শ্রীমদ্ভগবদগীতা যথাযথ

ষষ্ট অধ্যায় - ধ্যানযোগ

শ্লোক ৬.১

শ্রীভগবানুবাচ

অনাশ্রিতঃ কর্মফলং কার্যং কর্ম করোতি যঃ। 

স সন্ন্যাসী চ যোগী চ ন নিরগ্নির্ন চাক্রিয়ঃ।।১।।

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- যিনি অগ্নিহোত্রাদি কর্ম ত্যাগ করেছেন এবং দৈহিক চেষ্টাশূন্য তিনি সন্যাসী বা যোগী নন। যিনি কর্মফলের প্রতি আসক্ত না হয়ে তাঁর কর্তব্য কর্ম করেন, তিনিই যথার্থ সন্ন্যাসী বা যোগী।

তাৎপর্য : এই অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্ণনা করেছেন যে, অষ্টাঙ্গযোগ হচ্ছে মন ও ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করার একটি পন্থাবিশেষ। তবে এই যোগ সকলের পক্ষে অনুশীলন করা কষ্টকর, বিশেষ করে এই কলিযুগে তা অনুশীলন করা এক রকম অসম্ভব। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই অধ্যায়ে অষ্টাঙ্গ যোগের পদ্ধতি বর্ণনা করে অবশেষে দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করেছেন যে, কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম বা কর্মযোগ অষ্টাঙ্গযোগ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এই জগতের সকলেই তার স্ত্রী, পুত্র, পরিজনের ভরণ-পোষণের জন্য কর্ম করে। ব্যক্তিগত স্বার্থ অথবা ভোগবাঞ্ছা ব্যতীত কেউই কোন কর্ম করে না। কিন্তু সাফল্যের মানদণ্ড হচ্ছে কর্মফলের প্রত্যাশা না করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার জন্য কর্ম করা। প্রতিটি জীবই ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই ভগবানের সেবা করাই হচ্ছে তাদের একমাত্র কর্তব্য। শরীরের বিবিধ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সম্পূর্ণ শরীরের পালন-পোষণের জন্য কর্ম করে, তাদের আংশিক স্বার্থের জন্য নয়। তেমনই, যে মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থের পরিবর্তে পরব্রহ্মের তৃপ্তির জন্য কর্ম করেন, তিনি হচ্ছেন প্রকৃত সন্ন্যাসী এবং প্রকৃত যোগী।

ভ্রান্তিবশত, কিছু সন্ন্যাসী মনে করে যে, তারা সব রকম জাগতিক কর্তব্য থেকে মুক্ত হয়েছে এবং তাই তারা অগ্নিহোত্র যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করা ত্যাগ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা স্বার্থপরায়ণ, কারণ তাদের লক্ষ্য হচ্ছে নির্বিশেষ ব্রহ্মসাযুজ্য লাভ করা। এই সমস্ত বাসনা জাগতিক কামনা থেকে মহত্তর হলেও তা স্বার্থশূন্য নয়। ঠিক তেমনই, সব রকমের জাগতিক ক্রিয়াকলাপ পরিত্যাগ করে, অর্ধনিমীলিত নেত্রে যোগী যে তপস্যা করে চলেছেন, তাও ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত। তিনিও তাঁর আত্মতৃপ্তির আকাঙ্ক্ষার দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত ভক্তই হচ্ছেন একমাত্র যোগী, যিনি পরমেশ্বরের তৃপ্তিসাধন করার জন্য নিঃস্বার্থভাবে কর্ম করেন। তাই, তাতে একটুও স্বার্থসিদ্ধির বাসনা থাকে না। শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধান করাটাই তাঁর সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি, তাই, তিনিই হচ্ছেন যথার্থ যোগী, যথার্থ সন্ন্যাসী। বৈরাগ্যের মূর্তবিগ্রহ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রার্থনা করেছেন—

ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং কবিতাং বা জগদীশ কাময়ে ।

মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে ভবতাদ্ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ি॥

“হে জগদীশ্বর! আমি ধন কামনা করি না, আমি অনুগামী কামনা করি না এবং আমি সুন্দরী স্ত্রী কামনা করি না। আমার একমাত্র কামনা হচ্ছে, আমি যেন জন্ম-জন্মান্তরে তোমার প্ৰতি অহৈতুকী ভক্তি লাভ করতে পারি।”

শ্লোক ৬.২

যং সন্ন্যাসমিতি প্রাহুর্যোগং তং বিদ্ধি পান্ডব। 

ন হ্যসংন্যস্তসংকল্পো যোগী ভবতি কশ্চন।।২।।

অনুবাদঃ হে পান্ডব! যাকে সন্ন্যাস বলা যায়, তাকেই যোগ বলা যায়, কারণ ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বাসনা ত্যাগ না করলে কখনই যোগী হওয়া যায় না।

তাৎপর্যঃ যথার্থ ‘সন্ন্যাস-যোগ’ অথবা ‘ভক্তিযোগের’ তাৎপর্য হচ্ছে জীবাত্মারূপে স্বীয় স্বরূপ সম্বন্ধে অবগত হয়ে সেই অনুসারে কর্ম করা। জীবাত্মার কোন পৃথক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। জীব হচ্ছে ভগবানের তটস্থা শক্তি। যখন সে জড়া শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে, তখন সে বদ্ধ অবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং যখন সে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করে, অর্থাৎ ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তি সম্বন্ধে সচেতন হয়, তখন সে তার স্বরূপে অধিষ্ঠিত হয়। তাই, জীব যখন ভগবৎ-তত্ত্ব সম্বন্ধে অবগত হয়, তখন সে জড় ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তি থেকে বিরত হয়, অথবা সব রকম ইন্দ্রিয় উপভোগের কার্যকলাপ পরিত্যাগ করে। ইন্দ্রিয় দমন করে যোগীরা জড় আসক্তি থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা করে। কিন্তু কৃষ্ণভক্ত তাঁর সব কয়টি ইন্দ্রিয়ই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত করেন, তাই তাঁর অন্য কোন বিষয়ের প্রতি আর আসক্তি থাকে না। সুতরাং, কৃষ্ণভক্ত একাধারে যোগী ও সন্ন্যাসী। জ্ঞান ও ইন্দ্রিয়-নিগ্রহ বিষয়ক যোগের প্রয়োজন কৃষ্ণভাবনায় আপনা থেকেই পূর্ণ হয়ে যায়। স্বার্থসিদ্ধির প্রবৃত্তি পরিত্যাগ করতে না পারলে জ্ঞান অথবা যোগ সাধন করার কোন অর্থ হয় না। জীবনের চরম উদ্দেশ্য হচ্ছে, সব রকম ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করে ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানে ব্রতী হওয়া। যিনি পরমতত্ত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছেন, অর্থাৎ যিনি কৃষ্ণভাবনার অমৃত লাভ করেছেন, ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের প্রতি তাঁর আর কোন স্পৃহা থাকে না। তিনি সব সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করবার চেষ্টায় মগ্ন। যারা ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে পারেনি, তাদের পক্ষে জড় ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তি সাধন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই, কারণ নিষ্ক্রিয় স্তরে কেউ এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। কৃষ্ণভাবনামৃত অনুশীলন করার ফলে সব কয়টি প্রয়োজনই যথার্থভাবে সাধিত হয়।

শ্লোক ৬.৩

আরুরুক্ষোর্মুনের্যোগং কর্ম কারণমুচ্যতে। 

যোগারূঢ়স্য তস্যৈব শমঃ কারণমুচ্যতে।।৩।।

অনুবাদঃ অষ্টাঙ্গযোগ অনুষ্ঠানে যারা নবীন, তাদের পক্ষে কর্ম অনুষ্ঠান করাই উৎকৃষ্ট সাধন, আর যাঁরা ইতিমধ্যেই  যোগারূঢ় হয়েছেন, তাঁদের পক্ষে সমস্ত কর্ম থেকে নিবৃত্তিই উৎকৃষ্ট সাধন।

তাৎপর্য : ভগবানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পন্থাকে বলা হয় যোগ। এই যোগকে একটি সিঁড়ির সঙ্গে তুলনা করা হয়, যার দ্বারা পারমার্থিক তত্ত্বজ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তরে আরোহণ করা যায়। জীবনের সর্বনিম্ন স্তর থেকে এই সিঁড়ির শুরু এবং ক্রমান্বয়ে তা অধ্যাত্মমার্গের চরম স্তরে উপনীত হয়েছে। উচ্চতার ক্রম অনুসারে এই সিঁড়ির বিভিন্ন অংশের ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে। কিন্তু সম্পূর্ণ সিঁড়িটিকে বলা হয় যোগ এবং সেটি তিন ভাগে বিভক্ত জ্ঞানযোগ, ধ্যানযোগ ও ভক্তিযোগ। এই সিঁড়ির প্রথম ও সর্বোচ্চ সোপানকে যথাক্রমে যোগারুরুক্ষু ও যোগারূঢ় স্তর বলা হয়।

অষ্টাঙ্গ যোগের প্রাথমিক স্তরে নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের মাধ্যমে আসন অভ্যাস করে ধ্যান করার প্রচেষ্টাকে সকাম কর্ম বলে গণ্য করা হয়। এই সমস্ত ক্রিয়ার প্রভাবে ক্রমশ ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পূর্ণ মানসিক সমতা লাভ হয়। ধ্যানাভ্যাসে সিদ্ধি লাভ হলে উদ্বেগ সৃষ্টিকারী সব রকম মানসিক ক্রিয়াগুলি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করা যায়। কৃষ্ণভাবনাময় কৃষ্ণভক্ত শুরু থেকেই ধ্যানের স্তরে অবস্থিত, কারণ তিনি সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করেন। তিনি সর্বদাই ভগবানের সেবায় রত, তাই তিনি সব রকম জাগতিক কর্মগুলি সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করেছেন বলে গণ্য করা হয়।

শ্লোক ৬.৪

যদা হি নেন্দ্রিয়ার্থেষু ন কর্মস্বনুষজ্জতে। 

সর্বসংকল্পসন্ন্যাসী যোগারূঢ়স্তদোচ্যতে।।৪।।

অনুবাদঃ যখন যোগী জড় সুখভোগের সমস্ত সংকল্প ত্যাগ করে ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ে এবং সকাম কর্মের প্রতি আসক্তি রহিত হন, তখন তাঁকেই যোগারূঢ় বলা হয়।

তাৎপর্য : মানুষ যখন ভক্তিযোগে সর্বতোভাবে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত হয়, তখন সে সর্বতোভাবে আত্মতৃপ্ত হয়, তখন ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তি অথবা সকাম কর্ম করার কোন প্রবৃত্তি তার থাকে না। আর তা না হলে, সে অবশ্যই ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তি সাধনে প্রবৃত্ত হবে, কারণ কর্মরহিত হয়ে মানুষ কখনও থাকতে পারে না। তাই, কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম না করা হলে, আত্মকেন্দ্রিক অথবা সমষ্টির স্বার্থে কর্ম করার বাসনা দেখা দেবে। কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের সন্তোষ বিধানের জন্য সব কিছুই করেন, তাই তিনি ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত। পক্ষান্তরে বলা যায়, যার এই উপলব্ধি হয়নি, তাকে যোগমার্গরূপ সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত বিষয় বাসনা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যন্ত্রবৎ প্রযত্ন করতে হবে।

শ্লোক ৬.৫

বন্ধুরাত্মাত্মনস্তস্য যেনাত্মৈবাত্মনা জিতঃ। 

অনাত্মনস্তু শত্রুত্বে বর্তেতাত্মৈব শত্রুবৎ।।৬।।

অনুবাদঃ যিনি তাঁর মনকে জয় করেছেন, তাঁর মন তাঁর পরম বন্ধু কিন্তু ‍যিনি তা করতে অক্ষম, তাঁর মনই তাঁর পরম শত্রু।

তাৎপর্য : অষ্টাঙ্গ-যোগের অনুশীলন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে মনকে সংযত করা, যার ফলে পরমার্থ সাধনের পথে সে বন্ধুর মতো সাহায্য করতে পারে। মনঃসংযম না করে লোকদেখানো যোগাভ্যাস করলে কেবল সময়ের অপচয় হয়। যে মানুষ মনকে বশ করতে অক্ষম, সে সর্বক্ষণ তার পরম শত্রুর সঙ্গে বাস করছে। তার ফলে, তার জীবন ও তার উদ্দেশ্য, দু-ই নষ্ট হয়ে যায়। জীবের স্বরূপ হচ্ছে তার প্রভুর আজ্ঞা পালন করা। মন যতক্ষণ অজিত শত্রু হয়ে থাকে, ততক্ষণ তাকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ আদির আজ্ঞা পালন করতে হয়। কিন্তু মন যখন বশীভূত হয়, তখন পরমাত্মারূপে প্রত্যেকের হৃদয়ে অবস্থিত যে ভগবান তাঁর আদেশ পালনে জীব স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়। যোগাভ্যাসের যথার্থ তাৎপর্য হচ্ছে, হৃদয়ে পরমাত্মার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তাঁর আজ্ঞা পালন করা। কেউ যখন সরাসরিভাবে কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করে, তখন সে আপনা থেকেই ভগবানের আজ্ঞার প্রতি সম্পূর্ণভাবে শরণাগত হয়।

শ্লোক ৬.৭

জিতাত্মনঃ প্রশান্তস্য পরমাত্মা সমাহিতঃ।

শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু তথা মানাপমানয়োঃ।।৭।।

অনুবাদঃ জিতেন্দ্রিয় ও প্রশান্তচিত্ত ব্যক্তি পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তাঁর কাছে শীত ও উষ্ণ, সুখ ও দুঃখ এবং সম্মান ও অপমান সবই সমান।

তাৎপর্য : পরমাত্মারূপে প্রত্যেক জীবের অন্তরে বিরাজ করেন যে ভগবান, তাঁর আদেশ পালন করাই হচ্ছে জীবের যথার্থ কর্তব্য। বহিরঙ্গা মায়াশক্তির প্রভাবে মন যখন বিপথে চালিত হয়, তখন জীব জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই, কোন একটি যোগ অভ্যাস করার মাধ্যমে মন যখন সংযত হয়, তখন বুঝতে হবে যে, তিনি তাঁর গন্তব্যস্থলে উপনীত হয়েছেন। ভগবানের আদেশ সকলকেই পালন করতে হয়। মন যখন পরা প্রকৃতিতে নিবিষ্ট হয়, তখন ভগবানের আদেশ শিরোধার্য করা ছাড়া আর কোন বিকল্প পন্থা থাকে না। মনকে অবশ্যই ঊর্ধ্বতন কারও বশ্যতা স্বীকার করে তাঁর নির্দেশ অনুসারে পরিচালিত হতে হয়। মনকে সংযত করার ফলে মন আপনা থেকেই পরমাত্মার নির্দেশ অনুসারে পরিচালিত হতে থাকে। কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত যেহেতু অবিলম্বে এই অপ্রাকৃত স্তরে উন্নীত হন, তাই তিনি সুখ-দুঃখ, শীত-উষ্ণ আদি জড় অস্তিত্বের দ্বৈত ভাবের দ্বারা প্রভাবিত হন না। এই অবস্থাকে বলা হয় ব্যবহারিক সমাধি অথবা ভগবৎ-তন্ময়তা।

শ্লোক ৬.৮

জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা কূটস্থো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ। 

যুক্ত ইত্যুচ্যতে যোগী সমলোষ্ট্রাশ্মকাঞ্চনঃ।।৮।।

অনুবাদঃ যে যোগী শাস্ত্রজ্ঞান ও তত্ত্ব অনুভূতিতে পরিতৃপ্ত, ‍যিনি চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত ও জিতেন্দ্রিয় এবং যিনি মৃৎখন্ড, প্রস্তর ও সুবর্ণে সমদর্শী, তিনি যোগারূঢ় বলে কথিত হন।

তাৎপর্য : পরম-তত্ত্বের অনুভূতি না হলে পুঁথিগত বিদ্যার কোন সার্থকতা নেই। শাস্ত্রে বলা হয়েছে

অতঃ শ্রীকৃষ্ণনামাদি ন ভবেদ্‌গ্রাহ্যমিন্দ্রিয়ৈঃ ।

সেবোন্মুখে হি জিহ্বাদৌ স্বয়মেব স্ফুরত্যদঃ ॥

“জড় কলুষিত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা কেউ শ্রীকৃষ্ণের নাম, রূপ, গুণ, লীলার দিব্য প্রকৃতি উপলব্ধি করতে পারে না। ভগবানের সেবা করার মাধ্যমে যখন দিব্য চেতনার উন্মেষ হয়, তখন ভগবানের অপ্রাকৃত নাম, রূপ ও লীলার চিন্ময় স্বরূপ তাঁর কাছে অনুভূত হয়।” (ভক্তিরসামৃতসিন্ধু পূর্ব ২/২৩৪)

এই ভগবদ্‌গীতা হচ্ছে কৃষ্ণভাবনার বিজ্ঞান। কেবল লৌকিক পাণ্ডিত্যের দ্বারা কৃষ্ণভাবনা লাভ করা যায় না। এই জ্ঞান লাভ করতে হলে ভগবৎ-তত্ত্ববেত্তা শুদ্ধ ভক্তের সঙ্গ লাভের সৌভাগ্যবান হতে হবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপার ফলে কৃষ্ণভাবনাময় মহাত্মা ভগবৎ তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারেন, কারণ তিনি শুদ্ধ ভক্তির দ্বারা পরিতৃপ্ত হয়ে থাকেন। ভগবৎ তত্ত্বজ্ঞান উপলব্ধির ফলে মানুষ তাঁর জীবনের যথার্থ সার্থকতা লাভ করেন। অপ্রাকৃত জ্ঞানের প্রভাবে ভগবানের প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় হয়, কিন্তু পুঁথিগত বিদ্যার ফলে আপাত পরস্পর বিরোধী উক্তির দ্বারা সহজেই মোহাচ্ছন্ন ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। ভগবৎ তত্ত্ববেত্তা কৃষ্ণভক্তই হচ্ছেন যথার্থ আত্ম-সংযমী, কারণ তিনি সর্বতোভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত। তিনি সর্বদাই অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত, কারণ লৌকিক জ্ঞানের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই। অন্যদের কাছে লৌকিক বিদ্যা ও মনোধর্মপ্রসূত জ্ঞান স্বর্ণবৎ উত্তম বলে প্রতিভাত হতে পারে, কিন্তু কৃষ্ণভক্তের কাছে তার মূল্য এক টুকরো মৃতখণ্ড বা পাথরের থেকে বেশি নয়।

শ্লোক ৬.৯

সুহৃন্মিত্রার্যুদাসীনমধ্যস্থদ্বেষ্যবন্ধুষু। 

সাধুষ্বপি চ পাপেষু সমবুদ্ধির্বিশিষ্যতে।।৯।।

অনুবাদঃ যিনি সুহৃদ, মিত্র, শত্রু, উদাসীন, মধ্যস্থ, মৎসর, বন্ধু, ধার্মিক ও পাপাচারী-সকলের প্রতি সমবুদ্ধি, তিনিই শ্রেষ্ঠতা লাভ করেন।

শ্লোক ৬.১০

যোগী যুঞ্জীত সততমাত্মনং রহসি স্থিতঃ। 

একাকাী যতচিত্তাত্মা নিরাশীরপরিগ্রহঃ।।১০।।

অনুবাদঃ যোগারূঢ় ব্যক্তি সর্বদা পরব্রহ্মে সম্পর্কযুক্ত হয়ে তাঁর দেহ, মন ও নিজেকে নিয়োজিত করবেন, তিনি একাকী নির্জন স্থানে বসবাস করবেন এবং সর্বদা সতর্কভাবে তাঁর মনকে বশীভূত করবেন। তিনি বাসনামুক্ত ও পরিগ্রহ রহিত হবেন।

তাৎপয: স্তরবিশেষে শ্রীকৃষ্ণকে ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও পরম পুরুষোত্তম ভগবানরূপে উপলব্ধি করা যায়। ভক্তি সহকারে সর্বক্ষণ ভগবানের সেবা করাই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনা। কিন্তু নির্বিশেষ ব্রহ্মবাদী জ্ঞানী এবং পরমাত্মার অন্বেষণকারী যোগীরাও আংশিকভাবে কৃষ্ণভাবনাময়, কারণ নির্বিশেষ ব্রহ্ম হচ্ছেন ভগবানের দেহনির্গত রশ্মিচ্ছটা এবং সর্বব্যাপ্ত পরমাত্মা হচ্ছেন ভগবানের আংশিক প্রকাশ। তাই, ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা না করলেও যোগী এবং জ্ঞানীরাও পরোক্ষভাবে কৃষ্ণভাবনাময়। তবে, সরাসরিভাবে কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী, কারণ তিনি পূর্ণরূপে ব্রহ্ম ও পরমাত্মাতত্ত্ব সম্বন্ধে অবগত। তিনিই পরমতত্ত্বকে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। কিন্তু নির্বিশেষবাদী জ্ঞানী ও ধ্যানমগ্ন যোগী পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করতে পারেননি।

তা সত্ত্বেও, এই সমস্ত নির্দেশ এখানে দেওয়া হয়েছে তাঁদের নির্দিষ্ট কার্যকলাপে সর্বদাই নিয়োজিত হবার জন্যে যাতে তাঁরা আগে-পরে সর্বোত্তম সিদ্ধিতে পৌঁছতে পারে। যোগীর প্রথম কর্তব্য হচ্ছে মনকে সর্বদা ভগবান শ্রীকৃষ্ণে একাগ্র করা। মুহূর্তের জন্যও ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে না গিয়ে সর্বক্ষণ তাঁর কথা স্মরণ করা। এভাবেই নিরন্তর ভগবানের চিন্তায় মনকে একাগ্র করার নাম হচ্ছে সমাধি। মনের এই একাগ্রতা লাভ করার জন্য নির্জনে বসবাস করা উচিত এবং বাহ্য বিষয়রূপী উপদ্রব থেকে দূরে থাকা উচিত। সাধকের সতর্ক থাকা উচিত—ভগবৎ-প্রাপ্তির জন্য অনুকূল পরিস্থিতি গ্রহণ করা এবং প্রতিকূল পরিস্থিতি পরিত্যাগ করা। দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে তাঁর অনাবশ্যক ভোগবাসনা পরিত্যাগ করা উচিত, কারণ তা পরিগ্রহরূপে বন্ধনের সৃষ্টি করে।

এই সমস্ত সাধন ও সতর্কতার পূর্ণ পালন তিনিই করতে পারেন, যিনি সর্বতোভাবে কৃষ্ণভাবনাময়; কারণ সর্বতোভাবে কৃষ্ণভাবনাময় হওয়া মানেই সম্পূর্ণরূপে ভগবানের কাছে আত্ম-উৎসর্গ করা। এই ধরনের ত্যাগে পরিগ্রহের কোন সম্ভাবনা থাকে না। শ্রীল রূপ গোস্বামীপাদ কৃষ্ণভাবনামৃতের ব্যাখ্যা করে বলেছেন—

অনাসক্তস্য বিষয়ান্ যথার্হমুপযুঞ্জতঃ ।

নির্বন্ধঃ কৃষ্ণসম্বন্ধে যুক্তং বৈরাগ্যমুচ্যতে ॥

প্রাপঞ্চিকতয়া বুদ্ধ্যা হরিসম্বন্ধিবস্তুনঃ ।

মুমুক্ষুভিঃ পরিত্যাগো বৈরাগ্যং ফল্গু কথ্যতে।। 

“বিষয়ের প্রতি আসক্তিশূন্য হয়ে এবং শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে নিবন্ধ করে ভগবানের সেবার অনুকূল বিষয়টুকু গ্রহণ করাকেই বলা হয় যুক্তবৈরাগ্য। পক্ষান্তরে, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে জীবের সম্পর্কের কথা না জেনে যে সব কিছু পরিত্যাগ করে, তার বৈরাগ্য পূর্ণ নয়।” (ভক্তিরসামৃতসিন্ধু পূর্ব ২/২৫৫-২৫৬)

কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত যথার্থরূপে জানেন যে, সব কিছুই শ্রীকৃষ্ণের সম্পত্তি। তাই, তিনি কোন কিছুই নিজের বলে দাবি করেন না। নিজে ভোগ করার জন্য তিনি কোন কিছুর লালসা করেন না। তিনি জানেন, শ্রীকৃষ্ণের সেবার অনুকূলে কোনটি গ্রহণ করা উচিত এবং কোন্‌টি পরিত্যাগ করা উচিত। বিষয় ভোগের প্রতি তিনি সর্বদাই উদাসীন, কারণ তিনি সর্বদাই অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত। ভগবদ্ভক্ত ছাড়া আর কারও সঙ্গ করার কোন প্রয়োজন নেই বলে তিনি সর্বদাই একাকী। তাই, কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তই হচ্ছে পরম যোগী।

শ্লোক ৬.১১,৬.১২

শুচৗৈ দেশে প্রতিষ্ঠাপ্য স্থিরমাসনমাত্মনঃ। 

নাত্যুচ্ছ্রিতং নাতিনীচং চৈলাজিনকুশোত্তরম্।।১১।।

তত্রৈকাগ্রং মনঃ কৃত্বা ষতচিত্তেন্দ্রিয়ক্রিয়ঃ। 

উপবিশ্যাসনে যুঞ্জ্যাদ্ যোগমাত্মবিশুদ্ধয়ে।।১২।। 

অনুবাদঃ যোগ অভ্যাসের নিয়ম এই যে, কুশাসনের উপর মৃগচর্মের আসন, তার উপরে বস্ত্রাসন রেখে অত্যন্ত উচ্চ বা অত্যন্ত নীচ না করে, সেই আসন পবিত্র স্থানে স্থাপন করে তাতে আসীন হবেন। সেখানে উপবিষ্ট হয়ে চিত্ত, ইন্দ্রিয় ও ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করে চিত্ত শুদ্ধির জন্য মনকে একাগ্র করে যোগ অভ্যাস করবেন।

তাৎপর্য : এখানে ‘পবিত্র স্থান’ বলতে তীর্থস্থানকে বোঝানো হয়েছে। ভারতবর্ষে প্রায় সমস্ত যোগী ও ভক্ত গৃহত্যাগ করে প্রয়াগ, মথুরা, বৃন্দাবন, হৃষীকেশ, হরিদ্বার আদি স্থানে অথবা গঙ্গা ও যমুনার তীরবর্তী কোন নির্জন স্থানে বসবাস করে যোগ অনুশীলন করেন। কিন্তু আধুনিক যুগের অধিকাংশ মানুষের পক্ষে এই ধরনের সাধনা করা সম্ভব নয়। আজকাল অনেক বড় বড় শহরে তথাকথিত যোগ অনুশীলনের স্কুল বা যৌগিক সংস্থা গড়ে উঠেছে। এই সমস্ত সংস্থাগুলি টাকা উপার্জনের একটি ভাল ব্যবসা হতে পারে, কিন্তু যথার্থ যোগ সাধনার জন্য এগুলি সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। উদ্বিগ্নচিত্ত, অসংযমী মানুষ কখনই ধ্যান করতে পারে না। তাই, বৃহন্নারদীয় পুরাণে বলা হয়েছে যে, বর্তমান কলিযুগে মানুষ যখন অল্পায়ু, পরমার্থ সাধনে অপটু এবং সর্বদাই নানা রকম উপদ্রবের দ্বারা উৎকণ্ঠিত, তাদের ক্ষেত্রে পরমার্থ সাধনের শ্রেষ্ঠ পন্থা হচ্ছে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র সংকীর্তন করা।

হরেনাম হরেনাম হরেনামের কেবলম্ ।

কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা ॥

“বিবাদ ও শঠতায় পরিপূর্ণ এই কলিযুগে মুক্তি লাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র সংকীর্তন করা। এ ছাড়া আর কোন গতি নাই, এ ছাড়া আর কোন গতি নাই, এ ছাড়া আর কোন গতি নাই।”

শ্লোক ৬.১৩ – ৬.১৪

সমং কায়শিরোগ্রীবং ধারয়ন্নচলং স্থিরঃ।।

সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং স্বং দিশশ্চানবলোকয়ন্।।১৩।।

প্রশান্তাত্মা বিগদভীর্ব্রহ্মচারিব্রতে স্থিতঃ। 

মনঃ সংযম্য মচ্চিত্তো যুক্ত আসীত মৎপরঃ।।১৪।।

অনুবাদঃ শরীর, মস্তক ও গ্রীবাকে সমানভাবে রেখে অন্য দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে, নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রশান্তাত্মা, ভয়শূন্য ও ব্রহ্মচর্য-ব্রতে স্থিত পুরুষ মনকে সমস্ত জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে, আমাকে জীবনের চরম লক্ষ্যরূপে স্থির করে হৃদয়ে আমার ধ্যানপূর্বক যোগ অভ্যাস করবেন।

তাৎপর্য : জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকে জানা, যিনি চতুর্ভুজ বিষ্ণুরূপে সকলের হৃদয়ে পরমাত্মারূপে বিরাজ করছেন। যোগসাধন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবানের এই পরমাত্মা রূপকে দর্শন করা। এ ছাড়া যোগের আর কোন উদ্দেশ্য নেই। জীবের হৃদয়ে বিরাজমান বিষ্ণু শ্রীকৃষ্ণেরই অংশ। চতুর্ভুজ বিষ্ণুরূপী পরমাত্মাকে দর্শন করার অভিপ্রায় না নিয়ে যিনি যোগ অনুশীলন করেন, তিনি কেবল অনর্থক সময়ের অপচয় করেন। জীবনের পরম উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানা। যোগাভ্যাসের মাধ্যমে তাঁরই অংশ পরমাত্মাকে জানার চেষ্টা করা হয়। জীবের হৃদয়ে বিরাজমান পরমাত্মারূপী শ্রীবিষ্ণুকে উপলব্ধি করতে হলে পূর্ণ ব্রহ্মচর্য পালন করতে হয়। তাই, যোগীকে গৃহত্যাগ করে নির্জনে একাকী পূর্বোক্ত বিধি অনুসারে ভগবানের ধ্যান করতে হয়। ঘরে অথবা বাইরে নিত্য মৈথুন-পরায়ণ হয়ে তথাকথিত যোগশিক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে তথাকথিত যোগাভ্যাস করলে কখনই যোগী হওয়া যায় না। মনঃসংযম ও সমস্ত রকমের ইন্দ্রিয়তপূর্ণ, বিশেষ করে যৌন জীবন পরিত্যাগের অভ্যাস করতে হয়। মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য রচিত ব্রহ্মচর্য-ব্রত সন্দর্ভে বলা হয়েছে

কর্মণা মনসা বাচা সর্বাবস্থাসু সর্বদা ।

সর্বত্র মৈথুনত্যাগো ব্রহ্মচর্যং প্রচক্ষতে ॥

 “সব রকম পরিস্থিতিতে সর্বদা সর্বত্র মন, বচন ও কর্মের দ্বারা পূর্ণরূপে মৈথুন পরিত্যাগ …করাকে বলা হয় ব্রহ্মচর্য।” মৈথুন-পরায়ণ ব্যক্তি কখনই যথার্থ যোগসাধন করতে পারে না। তাই শৈশব থেকেই ব্রহ্মচর্য পালন করার শিক্ষা দেওয়া হয়, কারণ তখন যৌন জীবন সম্বন্ধে তার কোন ধারণাই থাকে না। বৈদিক সংস্কৃতি অনুসারে শিশুকে পাঁচ বছর বয়সে গুরুকুলে প্রেরণ করা হয়, সেখানে গুরুদেব তাকে ব্রহ্মচর্যের দৃঢ় সংযম শিক্ষা দান করেন। এভাবেই সুনিয়ন্ত্রিত না হলে ধ্যান, জ্ঞান অথবা ভক্তি আদি কোন যোগের পথেই অগ্রসর হওয়া যায় না। শাস্ত্রের বিধান অনুসারে বিবাহিত জীবন যাপন করে যে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে স্ত্রীসঙ্গ করে, তাকে ব্রহ্মচারী বলে গণ্য করা হয়। এই ধরনের সংযত গৃহস্থকে ভক্ত সম্প্রদায় গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু জ্ঞানী অথবা ধ্যানী সম্প্রদায় গৃহস্থ ব্রহ্মচারীকেও গ্রহণ করে না। তাদের জন্য পূর্ণ ব্রহ্মচর্য পালন করা অবশ্য কর্তব্য। ভক্তিমার্গে গৃহস্থ ব্রহ্মচারীকেও গ্রহণ করা হয়, কারণ এই যোগ এত বলবর্তী যে, তার অভ্যাস করে ভগবানের সেবা করার ফলে স্ত্রীসঙ্গ করার সমস্ত বাসনা আপনা থেকেই অন্তর্হিত হয়ে যায়। ভগবদ্গীতায় (২/৫৯) বলা হয়েছে—

বিষয়া বিনিবর্তন্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ ।

রসবর্জং রসোঽপ্যস্য পরং দৃষ্ট্বা নিবর্ততে ॥

পরমার্থ সাধনের পথে আর সকলকে জোর করে ইন্দ্রিয় সংযম করতে হলেও পরম-তত্ত্বের সৌন্দর্য দর্শন করে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার ফলে, ভক্তের আভ্যন্তরীণ বিষয়াসক্তি আপনা থেকেই নিবৃত্ত হয়ে যায়। ভক্ত ছাড়া আর কেউই এই অপ্রাকৃত আনন্দের স্বাদ পায় না।

বিগতভীঃ। পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করে প্রশান্ত না হলে নিৰ্ভীক হওয়া যায় না। বদ্ধ জীব স্বরূপ বিস্মৃত হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে যাওয়ার ফলে সর্বদাই ভীত। শ্রীমদ্ভাগবতে (১১/২/৩৭) বলা হয়েছে—ভয়ং দ্বিতীয়াভিনিবেশতঃ স্যাদীশাদপেতস্য বিপর্যয়োঽস্মৃতিঃ। কৃষ্ণভাবনামৃতই হচ্ছে ভয় থেকে মুক্ত হওয়ার একমাত্র অবলম্বন। তাই, কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তই কেবল যথার্থভাবে যোগ অভ্যাস করতে পারেন। আর যেহেতু যোগসাধন করার পরম লক্ষ্য হচ্ছে অন্তর্যামী শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করা, তাই নিঃসন্দেহে কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তই হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ যোগী। এখানে যে যোগের কথা বলা হয়েছে, তা আজকাল যে সমস্ত জনপ্রিয় তথাকথিত যোগশিক্ষা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

শ্লোক ৬.১৫

যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী নিয়তমানসঃ। 

শান্তিং নির্বাণপরমাং মৎসংস্থামধিগচ্ছতি।।১৫।।

অনুবাদঃ এভাবেই দেহ, মন ও কার্যকলাপ সংযত করার অভ্যাসের ফলে যোগীর জড় বন্ধন মুক্ত হয় এবং তিনি তখন আমার ধাম প্রাপ্ত হন।

তাৎপর্য : যোগ অনুশীলন করার পরম উদ্দেশ্য এখানে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। জড় জগতের সুখস্বাচ্ছন্দ্য লাভ করা যোগ-সাধনের উদ্দেশ্য নয়। পক্ষান্তরে, জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করাই হচ্ছে যোগ-সাধনের প্রকৃত উদ্দেশ্য। স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন, করা অথবা লৌকিক সিদ্ধিলাভ করার জন্য যোগ অভ্যাস যে করে, ভগবদ্গীতায় তাকে যোগী বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ভবরোগ নিবৃত্তির অর্থ স্বকপোলকল্পিত শূন্যে বিলীন হয়ে যাওয়া নয়। ভগবানের সৃষ্টিতে শূন্য বলে কিছুই নেই। বরং, ভবরোগ নিবৃত্তি হলে পরব্যোমে ভগবৎ-ধাম প্রাপ্তি হয়। ভগবদ্‌গীতায় ভগবৎ-ধামের বিশদ বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, সেই বৈকুণ্ঠধামকে আলোকিত করবার জন্য সূর্য, চন্দ্র অথবা তড়িৎ-শক্তির প্রয়োজন হয় না। সেখানে প্রতিটি গ্রহই সূর্যের মতো আপন আলোকে উদ্ভাসিত। ভগবৎ ধাম সর্বব্যাপক, কিন্তু পরব্যোম এবং সেখানে অবস্থিত গ্রহলোককে পরমং ধাম অথবা উৎকৃষ্ট ধাম বলা হয়।

যে যোগী তাঁর যোগ-সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছেন, যিনি সর্বতোভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পেরেছেন, তাঁর সম্বন্ধে ভগবান বলেছেন—মচ্চিত্তঃ, মৎপরঃ, মৎস্থানম্। তিনিই যথার্থ শান্তি লাভ করেন, জীবনান্তে কৃষ্ণলোক বা গোলোক বৃন্দাবন নামক তাঁর পরম ধামে প্রবেশ করার যোগ্যতা অর্জন করেন। ভগবানের আলয় গোলোক বৃন্দাবন সম্বন্ধে ব্রহ্মসংহিতাতে (৫/৩৭) বলা হয়েছে, গোলোক এব নিবসত্যখিলাত্মভূতঃ—ভগবান যদিও তাঁর স্বধাম গোলোকে বাস করেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর উৎকৃষ্ট চিন্ময় শক্তির প্রভাবে সর্বব্যাপ্ত ব্রহ্ম এবং সর্বভূতে পরমাত্মারূপে সর্বত্র বিরাজমান। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর স্বাংশ প্রকাশ বিষ্ণু সম্বন্ধে সর্বতোভাবে অবগত না হলে কোন অবস্থাতেই ভগবানের নিত্য আলয় বৈকুণ্ঠলোক অথবা গোলোক বৃন্দাবনে প্রবেশ করা যায় না। তাই, পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে যিনি ভগবানের সেবা করছেন, তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত যোগী, কারণ তাঁর মন সর্বতোভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চিন্তাতেই মগ্ন—স বৈ মনঃ কৃষ্ণপদারবিন্দয়োঃ। বেদেও (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/৮) বলা হয়েছে, তমেব বিদিত্বাতি মৃত্যুমেতি—“পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারার ফলেই জন্ম ও মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়।” এর থেকে বোঝা যায় যে, যোগসাধন করার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া। ম্যাজিক দেখানো বা শারীরিক কসরৎ দেখিয়ে লোকঠকানো যোগের উদ্দেশ্য নয়।

শ্লোক ৬.১৬

নাত্যশ্নতস্তু যোগোহস্তি ন চৈকান্তমনশ্নতঃ। 

ন চাতিস্বপ্নশীলস্য জাগ্রতো নৈব চার্জুন।।১৬।।

অনুবাদঃ অধিক ভোজনকারী, নিতান্ত অনাহারী, অধিক নিদ্রাপ্রিয় ও নিদ্রাশূন্য ব্যক্তির যোগী হওয়া সম্ভব নয়।

তাৎপর্য : এই শ্লোকে যোগীদের আহার ও নিদ্রা সংযত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতিভোজীর অর্থ হচ্ছে যে, যারা প্রাণ ধারণের অতিরিক্ত আহার করে। মানুষের জন্য ভগবান যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য-শস্য, ফল-মূল, দুধ আদি দিয়েছেন, তাই পশু ভক্ষণ করা মানুষের কোন মতেই উচিত নয়। ভগবদ্গীতায় এই প্রকার সাদাসিধে খাদ্যকে সত্ত্বগুণময় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মাংস তমোগুণ সম্পন্ন মানুষের আহার। তাই, যারা মাছ-মাংস আহার করে, মদ পান করে, ধূমপান করে এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন না করে আহার করে, তারা আহার-দোষের ফলস্বরূপ নিঃসন্দেহে পাপের ফল ভোগ করে।

ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্তাত্মকারণাৎ। যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন না করে কেবল নিজের ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য রন্ধন করে এবং আহার করে, সে পাপ ভক্ষণ করে। যে এভাবে পাপ আহার করে বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার করে, সে কখনই যোগ অনুশীলন করতে পারে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন করে তাঁর প্রসাদ গ্রহণ করাই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা। কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত ভগবানকে উৎসর্গ না করে কখনই কিছু গ্রহণ করেন না। তাই, কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তই কেবল যোগসাধনে পূর্ণতা লাভ করতে পারেন। কিন্তু যে মনগড়া উপবাস প্রণালী সৃষ্টি করে কৃত্রিম উপায়ে আহার বর্জন করে, সে যথার্থ যোগ অনুশীলন করতে পারে না। কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত শাস্ত্রের বিধান অনুসারে উপবাস করেন। তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহারও করেন না, আবার উপবাসও করেন না। তাই, তিনি যোগ অভ্যাস করার জন্য যথার্থই উপযুক্ত। যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার করে, সে ঘুমন্ত অবস্থায় নানা রকম স্বপ্ন দেখে এবং তার ফলে সে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘুমায়। ৬ ঘণ্টার বেশি ঘুমানো কারও পক্ষেই উচিত নয়। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যে ছয় ঘণ্টার বেশি ঘুমায়, সে অবধারিতভাবে তমোগুণের দ্বারা প্রভাবিত। যে মানুষ তমোগুণের দ্বারা আচ্ছন্ন, সে স্বভাবতই অলস এবং অত্যধিক নিদ্রাতুর। সেই মানুষ যোগ অনুশীলন করতে পারে না।

শ্লোক ৬.১৭

যুক্তহারবিহারস্য যুক্তচেষ্টস্য কর্মসু।

যুক্তস্বপ্নাববোধস্য যোগো ভবতি দুঃখহা।।১৭।।

অনুবাদঃ যিনি পরিমিত আহার ও বিহার করেন, পরিমিত প্রয়াস করেন, যাঁর নিদ্রা ও জাগরণ নিয়মিত, তিনিই যোগ অভ্যাসের দ্বারা সমস্ত জড়-জাগতিক দুঃখের নিবৃত্তি সাধন করতে পারেন।

তাৎপর্য : আহার, নিদ্রা, ভয় ও মৈথুন—এগুলি হচ্ছে দেহের প্রবৃত্তি। যথাযথভাবে এদের সংযত না করা হলে এরা যোগের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ভগবানকে নিবেদিত প্রসাদ গ্রহণ করার মাধ্যমে আহারের প্রবৃত্তিকে সংযত করা যায়। ভগবদ্‌গীতা (৯/২৬) অনুসারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অন্ন, শাক, সবজি, ফল, ফুল, দুধ আদি নিবেদন করা যায়। এভাবেই কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত মানুষের অযোগ্য অর্থাৎ সত্ত্বগুণের শ্রেণীভুক্ত নয়, এমন খাদ্য বর্জন করার শিক্ষা লাভ করেন। কৃষ্ণভক্ত সর্বদাই তাঁর কৃষ্ণভাবনাময় কর্তব্য পালন করতে তৎপর, তাই তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিদ্রা উপভোগকে মস্ত বড় ক্ষতি বলে মনে করেন। অব্যর্থকালত্বম্—কৃষ্ণভক্ত শ্রীকৃষ্ণের সেবা না করে একটি মুহূর্তও নষ্ট করতে চান না। তাই তিনি খুব অল্প সময় নিদ্রার জন্য বায় করেন। এই বিষয়ে তাঁর আদর্শ হচ্ছেন শ্রীল রূপ গোস্বামী, যিনি সর্বদাই কৃষ্ণভাবনায় তন্ময় থেকে কেবলমাত্র দুই ঘণ্টার জন্য নিদ্রা যেতেন, কখনও কখনও আবার তারও কম। নামাচার্য ঠাকুর হরিদাস তিন লক্ষ নাম জপ না করে মুহূর্তের জন্যও ঘুমাতেন না এবং প্রসাদ পর্যন্ত গ্রহণ করতেন না। কৃষ্ণসেবা ছাড়া কৃষ্ণভক্ত আর কোন কর্মই করেন না। তাই, তাঁর প্রতিটি কর্মই সংযত এবং ইন্দ্রিয় তৃপ্তির কলুষ থেকে মুক্ত। কৃষ্ণভক্তের যেহেতু ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির বাসনা থাকে না, তাই তাঁর জড় সুখভোগের অবকাশ নেই। যেহেতু তাঁর কর্ম, বাক্য, নিদ্রা, জাগরণ এবং সব রকমের দৈহিক কর্ম সুনিয়ন্ত্রিত, তাই তিনি কখনই জড়-জাগতিক ক্লেশ ভোগ করেন না।

শ্লোক ৬.১৮

যদা বিনিয়তং চিত্তমাত্মন্যেবাবতিষ্ঠতে। 

নিস্পৃহঃ সর্বকামেভ্যো যুক্ত ইত্যুচতে তদা।।১৮।।

অনুবাদঃ যোগী যখন অনুশীলনের দ্বারা চিত্তবৃত্তির নিরোধ করেন এবং সমস্ত জড় কামনা বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মাতে অবস্থান করেন, তখন তিনি যোগযুক্ত হয়েছেন বলে বলা হয়।

তাৎপর্য : সাধারণ মানুষের কার্যকলাপের সঙ্গে যোগীর কার্যকলাপের পার্থক্য হচ্ছে যে, যোগী কোন অবস্থাতেই জড়-জাগতিক কামনা-বাসনা বিশেষ করে যৌনসঙ্গের দ্বারা প্রভাবিত হন না। যথার্থ যোগীর মনঃক্রিয়া এত সংযত যে, তিনি কোন রকম জাগতিক বাসনার দ্বারা উদ্বিগ্ন হন না। কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত আপনা থেকেই এই অতি উৎকৃষ্ট অবস্থা প্রাপ্ত হন। সেই সম্বন্ধে শ্রীমদ্ভাগবতে (৯/৪/১৮-২০) বলা হয়েছে—

স বৈ মনঃ কৃষ্ণপদারবিন্দয়ো-বচাংসি বৈকুণ্ঠগুণানুবর্ণনে।

করৌ হরেমন্দিরমার্জনাদিষুশ্রুতিং চকারাচ্যূতসৎকথোদয়ে।।

মুকুন্দলিঙ্গালয়দর্শনে দৃশৌতদভৃত্যগাত্রস্পর্শেহঙ্গসঙ্গমম্ ।

ঘ্রাণং চ তৎপাদসরোজসৌরভে শ্রীমত্তুলস্যা রসনাং তদর্পিতে ॥

পাদৌ হরেঃ ক্ষেত্রপদানুসর্পণে শিরো হৃষীকেশপদাভিবন্দনে ।

কামং চ দাস্যে ন তু কামকাম্যয়া যথোত্তমশ্লোকজনাশ্রয়া রতিঃ ॥

“মহারাজ অম্বরীষ সর্বপ্রথমে তাঁর মনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দের ধ্যানে মগ্ন করেছিলেন। তারপর ক্রমশ তিনি তাঁর বাণী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলা বর্ণনায় নিয়োজিত করেছিলেন। তাঁর হস্ত দ্বারা তিনি ভগবানের মন্দির মার্জনা করেছিলেন, তাঁর শ্রবণ-ইন্দ্রিয় দ্বারা ভগবানের লীলা শ্রবণ করেছিলেন, তাঁর চক্ষু দ্বারা ভগবানের অপ্রাকৃত রূপ দর্শন করেছিলেন, তাঁর ত্বক-ইন্দ্রিয় দিয়ে তিনি ভগবদ্ভক্তের দেহ স্পর্শ করেছিলেন এবং তাঁর ঘ্রাণ-ইন্দ্রিয় দিয়ে তিনি ভগবানের শ্রীচরণে অর্পিত পদ্ম ফুলের ঘ্রাণ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর জিহ্বা দিয়ে ভগবানের শ্রীচরণে অর্পিত তুলসীর স্বাদ গ্রহণ করেছিলেন, তাঁর পদযুগল দ্বারা তিনি বিভিন্ন তীর্থস্থানে এবং ভগবানের মন্দিরে গমন করেছিলেন, তাঁর মস্তক দিয়ে তিনি ভগবানকে প্রণতি নিবেদন করেছিলেন এবং তাঁর সমস্ত কামনাকে তিনি ভগবানের সেবায় নিয়োজিত করেছিলেন। এই সমস্ত অপ্রাকৃত কর্মগুলি শুদ্ধ ভক্তেরই যোগ্য।”

নির্বিশেষবাদীদের পক্ষে এই অপ্রাকৃত অবস্থার কথা অনুমান করা অসম্ভব হতে পারে, কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তের পক্ষে তা অত্যন্ত সুগম এবং ব্যবহারিক, যা মহারাজ অম্বরীষের কার্যকলাপের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়। অনবরত স্মরণের দ্বারা মন যতক্ষণ না ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে একাগ্র হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত অপ্রাকৃত ভগবৎ-সেবায় এই রকম তৎপরতা সম্ভব নয়। ভক্তিমার্গে এই সমস্ত বিহিত কর্মগুলিকে বলা হয় ‘অর্চন’ অর্থাৎ সমস্ত ইন্দ্রিয় ভগবানের সেবায় নিয়োজিত করা। মন ও ইন্দ্রিয়গুলিকে কোন না কোন কর্মে অবশ্যই নিযুক্ত করতে হয়। কর্মবিরত হয়ে মন ও ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করা কোন মতেই সম্ভব নয়। তাই, সাধারণ মানুষের বিশেষ করে যারা সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করেন, তাদের পক্ষে পূর্ববর্ণিত বিধি অনুসারে ইন্দ্রিয়গুলিকে ও মনকে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত করাই ভগবৎ-প্রাপ্তির যথার্থ পন্থা। ভগবদ্গীতায় একে যুক্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

শ্লোক ৬.১৯

যথা দীপো নিবাতস্থো নেঙ্গতে সোপমা স্মৃতা। 

যোগিনো যতচিত্তস্য যুঞ্জতো যোগমাত্মনঃ।।১৯।।

অনুবাদঃ বায়ুশূন্য স্থানে দীপশিখা যেমন কম্পিত হয় না, চিত্তবৃত্তির নিরোধ অভ্যাসকারী যোগীর চিত্তও তেমনইভাবে অবিচলিত থাকে।

তাৎপর্য : বাতাস না থাকলে দীপশিখা যেমন স্থিরভাবে জ্বলে, সর্বতোভাবে পরব্রহ্মের

চিন্তায় ধ্যানস্থ হয়ে আছেন যে ভক্ত, তার চিত্তও সেই দীপশিখার মতোই স্থির নিশ্চল।

শ্লোক ৬.২০ – ৬.২৩

যত্রোপরমতে চিত্তং নিরুদ্ধং যোগসেবয়া। 

যত্র চৈবাত্মনাত্মনং পশ্যন্নাত্মনি তুষ্যতি।।২০।।

সুখমাত্যন্তিকং যত্তদ্ বুদ্ধিগ্রাহ্যমতীন্দ্রিয়ম।

বেত্তি যত্র ন চৈবায়ং স্থিতশ্চলতি তত্ত্বতঃ।।২১।।

যং লব্ধা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ।

যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে।।২২।।

তং বিদ্যাদ্দুঃখসংযোগবিয়োগং যোগসংজ্ঞিতম্।।২৩।।

অনুবাদঃ যোগ অভ্যাসের ফলে যে অবস্থায় চিত্ত সম্পূর্ণরূপে জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহৃত হয়, সেই অবস্থাকে যোগসমাধি বলা হয়। এই অবস্থায় শুদ্ধ অন্তঃকরণ দ্বারা আত্মাকে উপলব্ধি করে যোগী আত্মাতেই পরম আনন্দ আস্বাদন করেন। সেই আনন্দময় অবস্থায় অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অপ্রাকৃত সুখ অনুভূত হয়। এই পারমার্থিক চেতনায় অবস্থিত হলে যোগী আর আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান থেকে বিচলিত হন না এবং তখন আর অন্য কোন কিছু লাভই এর থেকে অধিক বলে মনে হয় না। এই অবস্থায় স্থিত হলে চরম বিপর্যয়েও চিত্ত বিচলিত হয় না। জড় জগতের সংযোগ-জনিত সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা থেকে এটিই হচ্ছে প্রকৃত মুক্তি।

তাৎপর্য : যোগ অনুশীলন করার ফলে ক্রমশ জড় বিষয়ের প্রতি অনাসক্তি আসে। এটিই হচ্ছে যোগের প্রথম লক্ষণ। তারপর যোগী সমাধিতে স্থিত হন। যার অর্থ হচ্ছে—তিনি আত্মা ও পরমাত্মাকে এক বলে মনে করার ভ্রম থেকে মুক্ত হয়ে অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয় ও চিত্তের দ্বারা পরমাত্মাকে অনুভব করেন। যোগমার্গ সাধারণত পতঞ্জলির যোগসূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিছু কপট ব্যাখ্যাকার জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে অভেদ স্থাপন করার অসৎ চেষ্টা করে এবং অদ্বৈতবাদীরা সেটিকে মুক্তি বলে মনে করে, কিন্তু তারা পতঞ্জলির যোগ প্রণালীর প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে না। পতঞ্জলির যোগপদ্ধতিতে অপ্রাকৃত আনন্দের উপলব্ধির কথা স্বীকার করা হয়েছে, কিন্তু অদ্বৈতবাদীরা তা স্বীকার করে না, কারণ তা হলে তাদের অদ্বৈত মতবাদ সম্পূর্ণভাবে ভ্রান্ত বলে পরিগণিত হবে। জ্ঞান ও জ্ঞাতার দ্বৈতবাদকে অদ্বৈতবাদীরা স্বীকার করে না, কিন্তু এই শ্লোকটিতে অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অপ্রাকৃত আনন্দ অনুভূতির কথা স্বীকার করা হয়েছে এবং সেই কথার স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন স্বয়ং পতঞ্জলি মুনি, যিনি হলেন যোগের প্রসিদ্ধ ভাষ্যকার। এই মহামুনি তাঁর যোগসূত্রে (৩/৩৪) বলে গেছেন— পুরুষার্থশূন্যানাং গুণানাং প্রতিপ্রসরঃ কৈবল্যং স্বরূপপ্রতিষ্ঠা বা চিতিশক্তিরিতি ।

এই চিতিশক্তি অথবা অন্তরঙ্গা শক্তি হচ্ছে অপ্রাকৃত। পুরুষার্থ বলতে বোঝায় ধর্ম, অর্থ, কাম এবং পরিশেষে ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। ব্রহ্মের সঙ্গে একীভূত হওয়াকে অদ্বৈতবাদীরা বলেন কৈবল্য। কিন্তু পতঞ্জলি বলছেন যে, এই কৈবলা হচ্ছে সেই দিব্য অন্তরঙ্গা শক্তি, যার দ্বারা জীব তার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর শিক্ষাষ্টকে এই অবস্থাকে বলেছেন, চেতোদর্পণ মার্জনম্ অথবা চিত্তরূপ দর্পণকে মার্জন করা। চিত্তের এই শুদ্ধিই হচ্ছে যথার্থ মুক্তি, অথবা ভবমহাদাবাগ্নিনির্বাপণম্। প্রারম্ভিক নির্বাণ-মতও এই সিদ্ধান্তের অনুরূপ। শ্রীমদ্ভাগবতে (২/১০/৬) একে বলা হয়েছে স্বরূপেণ ব্যবস্থিতিঃ। ভগবদ্গীতার এই শ্লোকেও সেই একই কথা বলা হয়েছে।

নির্বাণের পরে, অর্থাৎ জড় অস্তিত্বের সমাপ্তি হলে কৃষ্ণভাবনামৃত নামক ভগবৎ-সেবার চিন্ময় ক্রিয়াকলাপ শুরু হয়। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে, স্বরূপেণ ব্যবস্থিতিঃ—এটিই হচ্ছে “জীবাত্মার যথার্থ স্বরূপ’। এই স্বরূপ যখন বিষয়াসক্তির দ্বারা আবৃত থাকে, তখন জীবাত্মা মায়াগ্রস্ত হয়। এই বিষয়াসক্তি বা ভবরোগ থেকে মুক্ত হওয়ার অর্থ এই নয় যে, তখন আদি নিত্য স্বরূপের বিনাশ হয়। পতঞ্জলি মুনি এই সত্যের সমর্থন করে বলেছেন— কৈবল্যং স্বরূপপ্রতিষ্ঠা বা চিতিশক্তিরিতি। এই চিতিশক্তি বা অপ্রাকৃত আনন্দ হচ্ছে যথার্থ জীবন। বেদান্ত-সূত্রেও (১/১/১২) সেই কথার স্বীকৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, আনন্দময়োইভ্যাসাৎ। এই স্বাভাবিক অপ্রাকৃত আনন্দই হচ্ছে যোগের চরম লক্ষ্য এবং ভক্তিযোগ সাধন করার মাধ্যমে অনায়াসে এই আনন্দ লাভ করা যায়। সপ্তম অধ্যায়ে ভক্তিযোগ বিশদভাবে বর্ণনা করা হবে।

এই অধ্যায়ে বর্ণিত যোগপদ্ধতিতে সমাধি দুই রকমের— ‘সম্প্রজ্ঞাত-সমাধি’ ও ‘অসম্প্ৰজ্ঞাত-সমাধি’। নানা রকম দার্শনিক অন্বেষণের দ্বারা অপ্রাকৃত স্থিতিকে বলা হয় ‘সম্প্ৰজ্ঞাত-সমাধি’। ‘অসম্প্রজ্ঞাত-সমাধিতে কোন রকম জড় বিষয়ানন্দ ভোগের সম্বন্ধ থাকে না, কারণ এই স্থিতিতে তিনি সব রকম ইন্দ্রিয়জাত সুখের অতীত। এই চিন্ময় স্বরূপে অধিষ্ঠিত যোগী কখনও কোন কিছুর দ্বারা বিচলিত হন না। যোগী যদি এই স্তরে উন্নীত না হতে পারেন, তা হলে বুঝতে হবে যে, তাঁর যোগসাধনা সফল হয়নি। আধুনিক যুগের তথাকথিত যোগ, যা বিভিন্ন ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের সঙ্গে যুক্ত তা মৈথুন ও মদ্যপানে আসক্ত হয়ে যে নিজেকে যোগী বলে, সে উপহাসের পাত্র। এমন কি, যে যোগী যৌগিক সিদ্ধির প্রতি আকৃষ্ট, সেও যথার্থ যোগী নয়। যোগী যদি যোগের আনুষঙ্গিক উপলব্ধির প্রতি আকৃষ্ট থাকে, তবে সে যোগের যথার্থ সিদ্ধি লাভ করতে পারে না, সেই কথা এই শ্লোকে বলা হয়েছে। তাই, যারা যোগ-ব্যায়ামের কসরৎ দেখায় অথবা তাদের সিদ্ধি প্রদর্শন করে ম্যাজিক দেখায়, তারা যোগের অপব্যবহার করছে। তাদের বোঝা উচিত যে, তাদের যোগসাধনার সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।

এই যুগে যোগ-সাধনার শ্রেষ্ঠ পন্থা হচ্ছে কৃষ্ণভাবনা এবং এই যোগসাধনা ব্যর্থ হয় না। ভগবদ্ভক্তি সাধন করবার মাধ্যমে ভক্ত যে অপ্রাকৃত আনন্দ আস্বাদন করে, তার ফলে তিনি আর কোন রকম জড় সুখভোগ করার আকাঙ্ক্ষা করেন না। শঠতাপূর্ণ এই কলিযুগে হঠযোগ, ধ্যানযোগ ও জ্ঞানযোগ অনুশীলনের পথে অনেক বাধাবিপত্তি আছে, কিন্তু কর্মযোগ অথবা ভক্তিযোগ অনুশীলনে তেমন কোন অসুবিধা নেই।

যতক্ষণ এই জড় দেহটি আছে, ততক্ষণ আহার, নিদ্রা, ভয়, মৈথুন আদি জড় দেহের চাহিদাগুলিও মেটাতে হবে। কিন্তু শুদ্ধ ভক্তিযোগ বা কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করার মাধ্যমে যখন এই আবশ্যকতাগুলি মেটান হয়, তখন ভক্তের ইন্দ্রিয়গুলি উত্তেজিত হয় না। বরং, ভক্ত তাঁর জীবন ধারণের জন্য যতটুকু নিতান্ত প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই গ্রহণ করে যথাসম্ভব লাভ ওঠাবার চেষ্টা করেন এবং কৃষ্ণভাবনামৃতের অপ্রাকৃত আনন্দ আস্বাদন করেন। তিনি দুর্ঘটনা, রোগ, অভাব, এমন কি অতি নিকট আত্মীয়ের মৃত্যু আদি প্রাসঙ্গিক ঘটনাতেও নির্বিকার থাকেন। কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্তি সাধনের ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ সজাগ। কোন দুর্ঘটনাই তাঁকে কর্তব্যচ্যুত করতে পারে না। ভগবদ্গীতাতে (২/১৪) বলা হয়েছে— আগমাপায়িনোঽনিত্যাঙাংক্তিতিক্ষস্ব ভারত। তিনি এই সমস্ত প্রাসঙ্গিক ঘটনাগুলিকে সহ্য করেন, কারণ তিনি ভালমতেই জানেন যে, এগুলি অনিত্য—এগুলি আসবে ও যাবে, তাই তাঁর কর্তব্যকর্ম কখনই এদের দ্বারা প্রভাবিত হয় না। এভাবেই তিনি যোগের পরম সিদ্ধি লাভ করেন।

শ্লোক ৬.২৪

স নিশ্চয়েন যোক্তব্যো যোগোহনির্বিণ্ণচেতসা। 

সংকল্পপ্রভবান্ কামাংস্ত্যক্ত্বা সর্বনশেষতঃ। 

মনসৈবেন্দ্রিয়গ্রামং বিনিয়ম্য সমন্ততঃ।।২৪।।

অনুবাদঃ অবিচলিত অধ্যবসায় ও বিশ্বাস সহকারে এই যোগ অনুশীলন করা উচিত। সংকল্পজাত সমস্ত কামনা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করে মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলিকে সব দিক থেকে নিয়ন্ত্রিত করা কর্তব্য।

তাৎপর্য : যোগীকে দৃঢ় সংকল্প ও ধৈর্য সহকারে অবিচলিত থেকে যোগ অভ্যাস করতে হয়। এক সময় না এক সময় সাধনার সিদ্ধি অবশ্যই হবে—এভাবেই পূর্ণ আশাবাদী হয়ে গভীর ধৈর্য সহকারে এই পথ অনুসরণ করতে হয়। সাফল্য লাভে বিলম্ব হলে হতোদ্যম হওয়া কখনই উচিত নয়। কারণ দৃঢ় সংকল্প নিয়ে যিনি যোগ অভ্যাস করেন, তিনি অবশ্যই সাফল্য লাভ করেন। ভক্তিযোগ সম্বন্ধে শ্রীল রূপ গোস্বামী বলেছেন—

উৎসাহান্নিশ্চয়াদ্ধৈর্যাৎ তত্তৎকর্মপ্রবর্তনাৎ ।

সঙ্গত্যাগাৎ সতো বৃত্তেঃ ষড়ভির্ভক্তিঃ প্রসিধ্যতি ॥

“আন্তরিক উৎসাহ, ধৈর্য ও দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে ভক্তসঙ্গে ভক্তির অনুকূল কর্ম করে এবং কেবল সত্ত্বগুণময়ী কর্ম করার ফলে ভক্তিযোগে সাফল্য লাভ করা যায়।” (উপদেশামৃত ৩) দৃঢ় সংকল্প সম্বন্ধে সেই চড়াই পাখির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা উচিত, যার ডিম সাগরের

জলে ভেসে গিয়েছিল। একটি চড়াই পাখি সমুদ্রের তীরে ডিম পেড়েছিল, কিন্তু মহাসমুদ্রের দুর্বার তরঙ্গে সেই ডিমগুলি ভেসে যায়। অত্যন্ত মর্মাহত চিত্তে সেই চড়াই পাখি তখন সমুদ্রের কাছে আবেদন করে তার ডিমগুলি ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু সমুদ্র তার সেই আবেদনে কর্ণপাতই করেনি। তখন সেই চড়াই পাখি সমুদ্রকে শুকিয়ে ফেলার সংকল্প করে তার ছোট্ট ঠোঁটে সমুদ্রের জল তুলতে লাগল। তার এই অসম্ভব সংকল্পের জন্য সকলেই তাকে পরিহাস করতে লাগল। এদিকে সেই চড়াই পাখির কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। অবশেষে বিষ্ণুর বাহন পক্ষীরাজ গরুড়ের কানে সেই কথা পৌঁছল এবং তাঁর ছোট্ট বোনটির জন্য সহানুভূতিতে তাঁর হৃদয় ভরে উঠল। তিনি সেই ছোট্ট চড়াই পাখিটিকে দেখতে সেই সমুদ্রের তীরে এলেন। গরুড় চড়াই পাখির এই দৃঢ় সংকল্প দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে সাহায্য করবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। তারপর তিনি সমুদ্রকে আদেশ করলেন চড়াই পাখির ডিমগুলি ফিরিয়ে দিতে, আর সে যদি তা না করে, তা হলে তিনিই সেই চড়াই পাখির কাজটি সম্পন্ন করবেন, সেই কথাও তিনি সমুদ্রকে জানিয়ে দিলেন। ভীতগ্রস্ত হয়ে সমুদ্র তখন চড়াই পাখির ডিমগুলি ফিরিয়ে দিলেন। এভাবেই গরুড়ের কৃপায় সেই চড়াই পাখি তার ডিম ফিরে পেয়ে সুখী হল।

তেমনই, যোগসাধনা করা, বিশেষ করে ভগবানের সেবার মাধ্যমে ভক্তিযোগ সাধন করাকে ভীষণ কঠিন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু কেউ যদি ঐকান্তিক নিষ্ঠার সঙ্গে ভক্তিযোগের অনুশীলন করেন, তখন ভগবান তাকে নিঃসন্দেহে সাহায্য করবেন, কেন না যে নিজেকে সাহায্য করে, ভগবান তাকে সব রকমের সাহায্য করেন।

শ্লোক ৬.২৫

শনৈঃ শনৈরুপরমেদ্ বুদ্ধা ধৃতিগৃহীতয়া। 

আত্মসংস্থং মনঃ কৃত্বা ন কিঞ্চিদপি চিন্তয়েৎ।।২৫।।

অনুবাদঃ ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধির দ্বারা মনকে ধীরে ধীরে আত্মাতে স্থির করে এবং অন্য কোন কিছুই চিন্তা না করে সমাধিস্থ হতে হয়।

তাৎপর্য : সুদৃঢ় বিশ্বাস ও বুদ্ধির প্রভাবে ইন্দ্রিয়গুলিকে ধীরে ধীরে বশ করতে হয়। একেই বলা হয় ‘প্রত্যাহার’। সুদৃঢ় বিশ্বাস, ধ্যান ও ইন্দ্রিয় নিবৃত্তির দ্বারা মনকে সর্বতোভাবে সংযত করে সমাধিস্থ করতে হয়। তখন আর দেহতে আত্মবুদ্ধি হওয়ার কোন আশঙ্কা থাকে না। পক্ষান্তরে বলা যায়, যতক্ষণ জড় দেহের অস্তিত্ব আছে, ততক্ষণ জড় জগতের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, কখনই ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির কথা চিন্তা করা উচিত নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের তৃপ্তির কথা ছাড়া আর অন্য কোন সুখের কথা কল্পনা করাও উচিত নয়। সরাসরিভাবে কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করার ফলে অনায়াসে এই স্থিতি লাভ করা যায়।

শ্লোক ৬.২৬

যতো যতো নিশ্চলতি মনশ্চঞ্চলমস্থিরম্। 

ততস্ততো নিয়ম্যৈতদাত্মন্যেব বশং নয়েৎ।।২৬।।

অনুবাদঃ চঞ্চল ও অস্থির মন যে যে বিষয়ে ধাবিত হয়, সেই সেই বিষয় থেকে নিবৃত্ত করে  মনকে আত্মার বশে আনতে হবে।

তাৎপর্য : মন স্বভাবতই অস্থির ও চঞ্চল। কিন্তু আত্মতত্ত্বজ্ঞ যোগীর কর্তব্য হচ্ছে সেই মনকে নিয়ন্ত্রিত করা, মনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া তাঁর কখনই উচিত নয়। যিনি তাঁর মন ও ইন্দ্রিয়গুলিকে বশ করতে পেরেছেন, তাঁকে বলা হয় গোস্বামী অথবা স্বামী; আর যে মনের অধীন তাকে বলা হয় গোদাস, অর্থাৎ সে তার ইন্দ্রিয়ের দাস। বিষয় ভোগের নিরর্থকতা একজন গোস্বামী ভালমতেই জানেন। অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয়সুখে, ইন্দ্রিয়গুলি হৃষীকেশ অথবা ইন্দ্রিয়ের অধীশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিরন্তর যুক্ত থাকে। বিশুদ্ধ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবাই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনা। ইন্দ্রিয়গুলিকে পূর্ণরূপে বশ করার সেটিই হচ্ছে প্রকৃষ্ট পন্থা। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সেটিই যোগ-সাধনার পরম সিদ্ধি।

শ্লোক ৬.২৭

প্রশান্তমনসং হ্যেনং যোগিনং সুখমুত্তমম্। 

উপৈতি শান্তরজসং ব্রহ্মভূতমকল্মষম্।।২৭।।

অনুবাদঃ ব্রহ্মভাব-সম্পন্ন, প্রশান্ত চিত্ত, রজোগুণ প্রশমিত ও নিষ্পাপ হয়ে যাঁর মন আমাতে নিবিষ্ট হয়েছে, তিনিই পরম সুখ প্রাপ্ত হন।

তাৎপর্য : জড় কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে ভগবানের অপ্রাকৃত সেবায় সর্বতোভাবে নিয়োজিত হওয়াকে বলা হয় ব্রহ্মভূত। মদ্ভক্তিং লভতে পরাম্ (ভঃ গীঃ ১৮/৫৪)। ভগবানের চরণারবিন্দে মন স্থিত না হওয়া পর্যন্ত ব্রহ্মভূত স্তরে অধিষ্ঠিত হওয়া যায় না। স বৈ মনঃ কৃষ্ণপদারবিন্দয়োঃ । ভগবদ্ভক্তি বা কৃষ্ণভাবনামৃতে নিত্য তন্ময় থাকলে রজোগুণ এবং সব রকম জড় কলুষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হওয়া যায়।

শ্লোক ৬.২৮

যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী বিগতকল্মষঃ।

সুখেন ব্রহ্মসংস্পর্শমত্যন্তং সুখমশ্নুতে।।২৮।।

অনুবাদঃ এভাবেই আত্মসংযমী যোগী জড় জগতের সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে ব্রহ্ম-সংস্পর্শরূপ পরম সুখ আস্বাধন করেন।

তাৎপর্য : আত্মদর্শনের অর্থ হচ্ছে ভগবানের সঙ্গে আমাদের যে নিত্য সম্পর্ক রয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের স্বরূপ উপলব্ধি করা। জীবাত্মা হচ্ছে ভগবানের অপরিহার্য অংশ। তাই, তার কর্তব্য হচ্ছে ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা করা। ভগবানের সঙ্গে এই অপ্রাকৃত সম্পর্ককে বলা হয় ব্রহ্মসংস্পর্শ।

 

শ্লোক ৬.২৯

 

সর্বভূতস্থমাত্মনং সর্বভূতানি চাত্মনি। 

ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ।।২৯।।

 

অনুবাদঃ প্রকৃত যোগী সর্বভূতে আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতে সব কিছু দর্শন করেন। যোগযুক্ত আত্মা সর্বত্রই আমাকে দর্শন করেন।

তাৎপর্য : কৃষ্ণচেতনাময় যোগীই হচ্ছেন প্রকৃত দ্রষ্টা, কারণ তিনি সকলের অন্তরে পরমাত্মারূপে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করেন। ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি। পরমাত্মারূপে ভগবান সকলের হৃদয়ে অবস্থান করেন। তিনি যেমন ব্রাহ্মণের হৃদয়ে অবস্থান করছেন, তেমনই আবার একটি কুকুরের হৃদয়েও অবস্থান করছেন। যথার্থ যোগী জানেন যে, ভগবান হচ্ছেন নিত্য চিন্ময়, তাই তিনি একটি কুকুরের হৃদয়েই অবস্থান করুন অথবা একজন সৎ ব্রাহ্মণের হৃদয়েই অবস্থান করুন, জড় কলুষের দ্বারা তিনি কখনও প্রভাবিত হন না। এটিই হচ্ছে ভগবানের পরম নিরপেক্ষতা। স্বতন্ত্র জীবাত্মাও স্বতন্ত্র হৃদয়ে অবস্থান করে, কিন্তু সে সর্বজীবের হৃদয়ে অবস্থান করে না। সেটিই হচ্ছে পরমাত্মা ও জীবাত্মার পার্থক্য। যে বাস্তবিকপক্ষে যোগ সাধনে রত নয়, সে তত স্পষ্টভাবে দর্শন করতে পারে না। একজন কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত কৃষ্ণভক্ত আপনা থেকেই বিশ্বাসী অবিশ্বাসী উভয়ের অস্তরে শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করতে পারেন। স্মৃতি শাস্ত্রে সেই সম্বন্ধে বলা হয়েছে— আততত্বাচ্চ মাতৃত্বাচ্চ আত্মা হি পরমো হরিঃ। সর্বজীবের উৎস হরি মায়ের মতো সকলকে পালন করেন। মা যেমন তাঁর সব কয়টি সন্তানের প্রতি সমদৃষ্টি-সম্পন্ন, পরম পিতা বা মাতা ভগবানও তেমন সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন। পরমাত্মারূপে তিনি সকলের অন্তরে বিরাজ করেন।

বাহ্যিকভাবেও, প্রতিটি জীব ভগবানের বহিরঙ্গা শক্তিতে অবস্থিত। ভগবানের শক্তির মুখ্য প্রকাশ হচ্ছে তাঁর চিৎশক্তি বা পরা শক্তি এবং জড়া শক্তি বা অপরা শক্তি। এই সম্বন্ধে ভগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায়ে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হবে। জীব ভগবানের পরা শক্তির অংশ হলেও সে অপরা শক্তির দ্বারা বন্ধ হয়ে পড়েছে। জীব সর্বদাই ভগবানের শক্তিতে অধিষ্ঠিত। প্রতিটি জীবই কোন না কোনভাবে ভগবানের মধ্যে অবস্থিত।

যোগী সর্বভূতে সমদৃষ্টি-সম্পন্ন, কারণ তিনি দেখেন যে, জীব তাদের কর্মফল অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে থাকলেও সর্ব অবস্থাতেই তারা ভগবানের নিত্যদাস। জীব যখন ভগবানের অপরা শক্তিতে বদ্ধ অবস্থায় থাকে, তখন সে জড় ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব করে, যখন সে ভগবানের পরা শক্তিতে অধিষ্ঠিত হয়, তখন সে সাক্ষাৎ ভগবানের সেবায় তৎপর হয়। উভয় অবস্থাতে জীব ভগবানেরই দাসত্ব করে। সর্বভূতের প্রতি এই যে সমদর্শন, তা কেবল কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তই পূর্ণরূপে প্রাপ্ত হন।

———————-

যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি। 

তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।৩০।।

অনুবাদঃ যিনি সর্বত্র আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতেই সমস্ত বস্তু দর্শন করেন, আমি কখনও তাঁর দৃষ্টির অগোচর হই না এবং তিনিও আমার দৃষ্টির অগোচর হন না।

তাৎপর্য ঃ কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত নিঃসন্দেহে সর্বত্র ভগবানকে দর্শন করেন এবং তিনি সব কিছুই ভগবানের মধ্যে দেখতে পান। যদিও মনে হতে পারে যে, এই ধরনের মানুষ মায়ার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশকে সাধারণ মানুষের মতো ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখছেন, কিন্তু তিনি অনুভব করেন যে, সব কিছুই শ্রীকৃষ্ণের শক্তিরই প্রকাশ, তাই তিনি সর্বদাই কৃষ্ণভাবনাময়। শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না এবং শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সব কিছুর ঈশ্বর। এটিই কৃষ্ণভাবনার মূলতত্ত্ব। কৃষ্ণভাবনামৃতের উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষ্ণপ্রেমের বিকাশ করা—এই স্তর জড় বন্ধন-মুক্তির অতীত। আত্ম-উপলব্ধির অতীত কৃষ্ণভাবনার এই স্তরে ভক্ত শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান, অর্থাৎ তাঁর কাছে তখন সব কিছুই কৃষ্ণময় হয়ে ওঠে এবং তিনিও তখন পূর্ণরূপে কৃষ্ণপ্রেমে আবিষ্ট হয়ে যান। ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে তখন এক নিবিড় অন্তরঙ্গ প্রেমময় সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই অবস্থায় জীব কখনই বিনাশ প্রাপ্ত হয় না, তখন শ্রীকৃষ্ণ আর কখনও তাঁর ভক্তের দৃষ্টির অগোচর হন না। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে লীন হলে আত্মার স্বাতন্ত্র্যের বিনাশ হয়। তাই ভক্ত কখনও এই ভুল করেন না। ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৩৮) বলা হয়েছে—

প্রেমাঞ্জনচ্ছুরিতভক্তিবিলোচনেনসন্তঃ সদৈব হৃদয়েষু বিলোকয়স্তি ।

যং শ্যামসুন্দরমচিন্ত্যগুণস্বরূপং গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।।

“প্রেমাঞ্জন দ্বারা রঞ্জিত ভক্তিচক্ষু-বিশিষ্ট সাধুরা যে অচিন্ত্য গুণসম্পন্ন শ্যামসুন্দর শ্রীকৃষ্ণকে হৃদয়ে অবলোকন করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।”

এই প্রেমাবস্থায়, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কখনই তাঁর ভক্তের দৃষ্টির অগোচর হন না এবং ভক্তও ভগবানের দৃষ্টির অগোচর হন না। যে সিদ্ধ যোগী তাঁর হৃদয়ে পরমাত্মারূপে ভগবানকে দর্শন করছেন, তিনিও এভাবেই নিরন্তর ভগবানকে দর্শন করেন। এই ধরনের সিদ্ধ যোগী শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তে পরিণত হন এবং তিনি এক মুহূর্তের জন্যও ভগবানকে না দেখে থাকতে পারেন না।

———————-

সর্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ।

সর্বথা বর্তমানোহপি স যোগী ময়ি বর্ততে।।৩১।।

অনুবাদঃ যে যোগী সর্বভূতে স্থিত পরমাত্মা রূপে আমাকে জেনে আমার ভজনা করেন, তিনি সর্ব অবস্থাতেই আমাতে অবস্থান করেন।

তাৎপর্য : যে যোগী পরমাত্মার ধ্যান করেন, তিনি তাঁর হৃদয়ে শ্রীকৃষ্ণের আংশিক প্রকাশ শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী চতুর্ভূজ বিষ্ণুকে দর্শন করেন। যোগীদের এটি জানা উচিত যে, শ্রীকৃষ্ণ থেকে শ্রীবিষ্ণু ভিন্ন নন। শ্রীকৃষ্ণ‍ই পরমাত্মা বিষ্ণুরূপে সর্বজীবের অন্তরে বিরাজ করেন। তা ছাড়া, অসংখ্য জীবের অন্তরে যে অসংখ্য পরমাত্মা বিরাজ করছেন, তাঁরাও ভিন্ন নন। তেমনই, ভক্তিযোগে তন্ময় কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত এবং পরমাত্মা বিষ্ণুর ধ্যানে মগ্ন যোগীর মধ্যেও কোন পার্থক্য নেই। কৃষ্ণভাবনাময় যোগী এই জড় জগতে অবস্থানকালে নানা রকম জাগতিক কাজে ব্যস্ত থাকলেও তিনি সর্বদা শ্রীকৃষ্ণে অবস্থান করেন। ভক্তিরসামৃতসিন্ধুতে (পূর্ব ২/১৮৭) শ্রীল রূপ গোস্বামী সেই সম্বন্ধে বলেছেন— নিখিলাস্বপ্যবস্থাসু জীবন্মুক্তঃ স উচ্যতে। সর্বদাই কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত সর্ব অবস্থাতেই জীবন্মুক্ত। নারদ পঞ্চরাত্রেও সেই সম্পর্কে বলা হয়েছে—

দিক্কালাদ্যনবচ্ছিন্নে কৃষ্ণে চেতো বিধায় চ।

তন্ময়ো ভবতি ক্ষিপ্রং জীবো ব্রহ্মণি যোজয়েৎ।।

“যিনি একাগ্র চিত্তে স্থান-কালের অতীত শ্রীকৃষ্ণের সর্বব্যাপক শ্রীবিগ্রহের ধ্যান করেন, তিনি কৃষ্ণভাবনায় তন্ময় হন এবং শ্রীকৃষ্ণের দিব্য সান্নিধ্য লাভ করে চিন্ময় আনন্দ অনুভব করেন।”

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধ্যানে মগ্ন হওয়াটাই যোগ সাধনার পরম সিদ্ধি। সমাধিযুক্ত যোগী যখন উপলব্ধি করতে পারেন যে, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মা রূপে সর্বজীবের অন্তরে বিরাজ করছেন, তখনই তিনি সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হন। শ্রীকৃষ্ণের অচিন্ত্য শক্তির সমর্থন করে বেদে (গোপালতাপনী উপনিষদ ১/২১) বলা হয়েছে, একোঽপি সন্ বহুধা যোঽবভাতি—যদিও ভগবান একজন, তিনি বহুরূপে অসংখ্য হৃদয়ে বিরাজমান।” অনুরূপভাবে, স্মৃতি-শাস্ত্রে বলা হয়েছে—

এক এব পরো বিষ্ণুঃ সর্বব্যাপী ন সংশয়ঃ । ঐশ্বর্যাদ্রূপমেকং চ সূর্যবৎ বহুধেয়তে ॥

“অদ্বিতীয় হলেও শ্রীবিষ্ণু নিঃসন্দেহে সর্বব্যাপক। তাঁর অচিন্তা শক্তির প্রভাবে এক বিগ্রহরূপে তিনি সর্বত্রই বিদ্যমান। সূর্যের মতো তিনিও একই সময় বহু স্থানে দৃষ্ট হন।”

———————-

আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোহর্জুন। 

সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ।।৩২।।

অনুবাদঃ হে অর্জুন! যিনি সমস্ত জীবের সুখ ও দুঃখকে নিজের সুখ ও দুঃখের অনুরূপ সমানভাবে দর্শন করেন, আমার মতে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।

তাৎপর্য : কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তই হচ্ছেন পরম যোগী। নিজের অনুভূতির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সকলেরই সুখ-দুঃখ সম্বন্ধে সচেতন। ভগবানের সঙ্গে তার শাশ্বত সম্পর্কের কথা ভুলে যাওয়ার ফলেই জীব ক্লেশভোগ করে। আবার পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণই যে মানুষের সমস্ত কার্যকলাপের পরম ভোক্তা, সমস্ত দেশ ও গ্রহলোকের মহেশ্বর এবং সমস্ত জীবের অন্তরঙ্গ সুহৃদ, সেই সত্যকে উপলব্ধি করাই হচ্ছে তার সুখের কারণ। সিদ্ধ যোগী জানেন যে, জড়া প্রকৃতির গুণে আবদ্ধ জীব শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তার নিত্য সম্পর্কের কথা ভুলে যাওয়ার ফলেই ত্রিতাপ ক্লেশ ভোগ করছে। আর কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত, যিনি পূর্ণ আনন্দের স্বাদ লাভ করেছেন, তিনি চান যে, আর সকলেই সেই দিব্য আনন্দ লাভ করুক, তাই তিনি সমস্ত বিশ্বে কৃষ্ণভাবনামৃত বিতরণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। যথার্থ যোগী কৃষ্ণভাবনামৃতের গুরুত্ব প্রচার করার প্রয়াসী হন, তাই তিনি এই জগতের শ্রেষ্ঠ পরোপকারী এবং তিনি হচ্ছেন ভগবানের প্রিয়তম সেবক। ন চ তস্মান্মনুষ্যেষু কশ্চিন্নে প্রিয়কৃত্তমঃ (গীতা ১৮/৬৯)। পক্ষান্তরে, ভগবদ্ভক্ত জীবের কল্যাণ সাধনে নিত্য তৎপর, তাই তিনি সকলের প্রকৃত সুহৃদ। তাঁকে সর্বোত্তম যোগী বলা হয়, কারণ তিনি স্বার্থসিদ্ধির জন্য যোগের সিদ্ধি কামনা করেন না, বরং তিনি সমস্ত জীবের যথার্থ কল্যাণ সাধনে নিত্য যুক্ত। তিনি কারও প্রতি হিংসা, দ্বেষ আদি মনোভাব পোষণ করেন না। শুদ্ধ ভক্ত ও সিদ্ধিকামী যোগীর মধ্যে এটিই হচ্ছে পার্থক্য। সিদ্ধি লাভ করার আশায় যে যোগী নির্জনে বসে ধ্যান করেন, তিনি স্বার্থ চিন্তায় মগ্ন। কিন্তু যে ভগবদ্ভক্ত প্রতিটি মানুষকে কৃষ্ণভক্তে পরিণত করবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছেন, তিনি নির্জনে ধ্যানরত যোগীর থেকে অনেক উচ্চমার্গে অবস্থিত।

———————-

অর্জুন উবাচ

যোহয়ং যোগস্ত্বয়া প্রোক্তঃ সাম্যেন মধুসূদন। 

এতস্যাহং ন পশ্যামি চঞ্চলত্বাৎ স্থিতিং স্থিরাম্।।৩৩।।

অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- হে মধুসূদন! তুমি সর্বত্র সমদর্শনরূপ যে যোগ উপদেশ করলে, মনের চঞ্চল স্বভাববশত আমি তার স্থায়ী স্থিতি দেখতে পাচ্ছি না।

তাৎপর্য : ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে শুচৌ দেশে থেকে শুরু করে যোগী পরমঃ পর্যন্ত যে যোগ-পদ্ধতির বর্ণনা করেছেন, অর্জুন এখানে সেই যোগকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, কারণ তিনি। নিজেকে সেই যোগসাধনে অযোগ্য বলে মনে করেছেন। এই কলিযুগে সাধারণ মানুষের পক্ষে গৃহত্যাগ করে পাহাড়-পর্বতে অথবা বনে-জঙ্গলে গিয়ে নির্জন স্থানে যোগাভ্যাস করা সম্ভব নয়। এই যুগের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বপ্ন আয়ুবিশিষ্ট জীবনের জন্য তিক্ত জীবন-সংগ্রাম। এই যুগের সাধারণ মানুষ এতই অধঃপতিত যে, পরমার্থ সাধন করবার কোন প্রচেষ্টাই তাদের মধ্যে নেই। অতি সহজ সরল পন্থা অবলম্বন করেও তারা পরমার্থ সাধনের প্রয়াসী হয় না। তা হলে জীবনযাত্রা, উপবেশনের প্রক্রিয়া, স্থান নির্বাচন এবং জড় বিষয় থেকে মনের আসক্তি নিয়ন্ত্রণ করে অত্যন্ত দুরূহ ও দুঃসাধ্য যোগের সাধন তারা কিভাবে করবে? তাই বাস্তব জীবন সম্বন্ধে অভিজ্ঞ অর্জুনের মতো মহাবীর চিন্তা করলেন, এই যোগসাধন করা একেবারেই অসম্ভব, এমন কি বিভিন্ন দিক থেকে তাঁর অনুকূল পরিস্থিতি থাকলেও। অর্জুন ছিলেন অতি উচ্চ বংশজাত রাজকুমার এবং তিনি অনন্ত গুণে বিভূষিত। তিনি ছিলেন মহা বীর্যবান, দীর্ঘায়ু-সম্পন্ন মহারথী এবং সর্বোপরি তিনি ছিলেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ সখা। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে অর্জুনের সুযোগ-সুবিধা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি। এই যোগপদ্ধতি সাধন করতে অস্বীকার করেন। প্রকৃতপক্ষে, ইতিহাসের কোথাও তাঁকে এই যোগ অনুশীলন করতে দেখা যায়নি। তাই আমাদের বুঝতে হবে যে, কলিযুগে অষ্টাঙ্গযোগ সাধন করা সাধারণত মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কয়েকজন দুর্লভ মানুষের পক্ষে তা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু সাধারণের পক্ষে এটি অসম্ভব। পাঁচ হাজার বছর পূর্বে যদি এই রকম হয়ে থাকে, তা হলে এখনকার অবস্থা কি হবে ? যে সমস্ত মানুষ বিভিন্ন যোগ অনুশীলন কেন্দ্রে এই যোগ পদ্ধতির অন্ধানুকরণ করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে, তারা কেবল তাদের সময়ের অপব্যবহার করছে। তাদের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ।

———————-

চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্।

তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্।।৩৪।

অনুবাদঃ হে কৃষ্ণ! মন অত্যন্ত চঞ্চল, শরীর ও ইন্দ্রিয় আদির বিক্ষেপ উৎপাদক, দুর্দমনীয় এবং অত্যন্ত বলবান,  তাই তাকে নিগ্রহ করা বায়ুকে বশীভূত করার থেকেও অধিকতর কঠিন বলে আমি মনে করি।

তাৎপর্য ঃ মন এতই বলবান ও দুর্দমনীয় যে, সে কখনও কখনও বুদ্ধির উপর আধিপত্য বিস্তার করে তাকে পরিচালিত করতে থাকে, যদিও স্বাভাবিকভাবে মন বুদ্ধির অধীনেই থাকা উচিত। সাংসারিক মানুষকে প্রতিনিয়ত নানা রকম বিরুদ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়, তাই তার পক্ষে মনকে সংযত করা অত্যন্ত কঠিন। কৃত্রিম উপায়ে শত্রু ও মিত্রের প্রতি সমদৃষ্টি-সম্পন্ন হয়ে মনের ভারসাম্য সৃষ্টি করার অভিনয় করলেও, বাস্তবিকভাবে কোন সংসারী মানুষ তা করতে পারে না। কারণ, তা প্রচণ্ড বেগবতী বায়ুকে সংযত করার চাইতেও কঠিন। বৈদিক শাস্ত্রে (কঠ উপনিষদ ১/৩/৩-৪) বলা হয়েছে—

আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমের তু ।

বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ ।।

ইন্দ্রিয়াণি হয়ানাহুর্বিষয়াংস্তেষু গোচরান্ । আত্মেন্দ্রিয়মনোযুক্তং ভোক্তেত্যাহুর্মনীষিণঃ ॥

“এই দেহরূপ রথের আরোহী হচ্ছে জীবাত্মা, বুদ্ধি হচ্ছে সেই রথের সারথি। মন হচ্ছে তার বল্গা এবং ইন্দ্রিয়গুলি হচ্ছে ঘোড়া। এভাবেই মন ও ইন্দ্রিয়ের সাহচর্যে আত্মা সুখ ও দুঃখ ভোগ করে। চিন্তাশীল মনীষীরা এভাবেই চিন্তা করেন।”

বুদ্ধির দ্বারা মনকে পরিচালিত করা উচিত, কিন্তু মন এত শক্তিশালী ও দুর্দমনীয় যে, বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হওয়ার পরিবর্তে সে বুদ্ধিকেই পরাভূত করে তাকে পরিচালিত করতে শুরু করে। ঠিক যেমন, অনেক সময় জটিল সংক্রমণ ওষুধের রোগ প্রতিষেধক ক্ষমতাকে অতিক্রম করে। এই রকম শক্তিশালী যে মন, তাকে যোগ-সাধনার মাধ্যমে সংযত করার বিধান দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অর্জুনের মতো প্রবৃত্তি-মার্গের মানুষের পক্ষেও তা সাধন করা বাস্তবসম্মত নয়। সুতরাং, আধুনিক মানুষের সম্বন্ধে আর কি বলার আছে? এই সম্পর্কে এখানে বায়ুর যে উপমা দেওয়া হয়েছে, তা খুবই উপযুক্ত। বেগবতী বায়ুকে দমন করার ক্ষমতা কারও নেই এবং তার তুলনায় অস্থির মনকে বশ করা আরও কঠিন। মনকে দমন করার সবচেয়ে সহজ পন্থা প্রদর্শন করে গেছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। সেই পন্থা হচ্ছে পূর্ণ দৈন্য সহকারে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করা। এই পথ হচ্ছে স বৈ মনঃ কৃষ্ণপদারবিন্দয়োঃ —মনকে সর্বতোভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত করতে হবে। তা হলেই আর কোন কিছুর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মন উদ্বিগ্ন হবে না।

———————-

শ্রীভগবানুবাচ

অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্।

অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে।।৩৫।।

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন-হে মহাবাহো! মন যে দুর্দমনীয় ও চঞ্চল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হে  কৌন্তেয়! ক্রমশ অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা মনকে বশীভূত করা যায়।

তাৎপর্য : অবাধ্য মনকে সংযত করা যে কত কঠিন তা অর্জুন বুঝতে পেরেছিলেন। ভগবানও সেই কথা স্বীকার করলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে ভগবান জানিয়ে দিলেন যে, অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা তা সম্ভব। সেই অভ্যাসটি কি? বর্তমান কলিযুগে তীর্থবাস, পরমাত্মার ধ্যান, মন ও ইন্দ্রিয়গুলির নিগ্রহ, ব্রহ্মচর্য, নির্জন বাস আদি কঠোর বিধি-বিধান পালন করা সম্ভব নয়। কিন্তু কৃষ্ণভাবনামৃত অনুশীলন করার ফলে নববিধা ভগবদ্ভক্তি সাধন করা যায়। ভক্তির প্রথম ও প্রধান অঙ্গ হচ্ছে কৃষ্ণকথা শ্রবণ। মনকে সমস্ত ভ্রান্তি ও অনর্থ থেকে শুদ্ধ করার জন্য এটি অতি শক্তিশালী পন্থা। কৃষ্ণকথা যত বেশি শ্রবণ করা যায়, মন ততই প্রবুদ্ধ হয়ে কৃষ্ণবিমুখ বিষয়ের প্রতি অনাসক্ত হয়। কৃষ্ণভক্তির প্রতিকূল কার্যকলাপ থেকে মনকে অনাসক্ত করার ফলে সহজেই বৈরাগ্য শিক্ষা লাভ করা যায়। বৈরাগ্য মানে হচ্ছে বিষয়ের প্রতি অনাসক্তি এবং ভগবানের প্রতি আসক্তি। কৃষ্ণলীলায় মনকে আসক্ত করার থেকে নির্বিশেষ বৈরাগ্য অনেক বেশি কঠিন। কৃষ্ণলীলার প্রতি আসক্তি বস্তুত খুবই সহজসাধ্য, কারণ কৃষ্ণকথা শ্রবণ করা মাত্রই শ্রোতা তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়। এই আসক্তিকে বলা হয় পরেশানুভব, অর্থাৎ পারমার্থিক সন্তোষ। এই অনুভূতি অনেকটা ক্ষুধার্ত ব্যক্তির প্রতি গ্রাসে গ্রাসে ক্ষুধা নিবৃত্তিরূপ তৃপ্তির মতো। ক্ষুধার সময় যতই ভোজন করা হয়, ততই তৃপ্তি ও শক্তি অনুভব হয়। সেই রকম, ভক্তির প্রভাবে মন বিষয়াসক্তি থেকে মুক্ত হয় এবং অপ্রাকৃত তৃপ্তি অনুভূত হয়। এই পদ্ধতি অনেকটা সুদক্ষ চিকিৎসা এবং উপযুক্ত আহারের দ্বারা রোগ নিরাময় করার মতো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চিন্ময় লীলা শ্রবণ করা হচ্ছে উন্মত্ত মনের সুদক্ষ চিকিৎসা এবং কৃষ্ণপ্রসাদ হচ্ছে ভবরোগ নিরাময়ের উপযুক্ত পথ্য। এই সর্বাঙ্গীণ চিকিৎসা হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃত।

———————-

অসংযতাত্মনা যোগো দুষ্প্রাপ ইতি মে মতিঃ। 

বশ্যাত্মনা তু যততা শক্যোহবাপ্তুমুপায়তঃ।।৩৬।।

অনুবাদঃ অসংযত চিত্ত ব্যক্তির পক্ষে আত্ম-উপলব্ধি দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু যার মন সংযত এবং যিনি যথার্থ উপায় অবলম্বন করে মনকে বশ করতে চেষ্টা করেন, তিনি অবশ্যই সিদ্ধি লাভ করেন। সেটিই আমার অভিমত।

তাৎপর্য : ভগবান আমাদের এখানে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, জড় বিষয় থেকে মনকে অনাসক্ত করার যথার্থ চিকিৎসা গ্রহণ না করলে কখনই যোগ-সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা যায় না। মনকে সুখভোগে নিয়োজিত রেখে যোগের অনুশীলন করাটা জল ঢেলে আগুন জ্বালাবার চেষ্টার সামিল। মনকে সংযত না করে যোগ অনুশীলন করা কেবল সময়েরই অপচয়। এই ধরনের লোকদেখানো যোগসাধনা অর্থ উপার্জন করার একটি ভাল উপায় হতে পারে, কিন্তু পরমার্থ সাধনের ব্যাপারে তা সম্পূর্ণ নিরর্থক। তাই, নিরস্তর ভগবানের অপ্রাকৃত প্রেমময় সেবায় নিয়োজিত করে মনকে সংযত করতে হয়। কৃষ্ণভাবনামৃত বা ভগবৎ-সেবা ছাড়া মনকে কখনও সংযত করা যায় না। কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত আলাদা প্রচেষ্টা ছাড়াই অনায়াসে যোগ-সাধনার সমস্ত ফল লাভ করেন। কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় না হয়ে যোগ অনুশীলনকারী কখনই তাঁর যোগ-সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে পারেন না।

———————-

অর্জুন উবাচ

অযতিঃ শ্রদ্ধয়োপেতো যোগাচ্চলিতমানসঃ।

অপ্রাপ্য যোগসংসিদ্ধিং কাং গতিং কৃষ্ণ গচ্ছতি।।৩৭।।

অনুবাদঃ অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- হে কৃষ্ণ! যিনি প্রথমে শ্রদ্ধা সহকারে যোগে যুক্ত থেকে পরে চিত্তচাঞ্চল্য হেতু ভ্রষ্ট হয়ে যোগে সিদ্ধিলাভ করতে না পারেন, তবে সেই ব্যর্থ যোগীর কি গতি লাভ হয়?

তাৎপর্য : ভগবদ্‌গীতাতে আত্ম-উপলব্ধির পন্থা বা যোগের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আত্ম-উপলব্ধি বলতে সেই জ্ঞানকে বোঝায় যার ফলে বুঝতে পারা যায় যে, এই জড় দেহটি জীবের স্বরূপ নয়, তার স্বরূপ হচ্ছে সৎ, চিৎ ও আনন্দময় আত্মা। এই স্বরূপ অপ্রাকৃত, তা জড় দেহ ও মনের অতীত। জ্ঞানযোগ, অষ্টাঙ্গযোগ অথবা ভক্তিযোগের মাধ্যমে এই আত্ম-উপলব্ধি অন্বেষণ করতে হয়। এই সব কয়টি পন্থাতেই অনুশীলনকারীকে জানতে হয় জীবের স্বরূপ কি, তার সঙ্গে ভগবানের কি সম্পর্ক এবং কিভাবে ভগবানের সাথে সেই সম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে কৃষ্ণভাবনাময় হওয়া যায়। এই তিনটি পথের যে কোন একটিকে অবলম্বন করে সর্বান্তঃকরণে তার অনুশীলন করতে শুরু করলে এক সময় না এক সময় গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো যায়। ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে ভগবান আশ্বাস দিয়ে বলেছেন যে, পরমার্থ সাধনের পথে স্বল্প প্রচেষ্টাও জড় বন্ধন থেকে মুক্ত করে এবং মহৎ ভয়ের থেকে ত্রাণ করে। এই তিনটি পন্থার মধ্যে ভক্তিযোগই এই যুগের পক্ষে সর্বাপেক্ষা উপযোগী। কারণ, ভগবানকে জানবার জন্য এটিই হচ্ছে সবচেয়ে সহজ পথ। মন থেকে সমস্ত সংশয় দূর করার জন্য অর্জুন আবার ভগবানকে সেই কথা জিজ্ঞেস করছেন। যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গে আমরা জ্ঞানযোগ ও অষ্টাঙ্গ যোগের অনুশীলন করতে পারি। কিন্তু তাদের মাধ্যমে আত্মজ্ঞান লাভ করা এই কলিযুগে অত্যন্ত কঠিন। তাই, ঐকান্তিক চেষ্টা থাকলেও সিদ্ধি লাভ না হতেও পারে—নানা কারণে তার পদস্খলন হতে পারে। সর্বপ্রথমে, কেউ হয়ত যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে পন্থাটি অনুশীলন নাও করতে পারে। পরমার্থ সাধনে ব্রতী হওয়া মায়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করারই সামিল। অতএব, কেউ যখন জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে, তখন মায়া বা জড়া প্রকৃতি তাকে নানাভাবে প্রলোভিত করে বিপথগামী করার চেষ্টা করে। বদ্ধ জীব এমনিতেই জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা মুগ্ধ হয়ে আছে, তাই পরমার্থ সাধন করার সময় পুনরায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। একে বলা হয় যোগাচ্ছলিতমানসঃ—যোগের পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পড়া। এভাবেই যোগভ্রষ্ট হয়ে পড়লে তার পরিণাম কি হয় তা জানতে অর্জুন উৎসুক।

———————-

কচ্চিন্নোভয়বিভ্রষ্টশ্ছিন্নাভ্রমিব নশ্যতি। 

অপ্রতিষ্ঠো মহাবাহো বিমূঢ়ো ব্রহ্মণঃ পথি।।৩৮।।

অনুবাদঃ হে মহাবাহো কৃষ্ণ! কর্ম ও যোগ হতে ভ্রষ্ট ব্যক্তি ব্রহ্ম লাভের পথ থেকে বিমূঢ় হয়ে যে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে, সে কি ছিন্ন মেঘের মতো একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে?

তাৎপর্য : দুটি পথ ধরে এগোনো যায়। যারা বিষয়াসক্ত, তারা পরমার্থ নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাই তারা অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করে জড় বিষয় ভোগ করতে তৎপর, অথবা যথোচিত কর্ম অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে স্বর্গলোকে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রয়াসী। কেউ যখন পারমার্থিক পথ অবলম্বন করে, তখন তাকে সব রকম বৈষয়িক কর্ম পরিত্যাগ করতে হয় এবং সব রকম জড় সুখভোগের বাসনা পরিত্যাগ করতে হয়। এই পরমার্থ সাধনে তিনি যদি সফল না হন, তখন আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে, তিনি দুই দিকই হারালেন— তিনি জড় সুখভোগ করতে পারলেন না, আর পারমার্থিক সিদ্ধিও লাভ করতে পারলেন। না। তিনি যেন বায়ু তাড়িত মেঘের মতোই ছন্নছাড়া। আকাশে অনেক সময় এক টুকরা মেঘ একটি ছোট মেঘ থেকে সরে গিয়ে একটি বড় মেঘের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু সে যদি সেই বড় মেঘটির সঙ্গে যুক্ত হতে না পারে, তা হলে সে বায়ুর দ্বারা বিতাড়িত হয়ে অসীম আকাশে হারিয়ে যায়। ব্রহ্মণঃ পথি কথাটির অর্থ হচ্ছে পরমার্থ সাধনের পথ, যার অনুশীলনের ফলে উপলব্ধি হয় যে, জীবের প্রকৃত স্বরূপ হচ্ছে তার আত্মা। এই আত্মা হচ্ছে সেই পরমেশ্বরের অংশ, যিনি ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবানরূপে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরম তত্ত্বের পূর্ণ প্রকাশ; তাই তাঁর চরণে যিনি প্রপত্তি করেছেন, তিনিই হচ্ছেন সার্থক পরমার্থবাদী। ব্রহ্ম ও পরমাত্মা উপলব্ধির মাধ্যমে জীবনের পরম লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে বহু বহু জন্মের প্রচেষ্টার ফলে সম্ভব হতে পারে—বহুনাং জন্মনামন্তে। তাই পরমার্থ সাধনের পরম শ্রেষ্ঠ পথ হচ্ছে ভক্তিযোগ বা কৃষ্ণভাবনামৃত, যার ফলে আমরা সরাসরিভাবে জানতে পারি—ভগবান কে? শ্রীকৃষ্ণ কে? তাঁর সঙ্গে আমাদের কি সম্পর্ক?

———————-

এতন্মে সংশয়ং কৃষ্ণ ছেত্তুমর্হস্যশেষতঃ।

ত্বদন্যঃ সংশয়স্যাস্য ছেত্তা ন হুপপদ্যতে।।৩৯।।

অনুবাদঃ হে কৃষ্ণ! তুমিই কেবল আমার এই সংশয় দূর করতে সমর্থ। কারণ, তুমি ছাড়া আর কেউই আমার এই সংশয় দূর করতে পারবে না।

তাৎপর্য : ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত। ভগবদ্গীতার প্রারম্ভে ভগবান বলেছেন যে, প্রতিটি জীবই তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এমন কি, জড় বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করার পরেও তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকবে। এভাবেই তিনি প্রতিটি জীবের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলে দিয়েছেন। এখন, অর্জুন তাঁর কাছ থেকে জানতে চাইছেন, যে সমস্ত সাধকেরা তাঁদের সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে পারলেন না, তাদের কি পরিণতি হবে? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষ, তাঁর ঊর্ধ্বে আর কেউ নেই, এমন কি তাঁর সমকক্ষও কেউ হতে পারে না। তথাকথিত সমস্ত জ্ঞানী ও দার্শনিকেরা, যারা প্রকৃতির কৃপার উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল, তারাও কখনও ভগবানের সমকক্ষ হতে পারে না। তাই, আমাদের সমস্ত সন্দেহ নিরসনের জন্য ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণীই হচ্ছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র, কারণ তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অবগত, কিন্তু তাঁকে কেউ কখনও সম্পূর্ণরূপে জানতে পারে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তেরাই যথার্থ তত্ত্বজ্ঞ।

———————-

শ্রীভগবানুবাচ

পার্থ নৈবেহ নামুত্র বিনাশন্তস্য বিদ্যতে। 

ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিদ্ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি।।৪০।।

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে পার্থ! শুভানুষ্ঠানকারী পরমার্থবিদের ইহলোকে ও পরলোকে কোন দুর্গতি  হয় না। হে বৎস! তার কারণ, কল্যানকারীর কখনও অধোগতি হয় না।

তাৎপর্য : শ্রীমদ্ভাগবতে (১/৫/১৭) শ্রীনারদ মুনি ব্যাসদেবকে নির্দেশ দিয়েছেন—

তাত্ত্বা স্বধর্ম চরণাম্বুজং হরে-র্ভজন্নপক্কোহথ পতেওতো যদি ।

যত্র ক বাভদ্রমভূদমুষ্য কিং কো বার্থ আপ্তোহভজতাং স্বধর্মতঃ ॥

“কেউ যদি সব রকম জড়-জাগতিক কর্তব্য পরিত্যাগ করে ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের শরণাগত হয়, তা হলে তার কোন রকম ক্ষতি বা পতনরূপী অমঙ্গলের আশঙ্কা থাকে না। পক্ষান্তরে, সর্বতোভাবে স্বধর্মাচরণে রত অভক্তের কোনই লাভ হয় না।”

জাগতিক উন্নতির জন্য নানা রকম শাস্ত্রোক্ত ও প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠান আছে। কিন্তু কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করবার জন্য পরমার্থ সাধককে এই সমস্ত ক্রিয়াকলাপ পরিত্যাগ করতে হয়। তর্কের খাতিরে কেউ বলতে পারে যে, ভগবদ্ভক্তি সাধনের পথে সিদ্ধি লাভ করলে পরমার্থ সাধিত হতে পারে, কিন্তু যদি সিদ্ধি লাভ না হয় তা হলে তার জাগতিক জীবন ও পারমার্থিক জীবন উভয়ই বিফলে যায়। শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, শাস্ত্রের বিধান অনুসারে স্বধর্মের আচরণ না করলে তাকে সেই পাপের ফল ভোগ করতে হয়; তাই কেউ যদি যথাযথভাবে পরমার্থ সাধনে ব্যর্থ হয়, তা হলে শাস্ত্র নির্দেশিত স্বধর্ম আচরণ না করার জন্য তার ফল ভোগ করতে হয়। এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে আমাদের সংশয় দূর করবার জন্য শ্রীমদ্ভাগবত অসফল পরমার্থবাদীকে এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, এক জীবনে পরমার্থ সাধনে সিদ্ধি লাভ না করতে পারলেও তাতে দুশ্চিন্তা করার কোন কারণ নেই। এমন কি যদিও স্বধর্ম যথাযথভাবে অনুষ্ঠান না করার জন্য তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়ার অধীন হলেও, তাঁর ক্ষতির কোন কারণ নেই। কারণ, শুভ কৃষ্ণভাবনামৃত কখনও বিফলে যায় না এবং পরবর্তী জীবনে কেউ যদি অত্যন্ত নীচ বংশেও জন্মগ্রহণ করেন, তা হলেও তিনি ভগবদ্ভক্তির মার্গ থেকে বিচ্যুত হন না। পক্ষান্তরে, কেউ যদি একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে স্বধর্মের আচার অনুষ্ঠান করে, কিন্তু অন্তরে যদি ভগবদ্ভক্তি না থাকে, তা হলে তার কোনই কল্যাণ হয় না।

এই তাৎপর্যে আমরা বুঝতে পারি যে, মানুষকে দুভাগে ভাগ করা যায়— সংযত ও উচ্ছৃঙ্খল। যে সমস্ত মানুষ পরজন্মের কথা বিবেচনা না করে, পারমার্থিক মুক্তির কথা বিবেচনা না করে, কেবল পশুর মতো তাদের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি করার চেষ্টা করে, তারা উচ্ছৃঙ্খল পর্যায়ভুক্ত। আর যারা শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জীবন যাপন করে, তারা সংযত পর্যায়ভুক্ত। যারা উচ্ছৃঙ্খল, তারা উন্নত হোক বা অনুন্নতই হোক, সভ্য হোক বা অসভ্যই হোক, শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিতই হোক, শক্তিশালী হোক অথবা দুর্বলই হোক, তারা সকলেই পাশবিক প্রবৃত্তির দ্বারা প্রভাবিত। তাদের ক্রিয়াকলাপ কখনও মঙ্গলজনক হয় না, কারণ আহার, নিদ্রা, ভয় আর মৈথুনের মাধ্যমে পশুর মতো ইন্দ্রিয়তৃপ্তি করে সুখের অন্বেষণ করার ফলে তারা চিরকালই দুঃখময় জড় জগতে পড়ে থাকে এবং নিরন্তর দুঃখকষ্ট ভোগ করে। পক্ষান্তরে, যাঁরা শাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী সংযত জীবন যাপন করে ক্রমান্বয়ে কৃষ্ণভক্তির পর্যায়ে উন্নীত হন, তাঁদের জন্ম হয় সার্থক।

যাঁরা মঙ্গলজনক সংযত জীবন যাপন করেন, তাঁদের আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ১) ‘কর্মী’—যাঁরা শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে জীবন যাপন করে জাগতিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করছেন। ২) ‘মুক্তিকামী’—যাঁরা জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন এবং ৩) “ভগবদ্ভক্ত’—যাঁরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে সর্বতোভাবে আত্মোৎসর্গ করে তাঁর সেবায় নিয়োজিত হয়েছেন। শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে জীবন যাপন করে চলেছেন। যে সমস্ত কর্মী, তাঁদের আবার দুভাগে ভাগ করা যায়—‘সকাম কর্মী” ও ‘নিষ্কাম কর্মী’। ধর্ম আচরণ করার প্রভাবে অর্জিত পুণ্যফলের বলে যাঁরা জড় সুখভোগ করতে চান, তাঁরা উন্নত জীবন প্রাপ্ত হন, এমন কি তাঁরা স্বর্গলোকও প্রাপ্ত হন। কিন্তু জড় সুখভোগ করার বাসনায় আসক্ত থাকার ফলে তাঁরা যথার্থ মঙ্গলজনক পথ অনুসরণ করছেন না। জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টাই হচ্ছে মঙ্গলজনক কার্যকলাপ। পরম তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার উদ্দেশ্যে অথবা দেহাত্মবুদ্ধি থেকে জীবকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে যে কর্ম সাধিত হয় না, তা কোন মতেই মঙ্গলজনক নয়। কৃষ্ণভাবনাময় কর্মই হচ্ছে একমাত্র মঙ্গলময় কর্ম। এই কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তিযোগের পথে প্রগতির জন্য যিনি স্বেচ্ছায় সব রকম শারীরিক অসুবিধাগুলিকে সহ্য করেন, তিনি নিঃসন্দেহে তপোনিষ্ঠ পূর্ণযোগী। অষ্টাঙ্গ-যোগেরও পরম উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করা, তাই এই প্রচেষ্টাও অত্যন্ত মঙ্গলজনক এবং যিনি এই মার্গে ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করবার যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন, তাঁরও কোন রকম অধঃপতনের সম্ভাবনা নেই।

———————-

প্রাপ্য পুণ্যকৃতাং লোকানুষিত্বা শাশ্বতীঃ সমাঃ। 

শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে যোগভ্রষ্টোহভিজায়তে।।৪১।।

অনুবাদঃ যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি পুণ্যবানদের প্রাপ্য স্বর্গাদি লোকসমূহে বহুকাল বাস করে সদাচারী ব্রাহ্মণদের গৃহে অথবা শ্রীমান ধনী বণিকদের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন।

তাৎপর্য : যোগভ্রষ্ট যোগী দুই প্রকারের—এক শ্রেণী হচ্ছেন যাঁরা অল্প সাধনার পর পতিত হয়েছেন, আর অপর শ্রেণী হচ্ছেন যাঁরা দীর্ঘকাল যোগাভ্যাস করার পর ভ্রষ্ট হয়েছেন। অল্প সাধনার পর যাঁরা পতিত হয়েছেন, তাঁরা উচ্চতর লোকে যান, যেখানে পুণ্যবানেরা প্রবেশ করার অধিকার লাভ করেন। সেখানে দীর্ঘকাল নানা রকম সুখভোগ করার পরে তাঁরা আবার এই জগতে ফিরে আসেন এবং সৎ ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব অথবা ধনী বণিকের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।

যোগসাধন করার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনার অমৃত লাভ করা, যা এই অধ্যায়ের শেষ শ্লোকটিতে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এই রকমের লক্ষ্যে পৌঁছাবার আগেই যদি কেউ মোহিনী মায়ার প্রভাবে ভ্রষ্ট হন, তা হলে ভগবানের কৃপায় তাঁরা তাঁদের জাগতিক কামনা-বাসনার তৃপ্তিসাধন করার পূর্ণ সুযোগ পান এবং তারপর ধার্মিক অথবা সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এই ধরনের সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করার ফলে তাঁরা ভগবদ্ভক্তি লাভ করার সুযোগ পান। তাই, তারা ধার্মিক ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন, পূর্ব জন্মের কথা স্মরণ করে তাঁদের ভগবদ্ভক্তি সাধনে ব্রতী হওয়া উচিত।

———————-

অথবা যোগিনামেব কুলে ভবতি ধীমতাম্। 

এতদ্ধি দুর্লভতরং লোকে জন্ম যদীদৃশম্।।৪২।।

অনুবাদঃ অথবা যোগভ্রষ্ট পুরুষ জ্ঞানবান যোগিগণের বংশে জন্মগ্রহণ করেন। এই প্রকার জন্ম এই জগতে অবশ্যই অত্যন্ত দুর্লভ।

তাৎপর্য : এই শ্লোকে ভগবান যোগী এবং পরমার্থবাদী সাধকের কুলে জন্ম হওয়ার প্রশংসা করেছেন। কারণ, এই কুলে জন্ম হওয়ার ফলে জীবনের শুরু থেকেই পরমার্থ সাধনের প্রেরণা লাভ করা যায়, বিশেষ করে আচার্য অথবা গোস্বামী পরিবারে জন্ম হওয়ার ফলে। পরম্পরা এবং শিক্ষার প্রভাবে এই কুল বিদ্বান ও ভক্তিযুক্ত হয়, তাই তাঁরা গুরুপদ প্রাপ্ত হতেন। ভারতবর্ষে এই রকম বহু আচার্য পরিবার আছে, কিন্তু যথেষ্ট শিক্ষা ও সংযমের অভাবে তারা অধঃপতিত হয়েছে। ভগবানের কৃপার ফলে কোন কোন পরিবারে পুরুষানুক্রমে সাধক উৎপন্ন হয়। এই রকম পরিবারে জন্ম লাভ করা অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের আচার্যদেব ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীশ্রীমদ ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী মহারাজ ও আমি স্বয়ং এই রকম পরিবারে জন্ম লাভ করেছি এবং জীবনের প্রারম্ভেই আমরা ভগবদ্ভক্তি অনুশীলন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। দৈব বিধান অনুসারে পরবর্তীকালে আমরা মিলিত হয়েছি।

———————-

তত্র তং বুদ্ধিসংযোগং লভতে পৌর্বদেহিকম্। 

যততে চ ততো ভূয়ঃ সংসিদ্ধৌ কুরুনন্দন।।৪৩।।

অনুবাদঃ হে কুরুনন্দন! সেই প্রকার জন্মগ্রহণ করার ফলে তিনি পুনরায় তাঁর পূর্ব জন্মকৃত পারমার্থিক চেতনার বুদ্ধিসংযোগ লাভ করে সিদ্ধি লাভের জন্য পুনরায় যত্নবান হন।

তাৎপর্য : পূর্ব জন্মের সুকৃতি অনুসারে সৎ ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করে পারমার্থিক চেতনার বিকাশ করার খুব সুন্দর দৃষ্টান্ত আমরা পাই মহারাজ ভরতের মাধ্যমে। মহারাজ ভারত ছিলেন সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর এবং তাঁরই নামানুসারে স্বর্গের দেবতাদের কাছেও এই গ্রহের নাম হয় ভারতবর্ষ। পূর্বে নাম ছিল ইলাবৃতবর্ষ। পারমার্থিক সিদ্ধি লাভ করবার জন্য ভরত মহারাজ খুব অল্প বয়সে সংসার ত্যাগ করেন কিন্তু তিনি সিদ্ধি লাভে অক্ষম হন। পরবর্তী জীবনে তিনি এক সৎ ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেন। কোন মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতেন না এবং কারও সঙ্গে কথা বলতেন না বলে তাঁর নাম হয় জড় ভরত। পরবর্তীকালে মহারাজ রহুগণ তাঁর সঙ্গে কথোপকথন করার মাধ্যমে জানতে পারেন যে, তিনি পরম ভাগবত। জড় ভরতের জীবনের মাধ্যমে আমরা অনায়াসে বুঝতে পারি যে, পারমার্থিক সাধনা বা যোগসাধনা কখনই বিফলে যায় না। ভগবানের কৃপার ফলে পরমার্থ সাধকেরা কৃষ্ণভাবনায় সিদ্ধি লাভ করবার জন্য বারবার সুযোগ পান।

———————-

পূর্বাভ্যাসেন তেনৈব হ্রিয়তে হ্যবশোহপি সঃ। 

জিজ্ঞাসুরপি যোগস্য শব্দব্রহ্মাতিবর্ততে।।৪৪।।

অনুবাদঃ তিনি পূর্ব জন্মের অভ্যাস বসে যেন অবশ হয়ে যোগ-সাধনের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই প্রকার যোগশাস্ত্রের জিজ্ঞাসু পুরুষ বেদোক্ত সকাম কর্মমার্গকে অতিক্রম করেন, অর্থাৎ সকাম কর্মমার্গে যে ফল নির্দিষ্ট আছে, তার থেকে উৎকৃষ্ট ফল লাভ করেন।

তাৎপর্য : উচ্চ স্তরের যোগীরা বেদের কর্মকাণ্ডের প্রতি আকৃষ্ট নন, কিন্তু তাঁরা স্বাভাবিক ভাবেই যোগ-পদ্ধতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন, যা তাদের কৃষ্ণভাবনামৃতের স্তরে উন্নীত করে। এই কৃষ্ণভাবনামৃতই হচ্ছে পরমার্থ সাধনের সর্বোচ্চ স্তর। শ্রীমদ্ভাগবতে (৩/৩৩/৭) বৈদিক কর্মকাণ্ডের প্রতি উন্নত পরমার্থবাদীর নিরাসক্তি সম্বন্ধে বলা হয়েছে—

অহো বত শ্বপচোহতো গরীয়ান্ যজ্জিহ্বাগ্রে বর্ততে নাম তুভ্যম্ ।

তেপুস্তপস্তে জুহুবুঃ সস্নুরার্যা ব্রহ্মানুচুর্নাম গৃণন্তি যে তে ৷

“হে ভগবান! চণ্ডালকুলে জন্মগ্রহণ করেও যদি কেউ তোমার অপ্রাকৃত নাম কীর্তন করেন, তবে বুঝতে হবে যে, তিনি পারমার্থিক জীবনে অত্যন্ত উন্নত। যিনি ভগবানের নাম করেন, তিনি নিঃসন্দেহে ইতিপূর্বেই সব রকমের তপশ্চর্যা, যাগ-যজ্ঞ, তীর্থস্নান ও শাস্ত্র অধ্যয়ন সমাপ্ত করেছেন।”

এই সম্বন্ধে একটি খুব সুন্দর দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঠাকুর হরিদাস, যাঁকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অন্যতম পার্ষদরূপে গ্রহণ করেছিলেন। যদিও হরিদাস ঠাকুর যবনকুলে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁকে নামাচার্যরূপে ভূষিত করেছিলেন, কেন না তিনি একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তিন লক্ষ হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র— হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে জপ করেছিলেন। যেহেতু তিনি নিরন্তর ভগবানের নাম কীর্তন করতেন, এর থেকে বোঝা যায় যে, পূর্ব জন্মে তিনি শব্দব্রহ্ম নামক বৈদিক কর্মকাণ্ডের অনুষ্ঠান পূর্ণরূপে সম্পন্ন করেছিলেন। অতএব শুদ্ধ না হলে ভগবদ্ভক্তি লাভ করা যায় না এবং ভগবানের অপ্রাকৃত নাম সমন্বিত হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র উচ্চারণ করা যায় না।

———————-

প্রযত্নাদ্ যতমানস্তু যোগী সংশুদ্ধকিল্বিষঃ। 

অনেকজন্মসংসিদ্ধস্ততো যাতি পরাং গতিম্।।৪৫।।

অনুবাদঃ যোগী ইহজন্মে পূর্বজন্মকৃত যত্ন অপেক্ষা অধিকতর যত্ন করে পাপ মুক্ত হয়ে পূর্ব পূর্ব জন্মের সাধন সঞ্চিত  সংস্কার দ্বারা সিদ্ধি লাভ করে পরম গতি লাভ করেন।

তাৎপর্য : ধর্মপরায়ণ, সম্ভ্রান্ত ও পবিত্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করার ফলে মানুষ পরমার্থ সাধন করবার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে তাঁর অসম্পূর্ণ সাধনাকে পূর্ণ করতে প্রয়াসী হন এবং এভাবেই সমস্ত জড় কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে তিনি কৃষ্ণভাবনা লাভ করেন। কৃষ্ণভাবনাই হচ্ছে জড় কলুষ থেকে মুক্ত হওয়ার প্রকৃষ্ট পন্থা । এই সম্বন্ধে ভগবদ্‌গীতায় (৭/২৮) বলা হয়েছে—

যেষাং তন্তগতং পাপং জনানাং পুণ্যকর্মণাম্ ।

তে দ্বন্দমোহনির্মুক্তা ভজন্তে মাং দৃঢ়ব্রতাঃ ॥

“জন্ম-জন্মান্তরের বহু পুণ্যকর্মের ফলে কেউ যখন পাপ ও জড় জগতের মোহময় দ্বন্দু থেকে পূর্ণরূপে মুক্ত হন, তখন তিনি দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে ভগবানের সেবায় যুক্ত হন।”

———————-

তপস্বিভ্যোহধিকো যোগী জ্ঞানিভ্যোহপি মতোহধিকঃ। 

কর্মিভ্যশ্চাধিকো যোগী তস্মাদযোগী ভবার্জুন।।৪৬।।

অনুবাদঃ যোগী তপস্বীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং সকাম কর্মীদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। অতএব, হে অর্জুন! সর্ব অবস্থাতেই তুমি যোগী হও।

তাৎপর্য ঃ যোগের অর্থ হচ্ছে পরম-তত্ত্বের সঙ্গে চেতনের সংযোগ। বিভিন্ন পন্থা অনুসারে এই যোগকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। কর্মের মাধ্যমে যখন চেতনাকে ভগবানের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়, তখন তাকে বলা হয় কর্মযোগ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে যখন ভগবানকে জানবার চেষ্টা করা হয়, তখন তাকে বলা হয় জ্ঞানযোগ এবং ভক্তির মাধ্যমে যখন ভগবানের সঙ্গে জীবের নিত্য সম্পর্কের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়, তখন তাকে বলা হয় ভক্তিযোগ। সমস্ত যোগের চরম পরিণতি বা পরম পূর্ণতা হচ্ছে ভক্তিযোগ বা কৃষ্ণভাবনা। সেই কথা পরবর্তী শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে ভগবান যোগের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করেছেন, কিন্তু তিনি কখনই বলেননি যে, এই যোগ ভক্তিযোগের থেকে শ্রেয়। ভক্তিযোগ হচ্ছে পরম তত্ত্বজ্ঞান এবং তাকে কোন কিছুই অতিক্রম করতে পারে না। আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান ব্যতীত তপশ্চর্যার কোন তাৎপর্য নেই। ভগবানে শরণাগতি না হলে গবেষণামূলক জ্ঞানও সম্পূর্ণ নিরর্থক। আর কৃষ্ণভাবনা-বিহীন সকাম কর্ম কেবল সময় নষ্ট করারই নামান্তর। তাই, সমস্ত যোগের মধ্যে ভক্তিযোগকেই শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য করা হয়। পরবর্তী শ্লোকে তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

———————-

যোগিনামপি সর্বেষাং মদগতেনান্তরাত্মনা। 

শ্রদ্ধাবান্ ভজতে যো মাং স মে যুক্ততমো মতঃ।।৪৭।।

অনুবাদঃ যিনি শ্রদ্ধা সহকারে মদগত চিত্তে আমার ভজনা করেন, তিনিই সবচেয়ে অন্তরঙ্গভাবে আমার সঙ্গে যুক্ত এবং তিনিই সমস্ত যোগীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সেটিই আমার অভিমত।

তাৎপর্য ঃ এখানে ভজতে শব্দটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ভজ্‌ ধাতু থেকে এই শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। ‘সেবা’ অর্থে এই শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে। পূজা করা এবং ভজনা করা— এই দুটি শব্দের অর্থ এক নয়। পূজা করার অর্থ পূজ্য ব্যক্তিকে অভিবাদন করা। কিন্তু ভজনা করার অর্থ হচ্ছে প্রেম ও ভক্তি সহকারে সেবা করা, যা কেবল ভগবানেই প্রযোজ্য। পূজ্য ব্যক্তিকে অথবা দেবতাকে পূজা না করলে মানুষ কেবল শিষ্টাচারহীন অভদ্র বলে পরিগণিত হয়। কিন্তু ভক্তি ও ভালবাসার সঙ্গে ভগবানের সেবা না করা নিন্দনীয় অপরাধ। প্রতিটি জীবই হচ্ছে ভগবানের অপরিহার্য অংশ, তাই প্রতিটি জীবেরই ধর্ম হচ্ছে ভগবানের সেবা করা। তা না করার ফলেই তার অধঃপতন হয়। শ্রীমদ্ভাগবতে (১১/৫/৩) সেই সম্বন্ধে বলা হয়েছে—

য এবাং পুরুষং সাক্ষাদাত্মপ্রভবমীশ্বরম্ ।

ন ভজন্ত্যবজানন্তি স্থানাদ ভ্রষ্টাঃ পতন্ত্যধঃ ॥

“পরমেশ্বর ভগবানের ভজনা না করে, যে তার কর্তব্যে অবহেলা করে, সে অবধারিতভাবে ভ্রষ্ট হয়ে অধঃপতিত হয়।”

এই শ্লোকেও ভজন্তি কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। পরমেশ্বর ভগবানের ক্ষেত্রেই কেবল ভজন্তি কথাটি প্রযোজ্য, কিন্তু ‘পূজা’ শব্দটি দেব-দেবী ও অন্যান্য মহৎ জীবের বেলায় ব্যবহার করা যেতে পারে। শ্রীমদ্ভাগবতের এই শ্লোকের অরজানন্তি শব্দটির উল্লেখ ভগবদ্গীতাতেও পাওয়া যায়। অবজানন্তি মাং মূঢ়াঃ- “যারা অত্যন্ত মূঢ়, তারাই কেবল পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে যথার্থভাবে জানতে না পেরে অবজ্ঞা করে।” ভগবানের প্রতি সেবার মনোবৃত্তি ছাড়াই এই সব মৃঢ়রা ভগবদ্গীতার তাৎপর্য লেখার দায়িত্বভার গ্রহণ করে, তাই তারা ভজন্তি ও ‘পূজা’ এই শব্দ দুটির মধ্যে যে কি পার্থক্য তা নিরূপণ করতে পারে না।

সব রকমের যোগ-সাধনার চরম পরিণতি হচ্ছে ভক্তিযোগ। অন্যান্য সমস্ত যোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবদ্ভক্তি বা ভক্তিযোগের স্তরে উন্নীত হওয়া। ‘যোগ’ বলতে প্রকৃতপক্ষে ভক্তিযোগকেই বোঝায়। আর অন্য সমস্ত যোগগুলি ক্রমান্বয়ে ভক্তিযোগেই যুক্ত হয়। কর্মযোগ থেকে শুরু করে ভক্তিযোগের শেষ পর্যন্ত আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান লাভের এক সুদীর্ঘ পথ। নিষ্কাম কর্মযোগ থেকেই এই পথের শুরু। কর্মযোগের মাধ্যমে যখন জ্ঞান ও বৈরাগ্যের উদয় হয়, তখন সেই স্তরকে বলা হয় জ্ঞানযোগ। দৈহিক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে যখন জ্ঞানযোগের সঙ্গে ধ্যান যুক্ত হয়ে মনকে পরমাত্মার উপর একাগ্র করা হয়, তখন তাকে বলা হয় অষ্টাঙ্গযোগ। অষ্টাঙ্গ-যোগকে অতিক্রম করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়াই হচ্ছে ভক্তিযোগ। প্রকৃতপক্ষে, এই ভক্তিযোগই হচ্ছে চরম পরিণতি। কিন্তু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ভক্তিযোগের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে হলে অন্য সমস্ত যোগ সম্বন্ধে অবগত হতে হয়। যে যোগী প্রগতিশীল, তিনি পরমার্থ সাধনের পথে বিশেষ সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। কিন্তু প্রগতিবিহীন হয়ে কেউ যখন কোন এক স্তরে স্থির হয়ে পড়ে, তখন তাকে সেই বিশেষ স্তরের নামানুসারে কর্মযোগী, জ্ঞানযোগী, ধ্যানযোগী, রাজযোগী, হঠযোগী আদি নামে অভিহিত করা হয়। পরম সৌভাগ্যের ফলে কেউ যখন ভক্তিযোগের স্তরে উন্নীত হন, তখন বুঝতে হবে যে, তিনি অন্য সব যোগের স্তর ইতিমধ্যেই অতিক্রম করেছেন। তাই, কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করে কৃষ্ণভক্ত হওয়াই যোগমার্গের সর্বোচ্চ শিখর। যেমন, আমরা যখন হিমালয় পর্বতের কথা বলি, তখন আমরা পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতমালা সম্পর্কে বলি, এই হিমালয়ের আবার সর্বোচ্চ শিখর হচ্ছে মাউন্ট এভারেস্ট।

অনেক সৌভাগ্যের ফলে মানুষ কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করে ভক্তিযোগের পথ অবলম্বন করে এবং বৈদিক শাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী এই যোগ অনুশীলন করে। আদর্শ যোগী শ্রীকৃষ্ণের ধ্যানে মগ্ন থাকেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে শ্যামসুন্দর বলা হয়, কারণ তাঁর অঙ্গকান্তি জলভরা মেঘের মতো নীলাভ, তাঁর পদ্মের মতো মুখারবিন্দ সূর্যের মতো প্রফুল্লোজ্জ্বল, তাঁর বসন মণি-রত্নের দ্বারা বিভূষিত, তাঁর শ্রীঅঙ্গ ফুলমালায় সুশোভিত। তাঁর দিব্য অঙ্গকান্তি ব্রহ্মজ্যোতির সর্ব ঐশ্বর্যময়ী প্রভায় সর্বদিক উদ্ভাসিত। শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীনৃসিংহদেব, শ্রীবরাহদের এবং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণরূপে তিনি অবতরণ করেন। তিনি হচ্ছেন সমস্ত অবতারের অবতারী—তিনি হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তিনি মাতা যশোদার নন্দনরূপে সাধারণ মানুষের মতো আবির্ভূত হন এবং শ্রীকৃষ্ণ, গোবিন্দ, বাসুদেব আদি নামে পরিচিত হন। তিনি হচ্ছেন আদর্শ সন্তান, আদর্শ পতি, আদর্শ সখা, আদর্শ প্রভু। তিনি সমস্ত ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ এবং অপ্রাকৃত গুণাবলীতে বিভূষিত। ভগবানের এই স্বরূপ যিনি সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করেছেন, তিনিই হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ যোগী।

যোগের সর্বোচ্চ সিদ্ধির এই স্তর লাভ হয় ভক্তিযোগের মাধ্যমে, যা বৈদিক শাস্ত্রে প্রতিপন্ন হয়েছে—

যস্য দেবে পরা ভক্তির্যথা দেবে তথা গুরৌ । তস্যৈতে কথিতা হ্যর্থাঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ ॥

“যে সমস্ত মহাত্মারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও গুরুদেবের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি লাভ করেছেন, তাঁদের কাছে সমস্ত বৈদিক জ্ঞানের সম্পূর্ণ তাৎপর্য প্রকাশিত হয়।”

(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৬/২৩)

ভক্তিরস্য ভজনং তদিহামুত্রোপাধিনৈরাস্যেনামুস্মিন্ মনঃকল্পনমেতদেব নৈষ্কর্ম্যম্।

“ভক্তি মানে হচ্ছে লৌকিক অথবা পারলৌকিক সব রকম বিষয়-বাসনা রহিত ভগবৎ-সেবা। বিষয় বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে মনকে সম্পূর্ণরূপে ভগবানের সেবায় পূর্ণরূপে তন্ময় করা। সেটিই হচ্ছে নৈষ্কর্মের উদ্দেশ্য।”

(গোপালতাপনী উপনিষদ ১/১৫)

এগুলি হচ্ছে যোগপদ্ধতির সর্বোচ্চ সিদ্ধির স্তর—ভক্তিযোগ বা কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করার কয়েকটি উপায়।

ইতি—ধ্যানযোগ নামক শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।