ভগবান শিবের প্রসাদ কিভাবে গ্রহণ করতে হয়?! (শৈব শাস্ত্র ও সনাতনী শাস্ত্র সিদ্ধান্ত)
ভগবান শিবের প্রসাদ ভোজনের একটা বিশেষ নিয়ম আছে। সরাসরি শিবের প্রসাদ খাওয়া যায় না। ভগবান শিবই শিবপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, পদ্মপুরাণাদি শাস্ত্র এর কারণ ব্যাখা করেছেন এবং শিবের প্রসাদ পাওয়ার বিশেষ নিয়মও বর্ণনা করেছেন।
মদ্যস্য মদ্যগন্ধস্য নৈবেদ্যস্য চ বর্জ্জনম।
সামানং সর্ব্ববর্ণানাং ব্রাহ্মণানাং বিশেষতঃ।।
[শিবপুরাণম, বায়বীয়সংহিতা, অধ্যায় ১১, শ্লোক ৮০]
অনুবাদ: শিব পার্বতীকে বললেন, “মদ্যসেবন, মদ্য আঘ্রান এবং আমার উদ্দেশ্যে নিবেদিত নৈবেদ্য পরিত্যাগ সমস্ত বর্ণের লোকেরই কর্তব্য, বিশেষভাবে ব্রাহ্মণের জন্য তা অবশ্য কর্তব্য।”
কেন এরূপ নিষেধাজ্ঞা?
উত্তরে শিব বলছেন-
“যেহেতু শিবলিঙ্গের নির্মাল্যে চণ্ডের অধিকার থাকে, তাই শিবের নৈবেদ্য সাধারণ ব্যক্তির খাওয়া উচিত নয়। কিন্তু শিবদীক্ষাযুক্ত শিবভক্ত ব্যক্তির জন্য সকল শিবলিঙ্গের নৈবেদ্য শুভ এবং ‘মহাপ্রসাদ’।”
[শিবপুরাণ, বিদ্যেশ্বর সংহিতা, অধ্যায় ২২]
অগ্রাহ্যং শিব নিৰ্ম্মাল্যং পত্রঃ পুষ্পং ফলং জলং।
দ্রব্যমন্নং ফলং তোয়ং শিবস্য ন স্পৃশেৎ কচিৎ।
ন নয়েচ্ছিব নিৰ্ম্মালাং কূপে সর্বং বিনিঃক্ষিপেৎ।।
– (কালিকাপুরাণ)
অনুবাদ: শিবের নির্মাল্য, পত্র,পুষ্প,ফল,জল সর্বদা অগ্রাহ্য করবে, কদাচিৎ গ্রহণ করবে না। শিবের সমস্ত নির্মাল্য কূপের জলে বিশেষভাবে নিক্ষেপ করবে।
লিঙ্গার্চন তন্ত্রে মহাদেবকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে-
দুর্ল্লভং তব নিৰ্ম্মাল্যং ব্রহ্মাদীনাং রুপা- নিধে।
তৎ কথং পরমেশান নিৰ্ম্মাল্যং তব দুষিতং ॥ “
অর্থাৎ, হে কৃপানিধে, তোমার নির্মাল্য ব্রহ্মাদির দুর্লভ। তবে, হে পরমেশ, তব নির্মাল্য দূষিত কেন?”
মহাদেব উত্তর করিলেন যে তাঁহার কণ্ঠে বিষ আছে বলিয়া লোকে তাঁহার নির্মাল্য ভক্ষণ করে না।
সাধারণ মানুষ শিবের প্রসাদ খেলে কি হবে?!
১) ভৃগুমুনির শিবকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, কেউ শিবের প্রসাদ গ্রহণ করলে চন্ডাল হয়ে জন্মাতে হবে।
(পদ্মপুরাণ, উত্তরখন্ড, অধ্যায় ২৫৫)
এ উপাখ্যানিটি শিব স্বয়ং মাতা পার্বতীকে বলেছেন পদ্মপুরাণে।
২) পার্বতীকে কৃষ্ণপ্রসাদ না দিয়ে শিব একাই কৃ্ষ্ণপ্রসাদ গ্রহণ করেছিলেন। তাই পার্বতী মনঃকষ্টে শিবকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, কেউ যদি শিবলিঙ্গের প্রসাদ গ্রহণ করে তবে সে ভারতভূমিতে সারমেয় (কুকুর) হয়ে জন্মাবে।
(ব্রহ্মবৈবর্ত মহাপুরাণ, কৃষ্ণজন্মখন্ড, অধ্যায় ৩৭)
৩) যম বলেছেন, শিবের নির্মাল্য গ্রহণে ১০০ বছর নরকবাস, এরপর ক্রমান্বয়ে গাছ, কৃমি, মলমূত্রের পোকা হয়ে অবশেষে ১০০ বার কুকুরযোনীতে জন্মাতে হবে।
(পদ্ম মহাপুরাণ, পাতালখন্ড, ৬৫।৫৩-৫৭)
এ উপাখ্যানিটি শিব স্বয়ং মাতা পার্বতীকে বলেছেন পদ্মপুরাণে।
৪) চন্দ্রশর্মা নামক এক কট্টর শৈব কৃষ্ণপূজা না করে শিবের পূজা করায় তার পিতৃপুরুষগণ প্রেতযোনী প্রাপ্ত হয়েছিলো। তাই পিতৃপুরুষগণ উপস্থিত হয়ে চন্দ্রশর্মাকে বললেন, “কেউ অগ্রে শ্রীকৃষ্ণের পূজা না করে শিবকে পূজা করলে তবে সে পূজা বিফল হয় এবং পূজারী প্রেতযোনী প্রাপ্ত হন।”
(স্কন্দপুরাণের প্রভাসখন্ডে-দ্বারকামাহাত্ম্যমের ২৩।১৫২)
মূল কথা, শিব পরমবৈষ্ণব হওয়ায় তিনি কৃষ্ণপ্রসাদ ব্যতীত কিছুই গ্রহণ করেন না। কেউ যদি শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন না করে শিবকে কিছু ভোগ লাগায় তবে শিবজী তা স্বীকার করেন বটে কিন্তু তা ভক্ষণ করেন না। তিনি সেগুলো তার সেবক ভূত,পিশাচ, কাপালিদের দিয়ে দেন। তাই সে প্রসাদে চণ্ডদের অধিকার থাকে, কোন সাধারণ মনুষ্য তা খেলে চন্ডাল, কুকুর কিংবা প্রেতযোনী প্রাপ্ত হন। এরকম গতি সাধারণ মানুষ চান না। সাধারণ সনাতনীরা স্বর্গ কিংবা বৈকুন্ঠমুক্তির বাসনা করেন। যারা শিবমন্ত্রে দীক্ষিত তারা শিবের নৈবেদ্য ভক্ষণ করে শিবধামে চন্ডালরূপে শিবের পার্ষদ ও সেবক হয়ে থাকার সুযোগ পাবেন।
তাহলে যারা শিবমন্ত্রে দীক্ষিত নন, তারা কিভাবে শিবলিঙ্গে নিবেদিত প্রসাদ পেতে পারেন?!
শিবের প্রসাদ খাওয়া বিধান হলো- প্রথমে শ্রীকৃষ্ণ/বিষ্ণুকে পূজা করে নিবেদন করতে হবে, তখন তা হয় মহাপ্রসাদ। এরপর তা শিব ও পার্বতীকে নিবেদন করতে হয়। তখন তাকে বলে ‘মহা মহা প্রসাদ। এ নিয়ে শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে একটা উপাখ্যান স্মরণীয়-
উপাখ্যানটি হলো, একবার জগতগুরু শিব মাতা পার্বতীকে না দিয়েই হরিপ্রসাদ গ্রহণ করেছিলেন। ফলে মাতা পার্বতী ক্রোধান্বিত হয়ে নিজের পতিকেই অভিশাপ দেন, যিনি শিবকে নিবেদিত কোন বস্তু আহার করবেন, তিনি ভারতে সারমেয় (কুকুর) হয়ে জন্মলাভ করবে। পরে ক্রোধ সংবরণ করে মাতা পার্বতী এ অভিশাপকে প্রশমিত করার জন্য বিধান দেন, ‘যদি সরাসরি শিবকে নিবেদন করে সে প্রসাদ গ্রহণ করবে সে ঠিকই ভারতে সারমেয় হয়ে জন্ম নিবে। কিন্তু যে প্রথমে শ্রীহরিকে নিবেদন করে সে কৃষ্ণপ্রসাদ শিবকে নিবেদন করে তা গ্রহণ করবে, সে আর পূর্বোক্ত অভিশাপের ভাগী হবেন না, বরং সে হরি ও হরের আশীর্বাদ প্রাপ্ত হবে।’
[শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, কৃষ্ণজন্মখন্ড, অধ্যায় ৩৭]
শিবপুরাণেও শিবজী বলেছেন-
“মুনীশ্বরগণ! শিবলিঙ্গের ওপর রাখা যে দ্রব্য সেগুলি অগ্রহণীয়। যে শিব-নৈবেদ্য, পত্র, পুষ্প, ফল, জল অগ্রহণীয়, সে সব দ্রব্য বিষ্ণুশালগ্রাম শিলার স্পর্শে এসে পবিত্র এবং গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়।”
[শিবপুরাণম, বিদ্যেশ্বর সংহিতা, অধ্যায় ২২, শ্লোক ২০]
বরাহপুরাণে উক্ত হইয়াছে,
অভক্ষ্যং শিবনির্মাল্যং পত্রং পুষ্পং ফলং জলং।
শালগ্রাম শিলাযোগাৎ পাবনং তদ্ভবেৎ সদা ।।
অর্থাৎ, “পত্র পুষ্প ফল জল প্রভৃতি শিব নিৰ্ম্মাল্য অভক্ষ্য। ভগবান বিষ্ণুর শালগ্রামশিলা- যোগে তাহা সদা পবিত্র হয়।”
অর্থাৎ, ভগবান শিবকে ভোগ নিবেদনের নিয়ম হলো- প্রথমে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন করতে হবে, এরপর সে কৃষ্ণপ্রসাদ ভগবান শ্রীশিবকে নিবেদন করতে হবে। অতঃপর সে প্রসাদ গ্রহণ করতে পারবেন।
শ্রীজগন্নাথপুরী ধামেও এভাবে অগ্রে জগন্নাথদেবকে ভোগ নিবেদন করে সে কৃষ্ণপ্রসাদ শিব ও বিমলাদেবীকে নিবেদন করা হয়।
“হরিপ্রসাদ আস্বাদন করে ‘পঞ্চমুখে রাম নাম গান ত্রিপুরারী”
।।হরে কৃষ্ণ।।
।।হর হর মহাদেব।।