আত্মারাম পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা নিয়ে বদ্ধজীবের মনে সংশয়ের অন্ত নেই। তার মধ্যে একটি সংশয় বড়ই আশ্চর্যের যে, ব্রজগোপিকাদের নিয়ে শারদ রাতে নৃত্যরত রসিকেন্দ্রচূড়ামণি, রাসেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ যাদের আরাধ্য ভগবান, রাসলীলা যাদের পাঠ্যবিষয়, তারা কীভাবে বৈরাগ্য শিক্ষা লাভ করে?
বস্তুত দেখা যায় যে, এই রাসলীলা যাদের পরম আদরণীয় বিষয়, তারা তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে বৈরাগ্যবিদ্যা চর্চা করেন এবং ব্রহ্মচর্যব্রত, সন্ন্যাস আশ্রম অবলম্বন করেন।
তাই, রাসলীলা শ্রবণ-কীর্তন করে কিভাবে বৈষ্ণবগণ তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে ‘অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ বর্জন’ আদি কঠোর ব্রত গ্রহণ করেন, সেই রহস্য উন্মোচন করা হবে এই ১ম পর্বে।
এই পর্বে উওর প্রদান করেছেন শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের শিষ্যবৃন্দ শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩০/৩৪ এর ভাষ্যে:
রেমে তয়া স্বাত্মরত আত্মারামোহপ্যখণ্ডিতঃ ।
কামিনাং দর্শয়ন্ দৈন্যং স্ত্রীণাঞ্চৈব দুরাত্মতাম্ ॥
অন্বয়ঃ রেমে – তিনি বিহার করেছিলেন; তয়া – তাঁর সঙ্গে; চ – এবং; আত্ম-রতঃ – স্ব-ক্রীড়; আত্ম-আরামঃ – আত্মসন্তুষ্ট; অপি – যদিও; অখণ্ডিতঃ – স্বয়ংসম্পূর্ণ; কামিনাম্ – সাধারণ কামুক মানুষের; দর্শয়ন্ – প্রদর্শনের জন্য; দৈন্যম্ – দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা; স্ত্রীণাম্ – সাধারণ নারীদের; চ এব – ও; দুরাত্মতাম্ – দুরাত্মতা।
অনুবাদ: [শুকদেব গোস্বামী বলতে থাকেন] ভগবান কৃষ্ণ স্ব-ক্রীড়, আত্মারাম ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ কামুক মানুষের দুর্দশা ও নারীদের দুরাত্মতা প্রদর্শনের জন্য সেই গোপীর সঙ্গে বিহার করেছিলেন।
তাৎপর্য: জড়জাগতিক মানুষেরা কখনও শ্রীকৃষ্ণের লীলার যে বিরুদ্ধ সমালোচনা করে থাকে, এই শ্লোকে সরাসরি তা খণ্ডন করা হয়েছে। দার্শনিক অ্যারিস্টটল সাধারণ কার্যকলাপ সবই ভগবানের অযোগ্য বলে দাবী করেছিলেন এবং কিছু মানুষ এই ধারণা পোষণ করার ফলে ঘোষণা করে যে, ভগবান কৃষ্ণের কার্যকলাপ যেহেতু সাধারণ মানুষের মতো, তাই তিনি স্বয়ং কখনও পরমব্রহ্ম হতে পারেন না।
কিন্তু এই শ্লোকে শুকদেব গোস্বামী দৃঢ়ভাবে বলছেন যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পারমার্থিক আত্ম-সন্তুষ্টির মুক্ত স্তরে ক্রিয়া করেন। এই সত্যটি আত্ম-রত, আত্মারাম, এবং অখণ্ডিত শব্দ গুলির মাধ্যমে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বন-জ্যোৎস্নায় আবেগপ্রবণ প্রণয় উপভোগকারী এক সুন্দর বালক এবং এক সুন্দরী বালিকা স্বার্থপর কামনা-বাসনারহিত শুদ্ধ কর্মে যুক্ত হতে পারে, সাধারণ মানুষের কাছে তা অচিন্তনীয়। যদিও ভগবান কৃষ্ণ সাধারণ মানুষদের কাছে অচিন্তনীয়, কিন্তু যারা তাঁকে ভালোবাসে, তারা সহজেই তাঁর লীলার পরম শুদ্ধতা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে।
কেউ হয়ত বলতে পারে যে, “সৌন্দর্য তো দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার!”, আর তাই কৃষ্ণভক্তগণ ভগবানের কার্যকলাপকে শুদ্ধ বলে কল্পনা করছেন। এই যুক্তি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ সত্যকে অবজ্ঞা করছে। যেমন প্রথম হল, কৃষ্ণপ্রেমে উন্নত হবার জন্য কৃষ্ণভাবনামৃতের পথে একজন ভক্তকে কঠোরভাবে চারটি বিধি নিষেধ পালন করতে হয় – অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ করা চলবে না, কোন রকম জুয়াখেলা চলবে না, কোন নেশা করা চলবে না এবং মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি আমিষাহার করা চলবে না। কেউ যখন জাগতিক কামনা থেকে মুক্ত হয়ে জাগতিক আকাঙ্ক্ষার অতীত এক মুক্ত স্তরে উন্নীত হন, তখন তিনি শ্রীকৃষ্ণের পরম সৌন্দর্য হৃদয়ঙ্গম করেন। এটি কোন তাত্ত্বিক পন্থা নয়, কৃষ্ণভাবনামৃতের পথ সম্বন্ধে উজ্জ্বল দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা রেখে গেছেন যে শত-সহস্র মহান ঋষিগণ, তাঁরা এটি সম্পূর্ণ অভ্যাসের মাধ্যমে আয়ত্ত করেছিলেন।
একথা ঠিকই যে, দ্রষ্টার দৃষ্টিভঙ্গির উপর সৌন্দর্য নির্ভর করে। কিন্তু প্রকৃত সৌন্দর্য জাগতিক দেহের কামুক চোখে নয়, আত্মার চোখে অনুভূত হয়। তাই, বৈদিক শাস্ত্রে বারে বারে দৃঢ়ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, জাগতিক আকাঙ্ক্ষা হতে মুক্তজনেরাই কেবল তাঁদের ভগবৎ-প্রেমের অঞ্জনে চর্চিত শুদ্ধ-আত্মার চোখ দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের সৌন্দর্য দর্শন করতে পারেন। অবশেষে লক্ষ্য করা যেতে পারে যে, শ্রীকৃষ্ণের লীলাসমূহ হৃদয়ঙ্গম করার মাধ্যমেই মানুষ জাগতিক ইন্দ্রিয়ের বিষয়গত সকল ইন্দ্রিয় বাসনার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেন।
পরিশেষে, চূড়ান্তভাবে বলা যায়, শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়লীলা তাঁর পরমতত্ত্বের যোগ্যতা অনুযায়ী যথাযথ। বেদান্তে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পরম ব্রহ্ম সমস্ত কিছুর মূল উৎস। তাই, জড় জগতের কোন সুন্দর বস্তু পরমতত্ত্বে নেই, তা হতে পারে না। যেহেতু জড় জগৎ চিৎজগতের বিকৃত প্রতিফলন, তাই পরমতত্ত্বে শুদ্ধ, অপ্রাকৃতরূপে অধিষ্ঠিত প্রণয় বিষয়ও এই জগতে তার বিকৃত, জাগতিক রূপে প্রকাশিত হতে পারে। তাই, এই জগতের প্রতিভাত সৌন্দর্যকে চরমে পরিত্যাগ না করে, বরং তাকে তার শুদ্ধ অপ্রাকৃত রূপে গ্রহণ করা উচিত।
অনাদি কাল হতে স্ত্রী ও পুরুষেরা প্রণয়কলা দ্বারা কাব্যিক আনন্দে উৎসাহিত হয়েছেন। দুর্ভাগ্যবশত, এই জগতে প্রণয় আমাদের হতাশা-ধ্বস্ত করে আমাদের হৃদয়ের পরিবর্তন কিম্বা মৃত্যু ঘটায়। এইভাবে প্রণয় বিষয়টিকে প্রথমত সুন্দর ও উপভোগ্যরূপে দেখা গেলেও, পরিশেষে তা জাগতিক প্রকৃতির প্রচণ্ড আক্রমণের ফলস্বরূপ নষ্ট হয়। তবুও প্রণয়ের ধারণাকে সামগ্রিকভাবে পরিত্যাগ করা অযৌক্তিক। বরং, স্বার্থপরতা বা জাগতিক কামে রঞ্জিত না করে প্রণয় আকর্ষণ যে ভাবে ঈশ্বরের মাঝে বিদ্যমান, সেই পরম, পূর্ণ, শুদ্ধ স্বরূপে আমাদের তা গ্রহণ করা উচিত। সেই পরম প্রণয় আকর্ষণ, পরম সত্যের পরম সৌন্দর্য ও আনন্দকে আমরা শ্রীমদ্ভাগবতের পাতায় পাতায় পাঠ করছি।
।। হরে কৃষ্ণ ।।
[ বি:দ্র: স্বধর্মম্ – এর অনুমোদন ব্যতীত এই গবেষণামূলক লেখার কোনো অংশ পুনরুৎপাদন, ব্যবহার, কপি পেস্ট নিষিদ্ধ। স্বধর্মম্ – এর সৌজন্যে শেয়ার করার জন্য উন্মুক্ত ]