আমাদের সমাজে কিছু শাস্ত্রজ্ঞানহীন ব্যক্তি আছে যারা একই বিষয়ে বেদের পরষ্পর বিপরীত বাক্য দেখলে যেকোন একটিকে স্বীকার করে, অন্যটিকে বিকৃত মনে করে পরিত্যাগ করে।এটি ভূল সিদ্ধান্ত।কারন বেদ পরমেশ্বর থেকে আগত।তাই বেদে কখনো ভূল থাকতে পারে না।বেদের মূখ্য অর্থে ঈশ্বর সাকার, তিনি শরীরধারী, তাই তার সকল ইন্দ্রিয় আছে।
দিবো বা বিষ্ণো উত বা পৃথিব্যা
মহো বা বিষ্ণু উরোরন্তরিক্ষাৎ।
উভো হি হস্তা বসুনা পূনস্বা
প্রযচ্ছ দক্ষিণাদোত সব্যাদ্বিষ্ণবে দ্বা।।
–(শুক্ল যজুর্বেদ ৫।১৯)
অনুবাদঃ হে বিষ্ণু(ঈশ্বর),তুমি দ্যুলোক অথবা ভূলোক হতে কিংবা মহান বিস্তৃত অন্তরিক্ষলোক হতে, তোমার উভয় হস্ত ধনের দ্বারা পূর্ণ কর। এবং দক্ষিণ অথবা বাম হস্তে আমাদের দান কর।
হিরন্ময়েন পাত্রেন সত্যস্যাহপিহিতং মুখম।
তৎ ত্বং পুষন্নপাবৃনু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।।
– (ঈশোপনিষদ ১৫,শুক্ল যজুর্বেদ)
অনুবাদঃ হে প্রভু,হে সর্বজীবপালক,আপনার উজ্জ্বল জ্যোতির দ্বারা আপনার শ্রীমুখ আচ্ছাদিত।কৃপা করে সেই আচ্ছাদন দূর করুন এবং যাতে আমরা আপনাকে দেখতে পারি।
পূষন্নেকর্ষে যম সূর্য প্রাজাপত্য
বূহ্য রশ্মীন্ সমূহ তেজো।
যৎ তে রূপং কল্যাণতমং তৎ তে পশ্যামি
যোহসাবসৌ পুরুষঃ সোহহমস্মি॥
– ঈশোপনিষদ ১৬(শুক্ল যজুর্বেদ )
অনুবাদঃ হে প্রভু, হে আদি কবি ও বিশ্বপালক, হে যম, শুদ্ধ ভক্তদের পরমগতি এবং প্রজাপতিদের সুহৃদ, কৃপা করে আপনার অপ্রাকৃত রশ্মির জ্যোতি অপসারণ করুন যাতে আপনার আনন্দময় রূপ আমি দর্শন করতে পারি। আপনি সনাতন পুরুষোত্তম ভগবান। সূর্য ও সূর্যকিরণের সম্বন্ধের মতো আপনার সাথে আমি সম্বন্ধযুক্ত।
আবার ঈশ্বরের যেহেতু মৃত্যু নেই তাই তার কোন বিনাশশীল দেহ নেই,তাই বেদ মূখ্য অর্থ অনুসারে, ঈশ্বর নিরাকার বা বিনাশশীল শরীরহীন।
ঈশ্বর সাকার নাকি নিরাকার এ সম্পর্কে শুক্ল যজুর্বেদীয় বৃহদারণ্যক উপনিষদ এবং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ শাস্ত্রে স্পষ্ট ধারনা প্রদান করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ঈশ্বর সাকার এবং নিরাকার উভয়ই।
দ্বে বাব ব্রহ্মণো রুপে মূর্তং চৈবামূতং।
চ মর্ত্যং চামৃতং চ স্থিতং চ যচ্চ সচ্চ ত্যচ্চ।।
-বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২/৩/১(শুক্ল যজুর্বেদ)
অনুবাদঃ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের দুটি রুপ-মূর্ত ( মূর্তিমান বা সাকার) এবং অমূর্ত(অমূর্তিমান বা নিরাকার)। তিনি মর্ত্য ও অমৃত।তিনি স্থিতিশীল, গতিশীল,সৎ(সত্তাশীল) এবং ত্যৎ(অব্যক্ত)।
সর্বেন্দ্রিয় গুণাভাসং সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম।
সর্বস্য প্রভুমীশানং সর্বস্য শরণং সুহৃৎ।। ১৭
-শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/১৭(কৃষ্ণ যজুর্বেদ),শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৩/১৫
অনুবাদঃ ঈশ্বর( পরমাত্মা) সমস্ত ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়ের গুণের অর্থাৎ চক্ষুকর্ণাদি দ্বারা গ্রহণযোগ্য জ্ঞানের প্রকাশক কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি সমস্ত জড় ইন্দ্রিয়বিবর্জিত, তিনি সকলেরই প্রভু এবং নিয়ন্তা। তিনি সকলের শরণ বা রক্ষক ও সকলের সুহৃৎ।
এক ঈশ্বর সম্পর্কে একই বিষয়ে বেদে এরুপ পরষ্পর বিপরীত মতামত দেখে কিছু মূর্খ ঈশ্বরের নিরাকার মতকে স্থাপন করে ঈশ্বরের সাকার মতকে তার কল্পনা দ্বারা গৌণ অর্থে প্রকাশ করেছেন।ঈশ্বরের হস্তকে সে সমস্ত মূর্খরা বর্ণনা করছেন কর্ম,মস্তককে জ্ঞান।ঈশ্বরের বাক্যে নিজের মতামত ডুকানোর অধিকার তাদের কে দিল? তারা যেহেতু ঈশ্বরকে নিরাকার মানে,তাই বেদে নিরাকারের বর্ণনায় ঠিক ঈশ্বরের হস্ত নেই এর অনুবাদ করছে হস্ত নেই,মস্তককে মস্তক বললেন।কিন্তু সাকারের বর্ণনায় ঈশ্বরের হস্তকে কর্ম,মস্তককে জ্ঞান বানিয়েে দিলেন।কেন এসমস্ত মূর্খরা এরুপ করলেন? ঈশ্বরের বর্ণনা যদি গৌন হয় তাহলে সাকার ঈশ্বরের বর্ননা গৌন বা কল্পনা করতে হল আর নিরাকারের বর্ণনা কেন মূখ্যই রাখা হল?নিরাকারের বর্ণনাকেও তো গৌন করা যেত।যাহোক মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে, একই বিষয়ে দুটি পরস্পর বিপরীত বাক্য থাকলে দুটিকে ধর্ম বা সত্য মনে করতে হবে।এ দুটি বাক্যের একটি সত্য আর অন্যটি মিথ্যা মনে করে মিথ্যাকে সত্য করতে কল্পনা বা গৌণ অনুবাদ করা উচিত নয়।
শ্রুতিদ্বৈধং তু যত্র স্যাত্তত্র ধর্মাবুভৌ স্মতৌ।
উভাবপি হি তৌ ধমৌ সম্যগুক্তৌ মনীষিভি।।
-মনুস্মৃতি ২/১৪
অনুবাদকঃ যেখানে দুটি শ্রুতি বা বেদ বচনের পরস্পর বিরুদ্ধ উপদেশ থাকলে সেখানে দুটিকেই ধর্ম বলে গ্রহণ করতে হবে ( যেমন- বেদে ঈশ্বরকে সাকার এবং নিরাকার উভয়ই বলা হয়েছে,ইত্যাদি)।কারন মনিষীগণ বলে গিয়েছেন, ঐ দুটি ধর্ম, ঐ দুটি দোষহীন।
এই বিষয়ে আরো বলা যায়, বেদ এবং গীতার ভাষায় ঈশ্বর স্বয়ংসম্পূর্ণ, তিনি অজ, তথাপি তিনি দুষ্টের দমন শিষ্ঠের পালন এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য যুগে যুগে অবতীর্ণ হন বা আবির্ভূত হন।ঈশ্বরের এরুপ আবির্ভাবকে দিব্য জন্মও বলা হয়।পরমেশ্বর ভগবানের আবির্ভাবকে দিব্য বা অপ্রাকৃত বলার মূল কারন হল, প্রাকৃতজনের জন্ম হয় কর্মফলে, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবানের জন্ম হয় স্ব ইচ্ছায়। প্রাকৃত জনের ন্যায় ভগবানের গর্ভাদি ক্লেশ নাই।
কিন্তু মূর্খরা ঈশ্বর সম্পর্কে একই বিষয়ে বেদের এরুপ পরষ্পর বিপরীত বচন শ্রবণ করে মনে করে ঈশ্বর অজ বা জন্মহীন, এটি সঠিক কিন্তু দ্বিতীয়টিতে বলা হল তথাপি তিনি বহুরুপে জন্মগ্রহণ করেন,এটি মিথ্যা।তখন তারা ঈশ্বরের অকাট্য বাক্যে নিজের কল্পনাকে জুড়িয়ে দিয়ে মূখ্য বেদ বাক্যকে গৌণ বা কল্পিত অর্থে বিকৃতভাবে বেদের অনুবাদ করে,যা ঈশ্বরের চরনে চরম অপরাধ। নিম্নোক্ত বেদ ও গীতা বাক্যে ঈশ্বর অজ, তথাপি তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
১/ “অজায়মানো বহুধা বিজায়তে”
(শুক্ল যজুর্বেদ ৩১/১৯,তৈত্তিরীয় আরন্যক ৩/১৩/১)
অনুবাদঃ সেই পরমেশ্বর যদিও জন্মরহিত(অজায়মান) তথাপিও তিনি বহুরুপে আবির্ভূত /জন্মগ্রহণ (বিজায়তে) করেন।
২/”তদৈক্ষত বহুস্যাং প্রজায়েয়তি”
-ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬/২/৩(সামবেদ)
অনুবাদঃ পরমেশ্বর বহু রুপে নিজেকে বিস্তার করেন।
৩/“একো বশী সর্বভূতান্তরাত্মা একং রূপং বহুধা যঃ করোতি।”
–কঠোপনিষৎ- ২/২/১২( কৃষ্ণ যজুর্বেদ)
অনুবাদঃ একক বশকর্তা, সর্ব জীবের অন্তরাত্মা,
সেই পরমেশ্বর এক তথাপি তিনি বহু রূপ ধারন করেন।
৪/রুপং রুপং প্রতিরুপো বভূব তদস্য রুপং প্রতিচক্ষণায়।ইন্দ্রো মায়াভিঃ পুরুরুপ ঈয়তে যুক্তা হ্যস্য হরয়ঃ শতা দশ।।
– ঋগ্বেদ ৬/৪৭/১৮
অনুবাদঃ ঈশ্বর বিভিন্ন রুপ ধারন করেন। এবং সে রুপ ধারন করে তিনি পৃথকভাবে প্রকাশিত হন।তিনি তার অন্তারঙ্গা শক্তি দ্বারা বিবিধ রুপ ধারন করে যজমানগণের নিকট উপস্থিত হন।কারন তার রথ সহস্র অশ্ব সংযুক্ত(অনন্ত শক্তি), অথাৎ তিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী।
৫/অজোহপি সন্নব্যায়িত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন। প্রকৃতিং স্বামহধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।। যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানি ভবতি ভারত।অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।।পরিত্রানায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ।ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন।।
-গীতা ৪/৬,৭,৮ ( ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
অনুবাদঃ হে অর্জুন, যদিও আমি সমস্ত জীবের ঈশ্বর,যদিও আমার জন্ম নেই ( অজ)এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় ।তবুও আমি আমার অন্তরঙ্গ শক্তিকে আশ্রয় করে অবতীর্ণ হই।যখনই জগতে ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের পরিমান বেড়ে যায়,তখনই সাধুদের (ভক্ত) রক্ষা ও দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপন হেতু যুগে যুগে অবতীর্ন হই।হে অর্জুন! যিনি আমার এই প্রকার দিব্য জন্ম ও কর্ম যথাযথভাবে জানেন, তাঁকে আর দেহত্যাগ করার পর পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না, তিনি আমার নিত্য ধাম ( চিন্ময় জগৎ) লাভ করেন।
হরে কৃষ্ণ। প্রনাম