শ্রীকৃষ্ণের কন্যা  শ্রীরাধিকা,মূর্খদের এ অপপ্রচার কেন শাস্ত্র সিদ্ধান্ত বহির্ভূত??

20250829_131756

  আবির্ব্বভূব কন্যৈকা কৃষ্ণস্য বামপার্শ্বতঃ।
‎ ধাবিত্বা পুষ্পমানীয় দদাবর্ঘ্যং প্রভোঃ পদে ॥ ২৫
‎ রসে সন্থয় গোলোকে সা দধাব হরেঃ পুরঃ।
‎ তেন রাধা সমাখ্যাতা পুরাবিদ্ভিদ্বিজোত্তম ॥ ২৬

‎     –(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণঃ ব্রহ্মখণ্ড-৫/২৫ -২৬)

অনুবাদঃ  শ্রীকৃষ্ণের বামপার্শ্ব হইতে এক কন্যা (নারী/স্ত্রী ) আবির্ভূতা হইয়া সত্বর গমনে পুষ্প আনয়নপূর্ব্বক ভগবানের পাদপদ্মে অর্ঘ্য প্রদান করিলেন। ২৫। গোলোকধামের রাসমণ্ডলে সেই কন্যা আবির্ভূতা হইয়াই, যেহেতু শ্রীকৃষ্ণের নিকটে ধাবিত হইয়াছিলেন সেই জন্যই পুরাণজ্ঞ পণ্ডিতেরা তাঁহাকে রাধা বলিয়া কীর্ত্তন করেন।২৬।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের উপরোক্ত এ দুটি শ্লোক শৌনক ঋষির প্রশ্নের উত্তরে সৌত  ঋষি বিস্তৃত আলোচনার এক পর্যায়ে পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের বামপার্শ্ব  থেকে শ্রীমতি রাধারাণীর আবির্ভাব বিষয়ে আলোচনা করেন।

মূর্খরা সাধারন সনাতনী মাঝে উপরোক্ত এ দুটি শ্লোকের মধ্যে প্রথম শ্লোকে ব্যবহৃত কন্যৈকা বা কন্যা ( “আবির্ব্বভূব কন্যৈকা কৃষ্ণস্য বামপার্শ্বত।”শ্রীকৃষ্ণের বামপার্শ্ব হইতে এক কন্যা আবির্ভূতা হইলেন) শব্দের উপর গুরুত্ব আরোপ করে, সাধারণ সনাতনী মাঝে অপপ্রচার  করছে, রাধা যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ থেকে প্রকাশ, তাই রাধারাণী হলেন শ্রীকৃষ্ণের কন্যা।

অথচ সৌত ঋষি এখানে “কন্যা’ শব্দে নারী বা স্ত্রীজাতিকে বুঝিয়েছেন,অন্যকোন অর্থে নয়।যেমন পুরুষ শব্দে ছেলেকে বুঝায়, এবং স্ত্রী/ নারী শব্দে  কন্যা বা মেয়েকে বুঝানো হয়। ছেলে বলতে কারো সন্তানও হতে পারে, আবার ছেলে শব্দে একজন পুরুষ ব্যক্তিকেও নির্দেশ করে। ঠিক তেমনই কন্যা শব্দে কারো সন্ততিকেও নির্দেশ করে, আবার কন্যা শব্দে মেয়ে বা নারী বা স্ত্রীজাতিকে বুঝানো হয়।

‎যায় হোক মূর্খদের মূর্খতার শিক্ষা দিতে আমাদের আরো বলতে হয়,বাংলায় একটি শব্দের যেমন স্থান,কাল, পাত্র অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ ধারণ করে,ঠিক তেমনই  সংস্কৃত একটি শব্দের স্থান,কাল, পাত্র অনুসারে বহু অর্থ ধারণ করে এবং তা নির্ধারিত হয় বাক্যটি কোন অবস্থানে অবস্থিত, সে মাপকাটি  অনুযায়ী।

‎এ শ্লোকে কন্যা শব্দে যে স্ত্রীজাতিকে নির্দেশ করে তাঁর বড়  প্রমান হল শ্রীমদ্ভাগবত।শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৫৯/৩৩ এবং শ্রীমদ্ভাগবত১০/৫৯/৪২ শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ী-

এক শ্রীকৃষ্ণ  ভৌমাসুর/ নরকাসুর কতৃর্ক অপহৃত ১৬১০০  রমনীকে বিবাহ করার  জন্য ১৬১০০ কৃষ্ণরুপে নিজেকে প্রকাশ করে তাদের আনন্দ বিধান করেছিলেন- 

‎তত্র রাজন্যকন্যানাং ষট্সহস্রাধিকাযুতম্

ভৌমাহৃতানাং বিক্রম্য রাজভ্যো দদৃশে হরিঃ ৷৷ ৩৩ ॥

               – ( শ্রীমদ্ভাগবতঃ ১০/৫৯/৩৩)

শব্দার্থঃ তত্র-সেখানে; রাজন্য-রাজার; কন্যানাম্-কন্যাদের; ষট্-সহস্র ছয় হাজার; অধিক-অধিক; অযুতম্-দশ হাজার; ভৌম-ভৌম দ্বারা; আহৃতানাম্-আহৃত; বিক্রম্য-বলপূর্বক, রাজভ্যঃ-রাজাদের থেকে; দদৃশে-দর্শন করলেন; হরিঃ- শ্রীকৃষ্ণ।

অনুবাদঃসেখানে বিভিন্ন রাজাদের কাছ থেকে ভৌম বলপূর্বক যে ষোল হাজারের অধিক রাজকন্যাদের ধরে নিয়ে এসেছিল, শ্রীকৃষ্ণ তাদের দেখতে পেলেন।

উপরোক্ত ভাগবতের শ্লোকে বর্ণিত ১৬ হাজারের অধিক সংখ্যাটি বিষ্ণু পুরাণ শাস্ত্রে  স্পষ্টভাবে ১৬ হাজার ১০০ সংখ্যায় বর্ণিত হয়েছে।

কন্যাপুরে স কন্যানাং ষোড়শাতুল্য বিক্রমঃ।

শতাধিকানি দদৃশে সহস্রাণি মহামতে ॥

( বিষ্ণুপুরাণ ৫/২৯/৩১)

অনুবাদঃ হে মহামতী, কন্যা-আবাসে ভগবান অনন্তবিক্রম ষোলহাজার একশত রাজকন্যা দেখতে পেয়েছিলেন।

অথো মুহূর্ত একস্মিন্ নানাগারেষু তাঃ স্ত্রিয়ঃ।

যথোপযেমে ভগবান্ তাবরূপধরোহব্যয়ঃ ॥ ৪২ ॥

(শ্রীমদ্ভাগবত১০/৫৯/৪২)

শব্দার্থঃ অথ উ-এবং অতঃপর; মুহূর্তে-পবিত্র সময়ে; একস্মিন্-একই; নানা-বিভিন্ন; আগারেষু-বাসগৃহে; তাঃ-সেই সকল; প্রিয়ঃ-রমণীগণ; যথা-যথাযথভাবে; উপযেমে-বিবাহ করলেন; ভগবান্ -শ্রীভগবান; তাবৎ-সেই বহু, রূপ-রূপ; ধরঃ-ধারণ করে; অব্যয়ঃ-অবিনাশী।

অনুবাদঃ অতঃপর অব্যয় পরমেশ্বর শ্রীভগবান, প্রতিটি বধূর কাছে ভিন্ন ভিন্ন নিজ রূপ প্রকাশ করে, একই সময়ে সকল রাজকন্যাকে, প্রত্যেকের নিজ নিজ প্রাসাদে, যথাবিহিত বিবাহ করলেন। 

শ্রোতাগণ দেখুন মূর্খরা কতটুকু গদর্ভ,

শ্রীকৃষ্ণের বামপার্শ্ব থেকে শ্রীমতি রাধারাণীর আবির্ভাব হওয়াতে মূর্খরা যদি মনে করে  রাধারাণী হলেন শ্রীকৃষ্ণের কন্যা,তাহলে তাদেরও মানতে হবে,দ্বারকায় অবস্থিত  এক শ্রীকৃষ্ণ থেকে ভৌমাসুর/ নরকাসুর কতৃর্ক অপহৃত ১৬১০০  রমনীকে বিবাহ করার  জন্য ১৬১০০ কৃষ্ণরুপে নিজেকে প্রকাশ করে তাদের আনন্দ বিধান করেছিলেন,সেসমস্ত ১৬১০০ কৃষ্ণ হলেন এক শ্রীকৃষ্ণের পুত্র/ছেলে? মূর্খ বাদে আর কেউ কি তাদের এরুপ মূর্খতাকে প্রশ্রয় দিবে?

‎‎আবার আমরা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান, ব্রহ্মখন্ডের
‎২য় এবং ৩য় অধ্যায়ের ১- ৭৩ শ্লোকের বর্ণনা অনুসারে জানতে পারি-

“শ্রীকৃষ্ণের দক্ষিণ অঙ্গ থেকে আবির্ভূত হন চতুর্ভুজ নারায়ন।এরপর শ্রীকৃষ্ণের বাম অঙ্গ থেকে আবির্ভূত হন শিব।এরপর শ্রীকৃষ্ণের নাভিপদ্ম থেকে আবির্ভূত হন ব্রহ্মার।এরপর শ্রীকৃষ্ণের বক্ষ থেকে আবির্ভূত হন মুর্তিমান ধর্মের।এরপর শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে আবির্ভূত হন স্বরস্বতী দেবীর।এরপর শ্রীকৃষ্ণের মন থেকে আবির্ভূত হন লক্ষ্মী দেবীর,এবং শ্রীকৃষ্ণের বুদ্ধি থেকে আবির্ভূত হন জগৎ পূজিতা মাতা দুর্গা দেবী।”

‎সুতারাং শ্রীকৃষ্ণের বামপার্শ্ব থেকে শ্রীমতি রাধারাণীর আবির্ভাব হওয়াতে মূর্খরা যদি মনে করে  রাধারাণী হলেন শ্রীকৃষ্ণের কন্যা,তাহলে তাদেরও মানতে হবে,ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, ব্রহ্মখন্ডের ‎২য় এবং ৩য় অধ্যায়ের ১- ৭৩ শ্লোকে বর্ণিত
‎শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন অঙ্গ এবং প্রত্যঙ্গ থেকে আবির্ভূত বিষ্ণু,শিব,ব্রহ্মা,লক্ষ্মী,সরস্বতী এবং দুর্গা এরা হলেন শ্রীকৃষ্ণের পুত্র (ছেলে)এবং কন্যা(মেয়ে)?

‎আবার আমরা যদি বেদ অধ্যয়ন করি তাহলে আমরা বেদে দেখতে পাই, ঈশ্বর এক হয়েই সৃষ্টির প্রয়োজনে   বহু অবতার  রুপ ধারণ করেন-

‎          একো বশী সর্বভূতান্তরাত্মা
‎        একং রূপং বহুধা যঃ করোতি

-‎কঠোপনিষৎঃ ২/২/১২ ( কৃষ্ণ যজুর্বেদ)

অনুবাদঃ যিনি একক নিয়ন্তা, সর্ব জীবের অন্তরাত্মা, যিনি এক /অদ্বিতীয় স্বরুপ / রুপ থেকে বহু রুপ ধারন করেন

রুপং রুপং প্রতিরুপো বভূব
‎তদস্য রুপং প্রতিচক্ষণায়।
‎ইন্দ্রো মায়াভিঃ পুরুরুপ ঈয়তে
‎যুক্তা হ্যস্য হরয়ঃ শতা দশ।।

‎                – (ঋগ্বেদ সংহিতা ৬/৪৭/১৮)

অনুবাদঃ ঈশ্বর (ইন্দ্র) বিভিন্ন রুপ বা দেহ ধারন করেন। এবং সে রুপ ধারন করে তিনি পৃথকভাবে প্রকাশিত হন।তিনি তার অন্তরঙ্গা শক্তি দ্বারা বিবিধ রুপ ধারন করে যজমানগণের নিকট উপস্থিত হন।কারন তার রথ  সহস্র অশ্ব সংযুক্ত(অনন্ত শক্তি), অথাৎ তিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী।

সুতারাং শ্রীকৃষ্ণের বামপার্শ্ব থেকে শ্রীমতি রাধারাণীর আবির্ভাব হওয়াতে মূর্খরা যদি মনে করে  রাধারাণী হলেন শ্রীকৃষ্ণের কন্যা,তাহলে তাদেরও মানতে হবে,কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় কঠোপনিষৎঃ ২/২/১২ এবং ঋগ্বেদ সংহিতা ৬/৪৭/১৮ মন্ত্র অনুযায়ী এক পরমেশ্বর থেকে যে বহু পরমেশ্বর প্রকাশ হয়, তাহলে সে পরমেশ্বরগনও এক পরমেশ্বরই সন্তান বা ছেলে?

‎পরিশেষে বেদ  হোক আর পুরাণ হোক শাস্ত্রকে বুঝতে হবে শাস্ত্র দ্বারা, কেতাবী বিদ্যা বা জল্পনা কল্পনার দ্বারা নয়।উপরোক্ত আলোচনায় বেদের বর্ণনায় সৃষ্টির প্রয়োজনে পরমেশ্বর যেমন বহু অবতার রুপ ধারণ করলেও ঈশ্বরের সেসমস্ত অবতার রুপ কখনো এক পরমেশ্বরের সন্তান বা পুত্র নয়,বরং সকল অবতারগণই হলেন এক পরমেশ্বর। 

‎এছাড়াও আমরা শ্রীকৃষ্ণ থেকে প্রকাশিত শ্রীমতী রাধারাণী সাথে শ্রীকৃষ্ণের কি সম্পর্ক তা জানতে পারি ব্রহ্মা এবং শিবের মতো মহান দেবতা, জ্ঞানী এবং মহাজন থেকে। ব্রহ্মবৈবর্ত  পুরাণ, প্রকৃতিখণ্ড-৪৮/৪১-৪৬ শ্লোকে স্বয়ং দেবাদিদেব শিব মাতা পার্বতীকে বলছেন,চিন্ময় জগতের গোলকে শ্রীকৃষ্ণের বামাঙ্গ হতে  শ্রীরাধা আবির্ভূত  হন। এ  শ্রীরাধার লোমকূপ হতে গোপিগণ এবং শ্রীকৃষ্ণের লোমকূপ হইতে গোপগণ জন্মগ্রহণ করেছেন।ত্রিলোকপ্রসিদ্ধ  মহালক্ষ্মী দেবী শ্রীরাধার বামভাগ হইতে উৎপন্ন হন এবং তিনি চতুর্ভুজ নারায়ণের প্রিয়তমা, বৈকুণ্ঠে তাঁর বাস।

‎ তারপর ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, প্রকৃতিখণ্ড-৪৮/৪৭ শ্লোকে দেবাদিদেব শিব মাতা পার্বতীকে বলছেন,সেই  গোলক বিহারী পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের পত্নী হলেন  শ্রীমতি রাধারাণী, অন্যকোন পরিচয় তার আর নেই।

‎স্বয়ং রাধা কৃষ্ণপত্নী কৃষ্ণবক্ষঃস্থলস্থিতা।

প্রাণাধিষ্ঠাতৃদেবী চ তস্যৈব পরমাত্মনঃ । ৪৭

-(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, প্রকৃতিখণ্ড-৪৮/৪৭)

অনুবাদঃ স্বয়ং শ্রীরাধিকা  শ্রীকৃক্ষের পত্নী।তিনি শ্রীকৃষ্ণের বক্ষঃস্থলে নিরন্তর অবস্থান করেন এবং তিনি পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের প্রাণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।

পরিশেষে মূর্খদের অপপ্রচার, গোলকে অবস্থিত শ্রীকৃষ্ণ থেকে আবির্ভূত রমনী কখনো শ্রীকৃষ্ণের মেয়ে নন,বরং একই পুরাণে উল্লেখিত দেবাদিদেব শিবের বর্ণনায় শ্রীমতী রাধারাণী হলেন শ্রীকৃষ্ণের পত্নী।

হরে কৃষ্ণ। প্রনাম।


Sadgun Madhav Dash

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments