রাসলীলা’র অন্তর্নিহিত তাৎপর্য-(২য় পর্ব)

20250218_182307

আপ্তকাম, হৃষিকেশ(ইন্দ্রিয়াধিপতি), জগৎপতি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সর্বোৎকৃষ্ট নর-লীলা ‘রাস’।যা ইন্দ্রিয়তর্পণপরায়ণ সাধারণ মানুষের কাম-ক্রীড়ার মতো মনে হলেও বস্তুত তা জড়াতীত। কেননা এই ‘রাস’ কীর্তনের শ্রোতা-বক্তা উভয়েই ছিলেন সুব্রত(নিষ্ঠা সহকারে ব্রহ্মচর্য ব্রতাদি পালনকারী)।

উন্নতস্তরের মানুষের কাছে সহজেই বোধগম্য যে, ভগবানের অপ্রাকৃত লীলাবিলাস বিষয়ে অজ্ঞ মানুষদের মনেই কেবল এই সকল সন্দেহের উদয় হবে। তাই অনাদিকাল থেকেই মহান ঋষিবর্গ ও পরীক্ষিৎ মহারাজের মতো উন্নত রাজারা ভাবীকালের জন্য প্রামাণ্য উত্তর প্রস্তুত রাখবার উদ্দেশ্যে এই সমস্ত প্রশ্ন প্রকাশ্যেই উত্থাপন করেছিলেন। এ পর্বে আমরা শুকদেব-পরীক্ষিত মহারাজের সেই কথোপকথন শ্রবণ করবো। যা আলোচিত হয়েছে শ্রীমদ্ভাগবত এর ১০/৩৩/২৬-৩৬ শ্লোকে।

শ্রীপরীক্ষিদুবাচ 

সংস্থাপনায় ধর্মস্য প্রশমায়েতরস্য চ ।

অবতীর্ণো হি ভগবানংশেন জগদীশ্বরঃ ॥ ২৬ ॥

স কথং ধর্মসেতুনাং বক্তা কর্তাভিরক্ষিতা।

প্রতীপমাচরদ্ ব্রহ্মন্ পরদারাভিমর্শনম্ ॥ ২৭ ॥

অন্বয়: শ্রীপরীক্ষিৎ উবাচ – শ্রীপরীক্ষিৎ মহারাজ বললেন; সংস্থাপনায় – স্থাপন করার জন্য; ধর্মস্য – ধর্মের, প্রশমায় – দমন করার জন্য; ইতরস্য – অধর্মের; – এবং, অবতীর্ণঃ – অবতরণ করেন (পৃথিবীতে); হি – বস্তুত; ভগবান্ – পরমেশ্বর ভগবান; অংশেন – তাঁর অংশপ্রকাশ (শ্রীবলরাম) সহ; জগৎ – সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের, ঈশ্বরঃ – প্রভু; সঃ – তিনি; কথম্ – কিভাবে; ধর্ম-সেতুনাম্ – ধর্ম-মর্যাদার; বক্তা – বক্তা, কর্তা – কর্তা; অভিরক্ষিতা – স্বাক্ষক, প্রতীপম্ – বিপরীত; আচরৎ – আচরণ করলেন; ব্রাহ্মন্ – হে ব্রাহ্মহ্মণ, শুকদেব গোস্বামী, পর – অন্যদের, দার – পত্নীদের, অভিমর্শনম্ – স্পর্শ করলেন।

অনুবাদ: পরীক্ষিৎ মহারাজ বললেন-হে ব্রাহ্মণ, যিনি পরমেশ্বর ভগবান, জগদীশ্বর, ধর্ম সংস্থাপন ও অধর্মের বিনাশের জন্য যাঁর অংশপ্রকাশ সহ এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে যিনি সমাজধর্মের মূল বক্তা, কর্তা ও সংরক্ষক, তিনি তা হলে কিভাবে পরস্ত্রীদের স্পর্শ করে প্রতিকূল আচরণ করলেন?

ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য: শুকদেব গোস্বামী যখন বলছিলেন, তখন পরীক্ষিৎ মহারাজ লক্ষ্য করলেন যে, গঙ্গাতীরের সেই সমাবেশে উপবিষ্ট কিছু ব্যক্তি ভগবানের কার্যাবলী সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করছিলেন। এই সকল সন্দেহগ্রস্ত ব্যক্তিরা ছিল কর্মী, জ্ঞানী ও অন্যান্যরা, যারা ভগবানের ভক্ত নয়। তাদের সেই সন্দেহগুলি নিরসনের জন্য তাদের পক্ষ থেকে পরীক্ষিৎ মহারাজ এই প্রশ্নটি করেছিলেন।

আপ্তকামো যদুপতিঃ কৃতবান্ বৈ জুগুপ্সিতম্। 

কিমভিপ্রায় এতন্নঃ সংশয়ং ছিন্ধি সুব্রত ॥ ২৮ ॥ 

অন্বয়

আপ্তকামঃ-আত্ম-তৃপ্ত, যদুপতি- যদু বংশের অধিপতি, কৃতবান্- করলেন, বৈ-অবশ্যই। জুগুস্পিতম্-এই ধরনের নিন্দনীয়, কিম্-অভিপ্রায়ঃ-কি উদ্দেশ্যে, এতৎ-এই। নঃ-আমাদের, সংশয়ম্- সন্দেহ; ছিদ্ধি- ছেদন করুন, সুব্রত- হে নিষ্ঠাবান ব্রতপালনকারী। 

অনুবাদ 

হে নিষ্ঠাবান ব্রহ্মচারী, আত্মতৃপ্ত যদুপতি কি উদ্দেশ্যে এই ধরনের নিন্দিত আচরণ করেন, দয়া করে তা বর্ণনা করে আমাদের সন্দেহ অঞ্জন করুন। 

তাৎপর্য 

উন্নতস্তরের মানুষের কাছে সহজেই বোধগম্য যে, ভগবানের অপ্রাকৃত লীলাবিলাস বিষয়ে অজ্ঞ মানুষদের মনেই কেবল এই সকল সন্দেহের উদয় হবে। তাই অনাদিকাল থেকেই মহান ঋষিবর্গ ও পরীক্ষিৎ মহারাজের মতো উন্নত রাজারা ভাবীকালের জন্য প্রামাণ্য উত্তর প্রস্তুত রাখবার উদ্দেশ্যে এই সমস্ত প্রশ্ন প্রকাশ্যেই উত্থাপন করেছিলেন। 

 

শ্রীশুক উবাচ 

ধর্মব্যতিক্রমো দৃষ্ট ঈশ্বরাণাঞ্চ সাহসম্। 

তেজীয়সাং ন দোষায় বহ্নেঃ সর্বভুজো যথা ॥ ২৯ ॥ 

অন্বয়

শ্রীশুকঃ উৰাচ-শ্রীল শুকদেব গোস্বামী বললেন, ধর্ম-ব্যতিক্রমঃ–ধর্মনীতির ব্যতিক্রম; দৃষ্টঃ-দেখা যায়, ঈশ্বরাণাম্- শক্তিশালী নিয়ন্তাগণের, চ-ও, সাহসম্-দুঃসাহস, তেজীয়সাম্-চিন্ময়ভাবে তেজস্বী, ন-না, দোষায়-দোষের; বহ্নেঃ -অগ্নির; সর্ব-সর্ব, ভুজঃ-ভক্ষণ; যথা-যেমন। 

অনুবাদ 

শ্রীশুকদেব গোস্বামী বললেন-ঐশ্বরিক শক্তিমান নিয়ন্তাদের কার্যকলাপের মধ্যে আমরা আপাতদৃষ্টিতে সমাজনীতির দুঃসাহসিক ব্যতিক্রম লক্ষ্য করলেও, তাতে তাঁদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় না, কারণ তাঁরা আগুনের মতোই সর্বভুক হলেও নির্দোষ হয়ে থাকেন।

তাৎপর্য 

মহান তেজস্বী ব্যক্তিত্বগণ আপাতদৃষ্ট সমাজনীতি লঙ্ঘনের ফলে অধঃপতিত হন না। শ্রীধর স্বামী এই প্রসঙ্গে অন্যত্র ব্রহ্মা, ইন্দ্র, সোম, বিশ্বামিত্র ও অন্যান্যদের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। আগুন সবকিছুই ভক্ষণ করে, কিন্তু তার ফলে আগুনের প্রকৃতির কোন পরিবর্তন হয় না। তেমনই, মহান ব্যক্তির আচরণের কোনও অনিয়ম হলেও তাঁর মর্যাদাহানি হয় না। যাই হোক, পরবর্তী শ্লোকে শুকদেব গোস্বামী সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করেছেন যে, আমরা যদি ব্রহ্মাণ্ড শাসনকারী শক্তিমান পুরুষদের অনুকরণ করার চেষ্টা করি, তবে তার ফল হবে ভয়াবহ। 

 

নৈতৎ সমাচরেজ্জাতু মনসাপি হ্যনীশ্বরঃ। 

বিনশ্যত্যাচরন্মৌঢ্যাদ্‌ যথারুদ্রোহব্ধিজং বিষম্ ॥ ৩০ ॥ 

অন্বয়

ন-না, এতৎ- এই; সমাচরেৎ-অনুষ্ঠান করা উচিত; জাতু-কখনও; মনসা-মনে মনে; অপি-ও; হি-নিশ্চিতভাবে, অনীশ্বরঃ- যে ঈশ্বর নয়, বিনশ্যতি-বিনাশ প্রাপ্ত হয়; আচরন মৌঢ্যাৎ-মূঢ়তা প্রযুক্ত আচরণ করে; যথা-যেমন; অরুদ্রঃ-যে রুদ্রদেব নয়; অব্ধিজম্- সমুদ্র হতে উৎপন্ন; বিষম্-বিষ। 

অনুবাদ 

যে ঈশ্বর নয়, তার কখনই মনে মনেও ঈশ্বরের আচরণের অনুকরণ করা উচিত নয়। যদি মুঢ়তাবশত কোনও সাধারণ মানুষ এই ধরনের আচরণের অনুকরণ করে, তা হলে সে নিজেকেই কেবল ধ্বংস করবে, যেমন রুদ্রদেব না হয়েই রুদ্রের মতো সমুদ্রপরিমাণ বিষ পান করার চেষ্টার ফলে মানুষ নিজেকেই বংস করে। 

তাৎপর্য 

রুদ্র অর্থাৎ ভগবান শিব একবার সমুদ্রপরিমাণ বিষ পান করেছিলেন, আর তার ফলে এক আকর্ষণীয় নীল চিহ্ন তাঁর কণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু আমরা যদি তেমন বিষের এক ফোঁটাও পান করি, আমরা সঙ্গে সঙ্গে মারা যাব। তাই আমাদের যেমন শিবের লীলা অনুকরণ করা উচিত নয়, তেমনি গোপীগণের সঙ্গে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাদিও অনুকরণ করা উচিত নয়। আমাদের পরিষ্কারভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে যে, ধর্মসংস্থাপনের জন্য অবতীর্ণ ভগবান কৃষ্ণ আমাদের কাছে প্রতিপাদন করার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে যে, নিশ্চিতভাবে তিনিই ভগবান, আমরা নই। সেটি অবশ্যই স্পষ্টভাবে প্রদর্শিত হওয়া উচিত। ভগবান তাঁর অন্তরঙ্গা 

শক্তির সঙ্গে উপভোগ করেন আর এইভাবে আমাদের পারমার্থিক স্তরে আকর্ষণ করেন। আমাদের কৃষ্ণকে অনুকরণ করার চেষ্টা করা উচিত নয়, কারণ তা হলে অপরিসীম দুঃখ পেতে হবে। 

ঈশ্বরাণাং বচঃ সত্যং তথৈবাচরিতং ক্বচিৎ। 

তেষাং যৎ স্ববচোযুক্তং বুদ্ধিমাংস্তৎ সমাচরেৎ ॥ ৩১ ॥ 

অন্বয়

ঈশ্বরাণাম্-পরমেশ্বর ভগবানের শক্তি প্রদত্ত সেবক, বচঃ-কথা; সত্যম্- সত্য, তথা এব-ও, আচরিতম্- তারা যা করে, কচিৎ-কখনও, তেষাম্-তাদের। যৎ- যাঃ স্ব বচঃ –তাদের নিজ কথার সঙ্গে, যুক্তম- সামঞ্জস্যপূর্ণ, বুদ্ধিমান- যিনি বুদ্ধিমান; তৎ-সেই, সমাচরেৎ-পালন করা উচিত। 

অনুবাদ 

পরমেশ্বর ভগবানের শক্তিপ্রদত্ত সেবকদের কথা সকল সময়েই সত্য আর সেই কথার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তাঁদের আচরণ অনুকরণযোগ্য। অতএব তাঁদের নির্দেশ পালন করা বুদ্ধিমান ব্যক্তিগণের উচিত। 

তাৎপর্য 

ঈশ্বর শব্দটাকে সচরাচর সংস্কৃত অভিযানে “প্রভু, পরিচালক, রাজ্য” এবং “সমর্থ, সম্পাদনে ক্ষমতাসম্পন্ন” রূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। শ্রীল প্রভুপাদ সাধারণত ঈশ্বর শব্দটিকে “নিয়ন্তা” রূপে অনুবাদ করতেন যা চমৎকারভাবে “পরিচালক বা রাজা” এবং “সমর্থ ব্য সম্পাদনে ক্ষমতাসম্পন্ন” মুখ্যত এই দুই প্রাথমিক ধারণারই সমন্বয় সাধন করে। কোনও পরিচালক অযোগ্য হতে পারেন কিন্তু একজন নিয়ন্ত্রক হন তিনিই, যিনি প্রভু বা পরিচালকরূপে প্রকৃতপক্ষে ঘটনাটিকে সংঘটিত করান। সর্বকারণের পরম কারণ ভগবান কৃষ্ণ নিশ্চিতভাবেই তাই পরমনিয়ন্তা বা পরমেশ্বর। 

ঈশ্বর বা শক্তিমান পুরুষেরা যে আমাদের ব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করেন, সেই বিষয়ে সাধারণ মানুষেরা, বিশেষত পশ্চিমী দেশগুলিতে সচেতন নন। ব্রহ্মাণ্ড সম্বন্ধে আধুনিক নির্বিশেণবাদী ধারণা অনুযায়ী বর্ণনা করা হয় যে, প্রাণহীন মহাজগতে পৃথিবী অনর্থক ভাসছে। এইভাবে আমরা জীবনের এক অনিশ্চিত চরম লক্ষ্য নিয়েই নিজেদের সংরক্ষণ করছি আর বংশরক্ষার প্রক্রিয়ায় জন্ম দিচ্ছি এবং পরের পর নিজস্ব ‘চরম লক্ষ্য’ সংরক্ষণ ও জন্মদানের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থেকে একটি অর্থহীন ঘটনাশৃঙ্খল বা ধারা তৈরি হয়ে চলেছে। 

অজ্ঞ জড়বাদীদের উদ্ভাবিত এই ধরনের নিখালা এবং অর্থহীন জগতের তুলনায় যে প্রকৃত মহা-জগৎ রয়েছে, তা জীবন প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ এবং সবিশেষ ব্যক্তি জীবন এবং প্রকৃতপক্ষে ভগবানের অস্তিত্বে পরিপূর্ণ, যে ভগবান এই সকল অস্তিত্ব ধারণ করে আছেন ও পালন করছেন। পরমেশ্বর ভগবান এবং তাঁর সঙ্গে আমাদের মত্যে অসংখ্য জীবনের ব্যক্তিগত সম্পর্কই প্রকৃত সত্যের সার। কিছু জীব জড়বাদের মায়ার ফাঁদে তার জড় দেহটিকে নিজের পরিচয় মনে করে, তখন অন্যান্যরা মুক্ত চিন্তায়, উপলব্ধি করে যে, তাদের চেতনা নিত্য ও দিব্য প্রকৃতির। এছাড়াও তৃতীয় এক শ্রেণীর মানুষ অজ্ঞতার জড়বাদী অবস্থান থেকে আত্মোপলব্ধির পথে কৃষ্ণভাবনামৃতের আলোকিত পর্যায়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। 

শেষপর্যন্ত সত্য হচ্ছেন রূপময় ও দিব্য। তাই এটা বিস্ময়ের নয় যে বৈদিক সাহিত্য আমাদের কাছে প্রকাশ করেছেন, আমাদের ব্রহ্মাণ্ড এবং অন্যান্য ব্রহ্মাণ্ডগুলিও মহান বাক্তিত্বদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, ঠিক যেমন আমাদের নগর, রাজ্য দেশ ক্ষমতা প্রদত্ত ব্যক্তিত্বদের দ্বারা পরিচালিত হয়। আমরা যখন গণতান্ত্রিকভাবে কোন নির্দিষ্ট রাজনীতিবিদকে শাসন করার ক্ষমতা প্রদান করি, আমরা তাঁকে ভোট প্রদান করি কেননা আমরা যাকে ‘নেতৃত্ব’ বা সমর্থতা বলি তিনি তা প্রদর্শন করেছেন। আমরা ভাবি “তিনি কাজটি করতে পারবেন”। অন্যভাবে বলতে গেলে আমরা তাকে নির্বাচিত করার পরেই কেবল কেউ শাসন করার ক্ষমতা অবনি করতে পারে। আমাদের নির্বাচন তাকে নেতা তৈরী করে না বরং অন্য কোন উৎস হতে তার মধ্যে সঞ্চারিত কোন শক্তিই তাকে পরিচিত করায়। তাই, ভগবদ্গীতার দশম অধ্যায়ের শেষে ভগবান কৃষ্ণ বর্ণনা করেছেন, যে কোন জীব দ্বারা প্রদর্শিত অসাধারণ ক্ষমতা, সমর্থতা বা কর্তৃত্ব অবশ্যই স্বয়ং ভগবান বা তাঁর শক্তি দ্বারা প্রদত্ত। 

যারা প্রত্যক্ষভাবে ভগবানের দ্বারা শক্তিপ্রদত্ত তারা তাঁর ভক্ত আর তাই তাদের শক্তি ও প্রভাব জগৎ জুড়ে মঙ্গলময়তার প্রসার ঘটায়। কিন্তু যারা ভগবানের মায়া শক্তি দ্বারা শক্তি প্রদত্ত, তারা কৃষ্ণের সঙ্গে অপ্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত, কারণ তাঁরা সরাসরিভাবে ভগবানের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটান না। অবশ্যই তাঁরা অপ্রত্যক্ষভাবে কৃষ্ণের ইচ্ছাকেই প্রতিফলিত করেন, কারণ কৃষ্ণের ব্যবস্থাপনাতেই অজ্ঞ জীবের উপর প্রকৃতির নিয়ম ক্রিয়াশীল, যা তাদের অনেক জন্মের যাত্রাপথের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তাদের পরমেশ্বর ভগবানের কাছে শরণাগত হতে প্ররোচিত করে। এইভাবে তারা রাজনীতিবিদ রূপে জড়বাদ অনুসারী ব্যক্তিদের জন্য যুদ্ধ সৃষ্টি করে, মিথ্যা আশ্য ও অসংখ্য আবেগপ্রবণ কর্মসূচীর পরিকল্পনা করে প্রকৃতপক্ষে বদ্ধজীবদের জন্য অনুমোদিত, ভগবৎহীনতার তিক্তফলের অভিজ্ঞতা অর্জনের ভগবান আয়োজিত অনুষ্ঠানের সম্পাদন করছেন। 

ঈশ্বরাণাম্ শব্দটিকে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর এইভাবে অনুবাদ করেছেন “যাঁরা জ্ঞান ও বৈরাগ্য দ্বারা সমর্থবান হয়েছেন”। যদি কেউ ভগবানের ইচ্ছা ও প্রকৃতিকে হৃদয়ঙ্গম করে পারমার্থিক জীবনে পরমোৎকর্ষতা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত ত্যাগ স্বীকার করেন তবে পরমেশ্বর ভগবানের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তিনি তাঁর দ্বারা ক্ষমতাপ্রদত্ত হন, যা তিনি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে স্বীকার করে নিয়ে গ্রহণ করেন। 

ধর্মাচরণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত প্রদর্শনের জন্য পরমেশ্বর ভগবান কৃপা করে এই পৃথিবীতে অবতরণ করেন। ভগবদগীতায় (৩/২৪) শ্রীকৃষ্ণ যেমন বলছেন “আমি যদি কর্ম না করি তাহলে এই সমস্ত জগৎ বিনষ্ট হবে।” তাই কিভাবে এই জগতে যথাযথভাবে কর্ম করতে হয়, ভগবান তা তাঁর বিভিন্ন অবতারে প্রদর্শন করেছেন। এমনই একটি ভাল উদাহরণ ভগবান রামচন্দ্র, যিনি দশরথ পুত্ররূপে অপূর্ব আচরণ করেছিলেন।

কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ যখন স্বয়ং অবতরণ করেন তখন, পরমেশ্বর ভগবান যে সর্ব জীবের অতীত এবং কেউ তাঁর পর অবস্থানের অনুকরণ করতে পারে না-তিনি সেই চুড়ান্ত ধর্মনীতি প্রতিপাদন করেছেন। ভগবান যে অদ্বিতীয়, অসমোর্ধ্ব-সেই সর্বোত্তম ধর্মনীতি গোপীগণের সঙ্গে দৃশ্যত অনৈতিক লীলায় শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্টভাবে প্রদর্শন করেছেন। শ্রীল শুকদেব গোস্বামী এখানে বর্ণনা করেছেন যে, ভয়ঙ্কর ফল ভোগ ছাড়া কেউই এই সকল কার্যাবলী অনুকরণ করতে পারে না। যে মনে করে যে শ্রীকৃষ্ণ একজন কামভাবাপন্ন সাধারণ জীব অথবা যে তাঁর রাসনৃত্য চমৎকার বলে মনে করে তা অনুকরণ করার চেষ্টা করে, এই অধ্যায়ের শ্লোক ৩০’এর বর্ণনা অনুযায়ী সে অবশ্যই বিনাশপ্রাপ্ত হবে। 

অবশেষে, ভগবান ও তাঁর ক্ষমতাত্মাপ্ত ভূত্যের মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য রয়েছে। ভগবানের কোনও ক্ষমতাপ্রাপ্ত ভৃত্য, যেমন ব্রহ্মার ক্ষেত্রে, কর্মের বিধান অনুযায়ী তাঁর প্রারব্ধ কর্মের প্রতিক্রিয়ার অবশিষ্টাংশ ভোগ করেন। কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান কর্ম-বিধানের যে কোন রকম বন্ধন থেকে নিত্যমুক্ত অদ্বিতীয় স্তরে অধিষ্ঠিত।

 

কুশলাচরিতেনৈষামিহ স্বার্থো ন বিদ্যতে। 

বিপর্যয়েণ বানর্থো নিরহঙ্কারিণাং প্রভো । ৩২ ॥ 

অন্বয়

কুশল-পুণ্য; আচরিতেন-আচরণ, এষাম্-তাদের জন্য। ইহ-এই জগৎ, স্ব-অর্থঃ–স্বার্থ, ন বিদ্যতে- নেই, বিপর্যয়েণ– ধর্ম-মর্যাদা লঙ্ঘনের জন্যও; বা- বা, অনর্থঃ-অনর্থ; নিরহঙ্কারিণাম্- যিনি অহঙ্কারমুক্ত, প্রভো-হে প্রভু।

অনুবাদ 

হে প্রভু, এই সকল নিরহঙ্কারী বিরাট পুরুষেরা যখন এই জগতে পুণ্য কর্ম করেণ, তাঁদের কোন স্বার্থ পূরণের উদ্দেশ্য থাকে না এবং এমন কি যখন তাঁরা ধর্মাচরণের বিপরীত কোন অসৎ আচরণ করেন, তাঁদের কোন অনর্থ হয় না। 

 

কিমুতাখিলসত্ত্বানাং তির্যঙ্‌মর্ত্যদিবৌকসাম্। 

ঈশিতুশ্চেশিতব্যানাং কুশলাকুশলান্বয়ঃ । ৩৩ ॥ 

অন্বয়

কিম্ উত-আর কি বলার আছে, অখিল-সমস্ত, সত্ত্বানাম্-সৃষ্ট বস্তুর; তির্যক-প্রাণী; মর্ত্য- মানুষ; দিব ওকসাম্-দেবতাগণের, ঈশিতুঃ-নিয়ন্তার, চ-এবং, ঈশিতব্যানাম্-যারা নিয়ন্ত্রিত, কুশল-পুণ্য, অকুশল-পাপ, অন্বয়ঃ– কারণস্বরূপ কোন সম্বন্ধ। 

অনুবাদ 

তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন জীবসমূহকে প্রভাবিতকারী ধর্মাচরণ ও অধর্মাচরণের সঙ্গে তা হলে কিভাবে প্রাণী, মানুষ দেবতা ও নিখিল জীবের অধীশ্বরের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে? 

তাৎপর্য 

শ্লোক ৩২’এ বর্ণনা করা হয়েছে যে, ভগবানের দ্বারা শক্তিপ্রদত্ত বিরাট ব্যক্তিত্বগণও কর্মের বিধান থেকে মুক্ত। তা হলে আর স্বয়ং ভগবানেরই কথা আর বলার কী আছে। তাঁর দ্বারা সৃষ্ট কর্মের বিধানগুলি তাঁর সর্বশক্তিমান ইচ্ছার প্রকাশ। তাই তাঁর নিজ শুদ্ধ গুণবশত অনুষ্ঠিত তাঁর কার্যাবলী কখনও সাধারণ জীব দ্বারা সমালোচনার বিষয় হতে পারে না। 

যৎপাদপঙ্কজপরাগনিষেবতৃপ্তা 

যোগপ্রভাববিধুতাখিলকর্মবন্ধাঃ। 

স্বৈরং চরন্তি মুনয়োহপি ন নহ্যমানাস্ 

তস্যেচ্ছয়াত্তবপুষঃ কুত এব বন্ধঃ । ৩৪ ॥ 

অন্বয়

যৎ-যাঁর; পাদপঙ্কজ-চরণকমলদ্বয়; পরাগ- রেণুর; নিষেব-সেবা দ্বারা, তৃপ্তাঃ -পরিতৃপ্ত, যোগ-প্রভাব–যোগপ্রভাবে, বিধৃত-বিমুক্ত, অখিল-সমস্ত; কর্ম-কর্ম, বন্ধাঃ-বন্ধন, স্বৈরম্- স্বাধীনভাবে, চরন্তি-বিচরণ করছে, মুনয়ঃ-মুনিগণ অপি-ও: ন-কখনও না; নহ্যমানাঃ-বন্ধনপ্রাপ্ত, তস্য-তাঁর, ইচ্ছয়া-স্বেচ্ছাপূর্বক, আপ্ত-গৃহীত। বপুষঃ-অপ্রাকৃত শরীর, কুতঃ-কিভাবে; এব-বস্তুত, বন্ধঃ-বন্ধন। 

অনুবাদ 

পরমেশ্বর ভগবানের পাদপদ্ম রেণুর সেবা দ্বারা পূর্ণ-তৃপ্ত তাঁর ভক্তগণ কখনও জড় কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হন না। এমন কি যোগপ্রভাবে সকল কর্মবন্ধন হতে মুক্ত মুনিগণও জড়কর্ম বন্ধনে আবদ্ধ নন। তা হলে যিনি স্বেচ্ছাপূর্বক অপ্রাকৃত শরীর ধারণ করেছেন স্বয়ং সেই ভগবানের বন্ধনের প্রশ্ন কিভাবে হতে পারে? 

 

গোপীনাং তৎপতীনাং চ সর্বেষামেব দেহিনাম্। 

যোহন্তশ্চরতি সোহধ্যক্ষঃ ক্রীড়নেনেহ দেহভাক্ ॥ ৩৫ ॥ 

অন্বয়

গোপীনাম্-গোপীগণের; তৎ-পত্রীনাম্–তাঁদের পতিদিগের, চ-এবং, সর্বেষাম্-সকল, এব-বস্তুত: দেহিনাম্-প্রাণীগণের, যঃ-যিনি, অন্ত-মধ্যে, চরতি-বাস করেন, সঃ-তিনি। অধ্যক্ষঃ- সর্বসাক্ষী, ক্রীড়নেন-ক্রীড়ায়, ইহ-এই জগতে; দেহ- তাঁর দেহ; ভাক্-বারণ করেছেন। 

অনুবাদ 

যিনি সর্বসাক্ষীরূপে গোপীগণ, তাঁদের পতিগণ এবং প্রকৃতপক্ষে সকল প্রাণীর অন্তরে বাস করেন, তিনিই অপ্রাকৃত লীলাবিলাসের জন্য এই জগতে দেহ ধারণ করেছেন

তাৎপর্য 

আমরা নিশ্চয়ই ভগবানের মতো অপ্রাকৃত লীলাবিলাসের উদ্দেশ্যে আমাদের এই দেহ ধারণ করিনি। এই জড় আগতকে ভোগ করার মুঢ় প্রচেষ্টার জন্য, আমরা নিত্য আত্মাগণ, এই জড় দেহ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি। ভগবানের দেহ সর্বতোভাবে নিত্য-চিন্ময় অস্তিত্ব স্বরূপ এবং আমাদের অনিতা মাংসরাশির সঙ্গে কোনভাবেই সমপর্যায়ভুক্ত নয়। 

যেহেতু পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের মধ্যে, তাঁদের তথাকথিত পতিদের মধ্যে এবং অন্যান্য সকল জীবের মধ্যে বাস করেন, তা হলে তাঁর সৃষ্ট কিছু জীবদের আলিঙ্গন করার জন্য তাঁর কি এমন পাপ হতে পারে? তাই ভগবান যদি গোপীদের নিয়ে কোন গোপন স্থানে যান, তাতেই বা তাঁর কি দোষ, যেহেতু তিনি এর চেয়েও গোপন স্থান, জীবের হহৃদয়ের গভীরে ইতিমধ্যেই বাস করছেন?

অনুগ্রহায় ভক্তানাং মানুষং দেহমাশ্রিতঃ। 

ভজতে তাদৃশীঃ ক্রীড়া যাঃ শ্রুত্বা তৎপরো ভবেৎ । ৩৬ ॥ 

অন্বয়

অনুগ্রহায়- অনুগ্রহ প্রদর্শন করার জন্য, ভক্তানাম্-ভক্তদের; মানুষম্-মানুষের মতো, দেহম্- দেহ, আশ্রিতঃ-গ্রহণ করে: ভজতে- তিনি উপভোগ করেন; তাদৃশীঃ- সেই রূপ, ক্রীড়াঃ-লীলা বিলাস, যাঃ-যা; শ্রুত্বা- শ্রবণ করে, তৎ-পরঃ–সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণসেবাপরায়ণ, ভবেৎ–অবশ্যই হওয়া উচিত। 

অনুবাদ 

তাঁর ভক্তকে কৃপা করবার জন্য ভগবান যখন মনুষ্য দেহ ধারণ করেন, তখন তিনি এরূপ লীলাবিলাসে যুক্ত হন যা সেই লীলাবিলাস শ্রবণকারীকে আকর্ষিত করে তাঁর প্রতি সেবাপরায়ণ করে তোলে। 

তাৎপর্য

এই বিষয়ে শ্রীপ জীব গোস্বামী বর্ণনা করেছেন যে, শীকৃষ্ণ যখন এই জগতে তাঁর মূল দ্বিভুজ রূপে অবতীর্ণ হন, মানব সমাজে আবদ্ধ তাঁর ভক্তদের প্রতি কৃপা পরবশ হয়ে তিনি সেই রূপেরই প্রকাশ করেন যা তারা প্রত্যক্ষ করে হহৃদয়ঙ্গম করতে পারবে। এইজন্য এখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানুষং দেহমাশ্রিতঃ “তিনি মনুষ্যতুলা দেহ ধারণ করেন”। শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর ভগবানের প্রণয়-লীলা-মহিমা কীর্তন করে উল্লেখ করছেন যে, এই সকল প্রণয় ঘটনাসমূহের, বন্ধ জীবের কলুষিত হৃদয়কে আকর্ষণ করার জন্য একটি অচিন্তনীয় অপ্রাকৃত শক্তি রয়েছে। এই সত্য অস্বীকার করা যাবে না যে, কোন শুদ্ধ ও সরল হৃদয়ের ব্যক্তি, যিনি কৃষ্ণের প্রণয়লীলার বিবরণ শ্রবণ করেন, তিনি ভগবানের পাদপদ্মের প্রতি আকর্ষিত হয়ে ধীরে ধীরে তাঁর ভক্ত হয়ে যান।

————————————————————————————————————————————————


ইতি টানছি শ্রীমদ্ভাগবতের আরও একটি শ্লোক দিয়ে— 

শ্রীমদ্ভাগবতের (১/৫/৩৩) প্রথম স্কন্ধে নারদ মুনি বলছেন-

আময়ো যশ্চ ভূতানাং জায়তে যেন সুব্রত ।

তদেব হ্যাময়ং দ্রব্যং ন পুনাতি চিকিৎসিতম্ ॥

“হে সুকৃতিবান্, যে দ্রব্যের প্রভাবে রোগ জন্মায়, সেই দ্রব্যই যখন অন্য দ্রব্য বা ঔষধের সঙ্গে রসায়ন-যোগে মিশ্রিত হয়, তখন তা গ্রহণ করার ফলে সেই রোগের কি নিবৃত্তি হয় না?” এইভাবে শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়লীলাসমূহ শুদ্ধ ও চিন্ময় ক্রিয়া হওয়ায় তা শ্রবণকারীর জাগতিক কামনার ব্যাধি আরোগ্য লাভ করে।

 

হরে কৃষ্ণ।

Navanila

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments