°প্রামাণিক শাস্ত্রসমূহে ভগবান নিত্যানন্দ প্রভু °
শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ, পঞ্চরাত্র সমস্ত শাস্ত্রই শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু এবং শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর আবির্ভাবের ঘোষণা করেছে। মহাপ্রভু প্রচ্ছন্ন অবতার বলেই অনেক সময় অনেক পণ্ডিতেরা পর্যন্ত দেখেও বুঝতে পারে না। এই বিষয়ে সূর্যের উপস্থিতিতেও সূর্যালোক দর্শনে অক্ষম পেঁচকের দৃষ্টান্ত টেনেছেন। সেই সমস্ত শাস্ত্র থেকে এই আলোচনা আজ শ্রীনিত্যানন্দ ত্রয়োদশী উপলক্ষে স্বধর্মম্ এর ক্ষুদ্র নিবেদন।
(১) শ্রুতি-প্রমাণ:
বলা হয়েছে, ধর্মাধর্ম নির্ণয়ে শ্রুতিই প্রমাণ। নিতাই-গৌরের আনুগত্যেহেরিনাম করাই জীবের পরম ধর্ম। একাধিক উপনিষদে নিত্যানন্দ প্রভুর আবির্ভাবের ঘোষণা রয়েছে, যথা:
স এব ভগবান্ যুগসন্ধিকালে শারদাভ্রসংনিকাশো রৌহিনেয়ো বাসুদেবঃ সর্বাণি গদাদ্যাযুধশাস্ত্রাণি ব্যাচক্ষাণো নৈকান্ রাজন্যমণ্ডলান্নিরাচিকীর্ষুঃ ভুভারমখিলং নিচখান ॥ ৫॥
স এব ভগবান্ যুগে তুরিয়েঽপি ব্রহ্মকুলে জায়মানঃ সর্ব উপনিষদঃ উদ্দিধীর্ষুঃ সর্বাণি ধর্মশাস্ত্রাণি বিস্তারযিষ্ণুঃ সর্বানপি জনান্ সন্তারযিষ্ণুঃ সর্বানপি বৈষ্ণবান্ ধর্মান্ বিজৃম্ভযন্ সর্বানপি পাষণ্ডান্ নিচখান ॥ ৬॥
[ অথর্ববেদ, কৃষ্ণোপনিষদ- ২।৫-৬, সঙ্কর্ষণোপনিষদ মন্ত্র: ৬]
অনুবাদ: শরৎকালীন মেঘের মতো উজ্জ্বল শ্বেত দীপ্তিমান রোহিণীপুত্র বাসুদেব ভগবান বলরাম দ্বাপর যুগসন্ধিকালে আবির্ভূত হয়ে গদা প্রভৃতি অস্ত্রের দ্বারা আসুরিক রাজন্যবর্গকে উৎখাত করে অখিল ভূভার হরণ করেছিলেন। সেই ভগবান চতুর্থ যুগে (কলিকালে) বৈষ্ণবের আনন্দবিধান করতে ব্রাহ্মণকুলে আবির্ভূত হয়ে উপনিষদসমূহে বর্ণিত পরমসত্যকে প্রচার করে জগৎবাসীকে উদ্ধার করেন এবং পাষণ্ডীদের নির্মূল করেন।
ব্যাখা: কৃষ্ণোপনিষদ ১০৮টি প্রধান উপনিষদের মধ্যে ৯৬নং উপনিষদ। বৈষ্ণবাচার্য শ্রীবল্লভ এ উপনিষদের টীকা রচনা করেছিলেন। এখানে বর্ণিত হয়েছে, চতুর্থ যুগ বা কলিযুগে জগতের দুর্দশা দেখে নবদ্বীপবাসী বৈষ্ণবগণ শোকসাগরে নিমজ্জিত ছিলেন। কিন্তু যখন নিতাই-গৌর আবির্ভূত হয়ে পাষণ্ডীদের হৃদয়স্থ পাপ নির্মূল করেন, তখন জগৎবাসী বৈষ্ণবগণ আনন্দসাগরে নিমজ্জিত হন।কলিসন্তরণোপনিষদে প্রজাপতি বলেছেন, হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র ব্যতীত আর কোনো শ্রেষ্ঠ উপায় ‘সর্ববেদেষু দৃশ্যতে’ – সমস্ত বেদে খেুঁজে পাওয়া যায় না, অর্থাৎ বেদ-উপনিষদের পরম সত্য হলো হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র, যা নিত্যানন্দ প্রভু প্রতি দ্বারে দ্বারে গিয়ে প্রচার করেছেন।
(২) পাঞ্চরাত্রিক সংহিতা প্রমাণ
(ক) অনন্ত সংহিতা
যদা প্রাদুর্ভবিষ্যামি স্বয়ং লোক-হিতায় বৈ।
তদৈব ত্বং মহাভাগ নিত্যং প্রাদুর্ভবিষ্যসি ॥ ৪৩॥
ত্বাং সংত্যজ্য ক্ষণমপি ন চ তিষ্ঠামি মানদ।
কল্পান্তরে করিষ্যামি জ্যেষ্ঠং বৃন্দাবনে হ্যহম্ ॥ ৪৪॥
অস্মিন্ দ্বীপে মহাক্ষেত্রে যদাহং প্রার্থিতঃ সুরৈঃ।
অবতীর্য্য দ্বিজবাসে হনিষ্যে কলিজং ভয়ম্ ॥ ৪৫॥
নিত্যানন্দো মহাকায়ো ভূত্বা মৎকীর্ত্তনে রতঃ।
বিমূঢ়ান ভক্তিরহিতান মম ভক্তান্ করিষ্যসি ॥ ৪৬॥
[শ্রী অনন্তসংহিতা, ৩।৪৩-৪৬ ]
অনুবাদ: শ্রীহরি বলিলেন, “হে অনন্ত, তুমি অত্যন্ত মহিমান্বিত! আমি যখনই জীবের মঙ্গলার্থে এই জগতে আবির্ভূত হব, তুমিও প্রতিবারে আমার সাথে আবির্ভূত হবে।হে মানদ, তোমাকে পরিত্যাগপূর্বক ক্ষণকালও আমার পক্ষে ক্ষণকালও থাকা সম্ভব নয়। এক কল্পে বৃন্দাবনে কুমি আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা হয়ে সেবাসুখ আস্বাদন করবে।
আমি যে সময়ে দেবগণ-কর্তৃক প্রার্থিত হয়ে কলিভয় বিনাশ করতে মহাক্ষেত্র নবদ্বীপে ব্রাহ্মণপুরন্দর শ্রীজগন্নাথ মিশ্রের গৃহে অবতীর্ণ হব, তখন তুমি মহাকায় নিত্যানন্দরূপে আবির্ভূত হয়ে আমার কীর্তনে রত থেকে ভক্তি-রহিত মূঢ় লোকেদের আমার ভক্তে পরিণত করিবে।”
ব্যাখা: শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা হলো অমানীনা মানদেন, যার মূর্তপ্রকাশ শ্রীনিত্যানন্দ রাম। তাই এখানে তাঁকে মানদ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সমস্ত তীর্থের আশ্রয়রূপে শ্রীনবদ্বীপ শাস্ত্রপ্রমাণে মহাক্ষেত্র। উদারতার মূর্তশরীর বলেই তিনি মহাকায়। ভজ গৌরহরি, বল কৃষ্ণ, ভজ কৃষ্ণ, কর কৃষ্ণ শিক্ষা প্রভৃতি কীর্তনে মগ্ন থেকে তিনি মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন শুধু তাঁদের উদ্ধার করার জন্য।
(খ) ঈশ্বর সংহিতা
অস্তি তে বিমলা ভক্তিঃ ময়ি যাদবনন্দন।
প্রথমং শেষরূপো মে কৈঙ্কর্যমকরোদ্ভবান্।
ততস্তু লক্ষ্মণো ভূত্বা মামারাধিতবানিহ॥
ইদানীমপি মাং যুষ্টং বলভদ্র ত্বমর্হসি।
কলাবপি যুগে ভূয়ঃ কশ্চিদ্ভূত্বা দ্বিজোত্তম্॥
নানাবিধৈমার্গেজলৈরর্চনং মে করিষ্যসি।
ইত্যুক্ত দেবদেবেন বলভদ্রঃ প্রহৃষ্টধীঃ॥
[ ঈশ্বরসংহিতা ২০/২৭৩-২৭৬ ]
অনুবাদ: ভগবান শ্রীহরি বলরামকে বললেন, “ হে যাদবনন্দন, আমার প্রতি তোমার বিমলা ভক্তি বিদ্যমান। তুমি শেষ রূপ ধারণ করে প্রথমে আমার সেবা করেছিলে। শ্রীরামাবতারে লক্ষ্মণ হয়ে তুমি আমার সেবা করেছিলে। এখন দ্বাপরে বলভদ্ররূপে তুমি সুযোগ্যরূপে আমার সেবা করছো এবং ভবিষ্যতে কলিযুগে তুমি উত্তম ব্রাহ্মণকুলে আবির্ভূত হয়ে নানাবিধ উপায়ে, জলরূপে আমাকে অর্চন করবে।” একথা শ্রবণ করে দেবতাগণের আরাধ্য দেব বলভদ্র আনন্দিত হলেন।
ব্যাখা: শ্লোকে ‘ভূয়ঃ কশ্চিদ্ভূত্বা দ্বিজোত্তম’ পদ দ্বারা নির্দেশিত হয়, কলিযুগে শ্রীবলরাম রাঢ়দেশে হাড়াই পণ্ডিতের পুত্ররূপে শাণ্ডিল্য ভক্তিসূত্র প্রণেতা শাণ্ডিল মুনির গোত্রে উত্তম ব্রাহ্মণকুলে আবির্ভূত হবেন। ‘নানাবিধৈমার্গ’ পদ দ্বারা নানা উপায়ে কলিযুগপাবনাবতারী শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর সেবা করেছেন। হরিনাম শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, পাদসেবন, অর্চন, বন্দন, দাস্য, সখ্য, আত্মনিবেদন -এই নববিধা ভক্তির প্রতিটি পন্থায় প্রত্যক্ষভাবে তিনি সেবা করেছেন। অহর্নিশ হরিনাম শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ সেবা, ভগবান শ্রীচৈতন্যের নিকট থাকাকালীন তাঁর প্রত্যক্ষ পাদসেবন, অর্চন ও বন্দন এবং অন্যকালে ‘শ্রীবাঁকারায়’ বিগ্রহে ভগবানের উক্ত সেবা করেছেন।তিনি সরাসরি ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রভুর দাস রূপে তার আদেশ পালন করেছেন, সখা রূপে জগাই-মাধাই উদ্ধার, কাজি দলনাদি নানাবিধ লীলায় অংশ নিয়েছেন এবং গুরু-গৌরাঙ্গের চরণে সর্বদা আত্মনিবেদিত। এভাবে নববিধা ভক্তির প্রতিটি তিনি আচরণ করে ভগবান শ্রীহরির প্রীতিবিধান করেছেন।শ্লোকে ‘জলৈরর্চনং’ পদের ব্যাখা – বৃন্দাবন পরিক্রমায় যাত্রাপথে শ্রীকৃষ্ণ বঙ্কিমরায় শ্রীবিগ্রহস্বরূপে জলমধ্যে নিত্যানন্দপ্রভুর নিকট অর্চনসেবা লাভের বাসনা করেন। নিত্যানন্দ প্রভু জল হতে প্রাপ্ত বঙ্কিমরায় বা বাঁকারায়কে তাঁর সমগ্র প্রকটকাল যাবৎ পরম ভক্তিতে সেবা করে অর্চনের আদর্শ স্থাপন করেছেন।যেহেতু ভগবান শ্রীবলরাম সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিযুক্ত থাকতে চান, তাই আদিনারায়ণ শ্রীকৃষ্ণ যখন তাঁকে কলিযুগে এইরূপ সেবার কথা ব্যক্ত করেন, তখন তিনি আনিন্দিত হবেন, এটিই স্বাভাবিক। সেবা অধিকার লাভ করে উল্লসিত হওয়ার শিক্ষা লাভের জন্য আমাদের এই দৃষ্টান্ত সর্বদা স্মরণ রাখা উচিত।
(৩) যামল-তন্ত্র প্রমাণ:
(ক)
ততঃ স ভগবান্ কৃষ্ণঃ লোক নিস্তার হেতুনা।
অনন্তমুক্তবান্দেবো জায়স্ব পৃথিবীতলে ॥
গোকুলে বলরামায় পাতু ত্বাং শৃণু পার্ব্বতী।
নিত্যানন্দঃ সহি ভাবি লোকানাং হিতকাম্যয়া ॥
(শ্রীব্রহ্মযামল তন্ত্র, ২।১-২)
অনুবাদ: শ্রীশিব বললেন, “হে পার্বতী, চিন্তামণি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ লোক নিস্তারের জন্য সবসময় উৎসুক। অনন্তদেব সকলকে মুক্তি জড়দুঃখ থেকে প্রদানকারী। তাই তাঁরা পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন।
(খ)
নিত্যানন্দ কলারূপী বলরামঃ স এবঃ হি।
পূর্ণঃ চৈতন্য এব স্যাৎ যঃ কৃষ্ণো গোকুলেংভবৎ ॥
তত্রৈব গৌরচন্দ্রস্থ্য ভক্তা এব ন সংশয়ঃ।
নিত্যানন্দ-শচীপুতৌ স্বত্বা যে নিপতন্তি চ॥
[ শ্রীব্রহ্মযামল তন্ত্র, ২।৬ , ৪।৫]
অনুবাদ: যিনি গোকুলে শ্রীবলরাম, সেই প্রভুই নিত্যানন্দরূপে জগতের পরম হিতকারী। গোকুলে যিনি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, তিনি এখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। তিনি পরমপূর্ণ। আর নিত্যানন্দ প্রভু পূর্ণকলারূপী স্বয়ং বলরাম।
শচীপুত্র শ্রীগৌরচন্দ্র ভক্তরূপ এবং নিত্যানন্দ প্রভু ভক্তস্বরূপ। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে, সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রের আদ্যান্তে এ মধ্যে চ হরিঃ সর্বত্র গীয়তে, আদিতে, অন্তে এবং মধ্যে সর্বত্রই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শ্রীহরির মহিমা কীর্তন করা হয়েছে।
উপরিউক্ত আলোচনা সেই শাস্ত্রবাণীকেই পুনঃপ্রমাণ করে। শ্রীমৎ নিত্যানন্দ প্রভুর কৃপায় সকলের শুভবোধোদয় হোক, সকলে নিত্য গৌরপ্রেমানন্দে মগ্ন হোক।
।।হরে কৃষ্ণ।।
– বিজয় দাস
– মধুর গৌরকিশোর দাস