শ্রীকৃষ্ণ কি শুধুই যোগেশ্বর নাকি পরমেশ্বরও?

image_2024-04-28_172805537
तमेव शरणं गच्छ सर्वभावेन भारत ।
तत्प्रसादात्परां शान्तिं स्थानं प्राप्स्यसि शाश्वतम् ॥
তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত ।
তৎপ্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্ ॥
‘হে ভারত! সর্বোতভাবে তাঁর শরণাগত হও। তাঁর প্রসাদে তুমি পরা শান্তি এবং নিত্য ধাম প্রাপ্ত হবে।’
গীতা ১৮/৬২ নং শ্লোকের এই ব্যাখ্যা নিয়ে ভগবদগীতার পাঠক হৃদয়ে কৌতূহলের অন্ত নেই!!!
স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ এখানে অর্জুনকে কার শরণাগত হওয়ার কথা বলছেন?!
উপরিউক্ত শ্লোকের ঠিক আগের অর্থাৎ ১৮/৬১ শ্লোক যদি দেখি—
ईश्वर: सर्वभूतानां हृद्देशेऽर्जुन तिष्ठति ।
भ्रामयन्सर्वभूतानि यन्‍त्रारूढानि मायया ॥
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি ।
ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া ॥৬১॥
“হে অর্জুন! পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছেন।”
এবং, এর পরের শ্লোক অর্থাৎ ১৮/৬২ এ শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নিশ্চয়ই সেই পরমেশ্বরের শরণ গ্রহণ করার কথা বলেছেন যিনি সকলের হৃদয়ে বিরাজ করছেন। তাই নয় কি?!
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তবে তো শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর নন, যদি হতেন তবে তিনি কেন অর্জুনকে
—>”আমার(কৃষ্ণের) শরণাগত হও”<—
না বলে পরমেশ্বরের শরণ গ্রহণ করার কথা বলেছেন?!
তবে একটা বিষয় এখান থেকে মেনে নিতেই হবে যে এই শ্লোক অবশ্যই শ্রীকৃষ্ণ বলছেন। তা না হলে এর অর্থ সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়াবে। অর্থাৎ ভগবদগীতায় “ভগবান উবাচ” বলে যতটি শ্লোক আছে তার প্রবক্তা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। তা না হলে ১৮/৬২ শ্লোককে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?! নিশ্চয়ই একমত হবেন যে এই শ্লোক শ্রীকৃষ্ণই বলছেন।
এবার একটু পিছনে তাকানো যাক। আমরা শ্রীমদ্ভগবদগীতার ১৫/১৫ শ্লোকটি যদি দেখি, সেখানে বলা আছে —
सर्वस्य चाहं हृदि सन्निविष्टो।
সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টো
“আমি সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থিত”।
এবার চিন্তা করে দেখুন তো ১৮/৬১ এবং ১৮/৬২ নং শ্লোক যদি শ্রীকৃষ্ণ বলে থাকেন নিশ্চয়ই এই শ্লোকটিও তিনিই বলেছেন।
অতএব শ্রীকৃষ্ণ আগেই পঞ্চদশ অধ্যায়ে বলে গেলেন যে “আমিই সমস্ত জীবের হৃদয়ে বিরাজ করি”। আর পরবর্তীতে অষ্টাদশ অধ্যায়ের ৬১,৬২ নং শ্লোকে বললেন “হে অর্জুন! তুমি সকলের হৃদয়ে বিরাজমান পরমেশ্বরের শরণ গ্রহণ কর”।
আবার শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং একটু পরেই অর্থাৎ ১৮/৬৬ শ্লোকে বলছেন
सर्वधर्मान्परित्यज्य मामेकं शरणं व्रज ।

সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ ।

“সকল প্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণ গ্রহণ করো।”
এবার তাহলে ঝামেলা তৈরি হলো!!!
একবার বলছেন “আমার শরণ গ্রহণ করো” অন্যত্র বলছেন “তাঁর(পরমেশ্বর) শরণ গ্রহণ করো”। এরকম দ্বৈততা কেন?!
ভগবদগীতার ১৫/১৫ অনুযায়ী(প্রত্যক্ষ উক্তিতে) এবং ১৮/৬১ শ্লোক অনুযায়ী (পরোক্ষ উক্তিতে) দুজনই যেহেতু একই ব্যক্তি অতএব শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরমেশ্বর। অতঃপর তাঁর এই দ্বৈত উক্তিতে আমাদের আর সন্দেহ থাকার কথা নয়। কারণ পরমেশ্বর যে একইসাথে এক এবং সর্বব্যাপক(পরমাত্মা) রূপে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন তা বৈদিক শাস্ত্র থেকে আমরা জানতে পারি।
नामेको बहूनां यो विदधाति कामान् ।
একো বহূনাং যো বিদধাতি কামান্ ।।
(কঠ উপঃ ২/২/১৩, শ্বেতাশ্বতর উপঃ ৬/১৩)
” যিনি এক হইয়াও বহু জীবের কাম সকল বিধান করিয়া থাকেন”।
वायुर्यथैको भुवनं प्रविष्टो रूपं रूपं प्रतिरूपो बभूव ।
एकस्तथा सर्वभूतान्तरात्मा रूपं रूपं प्रतिरूपो बहिश्च ॥
“সর্বভূতের একই অন্তরাত্মা নানা বস্তুভেদে তদ্বস্তুরূপ হইয়াছেন এবং সকল প্রাণীর বাহিরেও অবস্থান করেন।”
– কঠোপনিষদ ২/২/১০
আসীনো দূরং ব্রজতি শয়ানো যাতি সর্বতঃ
সেই পরমেশ্বর বসে থেকেই দূরে চলে যান, আবার শুয়ে থেকেই সর্বত্র চলাফেরা করেন।
– কঠোপনিষদ ১/২/২১
तदन्तरस्य सर्वस्य तदु सर्वस्यास्य बाह्यतः ॥
‘তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বাস্যাস্য বাহ্যতঃ
(ঈশোপনিষদ ৫)
তিনি সকল বস্তুর ভিতরে বিরাজ করেন, তিনি সকল বস্তুর বাহিরেও অবস্থান করেন।

যো যোনিং যোনিমধিতিষ্ঠত্যেকো

বিশ্বানি রূপাণি যোনীশ্চ সর্বাঃ।

ঋষিং প্রসূতং কপিলং যস্তমগ্রে

জ্ঞানৈর্বিভর্ত্তি জায়মানঞ্চ পশ্যেৎ।।

(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৫/২) 

অনুবাদ:- যিনি এক হয়েও প্রত্যেক বস্তুর ও সমষ্টিভূত বিশ্বরূপের উৎপত্তিস্থানে অন্তর্যামী রূপে অবস্থান করেন, যিনি কল্পের আদিতে সৃষ্ট হিরন্যগর্ভ ব্রহ্মাকে জ্ঞানের দ্বারা পুষ্ট করেছিলেন ও পরে তার জায়মান দশায় কৃপাকটাক্ষ করেছিলেন, তিনি জীব হতে ভিন্ন পুরুষ, অর্থাৎ পরমেশ্বর।

———————————————————————————————————————————————

পরমেশ্বরের একইসাথে এক এবং বহুভাবে নিজেকে বিস্তারের যে অচিন্ত্য তত্ত্ব তা আমাদের বোধগম্য হওয়া যদিও কঠিন তবুও শাস্ত্রে কিছু উদাহরণ এর মাধ্যমে আমাদের সেই অচিন্ত্য শক্তির কিঞ্চিত ধারণা দেওয়া হয়েছে।
একদেশস্থিতস্যাগ্নের্জ্যোৎস্না বিস্তারিণী যথা ।
পরস্য ব্রহ্মণঃ শক্তিস্তথেদমখিলং জগৎ ।।
(বিষ্ণু পুরাণ ১/২২/৫৩)
অনুবাদ: একই স্থানে অবস্থিত অগ্নির প্রভা বা আলোক যেমন সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়, সেই রকম পরব্রহ্মের শক্তি অখিল জগৎ জুড়ে ব্যাপ্ত হয়ে আছে।
দীপার্চিরেব হি দশান্তরমভ্যুপেত্য
দীপায়তে বিবৃতহেতুসমানধর্মা ।
(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৪৬)
অনুবাদ: এক মূল প্রদীপের জ্যোতি অন্য বর্তি বা বাতিগত হয়ে বিবৃত (বিস্তার) হেতু সমান ধর্মের সঙ্গে পৃথক প্রজ্জ্বলিত হয়।
———————————————————————————————————————————————
এই তত্ত্বটি আরও স্পষ্ট হয় শ্রীমদ্ভাগবতে, যেখানে কুন্তিদেবী মহারাজ পরীক্ষিতের প্রাণরক্ষার জন্য কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করছিলেন—
অন্তঃস্থঃ সর্বভূতানামাত্মা যোগেশ্বরো হরিঃ
স্বমায়য়াবৃণোদ্‌গর্ভং বৈরাট্যাঃ কুরুতন্তবে ৷।
শ্রীমদ্ভাগবতঃ ১/৮/১৪  
অনুবাদঃ পরম যোগ রহস্যের নিয়ন্তা যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ সর্ব জীবের হৃদয়ে পরমাত্মারূপে বিরাজ করেন। তাই কুরুবংশ রক্ষা করার জন্য তাঁর যোগমায়ার দ্বারা তিনি উত্তরার গর্ভ আবৃত করলেন।
———————————————————————————————————————————————
মূর্খদের যে দাবি, “শ্রীকৃষ্ণের অন্তরস্থ পরমেশ্বর ভগবদ্‌গীতার জ্ঞান প্রদান করেছিলেন” তা একেবারেই মিথ্যা কেননা শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং পরমব্রহ্ম, পরমাত্মা। তাঁর অন্তর বাহির বলে কিছুই নেই।
(বসুদেব কর্তৃক শ্রীকৃষ্ণের স্তব)
অনাবৃতত্বাদ বহিরন্তরং ন তে
সর্বস্য সর্বাত্মন আত্মবস্তুনঃ।।
শ্রীমদ্ভাগবতঃ ১০/৩/১৭
অনুবাদঃ আপনি বাহ্য ও অন্তরশূন্য। আপনি কখনও দেবকীর গর্ভে প্রবেশ করেননি; পক্ষান্তরে, আপনি পূর্বেই সেখানে বিদ্যমান ছিলেন।
———————————————————————————————————————————————
পরিশেষে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনিত হলাম যে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এক এবং অদ্বিতীয় স্বরুপ হিসেবে অর্জুনের রথে উপস্থিত হয়ে শ্রীমদ্ভগবদগীতার জ্ঞান দান করেছেন। আবার তিনিই সর্বব্যাপ্ত পরমাত্মা (ক্ষীরোদক্‌শায়ী বিষ্ণু)রূপে সকলের হৃদয়ে প্রকাশিত হয়ে সকলের কামনা বিধান করেন।
অতএব ভগবদগীতায় কোন আপাতবিরোধী কথা বলা হয়নি। যারা শ্রীকৃষ্ণের পরমেশ্বরত্ব অস্বীকার করেন তাদের কাছেই কেবল এসকল তত্ত্বকে সাংঘর্ষিক বা প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হতে পারে, ভক্তদের কাছে নয়।
কিছু ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠী পরমেশ্বরের অসীম, অচিন্ত্য ঐশ্বর্যকে তাদের ক্ষুদ্র জ্ঞান দ্বারা সংজ্ঞায়িত করতে চায়, তাঁর(শ্রীকৃষ্ণ) বিরোধিতা করে তাঁকে অবমাননা করে। তবে তাদের বাকচাতুর্য কখনোই ভক্তহৃদয়কে ব্যথিত করতে পারে না।
কারণ তাঁরা জানেন,
अवजानन्ति मां मूढा मानुषीं तनुमाश्रितम् ।
“অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্-
আমি যখন মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হই, মূর্খেরা আমাকে অবজ্ঞা করে”।
– গীতা ৯/১১
৷৷হরে কৃষ্ণ৷৷
৷৷প্রণাম৷৷

Ananta Shayi Das

Writer & Admin

1 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments