কিছু ভগবদ্বিদ্বেষী সাধারণ সনাতনীদের মাঝে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ,শ্রীকৃষ্ণ জন্মখন্ড, অধ্যায় ৩৬, শ্লোক সংখ্যা১০৫ ব্যবহার করে(তাদের রেফারেন্স ১০৬ যেটা ভূল,সঠিক হবে ১০৫) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার করছে।শ্লোকটি নিম্নরুপ-
ব্রহ্মণঃ পতনে নাপি শূলপাণেঃ ক্ষয়ো ভবেৎ।
তস্মাযুষঃ প্রমাণঞ্চ নাহং জনামি কা শ্রুতিঃ ॥ ১০৫
-ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণঃ শ্রীকৃষ্ণ জন্মখন্ড ৩৬/ ১০৫
অনুবাদঃ ব্রহ্মার পতন হইলেও শিবের বিনাশ হয় না; তাঁহার আয়ু সংখ্যা আমি জানি না, শ্রুতি কি জানিবে?১০৫।
এ শ্লোকটি রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে তারা অপপ্রচার করছে, শ্রীকৃষ্ণ কখনো পরমতত্ত্ব / পরমেশ্বর নন।যদি তিনি পরমেশ্বর হবেন,তবে তিনি কেন বললেন,শিবের আয়ু কত তা তিনি জানেন না।পরমেশ্বরের কি কখনো কোন কিছু অজ্ঞাত থাকে?সুতরাং শ্রীকৃষ্ণ কখনো পরমেশ্বর নন,পরমেশ্বর হল শিব।
অথচ তাদের এ প্রশ্নের উত্তর উক্ত শ্লোকে এবং তার পরের শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্ট শব্দে বর্ণনা করেছেন।শ্লোকসমূহ নিম্নরুপ-
দিব্যলোকে দিব্যতল্পে জনতায়াং ন তন্মনঃ।
শ্মশানেহতীবরহসি ধ্যায়তে মামহর্নিশম্ ॥ ১০৩
আব্রহ্মতৃণপর্য্যন্তৎ স্বপ্নবন্মন্যতে শিবঃ।
মমানির্বচনীয়েহত্র রূপে তন্মগ্নমানসম্ ॥ ১০৪
ব্রহ্মণঃ পতনে নাপি শূলপাণেঃ ক্ষয়ো ভবেৎ।
তস্মায়ুষঃ প্রমাণঞ্চ নাহং জানামি কা শ্রুতিঃ ॥ ১০৫
জ্ঞানং মৃত্যুঞ্জয়ং শূলমদধাৎ তেজসা সমম।
বিনা ময়ান কশ্চিৎ তৎ শঙ্করৎ জেতুমীশ্বরঃ ॥১০৬
-ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডঃ ৩৬/১০৩-১০৬
অনুবাদঃ শ্রীরাধিকাকে শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন,তাঁহার(শিব) মন দিব্যশয্যায়, দিব্যলোকে ও জনতাপূর্ণ স্থানে আসক্ত হয় না। কেবল অতি নির্জন শশ্মানে দিবানিশি আমাকেই ধ্যান করিয়া থাকেন।১০৩।
শিব, ব্রহ্মা অবধি তৃণ পর্যন্ত সমস্তই স্বপ্নের ন্যায় জ্ঞান করেন। কেবল অনির্বচনীয় আমার রূপে তাঁহার মন নিয়ত মগ্ন। ১০৪।
ব্রহ্মার পতন হইলেও শিবের বিনাশ হয় না; তাঁহার আয়ু সংখ্যা আমি জানি না, শ্রুতি কি জানিবে?১০৫।
শঙ্কর (শিব)মৃত্যুঞ্জয়-জ্ঞান ও আমার তুল্য, তেজঃশালী শূল ধারণ করেন।অতএব আমি ব্যতীত তাঁহাকে অন্য কেহই পরাজয় করিতে সক্ষম নহে।১০৬।
শ্রোতাগণ, দেখুন ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডঃ ৩৬/১০৫ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন,”ব্রহ্মণঃ পতনে নাপি শূলপাণেঃ ক্ষয়ো ভবেৎ” ব্রহ্মার পতন বা মৃত্যু হইলেও শিবের বিনাশ হয় না।সুতারাং শ্রীকৃষ্ণ এখানে শ্রীমতি রাধারাণীকে উপলক্ষ করে আমাদের বুঝাতে চাচ্ছেন, এ জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবতত্ত্ব রুপে ব্রহ্মার আয়ু সমাপ্তি হলে ব্রহ্মা মৃত্যুবরণ করেন।কিন্তু শিব অবিনাশী অথাৎ জগৎ বিনাশের পরও তাঁর বিনাশ বা মৃত্যু নেই।
শিবের যেহেতু মৃত্যু নাই তাই শ্রীকৃষ্ণ একই শ্লোকের পরের লাইনে বলছেন,”তস্মায়ুষঃ প্রমাণঞ্চ নাহং” তাঁহার(শিবের) আয়ু কত অথবা তিনি কতদিন এ জগতে জীবিত থাকবেন আমি তা জানি না।
এ বিষয়টি আরো পরিষ্কার করা হয়েছে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ,শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ডঃ ৩৬/১০৬ শ্লোকের প্রথম লাইনে ব্যবহৃত মৃত্যুঞ্জয় শব্দ দ্বারা( “জ্ঞানং মৃত্যুঞ্জয়ং শূলমদধাৎ তেজসা সমম।” শঙ্কর বা শিব মৃত্যুঞ্জয়,তাই তিনি জ্ঞান ও আমার তুল্য তেজঃশালী শূল ধারণ করেন)।মৃত্যুঞ্জয় শব্দের অর্থ হল শিব মৃত্যুকে জয় করেছেন।অথাৎ শিবের কখনো মৃত্যু হবে না।
সুতরাং, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ,শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডঃ ৩৬/১০৫ নং শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্টই আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন শিবের যেহেতু বিনাশ বা মৃত্যু নেই (“ব্রহ্মণঃ পতনে নাপি শূলপাণেঃ ক্ষয়ো ভবেৎ”), সুতরাং এ জগতে শিব কতদিন বেঁচে থাকবেন বা তাঁর আয়ু কত তা কখনো প্রশ্ন হতে পারে না।তাই শ্রীকৃষ্ণ বললেন, তাঁহার(শিবের) আয়ু কত অথাৎ তিনি কতদিন এ জগতে জীবিত থাকবেন তা আমি জানি না।
এ কথা থেকে মূর্খদের যে অপপ্রচার শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর নন,তা কখনো প্রমানিত হয় না।বরং পরমপ্রভু বা পরমেশ্বররুপে শ্রীকৃষ্ণের মহিমা /মাহাত্ম্য প্রচারিত হয়।
পরিশেষে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ,শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডঃ ৩৬/১০৬ শ্লোকে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের মহানতাসূচক কথাটি আকর্ষনীয়, যেখানে স্বয়ং পরমপ্রভু শ্রীকৃষ্ণ বলেন,”বিনা ময়ান কশ্চিৎ তৎ শঙ্করৎ জেতুমীশ্বরঃ।” -“আমি ব্যতীত তাঁহাকে(শিবকে) অন্য কেহই পরাজয় করিতে সক্ষম নহে।”
সুতরাং শিব কখনো শ্রীকৃষ্ণের সমান বা পরমেশ্বর নন ,তিনি সর্বদা শ্রীকৃষ্ণের অধীন, শ্রীকৃষ্ণের পরমভক্ত।তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন, শিব এমনই আমার পরম ভক্ত যে দিবানিশি কেবল আমাকেই ধ্যান করেন (“ধ্যায়তে মামহর্নিশম্”-ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ,শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডঃ ৩৬/১০৩),শিব কেবল আমার কাছে পরাজিত হবে, অন্য কেউ তাঁকে পরাজিত করতে পারবে না।
হরে কৃষ্ণ। প্রনাম।
গ্রন্থ সহায়তা
১/ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ
অনুবাদকঃ শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন।
প্রকাশনীঃ নবভারত পাবলিশার্স।