শ্রীকৃষ্ণের জন্মের পূ্র্বে যদি বেদ সৃষ্টি হয়,তাহলে কিভাবে বেদে শ্রীকৃষ্ণের নাম উল্লেখ করা হয়েছে?

20250410_121246

বেদ হল সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ।বেদের অপর নাম শ্রুতি।বেদ বা শ্রুতি  চারপ্রকার –ঋগ্,যর্জু, সাম,অর্থব।প্রতিটি বেদ বা শ্রুতি আবার চারপ্রকার-সংহিতা(উপাসনা কান্ড), ব্রাহ্মণ( কর্মকান্ড),আরন্যক এবং  উপনিষদ(জ্ঞানকান্ড)।অথাৎ প্রতিটি বেদ বা শ্রুতি শাস্ত্রের প্রথম ভাগ হল সংহিতা।দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ভাগ হল বহুবিধ ব্রাহ্মণ ও আরন্যক ।এরপর  চতুর্থ ভাগ হল উপনিষদসমূহ।উপনিষদ যেহেতু প্রতিটি বেদের সর্বশেষ ভাগ তাই উপনিষদকে বেদান্ত বা বেদ শাস্ত্রের অন্তভাগও বলা হয়।

এখন আপনার প্রশ্ন হল,শ্রীকৃষ্ণের জন্মের পূর্বে তো বেদ সৃষ্টি হয়েছে,তাহলে বেদে কিভাবে শ্রীকৃষ্ণের নাম উল্লেখ করা হয়েছে?এর উত্তর হল-

ব্রহ্মসংহিতা,মহাভারত, স্কন্দ পুরান, পদ্মপুরান,ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান আদি অষ্টাদশ পুরান, গোপালতাপনী উপনিষদ ইত্যাদি শাস্ত্রের বর্ণনা অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ  তার স্বধাম চিন্ময় জগতের গোলক বৃন্দাবনে নিত্য বিরাজমান (ব্রহ্মসংহিতা৫/৪৩)। অথর্ববেদের অন্তর্গত গোপালতাপনী উপনিষদ,কৃষ্ণ উপনিষদ,  সামবেদের অন্তর্গত ছান্দোগ্য উপনিষদ,কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্গত নারায়ন উপনিষদ ইত্যাদি শাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান বলা হয়েছে।

 ব্রহ্মন্যো দেবকীপুত্র”দেবকীপুত্র শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর ভগবান।  -নারায়ন উপনিষদ ৪( কৃষ্ণ যজুর্বেদ)

“একো বশী সর্বগঃ কৃষ্ণ ঈড্যঃসেই একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই  পরম পুরুষোত্তম ভগবান,তিনিই আরাধ্য।

    – গোপালতাপনী উপনিষদ  ১/২১(অথর্ববেদ)

মৎস্যপুরাণ৬৯/৬-৮,স্কন্দপুরাণ- প্রভাসখণ্ড ১৯/৭১-৭৮, চৈ. চঃ আদি.৩/৫-১০ অনুসারে,” প্রতি দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণ এ পৃথিবীতে আবির্ভূত হন না,শুধুমাত্র  ব্রহ্মার একদিনে( “সহস্রযুগপর্যন্তমর্যদ বিদু” ব্রহ্মার ১ দিন  সমান মনুষ্যজীবের ১০০০ চতুর্যুগ”- গীতা  ৮/১৭) মাত্র একবার অথাৎ অষ্টাবিংশ  দ্বাপর যুগের শেষভাগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ  এ পৃথিবীতে আবির্ভুত হন”।

বৈবস্বতাখ্যে সঞ্জাতে সপ্তমে সপ্তলোক-কৃৎ।
    দ্বাপরাখ্যং যুগং তদ্বদষ্টাবিংশতিমং জগুঃ।।
    তস্যান্তে স মহাদেবো বাসুদেবো জনার্দ্দনঃ।
     ভারাবতরণার্থায় ত্রিধা বিষ্ণুর্ভবিষ্যতি।।
    দ্বৈপায়নঋষিন্তব্বদ্রৌহিণেয়োঽথ কেশবঃ।
    কংসাদি-দর্পমত্থনং কেশবঃ ক্লেশনাশনঃ।।

অনুবাদঃ বৈবস্বতাখ্য সপ্তম মন্বন্তর উপস্থিত হলে তাহার যে অষ্টাবিংশতিতম দ্বাপর যুগ, সেই যুগের শেষভাগে সপ্তলোককর্তা মহাদেব বাসুদেব জনার্দ্দন ভূভার-হরণের জন্য দ্বৈপায়ন, রৌহিণেয় ও কেশব এই ত্রিধা মূর্তিতে আবির্ভূত হইবেন। সেই কেশব কংসাদি দর্প দলন করে সকলকে ক্লেশাপনয়ন করবেন।

                 -মৎস্যপুরাণেঃ৬৯/৬-৮

বৈবস্বতেঽস্তরে প্রাপ্তে যশ্চায়ং বর্ত্ততেঽনা। দ্বাপরে বিষ্ণুরষ্টাবিংশে পরাশরাৎ। বেদব্যাসস্ততো জজ্ঞো। তত্রৈব দেবক্যাং বসুদেবাত্তু ব্রহ্মগর্গ-পুরঃসরঃ। একবিংশতমস্যাস্য দ্বাপরস্যাংশসঙ্ক্ষয়ে। নষ্টে ধর্মে তদা জজ্ঞে বিষ্ণুর্বৃষ্ণিকুলে স্বয়ং।

অনুবাদঃ এখন যে বৈবস্বত মন্বন্তর চলছে, সেই মন্বন্তরে অষ্টাবিংশচতুর্যুগীয় দ্বাপরে পরাশর হতে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন জন্মগ্রহণ করেন। সেই দ্বাপরেই ব্রহ্মর্ষি গর্গমুনিকে অগ্রে করে বসুদেব হতে দেবকীতে ভগবান জন্মগ্রহণ করেন। এই দ্বাপরের একবিংশতিতম সন্ধ্যাংশের সম্যক ক্ষয়ে (দ্বাপরের শেষভাগে) ধর্মহানি হলে যদুকূলে স্বয়ং বিষ্ণু (স্বয়ংরূপ কৃষ্ণ) জন্মলীলা  করেন।

          -স্কন্দপুরাণঃপ্রভাসখণ্ড ১৯।৭১-৭৮

পূর্ন ভগবান কৃষ্ণ ব্রজেন্দ্রকুমার।গোলোকে ব্রজের সহ নিত্য বিহার।। ব্রহ্মার এক দিনে তিহোঁ অবতার। অবতীর্ণ হঞা করেন প্রকট বিহার।সত্য,ত্রেতা,দ্বাপর,
কলি,চারিযুগ জানি।সেই চারিযুগ দিব্য একযুগ মানি।। একাত্তর চতুর্যুগে এক মন্বন্তর।চৌদ্ধ মন্বন্তর ব্রহ্মার দিবস ভিতর।।” বৈবস্বত” – নাম এই সপ্তম মন্বন্তর।সাতাইশ চতুর্যুগ তাহার ভিতর।। অষ্টাবিংশ চতুর্যুগে দ্বাপরের শেষে।  ব্রজের সহিতে হয় কৃষ্ণের প্রকাশে।।”

অনুবাদঃ ব্রজরাজের পুত্র শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। তিনি ব্রজধাম সহ তার নিত্য আলয় গোলক বৃন্দাবনে  নিত্য লীলাবিলাস করছেন।ব্রহ্মার একদিনে একবার তিনি তার অপ্রাকৃত লীলা প্রকট করার জন্য এই জড়জগতে অবতীর্ণ হন। আমরা জানি যে সত্য, দ্বাপর ও কলি এই চারটি যুগ রয়েছে। এই চারটি যুগকে একত্রে এক দিব্যযুগ বলা হয়। একাত্তরটি দিব্যযুগে এক মন্বন্তর হয়। ব্রহ্মার এক দিনে চৌদ্ধটি মন্বন্তর রয়েছে। বর্তমান সপ্তম মন্বন্তরে মনু হচ্ছেন বৈবস্বত।তার আয়ুষ্কালের সাতাশ দিব্যযুগ গত হয়েছে।  অষ্টাবিংশতি দিব্য যুগের দ্বাপর যুগের শেষভাগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার নিত্য ব্রজধামের সমস্ত উপকরণসহ এই জড় জগতে আবির্ভূত হন।  

           – শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতঃ আদি.৩/৫-১০

এইভাবে ব্রহ্মার শতবছরে শ্রীকৃষ্ণ বহুবার এই মত্যলোকে আবির্ভূত হন,  দুষ্টের দমন,  সৃষ্টের পালন, এবং ধর্ম সংস্থাপন করেন।আজ থেকে ৫২৪৯বছর (২০২৩ ইংরেজী অনুযায়ী) পূর্বে  দ্বাপর যুগের শেষভাগে বর্তমান ভারতের মথুরা প্রদেশে কংসের কারাগারে বসুদেব এবং দেবকী মাতার অষ্টম পুত্ররুপে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এ জড় জগতে আবির্ভূত হন।

অথর্ববেদের  অন্তগর্ত গোপালতাপনী উপনিষদ অনুসারে এই জড় ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির পর প্রথম ব্রহ্মাকে  ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বেদ জ্ঞান প্রদান করেন।

 “যো ব্রহ্মাণং বিদধাতি পূর্বং  যো বিদ্যাতস্মৈ গোপয়তিস্ম কৃষ্ণ।”

অনুবাদঃশ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মাকে প্রথমে বেদবিদ্যা প্রদান করেন।এবং তিনিই সেই জ্ঞান আদিকালে ( সৃষ্টির শুরুতে) প্রদান করেছিলেন।

     -গোপালতাপনী উপনিষদ১/২৪ (অথর্ববেদ)

কৃষ্ণ  যর্জুবেদের অন্তর্গত শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদেও একই কথা বলা হয়েছে।সেখানে বলা হয়েছে, পরমেশ্বর ভগবান প্রথম ব্রহ্মাকে বেদজ্ঞান প্রদান করেন।

যো ব্রহ্মাণং বিদধাতি পূর্বং যো বৈ বেদাংশ্চ প্রহিনোতি তমৈ।তং হ দেবমাত্মবুদ্ধি প্রকাশং মুমুক্ষুবৈ শরণমহং প্রপদ্যে।।”

অনুবাদঃ যিনি সৃষ্টির প্রারম্ভে ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করেছেন,তিনি তার উদ্দেশ্যে বেদ বিদ্যা প্রেরণ করেছেন, আত্মবিষয়ক বুদ্ধির প্রকাশক সেই পরমেশ্বরের(শ্রীকৃষ্ণের) নিকট আমি শরণাপন্ন হই।

  -শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৬/১৮ (কৃষ্ণ যজুর্বেদ)

পরিশেষে,উপরোক্ত আলোচনায় স্পষ্টভাবে বুঝা যায়,আজ থেকে ৫ হাজার বছর পূর্বে শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপরযুগে আবির্ভূত হলেও বেদ বা শ্রুতি প্রমান  অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরমেশ্বর ভগবান,তিনি এ জগৎ সৃষ্টির সূচনা লগ্নে ব্রহ্মাকে বেদজ্ঞান প্রদান করেন।ব্রহ্মার প্রতিদিবসে একবার শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন,এইভাবে শ্রীকৃষ্ণ অসংখ্যবার এই জড় জগতে আবির্ভূত হন।অথর্ববেদের গোপালতাপনী উপনিষদ অনুসারে, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে বেদজ্ঞান ব্রহ্মাকে দান করেন।এরপর ঋষিগন সে বেদজ্ঞান ধ্যানের মাধ্যমে ব্রহ্মা থেকে প্রাপ্ত হন।

অনেকে মনে করেন বেদের জ্ঞান হল সত্যযুগের, কিন্তু তা ঠিক নয়।তবে বেদের জ্ঞান সত্যযুগ থেকে দ্বাপর যুগ পর্যন্ত গুরু থেকে শিষ্য পরম্পরার ধারায় ঋষিদের মাঝে শ্রৌতপন্থায় প্রবাহিত হয়েছিল। দ্বাপর যুগের শেষের দিকে ভগবানের শক্ত্যাবেশ অবতার ( শক্তির আবেশ অবতার)  শ্রীল ব্যাসদেব বেদ লিপিবদ্ধ করেন,যেখানে পরমেশ্বর ভগবানরুপে  শ্রীকৃষ্ণের নাম এবং মহিমা উল্লেখ করা হয়েছে ।

                       হরে কৃষ্ণ।প্রনাম

Avatar of Sadgun Madhav Dash

Sadgun Madhav Dash

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments