‘বৈষ্ণব’ হচ্ছেন তাঁরাই, যারা শ্রীবিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত। বেদে শ্রীকৃষ্ণ বা শ্রীবিষ্ণুকে পরমেশ্বর বলা হয়েছে এবং তার সেবা করাকেই ধর্ম বলে নির্দেশ করা হয়েছে। একইসাথে বেদশাস্ত্রে সমগ্র মানবজাতিকেই বিষ্ণুভক্ত বা বৈষ্ণব হওয়ার জন্য উপদেশ প্রদান করা হয়েছে—
“বৈষ্ণবমসি বিষ্ণবে ত্বা॥”:
-(শুক্লযজুর্বেদ ৫।২১)
অনুবাদঃ বৈষ্ণব হও, বিষ্ণুর প্রীতির জন্য তোমাকে নিযুক্ত করছি।” (শুক্লযজুর্বেদ ৫।২১)।
সুতরাং যারা বৈষ্ণব, তাঁরা শ্রীবিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণের সেবক, তাই তাঁরা শতভাগ বেদ মান্য করেন এবং বেদবিহিত ধর্ম পালন করেন।
এখন প্রথমে আমরা বেদ সম্পর্কে আলোচনা করব। বেদ আমাদের মূল ধর্মগ্রন্থ। বেদ শব্দের অর্থ হল জ্ঞান। যে শাস্ত্রে পরমেশ্বর ভগবানের মহিমাগাথা আলোচনা করা হয়েছে, জীবের সুখ এবং শান্তির পথ নির্দেশ রয়েছে তাঁকে বেদ বলা হয়। বেদের অপর নাম শ্রুতি। বেদ চার ভাগে বিভক্ত— ঋগ্বেদ, যর্জুবেদ (শুক্ল ও কৃষ্ণ), সামবেদ এবং অথর্ববেদ। প্রতিটি বেদেরইচারটি অংশ রয়েছে— সংহিতাভাগ, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ।
সামবেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদে (৭।১।২) মহাভারত ও রামায়ণ নামক ইতিহাস এবং অষ্টাদশ পুরাণশাস্ত্রকে পঞ্চম বেদ হিসেবে সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়েছে—
“সহোবাচর্গ্বেদং ভগবোধ্যেমি যজুর্বেদং সামবেদমাথর্বণং চতুর্থমিতিহাসপুরাণং পঞ্চমং বেদানাং“
অনুবাদঃনারদ বললেন, “হে ভগবান, আমি অবগত আছি, ঋক্ ,সাম, যজুঃ ও অর্থব— চারটি বেদ। আর বেদের পঞ্চমটি হল অষ্টাদশ পুরাণ এবং ইতিহাস (মহাভারত ও রামায়ণ)।”
এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট করা হয়েছে অমলপুরাণ শ্রীমদ্ভাগবত শাস্ত্রে (৩।১২।৩৯)। সেখানে বলা হয়েছে- পুরাণসমূহই পঞ্চম বেদ
“পুরাণাণি পঞ্চমং বেদম্।”
আজকাল কিছু ব্যক্তি অল্পবিদ্যার ফলে নিজেরা তত্ত্ব সম্বন্ধে বিভ্রান্ত হয়ে অন্যদেরও বিভ্রান্ত করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরল সনাতনীর মাঝে প্রচার করছে বৈষ্ণবগণ নাকি বেদবিহিত ধর্ম পালন করেন না।
এইভাবে তাঁরা সনাতনীদের বোঝাতে চাচ্ছে বৈষ্ণবগণ বেদ মানে না বা বেদের ধর্ম পালন করে না। তাই তাঁরা সনাতনী নন। অথচ বৈষ্ণবগণ বেদের প্রকৃত অনুসারী। বেদ অখিল শাস্ত্রের মূল এবং তাই বৈষ্ণবগণ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর “বেদ না মানিলে হয় তো নাস্তিক “— এই বাক্যের দৃঢ় অনুসারী।উদাহরণস্বরূপ ব্রহ্ম-মাধ্ব-গৌড়ীয় বৈষ্ণব পরম্পরাগত আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন) এর ভক্তদের দেখা যাক। বৈষ্ণব হিসেবে প্রতিটি ইস্কন ভক্ত প্রতিদিন ভোর চারটায় ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যা ত্যাগ করার পর রাত্র ১০টায় শয়ন করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বেদবিহিত ধর্ম আচরণ করেন। বেদ নিষেধ করে এমন কোন কর্ম বৈষ্ণবগণ বা ইস্কন ভক্তগণ পালন করেন না। ইস্কনের বৈষ্ণবগণ প্রতিদিন ভোর চারটায় শয্যা ত্যাগ করে স্নান করে—
- প্রথমে দ্বাদশ অঙ্গে তিলক ধারণ করেন, যা বেদবিহিত।
- এরপর গুরুদেব এবং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বা শ্রীবিষ্ণুর উদ্দেশ্য প্রণতি নিবেদন করে বিনীত প্রার্থনা এবং স্তবস্তুতি পাঠ করেন, যা বেদে নির্দেশিত।
- এরপর প্রতিটি ইস্কন ভক্ত বেদোক্ত হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন এবং জপ করেন।
- এরপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতার শ্রীনৃসিংহদেবের উদ্দেশ্যে পূজা এবং স্তব পাঠ করা হয়, যা বেদবিহিত।
- এছাড়াও গায়ত্রী সংস্কারপ্রাপ্ত ভক্তগণ গায়ত্রী মন্ত্র এবং প্রণব জপ করেন, যা বেদ বিহিত।
- এরপর তুলসীবৃক্ষের আরাধনা করা হয়, এটিই বেদবিহিত।
- ভক্তগণ প্রতিদিন শ্রীমদ্ভাগবত, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ঈশোপনিষদ প্রভৃতি বৈদিক শাস্ত্র পাঠ করেন, যা বেদবিহিত।
- এরপর বৈষ্ণবগণ বেদের বর্ণিত পদ্ধতিতে নিরামিষ খাদ্যসামগ্রী দ্বারা যজ্ঞরূপী বিষ্ণু বা কৃষ্ণের আরাধনাপূর্বক সেই নিবেদিত আহার্য প্রসাদরূ পে গ্রহণ করেন।
- এছাড়াও ইস্কন বৈষ্ণবগণের দশবিধ সংস্কার অনুষ্ঠানে অগ্নিহোত্র যজ্ঞাদি অনুষ্ঠিত হয়, যা নিঃসন্দেহে বেদবিহিত কেননা সেসব যজ্ঞে বেদমন্ত্র পাঠ করা হয়।
- এছাড়াও প্রতিটি বৈষ্ণবগণ প্রতি মাসে দুইটি একাদশী ব্রত পালন করেন, যা বেদে নির্দেশিত হয়েছে।
এখন আমরা উপর্যুক্ত আলোচ্য বিষয়ের সংক্ষিপ্ত বেদপ্রমাণ তুলে ধরবো –
১। দ্বাদশ অঙ্গে তিলক ধারণঃ
সামবেদীয় বাসুদেব উপনিষদে গোপীচন্দন দ্বারা উদ্ধপুণ্ড্র তিলক ধারনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে –
ওঁ নমস্কৃত্য ভগবান্নারদঃ সর্ব্বেশ্বরং বাসুদেবং পপ্রচ্ছ অধীহি ভগবন্নূপূণ্ড্র বিধিং দ্রব্যমন্ত্রস্নানাদিসহিতং মে ব্রিহীতি।
তংহোবাচ ভগবান বাসুদেবো বৈকুন্ঠস্থানাদুৎপন্নং মম প্রীতিকরং মদ্ভক্তৈর্ব্রহ্মাদিভিধারিতং বিষ্ণুচন্দনং মমঙ্গে প্রতিনিমালিপ্তং গোপীভিঃ প্রক্ষালনাদে গোপীচন্দনমাখ্যাতং মদঙ্গলেপনং পুণ্যাং চক্রতীর্থান্তস্থিতং চক্রসমাযুক্তং পীতবর্ণং মুক্তিসাধনং ভবতি॥
অথ গোপীচন্দনং নমস্কৃত্বোদ্ধৃত্য।
গোপীচন্দন পাপঘ্ন বিষ্ণুদেহসমুদ্ভব॥
অনুবাদ: শ্রীনারদ সর্বেশ্বর ভগবান বাসুদেবকে প্রণাম নিবেদন করে জিজ্ঞাসা করলেন, হে ভগবান, আপনি আমাকে দ্রব্য, মন্ত্র ও স্নানাদির সহিত উর্দ্ধপুণ্ড্রর তিলক ধারণ বিধি সম্বন্ধে উপদেশ প্রদান করুন।ভগবান বাসুদেব তখন বললেন, বিষ্ণুচন্দন নামক দ্রব্য বৈকুণ্ঠস্থান হতে উৎপন্ন হয়েছে, তাই তা আমার অতিশয় প্রিয়। ব্রহ্মা প্রভৃতি আমার ভক্তগণ তা ধারণ করেন। গোপরমণীগণ তা আমার শরীরে লেপন করতেন, এইজন্য তা গোপীচন্দন নামে বিখ্যাত। এ গোপীচন্দন আমার পবিত্র অঙ্গলেপন, তা চক্রতীর্থে অবস্থিত, চক্রচিহ্নযুক্ত এবং পীতবর্ণ, তাই তা মুক্তির সাধন। অতএব গোপীচন্দনকে নমস্কার করে উত্তোলন করবে, কেননা গোপীচন্দন পাপবিনাশকারী এবং বিষ্ণুর দেহ থেকে উদ্ভুত।
উল্লেখ্য, মুক্তিকোপনিষদের ১।২৭-৩৬ মন্ত্রসমূহে ১০৮টি উপনিষদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে ১।৩২ মন্ত্র অনুসারে বাসুদেব উপনিষদ হচ্ছে ৫৬ তম উপনিষদ এবং ১।৫৪ মন্ত্র অনুসারে বাসুদেব উপনিষদ সামবেদের অন্তর্গত।
২। পরমেশ্বর ভগবানরূপে শ্রীকৃষ্ণ বা শ্রীবিষ্ণুর আরাধনাঃ
শ্রীকৃষ্ণের প্রকাশ শ্রীবিষ্ণু। শ্রীবিষ্ণু এবং শ্রীকৃষ্ণ একই পরমেশ্বর ভগবান। সমগ্র বেদে শ্রীকৃষ্ণকে বিষ্ণু, কৃষ্ণ,গোপাল, দেবকীপুত্র ইত্যাদি নামে সম্বোধন করা হয়েছে। ঋগ্বেদীয় পুরুষসুক্তের বর্ণনা অনুসারে বিষ্ণু সমগ্র জগতে ব্যাপৃত। পুরুষসূক্তে বিষ্ণুর বিরাটরূপ বা বিশ্বরূপের বর্ণনা করা হয়েছে যা শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দর্শন প্রদান করেছিলেন (গীতা ১১।৫-৪৪)। পরে অর্জুনের প্রার্থনায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে চতুর্ভূজ বিষ্ণুরূপ প্রদর্শন করেছিলেন (গীতা ১১।৪৬-৫০)।
বৈষ্ণবগণ বেদোক্ত পরমাত্মা পরমেশ্বর ভগবানরুপে শ্রীকৃষ্ণ বা শ্রীবিষ্ণুর আরাধনা করেন। ঋগ্বেদপ্রমাণে শ্রীকৃষ্ণ বা শ্রীবিষ্ণু হলেন পরমেশ্বর ভগবান –
“কালিকো নাম সৰ্পো নবনাগসহস্রবলঃ।
যমুনহ্রদে হ সো জাতো অসৌ নারায়ণবাহনঃ॥
যদি কালিকদূতস্য যদি কাঃকালিকাদ্ ভয়ম্।
জন্মভূমিং পরিক্রান্তো নির্বিষো যাতি কালিকঃ॥”
~ (ঋগ্বেদ, আশ্বলায়ন শাখা, ০৭।৫৬।৪-৫)
অনুবাদ: “যমুনার হ্রদে আগত সহস্র হস্তির ন্যায় বলশালী সেই কালিক নামক সর্প নারায়ণের বাহন (নারায়ণ বা কৃষ্ণ, তিনি তাঁর চরণযুগল স্থাপন করে কালিয় সর্পের উপর নৃত্য করেছিল, তাই কালিয় সর্পকে এখানে নারায়ণের বাহন বলা হয়েছে)।কালিক সর্প কাঃকালিক যার দূত, তাঁর দ্বারা ভীত হয়েছিল। জন্মভূমি ত্যাগ করে সে নির্বিষ হয়েছিল।(গরুড়কে এখানে কাঃকালিক বলা হয়েছে, গরুড়ের ভয়ে কালিয় যমুনা নদী সংলগ্ন একটি হ্রদে আশ্রয় নিয়েছিল। পরবর্তীতে যমুনার হ্রদে বসবাসকারী কালিয় কৃষ্ণের পাদস্পর্শে বিষহীন হয়েছিল)
এছাড়াও বিভিন্ন উপনিষদে বর্ণিত হয়েছে,
“ব্রহ্মন্যো দেবকীপুত্রঃ”
(কৃষ্ণযজুর্বেদোক্ত নারায়ণ উপনিষদ, মন্ত্র ৪)
অনুবাদঃ দেবকীপুত্র শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর ভগবান।
“নারায়ণায় বিদ্মহে বাসুদেবায় ধীমহি।
তন্নো বিষ্ণুঃ প্রচোদয়াৎ॥
(তৈত্তিরীয় আরণ্যক, ১০।১;
নারায়ণ উপনিষদ: ১০।১।২৯)
অনুবাদ: “আমরা নারায়ণকে জানব। তাই বসুদেবতনয় বাসুদেবের ধ্যান করি। সেই ধ্যানে তিনি আমাদের প্রেরণ করুন।”
“যো ব্রহ্মানং বিদধাতি পূর্বং যো বৈ বেদাংশ্চ স্ম কৃষ্ণঃ”
(অথর্ববেদীয় গোপালতাপনী উপনিষদ ১।২৪)
অনুবাদ: ব্রহ্মা যিনি পূর্বকালে বৈদিক জ্ঞান প্রদান করেন, তিনি সেই জ্ঞান সৃষ্টির আদিতে শ্রীকৃষ্ণের থেকে প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
“একো বশী সর্বগঃ কৃষ্ণ ঈড্যঃ”
(গোপালতাপনী উপনিষদ ১।২১)
অনুবাদ: সেই একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই পরম পুরুষোত্তম ভগবান,তিনিই আরাধ্য।
সচ্চিদানন্দরূপায় কৃষ্ণায়াক্লিষ্টকারিনে।
নমো বেদান্তবেদ্যায় গুরুবে বুদ্ধিসাক্ষিনে॥
(গোপালতাপনী উপনিষদ ১।১)
অনুবাদ: আমি শ্রী কৃষ্ণের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জ্ঞাপন করছি যার আপ্রাকৃত রূপ সৎ,চিৎ ও আনন্দময়। তাকে জানার অর্থ সমগ্র বেদকে জানা।
তদ্ধৈতদ্ ঘোর আঙ্গিরসঃ কৃষ্ণায় দেবকীপুত্ৰায়োক্ত্বোবাচাপিপাস এব
স বভূব সোঽস্তবেলায়ামেতত্রয়ং প্রতিপদ্যেতাক্ষিতমস্যচ্যুতমসি
প্রাণসংশিতমসীতি তত্রৈতে দ্বে ঋচৌ ভবতঃ॥
আদিৎ প্রত্নস্য রেতসঃ উদ্বয়ং তমসম্পরি জ্যোতিঃ পশ্যন্ত উত্তরং স্বঃ পশ্যন্ত উত্তরং
দেবং দেবত্রা সূর্যমগন্ম জ্যোতিরুত্তমমিতি জ্যোতিরুত্তমমিতি॥
~ (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩।১৭।৬-৭)
অনুবাদ: আঙ্গিরস ঘোর পূর্বোক্ত এই যজ্ঞবিজ্ঞান দেবকীপুত্র কৃষ্ণকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, যথোক্ত যজ্ঞবিদ্ মৃত্যুকালে এই মন্ত্রত্রয় জপ করবেন। হে কৃষ্ণ!তুমি অক্ষত, তুমি অচ্যুত, তুমি সূক্ষ্মপ্রাণস্বরূপ৷ এই বিজ্ঞান শ্রবণ করে দেবকীপুত্র কৃষ্ণ নিঃস্পৃহ হয়েছিলেন৷ এ বিষয়ে দুটি ঋক রয়েছে।
এষ বোহভিহিতো মার্গো গয়া বৈ মুনিসত্তমাঃ।
তং দৃষ্টা সর্ব্বশো দেবং দৃষ্টাঃ স্যুঃ সুরসত্তমাঃ ॥৫১৷৷
মহাবরাহং তং দেবং সর্ব্বলোকপিতামহম্।
অহং চৈব নমস্যামি নিত্যমেব জগৎপতিম্ ॥৫২॥
“তত্র চ ত্রিতয়ং দৃষ্টং ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ ॥
সমস্তা হি বয়ং দেবান্তস্য দেহে বসামহে” ॥৫৩
(মহাভারত, অনুশাসন পর্ব, ১২৫।৫১-৫৩)
অনুবাদ: মুনিশ্রেষ্ঠগণ! এই আমি আপনাদের নিকটে উৎকৃষ্ট পথ বলিলাম। সেই বাসুদেবকে সর্বপ্রকারে দর্শন করিলে সমস্ত দেবশ্রেষ্ঠগণকেই দেখা হয়।মহাবরাহরূপধারী, সমস্ত লোকের পিতামহ ও জগদীশ্বর সেই বাসুদেবকে আমিও সর্বদাই নমস্কার করি। সেই বাসুদেবকে দর্শন করলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব এই তিনজনকেই দেখা হইবে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কারণ, আমরা সমস্ত দেবতারাই তাঁর শরীরে বাস করিয়া থাকি।
ইত্যুদ্ধবেনাত্যনুরক্তচেতসা
পৃষ্টো জগৎক্রীড়নকঃ স্বশক্তিভিঃ।
গৃহীতমূর্তিত্রয় ঈশ্বরেশ্বরো জগাদ্
সপ্রেমমনোহরস্মিতঃ॥
– (শ্রীমদ্ভাগবতঃ১১/২৯/৭)
অনুবাদ: শ্রীশুকদেব বললেন, হে পরীক্ষিৎ! ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মাদি ঈশ্বরদেরও ঈশ্বর। তিনিই সত্ত্ব, রজ আদি গুণসকল দ্বারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং রুদ্রের রূপ ধারণ করে জগতের সৃষ্টি স্থিতি আদি ক্রীড়ায় যুক্ত থাকেন। যখন উদ্ধব সানুরাগ চিত্তে তাঁকে এই প্রশ্ন করলেন তখন তিনি অধরে মৃদুমন্দ হাস্য ধারণ করে বলতে শুরু করলেন।
৩। হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন এবং জপঃ
নারদঃ পুনঃ পপ্রচ্ছ তন্নাম কিমিতি।
সহোবাচ হিরণ্যগর্ভঃ।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে॥
ইতি ষোড়শকং নাম্নাং কলিকল্মষনাশনম।
নাতঃ পরতরোপায় সর্ববেদেষু দৃশ্যতে।
ষোড়শকলাবৃতস্য জীবস্যাবরনবিনাশনম্॥
ততঃ প্রকাশতে পরং ব্রহ্ম মেঘাপায়ে।
রবিরশ্মিমণ্ডলীবেতি॥
–(কৃষ্ণযজুর্বেদোক্ত কলিসন্তরণ উপনিষদ ২ )
অনুবাদঃ তখন নারদ পুনঃ প্রশ্ন করলেন সেই নাম
কি? তখন হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্মা বললেন,হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে॥ এই ষোড়শ নাম কলিযুগে সমস্ত পাপ নাশ করে। সমস্ত বেদ শাস্ত্রে এর থেকে শ্রেষ্ঠ কোনো উপায় নেই। এই মন্ত্র উচ্চারণে জীবের ষোড়শকলা যুক্ত আবরণ বিনষ্ট হয়। বৃষ্টির পর যেমন মেঘ কেটে গিয়ে সূর্যরশ্মি প্রকাশিত হয় তেমনই জীব পরমব্রহ্মকে জানতে পারে।
উল্লেখ্য শুক্ল যজুর্বেদীয় মুক্তিকোপনিষদে ১০৮ টি উপনিষদের তালিকায় কলির্সন্তরণ উপনিষদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
এতত্তে কথিতং রাজন্ ! বিষ্ণুতত্ত্বমনুত্তমম্ ।
ভজস্বৈনং বিশালাক্ষং জপন্ কৃষ্ণেতি সত্তম !॥
– ( মহাভারত, শান্তিপর্ব ২০৪।৭৭ )
অনুবাদ: ভীষ্ম বলিলেন—’সাধুশ্রেষ্ঠ রাজা ! এই আমি তোমার নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ বিষ্ণুতত্ত্ব বলিলাম। তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ নাম- কৃষ্ণ নাম জপ করিতে থাকিয়া এই বিশালনয়ন কৃষ্ণের সেবা কর ॥
“হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে॥
ইত্যষ্টশতকং নাম্নাং ত্রিকাল কল্মষাপহং।
নাতঃ পরতরোপায়ঃ সর্ব্ববেদেষু বিদ্যতে॥”
(ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, উত্তরখণ্ড, রাধাহৃদয়মাহাত্ম্য, ৬।৫৫,৫৬ )
অনুবাদ:হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে॥ -এই মহামন্ত্র হরিনাম একশত অষ্টবার ত্রিকাল জপে সর্ব্বপ্রকার পাপের অপহারক হন। অর্থাৎ প্রাতঃ মধ্যাহ্ন ও সায়াহ্ন একশত অষ্ট বার প্রত্যেক সময়ে জপ করাতল সকল পাতক ধংস হয়। ইহার পর ভবভীরু জনের ভব নিস্তারণ উপায় আর নাই, ইহা সর্ব্ববেদে কথিত আছে।
কলের্দোষ নিধে রাজন্ অস্তি এক মহান গুণ।
কীর্তনাৎ এব কৃষ্ণস্য মুক্তসঙ্গ পরং ব্রজেৎ॥
– (শ্রীমদ্ভাগবত ১২।৩।৫১ )
অনুবাদ: হে রাজন,যদিও কলিযুগ এক দোষের সমুদ্র, তবুও তার একটি মহান গুন আছে- শুধুমাত্র হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করার মাধ্যমে জড়বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে পরম ধামে উন্নীত হবেন।
৪। নৃসিংহদেবের পূজা এবং স্তব পাঠঃ
বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকে নৃসিংহদেবের গায়ত্রী মন্ত্র রয়েছে –
“বজ্রনখায় বিদ্মহে তীক্ষ্ণদংষ্ট্ৰায় ধীমহি।
তন্নো নারসিংহঃ প্রচোদয়াৎ ॥ “
– (তৈত্তিরীয় আরণ্যক, দশম প্রপাঠক)
অনুবাদ:আমরা বজ্রনখকে জানব। তাই আমরা তীক্ষ্ণদন্তের ধ্যান করি। সেই ধ্যানে নরসিংহ আমাদেরকে প্রেরিত করুন।
কৃষ্ণ যজুর্বেদের ‘মহানারায়ণ উপনিষদ’ শাস্ত্রেও এই নৃসিংহ গায়ত্রী মন্ত্রটি পাওয়া যায়। এ মন্ত্রটিতে নৃসিংহদেবকে ‘বজ্রনখা’ এবং ‘তীক্ষ্ণদংষ্ট্ৰা’ নামে অবিহিত করা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর নখ বজ্রের মত কঠোর ভয়ংকর এবং দাঁত তীক্ষ্ণ ধারালো।ঋগ্বেদ সংহিতায় প্রথম মণ্ডলের ১৫৪ সূক্তে ভগবান বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতারের কথা বর্নিত আছে।সেখানে বলা হয়েছে-
” প্র তদ্ বিষ্ণু স্তবতে বীর্যেণ
মৃগো ন ভীমঃ কুচরো গিরিষ্ঠাঃ ।
যস্যোরুষু ত্রিষু বিক্রমণেষধি-
ক্ষিয়ন্তি ভুবনানি বিশ্বা ॥
প্র বিষ্ণবে শূষমেতু মন্ম
গিরিক্ষিত উরুগায়ায় বৃষ্ণে।
য ইদং দীর্ঘং প্রযতং সধস্থমেকো
বিমমে ত্রিভিরিৎ পদেভিঃ॥
– ঋগ্বেদ সংহিতা: ১। ১৫৪।২-৩
অনুবাদ:সেই বিষ্ণু বীরত্ব বীর্যসূচক কর্মহেতু জগতে স্তুত হয়ে থাকেন। বিষ্ণুর তিন পদক্ষেপে সমস্ত ভুবনে অবস্থান করে আছেন; এতেই সকল প্রাণী জীবিত থাকে।আবার তিনি ভয়ঙ্কর, হিংস্র, গিরিশায়ী দুর্গম স্থানে বিচরণশীল। অর্থাৎ বিষ্ণুর শান্ত এবং উগ্র উভয়রূপ বিরাজমান।২।লোকপ্রশংসিত মহাবল বিষ্ণু এ স্তোত্রসমূহ গ্রহণ করুক। তিনি ফলবর্ষণকারী বৃষভ, তিনি পর্বতবাসী, তিনি সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়ে ভ্রমণকারী। সেই বিষ্ণু তিনটিমাত্র পদক্ষেপ দ্বারা এই দীর্ঘ, অতিবিস্তৃত সকলের বাসস্থান পরিমাপ করেছেন।৩।
এছাড়াও সামবেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদ ৭।১।২ মন্ত্র অনুযায়ী পঞ্চম বেদরুপে মহাভারত নামক ইতিহাস এবং পুরাণ শাস্ত্রের মধ্যে শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ, অগ্নিপুরাণ, ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ, বায়ুপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ, বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ, কূর্মপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, পদ্মপুরাণ (উত্তরখণ্ড), শিবপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণে নৃসিংহ অবতারের কথা বর্নিত আছে।শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের সপ্তম স্কন্দে নৃসিংহ অবতার এবং ভক্ত প্রহ্লাদের কাহিনী খুব সুন্দরভাবে শ্রীল শুকদেব গৌস্বামী রাজা পরীক্ষিৎ মহারাজকে বর্ণনা করেন।
৫. গায়ত্রী এবং ওঁ মন্ত্র জপঃ
ইস্কনের বৈষ্ণবদের মাঝে যারা গায়ত্রী দীক্ষার মাধ্যমে উপনয়ন প্রাপ্ত হয়েছেন, তারা প্রতিদিন ঋগ্বেদোক্ত মন্ত্র মনে মনে উচ্চারণ করেন।
ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গো দেবস্য ধীমহি।
ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ॥
– ঋগ্বেদ ৩।৬২।১০
অনুবাদ: যিনি ভুলোক,ভুবলোক এবং স্বর্গলোক এই ত্রিলোকের স্রষ্টা,অথাৎ সমস্ত বিশ্বলোকের প্রসবিতা, সেই সচ্চিদানন্দঘন পরমব্রহ্মের বরনীয় জ্যোতিকে আমরা ধ্যান করি।তিনি আমাদের মন ও বুদ্ধিকে শুভ কার্যে প্রেরনা প্রদান করুন।
এছাড়াও প্রতিটি ইস্কন ভক্তগণ নিত্য শ্রীমদ্ভাগবত এবং গীতা পাঠ,দশবিধ সংস্কার উপলক্ষে অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, আদ্যশ্রাদ্ধ সহ অন্যান্য সকল শুভ কর্মে ওঁ বা প্রণব উচ্চারণ করেন।
৬. তুলসী সেবাঃ
ছান্দোগ্য উপনিষদ ৭।১।২ মন্ত্র অনুযায়ী পঞ্চম বেদরূপে বিভিন্ন পুরাণ শাস্ত্রে তুলসী দেবীর সেবা করার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। তাই বৈষ্ণবগণ প্রতিদিন বেদের নির্দেশে তুলসী বৃক্ষ রুপে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুদ্ধভক্ত বৃন্দাদেবীর উদ্দেশ্যে প্রনাম,আরতি এবং গুণকীর্তনের মাধ্যমে সেবা করে থাকেন।পদ্মপুরাণ,সৃষ্টিখন্ডে ৬০ তম অধ্যায়ে মহাদেব শিব পুত্র কার্তিককে বর্ণনা করেন-
সর্বেভ্যঃ পত্রপুষ্পেভ্যঃ সত্তমা তুলসী শিবা।
সর্বকামপ্রদা শুদ্ধা বৈষ্ণবী বিষ্ণুসুপ্রিয়া ॥
– (পদ্মপুরাণঃ সৃষ্টিখন্ডে ৬০/১০৫)
অনুবাদঃসমস্ত পত্র ও পুষ্পের মধ্যে তুলসী হচ্ছেন শ্রেষ্ঠা। তুলসী সর্বকামপ্রদা, মঙ্গলময়ী, শুদ্ধা, মুখ্যা, বৈষ্ণবী, বিষ্ণুর প্রেয়সী এবং সর্বলোকে পরম শুভা।
যো মঞ্জরীদলৈরেব তুলস্যা বিষ্ণুমর্চয়েঃ।
তস্য পুণ্যফলং স্কন্দ কথিতুং নৈব শক্যতে ॥১১৭।।
তত্র কেশবসান্নিধ্যং যত্রাস্তি তুলসীবনম্।
তত্র ব্রহ্মা চ কমলা সর্বদেবগণৈঃ সহ ॥১১৮।।
তস্মাত্তাং সন্নিকৃষ্টে তু সদা দেবীং প্রপূজয়েৎ।
স্তোত্রমন্ত্রাদিকং যত্বা সর্ব্বমানস্ত্যমশ্মুতে। ১১৯।।
-(পদ্মপুরাণঃ সৃষ্টিখন্ডে ৬০/১১৭-১১৯)
অনুবাদঃ হে কার্তিক! যে ব্যক্তি ভক্তিসহকারে প্রতিদিন তুলসীমঞ্জরি দিয়ে শ্রীহরির আরাধনা করে, এমনকি আমিও তার পুণ্য বর্ণনা করতে অক্ষম। যেখানে শ্রীতুলসীর বন আছে, শ্রীগোবিন্দ সেখানেই বাস করেন। আর গোবিন্দের সেবার উদ্দেশ্যে লক্ষ্মী, ব্রহ্মা প্রভৃতি সমস্ত দেবতা সেখানেই বাস করেন।অতএব তুলসী দেবীকে সর্ব্বদাই পুজা করিবে। তুলসীর সমীপে যা কিছু স্তোত্র বা মন্ত্রাদি পাঠ করা যায়, সমস্তই অনন্তফল লাভ হয়।
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের প্রকৃতিখণ্ডে ২২তম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে-
শিরোধার্যাঞ্চ সর্বেসামীপ্সিতাং বিশ্বপাবনীম্।
জীবন্মুক্তাং মুক্তিদাঞ্চ ভজে তাং হরিভক্তিদাম্ ॥
-(ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণঃ প্রকৃতিখণ্ড ২২/৪২-৪৪)
অনুবাদঃযিনি সকলের শিরোধার্যা, উপাস্যা, জীবন্মুক্তা, মুক্তিদায়িনী এবং শ্রীহরিভক্তি প্রদায়িনী, সেই সমগ্র বিশ্বকে পবিত্রকারিণী বিশ্বপাবনী তুলসীদেবীকে সতত প্রণাম করি।
সমগ্র বৈদিক শাস্ত্রের সংকলক তথা সম্পাদক শ্রীব্যাসদেব তুলসীর মহিমা বর্ণনা করতে গিয়ে পদ্মপুরাণের সৃষ্টিখণ্ডে ৬০ তম অধ্যায়ে বলেছেন,
পূজনে কীর্তনে ধ্যানে রোপণে ধারণে কলৌ।
তুলসী দহতে পাপং স্বর্গং মোক্ষং দদাতি ॥
উপদেশং দিশেদস্যাঃ স্বয়মাচরতে পুনঃ।
স যাতি পরমং স্থানং মাধবস্য নিকেতনম্ ॥
– (পদ্মপুরাণের সৃষ্টিখণ্ডে -৬০/১২৭-১২৮)
অনুবাদঃ শ্রীতুলসীদেবীর পূজা, কীর্তন, ধ্যান, রোপণ ও ধারণে সমস্ত পাপ নাশ হয় এবং পরমগতি লাভ হয়। যে ব্যক্তি অন্যকে তুলসী দ্বারা শ্রীহরির অর্চনার উপদেশ দেন, এবং নিজেও অর্চনা করেন, তিনি শ্রীমাধবের আলয়ে গমন করেন। শুধু শ্রীমতী তুলসীদেবীর নাম উচ্চারণ করলেই শ্রীহরি প্রসন্ন হন। ফলে পাপসমূহ নাশ হয় এবং অক্ষয় পুণ্যার্জিত হয়।
পদ্মপুরাণের ব্রহ্মখণ্ডে বলা হয়েছে,
গঙ্গাদ্যাঃ সরিতঃ শ্রেষ্ঠা বিষ্ণুব্রহ্মামহেশ্বরাঃ।
দেবৈস্তীর্থৈঃ পুষ্করাদ্যৈস্তিষ্ঠান্ত তুলসীদলে ॥ ২২।।
– (পদ্মপুরাণঃ ব্রহ্মখণ্ড,৬/২২)
অনুবাদঃ গঙ্গাদি সমস্ত পবিত্র নদী এবং ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, পুষ্করাদি সমস্ত তীর্থ সর্বদাই তুলসীদলে বিরাজ করেন।
এছাড়াও শ্রীমদ্ভাগবত ৯ ম স্কন্দের চতুর্থ অধ্যায়ে অম্বরীষ মহারাজের আখ্যন আলোচিত হয়েছে,যেখানে অম্বরীষ মহারাজ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মে তুলসী অর্পন করতেন।এরপর নিবেদিত তুলসীর ঘ্রাণ গ্রহণ করতেন।
স বৈ মনঃ কৃষ্ণপদারবিন্দয়ো-
বচাংসি বৈকুণ্ঠগুণানুবর্ণনে।
করৌ হরেমন্দিরমার্জনাদিষু
শ্রুতিং চকারাচ্যুতসৎকথোদয়ে ৷ ১৮ ॥
মুকুন্দলিঙ্গালয়দর্শনে দৃশৌ
তদভৃত্যগাত্রস্পর্শেহঙ্গসঙ্গমম্।
ঘ্রাণং চ তৎপাদসরোজসৌরভে
শ্রীমদতুলস্যা রসনাং তদর্পিতে ৷ ১৯ ॥
– ( শ্রীমদ্ভাগবতঃ৯/৪/১৮-১৯)
অনুবাদঃ মহারাজ অম্বরীষ সর্বদা তাঁর মনকে শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মের ধ্যানে, তাঁর বাণী ভগবানের মহিমা বর্ণনায়, তাঁর হস্তদ্বয় মন্দির মার্জনে, তাঁর কর্ণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহিমা শ্রবণে, তাঁর চক্ষুদ্বয় শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ এবং মথুরা-বৃন্দাবন আদি স্থানে শ্রীকৃষ্ণের মন্দির দর্শনে, তাঁর স্পর্শেন্দ্রিয় ভগবদ্ভক্তের অঙ্গস্পর্শনে, তাঁর ঘ্রাণেন্দ্রিয় ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে নিবেদিত তুলসীর ঘ্রাণ গ্রহণে, তাঁর রসনা কৃষ্ণপ্রসাদ আস্বাদনে।
ছান্দোগ্য উপনিষদ ৭।১।২ মন্ত্র অনুযায়ী পঞ্চম বেদরূপে বিভিন্ন পুরাণ শাস্ত্রে তুলসী দেবীর সেবা করার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। তাই বৈষ্ণবগণ প্রতিদিন বেদের নির্দেশে তুলসী বৃক্ষ রুপে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুদ্ধভক্ত বৃন্দাদেবীর উদ্দেশ্যে প্রনাম,আরতি এবং গুণকীর্তনের মাধ্যমে সেবা করে থাকেন।
দৃষ্টাস্পর্শাতথা ধ্যাতা কীত্তির্তা নমিতা শ্রুতা।
রোপিতা সেবিতা নিত্যং পূজিতা তুলসী শুভা॥
নবধা তুলসী নিত্যং যে ভজন্তি দিনে দিনে।
যুগকোটি সহস্রানি তে বসন্তি হরিগৃহে॥
– স্কন্দ পুরাণ
অনুবাদ: তুলসী সর্ব মঙ্গলময়ী। তাই সকলের উচিত প্রত্যহ তুলসীর দর্শন, স্পর্শ,ধ্যান, গুণকীর্তন, প্রণাম,গুন শ্রবন,রোপন,জলপ্রদানের মাধ্যমে সেবা ও পূজা করা। সব রকমের কল্যাণ এই প্রকার নয়টি বিধির মাধ্যমে লাভ হয়।তুলসী সেবা করলে সহস্রকোটি যুগ পর্যন্ত বিষ্ণুলোকে বাস করা যায়।
৭. বৈদিক শাস্ত্র অধ্যয়নঃ
প্রতিদিন ইস্কন ভক্তগণ পঞ্চম বেদরুপে শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ,এবং ইতিহাস শাস্ত্র রুপে মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠ করেন।এছাড়াও ইসকন ভক্তগণ বৈদিক জ্ঞান আহরনের জন্য শুক্ল যজুর্বেদীয় ঈশোপনিদ সহ বিভিন্ন উপনিষদ এবং ঋগ্বেদ সংহিতা, যজুর্বেদ সংহিতা, সামবেদ সংহিতা, অষ্টাদশ পুরাণ সহ বিভিন্ন সনাতনী শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।
৮। শ্রীকৃষ্ণকে ভোগ নিবেদন এবং প্রসাদ গ্রহণঃ
সামবেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদ ৭।১।২ মন্ত্র অনুযায়ী পঞ্চম বেদরুপে মহাভারত নামক ইতিহাস শাস্ত্রের অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (মহাভারত,ভীষ্মপর্ব ২৫-৪২)অনুযায়ী ইসকন ভক্তগণ পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণকে নিরামিষ খাদ্যদ্রব্য ভোগরুপে নিবেদন করে তা প্রসারুপে গ্রহণ করেন।
পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি।
তদহং ভক্ত্যুপহৃতমন্নামি প্রযতাত্মনঃ ॥
– (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৯।২৬)
অনুবাদ: যে বিশুদ্ধচিত্ত নিষ্কাম ভক্ত ভক্তি সহকারে আমাকে (শ্রীকৃষ্ণ)পত্র, পুষ্প, ফল ও জল অর্পণ করেন, আমি তাঁর সেই ভক্তিপ্লুত উপহার প্রীতি সহকারে গ্রহণ করি।
যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুচ্যন্তে সর্বকিল্বিষৈঃ।
ভুঞ্জতে তে ত্বষং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ॥ ১৩॥
অনুবাদ: ভক্তরা সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন, কারণ তাঁরা যজ্ঞাবশিষ্ট অন্নাদি গ্রহণ করেন। যারা কেবল স্বার্থপর হয়ে নিজেদের ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তির জন্য অন্নাদি পাক করে, তারা কেবল পাপই ভোজন করে।
বিভিন্ন সংস্কার এবং শুভ অনুষ্ঠানে বিশ্বশান্তি এবং মঙ্গল কামনায় অগ্নিহোত্র যজ্ঞ অনুষ্ঠান করা হয় যেখানে ঋগ্বেদীয়,শুক্ল এবং কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় মন্ত্র উচ্চস্বরে পাঠ করা হয়।
তদ্বিষ্ণো পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ।
দিবীব চক্ষুরাততম্॥
অনুবাদ: আকাশে সর্বতো বিচারী যে চক্ষু যেরূপ দৃষ্টি করে, বিদ্বানেরা বিষ্ণুর (ঈশ্বর) পরমপদ (শ্রীচরণ) সেরূপ দৃষ্টি করেন।
তদ্বিপ্রাসো বিপন্যবো জাগৃবাংসঃ সমিন্ধতে।
বিষ্ণোর্যৎ পরমং পদম॥
অনুবাদ: স্তুতিবাদক ও সদাজাগরূক মেধাবী লোকেরা যে বিষ্ণুর পরমপদ প্রদীপ্ত(দর্শন) করেন।
১০। একাদশী উপবাস ব্রত পালনঃ
বেদে ঈশ্বরের প্রীতির জন্য অনশন বা উপবাস ব্রত পালন করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। তাই বৈষ্ণবগণ প্রতিমাসের একাদশী তিথিতে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি বা আনন্দ বিধানের জন্য উপবাস ব্রত পালন করেন।
যদনাশ্বানুপবসেৎ ক্ষোধুকঃ স্যাদ্যষ্বীয়াদ্রদ্রোহস্য পশূনভি মন্যেত। অপোহশ্মাতি। তন্নেবাশিতং নেবানশিতং ন ক্ষোধুকো ভবাতি নাস্র রুদ্রঃ পশূনভি মন্যতে। বজ্ৰো বৈ যজ্ঞঃ ক্ষুৎ খলু বৈ মনুষ্যস্য ভ্রাতৃব্যো যদনাশ্বানুপবসতি বজ্রেণৈব সাক্ষাৎক্ষুধং ভ্রাতৃব্যং হন্তি॥
– (কৃষ্ণযজুর্বেদ, ১।৬।৭)
অনুবাদ: উপবাসে ক্ষুধা বৃদ্ধি পায় এবং ক্ষুধাগ্নি জীবের ক্ষতি সাধন করে । যদি ক্ষুধা অসহনীয় হয় তবে জলপান করবে। জলপানে ভোজন হয়, আবার হয়না। যজ্ঞ বজ্রসদৃশ, ক্ষুধা মানুষের শত্রু। না খেয়ে উপবাস করলে যজ্ঞরূপ বজ্র তার ক্ষুধারূপ শত্রুকে বিনাশ করে।
তমেতং বেদান বচনেন ব্রাহ্মণা বিবিদিষন্তি
যজ্ঞেন দানেন তপসাংনাশকেনৈতমেব বিদিত্বা মুনির্ভবতি।
– (বৃহদারণ্যক ঊপনিষদ ৪।৪।২২,শুক্ল যজুর্বেদ)
অনুবাদ: বেদবচন, যজ্ঞ, দান, তপস্যা ও অনশন (উপবাস ব্রত) দ্বারা ব্রহ্মবিদগণ পরমেশ্বরকে জানিতে চাহেন। ইহাকে জানিয়াই মানুষ মুনি হয়।
এছাড়াও সামবেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদ ৭।১।২ মন্ত্র অনুযায়ী পঞ্চম বেদ পদ্মপুরাণ,শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ সহ অসংখ্য পুরাণ শাস্ত্রে মানবজাতিকে ঈশ্বরের প্রীতি বিধানের নিমিত্তে একাদশী উপবাস ব্রত পালন করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশাং শূদ্রণাঞ্চৈব যোষিতাম্।
মোক্ষদং কূর্ব্বতাং ভক্ত্যা বিষ্ণো:প্রিয়তরং দ্বিজাঃ॥
~ ( বৃহন্নারদীয় পুরাণ, অধ্যায়-২১ শ্লোক-২ )
অনুবাদ: ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়, বৈশ্য,শুদ্র এবং বিবাহিত স্ত্রীলোক – ইহাদিগের মধ্যে যে কোন ব্যক্তি হউক, ভক্তি পূর্ব্বক একাদশী ব্রত পালন করে মুক্তি লাভ করতে পারে।
পতিসহিতা যা যোষিৎ করোতি হরিবাসরম্ ।
সুপুত্ৰা স্বামিসুভগা যাতি প্রেত্য হরের্গৃহম॥ ৭৬
যো যচ্ছতি হরেরগ্রে প্রদীপং ভক্তিভাবতঃ।
হরের্দিনে দ্বিজশ্রেষ্ঠ পুণ্যসঙ্গ্যা ন বিদ্যতে ॥৭৭
যাঙ্গনা ভর্ত্তৃসহিতা কুরুতে জাগরং হরেঃ।
হরের্নিকেতনে তিষ্ঠেচ্চিরং পত্যা সহ দ্বিজ ॥৭৮
~ ( পদ্মপুরাণ, স্বর্গখন্ড, অধ্যায় ৪৪, শ্লোক- ৭৬-৭৮ )
অনুবাদ: যে স্ত্রী পতি সহ একাদশীব্রত করে, সে সুপুত্রা স্বামি-সুভাগা হয়, মরণান্তে হরিগৃহ বৈকুন্ঠে যায়। দ্বিজ শ্রেষ্ঠ! একাদশীতে ভক্তিভাবে যে জন হরির অগ্রে প্রদীপ দান করে, তাহার পুণ্যের সংখ্যা নাই অর্থাৎ অগণিত পুণ্য লাভ করে । আর যে স্ত্রী স্বামীর সহিত একাদশীতে রাত্রি জাগরণ করে, সে চিরকাল পতিসহ হরির নিকেতনে বাস করে।
অতএব বৈষ্ণবগণ যে বেদ মান্য করেন না বা বেদ বিহিত ধর্ম আচরণ করেন না তা বলার কোনো সুযোগ নেই।
হরে কৃষ্ণ।প্রনাম।