ঈশ্বর এক (একজন)নাকি বহু?

IMG-20250208-WA0046

ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। তিনি অনাদির আদি।তিনি সর্বব্যাপী। তিনি এই সমগ্র জগৎ সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আবার এই জগৎকে পালন করছেন,পুনরায় তিনিই আবার এই জগৎকে ধ্বংস করবেন। তাকে সনাতনী শাস্ত্রে ভগবান,পরমব্রহ্ম,পরমাত্মা, পরমেশ্বর বলা হয়েছে। বেদসহ সমগ্র সনাতনী শাস্ত্র অনুসারে সেই ঈশ্বর হলেন সাকার।অথাৎ ঈশ্বরের মস্তক(মাথা),চক্ষু (চোখ),হস্ত(হাত),পদ(পদ) ইত্যাদি সমস্ত ইন্দ্রিয় বিদ্যমান।

দিবো বা বিষ্ণো উত বা পৃথিব্যা
মহো বা বিষ্ণু উরোরন্তরিক্ষাৎ।
উভো হি হস্তা বসুনা পূনস্বা
প্রযচ্ছ দক্ষিণাদোত সব্যাদ্বিষ্ণবে দ্বা।।

– (শুক্ল যজুর্বেদ ৫।১৯)

অনুবাদঃ হে বিষ্ণু(ঈশ্বর),তুমি দ্যুলোক অথবা ভূলোক হতে কিংবা মহান বিস্তৃত অন্তরিক্ষলোক হতে, তোমার উভয় হস্ত ধনের দ্বারা পূর্ণ কর। এবং দক্ষিণ অথবা বাম হস্তে আমাদের তা দান কর।

বেদ,রামায়ন,মহাভারত,
অষ্টাদশ পুরান, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ইত্যাদি শাস্ত্র অনুসারে ঈশ্বর একজন।তথাপি তিনি তার অনন্ত শক্তির প্রভাবে বহুরুপে এবং বহুনামে নিজেকে প্রকাশ করেন।

সমগ্র সনাতনী শাস্ত্র অনুসারে সে এক পরমেশ্বর হলেন শ্রীকৃষ্ণতিনি বিষ্ণু, রাম,বলরাম,বামন,নৃসিংহ, বরাহ,কূর্ম ইত্যাদি বহুরুপে নিজেকে প্রকাশ করেন।একটি মাটির প্রদীপের অগ্নি থেকে বহু বহু মাটির প্রদীপে অগ্নি প্রজ্বলিত করা হলেও, সমস্ত প্রদীপকে দেখতে যেমন ভিন্ন ভিন্ন মনে হয়,কিন্তু তারপরেও প্রতিটি প্রদীপই যেমন এক অগ্নি,ঠিক তেমনই এক পরমেশ্বর ভগবান হলেন শ্রীকৃষ্ণ, তিনি তার অনন্ত শক্তির প্রভাবে বিষ্ণু,রাম, বলরাম,নৃসিংহ ইত্যাদি বহুরুপে প্রকাশিত বা আবির্ভূত হলেও মূলত তারা এক পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।

                  ১/একো বশী সর্বভূতান্তরাত্মা

একং রূপং বহুধা যঃ করোতি

তমাত্মস্থং যেহনুপশ্যন্তি ধীরাস্তেষাং
   সুখং শাশ্বতং নেতরেষাম্’।। ১২ ৷।

-কঠোপনিষৎঃ ২/২/১২ ( কৃষ্ণ যজুর্বেদ)

শব্দার্থঃ একঃ=এক, বশী= নিয়ন্ত্রক/নিয়ন্তা, সর্বভূতান্তরাত্মা=সর্ব জীবের অন্তরাত্মা,একম রুপম বহুধা=এক /অদ্বিতীয় স্বরুপ / রুপ থেকে বহু রুপ,য= যিনি/তিনি, করোতি=করেন।তম্ আত্মস্থম্=তাঁকে অন্তরস্থিতরূপে;যে=যে,অনুপশ্যন্তি=নিরন্তর দর্শন করেন,ধীরাঃ = জ্ঞানী পুরুষেরা,তেষাম্ =তাঁদের; সুখম শাশ্বতম্ = শাশ্বত সুখ (পরমানন্দস্বরূপ বাস্তবিক সুখ প্রাপ্তি হয়),ন= নয়,ইতরেষাম্ =অপরের । ১২॥

অনুবাদঃ যিনি একক নিয়ন্তা, সর্ব জীবের অন্তরাত্মা, যিনি এক /অদ্বিতীয় স্বরুপ / রুপ থেকে বহু রুপ ধারন করেন,তাঁকে অন্তরস্থিতরূপে জ্ঞানী পুরুষেরা নিরন্তর দর্শন করে শাশ্বত সুখ লাভ করেন।কিন্তু  অন্যদের ক্ষেত্রে তা লাভ করা সম্ভবপর নয়।

২/”সহস্রং স একমুখো” ঈশ্বরের সহস্র রূপ তথাপি তিনি এক। –অথর্ববেদ ৯/৪/৯

৩/”সহস্রস্য প্রতিমা বিশ্বরুপম।।”এক পরম ঈশ্বরের অসংখ্য রুপের প্রতিমা বা মূর্তি বা রুপ রয়েছে।
– শুক্ল যজুর্বেদঃ ১৩/৪১

৪/”তদৈক্ষত বহুস্যাং প্রজায়েয়তি” -পরমেশ্বর বহু রুপে নিজেকে বিস্তার করেন।

 -ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬/২/৩( সামবেদ)

৫/”অজায়মানো বহুধা বিজায়তে -সেই পরমেশ্বর যদিও জন্মরহিত তথাপিও তিনি বহুরুপে জন্মগ্রহণ করেন

-শুক্ল যজুর্বেদ -৩১/১৯,তৈত্তিরীয় আরন্যক ৩/১৩/১

৬/যে ত্রিষপ্তাঃ পরিয়ন্তি বিশ্বরুপানি বিভ্রতঃ।

বাচষ্পতির্বলা তেষা তন্বো অদ্য দধাতু মে।।

– অথর্ববেদ ১/১/১

অনুবাদঃ”যিনি (যে) স্বর্গ, মত্য এবং পাতাল এই তিন লোক (ত্রিষপ্তা) জুড়ে পরিব্যাপ্ত ( পরিয়ন্তি),সেই ঈশ্বর বহুরূপ (বিশ্বরুপানি) ধারী ( বিভ্রত)। সে ঈশ্বর (বাচষ্পতি) তাহার শক্তি ( বলা তেষা) আমার শরীরে ( তন্বো) তিনি আমাকে দান করুন ( অদ্য দধাতু মে)।”

৭/রুপং রুপং প্রতিরুপো বভূব
তদস্য রুপং প্রতিচক্ষণায়।
ইন্দ্রো মায়াভিঃ পুরুরুপ ঈয়তে
যুক্তা হ্যস্য হরয়ঃ শতা দশ।।

-ঋগ্বেদ ৬/৪৭/১৮

অনুবাদঃ ঈশ্বর (ইন্দ্র), বিভিন্ন রুপ বা দেহ ধারন করেন। এবং সে রুপ ধারন করে তিনি পৃথকভাবে প্রকাশিত হন।তিনি তার অন্তরঙ্গা শক্তি দ্বারা বিবিধ রুপ ধারন করে যজমানগণের নিকট উপস্থিত হন।কারন তার রথ সহস্র অশ্ব সংযুক্ত(অনন্ত শক্তি), অথাৎ তিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী।

৮/”একো দেবো নিত্যলীলানুরক্তো ভক্তব্যাপী হৃদ্যন্তরাত্মা”

-(পুরুষবোধিনী উপনিষদ)

অনুবাদঃ –এক ও অদ্বিতীয় পরমেশ্বর ভগবান নানা দিব্যরুপে তার শুদ্ধ ভক্তদের সঙ্গে লীলা সম্পাদনে নিত্য অনুরক্ত।

একই কথা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদগীতার ৪/৬,৭,৮ নং শ্লোকে বর্ণনা করেন..

৯/অজোহপি সন্নব্যায়িত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন। প্রকৃতিং স্বামহধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।। যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানি ভবতি ভারত।অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।।পরিত্রানায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ।ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন।।

– (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৪/৬,৭,৮,৯)

অনুবাদঃ হে অর্জুন, যদিও আমি সমস্ত জীবের ঈশ্বর,যদিও আমার জন্ম নেই ( অজ)এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় ।তবুও আমি আমার অন্তরঙ্গ শক্তিকে আশ্রয় করে অবতীর্ণ হই।যখনই জগতে ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের পরিমান বেড়ে যায়,তখনই সাধুদের (ভক্ত) রক্ষা ও দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপন হেতু যুগে যুগে অবতীর্ন হই।হে অর্জুন! ‍যিনি আমার এই প্রকার দিব্য জন্ম ও কর্ম যথাযথভাবে জানেন, তাঁকে আর দেহত্যাগ করার পর পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না, তিনি আমার নিত্য ধাম ( চিন্ময় জগৎ) লাভ করেন।

এছাড়াও এ সম্পর্কে অথর্ববেদীয় গোপালতাপনী উপনিষদে বলা হয়েছে –

 ১০/একো বশী সর্বগঃ কৃষ্ণ ঈড্য
একোহপি সন্ বহুধা হো বিভাতি।

-গোপালতাপনী উপনিষদ ১/২১ (অথর্ববেদ)

অনুবাদঃ একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান এবং তিনিই আরাধ্য।তিনি এক,কিন্তু তিনি অনন্ত রুপের মাধ্যমে প্রকাশিত হন

ব্রহ্মসংহিতা শাস্ত্রেও এ সম্পর্কে বলা হয়েছে –

১১/দীপার্চ্চিরেব হি দশান্তরমভ্যুপেত্য
দীপায়তে বিবৃতহেতুসমানধৰ্ম্মা।
যস্তাদৃগেব হি চরিষ্ণুতয়া বিভাতি
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।।৪৬।।

-(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৪৬)

অনুবাদঃ এক মূল প্রদীপের জ্যোতিঃ(অগ্নি) যেমন অন্য বর্তি বা বাতি-গত হয়ে বিস্তার (বিবৃত) হেতু সমান ধর্মের সাথে পৃথক প্রজ্বলিত হয়, সেইরূপ যিনি বিষ্ণুরুপে( রিষ্ণু) প্রকাশ পান, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে (শ্রীকৃষ্ণ) আমি ভজনা করি ।”

১২/যস্যৈকনিশ্বসিতকালমথাবলম্ব্য
জীবন্তি লোমবিলোজা জগদগুনাথাঃ।
বিষ্ণুর্মহান্ স ইহ যস্য কলাবিশেষো
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।৪৮

-(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৪৮)

অনুবাদঃ মহাবিষ্ণুর একটি নিশ্বাস বের হয়ে যে কাল পর্যন্ত অবস্থান করে, তাঁর রোমকূপজাত ব্রহ্মাণ্ডপতি ব্রহ্মাদি সেই-কালমাত্র জীবিত থাকেন। সেই মহাবিষ্ণু-যাঁর কলাবিশেষ অর্থাৎ অংশের অংশ, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে (শ্রীকৃষ্ণ)আমি ভজনা করি।।৪৮।।

১৩/রামাদিমূর্তিষু কলানিয়মেন তিষ্ঠন
নানাবতারমকরোদ্ভূবনেষু কিন্তু।
কৃষ্ণ স্বয়ং সমভবৎ পরমঃ পুমান্ যো
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ॥ ৩৯ ॥

-(ব্রহ্মসংহিতা৫/৩৯)
অনুবাদঃ যে পরমপুরুষ স্বাংশ কলাদি নিয়মে রাম, নৃসিংহ ইত্যাদি মূর্তিতে স্থিত হয়ে ভুবনে নানাবতার প্রকাশ করেছিলেন এবং স্বয়ং কৃষ্ণরূপে প্রকট হয়েছিলেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে (শ্রীকৃষ্ণ)
আমি ভজনা করি।

হরে কৃষ্ণ। প্রনাম

সদগুন মাধব দাস।
স্বধর্মম্ : Connect to the inner self.

Sadgun Madhav Dash

Writer & Admin

1 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Joy kanti dey
Joy kanti dey
4 months ago

Nice structure all documents with attachments.