❝শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর মন্তব্য করেছেন, “মায়াবাদী সন্ন্যাসীরা মনে করে যে, শারীরক-ভাষ্য নামক শ্রীপাদ শঙ্করাচার্যকৃত বেদান্তসূত্রের ব্যাখ্যা, যা অদ্বৈতবাদ রূপে প্রতিষ্ঠিত, তা হচ্ছে বেদান্তসূত্রের যথার্থ ভাষ্য। এভাবেই তারা বেদান্তসূত্র, উপনিষদ ও অন্য সমস্ত বৈদিক শাস্ত্র তাদের নির্বিশেষ মতের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করে। একজন প্রখ্যাত মায়াবাদী সন্ন্যাসী সদানন্দ যোগীন্দ্র বেদান্তসার নামক গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং তাতে তিনি লিখেছেন, বেদান্তো নাম উপনিষৎ-প্রমাণম্, তদুপকারীণি শারীরক-সূত্রাদীনি চ। সদানন্দ যোগীন্দ্রের মতে শঙ্করাচার্যকৃত উপনিষদ ও বেদান্তের শারীরক-ভাষ্য হচ্ছে বৈদিক প্রমাণের একমাত্র উৎস। কিন্তু আসলে বেদান্ত বলতে সমস্ত বৈদিক জ্ঞানের সারমর্মকে বোঝায় এবং শঙ্করাচার্যের শারীরক-ভাষ্য ছাড়া বেদান্তের মধ্যে আর কিছু নেই তা ঠিক নয়। বৈষ্ণব আচার্যদের রচিত আরও অনেক বেদান্ত ভাষ্য রয়েছে এবং তাঁরা কেউই শঙ্করাচার্যকে অনুসরণ করেননি, অথবা তাঁর কল্পনাপ্রসূত ভাষ্যকে স্বীকার করেননি। তাঁদের ভাষ্যসমূহ দ্বৈতবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। শঙ্করাচার্য এবং তাঁর অনুগামী অদ্বৈতবাদীরা প্রতিপন্ন করতে চায় যে, ভগবান ও জীব এক এবং পরমেশ্বর ভগবানের আরাধনা করার পরিবর্তে তারা নিজেরাই ভগবান হতে চায়। তারা অন্যদের কাছে ভগবানের মতো পূজিত হতে চায়। এই ধরনের মানুষেরা শুদ্ধাদ্বৈত, শুদ্ধ-দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত, দ্বৈতাদ্বৈত ও অচিন্ত্য-ভেদাভেদ-বৈষ্ণব আচার্যদের এই সমস্ত দর্শন স্বীকার করে না। মায়াবাদীরা এই সমস্ত দর্শন আলোচনা করে না, কেন না তাদের বদ্ধমূল ধারণা যে, তাদের কেবলাদ্বৈতবাদ হচ্ছে একমাত্র দর্শন। এই দর্শনকে তারা বেদান্তসূত্রের বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত বলে মনে করে তারা বিশ্বাস করে যে, শ্রীকৃষ্ণের দেহ জড় উপাদান দ্বারা গঠিত এবং কৃষ্ণভক্তি হচ্ছে কেবল ভাবপ্রবণতা মাত্র। তাদের বলা হয় মায়াবাদী, কারণ তাদের মতে শ্রীকৃষ্ণের দেহ মায়ার দ্বারা রচিত এবং তাঁর প্রতি ভক্তের যে ভক্তিমূলক সেবা তাও মায়া। তারা মনে করে যে, এই প্রকার ভগবদ্ভক্তিও সকাম কর্মেরই (কর্মকাণ্ডের) একটি অঙ্গ। তাদের দৃষ্টিতে ভক্তিই হচ্ছে মনোধর্ম-প্রসূত জল্পনা-কল্পনা অথবা ধ্যান। এটিই হচ্ছে মায়াবাদী দর্শন ও বৈষ্ণব দর্শনের মধ্যে পার্থক্য।❞
(শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত: আদি/০৭/১০১ ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য)