বেদ কি?বেদ সম্পর্কে আলোচনা করুন।

20250713_140514

বেদ বা শ্রুতিঃ

‘বিদ’ ধাতু হতে বেদ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছেে।বেদ শব্দের অর্থ হল জ্ঞান। যে শাস্ত্রে পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশ অথবা উপদেশ আলোচনা করা হয়েছে তাকে বেদ বলা হয়। বেদকে শ্রুতিও বলা হয়,অথাৎ বেদের আর একটি নাম হল শ্রুতি।বেদ সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ।বেদের জ্ঞান গুরু থেকে শিষ্য শ্রবণ বা শ্রৌত পন্থায় প্রবাহমান, তাই বেদকে শ্রুতি বলা হয়।বেদ বা শ্রুতি চারপ্রকার –ঋগ্,যর্জু, সাম,অর্থব।প্রতিটি বেদ বা শ্রুতি আবার চারপ্রকার-সংহিতা ( উপাসনা কান্ড), ব্রাহ্মণ( কর্মকান্ড),আরন্যক এবং উপনিষদ(জ্ঞানকান্ড)।

অথাৎ প্রতিটি বেদ বা শ্রুতি শাস্ত্রের প্রথম ভাগ হল সংহিতা।দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ভাগ হল বহুবিধ ব্রাহ্মণ ও আরন্যক ।এরপর চতুর্থ বা শেষভাগ হল উপনিষদ।উপনিষদ যেহেতু প্রতিটি বেদের সর্বশেষ ভাগ তাই উপনিষদকে বেদান্ত বা বেদ শাস্ত্রের অন্তভাগও বলা হয়।

১/ঋগ্বেদঃ

‘ঋচ’ ধাতু থেকে ঋগ্ শব্দটি এসেছে। ঋগ্ শব্দের অর্থ হল স্তুতি।বেদের যে বিভাগে পরমেশ্বর ভগবানের উদ্দেশ্য স্তুতি বা প্রশংসা করা হয়েছে তাকে ঋগ্বেদ বলে।

২/ যজুর্বেদঃ

‘যজ’ ধাতু উসি প্রত্যয় যোগে যজুস্ পদটি গঠিত।’যজ’ধাতুর অর্থ যজন বা যজ্ঞ করা।সুতরাং যজুর্বেদ  মানে যজ্ঞের মন্ত্র। প্রাচীনকালের ঋষিরা মন্ত্র উচ্চারণ বা আবৃত্তি করে ধর্মানুষ্ঠান বা যজ্ঞ করতেন।যজুর্বেদ দুটি ভাগে বিভক্ত।যথা- ১. শুক্ল যজুর্বেদ ২. কৃষ্ণ  যজুর্বেদ ।

৩/ সামবেদঃ  ‘সো’ ধাতু থেকে সাম শব্দটি গঠিত হয়েছে। সাম’ শব্দের অর্থ হল গান।যজ্ঞ করার সময় যে মন্ত্র সমূহ গান করে গাওয়া হত,তার একত্রিত সংকলনকে সামবেদ বলা হয়।

৪/অথর্ববেদঃ অথর্ববেদ শব্দটি সংস্কৃত অথর্বণ (দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রণালী) ও বেদ (জ্ঞান) শব্দ দুইটির সমষ্টি। যে শাস্ত্রে জাগতিক এবং আধ্যত্মিকভাবে যুগপৎ জীবনাচরন করা যায় তার শিক্ষা প্রদান করে তাকে অথর্ববেদ বলা হয়।

ক. সংহিতাঃ

আক্ষরিক অর্থে সংহিতা শব্দের অর্থ হল একত্রিত বা মিলিত বা যুক্ত”। নির্দিষ্ট পদ্ধতি ও নিয়ম অনুসারে বেদের একত্রিত গ্রন্থ বা মন্ত্র-সংকলনকে সংহিতা বলা হয়।ঋগ্,যর্জু, সাম,অর্থব এই চারিবেদের প্রথম ভাগ হল সংহিতা।

ঋগ্বেদ সংহিতাঃ

সংহিতা বিভাগের প্রথম ভাগ হল ঋগ্বেদ সংহিতা।ঋগ্বেদ সংহিতায় রয়েছে ১০ টি মন্ডল, ১০২৮ টি সুক্ত এবং ১০৫৫২ টি মন্ত্র। ঋগ্বেদ সংহিতা পদ্যে রচিত।এছাড়াও পতঞ্জলির মহাভাষ্য অনুসারে ২১ টির মতো ঋগ্বেদ সংহিতার শাখা আছে।তাদের মধ্যে অনেকগুলি শাখা এখন বিলুপ্ত।বর্তমানে ঋগ্বেদ সংহিতার শাকল,বাস্কল, আশ্বলায়ন,শাংখ্যায়ণ এবং মান্ডুকেয় শাখাগুলি প্রচলিত রয়েছে। ঋগ্বেদ সংহিতার ঋষিরা হলেন মধুছন্দা ঋষি,জেতৃ ঋষি,মেধাতিথি ঋষি, শুনঃশেপ ঋষি প্রমুখ।

যজুর্বেদ সংহিতাঃ

সংহিতা বিভাগের দ্বিতীয় ভাগ হল যজুর্বেদ সংহিতা।শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতায় রয়েছে ৪৪টি অধ্যায়, ৩০৩ টি অনুবাক, ১৯১৫টি মন্ত্র । এবং কৃষ্ণ যজুর্বেদ সংহিতায় ৭টি কাণ্ড, ৪৪ টি প্রপাঠক,৬৪৪টি অনুবাক এবং ২১৮৪টি মন্ত্র রয়েছে। শুক্ল এবং কৃষ্ণ উভয় যজুর্বেদ সংহিতা গদ্য ও পদ্য উভয় রীতিই ব্যবহার করা হয়েছে।পতঞ্জলি মহাভাষ্যে যর্জুবেদের ১০০টি শাখার কথা বলা হয়েছে। তবে বর্তমানে যর্জুবেদের মাত্র ৫টি শাখা প্রচলিত,যথা -শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতার মাধ্যন্দিন ও কান্ব এবং কৃষ্ণ যজুর্বেদ সংহিতার কাঠক,মৈত্রাণীয়,তৈত্তিরীয় শাখা।শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতার অপর নাম বাজসনেয়ী সংহিতা এবং কৃষ্ণ যজুর্বেদ সংহিতার অপর নাম তৈত্তিরীয় সংহিতা।

সামবেদ সংহিতাঃ 

সংহিতা বিভাগের তৃতীয় ভাগ হল সামবেদ সংহিতা। সাম’ শব্দের অর্থ হল গান।সামবেদ-সংহিতার মন্ত্রসংখ্যা ১৮১০টি। সামবেদ সংহিতা পদ্যে রচিত।সামবেদ সংহিতার দুইটি ভাগ- পূর্বার্চিক, উত্তরার্চিক।পূর্বার্চিকে অধ্যায়, খণ্ড ও মন্ত্র ক্রমে এবং উত্তরার্চিকে অধ্যায়, খণ্ড, সুক্ত ও মন্ত্র ক্রমে বিভক্ত।চরণব্যুহ গ্রন্থে সামবেদের ৭ টি শাখার পরিচয় পাওয়া যায়,যথা-রাণায়নীয়,শাত্যমুগ্র,কলাপ,মহাকলাপ,শার্দূল,লাঙ্গলায়ন এবং কৌথুম।বর্তমানে রাণায়নীর,কৌথুম এবং জৈমিনীয় এই তিনটি শাখা পাওয়া যায়।

অথর্ববেদ সংহিতাঃ 

সংহিতা বিভাগের চতুর্থ ভাগ হল অথর্ববেদ সংহিতা।অথর্ববেদ সংহিতায় রয়েছে ২০ টি কাণ্ড,৩৮ টি প্রপাঠক,৯০টি অনুবাক, ৭৩১টি সুক্ত এবং ৬০০০ টি মন্ত্র। অথর্ববেদ সংহিতা গদ্যে রচিত।অর্থববেদের ৯ টি শাখা রয়েছে। তবে বর্তমানে শৌনক এবং পিপ্পলাদ এই দুটি শাখা প্রচলিত। 

খ.ব্রাহ্মণঃ

পরমব্রহ্মের প্রীতি বিধানের নিমিত্তে বেদের যে বিভাগে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, উপাচার এবং এদের বিনিয়োগ সম্পর্কে যে গ্রন্থসমূহে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তাকে ব্রাহ্মণ বলা হয়।

প্রতিটি বেদের রয়েছে আছে, নিদির্ষ্ট কিছু কিছু ব্রাহ্মণ,আরন্যক এবং উপনিষদ।সে অনুসারে চারটি বেদের রয়েছে নিদির্ষ্ট কিছু ব্রাহ্মণ শাস্ত্র ।যেমন ঋগ্বেদীয় ব্রাহ্মণ হল ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ও কৌষীতকী ব্রাহ্মণ।কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় ব্রাহ্মণ হল তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ,শুক্ল যজুর্বেদীয় ব্রাহ্মণ হল শতপথ ব্রাহ্মণ।সামবেদীয় ব্রাহ্মণ হল ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ ও তাণ্ড্য ব্রাহ্মণ, অথর্ববেদীয় ব্রাহ্মণ হল গোপথ ব্রাহ্মণ।

গ. আরণ্যকঃ

অরণ্য অর্থাৎ নির্জন বনে একান্তভাবে অবস্থান করে যজ্ঞের রহস্য বর্ণনাকারী যে বিদ্যার পঠন-পাঠন, তার একত্রিত কিছু গ্রন্থসমূহকে আরণ্যক বলে ।আরন্যক হল বেদের তৃতীয় বিভাগ।ঋগ্বেদীয় ঐতরেয় ব্রাহ্মণের আরণ্যক হল ঐতরেয় আরণ্যক, শুক্ল যজুর্বেদীয় শতপথ ব্রাহ্মণের আরণ্যক হল বৃহদারন্যাক আরণ্যক,কৃষ্ণ যজুৰ্ব্বেদীয় তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের আরণ্যক হল তৈত্তিরীয় আরণ্যক।

ঘ.উপনিষদঃ

“উপ” উপসর্গের অর্থ হল নিকটে গমন করা ,”নি” উপসর্গের অর্থ হল নিশ্চয়ের সঙ্গে,”সদ” ধাতুর অর্থ হল অনর্থের বিনাশ। সুতারাং উপনিষদ শব্দের অর্থ হল পরমতত্ত্ব পরমেশ্বর ভগবান সমন্ধে জ্ঞান, যা শিষ্য গুরুর নিকট নিশ্চিতভাবে লাভ করে জাগতিক জীবনের সমস্ত অনর্থ থেকে মুক্তি লাভ করে। উপনিষদ হল বেদের সর্বশেষ বিভাগ।

মুক্তিকোপনিষদে ১/২৭-৩৬ নং মন্ত্রে ঈশোপনিষদ, কেন উপনিষদ, কঠোপনিষদ, প্রশ্নোপনিষদ,ঐতরেয় উপনিষদ,তৈত্তিরীয় উপনিষদ,মুন্ডক উপনিষদ,মান্ডূক্যোপনিষদ,বৃহদারন্যক উপনিষদ,ছান্দোগ্য উপনিষদ, গোপালতাপনী উপনিষদ,কৃষ্ণ উপনিষদ,কলির্সন্তরন উপনিষদ ইত্যাদি ১০৮ টি উপনিষদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

মুক্তিকোপনিষদ ১/৫১-৫৫ নং মন্ত্র অনুসারে ১০৮ টি উপনিষদকে চারটি বেদ অনুসারে বিভক্ত করা হয়েছে।মুক্তিকোপনিষদ ১/৫১-৫৫ নং মন্ত্র অনুসারে ১০টি ঋগ্বেদের উপনিষদ, শুক্ল-যজুর্বেদের ১৯টি উপনিষদ, কৃষ্ণ-যজুর্বেদের ৩২টি উপনিষদ, সামবেদের ১৬ টি উপনিষদ এবং অথর্ববেদের ৩১ টি উপনিষদ।

মুক্তিকোপনিষদ ১/৫১ নং মন্ত্র অনুসারে ঐতরেয় উপনিষদ হল ঋগ্বেদের অন্তর্গত।মুক্তিকোপনিষদ ১/৫২ নং মন্ত্র অনুসারে ঈশোপনিষদ, বৃহদারন্যক উপনিষদ এবং মুক্তিকোপনিষদ শুক্ল যজুর্বেদের অন্তর্গত।মুক্তিকোপনিষদ ১/৫৩ নং মন্ত্র অনুসারে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ,কলির্সন্তরন উপনিষদ, কঠোপনিষদ,তৈত্তিরীয় উপনিষদ এবং নারায়ন উপনিষদ হল কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্গত।মুক্তিকোপনিষদ ১/৫৪ নং মন্ত্র অনুসারে কেন উপনিষদ,ছান্দোগ্য উপনিষদ সামবেদের অন্তর্গত।মুক্তিকোপনিষদ ১/৫৫ নং মন্ত্র অনুসারে প্রশ্নোপনিষদ,মুন্ডকোপনিষদ,মান্ডূক্য উপনিষদ গোপালতাপনী উপনিষদ এবং কৃষ্ণোপনিষদ হল অর্থববেদের অন্তর্গত।

হরে কৃষ্ণ।প্রনাম 

গ্রন্থ সহায়তাঃ

১/ঋগ্বেদ সংহিতা  -রমেশচন্দ্র দত্ত অনূদিত।

২/শুক্ল যজুর্বেদ এবং কৃষ্ণ যজুর্বেদ  সংহিতা-শ্রীবিজনবিহারী গৌস্বামী অনুদিত ও সম্পাদিত।

৩/সামবেদ সংহিতা – পরিতোষ  ঠাকুর অনুদিত।

৪/অথর্ববেদ সংহিতা -শ্রীবিজনবিহারী গৌস্বামী অনুদিত ও সম্পাদিত।

৫/মুক্তিকোপনিষদ- শ্রীমহেশচন্দ্র পাল অনুদিত ও সম্পাদিত।

৬/হিন্দুধর্মের সারকথা-আকাশ বৈরাগী।

 

Sadgun Madhav Dash

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments