চিন্ময় জগৎ কি? চিন্ময় জগত বা ভগবদ্ধাম সম্পর্কে আলোচনা করুন।

FB_IMG_1739761115449

চিন্ময় জগতঃ

 শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা শাস্ত্রে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ  দুটি জগতের কথা বর্ণনা করেন-
অপরা প্রকৃতি বা জড় জগৎ এবং পরা প্রকৃতি
বা চিন্ময় জগৎ।চতুর্দশ ভূবন সমন্বিত যেখানে আমরা বর্তমানে বসবাস করছি, সেটিকে বলা হয় জড় জগৎ বা অপরা প্রকৃতি।আর এ জড় জগতের বিপরীতে রয়েছে সমগ্র জীবের পরম গন্তব্য পরা প্রকৃতি বা চিন্ময় জগৎ।সে চিন্ময় জগতকে ভগবদ্ধাম বা ভগবানের ধামও বলা হয়। সেই চিন্ময় জগতে নিত্য আনন্দ বর্তমান।সেখানে সমস্ত
জীব জন্ম,মৃত্যু, জরা, ব্যাধি,ত্রিতাপ ক্লেশ (আদিভৌতিক,আদিদৈবিক, আধ্যত্মিক) থেকে সর্বদা মুক্ত।

        অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধিমে পরাম্

জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ।।

             -(গীতা ৭/৫ঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)

অনুবাদঃ হে মহাবাহো! এই অপরা প্রকৃতি ( জড় জগৎ) ব্যতীত আমার আর একটি পরা প্রকৃতি(চিন্ময় জগৎ) রয়েছে। সেই প্রকৃতি চৈতন্য-স্বরূপা ও জীবভূতা; সেই শক্তি থেকে সমস্ত জীব নিঃসৃত হয়ে এই জগৎকে ধারণ করে আছে।”

কৃষ্ণ যজুর্বেদীয়  কঠ উপনিষদ শাস্ত্রেও  চিন্ময় জগত সম্পর্কে বলা হয়েছে..

ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোহয়মগ্নিঃ।তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।।

                 – (কঠ উপনিষদ ২/২/১৫)

অনুবাদঃ চিন্ময় জগতে সূর্য প্রকাশিত হয় না,চন্দ্র ও তাঁরাগনও সেখানে প্রকাশিত হয় না,এমনকি বিদ্যুৎও ঝলকায় না,তাহলে এই লৌকিক অগ্নিই কিভাবে সেখানে  প্রকাশিত হতে পারে, তার প্রকাশের দ্বারাই সমস্ত (সূর্য চন্দ্র তারকাদি) কিছু প্রকাশিত হয়,তার জ্যোতিতেই সম্পূর্ণ চিন্ময় জগৎ প্রকাশিত হয়।”

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান, ব্রহ্মসংহিতা সহ বিভিন্ন সনাতনী শাস্ত্র অনুসারে  চিন্ময় জগতের সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে গোলক বৃন্দাবন নামক কৃষ্ণলোক, যেখানে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তারই অভিন্ন প্রকাশ শ্রীমতি রাধারাণী, বলরাম সহ অসংখ্য ভক্তবৃন্দ দ্বারা পরিবৃত।গোলক বৃন্দাবনের অধোদিকে  বৈকুন্ঠলোক,এই বৈকুন্ঠ লোকে ভগবান শ্রীনারায়ন মাতা লক্ষ্মী সহ অসংখ্য ভক্তবৃন্দ দ্বারা পরিবৃত। এরপর রয়েছে শিবলোক,এখানে ভগবান সদাশিব, যিনি স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু তিনি অসংখ্য ভক্তবৃন্দ দ্বারা পরিবৃত।

অথর্ববেদীয় গোপালতাপনী উপনিষদে চিন্ময় জগতের গোলক বৃন্দাবন সম্পর্কে  বলা হয়েছে…

তমেকং গোবিন্দং সচ্চিদানন্দ বিগ্রহং পঞ্চপদং বৃন্দাবনসুরভূরুহতলাসীনং সততং সমরুদগণোহহং পরময়া স্তুত্যা তোষয়ামি।।

       -(গোপালতাপনী উপনিষদঃ পূর্ব ২/৩৫)

অনুবাদঃ যিনি গোলক বৃন্দাবনের কল্পতরুমূলে সমাসীন  আছেন,সতত আমি মরুদগনের সহিত পরম স্তুতি দ্বারা পঞ্চপদাত্মক সেই গোবিন্দদেবের(শ্রীকৃষ্ণের) সন্তোষ বিধান করি।

অষ্টাদশ পুরানের শাস্ত্রের ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানে চিন্ময় জগতের গোলক বৃন্দাবন ধাম এবং তার অধোদেশে বৈকুন্ঠ এবং শিবধাম সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরন পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে…

  সূর্য্যকোটিপ্রভং নিত্যমসখ্যং বিশ্বব্যাপকম।
স্বেচ্ছাময়স্য চ বিভোস্তজ্জ্যোতবরুজ্জ্বলং মহৎ।।
জ্যোতিরভ্যন্তরে লোকত্রয়মেব মনোহরম।
অদৃশ্য যোগিবি স্বপ্নে দৃশ্য গম্যঞ্চ বৈষ্ণবৈঃ।।
যোগেন ধৃতমীশেন চান্তরীক্ষস্থিতং পরম।
আধিব্যাধিজরামৃত্যুশোকবীতিবিবর্জিত।।
সদ্রত্মরচিতাসংখ্যমন্দিরৈঃ পরিশোবিত।
লয়ে কৃষ্ণযুতং সৃষ্টৌ গোপগোপীভিরাবৃতম।।
তদধো দক্ষিনে সব্যে পঞ্চাশংকোটিযোজনাৎ।
বৈকুন্ঠং শিবলোকঞ্চ তৎসমং সুমনোহরম।।
কোটিযোজনবিস্তীনং বৈকুন্ঠং মন্ডলাকৃতম।
লয়ে শূণ্যঞ্চ সৃষ্টৌ চ লক্ষ্মীনারায়নন্বিতম।।
গোলকাভ্যন্তরে জ্যোতিঃ সর্ব্বতেজোগুণান্বিতম।
চতুর্ভুজৈ পার্ষদৈশ্চ জন্মমৃত্যুবিবর্জ্জিতৈ।।
সব্যে চ শিবলোকশ্চ কোটিযোজনবিস্তৃতম।
লয়ে সৃষ্টৌ চ সপার্ষদশিবান্বিতম।।

       – (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানঃ ব্রহ্মখন্ড ২/৪-১১)

অনুবাদঃ কোটিসূর্যের প্রভাসমন্বিত  চিন্ময় জগৎ,যার  অভ্যন্তরে স্বেচ্ছাময় পরমেশ্বর ভগবান বিরাজমান।সেই উজ্জ্বল  জ্যোতির অভ্যন্তরে অবস্থিত  মনোহর ত্রিলোক( গোলক বৃন্দাবন, বৈকুন্ঠ এবং শিবধাম)।যোগীগন স্বপ্নেও সেই চিন্ময় জগতকে দর্শন করতে পারে না,কিন্তু বৈষ্ণবগন সেই জগৎ দর্শন করতে পারে এবং সেখানে গমন করতে পারে।সে জগৎ আধিভৌতিক, আদি দৈবিক, আধ্যত্মিক ক্লেশ থেকে মুক্ত।জরা,মৃত্যু, শোক বিবর্জিত। সে জগত অসংখ্য রত্মখচিত মন্দির দ্বারা পরিবৃত।সে জগতের মধ্যে গোলক বৃন্দাবনে  শ্রীকৃষ্ণ অসংখ্য গোপ গোপী সমন্বিত হয়ে সৃষ্টির সময় থেকে অবস্থান করছেন।গোলক বৃন্দাবনের  অধোদেশে(“তদধো”- তৎ+ অধ)পঞ্চাশ কোটি যোজন দক্ষিণে অবস্থিত বৈকুন্ঠ।গোলক বৃন্দাবনের মতোই মনোরম বৈকুন্ঠ এবং শিবলোক ।বৈকুন্ঠের পরিধি কোটি যোজন বিস্তৃত।  সৃষ্টির সময় থেকে বৈকুন্ঠে নারায়ন লক্ষ্মী সমন্বিত রুপে বিরাজমান।সে বৈকুন্ঠে বিষ্ণুর পার্ষদগন চতুর্ভুজ, তারা জন্মমৃত্যু বর্জিত।শিবলোক কোটিযোজনবিস্তৃত,এবং সে লোক সৃষ্টির সময় থেকে স্বপার্ষদ শিব সমন্বিত।”

   ব্রহ্মসংহিতা শাস্ত্রেও  চিন্ময় জগত সম্পর্কে স্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায়।সেখানে বলা হয়েছে…

গোলকনাম্নি নিজধাম্নি তলে চ তস্য
দেবী-মহেশ-হরি-ধামসু-তেষু তেষু।
তে তে প্রভাবনিচয়া বিহিতাশ্চ যেন
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি॥

        -(ব্রহ্মসংহিতা-৫/৪৩ঃব্রহ্মা)

অনুবাদঃ এই চৌদ্দভুবন বিশিষ্ট দেবীধাম বা জড় জগৎ।তার উপরে রয়েছে (চিন্ময়জগৎ)  শিবধাম,তার উপরে বৈকুন্ঠধাম এবং সবার উপরে গোলক নামক কৃষ্ণধাম।সেই সমস্ত ধামে বিভিন্ন প্রভাব সমূহ যিনি বিধান করেছেন,সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি। 

  চিন্তামনিপ্রকরসন্মসু কল্পবৃক্ষ-
লক্ষাবৃতেষু সুরভীরভিপালয়ন্তম।
লক্ষ্মীসহস্রশতসম্ভ্রমসেব্যমানং
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।।

   -( ব্রহ্মসংহিতা ৫/২৯, ব্রহ্মা)

অনুবাদঃ লক্ষ লক্ষ কল্পবৃক্ষ দ্বারা আবৃত চিন্তামণিকর গঠিত গৃহসমূহে সুরভী অর্থাৎ কামধেনুগণকে যিনি পালন করছেন এবং শত সহস্র লক্ষ্মীগণ(গোপীগন) কর্তৃক সাদরে যিনি  সেবিত হচ্ছেন সে আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

আনন্দচিন্ময়রসপ্রতিভাবিতাভি-

স্তাভির্য এব নিজরূপতয়া কলাভিঃ।
গোলোক এব নিবসত্যখিলাত্মভূতো

গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।।৩৭।।

-( ব্রহ্মসংহিতা ৫/৩৭, ব্রহ্মা)

অনুবাদঃ আনন্দচিন্ময়রস কর্তৃক প্রতিভাবিতা, স্বীয় চিৎরুপের অনুরূপা শ্রীরাধিকা ও তৎকায়ব্যূহরূপা সখীবর্গের সহিত যে অখিলাত্মভূত শ্রীগোবিন্দ নিত্য স্বীয় গোলোকধামে বাস করেন, সেই আদিপুরুষকে আমি ভজনা করি।।৩৭।।

শ্রিয়ঃ কান্তাঃ কান্তঃ পরমপুরুষঃ কল্পতরবো

দ্রুমা ভূমিশ্চিন্তামনিগণময়ী তোয়মমৃতম।।
কথা গানং নাট্যং গমনমপি বংশী প্রিয়সখী
চিদানন্দং জ্যোতি পরমপি তদাস্বাদ্যমপি চ।।
স যত্র ক্ষীরাব্ধিঃ স্রবতি সুরভীভ্যশ্চ সুমহান্
নিমেষার্ধাখ্যো বা ব্রজতি ন হি যত্রাপি সময়ঃ।
ভজে শ্বেতদ্বীপং তমহমিহ গোলকমিতি যং
বিদন্তস্তে সন্তঃ ক্ষিতিবিরলচারাঃ কতিপয়ে।।

                 –(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৫৬ঃ ব্রহ্মা)

অনুবাদঃ যে স্থানে চিন্ময়ী লক্ষ্মীগন( গোপীগণ) কান্তারুপা,পরমপুরুষ কৃষ্ণই একমাত্র কান্ত,বৃক্ষমাত্রই চিদগত কল্পতরু,ভূমিমাত্রই চিন্তামণি ( চিন্ময় মণিবিশেষ),জলমাত্রই অমৃত,কথামাত্রই গান,গমনমাত্রই নাট্য,বংশী – প্রিয়সখী,জ্যোতি- চিদানন্দময়,আহার মাত্রই আস্বাদনীয়( সুস্বাদু),যে স্থানে কোটি কোটি সুরভী হতে চিন্ময় মহা – ক্ষীরসমুদ্র নিরন্তর স্রাবিত হচ্ছে,ভূত ও ভবিষ্যৎরুপ খন্ডত্ব রহিত চিন্ময় কাল নিত্য বর্তমান, সুতারাং নিমেষার্ধ প্রাপ্ত হয় না,সেই শ্বেতদ্বীপরুপ পরমপীঠকে আমি ভজনা করি।সেই ধামকে এই  জড় জগতে বিরলচর অতি স্বল্পসংখ্যাক সাধুব্যক্তিই গোলক বলে জানেন।

                      হরে কৃষ্ণ।প্রনাম

প্রচারে-  স্বধর্মম্ : Connect to the inner self.

Sadgun Madhav Dash

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments