কলিযুগে জীবের ধর্ম কি?চিন্ময় জগৎ প্রাপ্তির উপায় কি? ‎

20250923_205628

‎বিভিন্ন সনাতন শাস্ত্রের ন্যায় শ্রীমদ্ভাগবত ১২/২/৩৯ শ্লোকে সত্য,ত্রেতা,দ্বাপর,কলি এ চারটি যুগের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। বর্তমান যুগকে কলিযুগ বলা হয়। সনাতন শাস্ত্রে আরো বলা হয়েছে, সমগ্র জগৎ সৃষ্টির মূলে রয়েছে পরমেশ্বর। পরমেশ্বর মনুষ্য সৃষ্টি করেছেন, তাই সমস্ত মনুষ্যজাতির প্রভু হলেন পরমেশ্বর,আর মনুষ্য হল তারই সন্তান। সন্তানের কর্তব্য যেমন পিতা- মাতার সেবা করা,ঠিক তেমনই মনুষ্য জাতির কর্তব্য হল পরম পিতা পরমেশ্বরের সেবা করা।

‎সেবা শব্দের অর্থ হল কায়/শরীর, মন এবং বাক্য দ্বারা যত্ন গ্রহণ করা।সেবা হল সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম।সম্পর্ক ব্যতীত এ জগতে কেউ সুখি হতে পারে না।সুতরাং সেবার অপর নাম সম্পর্ক স্থাপন ।

‎সমগ্র সনাতন শাস্ত্র অনুসারে একজনই পরমেশ্বর, তাঁর নাম শ্রীকৃষ্ণ। সৃষ্টির প্রয়োজনে এক শ্রীকৃষ্ণ শ্রীবিষ্ণু,শ্রীরাম,শ্রীনৃসিংহ ইত্যাদি রুপ ধারন করেন।সনাতন শাস্ত্রে তাঁর প্রতি সম্পর্ক স্থাপন/ সেবা ভাবের বিভিন্ন মাধ্যমের উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলি হল-

১/ পরমপ্রভু রুপে শ্রীকৃষ্ণ/ শ্রীবিষ্ণুর ধ্যান করা বা স্মরণ করা।

‎২/ যজ্ঞবেদী স্থাপন করে তাতে অগ্নি প্রজ্বলিত করে পুরুষসুক্ত,বিষ্ণুসুক্ত,নারায়ন সুক্ত ইত্যাদি বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে শ্রীকৃষ্ণ /শ্রীবিষ্ণুর উদ্দেশ্য ঘৃত এবং পঞ্চশস্য দ্বারা আহুতি প্রদান করা।এ পদ্ধতিকে বলা হয় অগ্নিহোত্র যজ্ঞ। এছাড়াও আরো বিভিন্ন ধরনের যজ্ঞ রয়েছে।

‎৩/শ্রীকৃষ্ণ/শ্রীবিষ্ণুর শ্রীমূর্তি স্থাপন করে অথবা চিত্রপটে অন্ন, সবজি,পায়েস ইত্যাদি রন্ধন করে,ফল ও জল ইত্যাদি সহকারে তা নিবেদন করে, সুগন্ধি পুষ্প,তুলসী,ধূপ, দীপ ইত্যাদি দ্বারা তাঁকে অর্চন/ পূজা করা

‎৪/ শ্রীকৃষ্ণ / শ্রীবিষ্ণু পবিত্র নাম কীর্তন / উচ্চারণ করা

‎৫/এছাড়াও শ্রীমদ্ভাগবত, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, বেদ, মহাভারত, রামায়ণ এবং পঞ্চরাত্র শাস্ত্র থেকে শ্রীকৃষ্ণ /শ্রীবিষ্ণুর মহিমা শ্রবণ করা।ইত্যাদি।

‎পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সেবা ভাব/ সম্পর্ক স্থাপনের উপরোক্ত এ সমস্ত পদ্ধতি প্রতিটি যুগের জন্য প্রযোজ্য। এ সমস্ত পদ্ধতির মাধ্যমে মনুষ্য পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সেবা পরায়ন হন।তবে বিভিন্ন যুগ অনুসারে শ্রীমদ্ভাগবত সহ বিভিন্ন শাস্ত্রে মনুষ্য জাতির ভগবৎ প্রাপ্তি/ চিন্ময় জগতে প্রত্যাবর্তন করার নিমিত্তে স্পেশাল একটি সেবা পদ্ধতির /ধর্ম অনুশীলনের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।সেগুলো হলঃ সত্যযুগে -ধ্যান, ত্রেতা যুগে-যজ্ঞ,দ্বাপরযুগে- অর্চন এবং কলিযুগে – হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন।

কৃতে যন্ধ্যায়তো বিষ্ণুং ত্রেতায়াং যজতো মখৈঃ।

দ্বাপরে পরিচর্যায়াং কলৌ তদ্ধরিকীর্তনাৎ ॥ ৫২॥

(শ্রীমদ্ভাগবত ১২/৩/৫২,শ্রীশুকদেব গৌস্বামী)

‎কৃতে-সত্যযুগে, যৎ-যা, ধ্যায়তঃ-ধ্যান করা থেকে, বিষ্ণুম-ভগবান শ্রীবিষ্ণুর, ত্রেতায়াম্-ত্রেতাযুগে, যজতঃ-আরাধনা থেকে, মখৈঃ-যজ্ঞ অনুষ্ঠানের দ্বারা, দ্বাপরে -দ্বাপর যুগে, পরিচর্যায়াম্-শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের অর্চন বা পূজা করে, কলৌ- কলিযুগে, তৎ-ঠিক সেই ফল (লাভ করা যায়); হরি কীর্তনাৎ-শুধুমাত্র হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তনের দ্বারা।

অনুবাদঃ সত্যযুগে শ্রীবিষ্ণুর ধ্যান করে, ত্রেতা যুগে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে এবং দ্বাপর যুগে ভগবানের অর্চন করার মাধ্যমে যা কিছু ফল লাভ হয়, কলিযুগে শুধুমাত্র হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করার মাধ্যমেই সেই ফল লাভ হয়ে থাকে

কলেদোষনিধে রাজন্নন্তি হ্যেকো মহান্ গুণঃ ।

কীর্তনাদেব কৃষ্ণস্য মুক্তসঙ্গঃ পরং ব্রজেৎ ॥ ৫১ ॥

-(শ্রীমদ্ভাগবত ১২/৩/৫১,শ্রীশুকদেব গৌস্বামী)
‎কলেঃ-কলিযুগের, দোষ-নিধেঃ-দোষের সমুদ্রে, রাজন-হে রাজা, অস্তি- আছে, হি-নিশ্চয়ই, একঃ-এক, মহান্-মহান, গুণঃ-গুণ, কীর্তনাৎ-কীর্তনের দ্বারা, এব-নিশ্চয়ই, কৃষ্ণস্য-শ্রীকৃষ্ণের পবিত্র নাম, মুক্ত-সঙ্গঃ-জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে, পরম্-দিব্য চিন্ময়ধামে, ব্রজেৎ-যেতে পারেন।

অনুবাদঃ হে রাজন, যদিও কলিযুগ হচ্ছে এক দোষের সাগর, তবুও তার একটি মহান গুণ আছে-শুধুমাত্র হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করার মাধ্যমে মানুষ জড়বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে পরমধামে উন্নীত হবেন

‎কলিং সভাজয়ন্ত্যার্যা গুণজ্ঞাঃ সারভাগিনঃ ।
‎যত্র সঙ্কীর্তনেনৈব সর্বস্বার্থোহভিলভ্যতে ॥ ৩৬ ॥

‎-(শ্রীমদ্ভাগবত ১১/৫/৩৬,শ্রীকরভাজন)

কলিম্-কলিযুগ, সভাজয়ন্তি-তাঁরা প্রশংসা করে থাকেন,আর্যাঃ-উন্নত শ্রেণীর মানুষেরা, গুণজ্ঞাঃ-(যুগের) যথার্থ মূল্য যাঁরা বোঝেন, সারভাগিনঃ-যাঁরা সারতত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারেন, যত্র-যাতে,সঙ্কীর্তনেন-পরমেশ্বর ভগবানের পবিত্র নাম সঙ্কীর্তনের মাধ্যমে,এব-শুধুমাত্র,সর্ব-সকল, স্ব-অর্থঃ-বাঞ্ছিত লক্ষ্য,অভিলভ্যতে-লাভ করা যায়।

‎ অনুবাদঃ যথার্থ জ্ঞানবান উন্নত শ্রেণীর মানুষেরা এই কলিযুগের যথার্থ মূল্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। এই ধরনের জ্ঞানবান মানুষেরা কলিযুগের প্রশংসাই করে থাকেন, যেহেতু এই অধঃপতনের যুগে নাম সঙ্কীর্তনের মাধ্যমে অনায়াসেই জীবনের সকল বাঞ্ছিত লক্ষ্য অর্জন করা যায়।

একই কথা বিষ্ণু পুরাণ ৬/২/১৭ এবং পদ্ম পুরাণঃ উত্তর খণ্ড, ৭২/২৫ এবং বৃহন্নারদীয় পুরাণ ৩৮/৯৭ শ্লোকেও বর্ণনা করা হয়েছে।

ধ্যায়ন কৃতে যজন যজ্ঞৈন্ত্রৈতায়াংদ্বাপরেহচয়ন। যদাপ্নোতি তদাপ্নোতি কলৌ সঙ্কীর্ত্য কেশবম্

অনুবাদঃ সত্যযুগে ধ্যানের দ্বারা, ত্রেতাযুগে যজ্ঞ অনুষ্ঠানের দ্বারা এবং দ্বাপর যুগে ভগবানের শ্রীপাদপদ্ম অর্চনের দ্বারা যা কিছু ফল লাভ হত, কলিযুগে শুধুমাত্র ভগবান শ্রীকেশবের নাম কীর্তনের দ্বারা সেই ফল লাভ হয়।

‎কৃষ্ণ-যজুর্বেদীয় কলির্সন্তরণ উপনিষদ তথা শ্রুতিতেও সরাসরি কলিযুগে জীবের মুক্তির পথ হিসেবে হরেকৃষ্ণ মন্ত্রটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে-

নারদঃ পুনঃ পপ্রচ্ছ তন্নাম কিমিতি। সহোবাচ হিরণ্যগর্ভঃ। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।। ইতি ষোড়শকং নাম্নাং কলিকল্মষনাশনম্। নাতঃ পরতরোপায়ঃ সর্ববেদেষু দৃশ্যতে ষোড়শকলাবৃতস্য জীবস্যাবরণবিনাশনম। ততঃ প্রকাশতে পরং ব্রহ্ম মেঘাপায়ে রবিরশ্মিমণ্ডলীবেতি।।২।।

‎ – কলিসন্তরণ উপনিষদঃ ২ (কৃষ্ণ-যজুর্বেদ)

অনুবাদঃ তখন নারদজী পুনঃ প্রশ্ন করলেন সেই নাম কি? তখন হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্মাজী বললেন, হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।। এই প্রকার ষোল নাম বত্রিশ অক্ষর মন্ত্র কলিযুগে সমস্ত দোষ নাশ করে। চারিবেদে এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো উপায় নেই। এই ষোলো অক্ষর মন্ত্র উচ্চারনে জীবের ষোড়শকলা যুক্ত আবরণ বিনষ্ঠ হয়। বৃষ্টির পর যেমন মেঘ কেটে গিয়ে সূর্যরশ্মি প্রকাশিত হয় তেমনই জীবও পরমব্রহ্মকে জানতে পারে।

‎ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ শাস্ত্রেও কলিজীবের মুক্তির পথ হিসেবে হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রটি নিদিষ্ট করা হয়েছে –

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
‎হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
‎ইত্যষ্টশতকং নাম্নাং ত্রিকাল কল্মষাপহং।
‎নাতঃ পরতরোপায়ঃ সর্ব্ববেদেষু বিদ্যতে।।

-‎(ব্রহ্মাণ্ড পুরাণঃ উত্তরখণ্ড, রাধাহৃদয় মাহাত্ম্য৬।৫৫,৫৬ )

অনুবাদঃ হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।। -এই মহামন্ত্র হরিনাম একশত অষ্টবার ত্রিকাল জপে সর্ব্বপ্রকার পাপের অপহারক হন। অর্থাৎ প্রাতঃ মধ্যাহ্ন ও সায়াহ্ন একশত অষ্ট বার প্রত্যেক সময়ে উচ্চারণ করাতে সকল পাতক ধ্বংস হয়। ইহার পর ভবভীরু জনের ভব নিস্তারণ উপায় আর নাই, ইহা সর্ব্ববেদে কথিত আছে।

বৃহন্নারদীয় পুরাণ শাস্ত্রেও কলিজীবের মুক্তির পথ তথা চিন্ময় জগত প্রাপ্তির পথ হিসেবে হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রটি নিদিষ্ট করা হয়েছে- –

হরের্নাম হর্রেনাম হরের্নামৈব কেবলম্।
‎ কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা।।

‎ -( বৃহন্নারদীয় পুরাণ ৩৮।১২৬ )

অনুবাদঃ  এই কলিযুগে হরিনাম ব্যতীত অন্য কোন গতি নেই, গতি নেই, গতি নেই

অনন্ত সংহিতা শাস্ত্রেও কলিজীবের চিন্ময় জগত প্রাপ্তির পথ হিসেবে হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রটি নিদিষ্ট করা হয়েছে-

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
‎হরে রাম হরেরাম রাম রাম হরে হরে।।
‎ষোড়ষৈতানি নামানি দ্বাত্রিদ্বর্ণকাণি চ ।
‎কলৌ যুগে মহামন্ত্র সম্মত জীবতারণে।।

‎ -(অনন্ত সংহিতা ৪।১০,১১ )

অনুবাদঃ “হরে কৃষ্ণে হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরেরাম রাম রাম হরে হরে।।“- এই ষোল নাম বত্রিশ অক্ষর কলিযুগে মহামন্ত্র এবং জীবতারণে অভিমত

সমগ্র সনাতনী শাস্ত্রের ন্যায় শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত এবং শ্রীচৈতন্য ভাগবত গ্রন্থে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আমাদের শিক্ষা প্রদান করছেন চারটি যুগের জন্য স্বয়ং পরমেশ্বর চারটি ধর্ম স্থাপন করছেন।কলি যুগের ধর্ম হল নাম সংকীর্তন। এই নাম সংকীর্তন থেকে জীব মুক্তি লাভ করবে।

চারি-যুগে চারি-ধর্ম রাখি’ ক্ষিতিতলে।
‎ স্বধর্ম স্থাপিয়া-প্রভু নিজ-স্থানে চলে।।১৩৪।।
‎ কলিযুগ-ধৰ্ম্ম হয় নাম-সঙ্কীর্ত্তন
‎ চারি-যুগে চারি-ধৰ্ম্ম জীবের কারণ।।১৩৭।

-( শ্রীচৈতন্য ভাগবতঃ আদি.১৪/১৩৪,১৩৭)

কলিকালে নামরুপে কৃষ্ণ-অবতার।

নাম হৈতে হয় সর্ব জগৎ নিস্তার।। 

(শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতঃ আদি.১৭/২২)

হরে কৃষ্ণ।প্রনাম।



Sadgun Madhav Dash

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments