ভারত ভূমির প্রকৃত ধর্ম কি? হিন্দুধর্ম নাকি সনাতন বৈষ্ণব ধর্ম?

277755653_135112489081556_5005084771574902321_n
ভারত ভূমির প্রকৃত ধর্ম কি?!
হিন্দুধর্ম নাকি সনাতন বৈষ্ণব ধর্ম?!
বর্তমানে বহুল আলোচিত বিতর্ক- আমাদের ধর্মের প্রকৃত নাম কি?! আমাদের ধর্ম হিন্দু না সনাতন?! আবার অনেকে কেন বলছেন আমাদের ধর্ম বৈষ্ণব?! শাস্ত্রে আমাদের ধর্মের নাম কি বলেছে?!
শুনতে হয়তো অদ্ভূত লাগতে পারে, আমাদের ধর্মের কোন শাস্ত্রেই ‘হিন্দু’ শব্দের কোন উল্লেখ নেই। বেদেও নেই, স্মৃতিতেও নেই, পুরাণ কিংবা ভারতের আদি ইতিহাস- মহাভারতেও নেই। আরো অদ্ভুত তথ্য হলো- সতের শতকের আগে পর্যন্ত ‘হিন্দু’ শব্দটির কোন অস্তিত্বই ছিলো না। উনিশ শতকের আগে অভিধানে হিন্দু বলে কোন শব্দই ছিলো না। ‘হিন্দু’ শব্দটি অতি আধুনিক শব্দ, অথচ ভারতভূমিতে বসবাসকারী জনগনের বৈদিক সংস্কৃতি এতোই সুপ্রাচীন যে কালের হিসেবে গণনা করা যায় না। আমাদের ধর্মের নাম সনাতন, আরো বিশেষভাবে বললে- সনাতন বৈষ্ণব ধর্ম। আমাদের ধর্ম শাস্ত্রগুলোতে সরাসরিভাবেই এর নামকরণ করা হয়েছে। হিন্দু শব্দটি কেবল জাতি বিশেষকে বুঝায়, ধর্মকে নয়। ধর্ম হিসেবে ব্যবহারের জন্য ‘হিন্দু’ শব্দের ব্যুৎপত্তিই হয় নি, এ শব্দের উৎপত্তি হয়েছিলো বিশেষ জাতিকে বুঝাতে। দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে বিদেশী শাসকদের অধীনে দাস্যত্ব করতে করতে আমরা নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ভুলে নিজেদেরকে বিদেশীদের দেওয়া নামে পরিচয় দিতে অধিক গর্ববোধ করি। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।
[ পোস্টের শেষাংশে আমাদের ধর্ম কেন ‘হিন্দু’ নয় তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখা করা হয়েছে ]
মহাভারতের যুদ্ধের অন্তে যুধিষ্ঠীরের অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন হলে যুধিষ্ঠীর মহারাজ শ্রীকৃষ্ণকে এ ভারতভূমির পরম ও সর্বোত্তম শ্রেষ্ঠ ধর্ম – সনাতন বৈষ্ণব ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন-
ভগবন্! বৈষ্ণবাধর্ম্মাঃ কিংফলাঃ কিংপরাষণাঃ।
কিংধর্ম্মসধিকৃত্যাথ ভবতোৎপাদিতাঃ পুবা ॥৩॥
পবিত্রাঃ কিল তে ধর্ম্মাঃ সর্বপাপপ্রণাশনাঃ।
সর্বধর্ম্মোত্তমাঃ পুণ্যা ভগবংস্ত্বন্মুখোদ্‌গতাঃ ॥৫॥
[মহাভারত: আশ্বমেধিক পর্ব/১১৭/৩,৫ ]
অনুবাদ: যুধিষ্ঠির বললেন, ” হে ভগবান কৃষ্ণ! বৈষ্ণবধর্মের ফল কি? তাহার আশ্রয় কি? এবং তুমি কোন আচার অবলম্বন করে এই ধর্ম উৎপাদন করেছো? ভগবান! তোমার মুখনির্গত এই বৈষ্ণবধর্ম পবিত্র, সর্বপাপনাশক ও দানধর্ম, অহিংসাধর্ম, পিতৃধর্ম, পতিধর্ম, বর্ণাশ্রম ধর্ম ইত্যাদি যত প্রকার পুন্যধর্ম আছে তা সে ধর্মেরই জাত, তাই এ বৈষ্ণবধর্ম সর্বশ্রেষ্ঠ।”
দ্রষ্টব্য: এ শ্লোকে ‘সর্বোধর্ম্মোত্তমাঃ’ শব্দ দ্বারা বৈষ্ণব ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে আক্ষ্যা দেওয়া হয়েছে। ‘ভগবংস্ত্বন্মুখোদগতা’ শব্দের দ্বারা বুঝানো হয়েছে এ ধর্ম স্বয়ং ভগবানের শ্রীমুখ হতে নিঃসৃত। অর্থাৎ এ সনাতন বৈষ্ণবধর্ম মানুষের সৃষ্টি নয়, এটি ভারতভূমীর সন্তানদের জন্য স্বয়ং ভগবান নিজে তৈরি করেছেন।
বৈশম্পায়ন উবাচ।
ইত্যেবং কথিতে দেবে ধর্ম্মপুত্রেণ সংসদি।
বসিষ্ঠাদ্যাস্তপোযুক্তা মুনয়স্তত্ত্বদর্শিনঃ।।
শ্রোতুকামাঃ পরং গুহ্যং বৈষ্ণবং ধর্ম্মমুত্তমম
তথা ভাগবতাশ্চৈব ততস্তং পর্য্যবারয়ন।
যুধিষ্ঠির উবাচ ।
তত্ত্বতস্তব ভাবেন পাদমূলমুপাগতম্ ।
যদি জানাসি মাং ভক্তং স্নিগ্ধং বা ভক্তবৎসল ! ॥১৩॥
ধৰ্ম্মগুহ্যানি সর্বাণি বেত্তুমিচ্ছাসি তত্ত্বতঃ ।
ধৰ্ম্মান্ কথয় মে দেব ! য্দ্যনুগ্রহভাগহম্ ॥১৪৷
বৈশম্পায়ন উবাচ ।
এবং পৃষ্টস্তু ধর্ম্মজ্ঞো ধৰ্ম্মপুত্রেণ কেশবঃ।
উবাচ ধৰ্ম্মান্ সূক্ষ্মার্থান্ ধৰ্ম্মপুত্ৰষ্স্য হৰ্ষিতঃ ॥১৫॥
[মহাভারত, আশ্বমেধিক পর্ব, ১১৭। ১১-১২ ]
অনুবাদ: বৈশম্পায়ন বলিলেন—সভায় যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে এইরূপ বলিলে, তপস্বী ও তত্ত্বদর্শী বসিষ্ঠপ্রভৃতি মুনিগণ এবং ভগবদ্ভক্ত সাধুগণ পরম গোপনীয় উত্তম বৈষ্ণবধর্ম্ম শুনিবার ইচ্ছা করিয়া আসিয়া কৃষ্ণকে পরিবেষ্টন করিলেন ॥ যুধিষ্ঠির বলিলেন—‘ভক্তবৎসল ! যথার্থই আমি তোমার প্রতি ভক্তিবশতঃ তোমার পাদমূলে আসিয়াছি, তুমি যদি আমাকে ভক্ত ও স্নেহযুক্ত বলিয়া জান এবং আমি যদি তোমার অনুগ্রহভাগী হই, তাহা হইলে আমার নিকট বৈষ্ণবধৰ্ম্ম বল। আমি যথার্থভাবে গুপ্ত সমস্ত বৈষ্ণবধৰ্ম্ম জানিতে ইচ্ছা করি’ ॥ বৈশম্পায়ন বলিলেন—যুধিষ্ঠির এইরূপ প্রশ্ন করিলে, ধর্ম্মত কৃষ্ণ আনন্দিত হইয়া তাঁহার নিকটে এ সূক্ষ্ম ধৰ্ম্ম বলিতে আরম্ভ করিলেন॥
উল্লেখ্য, এ শ্লোকে ‘পরং গুহ্যং বৈষ্ণবং ধর্ম্মমুত্তমম’ শব্দ দ্বারা বৈষ্ণব ধর্মকে সর্বাধিক গোপনীয় ধর্ম আক্ষ্যা দেওয়া হয়েছে। তাই এ বৈষ্ণব ধর্মকে আমরা সাধারণত ‘সনাতন ধর্ম’ বলেই অধিক ডাকি। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণই এ বৈষ্ণব ধর্মকে সনাতন ধর্ম আক্ষ্যা দিয়েছেন মহাভারতে। আমাদের বৈদিক শাস্ত্রের অন্য কোনরূপ মত বা -ism কে সনাতন ধর্ম বলে স্বীকৃতি দেওয়া নেই।
ভগবানুবাচ।
শৃণু পার্থিব ! তৎ সৰ্ব্বং ধৰ্ম্মসূক্ষ্মং সনাতনম্
দুর্বিজ্ঞেয়তমং নিত্যং যজ্ঞ যত্র মহাজনাঃ ॥
[ মহাভারত আশ্বমেধিক পর্ব, ১২০।২ ]
-ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “রাজা! অভিজ্ঞ লোকেরাও যে বিষয়ে সর্বদা মুগ্ধ হয়ে থাকেন, অত্যন্ত দুর্জ্ঞেয় সেই সূক্ষ্ম সনাতনধর্ম আপনি শ্রবণ করুন।”
বৈশম্পায়ন উবাচ।
এবং শ্ৰুত্বা বচঃ পুণ্যং সত্যং কেশবভাষিতম ।
এহৃষ্টমনসো ভূত্বা চিন্তযস্ন্তোহদ্ভূতং পরম্ ॥৫॥
দেবব্রহ্মর্ষণঃ সর্বে গন্ধৰ্বপ্পবসস্তথা।
ভূতা যক্ষগ্রহাশ্চৈব গুহ্যকা ভুজগাস্তথা ॥৬॥
বালখিল্যা মহাত্মানো যোগিনস্তত্ত্বদৰ্শিনঃ।
তথা ভাগবতাশ্চাপি পঞ্চকলিমুপসিকাঃ ॥৭॥
কৌতূহলসমাবিষ্টাঃ প্রহৃষ্টেদ্ৰিয্যানসাঃ।
শ্রোতুকানাঃ পরং ধর্ম্মং বৈষ্ণবংধর্মশাসনস্
হৃদি কর্তৃক তদ্বাক্যং প্রণেমুঃ শিরসা নতাঃ।।
[মহাভারত: আশ্বমেধিক পর্ব/১১৮/৫-৮ ]
অনুবাদঃ বৈশম্পায়ন বলিলেন—কৃষ্ণোক্ত এইরূপ সত্য ও পুণ্যজনক বাক্য শুনে অত্যন্ত অদ্ভুক্ত হবে এমন ভেবে প্রফুল্ল হয়ে সকল দেবর্ষি, ব্রহ্মর্ষি, গন্ধৰ্ব্ব, অপসরা, ভূত, যক্ষ, গ্রহ, গুহক, নাগ, মহাত্মা যোগী ও তত্ত্বদর্শী বালখিল্য ও দিনের মধ্যে পাঁচটী সময়ে ভগবানের উপাসক সাধুগণ কৌতুকযুক্ত হয়ে উত্তম বৈষ্ণবধৰ্ম্ম শুনার ইচ্ছা করে মস্তক অবনত করে কৃষ্ণকে নমস্কার করলেন॥
ভগবান শুধু আমাদের ভারতভূমীর জন্য ধর্ম সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হন নি, তিনি স্বয়ং এ শাশ্বত সনাতন ধর্মের রক্ষা করছেন। শ্রীমদ্ভগবদগীতায় সে কথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে-
ত্বমক্ষরং পরমং বেদিতব্যং
ত্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্।
ত্বমব্যয়ঃ শাশ্বতধর্মগোপ্তা
সনাতনস্ত্বং পুরুষো মতো মে।।
[ গীতা ১১।১৮ ]
অনুবাদ: তুমি পরম ব্রহ্ম এবং একমাত্র জ্ঞাতব্য। তুমি বিশ্বের পরম আশ্রয়। তুমি অব্যয়, সনাতন ধর্মের রক্ষক এবং সনাতন পরম পুরুষ। এই আমার অভিমত।
কেউ হয়তো দাবী করতে পারে, বৈষ্ণব যদি ধর্ম হয়, তবে শৈব, শাক্ত, গাণপত্য কিংবা সৌরাদি অন্যান্য মতও এক একটা ধর্ম। কিন্তু তাদের এ দাবী সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। শৈব ধর্ম, শাক্তধর্ম, গাণপত্য ধর্ম কিংবা সৌর ধর্ম বলে কোন টার্ম সনাতন ধর্মের কোন প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থে নেই। বাস্তবে বৈষ্ণবমত, শৈবমত, শাক্তমত, গাণপত্যমত ও সৌর মত- এ প্রধান পাঁচটি মত ও অন্যান্য বেদানুগামী মত হলো সনাতন বৈষ্ণবধর্মের শাখা, এগুলো স্বতন্ত্র কোন ধর্ম নয়। তাই এগুলোকে আমরা পঞ্চমত বলি, পঞ্চধর্ম বলি না। এগুলোর সমন্বয়েই সনাতন বৈষ্ণব ধর্ম। পরমেশ্বর ভগবান বিষ্ণু স্বয়ং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, প্রকৃতিমাতা দূর্গাদি দেবতাদের নিজের দেহ হতে প্রকাশ করে এদের দ্বারা সমগ্র সৃষ্টি সৃজন-পালন-লয়-বিনির্মান প্রভৃতি কার্য চালনা করেন। এ সমস্ত দেবতা ভেদে একেক মত, একেক পথ। মহাভারতে বৈষ্ণবধর্ম ব্যাখা করতে গিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তারও ব্যাখা দিয়েছেন-
“আমি দেবগণের আদি, আমি ব্ৰহ্মাদি দেবগণকে সৃষ্টি করিয়াছি এবং আমি নিজের প্রকৃতিকে অবলম্বন করিয়া সমগ্র জগৎ সৃষ্টি করিয়া থাকি। আমি ব্রহ্মচর্য্যপ্রভৃতি চারিটী আশ্রমের ধর্ম্মস্বরূপ, চাতুর্হোত্রযজ্ঞের ফল ভোগ করি, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও প্রজাপতি এই চারিটী আমার মূর্তি এবং ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ্য, বানগ্রস্থ ও ভিক্ষু—এই চারিটী আশ্রম আমিই সৃষ্টি করিয়াছি ॥ দেবতা, অসুর, মানুষের সহিত সমগ্র জগৎ এইভাবে আমার থেকে উৎপন্ন হয় এবং আমাতেই লয় পায়।”
– [ মহাভারত, আশ্বমেধিক পর্ব, ১১৭।৩৮,৫০,৫৯ ]
অতএব স্পষ্টতই, ভারতভূমীর বেদানুগামী সভ্য মনুষ্যের ধর্ম যে সনাতন-বৈষ্ণব ধর্ম, সে কথা ভারতের ইতিহাস মহাভারতে উল্লেখ আছে, গীতাতে উল্লেখ আছে, সর্বোপরি পবিত্র বেদেও আমাদের বৈষ্ণব হওয়ারই নির্দেশ দিয়েছে। পবিত্র বেদে বলছে-
বৈষ্ণবমসি বিষ্ণবে ত্বা।
– [ শুক্ল যজুর্বেদ ৫।২১ ]
-(হে মনুষ্য), তোমার পরিচয় তুমি বৈষ্ণব, বিষ্ণুর প্রীতির জন্য তোমাকে নিযুক্ত করছি।
বিষ্ণোনুকং বীর্যাণি প্র বোচং যঃ পার্থিবানি বিমমে রজাংসি যো অস্কভায়দুত্তরং সধস্থং বিচক্রমাণস্ত্রেধোরগায়ো বিষ্ণবে ত্বা৷৷
– [ শুক্ল যজুর্বেদ ৫।১৮]
-যিনি পার্থিব পরমাণু জাত নির্মাণ করেছেন, সে বিশ্বব্যাপক ভগবান বিষ্ণুর মহিমা নিত্য কীর্তন করছি। অগ্নি, বায়ু ও সূর্যরূপে যিনি ভূমি, অন্তরিক্ষ ও দ্যুলোকে নিজ মাহাত্ম্য স্থাপন করেছেন, মাহাত্মাগণের দ্বারা যিনি গীত, যিনি উপরিতন অন্তরিক্ষলোক স্তম্ভিত করেছেন, (হে মনুষ্য) সে বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে তোমাকে নিযুক্ত করছি।
দিবো বা বিষ্ণ উত বা পৃথিব্যা মহো বা বিষ্ণ উরোরন্তরিক্ষাৎ। উভা হি হস্তা বসুনা পূণস্বা প্র যচ্ছ দক্ষিণাদোত সব্যাদ্বিষ্ণবে ত্বা৷
– [ শুক্ল যজুর্বেদ ৫।১৯ ]
– হে বিষ্ণু, তুমি দ্যুলোক অথবা ভূলোক হতে, কিম্বা মহান বিস্তৃত অন্তরিক্ষলোক হতে তোমার উভয় হস্ত ধন-সম্পত্তি দ্বারা পূর্ণ কর এবং দক্ষিণ বা বাম হস্তে আমাদের দাও। হে মনুষ্য, সে সর্বব্যাপক ভগবান বিষ্ণুর প্রীতির জন্য তোমাকে নিযুক্ত করছি।
বৈষ্ণবমসি বৈষ্ণবা স্থ।।
– [ শুক্লযজুর্বেদ ৫/২৫ ]
~তোমরা বৈষ্ণব হও, তােমরা ভগবান বিষ্ণুর প্রীতিসাধক হও।।
অর্থাৎ, বেদ বারংবার আমাদের বৈষ্ণব হওয়ার জন্যই আহ্বান জানাচ্ছে। বেদ কিন্তু বলছে না, তুমি শৈব হও, বেদ বলছে না তুমি শাক্ত হও, বেদ বলছে না তুমি গাণপত্য বা সৌর হও। পবিত্র বেদ স্পষ্টভাবে বলছে, তুমি বৈষ্ণব হও, বিষ্ণুর প্রীতিবিধানার্থে নিজেকে সর্বোতভাবে নিযুক্ত করো। ঠিক যেমনটা গীতায় পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদযাজী মাং নমস্কুরু।
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োহসি মে।।৬৫।।
সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।৬৬।।
[ শ্রীমদ্ভগবদগীতা ১৮।৬৫-৬৬ ]
অনুবাদ: তুমি আমাতে(শ্রীকৃষ্ণ তথা বিষ্ণু) চিত্ত অর্পণ কর, আমর ভক্ত হও, আমার পূজা কর এবং আমাকে নমস্কার কর। তা হলে তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয় হবে৷ সর্ব প্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। এ নিয়ে তুমি কোনরূপ সন্দেহ রেখো না।
বৈষ্ণব হলো আত্মার ধর্ম, জৈবধর্ম, কারণ আত্মা হলো পরমাত্মা বিষ্ণুর অংশ, তাই বিষ্ণুর সেবা করাই জীবাত্মার ধর্ম। শৈব, শাক্তাদি হলো দেহের ধর্ম। জড়জগতের তিনগুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে লোকে ‘প্রপদ্যন্তেঽন্যদেবতা’– অন্যান্য দেবদেবীর আরাধনা করে [গীতা ৭।২০]। কিন্তু শৈব হোক বা শাক্ত, প্রকৃত স্বরূপে সকলেই বৈষ্ণব। তারা সেটি ভুলে গিয়েছে বলেই বেদ তাদের পুনরায় বলছে ‘বৈষ্ণবমসি’ [ যজুর্বেদ ৫।২৫ ]- বৈষ্ণব হও ।। যেহেতু বৈষ্ণবেরাই শিব, শক্তি, গণেশ প্রভৃতি দেবগণের প্রকৃত স্বরূপ– বৈষ্ণবত্ব জানেন, তাই বৈষ্ণব‌ই প্রকৃত শৈব, শাক্ত, গাণপত্য বা সৌর। এজন্যই আমাদের ধর্মের কোথাও শৈবধর্ম, শাক্তধর্ম, গাণপত্যধর্ম বলে কোন শব্দ নেই, কিন্তু সর্বশাস্ত্রে সরাসরিভাবেই বৈষ্ণব ও বৈষ্ণবধর্মের উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতের প্রাচীন ইতিহাস শাস্ত্র মহাভারতের যুদ্ধ শেষে যুধিষ্ঠির মহারাজ পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের নিকট ‘বৈষ্ণব ধর্ম’ কি তা জানতে চাইলে ভগবান তাকে তা ব্যাখা করেন। ‘বৈষ্ণব’ শব্দটি সরাসরিই বেদ হতেই আগত, কোন বিদেশী ম্লেচ্ছদের দেওয়া নাম নয়।
‘হিন্দু’ আমাদের ধর্ম নয়। কেন’?!
———————————————–
আমাদের ধর্মের কোন শাস্ত্রেই ‘হিন্দু’ শব্দের কোন উল্লেখ নেই। বেদেও নেই, স্মৃতিতেও নেই, পুরাণ কিংবা মহাভারতেও নেই। বাস্তবে হিন্দু শব্দটি আমাদের ভারত ভূমির ভাষাগত শব্দই নয়, এটি বিদেশীদের (ফরাসিদের) দেওয়া নাম। ফরাসি বণিকেরা যখন ভারতভূমিতে বাণিজ্যের যখন এসেছিলো, তখন তারা ‘সিন্ধু’ নদের তীরবর্তী লোকসমাজকে ‘হিন্দু’ বলে ডাকতো। অর্থাৎ, ‘হিন্দু’ শব্দটির উৎপত্তি কোন ধর্মবিশেষকে বুঝানোর জন্য হয় নি, এর দ্বারা সিন্ধু নদের তীরবর্তী লোকসমাজ, সংস্কৃতি কিংবা বাসিন্দাদের বুঝানো হয়। ভারতের সংবিধানেও “হিন্দু” শব্দটি ব্যবহার করে যে কোন ভারতীয়কে বুঝায়, সে যেই ধর্মবিশ্বাসীই হোক না কেন। ভারতের সংবিধানে ‘হিন্দু’ শব্দ দ্বারা এ অঞ্চলের সকল ধর্মবিশ্বাসীকে (হিন্দুধর্ম, জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম বা শিখধর্ম) নির্দেশ করা হয়েছে।
ভারতীয় সংবিধান : Religious rights Article 25:”Explanation II: In sub-Clause (b) of clause (2), the reference to Hindus shall be construed as including a reference to persons professing the Sikh, Jaina or Buddhist religion”
অতএব, দেখা গেলো, যারা বেদকে অস্বীকার করে অর্থাৎ নাস্তিক, বেদাচার বহির্ভূত ভোগাবিলাস বা কর্মকান্ডে লিপ্ত, সে সকল বুদ্ধ, জৈন, শিখ, চার্বাক প্রভৃতি মতাবলম্বীদেরও হিন্দু বলা হয়। সুতরাং, হিন্দু কোন ধর্ম নয়, এটি একটি লোকসমাজকে নির্দেশ করে। উল্লেখ্য, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদের পূর্বাবধি “হিন্দু” শব্দটি ধর্মের বদলে ‘দেশীয় জনগণ’ অর্থেই অধিকতর প্রযোজ্য ছিল। ১৮শ শতাব্দীর শেষের দিকে, ইউরোপীয় ব্যবসায়ী ও ঔপনিবেশিকরা ভারতীয় ধর্মের অনুসারীদেরকে একত্রে (একক কোন ধর্মকে নয়) হিন্দাস হিসেবে নির্দেশ করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে Hinduism বা হিন্দুধর্ম শব্দটি ইংরেজি ভাষায় সূচিত হয় ভারতীয়দের ধর্ম বিশ্বাস, দর্শন এবং সংস্কৃতিকে বোঝানোর জন্য। এভাবে কালক্রমে আমরা নিজেদের হিন্দুধর্মাবলম্বী বলে ডাকি, অথচ হিন্দু শব্দের উল্লেখ আমাদের কোন শাস্ত্রেই নেই, সতের শতকে ফরাসিরা এ ভূখন্ডে আসার আগে ‘হিন্দু’ শব্দটির অস্তিত্বই ছিলো না।
অধিক বিস্তারিত- https://bn.wikipedia.org/…/%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%A8…

রাজা “ভরত” এর নাম থেকে সেই জায়গার নাম হয় “ভারতবর্ষ”। যখন মুঘলরা এলো তখন সেই জায়গার নাম হল “হিন্দুস্থান” এবং ইংরেজরা আসার পরে নাম দিলো “ইন্ডিয়া”। যখন মুঘলরা এই দেশে রাজত্ব করা শুরু করে তখন তারা আমাদের উপর “জিজিয়া কর” লাগায় । “জিজিয়া কর” সম্পর্কে অনেকেই ইতিহাসে পড়েছেন । অমুসলিমদের কে যদি মুসলিম শাসন করে তাহলে সেই অমুসলিম কে “জিজিয়া কর” দিতে হবে এইটা কুরআনের বাণী ( ৯ সূরা আত তাওবাহ্.. আয়াত ২৯ ) তাই আমাদের কে চিহ্নিত করার জন্য আমাদের নাম দেওয়া হয় “হিন্দু” , অর্থাৎ আমাদেরকে তখন “হিন্দু” বলে ডাকতো । যেহেতু মুসলিমদের দেওয়া নাম এই “হিন্দু” সেহেতু তাদের হিসেব মতোই এই নামের অর্থ তারাই দিয়েছে ।

আপনারা যদি “হিন্দু”-র অর্থ উর্দু , ফারসি , আরবি ভাষার মধ্যে খুঁজতে যাও তাহলে এর অর্থ মিলবে – ‘চোর’ , ‘লুচ্চা’ , ‘ডাকাত’ , ‘মাতাল’ , ‘দাঙ্গাবাজ’ , ‘কালো’ , ‘শয়তান’ , ‘কাফের’ । এর থেকে আর খারাপ কিছু অর্থ নেই । ডিকশনারীর নাম বলে দিচ্ছি – “Gayas-ul-Lughat” ফারসী ডিক্শনারী , “Kareem-ul-Lughat” আরবি ডিকশনারি , “Feroz-ul-Lughat” ঊর্দু ডিকশনারি , এগুলোতে পেয়ে যাবেন “হিন্দু” শব্দের অর্থ কি । যতটা খারাপ বলা যায়, ‘ঘৃণাবাচক’ শব্দ একটা এই “হিন্দু”। মোঘলরা আমাদের নাম “হিন্দু” দিয়েছে আর আমরা সেটা গ্রহন করেছি । কেউ আমাদের বা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে চোর , ডাকাত , মাতাল , দাঙ্গাবাজ প্রভৃতি বলছে আর এটা শুনে কি আমাদের গর্ব হচ্ছে নাকি অসম্মান হচ্ছে একটু ভেবে দেখবেন।

“Perso-Arabic dictionaries define Hindu as a black, thief and slave” https://satish.com.in/20140416/

অতএব, আমাদের সমাজ -হিন্দু, কিন্তু ধর্ম হলো সনাতন বৈষ্ণব। ভারতভূমিতে জন্মানো পাষন্ড, ভোগবাদী, বেদ বিদ্বেষী নাস্তিকেরাও হিন্দু বলে পরিচিত, ফলে ‘হিন্দু’ শব্দটি কখনোই আমাদের প্রকৃত পরিচয় বহন করে না। আমাদের প্রকৃত ও সর্বোত্তম পরিচয় পরমেশ্বর পবিত্র বেদেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তা হলো- ‘আমরা সকলে বৈষ্ণব, আমাদের ধর্ম বৈষ্ণব ‘। মহান গৌড়ীয় বৈষ্ণবাচার্য শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তা খুব সুন্দরভাবে ব্যাখা করেছেন-
” চার্বাকাদি অতি পাষণ্ড ব্যক্তিও হিন্দু, কিন্তু বৈষ্ণব নহেন। আমরা বৈষ্ণব হিন্দু, কেবল হিন্দু নই অর্থাৎ আমাদের সমাজ হিন্দু কিন্তু আমাদের ধর্ম -বৈষ্ণব। তদ্রুপ হরিদাস ঠাকুর প্রভৃতি পূজনীয় পুরুষগণ ‘’হিন্দু’ নহেন, কিন্তু সর্বলোক নমস্কৃত ‘বৈষ্ণব’। বেদশাস্ত্রের যথার্থ তাৎপর্য্যানুসারে শ্রীশ্রীমহাপ্রভু সর্ব্বজাতিকে বৈষ্ণবধর্ম্মের অধিকারী বলিয়া উপদেশ করেন। “
– (ভক্তিবিনোদ, সঃ তোঃ ২/১০-১১)।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শিক্ষা দিয়েছেন-
“জীবের স্বরূপ হয় কৃষ্ণের নিত্য দাস।
কৃষ্ণের তটস্থা শক্তি ভেদাভেদ প্রকাশ।।”
।।সত্যং পরং ধীমহি।।

Pravira Caitanya Candra Das

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments