আজকাল কিছু শাস্ত্রজ্ঞানহীন ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার করছে যে, শ্রীরামচন্দ্র নাকি কখনো স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান নন ,তিনি নাকি একজন রাজনীতিজ্ঞ আর মহাত্মা। অথচ বেদ, রামায়ন,মহাভারত, অষ্টাদশ পুরান, পঞ্চরাত্র ইত্যাদি সমগ্র সনাতনী শাস্ত্রে শ্রীরামচন্দ্রকে পরমেশ্বর ভগবান বলা হয়েছে।তাকে ভগবান শ্রীবিষ্ণু অথবা শ্রীবিষ্ণুর অংশ অবতার মর্যাদা পুরুষোত্তম ভগবান বলা হয়েছে।
আমাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হল বেদ।বেদকে শ্রুতি বলা হয়। বেদ চার প্রকার – ঋগ্,যজু (শুক্ল,কৃষ্ণ) সাম এবং অথর্ব।আবার প্রতিটি বেদের চারটি অংশ রয়েছে।যথা-সংহিতা,ব্রাহ্মন, আরন্যক এবং উপনিষদ।বেদের এ চারটি অংশকে একত্রে বেদ বা শ্রুতি বলা হয়। উপনিষদ হল বেদের সর্বশেষ অংশ, তাই উপনিষদের অপর নাম বেদান্ত।
মুক্তিকোপনিষদ ১/৫১-৫৫ নং মন্ত্রে ১০৮ টি উপনিষদের বর্ননা করা হয়েছে ।শুক্লযজুর্বেদীয় মুক্তিকোপনিষদে শ্রীরামচন্দ্রকে পরমেশ্বর ভগবান বলা হয়েছে। তাকে শ্রীবিষ্ণু বা শ্রীহরি বলা হয়েছে।
ওঁ অযোধ্যানগরে রম্যে রত্নমন্ডপমধ্যমে।
সীতাভরতসৌমিত্রিশত্রুঘ্নাদ্যৈঃ সমন্বিতম।।
সনকাদ্যৈমুর্নিগনৈব্বশিষ্ঠাদ্যৈঃ শুকাদিভি।
অন্যৈর্ভাগবতৈশ্চাপি স্তুয়মানমহনির্শম।।
ধীবিক্রিয়াসহস্রানাং সাক্ষিনং নির্ব্বিকারিণম।
স্বরুপধ্যাননিরতং সমাধিবিরমে হরিম।।”
ভক্ত্যা শুশ্রুষয়া রামং স্তুবনং প্রপচ্ছ মারুতি।
রাম! ত্বং পরমাত্মাসি সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ।।
– মুক্তিকোপনিষদ ১/১-৪ ( শুক্ল যজুর্বেদ)
অনুবাদঃ একদা কুলাদিপতি রামচন্দ্র অযোধ্যা নগরের রমনীয় রত্নসিংহাসনে রাম, লক্ষণ, ভরত এবং শত্রুঘ্ন প্রভৃতি ভাতৃগন, অমাত্যগণ পরিবৃত হয়ে রত্মসিংহাসনে বসে আছেন।
সনক,সনাতন,বশিষ্ট,জাবালি,কশ্যপ,শুক প্রভৃতি ভক্তগন পরমব্রহ্ম জ্ঞানে তাঁকে স্তব করছেন। পবনতনয় হনুমান, সর্ব্বান্তর্যামী নির্ব্বিকার, নিরঞ্জন, স্বরুপধ্যানেনিরত রামচন্দ্র শ্রীহরিকে ধ্যানবিরামে অবসর জেনে প্রগাঢ় ভক্তি এবং বিবিধ শ্রুশ্রুষা দ্বারা স্তব করে জিজ্ঞাসা করলেন,হে রাম! তুমি ভৌতিক দেহশূণ্য অথাৎ চিন্ময়দেহধারী(সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ) পরমাত্মা।
ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের সুমহান বর্ণনা প্রদত্ত হয়েছে সমগ্র পৃথিবীর আদি কাব্যগ্রন্থ শ্রীরামায়ন শাস্ত্রে।সেখানে বলা হয়েছে, রাবনের অত্যাচারে পৃথিবী যখন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল,তখন দেবতারা ব্রহ্মাকে সাথে নিয়ে এ ব্রহ্মান্ডের অন্তর্গত ক্ষীরোধ সমুদ্রে ভগবান বিষ্ণুর শরনাগত হয়েছিলেন।ভগবান বিষ্ণু তাদের আশ্বাস দেন যে,তিনি অযোধ্যায় সূর্যবংশে দশরথের পুত্র হয়ে চারঅংশে জন্মগ্রহণ করে রাবন আদি অসুরদের বিনাশ করার জন্য শীঘ্রই আবির্ভূত হবেন।সে অনুসারে ভগবান বিষ্ণু অযোধ্যায় রাম,লক্ষ্মন, ভরত এবং শত্রুঘ্ন এ চাররুপে আবির্ভূত হন। রামায়ন শাস্ত্রে বর্ণিত আছে, ব্রহ্মাজী ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে স্তুতি দ্বারা বলছেন-
সিদ্ধানামপি সাধ্যানামাশ্রয়শ্চাসি পূর্বজঃ।
ত্বং যজ্ঞস্ত্বং বষটকারস্ত্বমোঙ্কারঃ পরাৎপর।।১৯।।
মহেন্দ্রশ্চ কৃতো রাজা বলিং বদ্ধা সুদারুণম্।
সীতা লক্ষ্মীর্ভবান্ বিষ্ণুর্দেবঃ কৃষ্ণঃ প্রজাপতিঃ।।”২৭।।
-বাল্মীকি রামায়ণ ৬।১১৭।১৯,২৭
অনুবাদঃ আপনি সিদ্ধ ও সাধ্যগণের আশ্রয়ভূত এবং পূর্বজ। যজ্ঞ, বষটকার এবং ওম্ কার আপনিই। আপনি শ্রেষ্ঠ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ পরমাত্মা। আপনি অত্যন্ত পরাক্রমী দৈত্যরাজ বলিকে বন্দি করে, দেবরাজ ইন্দ্রকে ত্রিভুবনের রাজা করেছিলেন। সীতা সাক্ষাৎ লক্ষ্মী এবং আপনি মূর্তিমান বিষ্ণু (নারায়ণ),আপনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
ত্রীল্লোকান্ ধারয়ন্ রাম দেবগন্ধর্বদানবান্।
অহং তে হৃদয়ং রাম জিহ্বা দেবী সরস্বতী।।
– রামায়ণঃ যুদ্ধ কাণ্ড, সর্গ ১১৭, শ্লোক ২৩।
অনুবাদ: শ্রীরাম ! আপনি ত্রিভুবনের তথা দেবতা-দানব-গন্ধর্বদের ধারক বিরাট পুরুষ নারায়ণ, সকলের হৃদয়স্থ পরমাত্মা। আমি প্রজাপতি ব্রহ্মা আপনার হৃদয় এবং দেবী সরস্বতী আপনার জিহ্বা।”
শ্রীমদ্ভাগবতেও বর্ণনা করা হয়েছে ভগবান বিষ্ণু / হরি ভগবান শ্রীরাম,লক্ষ্মন,ভরত এবং শত্রুঘ্নরুপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
তস্যাপি ভগবানেষ সাক্ষাদ্ ব্রহ্মময়ো হরিঃ।
অংশাংশেন চতুর্ধাগাৎ পুত্রর্ধাগাৎ পুত্রত্বং প্রার্থিতঃ সুরৈঃ।রামলক্ষ্মণভরতশত্রুঘ্না ইতি সংজ্ঞয়া।।
–(শ্রীমদ্ভাগবত ৯/১০/২)
অনুবাদঃ দেবতাদের দ্বারা প্রার্থিত হয়ে সাক্ষাৎ ব্রহ্মময় ভগবান শ্রীহরি ( বিষ্ণু) তার অংশ এবং অংশের অংশসহ আবির্ভূত হয়েছিলেন।তাঁদের নাম রাম, লক্ষ্মন, ভরত এবং শত্রুঘ্ন। এভাবেই ভগবান চার মূর্তিতে মহারাজ দশরথের পুত্ররুপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
হরে কৃষ্ণ || প্রনাম