মহাভারতের দৃষ্টিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ!

Svadharmam Image

🟠 মহাভারতের দৃষ্টিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ!

শ্রীকৃষ্ণ যে স্বয়ং পরমেশ্বর তা সম্বন্ধে দুয়েকটা উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করা যাক-

‘পাপকর্ষণ জন্য সচ্চিদানন্দরূপী কৃষ্ণই পরমদেবতা। গোশব্দ নানার্থপ্রযুক্ত ভূমি এবং বেদ, ইহাতে যিনি বিখ্যাত ও দ্রষ্টা, তিনি গোবিন্দ, মৃত্যু ইহাকে গোশব্দের অধিষ্ঠানরূপে জ্ঞাত হইয়া ভয়প্রাপ্ত হয়।” (অথর্ববেদান্তর্গত, গোপালতাপনী উপনিষদ: ৮)

“ঈশ্বর পরম কৃষ্ণ সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ।।” (ব্রহ্মসংহিতা: ৫/১)

“এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ং।।” (শ্রীমদ্ভাগবত:১/৩/২৮)

“সর্বে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ং।।” (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ: শ্রীকৃষ্ণজন্মখন্ড/১১৭/১২)

“একেলা ঈশ্বর কৃষ্ণ আর সব ভৃত্য” (শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত: আদিলীলা ৫/১৪২)।

🌿 এবার আসি সর্বজনীন প্রামাণিক শাস্ত্র মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণকে আসলে কেমন রূপে আমরা দেখতে পাই, তা আজকের আলোচনায় স্পষ্ট করা হবে। মহাভারত: ভীষ্মপর্ব/৬৪ নং অধ্যায়ে দেখা যায় যখন কৌরবশ্রেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র তার সারথি সঞ্জয়ের নিকট যুদ্ধের বর্ণনা শুনছিলেন, তার এককালে তিনি সঞ্জয়ের নিকট যুদ্ধের পরিস্থিতি জানার জন্য এভাবে প্রশ্ন করেন-

“ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, সঞ্জয়! পান্ডবগণের কার্য্য দেবগণের পক্ষেও অতিদুষ্কর। ইহা শুনিয়া আমার গুরুতর ভয় ও বিস্ময় জন্মিয়াছে।।১।।

👉 এরকমভাবে ধৃতরাষ্ট্র তার আরও ভয় ও আশংকার কারণ ব্যক্ত করে সঞ্জয়কে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন যে, কিরুপে পান্ডবগণ অজেয় হয়ে উঠছে, কিভাবেই’বা তারা কৌরবপক্ষীয় সমস্ত বড় বড় রথি-মহারথি যোদ্ধাদের পরাজিত-নিহত করে দিচ্ছে, তাদের জয়ের পিছনে কোন শক্তি কাজ করছে, ইত্যাদি।
ধৃতরাষ্ট্রের দ্বারা জিজ্ঞাসিত হলে সঞ্জয় তার উত্তর প্রদান করেন যে, পান্ডুপুত্রগণ তথা পান্ডবরা কোনো অধর্ম করছেন না, ধর্মের পথে থেকেই যুদ্ধ করছেন এজন্য তারা জয়ী হচ্ছেন, সর্বোপরি শ্রীকৃষ্ণ তাদের সঙ্গে রয়েছেন।
আর অন্যদিকে দুর্যোধনাদি কৌরবেরা পাপাচারে লিপ্ত অধর্মপরায়ণ তাই যুদ্ধে তাদের ক্ষয় হচ্ছে।

সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে পূর্বের বিষয়ে স্মরণ করে আরও কিছু কথা বললেন যে- আপনার পুত্রদের অবৈধ কার্যের বিষয়ে আপনাকে তখন বারবার অবগত, সতর্ক করা হলেও যেহেতু তখন আপনি কোনোকিছুই শোনেননি তাই এখন আপনি তার ফল ভোগ করুন। এভাবে বলে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের করা প্রশ্নের উত্তরে তারই কর্মফলকে স্মরণ করিয়ে দিলেন।

অতঃপর সঞ্জয় পুনরায় ধৃতরাষ্ট্রের নিকট কুরুক্ষেত্রের পরিস্থিতি সম্বন্ধে বর্ণনা দিয়ে বলতে লাগলেন। দুর্যোধন যুদ্ধে নিজেদের পক্ষে মহারথী ভীষ্ম, দ্রোণ, শল্য, কৃপ, অশ্বত্থামাসহ আরও অনেকে যারা ত্রিভূবন জয় করতেও সমর্থ তারা থাকা সত্ত্বেও পান্ডবরা কিভাবে বারবার জয়ী হচ্ছিল তা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে ভীষ্মদেবের নিকট বিনম্রভাবে তার রহস্য জানতে চাইলে ভীষ্মদেব উত্তরে তাকে পান্ডবদের সাথে সন্ধি করার জন্য বললেন এবং মুনিগনের উদ্ধৃতি দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের পরমেশ্বরত্ব ও সর্বশক্তিমত্ত্বা স্থাপন করে বললেন-

“ত্রিভুবনে এমন প্রাণী ছিলো না, বর্তমানে নাই, ভবিষ্যতে হইবে না, যে প্রাণী কৃষ্ণকর্তৃক রক্ষিত পান্ডবগণকে জয় করিতে পারে।।৪০।।”

👉 তো উক্ত শ্লোকে স্পষ্টতই পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের সর্বশক্তিমত্তা প্রকাশিত হচ্ছে। এটা সামান্যতম দূরদর্শী হলেই বুঝতে পারা যায়। তো এরপর ভীষ্মদেব শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনার জন্য পূর্বকালে গন্ধমাদন পর্বতে ঋষি, দেবতাদিগণ সম্মিলিত হয়ে তন্মধ্যে উপবিষ্ট ব্রহ্মাজির সাথে একটি আলোচনার বর্ণনা দিলেন-

“তাহাদের মধ্যে উপবিষ্ট ব্রহ্মা দর্শন করিলেন- তেজে উজ্জ্বল ও উৎকৃষ্ট একখানা বিমান আকাশে অবস্থান করিতেছে।।৪৩।।
তখন ব্রহ্মা ধ্যানে তাহার বিষয় জানিয়া, সংযত ও হৃষ্ট চিত্ত হইয়া এবং অঞ্জলি বন্ধন করিয়া আদিপুরুষ পরমেশ্বরকে নমস্কার করিলেন ॥৪৪॥
তাহার পর দেবতারা ও ঋষিরা ব্রহ্মাকে দণ্ডায়মান দেখিয়া এবং আকাশে অত্যাশ্চর্য্য বস্তু দেখিতে থাকিয়া সকলেই কৃতাঞ্জলি হইয়া দাঁড়াইলেন॥৪৫॥
পরে বেদজ্ঞশ্রেষ্ঠ, জগতের সৃষ্টিকর্তা ও পরমধৰ্ম্মবিৎ ব্রহ্মা যথানিয়মে সেই পরমদেবতাকে নমস্কার করিয়া বলিতে লাগিলেন-॥৪৬॥
‘ভগবান্। যে হেতু আপনি বিশ্বাবসু, বিশ্বব্যাপী, বিশ্বমূর্তি, বিষক্-সেন, বিশ্বকর্মা, স্বাধীন, বিশ্বেশ্বর, বাসুদেব, মায়াশালী এবং নানাবিধ ক্রীড়াযুক্ত, সেই হেতু আমি আপনার শরণাপন্ন হইতেছি ॥৪৭।।

🌿 এভাবেই ব্রহ্মা সেই পরম ব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণের নিকট প্রপত্তি স্বীকার করে, তাঁর স্তুতি করে বিশদ বর্ণনা দিলেন। কিভাবে পরম-ঈশ্বর, পরম-ব্রহ্ম সৃষ্টিকার্য্য সম্পাদন করেন কিভাবেই’বা তিঁনি ব্রহ্মাজিরও উৎপত্তির কারণ। যা উক্ত অধ্যায়ের পরবর্তী শ্লোকগুলোতে বিদ্যমান। সেই অত্যাশ্চর্য বিমানসহ ব্যক্তি যখন অন্তর্হিত হলেন তখন পরবর্তীতে ঋষি, দেবতাদিগণ জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলেন সেই দিব্য পুরুষ কে। তাদের প্রত্যুত্তরে ব্রহ্মা বললেন- (মহাভারত ভীষ্মপর্বের পরবর্তী ৬৫ নং অধ্যায়ে বর্ণিত)

“দেবশ্রেষ্ঠগণ। সেই যিনি পরম বস্তু এবং যে পরম বস্তু অতীতকালে ছিলেন, বর্তমানে আছেন, ভবিষ্যতেও থাকিবেন, আর যে পরম বস্তু ত্রিভুবনের প্রভু ও ‘ব্রহ্ম’ নামে অভিহিত, তিনি প্রসন্ন হইয়া আমার সহিত আলাপ করিলেন। আমিও জগতের প্রতি অনুগ্রহ করিবার জন্য সেই জগৎপতির নিকট প্রার্থনা করিলাম ॥৬-৭॥

“সমগ্র জগতের প্রভু আমিও সেই নারায়ণেরই জ্যেষ্ঠপুত্র; অতএব দেব-গণ। জগতের মহেশ্বর সেই বাসুদেব তোমাদের পুজনীয়ই হইবেন ॥১৩।।
সুতরাং দেবশ্রেষ্ঠগণ! ‘ইনি মানুষ’ এইরূপ মনে করিয়া কখনও তোমরা, মহাশক্তিশালী ও শঙ্খ-চক্র-গদাধারী সেই নারায়ণকে অবজ্ঞা করিও না ॥১৪৷।
ইনি পরমগোপনীয়, ইনি পরম বস্তু, ইনি পরম ব্রহ্ম এবং ইনি পরম যশ ॥১৫৷৷
ইনি নিত্য, ইনি অব্যক্ত, ইনি চিরস্থায়ী তেজ এবং ঋষিরা যাঁহাকে পুরুষ বলেন, ইনি সেই পদার্থ; কিন্তু ইহাকে জানা যায় না ॥১৬৷৷
ইনি পরম তেজ, ইনি পরম সুখ এবং ইনি পরম সত্য-ইহা বেদ বলিয়াছেন।।১৭।।
অতএব অমিতবিক্রমশালী ও জগদীশ্বর এই বাসুদেবকে মানুষ মনে করিয়া ইন্দ্রপ্রভৃতি দেবতারা কিংবা অন্যান্য লোকেরা যেন ইহাকে অবজ্ঞা করেন না॥১৮।।
যে লোক অজ্ঞানবশতঃ এই হৃষীকেশকে কেবল মানুষ বলিবে, সে লোক মূঢ়বুদ্ধি এবং তাহাকে সকলে পুরুষাধম বলিবে॥১৯।।
মনুষ্যদেহধারী, মহাযোগী ও মহাত্মা বাসুদেবকে যে লোক অবজ্ঞা করিবে, লোকে তাহাকে তমসাচ্ছন্ন বলিবে ॥২০॥

এই অধ্যায়ে আরও দেখা যায় ভীষ্মদেব বলছেন এইসমস্তই তিঁনি মুনিগনদের নিকট তো শুনেছেনই আবার শাস্ত্রবিশারদ! জমদগ্নীনন্দন রাম, জ্ঞানী মার্কন্ডেয়, ব্যাস এবং নারদের নিকটেও শুনেছেন। তাহলে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে সমস্ত মহান মহান ব্যক্তিগণ শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান হিসেবেই জানতেন, এমনকি এভাবে ভীষ্মদেব দুর্যোধনের নিকট শ্রীকৃষ্ণের পরমেশ্বরত্ব বর্ণনা করার দরুন দুর্যোধনও সেই বিষয়ে অবগত ছিলেন, কিন্তু দারুনভাবে মোহগ্রস্ত থাকার ফলে এসব তোয়াক্কা করেননি।
তাই আজকালও দেখা যায় শিশুপাল, দুর্যোধনাদির মতো কিছু লোকজন শ্রীকৃষ্ণকে কেবল মনুষ্যরূপে জেনে থাকে। অথবা জেনে-বুঝেই মোহগ্রস্ত হওয়ায় শ্রীকৃষ্ণের পরমেশ্বরত্ব স্বীকার না করার মতো মারাত্মক দুষ্কর্ম্মে লিপ্ত হয়।

অতএব, সেই সমস্ত অবাঞ্চিতদের দ্বারা বিভ্রান্ত না হয়ে ভীষ্ম আদি মহাজনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কৃষ্ণভক্তিতে যুক্ত থাকুন।। হরেকৃষ্ণ।।

উপস্থাপনে
প্রবীর চৈতন্যচন্দ্র দাস

Join with us 👇

Avatar of Prakash

Prakash

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments