শ্রীমদ্ভগবদগীতা যথাযথ

পঞ্চম অধ্যায় - কর্মসন্ন্যাস-যোগ

শ্লোক ৫.১

 

অর্জুন উবাচ

সন্ন্যাসং কর্মণাং কৃষ্ণ পুনর্যোগং চ শংসসি। 

যচ্ছ্রেয় এতয়োরেকং তন্মে ব্রুহি সুনিশ্চিতম্।।১।।

 

অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- হে শ্রীকৃষ্ণ! প্রথমে তুমি আমাকে কর্ম ত্যাগ করতে বললে এবং তারপর কর্মযোগের অনুষ্ঠান করতে বললে। এই দুটির মধ্যে কোনটি অধিক কল্যাণকর, তা সুনিশ্চিতভাবে আমাকে বল।

তাৎপর্য : ভগবদ্গীতার এই পঞ্চম অধ্যায়ে ভগবান বলছেন যে, শুষ্ক জ্ঞানের মানসিক জল্পনার চেয়ে কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তিভাবমূলক কর্ম শ্রেয়। ভক্তিভাবমূলক সেবা শুষ্ক, জল্পনা কল্পনার চেয়ে সহজতর, কারণ এই ধরনের কর্ম অপ্রাকৃত এবং তা সাধন করার ফলে মানুষ কর্মফলের প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত হয়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আত্মার প্রাথমিক জ্ঞান এবং জড় জগতে তার বন্ধনের কারণ বর্ণনা করা হয়েছে এবং বুদ্ধিযোগ বা ভক্তিযোগের অনুশীলনের ফলে কিভাবে সেই বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়, তার ব্যাখ্যাও করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, যিনি শুধু জ্ঞানের স্তরে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তাঁর আর কোন কর্তব্য নেই। চতুর্থ অধ্যায়ে ভগবান অর্জুনকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, সব রকমের যজ্ঞই জ্ঞানে পরিসমাপ্তি হয়। তবে, এই চতুর্থ অধ্যায়ের শেষে ভগবান অর্জুনকে উপদেশ দিলেন, পূর্ণ জ্ঞানে অধিষ্ঠিত হয়ে মোহমুক্ত হয়ে যুদ্ধ করতে। সুতরাং, এভাবে একই সঙ্গে ভক্তিভাবমূলক কর্মে নিয়োজিত হতে এবং জ্ঞানে অধিষ্ঠিত হয়ে কর্ম পরিহার করতে পরামর্শ দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বিভ্রান্ত করেছিলেন আর তাঁকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিচলিত করে তোলেন। অর্জুন বুঝতে পেরেছিলেন যে, জ্ঞানের প্রভাবে কর্ম ত্যাগের অর্থ হচ্ছে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য যে সমস্ত কর্ম, তা থেকে বিরত থাকা। কিন্তু কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে ভক্তিযোগ সাধন করার জন্য যদি কর্ম করা হয়, তা হলে কর্ম ত্যাগ করা হল কি করে? তিনি মনে করেছিলেন, জ্ঞানের প্রভাবে কর্মত্যাগ অর্থাৎ সন্ন্যাস হচ্ছে সব রকমের কর্ম থেকে বিরত হওয়া, কারণ কর্ম ও ত্যাগ তাঁর কাছে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়েছিল। সাধারণ মানুষের মতো তিনিও বুঝতে পারেননি যে, পূর্ণ জ্ঞানে অধিষ্ঠিত হয়ে যে কর্ম করা হয়, তা কর্মফল থেকে মুক্ত এবং তাই তা ‘অকর্ম’। সুতরাং, তিনি ভগবানকে প্রশ্ন করেছেন, পরমার্থ সাধনের জন্য তিনি কি সর্বতোভাবে কর্ম পরিত্যাগ করবেন, না, পূর্ণ জ্ঞানে কর্ম করবেন।

 

শ্লোক ৫.২

 

 

শ্রীভগবানুবাচ

সন্ন্যাসঃ কর্মযোগশ্চ নিঃশ্রেয়সকরাবুভৌ। 

তয়োস্ত কর্মসন্ন্যাসাৎ কর্মযোগো বিশিষ্যতে।।২।।

 

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- কর্মত্যাগ কর্মযোগ উভয়ই মুক্তিদায়ক। কিন্তু, এই দুটির মধ্যে কর্মযোগ কর্মসন্ন্যাস থেকে শ্রেয়।

তাৎপর্য : ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য যে সকাম কর্ম করা হয়, তা মানুষকে জড় বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে। জীব যখন তার শারীরিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি করার আশায় নানাবিধ কর্ম করে চলে, তখন সে নিশ্চিতভাবে তার কর্মের ফলস্বরূপ একটির পর একটি বিভিন্ন ধরনের দেহ ধারণ করে এই জড় জগতে ঘুরে বেড়ায় এবং তার ফলে জড় বন্ধন অনন্তকাল ধরেই চলতে থাকে। সেই সম্বন্ধে শ্রীমদ্ভাগবতে (৫/৫/৪-৬) প্রতিপন্ন করে বলা হয়েছে—

নূনং প্রমত্তঃ কুরুতে বিকর্ম যদিন্দ্রিয়প্রীতয় আপৃণোতি ।

ন সাধু মন্যে যত আত্মনোঽয়মসন্নপি ক্লেশদ আস দেহঃ ॥

পরাভবস্তাবদবোধজাতো যাবন্ন জিজ্ঞাসত আত্মতত্ত্বম্ ।

যাবৎ ক্রিয়াস্তাবদিদং মনো বৈকর্মাত্মকং যেন শরীরবন্ধঃ ॥

এবং মনঃ কর্মবশং প্রযুঙক্তে অবিদ্যয়াত্মন্যুপধীয়মানে ।

প্রীতির্ন যাবন্ময়ি বাসুদেবেন মুচ্যতে দেহযোগেন তাবৎ ॥

“ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করবার জন্য মানুষ উন্মাদ এবং সে জানে না যে, তার ক্লেশদায়ক দেহটি হচ্ছে তার পূর্বকৃত সকাম কর্মের ফল। এই দেহটি অস্থায়ী, অথচ এর জন্যই মানুষকে দুঃখকষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। তাই, জড় ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করবার আশায় কর্ম করা ভাল নয়। নিজের প্রকৃত স্বরূপ সম্বন্ধে যে মানুষ কোনও অনুসন্ধান করে না, তার জীবন ব্যর্থ বলেই মনে করতে হবে। যতদিন মানুষ তার প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে না পারে, ততদিন তাকে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য কর্মফলের আশায় কর্ম করতে হয় এবং যতদিন বিষয়সুখ ভোগ করবার বাসনায় তার চেতনা আচ্ছন্ন থাকে, ততদিন তাকে এক দেহ থেকে আর এক দেহে দেহান্তরিত হতে হয়। অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন মন সকাম কর্মে নিবিষ্ট হতে পারে, কিন্তু মানুষের কর্তব্য হচ্ছে মনের এই বাসনাকে দমন করে বাসুদেবের চরণে প্রপত্তি করা। কেবল তখনই সে এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হবার সুযোগ পেতে পারে।” তাই, যে জ্ঞান মানুষকে শিক্ষা দেয় যে, সে তার জড় দেহ নয়, তার প্রকৃত স্বরূপ হচ্ছে তার আত্মা, সেই জ্ঞানও জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়। আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পেরে আত্মার শাশ্বত ধর্ম পালন করতে হয়, নচেৎ জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় নেই। কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে ভগবানের সেবা করার জন্য যে কর্ম করা হয়, সেই কর্ম সকাম কর্ম নয়। জ্ঞানময় কর্ম মানুষের প্রকৃত জ্ঞানের প্রগতিকে শক্তিশালী করে। কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত না হয়ে, কেবল সকাম কর্ম ত্যাগ করলেই বদ্ধ জীবের হৃদয় কলুষমুক্ত হয় না। যতক্ষণ পর্যন্ত হৃদয় সম্পূর্ণভাবে কলুষমুক্ত না হচ্ছে, ততক্ষণ সকাম কর্মের স্তরে কর্ম করতে হয়। কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম সাধিত হলে তা আপনা থেকেই কর্মফলের বন্ধন থেকে মানুষকে মুক্ত করতে সাহায্য করে এবং তখন তাকে আর এই জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না। তাই, কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম সর্বদাই কর্মত্যাগের চেয়ে শ্রেয়, কেন না কর্মত্যাগ থেকে পতনের সম্ভাবনা থাকে। কৃষ্ণভক্তিবিহীন বৈরাগ্য অপূর্ণ, সেই কথা শ্রীল রূপ গোস্বামী তাঁর ভক্তিরসামৃতসিন্ধুতে (পূর্ব ২/২৫৬) বলেছেন—

প্রাপঞ্চিকতয়া বুদ্ধ্যা হরিসম্বন্ধিবস্তনঃ।

মুমুক্ষুভিঃ পরিত্যাগো বৈরাগ্যং ফল্গু কথ্যতে ॥

“মুমুক্ষুরা ভগবান সম্বন্ধীয় বস্তুকেও প্রাকৃত জ্ঞানে পরিত্যাগ করে এবং সেই ত্যাগ সম্পূর্ণ হয় না। এই ধরনের বৈরাগ্যকে ‘ফল্গুবৈরাগ্য’ বলা হয়।” আমরা যখন বুঝতে পারি যে, সব কিছুই ভগবানের, আমাদের কিছুই নয়, তাই ‘আমার’ বলে কোন কিছুর উপর আমাদের অধিকার বিস্তার করা উচিত নয়; তখন ত্যাগের সম্পূর্ণতা আসে। মানুষের বোঝা উচিত, বাস্তবিকই কোন কিছুই তার নিজের নয়। তা হলে ত্যাগের প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? যে জানে, সব কিছুই হচ্ছে ভগবানের সম্পত্তি, সে নিত্য বৈরাগ্যযুক্ত। যেহেতু সব কিছুই শ্রীকৃষ্ণের, তাই সবই শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োগ করতে হয়। এই শুদ্ধ কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত কর্ম মায়াবাদী সন্ন্যাসীদের কৃত্রিম বৈরাগ্যের চেয়ে অনেক ভাল।

 

শ্লোক ৫.৩

জ্ঞেয়ঃ স নিত্যসন্ন্যাসী যো ন দ্বেষ্টি ন কাঙ্ক্ষতি। 

নির্দ্বন্দ্বো হি মহাবাহো সুখং বন্ধাৎ প্রমুচ্যতে।।৩।।

 

অনুবাদঃ হে মহাবাহো! যিনি তাঁর কর্মফলের প্রতি দ্বেষ বা আকাঙ্ক্ষা করেন না, তাঁকেই নিত্য সন্ন্যাসী বলে জানবে। এই প্রকার ব্যক্তি দ্বন্দ্বরহিত এবং পরম সুখে কর্মবন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করেন।

তাৎপর্য : যিনি পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনাময়, তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত ত্যাগী, কারণ তিনি কর্মফলের প্রতি বীতরাগ বা অনুরাগ যে কোন দিক থেকেই সম্পূর্ণভাবে নিরাসক্ত। এভাবেই যিনি সব কিছু ত্যাগ করে অনন্য ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা করেন, তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত জ্ঞানী। কারণ, ভগবানের সঙ্গে তাঁর নিত্য সম্পর্কের কথা তিনি জানেন। তিনি খুব ভালভাবেই জানেন যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সম্যক্‌ভাবেই পূর্ণ এবং তিনি হচ্ছেন তাঁর অবিচ্ছেদ্য অংশ মাত্র। এই জ্ঞানই পরম জ্ঞান তা গুণবৈশিষ্ট্য এবং পরিমাণ-তত্ত্ব বিচারেও পরম সত্য। নির্বিশেষবাদীরা যে ভগবানের সঙ্গে এক হয়ে ভগবান হওয়ার বাসনা পোষণ করে তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, কারণ অংশ কখনও পূর্ণের সমান হতে পারে না। গুণগত বৈশিষ্ট্যে মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবে পরিমাণ তত্ত্ব বিচারে ভিন্নতা বিশিষ্ট, এই অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্বজ্ঞানই হচ্ছে প্রকৃত পারমার্থিক তত্ত্বজ্ঞান। তখন মানুষের আকাঙ্ক্ষা বা শোক করবার কিছুই থাকে না। তাই তাঁর মনে আর কোনও দ্বন্দ্বভাব থাকে না, কারণ তিনি যা করেন তা সবই শ্রীকৃষ্ণের জন্য করেন। এভাবেই দ্বন্দ্বভাবের স্তর থেকে মুক্ত হবার ফলে তিনি জড় বন্ধনমুক্ত হন। এমন কি এই জড় জগতে অবস্থানকালেও তিনি বন্ধনমুক্ত থাকেন।

 

শ্লোক ৫.৪

সাংখ্যযোগৌ পৃথগ্ বালাঃ প্রবদন্তি ন পন্ডিতাঃ। 

একমপ্যাস্থিতঃ সম্যগুভয়োর্বিন্দতে ফলম্।।৪।।

 

অনুবাদঃ অল্পজ্ঞ ব্যক্তিরাই কেবল সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগকে পৃথক পৃথক পদ্ধতি বলে প্রকাশ করে, পন্ডিতেরা তা বলেন না। উভয়ের মধ্যে যে কোন একটিকে সুষ্ঠুরূপে আচরণ করলে উভয়ের ফলই লাভ হয়।

তাৎপর্য : সাংখ্য-দর্শনের উদ্দেশ্য হচ্ছে জড় জগতের বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে আত্মার অস্তিত্ব উপলব্ধি করা। জড় জগতের আত্মা হচ্ছেন শ্রীবিষ্ণু বা পরমাত্মা। ভক্তিযোগে যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করা হয়, তখন পরমাত্মারও সেবা সাধিত হয়। একটি প্রক্রিয়া হচ্ছে গাছের মূল খুঁজে বার করা, আর অন্যটি হচ্ছে সেই মূলে জলসিঞ্চন করা। সাংখ্য-দর্শনের যথার্থ শিক্ষার্থী জড় জগতের মূল শ্রীবিষ্ণুকে জানতে পেরে পূর্ণ জ্ঞানযুক্ত হয়ে তাঁর সেবায় প্রবৃত্ত হন। তাই, এই দুটি পদ্ধতিতে কোনও ভেদ নেই, কারণ এদের উভয়েরই উদ্দেশ্য হচ্ছেন শ্রীবিষ্ণু। তাই, পরম লক্ষ্যকে যারা জানে না, তারাই কেবল বলে যে, সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগের উদ্দেশ্য এক নয়। কিন্তু যিনি যথার্থ জ্ঞানী তিনি জানেন, এই সমস্ত বিভিন্ন পদ্ধতির উদ্দেশ্য হচ্ছে এক।

 

শ্লোক ৫.৫

 

যৎ সাংখ্যৈঃ প্রাপ্যতে স্থানং তদ্ যোগৈরপি গম্যতে।

একং সাংখ্যং চ যোগং চ যঃ পশ্যতি স পশ্যতি।।৫।।

 

অনুবাদঃ যিনি জানেন, সাংখ্য-যোগের দ্বারা যে গতি লাভ হয়, কর্মযোগের দ্বারাও সেই গতি প্রাপ্ত হওয়া যায় এবং যিনি সাংখ্যযোগ ও কর্ম-যোগকে এক বলে জানেন, তিনিই যথার্থ তত্ত্বদ্রষ্টা।

তাৎপর্য : দার্শনিক গবেষণার যথার্থ উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনের পরম লক্ষ্য সম্বন্ধে অবগত হওয়া। জীবনের পরম লক্ষ্য হচ্ছে আত্ম-উপলব্ধি, তাই এই দুটি পদ্ধতির মাধ্যমে যেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, তা ভিন্ন নয়। সাংখ্য-দর্শনের মাধ্যমে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, জীব এই জড় জগতের বস্তু নয়, সে হচ্ছে পূর্ণ পরমাত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই, এই জড় জগতে চিন্ময় আত্মার কোনই প্রয়োজন নেই। তার অস্তিত্বের ও কর্মের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবানের সঙ্গে সম্বন্ধ রক্ষা করা। যখন সে কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে কর্ম করে, তখন সে যথার্থই তার স্বরূপে অধিষ্ঠিত হয়। প্রথমোক্ত পদ্ধতি সাংখ্য-যোগের মাধ্যমে মানুষকে জড় বিষয়ের প্রতি নিরাসক্ত হতে হয় এবং কর্মযোগ পদ্ধতি অনুসারে মানুষকে কৃষ্ণভাবনাময় কর্মে আসক্ত হতে হয়। প্রকৃতপক্ষে, এই দুটি পন্থা এক ও অভিন্ন, যদিও আপাতদৃষ্টিতে তাদের একটিকে নিরাসক্তি ও অন্যটিকে আসক্তি বলে মনে হয়। কিন্তু জড় বস্তুর প্রতি অনাসক্তি এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আসক্তি একই তত্ত্ব। এই কথা যিনি বুঝতে পেরেছেন, তিনি প্রকৃত তত্ত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন।

 

শ্লোক ৫.৬

 

সন্ন্যাসস্ত মহাবাহো দুঃখমাপ্তুমযোগতঃ। 

যোগযুক্তো মুনির্ব্রহ্ম ন চিরেণাধিগচ্ছতি।।৬।।

 

অনুবাদঃ হে মহাবাহো! কর্মযোগ ব্যতীত কেবল কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাস দুঃখজনক। কিন্তু যোগযুক্ত মুনি অচিরেই ব্রহ্মকে লাভ করেন।

তাৎপর্য : সন্ন্যাসী দুই প্রকারের—মায়াবাদী ও বৈষ্ণব। মায়াবাদী সন্ন্যাসীরা সাংখ্য দর্শন অধ্যয়ন করেন আর বৈষ্ণব সন্ন্যাসীরা বেদান্ত-সূত্রের যথার্থ ভাষ্য শ্রীমদ্ভাগবত-দর্শন অধ্যয়ন করেন। মায়াবাদী সন্ন্যাসীরাও বেদান্ত-সূত্র অধ্যয়ন করেন, কিন্তু তাঁরা তা অধ্যয়ন করেন শ্রীপাদ শঙ্করাচার্যের শারীরক-ভাষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে। শ্রীমদ্ভাগবত অনুসরণকারী বৈষ্ণবেরা পাঞ্চরাত্রিকী বিধি অনুসারে ভক্তিমার্গে ভগবানের সেবা করেন, তাই বৈষ্ণব সন্ন্যাসীরা চিন্ময় ভগবদ্ভক্তিতে নানাবিধ কর্তব্য পালন করেন। বৈষ্ণব সন্ন্যাসীদের জড় জাগতিক কর্তব্যকর্ম সাধন করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই, কিন্তু তবুও ভগবানের সেবা করার জন্য তাঁরা নানা রকম কার্যকলাপের অনুষ্ঠান করেন। কিন্তু সাংখ্য ও বেদান্ত-দর্শন অধ্যয়নকারী এবং মনোধর্ম-পরায়ণ মায়াবাদী সন্ন্যাসীরা ভগবদ্ভক্তি আস্বাদন করতে পারেন না। যেহেতু তাঁদের অধ্যয়ন অত্যন্ত শ্রমদায়ক, তাই ব্রহ্ম বিষয়ক মনোধর্মের প্রভাবে বিভ্রান্ত ও ক্লান্ত হয়ে তাঁরা কখনও কখনও শ্রীমদ্ভাগবতের শরণাপন্ন হন। কিন্তু শ্রীমদ্ভাগবতের যথার্থ মর্ম উপলব্ধি করতে না পারার ফলে তাও ক্লেশদায়ক হয়ে ওঠে। কৃত্রিম উপায়ে মায়াবাদীদের শুষ্ক জ্ঞানালোচনা এবং জল্পনা-কল্পনা-প্রসূত অনুমান সবই নিরর্থক। ভগবদ্ভক্তি পরায়ণ বৈষ্ণব সন্ন্যাসীরা তাঁদের দিব্য কর্তব্য সম্পাদন করে অপ্রাকৃত আনন্দ লাভ করেন এবং এই জগতের কাজ সমাপ্ত হলে অন্তিমে তাঁরা যে চিন্ময় ভগবৎ-ধামে ফিরে যাবেন, সেই সম্বন্ধে তাঁরা নিশ্চিত। মায়াবাদী সন্ন্যাসীরা কখনও কখনও আত্ম-উপলব্ধির মার্গ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে সমাজসেবা, পরোপকার আদি প্রাকৃত কার্যকলাপে পুনরায় প্রবৃত্ত হন। এগুলি সবই জড়-জাগতিক কর্মবন্ধন। এভাবেই আমরা দেখতে পাই, যাঁরা ভক্তি সহকারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করে চলেছেন, তাঁরা ব্রহ্মজ্ঞান অনুসন্ধানী সন্ন্যাসীদের থেকে অনেক উচ্চ মার্গে রয়েছেন। এই সমস্ত ব্রহ্মবাদী জ্ঞানীরাও বহু জন্মের পরে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করেন।

 

শ্লোক ৫.৭

 

যোগযুক্তো বিশুদ্ধাত্মা বিজিতাত্মা জিতেন্দ্রিয়ঃ। 

সর্বভুতাত্মভূতাত্মা কুর্বন্নপি ন লিপ্যতে।।৭।।

 

অনুবাদঃ যোগযুক্ত জ্ঞানী বিশুদ্ধ বুদ্ধি, বিশুদ্ধ চিত্ত ‍ও জিতেন্দ্রিয় এবং তিনি সমস্ত জীবের অনুরাগভাজন হয়ে সমস্ত কর্ম করেও তাতে লিপ্ত হন না।

তাৎপর্য : কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে যিনি মুক্তির পথে এগিয়ে চলেছেন, তিনি প্রতিটি জীবেরই অত্যন্ত প্রিয় এবং প্রতিটি জীবই তাঁর প্রিয়। কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করার ফলেই এটি সম্ভব। এই প্রকার ব্যক্তি কোন কিছুকেই শ্রীকৃষ্ণের থেকে ভিন্নরূপে দেখেন না। একটি গাছের ডালপালা যেমন গাছটি থেকে ভিন্ন নয়, তেমনই তিনিও দেখেন যে, প্রতিটি জীবও ভগবানের থেকে অভিন্ন। তিনি জানেন, গাছের গোড়ায় জল দিলে যেমন সমস্ত গাছটিকে জল দেওয়া হয় অথবা উদরকে খাদ্য দিলে যেমন সমস্ত দেহকেই খাদ্য দেওয়া হয়, তেমনই ভগবানের সেবা করার ফলে সমস্ত জীব-জগতের সেবা করা হয়। এভাবেই শ্রীকৃষ্ণের দাসত্ব করার মাধ্যমে তিনি সকলেরই দাসত্ব করে চলেছেন। তাই তিনি সকলেরই প্রিয় এবং সকলেই তাঁর অতি প্রিয়। যেহেতু তাঁর কার্যকলাপে সকলেই সন্তুষ্ট, তাই তাঁর চেতনা পবিত্র ও নির্মল। যেহেতু তাঁর চেতনা পবিত্র ও নির্মল, তাই তাঁর মন সম্পূর্ণরূপে সংযত। আর তাঁর চিত্ত সংযত হবার ফলে তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিও সংযত। তাঁর মন সর্বদাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিবদ্ধ, তাই তিনি কখনই ভগবানকে বিস্মৃত হন না। সুতরাং, তাঁর ইন্দ্রিয়গুলি কৃষ্ণসেবা ব্যতীত জড় কার্যকলাপে নিযুক্ত হবার কোন সম্ভাবনা থাকে না। তিনি কৃষ্ণকথা ছাড়া আর কিছুই শোনেন না, তিনি কৃষ্ণপ্রসাদ ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করেন না এবং তিনি ভগবানের মন্দির ছাড়া অন্য কোথাও যেতে চান না। তাই, তাঁর ইন্দ্রিয়গুলি সর্বতোভাবে সংযত। এভাবেই যাঁর ইন্দ্রিয় সংযত হয়েছে, তিনি কারও ক্ষতিসাধন করেন না। এখানে কেউ প্রশ্ন করতে পারে, “তা হলে অর্জুন কেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অন্যদের আঘাত দিলেন? তিনি কি ভগবৎ-চেতনাময় ছিলেন না?” সেই প্রশ্নের উত্তর ভগবদ্‌গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেওয়া হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে অর্জুনকে অপরাধী বলে মনে হতে পারে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত ব্যক্তিরা স্বতন্ত্রভাবে চিরকাল বেঁচে থাকবে, কেন না আত্মাকে কখনই হত্যা করা যায় না। তাই, আত্মার পরিপ্রেক্ষিতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে কেউই নিহত হয়নি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে কেবল তাদের পোশাকের পরিবর্তন হয়েছিল। তাই, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুন সত্যি সত্যিই যুদ্ধ করছিলেন না। সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদেশ পালন করছিলেন। এই ধরনের ভগবদ্ভক্ত কোন অবস্থাতেই কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হন না।

 

 

শ্লোক ৫.৮ – ৫.৯

 

নৈব কিঞ্চিৎ করোমীতি যুক্তো মন্যেত তত্ত্ববিৎ। 

পশ্যন্ শৃণ্বন্ স্পৃশন্ জিঘ্রন্নশ্নন্ গচ্ছন্ স্বপন্ শ্বসন্।।৮।।

 

প্রলপন্ বিসৃজন্ গৃহ্নন্নুন্মিষন্নিমিষন্নপি।

ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেষু বর্তন্ত ইতি ধারয়ন্।।৯।।

 

অনুবাদঃ চিন্ময় চেতনায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তি দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, ঘ্রাণ, ভোজন, গমন, নিদ্রা ও নিঃশ্বাস আদি ক্রিয়া করেও সর্বদা জানেন যে, প্রকৃতপক্ষে তিনি কিছুই করছেন না। কারণ প্রলাপ, ত্যাগ, গ্রহণ, চক্ষুর উন্মেষ ও নিমেষ করার সময় তিনি সব সময় জানেন যে, জড় ইন্দ্রিয়গুলিই কেবল ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে প্রবৃত্ত হয়েছে, তিনি নিজে কিছুই করছেন না।

তাৎপর্য : যিনি কৃষ্ণভাবনাময় তাঁর অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে পবিত্র, তাই তিনি কর্তা, কর্ম, অধিষ্ঠান, প্রচেষ্টা ও দৈব—এই পাঁচটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণের দ্বারা সাধিত কর্মের সঙ্গে কোনভাবে সংযুক্ত নন। তার কারণ হচ্ছে, তিনি সর্বক্ষণ কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে প্রেমভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা করছেন। আপাতদৃষ্টিতে যদিও মনে হয়, তিনি তাঁর দেহ ও ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে তাঁর কর্ম করছেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি তাঁর যথার্থ স্থিতি সম্বন্ধে সচেতন, যা হচ্ছে পারমার্থিক কার্যকলাপ। জড় চেতনায় ইন্দ্রিয়গুলি ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তি সাধনের চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে, কিন্তু কৃষ্ণভাবনায় ইন্দ্রিয়গুলি শ্রীকৃষ্ণের ইন্দ্রিয়ের সন্তুষ্টি বিধান করার সেবায় প্রবৃত্ত হয়। তাই, কৃষ্ণভক্তকে আপাতদৃষ্টিতে ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপে নিয়োজিত বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি সর্বদাই মুক্ত। দর্শন ও শ্রবণাদি হচ্ছে ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপ এবং এগুলির উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্ঞান আহরণ করা, সেই রকম গমন, প্রলাপন ও মলত্যাগাদিও ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপ এবং এগুলির উদ্দেশ্য হচ্ছে কর্ম করা। কৃষ্ণভক্ত কোন অবস্থাতেই ইন্দ্রিয়ের এই সমস্ত কর্মের দ্বারা প্রভাবিত হন না। ভগবানের সেবা ছাড়া তিনি আর কোন কর্মই করতে পারেন না। কারণ তিনি জানেন, তিনি হচ্ছেন ভগবানের নিত্যদাস।

 

 

শ্লোক ৫.১০

 

ব্রহ্মণ্যাধায় কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা করোতি যঃ। 

লিপ্যতে ন স পাপেন পদ্মপত্রমিবাম্ভসা।।১০।।

 

অনুবাদঃ যিনি সমস্ত কর্মের ফল পরমেশ্বর ভগবানকে অর্পণ করে অনাসক্ত হয়ে কর্ম করেন, কোন পাপ তাঁকে কখনও স্পর্শ করতে পারে না, ঠিক যেমন জল পদ্মপাতাকে স্পর্শ করতে পারে না।

তাৎপর্য : এখানে ব্রহ্মণি শব্দটির অর্থ হচ্ছে কৃষ্ণভাবনায়। জড় জগৎ হচ্ছে প্রকৃতির তিনটি গুণের অভিব্যক্তি—তাকে বলা হয় ‘প্রধান’। বৈদিক মন্ত্র—সর্বং হোত্দ ব্রহ্ম (মাতৃকা উপনিষদ ২), তস্মাদেতদ্ ব্রহ্ম নামরূপমন্নং চ জায়তে (মুণ্ডক উপনিষদ ১/১/৯) এবং ভগবদ্‌গীতার শ্লোক মম যোনির্মহদ্ ব্রহ্ম (গীতা ১৪/৩) বর্ণনা করে যে, এই জগতে সব কিছুই ব্রহ্মের প্রকাশ। কিছুই ব্রহ্মের প্রকাশ। এই প্রকাশ যদিও ভিন্নরূপে হয়, কিন্তু তা মূল কারণ থেকে অভিন্ন। ঈশোপনিষদে বলা হয়েছে, সব কিছুই পরমব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। তাই, তিনি হচ্ছেন সব কিছুর অধীশ্বর। যিনি এই সত্যকে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং সেই উপলব্ধির ফলে সব কিছুই ভগবানের সেবায় নিয়োজিত করেছেন, তিনি কোন অবস্থাতেই পাপ-পুণ্য কর্মফলের বন্ধনের দ্বারা আবদ্ধ হন না। পাপ অথবা পুণ্য কোন কর্মফলই তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি জানেন, কোন বিশেষ কর্ম সাধন করার জন্যই ভগবান তাঁকে তাঁর জড় শরীরটি দান করেছেন, তাই ভগবানের সেবাতেই তিনি সেটি নিয়োজিত করেন। তখন তা সব রকম কলুষ থেকে মুক্ত, ঠিক যেমন জলে থাকলেও পদ্মপাতাকে জল কখনও স্পর্শ করতে পারে না। গীতাতেও (৩/৩০) ভগবান বলেছেন, ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সংন্যস্য—”সমস্ত কর্ম আমার (শ্রীকৃষ্ণের) কাছে সমর্পণ কর।” সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যে জীব কৃষ্ণভাবনাশূন্য, তার দেহ ও ইন্দ্রিয়কে তার স্বরূপ মনে করে সে কর্ম করে, কিন্তু যিনি কৃষ্ণভাবনাময় তিনি জানেন, তাঁর দেহটি শ্রীকৃষ্ণের সম্পত্তি, তাই তিনি তা সর্বতোভাবে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত করেন।

 

 

শ্লোক ৫.১১

 

কায়েন মনসা বুদ্ধ্যা কেবলৈরিন্দ্রিয়ৈরপি।

যোগিনঃ কর্ম কুর্বন্তি সঙ্গং ত্যক্ত্বাত্মশুদ্ধয়ে।।১১।।

 

অনুবাদঃ আত্মশুদ্ধির জন্য যোগীরা কর্মফলের আসক্তি ত্যাগ করে দেহ, মন, বুদ্ধি, এমন কি ইন্দ্রিয়ের দ্বারাও কর্ম করেন।

তাৎপর্য : কৃষ্ণভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করার জন্য শরীর, মন, বুদ্ধি অথবা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যে কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তা জীবকে জড় জগতের কলুষ থেকে মুক্ত করে। কৃষ্ণভাবনাময় কর্মের কোন জড় প্রতিক্রিয়া হয় না। তাই, কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম করার ফলে অনায়াসে সদাচার সাধিত হয়। ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থে (পূর্ব ২/১৮৭) শ্রীল রূপ গোস্বামী তার বর্ণনা করে বলেছেন—

ঈহা যস্য হরের্দাস্যে কর্মণা মনসা গিরা ।
নিখিলাস্বপ্যবস্থাসু জীবন্মুক্তঃ স উচ্যতে ॥

“যিনি শরীর, মন, বুদ্ধি ও বাণী দিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করেন, তিনি এই জড় জগতে অবস্থান করলেও, এমন কি তথাকথিত জড়-জাগতিক কর্মে ব্যাপৃত থাকলেও তিনি মুক্ত পুরুষ।” তাঁর কোন রকম মিথ্যা অহঙ্কার নেই এবং তিনি কখনই মনে করেন না তাঁর দেহটিই হচ্ছে তাঁর স্বরূপ, অথবা তিনি তাঁর দেহটির মালিক। তিনি জানেন যে, তাঁর স্বরূপ তাঁর দেহটি নয় এবং তাঁর দেহটি তার সম্পত্তি নয়। তিনি শ্রীকৃষ্ণের এবং তাঁর দেহটিও শ্রীকৃষ্ণের। যখন তিনি তাঁর দেহ, মন, বুদ্ধি, বাণী, জীবন, ধন আদি সবই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিবেদন করেন, তৎক্ষণাৎ তিনি সর্বতোভাবে কৃষ্ণগত প্ৰাণ। যে মিথ্যা অহঙ্কারের প্রভাবে মানুষ মনে করে, তার দেহটি হচ্ছে তার স্বরূপ, কৃষ্ণভাবনায় তন্ময় থাকার ফলে তিনি সেই অহঙ্কার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হন। এটিই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃতের পূর্ণ বিকশিত অবস্থা।

 

 

শ্লোক ৫.১২

 

যুক্তঃ কর্মফলং ত্যক্ত্বা শান্তিমাপ্নোতি নৈষ্ঠিকীম্।

অযুক্তঃ কামকারেণ ফলে সক্তো নিবধ্যতে।।১২।।

 

অনুবাদঃ যোগী কর্মফল ত্যাগ করে নৈষ্ঠিকী শান্তি লাভ করেন; কিন্তু সকাম কর্মী কর্মফলের প্রতি আসক্ত হয়ে কর্ম করার ফলে কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

তাৎপর্য : কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত ও দেহাত্মবুদ্ধিসম্পন্ন বৈষয়িক মানুষের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে যে, কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আসক্ত এবং দেহাত্ম-বুদ্ধিসম্পন্ন বিষয়ী তার কর্মফলের প্রতি আসক্ত। যে মানুষ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আসক্ত এবং তাঁর প্রীতি উৎপাদনের জন্য সমস্ত কর্ম করেন, তিনি অবধারিতভাবে মুক্ত পুরুষ; কারণ, তিনি কখনই কর্মফলের আশায় উৎকণ্ঠিত হন না। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে, দ্বৈত ধারণাযুক্ত হয়ে, অর্থাৎ পরতত্ত্ব সম্বন্ধে অবগত না হয়ে কর্ম করার ফলে কর্মফলের প্রতি উৎকণ্ঠার উদয় হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরতত্ত্ব পরমেশ্বর। কৃষ্ণভাবনায় তাই দ্বৈতভাব নেই। বিশ্বচরাচরের যা কিছু আছে, তা সবই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শক্তিজাত। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম মঙ্গলময়। তাই, কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে যে কার্যকলাপ সাধিত হয়, তা পারমার্থিক কর্ম; তা অপ্রাকৃত এবং জড় জগতের কলুষের দ্বারা প্রভাবিত হয় না। তাই কৃষ্ণভক্ত শান্ত। কিন্তু যারা সর্বক্ষণ ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য লাভ-ক্ষতির হিসাব করছে, তারা কখনই শান্তি পেতে পারে না। এটিই কৃষ্ণভাবনামৃতের রহস্য—শ্রীকৃষ্ণের সম্বন্ধ-রহিত কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই এবং এই সত্য উপলব্ধিই পরম শান্তি ও অভয় দান করে।

 

 

শ্লোক ৫.১৩

 

সর্বকর্মাণি মনসা সংন্যস্যাস্তে সুখং বশী। 

নবদ্বারে পুরে দেহী নৈব কুর্বন্ন কারয়ন্।।১৩।।

 

অনুবাদঃ বাহ্যে সমস্ত কার্য করেও মনের দ্বারা সমস্ত কর্ম ত্যাগ করে জীব নবদ্বার-বিশিষ্ট দেহরুপ গৃহে পরম সুখে বাস করতে থাকেন; তিনি নিজে কিছুই করেন না এবং কাউকে দিয়েও কিছু করান না।

তাৎপর্য : দেহধারী জীবাত্মা নয়টি দ্বারবিশিষ্ট একটি নগরে বাস করে। দেহরূপী নগরটির কার্য প্রকৃতির বিশেষ গুণের প্রভাবে আপনা থেকেই সাধিত হয়। জীবাত্মা যদিও স্বেচ্ছায় এই দেহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে, কিন্তু তবুও যদি সে ইচ্ছা করে, তবে এর থেকে মুক্ত হতে পারে। তার দিব্য স্বরূপের কথা ভুলে যাওয়ার ফলে সে তার জড় দেহটিকে তার স্বরূপ বলে মনে করে নানা রকম দুঃখকষ্ট ভোগ করে। কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রভাবে তার যথার্থ স্বরূপকে পুনরুজ্জীবিত করার ফলে সে তার দেহবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে। জীব যখন কৃষ্ণভক্তে পরিণত হয়, তখন তাঁর দেহগত সমস্ত কর্ম থেকে সে মুক্ত হয়। এই ধরনের নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করে যখন তার মনোবৃত্তির পরিবর্তন হয়, তখন সে মহানন্দে এই নবদ্বার-বিশিষ্ট নগরীতে বাস করে। এই নয়টি দ্বারবিশিষ্ট নগরীর বর্ণনা করে। বলা হয়েছে

নবদ্বারে পুরে দেহী হংসো লেলায়তে বহিঃ ।

বশী সর্বস্য লোকস্য স্থাবরসা চরস্য চ ॥

“পরমেশ্বর ভগবান যিনি জীবাত্মার দেহে বাস করছেন, তিনিই হচ্ছেন বিশ্বচরাচরের অধীশ্বর। দেহের নয়টি দ্বার হচ্ছে—দুটি চোখ, দুটি নাক, দুটি কান, মুখ, উপস্থ ও পায়ু। বন্ধ অবস্থায় জীব তার দেহকে তার স্বরূপ বলে পরিচয় দেয়, কিন্তু যখন সে তার অন্তরে অধিষ্ঠিত পরমাত্মার সঙ্গে তার পরিচয় খুঁজে পায়, তখন দেহে থাকলেও সে পরমাত্মার মতোই মুক্ত হয়।” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/১৮)

সেই জন্য, কৃষ্ণভাবনাময় মানুষ জড় দেহের বাহ্য ও আভ্যন্তরীণ এই দুই প্রকার কর্ম থেকেই মুক্ত।

 

 

শ্লোক ৫.১৪

 

ন কর্তৃত্বং ন কর্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভুঃ। 

ন কর্মফলসংযোগং স্বভাবস্তু প্রবর্ততে।।১৪।।

 

অনুবাদঃ দেহরূপ নগরীর প্রভু জীব কর্ম সৃষ্টি করে না, সে কাউকে দিয়ে কিছু করায় না এবং সে কর্মের ফলও সৃষ্টি করে না। এই সবই হয় জড়া প্রকৃতির গুণের প্রভাবে।

তাৎপর্য : ভগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায় অনুসারে, জীব ভগবানের মতোই পরা প্রকৃতি সম্ভূত। এই পরা প্রকৃতি ভগবানের অন্য প্রকৃতি অপরা থেকে ভিন্ন। কোন না কোনভাবে এই উৎকৃষ্ট পরা প্রকৃতির অংশ জীবাত্মা অনাদিকাল ধরে অপরা প্রকৃতির সংসর্গে আছে। জীবাত্মা তার কর্ম অনুসারে ক্ষণস্থায়ী এক একটি দেহ প্রাপ্ত হয়ে সেই দেহে বাস করে। এভাবেই দেহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সে বদ্ধদশা প্রাপ্ত হয়। সে তখন অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে সেই জড় দেহটিকেই তার প্রকৃত স্বরূপ বলে মনে করতে শুরু করে এবং সেই দেহগত কর্মের ফল ভোগ করতে থাকে। জন্ম-জন্মান্তরের সঞ্চিত অজ্ঞতার পরিণামে তাকে এই দেহজাত দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয়। কিন্তু যে মুহূর্তে সে দেহাত্মবুদ্ধি পরিত্যাগ করে এবং বুঝতে শেখে যে, সে তার দেহ নয়, সেই মুহূর্তেই সে তার দেহের বন্ধন থেকে—তার কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। যতক্ষণ সেই দেহরূপ নগরীতে সে বাস করে, ততক্ষণ সে মনে করে যে, সে-ই হচ্ছে তার দেহটির অধীশ্বর। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে তার দেহের অধীশ্বরও নয় এবং তার কর্মফলের কর্তাও নয়। সে হচ্ছে ভবসমুদ্রে নিমজ্জমান, জীবন-সংগ্রামে বিধ্বস্ত, অণুসদৃশ জীব। ভব-সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গগুলি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করবার কোন শক্তিই তার নেই। চিন্ময় কৃষ্ণভাবনামৃতরূপী তরণীর আশ্রয় গ্রহণ করলে সে এই ভবসমুদ্র পার হতে পারে—সমস্ত দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে পারে।

 

 

শ্লোক ৫.১৫

 

নাদত্তে কস্যচিৎ পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভুঃ। 

অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ।।১৫।।

 

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান জীবের পাপ অথবা পুণ্য কিছুই গ্রহণ করেন না। অজ্ঞানের দ্বারা প্রকৃত জ্ঞান আবৃত হওয়ার ফলে জীবসমূহ মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

তাৎপর্য : সংস্কৃত বিভু শব্দটির অর্থ হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবান, যিনি অনন্ত জ্ঞান, শ্রী, যশ, বীর্য, ঐশ্বর্য ও বৈরাগ্যে পরিপূর্ণ। তিনি সর্বদাই আত্মতৃপ্ত। পাপ ও পুণ্য তাঁকে কখনই স্পর্শ করতে পারে না। তিনি কোন জীবের জন্যই কোন বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি করেন না। কিন্তু অজ্ঞানতার দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে জীব বিভিন্ন পরিস্থিতির কামনা করে এবং তার ফলে তার কর্ম ও কর্মফলের প্রবাহ শুরু হয়। জীব ভগবানের পরা প্রকৃতিজাত, তাই তার স্বরূপে সে পূর্ণজ্ঞানে অধিষ্ঠিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার শক্তি সীমিত হওয়ার ফলে সে অজ্ঞানের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ভগবান সর্ব শক্তিমান, কিন্তু জীব তা নয়। ভগবান বিভু, কিন্তু জীব অণুসদৃশ। জীবাত্মার স্বাধীনভাবে ইচ্ছা করার স্বাতন্ত্র্য আছে, কিন্তু কেবলমাত্র সর্ব শক্তিমান ভগবানের দ্বারাই তার সেই ইচ্ছা পরিপূর্ণ হয়। জীব যখন তার কামনা-বাসনার দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তখন সেই কামনা-বাসনাগুলিকে পূর্ণ করতে ভগবান তাকে অনুমোদন করেন। কিন্তু তাদের বিশেষ বাসনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কর্ম ও কর্মফলের জন্য ভগবান কোন অবস্থাতেই দায়ী নন। বিভ্রান্ত হয়ে জীব তাই তার জড় দেহটিকেই তার স্বরূপ বলে মনে করে এবং অনিত্য সুখ ও দুঃখ ভোগ করতে থাকে। পরমাত্মারূপে ভগবান প্রতিটি জীবের নিত্য সহচর। ফুলের কাছে গেলে যেমন তার গন্ধ পাওয়া যায়, তেমনই আমাদের খুব কাছে আছেন বলে ভগবান আমাদের অন্তরের সমস্ত কামনা-বাসনাগুলির কথা জানেন। কামনা-বাসনাগুলি হচ্ছে জীবের বন্ধনের সূক্ষ্ম রূপ। জীব যেভাবে কামনা করে, ভগবান ঠিক সেভাবেই তার যথাযোগ্য পূর্তি করেন। তাই, ইচ্ছা পূরণ করার কোন শক্তিই জীবের নেই, কিন্তু ভগবান হচ্ছেন সর্ব শক্তিমান বাঞ্ছাকল্পতরু। তিনি সর্বতোভাবে নিরপেক্ষ, তাই তিনি অণু স্বাতন্ত্র্য-বিশিষ্ট জীবের ইচ্ছায় হস্তক্ষেপ করেন না। কিন্তু কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়ার ইচ্ছা করেন, তখন ভগবান তাঁর প্রতি বিশেষভাবে যত্নপরায়ণ হন এবং তাঁকে এমনভাবে উৎসাহিত করেন, যার ফলে তিনি তাঁকে পেয়ে শাশ্বত সুখ আস্বাদন করতে পারেন।

বৈদিক মন্ত্রে বলা হয়েছে, এষ উ হোব সাধু কর্ম কারয়তি তং যমেভ্যো লোকেভা উন্নিনীযতে। এষ উ এবাসাধু কর্ম কারয়তি যমধো নিনীষতে—“ভগবান জীবকে সৎকর্মে প্রবৃত্ত করেন যাতে তার উন্নতি সাধন হয়। তিনি জীবকে অসৎ কর্মে প্রবৃত্ত করেন যাতে সে নরকগামী হয়।” (কৌষীতকী উপনিষদ ৩/৮)

অজ্ঞো জন্তুরনীশোহয়মাত্মনঃ সুখদুঃখয়োঃ ।
ঈশ্বরপ্রেরিতো গচ্ছেৎ স্বর্গং বাশ্বভ্রমেব চ॥

“সুখ-দুঃখের উপর জীব সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। বায়ু যেমন মেঘকে চালিত করে, তেমনই ভগবানের ইচ্ছার ফলে জীব স্বর্গে অথবা নরকে গমন করে।”

তাই, দেহধারী জীব অনন্তকাল ধরে কৃষ্ণবিমুখ হয়ে থাকার বাসনা করে এবং সেটিই তার মোহাচ্ছন্ন হবার কারণ। তাই সে সচ্চিদানন্দময় হলেও, যেহেতু তার সত্তা ক্ষুদ্র ও বদ্ধ, তাই সে তার স্বরূপ বিস্মৃত হয়— সে ভুলে যায় যে, সে ভগবানের নিত্যদাস এবং এভাবেই সে অবিদ্যার দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে। অজ্ঞানের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ার ফলে সে বলে যে, তার ভব-বন্ধনের জন্য ভগবানই দায়ী। এই কথার বিরোধিতা করে বেদান্ত সূত্রে (২/১/৩৪) বলা হয়েছে, বৈষম্যনৈঘূণ্যে ন সাপেক্ষত্বাৎ তথা হি দর্শয়তি—”ভগবান কাউকে ঘৃণা করেন না অথবা ভালবাসেন না, যদিও সেই রকম মনে হয়।”

 

 

শ্লোক ৫.১৬

 

জ্ঞানেন তু তদজ্ঞানং যেষাং নাশিতমাত্মনঃ। 

তেষামাদিত্যবজজ্ঞানং প্রকাশয়তি তৎ পরম্।।১৬।।

 

অনুবাদঃ জ্ঞানের প্রভাবে যাঁদের অজ্ঞান বিনষ্ট হয়েছে, তাঁদের সেই জ্ঞান অপ্রাকৃত পরমতত্ত্বকে প্রকাশ করে, ঠিক যেমন দিনমানে সূর্যের উদয়ে সব কিছু প্রকাশিত হয়।

তাৎপর্য:  যারা শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে গেছে তারা অবশ্যই মোহাচ্ছন্ন, কিন্তু যাঁরা কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত তাঁরা কখনই মোহাচ্ছন্ন হন না। ভগবদ্‌গীতাতে বলা হয়েছে—সর্বং জ্ঞানপ্লবেন, জ্ঞানাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি এবং ন হি জ্ঞানেন সদৃশম্। জ্ঞান সর্বদাই অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন। এই জ্ঞানের স্বরূপ কি? শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়ার ফলেই পূর্ণ জ্ঞান লাভ করা যায়, যে কথা সপ্তম অধ্যায়ের ঊনবিংশতি শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে—বহুনাং জন্মনামস্তে জ্ঞানবান্মাং প্রপদ্যতে। বহু বহু জন্মের পরে জ্ঞানী যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হন, অথবা কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হন, তখন তাঁর কাছে সমস্ত তত্ত্ব প্রকাশিত হয়, যেমন দিনের বেলায় সূর্যের আলোতে সব কিছু প্রকাশিত হয়। জীব নানাভাবে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ধৃষ্টতাপূর্বক সে যখন নিজেকে ভগবান বলে মনে করে, তখন সে মায়ার অন্তিম ফাঁদে পতিত হয়। জীব যদি ভগবান হয়, তা হলে সে মায়ার দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয় কিভাবে? যদি তা সম্ভব হয়, তা হলে বুঝতে হবে যে, অজ্ঞান বা শয়তান ভগবানের চেয়েও বেশি ক্ষমতাশালী। যথার্থ জ্ঞান কৃষ্ণভাবনাময় মহাপুরুষের কাছ থেকেই লাভ করা যায়। তাই, এই রকম যথার্থ সদগুরুর অনুসন্ধান করে তাঁর কাছে কৃষ্ণভাবনামৃতের শিক্ষা হৃদয়ঙ্গম করতে হয়। সূর্য যেমন অন্ধকার দূর করে, কৃষ্ণভাবনামৃত তেমন সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞানতা দূর করতে পারে। কেউ জ্ঞান লাভের মাধ্যমে উপলব্ধি করতে পারে যে, সে তার দেহ নয়, সে তার জড় দেহের অতীত, তবুও সে আত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে না। কিন্তু সে যদি কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত সদগুরুর শরণাগত হতে যত্নবান হয়, তা হলে সে সব কিছুই ভালভাবে জানতে পারে। কেবলমাত্র ভগবানের প্রতিনিধির সান্নিধ্য লাভ হলেই ভগবান ও ভগবানের সঙ্গে আমাদের নিত্য সম্পর্কের কথা জানা যায়। ভগবানের প্রতিনিধি কখনও দাবি করেন না যে, তিনি ভগবান, কিন্তু তাঁকে ভগবানের মতোই সম্মান করা হয়, কারণ তিনি ভগবৎ-তত্ত্ব জানেন। ভগবান ও জীবের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, তা জানা উচিত। ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের দ্বাদশ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই জন্য বলেছেন, প্রত্যেক জীব স্বতন্ত্র এবং ভগবানও স্বতন্ত্র। অতীতে তাদের সকলেরই পৃথক স্বরূপ ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতে মুক্তির পরেও থাকবে। রাত্রির অন্ধকারে যেমন সব কিছুই এক বলে মনে হয়, কিন্তু দিনের বেলায় সূর্যোদয় হলে প্রতিটি বস্তু তাদের যথার্থ রূপে প্রতিভাত হয়। জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হলে তেমনই সব কিছুর স্বরূপ উপলব্ধি হয়। পারমার্থিক জীবনে স্বতন্ত্রভাবে স্বরূপ উপলব্ধিই হচ্ছে যথার্থ জ্ঞান।

 

 

শ্লোক ৫.১৭

 

তদ্বুদ্ধয়স্তদাত্মানস্তন্নিষ্ঠাস্তৎপরায়ণাঃ। 

গচ্ছন্ত্যপুনরাবৃত্তিং জ্ঞাননির্ধূতকল্মষাঃ।।১৭।।

 

অনুবাদঃ যাঁর বুদ্ধি ভগবানের প্রতি উন্মুখ হয়েছে, মন ভগবানের চিন্তায় একাগ্র হয়েছে, নিষ্ঠা ভগবানে দৃঢ় হয়েছে এবং যিনি ভগবানকে তাঁর একমাত্র আশ্রয় বলে গ্রহণ করেছেন, জ্ঞানের দ্বারা তাঁর সমস্ত কলুষ সম্পূর্ণরূপে বিধৌত হয়েছে এবং তিনি জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছেন ।

তাৎপর্য : ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরতত্ত্ব। সম্পূর্ণ ভগবদ্গীতা শ্রীকৃষ্ণের ভগবত্তার কথা ঘোষণা করছে। সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রেও সেই একই কথা বলা হয়েছে। তত্ত্ববিদেরা পরতত্ত্বকে ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবানরূপে জানেন। ভগবান হচ্ছেন পরতত্ত্বের শেষ কথা। তাঁর ঊর্ধ্বে আর কিছু নেই। ভগবানও বলছেন, মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয় – “হে অর্জুন! আমার থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউই নয়।” নির্বিশেষ ব্রহ্ম সম্বন্ধেও শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ব্রহ্মণো হি প্রতিষ্ঠাহম্—আমিই নির্বিশেষ ব্রহ্মের আশ্রয়। সুতরাং, সর্বতোভাবে শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরাৎপর তত্ত্ব। যাঁর মন, বুদ্ধি, নিষ্ঠা ও আশ্রয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণতেই নিত্য কেন্দ্রীভূত, অর্থাৎ যিনি পূর্ণরূপে শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত, তিনি নিঃসন্দেহে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ণজ্ঞানে পরম সত্যকে উপলব্ধি করেন। কৃষ্ণভক্ত পূর্ণরূপে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অচিন্ত্য ভেদাভেদ-তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারেন। এই দিব্যজ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে তিনি অবিচলিতভাবে মুক্তির পথে এগিয়ে চলেন।

 

 

শ্লোক ৫.৩

 

বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি।

শুনি চৈব শ্বপাকে চ পন্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ।।১৮।।

 

অনুবাদঃ জ্ঞানবান পন্ডিতেরা বিদ্যা-বিনয়সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, গাভী, হস্তী, কুকুর ও চন্ডাল সকলের প্রতি সমদর্শী হন।

তাৎপর্য: কৃষ্ণভক্ত কখনই জাতি অথবা কুলের মধ্যে পার্থক্য বিচার করেন না। সমাজ ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একজন ব্রাহ্মণ একজন চণ্ডালের থেকে আলাদা হতে পারে, অথবা একটি কুকুর, একটি গরু, একটি হাতি জাতিগতভাবে ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু ভগবৎ তত্ত্বজ্ঞানীর দৃষ্টিতে এই দেহজাত ভেদগুলি নিরর্থক। কারণ, সকলেই ভগবানের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। তিনি দেখেন, সমস্ত জীবের অন্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর আংশিক প্রকাশ পরমাত্মারূপে বিরাজ করছেন। পরতত্ত্বের এই উপলব্ধি হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞান। জাতি বর্ণ নির্বিশেষে ভগবান সকলকেই সমানভাবে কৃপা করেন, কারণ তিনি প্রতিটি জীবকেই তাঁর সখা বলে মনে করেন এবং জীবের অবস্থা নির্বিশেষে পরমাত্মা রূপে সর্বদাই তার সঙ্গে বিরাজ করেন। চণ্ডাল এবং ব্রাহ্মণের দেহ ভিন্ন হলেও ভগবান তাদের উভয়ের সঙ্গেই পরমাত্মা রূপে বিরাজমান। জড়া প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন গুণের প্রভাবে জড় দেহের সৃষ্টি হয়। কিন্তু দেহমধ্যস্থ জীবাত্মা ও পরমাত্মা একই চিন্ময় গুণসম্পন্ন। গুণগতভাবে এক হলেও জীবাত্মা এবং পরমাত্মার আয়তন ভিন্ন, কারণ জীবাত্মা কেবল একটি দেহে থাকতে পারে, কিন্তু পরমাত্মা প্রত্যেক দেহে বিরাজ করেন। কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত কৃষ্ণভক্ত এই তত্ত্ব সম্পূর্ণভাবে অবগত। তাই, তিনি প্রকৃত জ্ঞানী এবং সমদৃষ্টিসম্পন্ন। জীবাত্মা ও পরমাত্মার সাদৃশ্য হচ্ছে যে, উভয়েই সচ্চিদানন্দময়; আর তাদের বৈসাদৃশ্য হচ্ছে যে, জীবাত্মা অণুচৈতন্য আর পরমাত্মা সর্বদেহে বিরাজমান বিভুচৈতন্য।

 

 

শ্লোক ৫.৩

 

ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো যেষাং সাম্যে স্তিতং মনঃ।

নির্দোষং হি সমং ব্রহ্ম তস্মাদ্ ব্রহ্মণি তে স্থিতাঃ।।১৯।।

 

অনুবাদঃ যাঁদের মন সাম্যে অবস্থিত হয়েছে, তাঁরা ইহলোকেই জন্ম ও মৃত্যুর সংসার জয় করেছেন। তাঁরা ব্রহ্মের মতো নির্দোষ, তাই তাঁরা ব্রহ্মেই অবস্থিত হয়ে আছেন।

তাৎপর্য : এই শ্লোকে যে মনের সাম্যস্থিতির কথা বলা হয়েছে, তা আত্ম-উপলব্ধির লক্ষণ। যাঁরা এই স্থিতি প্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁরা জড় বন্ধন, বিশেষ করে জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছেন বলে বুঝতে হবে। যতক্ষণ জীব তার দেহটিকে তার স্বরূপ বলে মনে করে, ততক্ষণ সে জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু আত্ম-উপলব্ধির ফলে যখন সে সব কিছুর প্রতি সমদৃষ্টিসম্পন্ন হয়, তখন সে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। পক্ষান্তরে, তখন আর তাকে এই জড় জগতে জন্মগ্রহণ করতে হয় না, দেহত্যাগ করার পর সে ভগবৎ-ধামে প্রবিষ্ট হয়। রাগ ও দ্বেষ থেকে মুক্ত হবার ফলে ভগবান সম্পূর্ণ নির্দোষ। তেমনই, জীবও যখন রাগ ও দ্বেষ থেকে মুক্ত হয়, তখন সেও নির্দোষ হয় এবং ভগবৎ ধামে প্রবেশ করার যোগ্যতা লাভ করে। এই ধরনের লোকেরা জীবন্মুক্ত। তাদের লক্ষণ পরবর্তী শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে।

 

 

শ্লোক ৫.২০

 

ন প্রহৃষ্যেৎ প্রিয়ং প্রাপ্য নোদ্বিজেৎ প্রাপ্য চাপ্রিয়ম্।

স্থিরবুদ্ধিরসংমূঢ়ো ব্রহ্মবিদ্ ব্রহ্মণি স্থিতঃ।।২০।।

 

অনুবাদঃ যে ব্যক্তি প্রিয় বস্তুর প্রাপ্তিতে উৎফুল্ল হন না এবং অপ্রিয় বস্তুর প্রাপ্তিতে বিচলিত হন না, যিনি স্থিরবুদ্ধি, মোহশূন্য ও ভগবৎ-তত্ত্ববেত্তা, তিনি ব্রহ্মেই অবস্থিত।

তাৎপর্য : এখানে আত্মজ্ঞানী মহাপুরুষের বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর প্রথম লক্ষণ হচ্ছে যে, তিনি মোহাচ্ছন্ন হয়ে তাঁর দেহটিকে তাঁর যথার্থ স্বরূপ বলে ভুল করেন না। তিনি সুনিশ্চিত ভাবেই জানেন যে, তিনি তাঁর দেহ নন। তাঁর প্রকৃত স্বরূপ হচ্ছে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এক অণুসদৃশ অংশ। সেই কারণে, দেহাত্মবুদ্ধির দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে তিনি জড়-জাগতিক লাভ অথবা ক্ষতিতে আনন্দিত বা দুঃখিত হন না। মনের এই দৃঢ়তাকে বলা হয় স্থিরবুদ্ধি। তাই, কখনই তিনি তাঁর জড় দেহটিকে আত্মা বলে ভুল করেন না, অথবা দেহটিকে নিত্য বলে মনে করে আত্মার অবহেলা করেন না। এই জ্ঞানের প্রভাবে তিনি পরমতত্ত্ব উপলব্ধির পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেন; অর্থাৎ তিনি ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবানকে জানতে পারেন। তিনি তাঁর স্বরূপ সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে অবগত হন, তাই তিনি ভগবানের সঙ্গে সর্বতোভাবে এক হয়ে যাবার ভ্রান্ত প্রচেষ্টা করেন না। এই হচ্ছে ব্রহ্ম উপলব্ধি অথবা আত্ম-উপলব্ধি। এই স্থিরমতি ভাবনার স্তরকেই বলা হয় কৃষ্ণভাবনা।

 

 

শ্লোক ৫.২১

 

বাহ্যস্পর্শেষ্বসক্তাত্মা বিন্দত্যাত্মনি যৎ সুখম্। 

স ব্রহ্মযোগযুক্তাত্মা সুখমক্ষয়মশ্নুতে।।২১।।

 

অনুবাদঃ সেই প্রকার ব্রহ্মবিৎ পুরুষ কোন রকম জড় ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের প্রতি আকৃষ্ট হন না, তিনি চিদগত সুখ লাভ করেন। ব্রহ্মে যোগযুক্ত হয়ে তিনি অক্ষয় সুখ ভোগ করেন।

তাৎপর্য : কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত মহাভাগবত শ্রীযামুনাচার্য বলেছেন—

যদবধি মম চেতঃ কৃষ্ণপদারবিন্দে নবনবরসধামন্যুদ্যতং রন্তুমাসীৎ।

তদবধি বত নারীসঙ্গমে স্মর্যমানে ভবতি মুখবিকারঃ সুষ্ঠু নিষ্ঠীবনং চ ॥

“যখন থেকে আমি ভগবদ্ভক্তি লাভ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পদারবিন্দের সেবায় রত হয়ে নব নব রস আস্বাদন করছি, তখন থেকে নারীসঙ্গমের কথা মনে হলে সেই চিন্তার উদ্দেশ্যে আমি থুতু ফেলি এবং ঘৃণায় আমার মুখ বিকৃত হয়।”

ব্রহ্মযোগী বা কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত ভক্ত ভগবানের প্রেমময় সেবায় এতই তন্ময় থাকেন যে, তখন আর ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করবার বাসনার প্রতি তাঁর লেশমাত্র রুচি থাকে না। জড় জগতে স্ত্রীসঙ্গ করাটাই হচ্ছে পরম সুখ। সমগ্র বিশ্ব এরই মোহে চালিত হচ্ছে। দেহসর্বস্ব বিষয়ী লোকেরা কিন্তু এর অনুপ্রেরণা ছাড়া কোন কাজই করতে পারে না। কিন্তু কৃষ্ণভাবনায় নিয়োজিত ভক্ত কামসুখ পরিহার করেও দ্বিগুণ উৎসাহে কর্ম করতে পারেন। সেটিই হচ্ছে পরমার্থ উপলব্ধির পরীক্ষা। পরমার্থ উপলব্ধি ও কাম উপভোগ সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। জীবন্মুক্ত কৃষ্ণভক্ত কোন রকম ইন্দ্রিয় সুখের প্রতি আকৃষ্ট হন না।

 

 

শ্লোক ৫.২২

 

যে হি সংস্পর্শজা ভোগা দুঃখযোনয় এব তে।

আদ্যন্তবন্তঃ কৌন্তেয় ন তেষু রমতে বুধঃ।। ২২।।

 

অনুবাদঃ বিবেকবান পুরুষ দুঃখের কারণ যে ইন্দ্রিয়জাত বিষয়ভোগ তাতে আসক্ত হন না। হে কৌন্তেয়! এই ধরনের সুখভোগ আদি ও অন্তবিশিষ্ট। তাই, জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাতে প্রীতি লাভ করেন না।

তাৎপর্য : জড় ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের সংযোগের ফলে ইন্দ্রিয়-সুখানুভূতির উদয় হয়। কিন্তু এই ইন্দ্রিয়গুলি অনিত্য, কারণ দেহটিই অনিত্য। জীবন্মুক্ত পুরুষ কখনও অনিত্য বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন না। অপ্রাকৃত আনন্দের স্বাদ পাবার পরে, কিভাবে তিনি অনিত্য জড় সুখভোগের প্রয়াসী হতে পারেন? পদ্ম পুরাণে বলা হয়েছে— 

রমন্তে যোগিনোহনন্তে সত্যানন্দে চিদাত্মনি

ইতি রামপদেনাসৌ পরং ব্রহ্মাভিধীয়তে ॥

“যোগীরা পরমতত্ত্বে রমণ করে অনন্ত চিদানন্দ আস্বাদন করেন। তাই, সেই পরম ব্রহ্মকে রাম বলা হয়।” শ্রীমদ্ভাগবতেও (৫/৫/১) বলা হয়েছে—

নায়ং দেহো দেহভাজাং নৃলোকেকষ্টান্ কামার্নহতে বিড়ভুজাং যে ।

তপো দিব্যং পুত্রকা যেন সত্ত্বং শুদ্ধ্যেদযস্মাদ্ ব্রহ্মসৌখ্যং ত্বনন্তম্ ৷৷

“হে পুত্রগণ! মনুষ্য-শরীর প্রাপ্ত হয়ে জড় ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করার কোন প্রয়োজন নেই। বিষ্ঠাহারী শুকরেরা এই সুখ লাভ করে থাকে। বরং, এই জীবনে তোমাদের তপশ্চর্যার অনুশীলন করা উচিত, যার প্রভাবে তোমরা শুদ্ধ হবে, পবিত্র হবে এবং তার ফলে অনন্ত চিন্ময় আনন্দ লাভ করবে।”

তাই, যথার্থ যোগী ইন্দ্রিয়-সুখের প্রতি আকৃষ্ট হন না, যা হচ্ছে অপ্রতিহত ভবরোগের কারণ। জীবের ভোগাসক্তি যত বেশি হয়, ততই সে জাগতিক ক্লেশের বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

 

 

শ্লোক ৫.২৩

 

শক্নোতীহৈব যঃ সোঢ়ুং প্রাক্ শরীরবিমোক্ষণাৎ।

কামক্রোধোদ্ভবং বেগং স যুক্তঃ স সুখী নরঃ।।২৩।।

 

 অনুবাদঃ এই দেহ ত্যাগ করার পূর্বে যিনি কাম, ক্রোধ থেকে উদ্ভুত বেগ সহ্য করতে সক্ষম হন, তিনিই যোগী এবং এই জগতে তিনিই সুখী হন।

তাৎপর্য : যদি কেউ আত্ম-উপলব্ধির পথে উন্নতি সাধনে প্রয়াসী হন, তবে তাঁকে জড় ইন্দ্রিয়ের বেগ দমন করবার চেষ্টা করতেই হবে। এই বেগ ছয় প্রকারের বাচোবেগ, ক্রোধবেগ, মনোবেগ, উদরবেগ, উপস্থবেগ ও জিহ্বাবেগ। যিনি ইন্দ্রিয়ের এই সমস্ত বেগ ও মনকে বশ করতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁকে বলা হয় গোস্বামী অথবা স্বামী। এই গোস্বামীরা কঠোর সংযমের সঙ্গে তাঁদের জীবন যাপন করেন এবং ইন্দ্রিয়ের সমস্ত বেগগুলিকে সর্বতোভাবে দমন করেন। জড় বাসনা যখন অতৃপ্ত থেকে যায়, তখন ক্রোধের সৃষ্টি হয় এবং তার ফলে মন, চক্ষু ও বক্ষ উত্তেজিত হয়। তাই, এই জড় দেহটিকে ত্যাগ করার আগেই এই বেগগুলি দমন করার অভ্যাস করতে হয়। যিনি তা পারেন, তিনি হচ্ছেন আত্ম-তত্ত্ববিদ এবং আত্ম-উপলব্ধির স্তরে তিনি পরম সুখী। যোগীদের কর্তব্য হচ্ছে কাম ও ক্রোধকে বশ করার প্রাণপণ চেষ্টা করা।

 

 

শ্লোক ৫.২৪

 

যোহন্তঃসুখোহন্তরারামস্তথান্তর্জ্যোতিরেব যঃ।

স যোগী ব্রহ্মনির্বাণং ব্রহ্মভূতোহধিগচ্ছতি।।২৪।।

 

অনুবাদঃ যিনি আত্মাতেই সুখ অনুভব করেন, যিনি আত্মাতেই ক্রীড়াযুক্ত এবং আত্মাই যাঁর লক্ষ্য, তিনিই যোগী। তিনি ব্রহ্মে অবস্থিত হয়ে ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করেন।

তাৎপর্য : আত্মায় যে সুখ আস্বাদন করেনি, সে অনিত্য সুখভোগের বাহ্য ক্রিয়াগুলি কিভাবে পরিত্যাগ করবে? জীবন্মুক্ত পুরুষ যথার্থ অনুভূতিতে সুখ আস্বাদন করেন। তাই, তিনি এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে চিন্ময় চেতনার সাহায্যে জীবনের ক্রিয়াগুলিকে উপভোগ করতে পারেন। এই ধরনের মুক্ত পুরুষ কখনই বাহ্য জাগতিক সুখের আকাঙ্ক্ষা করেন না। এই অবস্থাকে ব্রহ্মভূত বলে, তখন ভগবৎ-ধামে ফিরে যাওয়া সুনিশ্চিত হয়।

 

 

শ্লোক ৫.২৫

 

লভন্তে ব্রহ্মনির্বাণম্ ঋষয়ঃ ক্ষীণকল্মষাঃ।

ছিন্নদ্বৈধা যতাত্মানঃ সর্বভূতহিতে রতাঃ।।২৫।।

 

অনুবাদঃ সংযতচিত্ত, সমস্ত জীবের কল্যাণে রত এবং সংশয় রহিত নিষ্পাপ ঋষিগণ ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করেন।

তাৎপর্য : যিনি সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনাময়, তিনিই কেবল পারেন সমস্ত জীবের মঙ্গল সাধন করতে। মানুষ যখন বুঝতে পারেন যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সর্ব কারণের কারণ, তখন সেভাবেই ভাবিত হয়ে তিনি যে কর্ম করেন, সেই কর্ম সকলেরই মঙ্গল সাধন করে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে পরম ভোক্তা, পরম ঈশ্বর, পরম বন্ধু, সেই কথা ভুলে যাওয়ার ফলেই মানুষ নানাভাবে কষ্ট পায়। তাই, সমস্ত মানব-সমাজে এই চেতনাকে পুনর্জাগরিত করাই হচ্ছে সবচেয়ে কল্যাণকর কর্ম। ব্রহ্মনির্বাণ স্তর লাভ না করলে, এই পরম পবিত্র কর্ম সম্পাদন করা যায় না। কৃষ্ণভক্তের মনে শ্রীকৃষ্ণের পরম ঈশ্বরত্ব সম্পর্কে কোন সংশয় থাকে না। তাঁর মনে কোন সংশয় থাকে না, কারণ তিনি সম্পূর্ণরূপে পাপমুক্ত। এটিই হচ্ছে দিব্য ভগবৎ-প্রেমের প্রকাশ।

যে মানুষ কেবলমাত্র মানব-সমাজের জাগতিক কল্যাণ সাধন করার কাজে রত, সে প্রকৃতপক্ষে কারওই কল্যাণ সাধন করতে পারে না। বাহ্যিক দেহ ও মনের সাময়িক উপশম কখনই শান্তি দিতে পারে না। জীবন-সংগ্রামের সমস্ত দুঃখ-কষ্টের যথার্থ কারণ হচ্ছে, ভগবানের সঙ্গে জীবের নিত্য সম্পর্কের চরম বিস্মৃতি। মানুষ যখন শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর নিত্য সম্পর্কের কথা পূর্ণরূপে অবগত হন, তখন তিনি জড় জগতের বন্ধন থেকে যথার্থই মুক্তি লাভ করেন, এমন কি জড় দেহের মধ্যে অবস্থান করলেও তিনি তখন মুক্ত।

 

 

শ্লোক ৫.২৬

 

কামক্রোধবিমুক্তানাং যতীনাং যতচেতসাম্।

অভিতো ব্রহ্মনির্বাণং বর্ততে বিদিতাত্মনাম্।।২৬।।

 

অনুবাদঃ কাম-ক্রোধশূন্য, সংযতচিত্ত, আত্মতত্ত্বজ্ঞ সন্ন্যাসীরা সর্বতোভাবে অচিরেই ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করেন।

তাৎপর্য : মুক্তি লাভের জন্য যে সমস্ত সাধুসন্ত সতত পরমার্থ সাধনে রত, তাঁদের মধ্যে কৃষ্ণভক্তই হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ। ভাগবতে (৪/২২/৩৯) এই কথার সমর্থনে বলা হয়েছে

যৎপাদপঙ্কজপলাশবিলাসভক্ত্যাকর্মাশয়ং গ্রথিতমুদ্‌গ্রথয়ন্তি সন্তঃ ৷

তদ্বন্ন রিক্তমতয়ো যতয়োঽপি রুদ্ধ-স্রোতোগণাক্তমরণং ভজ বাসুদেবম্ ॥

“কেবল ভগবৎ-সেবার মাধ্যমে পরম পুরুষোত্তম ভগবান বাসুদেবের ভজনা কর। যাঁরা সকাম কর্মের বদ্ধমূল বাসনা উৎপাটিত করে অপ্রাকৃত আনন্দের সঙ্গে ভগবানের পাদপদ্মের সেবায় রত আছেন, তাঁদের মতো সুষ্ঠুভাবে কোনও মহান মুনি-ঋষিরাও ইন্দ্রিয়বেগ দমন করতে পারেন না।”

বদ্ধ জীবের কর্মফল ভোগ করার বাসনা এত প্রবল যে, বড় বড় মুনি-ঋষিরা বহু তপস্যার ফলেও সেই বাসনাকে দমন করতে পারেন না। কিন্তু ভগবদ্ভক্ত নিরন্তর ভগবান কৃষ্ণের অপ্রাকৃত সেবায় নিযুক্ত হওয়ার ফলে, আত্ম-উপলব্ধি করে অতি শীঘ্রই ব্রহ্মনির্বাণ স্তর লাভ করেন। পূর্ণরূপে আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার ফলে তিনি সর্বদাই সমাধিস্থ থাকেন।

এর উপমামূলক উদাহরণ দিয়ে বলা যায়—

দর্শনধ্যানসংস্পর্শৈমৎ‍স্যকুর্মবিহঙ্গমাঃ ।
স্বান্যাপত্যানি পুষ্ণন্তি তথাহমপি পদ্মজ ॥

“দর্শন, ধ্যান ও স্পর্শের দ্বারাই কেবল মাছ, কূর্ম ও পাখিরা তাদের সন্তান প্রতিপালন করে। হে পদ্মজ (ব্রহ্মা)! আমিও তাই করি।”

মাছেরা কেবল দৃষ্টিপাতের দ্বারা তাদের সন্তান প্রতিপালন করে। কূর্ম ধ্যান করে তাদের সন্তান প্রতিপালন করে। সে ডাঙ্গায় ডিম পেড়ে তারপর জলের মধ্যে তাদের ধ্যান করতে থাকে। তেমনই, কৃষ্ণভক্ত ভগবৎ-ধাম থেকে অনেক দূরে থাকলেও সর্বক্ষণ ভগবানের ধ্যান করার ফলে এবং সর্বক্ষণ কৃষ্ণভাবনায় তৎপর থাকার ফলে ভগবৎ-ধাম প্রাপ্ত হন। তিনি জড় জগতের দুঃখ-কষ্টের প্রতি সম্পূর্ণ নির্বিকার। ভগবৎ-উপলব্ধির এই স্তরকে বলা হয় ব্রহ্মনির্বাণ, যার অর্থ হচ্ছে ভগবানের চিন্তায় নিমগ্ন থাকার ফলে প্রাকৃত দুঃখ কষ্টের পূর্ণ নিবৃত্তি।

 

 

শ্লোক ৫.২৭- ৫.২৮

 

স্পর্শান্ কৃত্বা বহির্বাহ্যাংশ্চক্ষুশ্চৈবান্তরে ভ্রুবোঃ।

প্রাণাপানৌ সমৌ কৃত্বা নাসাভ্যন্তরচারিণৌ।।২৭।।

 

যতেন্দ্রিয়মনোবুদ্ধির্মুনির্মোক্ষপরায়ণঃ।

বিগতেচ্ছাভয়ক্রোধো যঃ সদা মুক্ত এব সঃ।।২৮।।

 

অনুবাদঃ মন থেকে বাহ্য ইন্দ্রিয়ের বিষয় প্রত্যাহার করে, ভ্রুযুগলের মধ্যে দৃষ্টি স্থির করে, নাসিকার মধ্যে বিচরণশীল প্রাণ ‍ও অপান বায়ুর উর্ধ্ব ও অধোগতি রোধ করে, ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি সংযম করে এবং ইচ্ছা, ভয় ও ক্রোধ শূন্য হয়ে যে মুনি সর্বদা বিরাজ করেন, তিনি নিশ্চিতভাবে মুক্ত।

তাৎপর্য : ভক্তিযোগে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত হলে অচিরেই স্বরূপ উপলব্ধি হয়। ভক্তির মাধ্যমে ভগবানকে জানা যায়। নিষ্ঠার সঙ্গে ভক্তিযোগ সাধন করার ফলে কৃষ্ণভক্ত অপ্রাকৃত স্থিতি লাভ করে তাঁর কর্মের গণ্ডিতে ভগবানের উপস্থিতি অনুভব করার যোগ্যতা অর্জন করেন। এই বিশেষ অবস্থাকে ব্রহ্মনির্বাণ বলা হয়।

ব্রহ্মনির্বাণ সম্বন্ধে উপরোক্ত সিদ্ধান্ত প্রতিপাদন করার পর ভগবান অর্জুনকে অষ্টাঙ্গযোগ (যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি) অভ্যাস করার মাধ্যমে কিভাবে এই স্তরে উন্নীত হওয়া যায়, সেই সম্বন্ধে উপদেশ দিয়েছেন। ষষ্ঠ অধ্যায়ে যোগের বিশদ ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তাই পঞ্চম অধ্যায়ের শেষে, এখানে কেবল তার অবতারণা করা হচ্ছে। যোগের প্রত্যাহার পদ্ধতির মাধ্যমে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ—এই ইন্দ্রিয়জ বিষয়গুলিকে পরিত্যাগ করে, দুই ভ্রূর মধ্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, অর্ধনিমীলিত নেত্রে নাসিকাগ্রে একাগ্র করতে হয়। এখানে সম্পূর্ণভাবে চোখ বন্ধ করতে নিষেধ করা হয়েছে, কারণ তা হলে ঘুমিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সম্পূর্ণভাবে চোখ খুলে রাখতেও নিষেধ করা হয়েছে, কারণ তা হলে ইন্দ্রিয়-বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হবার ভয় থাকে। দেহের অভ্যন্তরে প্রাণ ও অপান বায়ুকে রোধ করার ফলে নাসিকার অভ্যন্তরে শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়। এভাবেই অভ্যাস করার ফলে ইন্দ্রিয়-বিষয় পরিত্যাগ করে ইন্দ্রিয়বেগ দমন করা সম্ভব হয় এবং তার ফলে সাধক ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করতে সক্ষম হন।

এই যোগপদ্ধতি সব রকম ভয়, ক্রোধ আদি থেকে মুক্ত করতে সাহায্য করে এবং এভাবেই অপ্রাকৃত শুদ্ধ সত্ত্বময় অবস্থায় পরমাত্মার উপস্থিতি অনুভব করা যায়। তবে, কৃষ্ণভাবনামৃতই হচ্ছে যোগসাধন করার সবচেয়ে সহজ ও সাবলীল পন্থা। পরবর্তী অধ্যায়ে তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হবে। কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত সর্বদাই ভগবৎ-সেবায় নিয়োজিত, তাই তাঁর ইন্দ্রিয়গুলি অন্য কোন বিষয়ে প্রবৃত্ত হতে পারে না। সুতরাং, ইন্দ্রিয় সংযম করার জন্য অষ্টাঙ্গ-যোগের চেয়ে ভক্তিযোগ অধিক উত্তম।

 

 

শ্লোক ৫.২৯

 

ভোক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্বলোকমহেশ্বরম্।

সুহৃদং সর্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি।।২৯

 

অনুবাদঃ আমাকে সমস্ত যজ্ঞ ও তপস্যার পরম ভোক্তা, সর্বলোকের মহেশ্বর এবং সমস্ত জীবের সুহৃদরূপে জেনে যোগীরা জড় জগতের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হয়ে শান্তি লাভ করেন।

তাৎপর্য : মায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে বদ্ধ জীব এই জড় জগতে শান্তির অন্বেষণ করে, কিন্তু ভগবদ্গীতার এই অংশে বর্ণিত শান্তি লাভের যথার্থ পন্থার কথা তারা জানে না। শান্তি লাভের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ নীতি হচ্ছে—ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত কর্মের ভোক্তা, এটি উপলব্ধি করা। তাই, মানুষের কর্তব্য হচ্ছে ভগবানের সেবায় সব কিছু উৎসর্গ করা, কারণ তিনি হচ্ছেন সমস্ত গ্রহলোকের এমন কি দেবতাদের অধীশ্বর। তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই। শিব, ব্রহ্মা আদি শ্রেষ্ঠ দেবতারাও তাঁর অনুগত ভৃত্য। বেদে (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৬/৭) ভগবানকে বলা হয়েছে—তমীশ্বরাণাং পরমং মহেশ্বরম্ । মায়ার দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে জীব সব কিছুর উপর আধিপত্য করার প্রয়াসী হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে ভগবানের মায়ার অধীন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন মায়াধীশ, কিন্তু জীব জড়া প্রকৃতির কঠোর নিয়মের দ্বারা আবদ্ধ। এই সরল সত্যটিকে উপলব্ধি করতে না পারলে, ব্যক্তিগতভাবে অথবা সঙ্ঘবদ্ধভাবে, কোনমতেই এই সংসারে শান্তি লাভ করা সম্ভব নয়। কৃষ্ণভাবনার অর্থ হচ্ছে যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরমেশ্বর এবং আর সমস্ত জীব, এমন কি বড় বড় দেবতারাও হচ্ছেন তাঁর অনুগত ভৃত্য। এই পরম সত্যকে উপলব্ধি করতে পারলেই পূর্ণ শান্তি লাভ করা যায়।

ভগবদ্‌গীতার এই পঞ্চম অধ্যায়ে কৃষ্ণভাবনামৃত বা কৃষ্ণভক্তির ব্যবহারিক ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যাকে সাধারণত কর্মযোগ বলা হয়। কর্মযোগ কিভাবে মুক্তি প্রদান করতে পারে— মনোধর্ম-প্রসূত এই যে প্রশ্ন, তার উত্তর এখানে দেওয়া হয়েছে। কর্মযোগের অর্থ হচ্ছে, পূর্ণজ্ঞানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরমেশ্বরত্ব সম্বন্ধে অবগত হয়ে তাঁর সেবায় কর্ম করা। এই কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগ অভিন্ন। কৃষ্ণভাবনামৃত হচ্ছে সাক্ষাৎ ভক্তিযোগ, আর জ্ঞানযোগ হচ্ছে ভক্তিযোগে অধিষ্ঠিত হওয়ার একটি পন্থাবিশেষ। কৃষ্ণভাবনামৃতের অর্থ হচ্ছে পরম তত্ত্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের কথা পূর্ণরূপে অবগত হয়ে তাঁর সেবায় কর্ম করা এবং এই ভাবনার পূর্ণতা আসে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে পূর্ণজ্ঞান লাভ করার মাধ্যমে। শুদ্ধ আত্মা ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে তাঁর নিত্যদাস। মায়াকে ভোগ করবার বাসনার ফলে সে মায়ার সংসর্গে আসে এবং সেটিই তার নানা রকম দুঃখকষ্ট ভোগের কারণ। যতক্ষণ সে জড়ের সংসর্গে থাকে, ততক্ষণ সে জাগতিক আবশ্যকতা অনুযায়ী কর্ম করতে বাধ্য হয়। কিন্তু কৃষ্ণভাবনামৃতের বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, প্রকৃতির গণ্ডির মধ্যে থাকলেও তা মানুষকে পারমার্থিক জীবন দান করে, কারণ জড় জগতে ভক্তির অভ্যাস করলে জীবের চিন্ময় স্বরূপ পুনর্জাগরিত হয়। ভক্তিমার্গে উত্তরোত্তর উন্নতি সাধনের অনুপাতে মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ হয়। ভগবান কোন জীবের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেন না। সব কিছু নির্ভর করে ইন্দ্রিয়-নিগ্রহ ও কাম-ক্রোধ দমন করবার জন্য কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ব্যবহারিক কর্তব্য পালন করার উপর। এই সমস্ত বিকারগুলি নিগ্রহ করে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করলে বাস্তবিকপক্ষে অপ্রাকৃত স্তর অথবা ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করা যায়। অষ্টাঙ্গ-যোগের পরম লক্ষ্য হচ্ছে এই কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করা। তাই, কৃষ্ণভাবনামৃতে অষ্টাঙ্গযোগ আপনা থেকেই সাধিত হয়ে যায়। যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি অভ্যাসের দ্বারা ধীরে ধীরে প্রগতি হয়। কিন্তু ভক্তিযোগের প্রারম্ভেই এই সব কয়টিতে সিদ্ধিলাভ হয়ে যায়। তাই, একমাত্র ভক্তিযোগই মানুষকে প্রকৃত শান্তি দিতে পারে—ভক্তিযোগেই জীবনের পরম প্রাপ্তি।

 

ইতি—কৃষ্ণভাবনাময় কর্তব্যকর্ম বিষয়ক কর্মসন্ন্যাস-যোগ’ নামক শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার পঞ্চম অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।