মাতৃগর্ভে শিশুর ক্রমবিকাশ বর্ণনা করছে ভবিষ্যপুরাণ

image_2024-04-28_173610387

গর্ভস্থ শিশু সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রত্যেক পিতামাতারই আছে। গর্ভের শিশুটি কেমন আছে, কী করছে এখন?! এমনি হাজারো দুঃশ্চিন্তা প্রতিনিয়ত ঘিরে রাখে গর্ভস্থ শিশুর পিতামাকে। কত ডাক্তার, কত টেস্ট করানো লাগে শিশুর(গর্ভস্থ) সুরক্ষা বিধানের জন্য।
কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন যে, গর্ভের শিশুর গর্ভে প্রবেশ থেকে শুরু করে, শিশুর(গর্ভে) শারীরিক গঠন, তার চেতনত্ব প্রাপ্তি, তার পুর্বকর্ম স্মরণ, পুনরায় বিস্মরণ, গর্ভের অসহ্য যাতনার এক ধারাহিক বর্ণণা দিচ্ছে ভবিষ্যপুরাণ। এই বর্ণনা এতটাই নিখুঁত ও বিজ্ঞানসম্মত যে তা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রগতিকেও হার মানাবে।
কারণ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রায় ১৮০০ শতাব্দীর শেষ থেকে আজ পর্যন্ত যা নির্ণয় করতে পারেনি তার চেয়েও কয়েক ধাপ উন্নত বায়োলজিক্যাল ফ্যাক্ট পরিষ্কার করছে আমাদের কাছে পুরাণশাস্ত্র। তার কারণ, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নত যন্ত্র দ্বারা, পরীক্ষা নিরীক্ষা দ্বারা আজও কোন ব্যক্তির ক্ষুধা অথবা তৃষ্ণা লেগেছে কিনা তা জানা বা বুঝার উপায় নেই। কিন্তু ভবিষ্যপুরাণ হাজার হাজার বছর পূর্বেই গর্ভস্থ শিশুর কোন মাসে ক্ষুধা-তৃষ্ণা লাগবে তা, সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে ।
আধুনিক বিজ্ঞান যেখানে স্থূল জড় বস্তুর(রক্ত, মাংস, বীর্য) গঠন-পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করে কালাতিপাত করছে ভবিষ্যপুরাণ সেখানে স্থূল জড়বস্তুর উর্দ্ধে সূক্ষ্ম জড়বস্তু(মন, বুদ্ধি, অহংকার) এবং তারও ঊর্দ্ধে চেতন বস্তুর(দেহী/আত্মা) উপস্থিতি, চেতনার বিকাশ সাধন নিয়ে গর্ভে থাকা শিশুর গর্ভে প্রবেশ থেকে শুরু করে ভূমিষ্ঠ হওয়া এবং তার মৃত্যু পর্যন্ত এক ধারাবাহিক যাত্রার বিবরণ দিচ্ছে।

ভবিষ্যপুরাণ উত্তর পর্বের ৩য় অধ্যায়ের বর্ণনায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠির মহারাজের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে বললেন—

শুভ কর্মে প্রাণী দেবত্ব প্রাপ্ত হন এবং যে কর্ম শুভ তথা অশুভ মিশ্রিত তার দ্বারা সে মানুষবতা প্রাপ্ত হয় এবং পুরোপুরি অশুভ কর্মের দ্বারা তির্যক যোনি প্রাপ্ত হয়।।৬।।

ঋতুকালে যিনি মুক্ত তিনি নির্দোষ যারা দ্বারা সংস্থিত তার বায়ুতে পৃষ্ঠ হয়ে স্ত্রী রক্তে একতা প্রাপ্ত হয়। শুক্র বিসর্গের সময় করণের দ্বারা যুক্ত জীব ভৃত্য নিজ কর্ম দ্বারা নিয়োজিত হয়ে যোনিতে প্রবেশ করে। সেই শুক্র এবং রক্ত একস্থ হয়ে একদিনে সে কলল হয়ে যায়। সে কলল ৫ (পাঁচ) রাত্রিতে বুদবুদাকার প্রাপ্ত হয়। সেই বুদবুদ সাত রাত্রে মাংস পেশী রূপে পরিণত হয়। পুনরায় দুই সপ্তাহে রক্ত মাংস দ্বারা দৃঢ়াঞ্চিত পেশী তৈরী হয়।। ৮-১১।।

পঁচিশ ২৫ (পঁচিশ) রাত্রে বীজ অংকুরের ন্যায় পেশীর মাস মাত্র সময় পাঁচ খন্ডে বিভক্ত হয়। পুনরায় দুই মাসে গ্রীবা-শির -স্কন্ধ-পৃষ্ঠাংশ এবং উদর ক্রমান্বয়ে উৎপন্ন হয়। চার মাসে যথাক্রমে অংগুলি উৎপন্ন হয়।। ১২-১৪।।

পাঁচমাসে মুখ -নাসিকা-কর্ণদ্বয় -দন্ত গুচ্ছ এবং নখ উৎপন্ন হয়। ছয়মাসে সছিদ্র কর্ণ, পায়ু, মেঢ্র, নাভি উৎপন্ন হয়।। ১৫-১৬।।

এই শরীরে সন্ধি সকল সাতমাসে তৈরী হয়। অঙ্গ তথা প্রত্যঙ্গে সম্পূর্ণ তথা বেশ সমন্বিত অবয়ব পূর্ণ পুষ্ট আটমাসে উদরস্থ শিশু গঠিত হয, এবং পুনরায় পঞ্চাত্মক সমাযুক্ত হয়ে গর্ভে স্থিত থাকে, যা পূর্ণরূপে পরিপক্ক।। ১৭-১৮।।

হে ভরতর্ষভ, মাতৃআহারের বীর্য দ্বারা ষড়বিধরস সংগ্রহ করে শিশু সংবর্ধিত হয়।। ১৯।।

হে অরিন্দম, এই সব আমি তোমাকে যথাযথ বলে দেব। নাভি সূত্র বিনন্ধের দ্বারা সে দিনদিনে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। অনন্তর সেই জীবাত্মা স্মৃতি প্রাপ্ত হয় কারণ তার শরীর সাঙ্গ সম্পূর্ণ হয়। সেই সময় সে দুঃখ এবং সুখ জানতে থাকে এবং পুরাকৃত নিদ্রা স্বপ্নেরও জ্ঞান হয়।। ২০-২১।।

সেই সময় তার জ্ঞান হয় কি যে, আমি মারা গিয়েছিলাম পুনরায় আমি জন্ম ধারণ করেছি এবং উৎপন্ন হয়েও পুনরায় আমি মৃত্যু প্রাপ্ত হব। আমি এই প্রকারে অনেক প্রকার সহস্র যোনি দেখেছি।। ২২।।

এই বার আমি উৎপন্ন হয়েই সংস্কার প্রাপ্ত হয়ে উত্তম কল্যাণ মার্গে কার্য করব যাতে করে আমাকে পুনরায় গর্ভবাসের কষ্ট পেতে না হয়। এই প্রকার জীবত্মা গর্ভ স্থিত হয়ে ভগবদ্ ভাবনায় ভাবিত হয় যে, আমি এই ঘোর গর্ভ থেকে নির্গত হয়ে সংসারে বিশেষ নিবৃত্তিকারী চারবেদ অধ্যয়ন করব।। ২৩-২৪।।

এই প্রকার মহান গর্ভ দুঃখে পরিপীড়িত জীব কর্ম বশে মোক্ষ প্রাপ্তির উপায় চিন্তা করে। যেমন কোনো গিরিবর দ্বারা আক্রান্ত প্রচন্ড দুঃখে আকুল হয় তেমন সেই দেহী জরায়ু চেষ্ঠিত দুঃখে স্থিত হয়।। ২৫- ২৬।।

সাগরে পতিত জিন যেমন দুঃখে যথাকুল হয় তেমন গর্ভোদক সিক্ত অঙ্গ রূপী পুরুষ অত্যন্ত ব্যকুল হয়।। যেমন কোনো লৌহ কুম্ভে ন্যস্ত অগ্নি দ্বারা পক্ক হয় ঠিক তেমন গর্ভস্থিত জন্তু পীড়িতোদর হয়ে পক্ক হয়।।২৭- ২৮।।

অগ্নিবর্ণের ন্যায় সূচের দ্বারা নিরন্তর বিভিন্ন হতে হতে যেরূপ দুঃখ হয় গর্ভস্থিত জীব তার থেকে ৮ গুণ দুঃখ প্রাপ্ত হয়। গর্ভাবাসের ন্যায় পরকষ্ট প্রদানকারী দ্বিতীয় কেউই নেই।। হে রাজন সেই গর্ভে নিবাস দেহধারি গণকে অত্যধিক দুঃখ প্রদান করে তা সুখের এবং সংকটময় ।। ২৯- ৩০।।

এই প্রকারে প্রাণিগণ যে ভাবে গর্ভ দুঃখ অনুভব করে তা আমি বললাম। এই অনুভূতি চর এবং স্থির সকলের আত্মগর্ভ অনুসারে হয়। গর্ভনিবাসে যে দুঃখ হয়, তার থেকে কোটিগুন দুঃখ হয় জন্মলাভের পর। সেই সময় যোনিযন্ত্র থেকে তাকে বাইরে বার করতে সে প্রপীড়িত হয়। স্বর্ণকারের তন্ত্রী আকর্ষণের ন্যায় তার শরীর অত্যন্ত পীড়া অনুভব করে এবং জায়মান দেহী মূর্ছিত হয়ে পড়ে। সেই সময় শরের ন্যায় যে পীড়িত সে নির্গত হয়। এমন পীড়া হয়, যেমন তার শিরে পাপ রূপী মুদগরের দ্বারা তাড়ণ করা হয়।। ৩১-৩৩।।

যখন সেই জীব গর্ভ থেকে নির্গত হয় সেই সময় প্রসব বায়ু থেকে তার মহাদুঃখ উৎপন্ন হয় এবং পরিত্রাণের জন্য সে বুদ্ধি প্রয়োগ করে। যন্ত্রেরদ্বারা যেমন তিল ও ইক্ষু রস নিঃসৃত হয় তেমন জীবাত্মার সেই শরীর এক প্রকার সার রহিত যোনি যন্ত্র দ্বারা প্রপীড়িত হয় ।। ৩৪-৩৫।।

অহো, মোহের কি অদ্ভুত মাহাত্ম্য যে এই সমস্ত জগৎ থেকে নিজ প্রভাবে ব্যামো হিত করে রেখেছে। নিজ দোষে যে এই শরীরের, তা বুঝে, দেখেও এর থেকে বিরক্ত হয় না।। ৩৬।।

এই প্রকারে এই শরীর স্বভাব দ্বারা নিশ্চয় অপবিত্র। এর সত্তর একমাত্র এবং কদলী সার সমান নিস্সার। গর্ভে স্থিত থাকার সময় যন্ত্রের স্মৃতি তার জন্মানো মাত্র যোনিযন্ত্রের পীড়নের দ্বারাই সে সব ভুলে যায়।। ৩৭-৩৮।।

মোহ নামক বহিবায়ুর স্পর্শে একপ্রকার জ্বর উৎপন্ন হয়। সেই মহান জ্বরের দ্বারা মহামোহ উৎপন্ন হয়। যখন মহামোহ থেকে সহমূঢ়তা প্রাপ্ত হয তখন সেই সংমূঢ় স্মৃতি শীঘ্র ভ্রংশ হয়ে যায়। স্মৃতি যা গর্ভদশাতে ছিল তা ভ্রংশ হওয়ার ফলে জীব পূর্বজন্মে কৃত কর্মে বশীভূত হয়ে পুনঃ সেই জন্মেরতি উৎপন্ন করে।। এই লোক তো রাগানুরক্ত পুনরায় এই মুঢ়কে অকার্যে প্রবৃত করে। তার ফলে সে নিজেকে চিনতে পারে না এবং পরকেউ প্রাপ্ত হয় না।। ৩৯-৪২।।

সে এমন মূঢ়, মোহান্ধ তথা বধির যে পরমশ্রের কথা শ্রবণ করেনা এবং নেত্র থেকেও কিছু দেখে না। বুদ্ধি থাকতেও বড় বড় বিদ্বান দ্বারা রুবড় বোধ্যমান হয়েও কিছু বোঝেনা। এই কারণে সে এই সংসারে রাগ এবং লোভের বশীভূত হয়ে ক্লেশ প্রাপ্ত হয়।। ৪৩-৪৫।।.

গর্ভে যে স্মৃতি ছিল তার অভাব হলে মহর্ষি মহানুভব শাস্ত্র কথন করেছেন যা, সেই দুঃখ মথন করার জন্য এবং স্বর্গ প্রদানের জন্য ।। ৪৬।।

 

পোস্টটি নাতিদীর্ঘ করার লক্ষ্যে গর্ভের শিশুর মৃত্যু অবদি বর্ণনাটি এখানে দেওয়া হয়নি। পরিশেষে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, যাহারা পুরাণের অবৈজ্ঞানিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে পঞ্চম বেদ পুরাণশাস্ত্রকে অস্বীকার করেন তাদের এই পুরাণবিমুখ প্রপাগাণ্ডা ধূলিসাৎ হয়ে যায় ভবিষ্যপুরাণোক্ত মাতৃগর্ভে শিশুর ক্রমবিকাশ এর এমন অত্যাধুনিক সবিস্তার বর্ণনায়।

অতএব, বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের উচিৎ এসব প্রপাগাণ্ডায় বিভ্রান্ত না হয়ে আচার্যদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পুরাণ শাস্ত্রকে হৃদয়ঙ্গম করা।

 

।। হরেকৃষ্ণ।।

Avatar of Ananta Shayi Das

Ananta Shayi Das

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments