
সম্প্রদায়ী কৃপাপূর্ণো বিরাগী গুরুরুচ্যতে ॥
[ পদ্মপুরাণ, পাতালখণ্ড, ৫১।৬-৮ ]
বঙ্গানুবাদ:
যিনি শান্ত, মাৎসর্য্য-বিহীন, ও কৃষ্ণভক্ত, কৃষ্ণোপাসনা ভিন্ন যাঁহার অন্য প্রয়োজন নাই, কৃষ্ণের অনুগ্রহ ভিন্ন যাঁহার দিন অন্য প্রয়োজন নাই অর্থাৎ কৃষ্ণের অনুগ্রহকেই যিনি সংসার-মুক্তির একমাত্র উপায় স্থির করিয়াছেন, যাঁহাতে ক্রোধ বা লোভের লেশমাত্র নাই, যিনি শ্রীকৃষ্ণরসতত্ত্বজ্ঞ এবং কৃষ্ণমন্ত্রজ্ঞদিগের অগ্রগণ্য, যিনি কৃষ্ণমন্ত্র আশ্রয় করিয়া সর্বদা সেই মন্ত্রে ভক্তিমান্ হইয়া পবিত্রভাবে কালযাপন করেন, সদ্ধর্ম্মের উপদেশ প্রদান করেন, সর্বদা সদাচারে নিযুক্ত থাকেন, যিনি তা এইরূপে বৈষ্ণবসম্প্রদায়ভুক্ত দয়ালু ও সংসার-বিরাগী, তিনিই গুরুপদবাচ্য।
.
সেই একই সিদ্ধান্ত শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে উল্লেখ রয়েছে-
কিবা বিপ্র, কিবা ন্যাসী, শূদ্র কেনে নয় ।
যেই কৃষ্ণতত্ত্ববেত্তা, সেই ‘গুরু’ হয় ।।
[ চৈতন্যচরিতামৃত, মধ্য ৮।১২৮ ]
বঙ্গানুবাদ:
যিনি কৃষ্ণ-তত্ত্ববেত্তা তিনিই গুরু, তা তিনি ব্রাহ্মণ হোন, কিংবা সন্ন্যাসীই হোন অথবা শূদ্রই হোন, তাতে কিছুই যায় আসে না।
.
শ্রীল রূপগোস্বামী উপদেশামৃতে এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন –
বাচোবেগং মনসঃ ক্রোধবেগং জিহ্বাবেগমুদরোপস্থবেগম্।
এতান বেগান যো বিষহেত ধীর সর্বামপীমাং পৃথিবীং সশিষ্যাৎ।।
বঙ্গানুবাদ:
যে ব্যক্তি বাক্যের বেগ, ক্রোধের বেগ, জিহ্বার বেগ, মনের বেগ, উদর এবং উপস্থের বেগ, এই ছয়টি বেগ দমন করতে সমর্থ হন তিনি পৃথিবী শাসন করতে পারেন। অর্থাৎ তিনিই গোস্বামী বা গুরুপদবাচ্য।
অর্থাৎ সদ্গুরুদের অবশ্যই কৃষ্ণতত্ত্ববেত্তা হবেন এবং সদগুরুদেবের প্রধান লক্ষণ তিনি অবশ্যই কৃষ্ণ ভক্ত হবেন।
.
সদ্গুরুদেব কি আমিষ-আহারীদের দীক্ষা দেন?
এ সম্পর্কে স্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে-
এবমাদিগুণৈর্ধূক্তং শিষ্যং নৈব পরিগ্রহেৎ।
গৃহ্ণীয়াদ্যদি তদ্দোষঃ প্রায়ো গুরুম্ পস্পৃশেৎ।।
অমাত্যদেষো রাজানং জায়াদোষঃ পতিং যথা।
তথা শিষ্যকৃতো দোষো গুরুং প্রাপ্নোত্যসংশয়ম্।।
তন্মাচ্ছিষ্যৎ গুরু-নিত্যং পরীক্ষ্যৈব পরিগ্রহেৎ।
[ স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুখণ্ড, মার্গশীর্ষ্যমাস মাহাত্ম্য ১৬। ১৬-১৮ ]
বঙ্গানুবাদ:
এই সকল গুণ (দোষ) যুক্ত মানবকে শিষ্য বলিয়া গ্রহণ করিবে না; আর এই সকল দোষের অনেকগুলি যদি গুরুকে স্পর্শ করে, তবে তাদৃশ গুরুকেও গুরু বলিয়া গ্রহণ করা কর্তব্য নহে। দেখ, যেমন অমাত্যদোষ নৃপকে এবং পত্নীদোষ পতিকে আশ্রয় করে, তদ্রূপ শিষ্যকৃত দোষও গুরুকে আশ্রয় করিয়া থাকে, সন্দেহ নাই; অতএব গুরু শিষ্যকে নিত্য পরীক্ষা করিয়া গ্রহণ করিবেন।
বিশ্লেষণ:
শ্রীমদ্ভাগবতে (৫/২৬/১৩)-তে উল্লেখ রয়েছে-, “যে সমস্ত নিষ্ঠুর মানুষ তাদের দেহ ধারণের জন্য এবং জিহ্বার তৃপ্তি সাধনের জন্য নিরীহ পশু-পক্ষীকে হত্যা করে রন্ধন করে, মৃত্যুর পর যমদূতেরা কুন্তীপাক নরকে ফুটন্ত তেলে তাদের পাক করে।” এই রকম পশু-পক্ষী হত্যাকারীকে গুরুদেব কখনো দীক্ষা দিবেন না।
যদি গুরুদেব এমন শিষ্যকে দীক্ষা দেন তাহলে রাজার প্রজারা যদি অধার্মিক হয়, যেভাবে রাজাকে নরকে যেতে হয়। স্ত্রী যদি অধার্মিক হয়, চরিত্রহীন হয় সেই দোষে যেভাবে স্বামী কে নরকে যেতে হয়। ঠিক সেই রকম যথার্থ গুরু এবং যথার্থ শিষ্য না হয়, গুরুর কারণে শিষ্য নরকে যাবে এবং শিষ্যের কারণে গুরুকে নরকগামী হতে হবে। তাই যিনি সদ্গুরুদেব তিনি কখনোই আমিষ আহারী ব্যক্তিকে দীক্ষা দিবেন না, দীক্ষার আগে তিনি শিষ্যকে পরিক্ষা করে দেখবেন তিনি আমিষাশী, নেশা এবং অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত কিনা। যদি কোনো গুরুদেব এমন পাপীকে দীক্ষা দেন, বুঝতে হবে তিনি সদ্গুরুদেব নন। এমন গুরুর থেকে দীক্ষা নিলে অবশ্যই সেই গুরু সহ শিষ্য নরকে নিমজ্জিত হতে হবে।
.
অসদ্গুরু কি ত্যাগ করা যায়?
এ সম্পর্কে মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে-
গুরোরপ্যবলিপ্তস্য কার্যাকার্যমজানতঃ।
উৎপথপ্রতিপন্নস্য পরিত্যাগো বিধীয়তে ॥
[ মহাভারত, উদ্যোগপর্ব, ১৬৭।২৫ ]
বঙ্গানুবাদ:
কার্য ও অকার্যে অনভিজ্ঞ কৃষ্ণভক্তিবিরুদ্ধগামী গর্বিত আত্মশ্লাঘী গুরুকে পরিত্যাগ করাই বিধি। যদি গুরুদেব ইন্দ্রিয় তর্পণের প্রতি আসক্ত হয় এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে ভক্তিযুক্ত ভগবৎসেবার পথ পরিত্যাগ করে পতনমুখী পথের দিকে ধাবিত হয়, তাহলে তাকে ত্যাগ করা উচিত।
[ অর্থাৎ অসদ্গুরুকে অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে। এই একই সিদ্ধান্ত স্কন্দপুরাণ, কূর্মপুরাণ, নারদ পঞ্চরাত্র শাস্ত্রেও উল্লেখ রয়েছে ]
.
এ সম্পর্কে শ্রীমদ্ভাগবতে বলা রয়েছে –
গুরুর্ন স স্যাৎ স্বজনো ন স স্যাৎ পিতা ন স স্যাজ্জননী ন সা স্যাৎ। দৈবং ন তৎস্যান্ন পতিশ্চ স স্যা-ন্ন মোচয়েদ্ যঃস মুপেতমৃত্যুম্।।
[ শ্রীমদ্ভাগবত ৫।৫।১৮ ]
বঙ্গানুবাদ:
যিনি তাঁর আশ্রিত জনকে সমুপস্থিত মৃত্যুরূপ সংসার মার্গ থেকে উদ্ধার করতে না পারেন, তাঁর গুরু, পিতা, পতি, জননী অথবা পূজ্য দেবতা হওয়া উচিত নয়।
অর্থাৎ যিনি তার শিষ্যকে মৃত্যুরূপ সংসার মার্গ থেকে উদ্ধার করতে পারেন না তিনি গুরু পদবাচ্যই নন। যে অসদ্গুরু নিজেই নরকগামী তার স্কন্ধপুরাণ, বিষ্ণুখণ্ড, মার্গশীর্ষ্যমাস মাহাত্ম্য (১৬/১৬-১৮) শ্লোক অনুযায়ী শিষ্যকেও নরকে যেতে হবে। শাস্ত্রে অনেক অসদ্গুরু পরিত্যাগের দৃষ্টান্ত দেখা যায়। শ্রীমদ্ভাগবতে ৮স্কন্দে ২০ অধ্যায়ে বলি মহারাজের তার গুরুদেব পাপী শুক্রাচার্যের নির্দেশ উপেক্ষা করায় তার গুরুদেব অভিশাপ দেন। কিন্তু তিনি অসদ্গুরু পরিত্যাগ করে ভগবানের শরণাপন্ন হওয়ার, ভগবানের বিশেষ কৃপা প্রাপ্ত হন। তাই অসদ্গুরু পরিত্যাগে অপরাধ নেই।
পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের মনুষ্য জীবের জন্য সদ্গুরুর গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা যদি অসদ্গুরু থেকে দীক্ষা গ্রহণ করি এবং সেই অসদ্গুরু পরিত্যাগ না করি তাহলে সেই গুরুর পাপে আমাদেরও নরকগামী হতে হবে। তাই আসুন আমরা সদ্গুরুর শরণাপন্ন হই এবং এই মনুষ্য জীবনকে ধন্য করি।
।। হরে কৃষ্ণ ।।
.
[ বি:দ্র: স্বধর্মম্-এর অনুমোদন ব্যাতীত এই গবেষণামূলক লেখার কোনো অংশ পুনরুৎপাদন, ব্যবহার, কপি পেস্ট নিষিদ্ধ। স্বধর্মম্-এর সৌজন্যে শেয়ার করার জন্য উন্মুক্ত ]
নিবেদক-
° স্বধর্মম্: প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন °