শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যোগস্থ হয়ে নাকি একাগ্রতার সাথে পরমেশ্বর ভগবান রুপে গীতার জ্ঞান দান করেছিলেন?

FB_IMG_1748786250646

আজকাল কিছু মূর্খ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার করছে, কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গণে শ্রীকৃষ্ণ নাকি যোগস্থ হয়ে গীতার জ্ঞান প্রদান করেছেন।এর স্বপক্ষে তারা মহাভারত,আশ্বমেধিক পর্ব-১৭/ ১৩ নং শ্লোকটি উপস্থাপন করেন,যেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন-

পরং হি ব্রহ্ম কথিতং যোগযুক্তেনতন্ময়া।
ইতিহাসং তু বক্ষ্যামি তস্মিন্নর্থে পুরাতনম।।

-(মহাভারত,আশ্বমেধিক পর্ব-১৭/ ১৩)

অনুবাদঃ তৎকালে আমি যোগযুক্ত হইয়া(একাগ্রচিত্ত হইয়া) পরব্রহ্মের বিষয় বলিয়া ছিলাম, এখন সেই বিষয়ে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলিতেছি॥১৩॥

(অনুবাদঃ বিশ্ববাণী প্রকাশনী,শ্রীহরিসিদ্ধান্ত বাগীশ অনুবাদকৃত,টীকা-ভারতকৌমুদী)

বিশ্বভারতী প্রকাশনী কতৃর্ক প্রকাশিত মহাভারতে ভারত কৌমুদী টীকা উল্লেখ করা হয়,সেখানে যোগযুক্ত শব্দের অর্থ করা হয়েছে, “যোগযুক্তেন ঐক্যাগ্রসমন্বিতে”- “যোগযুক্ত শব্দে একাগ্রতার সহিত”। সুতরাং যোগযুক্ত শব্দের অর্থ যোগস্থ হয়ে নয় বরং একাগ্রতার সাথে।

মহাভারতের সর্বাধিক জনপ্রিয় টীকা ভারত কৌমুদী যোগযুক্ত শব্দের অর্থ করেছেন “একাগ্রতার সাথে”। অথচ যারা তাদের মূর্খতাকে আশ্রয় করে শ্রীকৃষ্ণকে বেদ/শ্রুতি,পুরাণ, মহাভারত, পঞ্চরাত্র ইত্যাদি শাস্ত্র অনুসারে পরমেশ্বর ভগবান রুপে গ্রহণ করতে চাই না,তারা শ্রীকৃষ্ণকে সাধারণ মানুষরুপে জনসমাজে পরিচয় করানোর জন্য যোগযুক্ত শব্দের অর্থ  করছেন- যোগস্থ হয়ে।

এখন আমরা মহাভারত,ভগবদ্গীতা শাস্ত্রের মাধ্যমে প্রমান করব শ্রীকৃষ্ণ যোগস্থ হয়ে ভগবদগীতা জ্ঞান প্রদান করেন নি,বরং একাগ্রতার সাথে পরমেশ্বর ভগবানরুপে ভগবদগীতার জ্ঞান দান করেন।

 প্রথম দাবীঃ

বেদসহ সমগ্র সনাতনী শাস্ত্রে ঈশ্বরকে পরমেশ্বর,ভগবান,পরমব্রহ্ম,পরমাত্মা রুপে সম্বোধন করা হয়েছে। তাই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় অর্জুনের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশকে শ্রীভগবান উবাচ বলা হয়েছে(গীতা ২/২,২/৫৫,২/৩ ইত্যাদি) । অথাৎ শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর বলা হয়েছে।এ বিষয় নিমোক্ত লিংকটি দর্শনীয় – https://svadharmam.com/why-is-the-word-bhagaban-a-logical-synonym-of-godhead/

গীতার মতোই মহাভারত শাস্ত্রেও প্রতিটি পর্বের প্রতিটি অধ্যায়ে বার বার বলা হয়েছে শ্রীকৃষ্ণ হলেন স্বয়ং বিষ্ণু, তিনি হলেন পরমেশ্বর ভগবান।

 অনুগ্রহার্থং লোকানাং বিষ্ণু লোক নমস্কৃতঃ।
বসুদেবাত্তু দেবক্যাং প্রাদুর্ভূতো মহাযশাঃ।।

-(মহাভারত আদিপর্ব, ৫৮/১৩৮)
অনুবাদঃ ত্রিজগতের পূজনীয় মহাযশস্বী স্বয়ং বিষ্ণু লোকের প্রতি অনুগ্রহ করিবার জন্য বসুদেব-দেবকীতে আবির্ভূত হইয়াছিলেন৷

এছাড়াও মহাভারত শাস্ত্রের ভীষ্মপর্বের ৩৪ তম অধ্যায়ের ৮ নং শ্লোকে অথাৎ গীতা ১০/৮ নং শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন নিজেকে সমগ্র জগতের সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বররুপে দাবী করেন(“অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে।”), তখন অর্জুন কোনরুপ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করে মহাভারত, ভীষ্মপর্ব ৩৪/১২-১৩ নং শ্লোকে অথাৎ গীতা ১০/১২-১৩ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণকে পরমব্রহ্ম অথাৎ পরমেশ্বর ভগবান বলে সম্বোধন করে বলেন যে, তুমি যে নিজেকে পরমব্রহ্ম অথাৎ পরমেশ্বর ভগবান বলে আমাকে শিক্ষা প্রদান করছ তা সত্য,কেননা ব্যাসদেব, নারদ, অসিত,দেবল ইত্যাদি মহান মহান ঋষিগন তোমাকে পরমব্রহ্ম অথাৎ পরমেশ্বর ভগবানরুপে জানে।

অর্জুন উবাচ-
পরং ব্রহ্ম পরং ধাম পবিত্রং পরমং ভবান্।
পুরুষং শাশ্বতং দিব্যমাদিদেবমজং বিভুম্ ॥
আহুস্তামৃষয়ঃ সর্বে দেবর্ষির্নারদস্তথা ।
অসিতো দেবলো ব্যাসঃ স্বয়ং চৈব ব্রবীষি মে ॥”

-(গীতা ১০/১২-১৩)

অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- তুমি ( হে কৃষ্ণ) পরম ব্রহ্ম ( ঈশ্বর) , পরম ধাম( পরম আশ্রয়), পরম পবিত্র ও পরম পুরুষ৷ তুমি নিত্য, দিব্য, আদি দেব, অজ ও বিভু। দেবর্ষি নারদ, অসিত, দেবল, ব্যাস আদি ঋষিরা তোমাকে সেভাবেই বর্ণনা করেছেন এবং তুমি নিজেও এখন আমাকে তা বলছ।

উপরোক্ত গীতাঃ ১০/১২-১৩ নং বিশ্লেষণ এই যে,সাধারণ মানুষের পক্ষে পরমেশ্বর ভগবানের পরিচিতি দানে শতভাগ ত্রুটি থাকবে এটি সত্য, কিন্তু দেবতাদের মধ্যে যিনি ঋষি সেই দেবর্ষি নারদ, যিনি তার স্বইচ্ছায় স্বর্গলোক,ব্রহ্মলোক সহ এই চৌদ্দ ভূবন বিশিষ্ট জড় ব্রহ্মান্ডে সর্বত্র বিচরণ করেন,এমনকি যিনি চিন্ময় জগতের বৈকুন্ঠ এবং গোলকে পরিভ্রমণ করে পরমেশ্বর ভগবানের প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত থাকেন, তিনিও উপদেশ করেন, শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরমব্রহ্ম অথাৎ পরমেশ্বর ভগবান। পুনরায় বেদ,পুরাণ,মহাভারত,
পঞ্চরাত্র শাস্ত্র যিনি লিপিবদ্ধ করছেন, সেই শ্রীল ব্যাসদেবেব শিক্ষায় শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরমব্রহ্ম অথাৎ পরমেশ্বর ভগবান।এছাড়াও অসিত, দেবল ইত্যাদি ঋষিরা, যারা ধ্যানস্থ অবস্থায় পরমেশ্বরের স্বরুপ দেখতে পান,সেই সমস্ত ঋষিদের বর্ণনায় শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরমেশ্বর ভগবান।

এছাড়াও গীতা ১১/৫-৪৫ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত জগৎ জুড়ে ব্যাপ্তিমান তার বিশ্বরুপ বা বিরাটরুপ প্রদর্শন করেন। এবং সেইসাথে গীতা ১১/৪৬ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ী অর্জুনের প্রার্থনায় পরমেশ্বর ভগবান রুপে শ্রীকৃষ্ণ গীতা ১১/৪৭-৫০ নং শ্লোক অনুযায়ী তার চতুর্ভূজ বিষ্ণু রুপ প্রদর্শন করেন।

এইভাবে সমগ্র মহাভারত শাস্ত্র এবং মহাভারতের অংশরুপে ভগবদগীতা শাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান বলা হয়েছে। আমরা দেখি অনেক ভূয়পোড় যোগী তাঁর শিষ্য হাজার খানেক হলে, আর কিছু যোগসিদ্ধি অথবা যাদু প্রদর্শন করার ক্ষমতা থাকলে সেগুলি দিয়ে তাঁর অজ্ঞানতার প্রভাবে নিজেকে তিনি ঈশ্বর বলে শিষ্যদের শিক্ষা দেন।শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু সেরকম ভূয়পোড় যোগী বা ঈশ্বর নন।শ্রীকৃষ্ণ গীতা শাস্ত্রে যা বলেছেন তা তিনি অর্জুনকে প্রদর্শন করেছেন।তিনি তার বিশ্বরুপ বা বিরাটরুপ প্রদর্শন করেন।এবং গীতা তার চতুর্ভূজ বিষ্ণু রুপ প্রদর্শন করেন।

দ্বিতীয় দাবীঃ

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মহাভারত,আশ্বমেধিক পর্ব-১৭/ ১৩ শ্লোকে বর্ণনা করেন, তিনি কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গণে একাগ্রতা সহকারে (যোগযুক্ত) ঈশ্বর বিষয়ক আলোচনা করেছিলেন(“পরং হি ব্রহ্ম কথিতং যোগযুক্তেনতন্ময়া।ইতিহাসং তু বক্ষ্যামি তস্মিন্নর্থে পুরাতনম।।”) এরপর অর্জুনের অনুরোধে সেই অষ্টাদশ অধ্যায়রুপী ভগবদগীতার হুবহু জ্ঞান প্রদান করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আশ্বমেধিক পর্ব, ১৭/১৪ থেকে ৬৬ অধ্যায়, অথাৎ মোট ৫৩ টি অধ্যায়ে এক প্রাচীন ইতিহাস আলোচনা করেন,যাকে মহাভারতে অনুগীতা বলা হয়।

মহাভারতের আশ্বমেধিক পর্ব ৬৬ অধ্যায়ের অনুগীতার আলোচনা সমাপ্ত হলে, ৬৭ তম অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে,মহাভারতের উপদেশরুপ ইতিহাস অনুগীতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে অর্জুন শ্রবণ করার করার পর অজুর্নের মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে কৃষ্ণ পরমেশ্বর ভগবান নন।অথবা মূর্খদের মতো অর্জুন বলেন নি, শ্রীকৃষ্ণ একজন যোগী, তিনি যোগস্থ হয়ে গীতার জ্ঞান আমাকে প্রদান করছেন,কিন্তু তিনি ঈশ্বর নন।বরং অর্জুনের ভাষায় শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরমাত্মা পরমেশ্বর ভগবান,তিনিই ছিলেন পান্ডবদের বিজয়ের মূল কারন।অর্জুন বললেন-

ত্বংপ্রসাদাজ্জয়ঃ প্রাপ্তো রাজ্ঞা বৃষ্ণিকুলোদ্বহ।।
নিহতাঃ শত্রবশ্চাপি প্রাপ্তং রাজ্যমকণ্টকম্ ॥৬৷৷
নাথবন্তশ্চ ভবতা পান্ডবা মধুসূদন!
ভবন্তং প্লবমাসাদ্য তীর্ণাঃ স্ম কুরুসাগরম্ ॥৭॥

বিশ্বকৰ্ম্মন্! নমস্তেহস্তু বিশ্বাত্মন্! বিশ্বসত্তম।।
তথা স্বামভিজানামি যথা চাহং ভবান্ মতঃ ॥৮॥
ত্বত্তেজঃসম্ভবো নিত্যং হুতাশো মধুসূদন।।
রতিঃ ক্রীড়াময়ী তুভ্যং মায়া তে রোদসী বিভো! ॥৯৷৷

ত্বয়ি সর্বমিদং বিশ্বং যদিদং স্থাণু জঙ্গমম্।
ত্বং হি সর্বং বিকুরুষে ভূতগ্রামং চতুর্বিধম্ ॥১০॥
পৃথিবীং চান্তরিক্ষঞ্চ দ্যাঞ্চৈব মধুসুদন।।
হসিতং তেহমলা জ্যোৎস্না ঋতবশ্চেন্দ্রিয়াণি তে ॥১১৷

-(মহাভারত,আশ্বমেধিক পর্ব,৬৭/৬-১১)

অনুবাদঃ হে বৃষ্ণিবংশশ্রেষ্ঠ। রাজা যুধিষ্ঠির তোমারই অনুগ্রহে জয়লাভ করিয়াছেন, শত্রুগণকে সংহার করিয়াছেন এবং নিষ্কণ্টক রাজ্য পাইয়াছেন। হে মধুসূদন, একমাত্র তুমিই পাণ্ডবগণের প্রভু এবং পাণ্ডবেরা তোমাকেই নৌকারূপে পাইয়া কৌরবসমুদ্র পার হইয়াছেন। হে বিশ্বকৰ্ম্মন,হে সমগ্র বিশ্বের পরমাত্মা(বিশ্বাত্মন), হে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ, হে প্রভু মধুসুদন,তোমাকে নমস্কার। আমি মনে মনে তোমাকে যেরূপ ধারণা করি, কার্য্য দ্বারাও তোমাকে সেইরূপই জানিতেছি। অগ্নি সর্ব্বদাই তোমার তেজ হইতে উৎপন্ন হয় এবং রতি তোমারই ক্রীড়াস্বরূপা, আর স্বর্গ ও মর্ত্য তোমারই মায়া।হে দেবকীনন্দন,
তুমি সন্তুষ্ট হইয়া আমাকে যা যা কিছু বলিতেছ সে সমস্তই ‘আমি করিব, এবিষয়ে আমার কোন বিবেচনা নাই।

সুতরাং অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ থেকে অষ্টাদশ অধ্যায়রুপী ভগবদগীতার হুবহু জ্ঞান আশ্বমেধিক পর্ব, ১৭/১৪ থেকে ৬৬ অধ্যায়, অথাৎ মোট ৫৩ টি অধ্যায়ে এক প্রাচীন ইতিহাসের মাধ্যমে শ্রবণ করার পর মহাভারত,আশ্বমেধিক পর্ব,৬৭/৬-১১ শ্লোকে তিনি যদি শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবানরুপে সম্বোধন করেন,তাহলে এসমস্ত মূর্খরা কি অর্জুন থেকেও বড় পন্ডিত হয়ে গেছে?সুতারাং আমাদের উচিত মূর্খদের অপপ্রচারে কর্ণপাত না করে আদৌ তাদের প্রচার সত্য কিনা তা জানার জন্য মহাভারত পাঠ করা।

এইভাবে মহাভারত এবং মহাভারতের অংশরুপে ভগবদগীতা শাস্ত্র অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ কখনো কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে যোগস্থ হয়ে অর্জুনকে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার জ্ঞান প্রদান করেন নি,বরং একাগ্রতার সাথে পরমেশ্বর
ভগবানরুপে ভগবদগীতার জ্ঞান প্রদান করেন (“যোগযুক্তেন ঐক্যাগ্রসমন্বিতে”)।

আর যুদ্ধক্ষেত্র কোন যোগ সাধনার নিরিবিলি স্থান নয়,সেখানে সর্বদা শত্রুর ভয় অথাৎ মৃত্যুর আয়োজন বিদ্যমান।গীতা ৬/১০-১৪ নং শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যোগীকে যোগস্থ হওয়ার পথ প্রদর্শন করে বর্ণনা করেন, “যোগী নির্জন বা কোলাহলহীন স্থানে গমন করে মৃগচর্মের উপর বস্ত্রাসন স্থাপন করে শরীর,মস্তক এবং গ্রীবাকে সোজা রেখে উপবেশন করে নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টিস্থাপন করে হৃদয়ে আমার (শ্রীকৃষ্ণের) ধ্যান করবেন।”

কই শ্রীকৃষ্ণকে তো আমরা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভূমিতে সেরকম যোগস্থ অবস্থায় দেখি না।আর তাঁকে কেন যোগস্থ হতে হবে?কারন তিনিই তো বেদ,মহাভারত সহ সমগ্র সনাতনী শাস্ত্র অনুসারে পরমেশ্বর ভগবান, তিনিই তো স্বয়ং বিষ্ণু।তিনিই(শ্রীকৃষ্ণ) হলেন যোগীগণের ধ্যানের বিষয়।যোগীগণ নিরন্তর ধ্যানে তাঁকে (শ্রীকৃষ্ণকে)স্মরণ করেন।আমরা গীতা ১/২৪ নং শ্লোক অনুযায়ী দেখতে পাই, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের অনুরোধে যুদ্ধকামী উভয় সৈন্যদলের মাঝখানে রথকে স্থাপন করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় যুদ্ধে পরাজয় স্বীকারে প্রস্তুত হতাশাগ্রস্থ অর্জুনকে পুনরায় যুদ্ধে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন উপদেশ প্রদান করছেন(যাকে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা বলা হয়)।সুতরাং মূর্খদের অপপ্রচার কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ যোগস্থ হয়ে অর্জুনকে গীতার জ্ঞান প্রদান করেন,এই ধরনের চিন্তা শুধু তাদের কল্পনা হতে পারে কিন্তু বাস্তবতার সাথে, শাস্ত্র সিদ্ধান্তের সাথে এই ধরণের উক্তির বিন্দুপরিমাণ মিল নেই।

 তৃতীয়  দাবীঃ

মূর্খরা এও বলে থাকে ঈশ্বরের জন্ম নাই, ঈশ্বর জন্ম গ্রহণ করতে পারেন না,শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেছেন, সুতরাং তিনি কখনো ঈশ্বর নন।শ্রীকৃষ্ণ গীতায় নিজেকে যে ঈশ্বর বলছেন, তাঁর কারন তখন তিনি যোগস্থ ছিলেন বলে তিনি নিজেকে নিজে ঈশ্বর বলেছেন।অথাৎ তাদের কথায় ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের দেহে ভর করেছিলেন আর শ্রীকৃষ্ণ যা কিছু গীতার জ্ঞান অর্জুনকে দান করেছেন, সবই হল ঈশ্বরের জ্ঞান। এক কথায় ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের ভিতর ডুকে গীতার জ্ঞান অর্জুনকে দান করেছেন, কিন্তু সেই গীতার জ্ঞান ব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণের নয়।

যদি গীতা সম্পর্কে তাদের অবান্তর কথাকে আমি কথার খাতিরে সত্য বলে ধরেও নি, তথাপি তারা যেভাবে বলছেন গীতার জ্ঞান ঈশ্বরের, ব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণের নয়,তাহলে তাদের ঈশ্বরের কথা মিথ্যা হয়।কারন তাদের ঈশ্বর কখনো জন্মগ্রহণ করেন না।অথচ গীতা ৪/৬,৭,৮,৯ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্ণনা করেন, তিনি ঈশ্বর, তার জন্ম নাই অথাৎ তিনি অজ তথাপি তিনি দুষ্টের দমন, শিষ্ঠের পালন ও ধর্ম সংস্থাপনের জন্য বার বার বিভিন্ন অবতার রুপে এই জগতে আবির্ভূত হন বা জন্মগ্রহণ করেন।যিনি তার জন্ম ও কর্মকে যথাযথ ভাবে জানতে পারেন তার আর পুনঃ জন্ম হয় না।

শ্রীভগবান উবাচ।
বহূনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন।
তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ ।।৫।।
অজোহপি সন্নব্যায়িত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন।
প্রকৃতিং স্বামহধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।। ৬।।

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানি ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।।৭।।
পরিত্রানায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।৮।।

জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ।
ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন।।৯।।

– ভগবান শ্রীকৃষ্ণঃ(গীতা ৪/৬,৭,৮,৯)

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে পরন্তপ অর্জুন ! আমার ও তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে। আমি সেই সমস্ত জন্মের কথা স্মরণ করতে পারি, কিন্তু তুমি পার না।যদিও আমি সমস্ত জীবের ঈশ্বর,যদিও আমার জন্ম নেই ( অজ)এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় ।তবুও আমি আমার অন্তরঙ্গ শক্তিকে সাথে নিয়ে অবতীর্ণ হই।যখনই জগতে ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের পরিমান বেড়ে যায়,তখনই সাধুদের (ভক্ত) রক্ষা ও দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপন হেতু যুগে যুগে অবতীর্ন হই।হে অর্জুন! ‍যিনি আমার এই প্রকার দিব্য জন্ম ও কর্ম যথাযথভাবে জানেন, তাঁকে আর দেহত্যাগ করার পর পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না, তিনি আমার নিত্য ধাম ( চিন্ময় জগৎ) লাভ করেন।

এবার আমাদের প্রশ্ন হল সেসমস্ত মূর্খদের প্রতি,তোমার ঈশ্বর তো জন্মগ্রহণ করেন না,তাহলে কৃষ্ণ তো নিজেকে ঈশ্বর বলছেন, তিনি তো গীতা ৪/৫-৯ নং শ্লোকে তিনি অজ, তার কোনপ্রকার জন্ম নাই এইরুপ বলে সৃষ্টির পালন,দুষ্টের দমন,সন্তের রক্ষা হেতু পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ বা আবির্ভূত হওয়ার করার কথা বলেছেন।তাহলে তোমার ঈশ্বর কি করে শ্রীকৃষ্ণের দেহে ভর করতে পারে?প্রকৃতই গীতা সম্পর্কে তুমি মূর্খ, তাই সমগ্র মহাভারত,এবং মহাভারতের অংশরুপে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা শাস্ত্রে যদিও শ্রীকৃষ্ণকে শ্রীবিষ্ণু বলা হয়েছে, পরমেশ্বর বলা হয়েছে, তথাপি তুমি তা সেইভাবে গ্রহণ না করে,তোমার নিকৃষ্ট চিন্তা চেতনা দ্বারা শ্রীকৃষ্ণকে বুঝার চেষ্টা করছ।ধিক তোমাকে ধিক।

চতুর্থ দাবীঃ

মূর্খদের দাবী ঈশ্বর যোগস্থ শ্রীকৃষ্ণের ভিতর ডুকে গীতার জ্ঞান অর্জুনকে দান করছেন।কিন্তু গীতা ৯/১১ নং শ্লোকটিতে শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে তাদের যুক্তিকে মূর্খের যুক্তি হিসেবে প্রমান প্রদান করে।কারন গীতা ৯/১১ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন,

অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্ ।
পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম্ ॥১১॥

– (গীতা ৯/১১,শ্রীকৃষ্ণ)
অনুবাদঃ আমি যখন মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হই,তখন মূর্খেরা আমাকে অবজ্ঞা করে৷ তারা আমার পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয় এবং তারা আমাকে সর্বভূতের(সমস্ত জীবের) মহেশ্বর(মহান ঈশ্বর) বলে জানে না।

গীতা ৯/১১ নং শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে স্পষ্টই বলছেন,যারা মূর্খ তারা আমাকে অবজ্ঞা করে আমি যখন মনুষ্যরুপে এই জগতে আবির্ভূত হই।তারা আমাকে সমস্ত জীবের মহান ঈশ্বর বলে জানে না।
সুতারাং গীতা ৯/১১ নং শ্লোক অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত জীবের মহান ঈশ্বর। তাই মূর্খরা যে বলে শ্রীকৃষ্ণ যোগস্থ হয়ে ঈশ্বরের জ্ঞান প্রদান করছে, আসলে তাদের এই ধরনের কথা গীতা ৯/১১ শ্লোক অনুযায়ী সম্পূর্ণ মিথ্যা।বরং গীতা ৯/১১ শ্লোক অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ নিজে মহান ঈশ্বর, তিনি সমগ্র জীবের মঙ্গলের নিমিত্তে অর্জুনকে গীতা জ্ঞান দান করেছেন

 পঞ্চম  দাবীঃ

মূর্খদের দাবী ঈশ্বর যোগস্থ শ্রীকৃষ্ণের ভিতর ডুকে গীতার জ্ঞান অর্জুনকে প্রদান করছেন।সুতরাং তাদের মতে গীতার জ্ঞান হল ঈশ্বরের জ্ঞান।ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মুখ দিয়ে অর্জুনকে গীতার জ্ঞান দান করেছেন। যদি এমন হয় তাহলে আমি কথার খাতিরে মানলাম,গীতা ১৮/৬৬ শ্লোকে ঈশ্বর তারই শরণাগত হতে বলেছেন।

সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।

-(গীতা ১৮/৬৬)
অনুবাদঃ সর্বধর্ম পরিত্যাগ করে একমাত্র আমার শরণ গ্রহণ কর; আমি তোমাকে সর্বপাপ হতে মুক্ত করব, তুমি শোক করো না।

কিন্তু সে একই ঈশ্বর আবার গীতা ১৮/৬১-৬২ শ্লোকে কোন ঈশ্বরের শরণাগত হতে অর্জুনকে উপদেশ করলেন?

ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি ।
ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া ॥৬১॥
তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত।

তৎপ্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্ ॥৬২।

(গীতা ১৮/৬১-৬২)
অনুবাদঃহে অর্জুন,ঈশ্বর সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করেন এবং তিনি তাদের দেহরূপ যন্ত্রে আরোহণ করিয়ে মায়ার দ্বারা ভ্রমণ করান।হে ভারত,সর্বতোভাবে তাঁর (ঈশ্বরের) শরণাগত হও।তাঁর প্রসাদে(কৃপায়) তুমি পরা শান্তি এবং নিত্যধাম প্রাপ্ত হও।

মুর্খদের প্রতি আমাদের প্রশ্ন, গীতা ১৮/৬২ শ্লোক বলার সময় ঈশ্বর কি তাহলে শ্রীকৃষ্ণের উপর ভর করা ছেড়ে দিয়েছিলেন অথবা শ্রীকৃষ্ণ যোগস্থ অবস্থা ত্যাগ করেছিলেন যার দরুন শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বরের শরণাগত হতে বলেছেন।আবার গীতা ১৮/৬৬ শ্লোক বলার সময় ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে প্রবেশ করছেন যার দরুন ঈশ্বর ঈশ্বরের শরনাগত হতে বলেছেন।

বস্তুতপক্ষে মূর্খ মূর্খই।কোন মূর্খ যদি সেগুন গাছকে আম গাছ মনে করে,তাহলে শত জন্ম অপেক্ষা করলেও সেগুন গাছে আম ফলবে না,আম সে খেতে পারবে না,ঠিক তেমনই এ সমস্ত মূর্খরা গীতায় যেভাবে শ্রীকৃষ্ণকে বর্ণনা করা হয়েছে, সেইভাবে গ্রহণ না করে, নিজেদের মতো শ্রীকৃষ্ণকে বুঝার চেষ্টা করে,তাই চিরকাল এদের কাছে পরমাত্ম সম্পর্কে জ্ঞান অপূর্ণ।

যায় হোক পুনরায় এসমস্ত মূর্খেরা আমাদের প্রশ্ন করতে পারে,আপনাদের মতে শ্রীকৃষ্ণ তো নিজে ঈশ্বর তাহলে গীতা ১৮/৬১-৬২ নং শ্লোক অনুযায়ী তিনি কেন অর্জুনকে ঈশ্বরের শরনাগত হতে বললেন ? নিমোক্ত লিংকে তাদের সে প্রশ্নের উত্তর প্রদান করা হয়েছে।
https://svadharmam.com/according-to-verse-18-61-62-of-sri-krishna-himself-why-did-he-tell-arjun-to-be-the-refuge-of-godhead/

এছাড়াও এসমস্ত মূর্খরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরো অপপ্রচার করছে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর অর্জুন পুনরায় গীতার জ্ঞান জানতে ইচ্ছা করলে শ্রীকৃষ্ণ নাকি বলেছিল আমি গীতা জ্ঞান ভূলে গেছি।আদৌ কি শ্রীকৃষ্ণ গীতার জ্ঞান ভূলেছিল,এ বিষয়ে জানতে নিমোক্ত লিংকে পাঠ করুন-
https://svadharmam.com/https-svadharmam-com-does-krishna-forgot-the-transendental-knowledge/

গ্রন্থ সহায়তাঃ

১/মহাভারতঃ বিশ্ববাণী প্রকাশনী,অনুবাদকঃ শ্রীহরিসিদ্ধান্ত বাগীশ ভট্টাচার্য।

২/শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাঃ বিবিটি প্রকাশনী,অনুবাদকঃ শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ।

 

 হরে কৃষ্ণ। প্রনাম।

©️ স্বধর্মম্ : Connect to the inner self

Sadgun Madhav Dash

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments