অনেক সময় সনাতনী শাস্ত্র সম্পর্কে অনভিজ্ঞ বিধর্মীরা সনাতনীদের প্রশ্ন করেন,সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর তো জন্মহীন, অথাৎ তিনি জন্মগ্রহণ করেন না। তাহলে শ্রীকৃষ্ণ তো জন্মগ্রহণ করেছেন, তার তো পিতা মাতা আছে, তাহলে তিনি কিভাবে ঈশ্বর হবেন?
এর উত্তর হল, সনাতনী শাস্ত্র অনুসারে, ঈশ্বর জন্মহীন এ তথ্যটি শতভাগ সঠিক।সেসাথে সনাতনী শাস্ত্রে এও বলা হয়েছে, ঈশ্বর হলেন সাকার।তিনি তার স্বইচ্ছার প্রভাবে দুষ্টের দমন, সন্তের রক্ষা এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য বিভিন্ন অবতার রুপে যুগে যুগে আবির্ভূত হন।সনাতনী শাস্ত্রে ঈশ্বরের এই প্রকার আবির্ভাবকে দিব্য জন্ম বলা হয়(গীতা৪/৮)।অথাৎ কোন বিশেষ ব্যক্তি বা বস্তু থেকে পরমেশ্বর ভগবান তার স্বইচ্ছার প্রভাবে আত্মপ্রকাশ করেন বিধায় পরমেশ্বর ভগবানের আবির্ভাবকে দিব্য জন্মও বলা হয়।এ সম্পর্কে আমাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদে বলা হয়েছে…
১/ “অজায়মানো বহুধা বিজায়তে“ -সেই পরমেশ্বর যদিও জন্মরহিত তথাপিও তিনি বহুরুপে জন্মগ্রহণ করেন।
–শুক্ল যজুর্বেদ ৩১/১৯,তৈত্তিরীয় আরন্যক ৩/১৩/১
২/“তদৈক্ষত বহুস্যাং প্রজায়েয়তি“ -পরমেশ্বর বহু রুপে নিজেকে বিস্তার করেন।
-ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬/২/৩(সামবেদ)
৩/“একো বশী সর্বভূতান্তরাত্মা একং রূপং বহুধা যঃ করোতি।”– একক বশকর্তা, সর্ব জীবের অন্তরাত্মা,
সেই পরমেশ্বর এক তথাপি তিনি বহু রূপ ধারন করেন।
-কঠোপনিষৎ- ২/২/১২( কৃষ্ণ যজুর্বেদ)
৪/“রুপং রুপং প্রতিরুপো বভূব তদস্য রুপং প্রতিচক্ষণায়।ইন্দ্রো মায়াভিঃ পুরুরুপ ঈয়তে যুক্তা হ্যস্য হরয়ঃ শতা দশ।।”
অনুবাদঃ ঈশ্বর বিভিন্ন রুপ ধারন করেন। এবং সে রুপ ধারন করে তিনি পৃথকভাবে প্রকাশিত হন।তিনি তার অন্তারঙ্গা শক্তি দ্বারা বিবিধ রুপ ধারন করে যজমানগণের নিকট উপস্থিত হন।কারন তার রথ সহস্র অশ্ব সংযুক্ত(অনন্ত শক্তি), অথাৎ তিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী।
– ঋগ্বেদ ৬/৪৭/১৮
একই কথা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদগীতার ৪/৬,৭,৮ নং শ্লোকে বর্ণনা করেন..
“অজোহপি সন্নব্যায়িত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন। প্রকৃতিং স্বামহধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।। যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানি ভবতি ভারত।অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।।পরিত্রানায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ।ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন।।”
অনুবাদঃ হে অর্জুন, যদিও আমি সমস্ত জীবের ঈশ্বর,যদিও আমার জন্ম নেই ( অজ)এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় ।তবুও আমি আমার অন্তরঙ্গ শক্তিকে আশ্রয় করে অবতীর্ণ হই।যখনই জগতে ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের পরিমান বেড়ে যায়,তখনই সাধুদের (ভক্ত) রক্ষা ও দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপন হেতু যুগে যুগে অবতীর্ন হই।হে অর্জুন! যিনি আমার এই প্রকার দিব্য জন্ম ও কর্ম যথাযথভাবে জানেন, তাঁকে আর দেহত্যাগ করার পর পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না, তিনি আমার নিত্য ধাম ( চিন্ময় জগৎ) লাভ করেন।
-গীতা ৪/৬,৭,৮
শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩/৯-১০ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুসারে , “দ্বাপরযুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন ইচ্ছা করলেন তখন তিনি দেবকীর গর্ভ থেকে চতুর্ভুজ এক অদ্ভুত শিশু রুপে আবির্ভুত হলেন।”
“তমদ্ভুতং বালকমম্বুজেক্ষণং
চতুর্ভুজং শঙ্খগদাদ্যুদায়ুধম্।
শ্রীবৎসলক্ষ্মং গলশোভিকৌস্তুভং
পীতাম্বরং সান্দ্রপয়োদসৌভগম্।।
মহাহর্বৈদূর্যকিরীটকুন্ডল
ত্বিষা পরিষ্বক্তসহসস্রকুন্তলম।
উদ্দামকাঞ্চ্যঙ্গণাদদিভির্বিরোচনমানং
বসুদেব ঐক্ষত।।”
অনুবাদঃ বসুদেব তখন দেখলেন যে,সেই নবজাত শিশুটির নয়নযুগল পদ্মের মতো।তার চার হাতে শঙ্খ,চক্র,গদা এবং পদ্ম।তার বক্ষে শ্রীবৎস চিহ্ন এবং গলদেশে কৌস্তুভ মনি বিরাজমান।তাঁর পরণে পীত বসন,তাঁর অঙ্গকান্তি নিবিড় মেঘের মতো শ্যামল,তারঁ কেশদাম উজ্বল এবং তাঁর মুকুট ও কর্নকুন্ডল বৈদূর্য – মনিচ্ছটায় অস্বাভাবিকভাবে উজ্বল। সেই শিশুটি অত্যন্ত দীপ্তিশালী মেখলা,কেয়ূর,বলয় প্রভৃতি অলঙ্কারে শোভিত।
– শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩/৯-১০
এরপর শ্রীমদ্ভাগবতঃ১০/৩/৪৬ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ী, পুনরায় দেবকীর প্রার্থনায় ভগবান দ্বিভুজ আদিরুপ ধারন করেন।
আবার শ্রীমদ্ভাগবত ৭/৮/১৫-৩৫ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুসারে, “সত্যযুগে বিষ্ণুরুপে শ্রীকৃষ্ণ যখন ইচ্ছা করেন তার ভক্ত প্রহ্লাদের বাণীকে সত্য করা প্রয়োজন, তখন এক স্ফটিক স্তম্ভ থেকে নৃসিংহ অবতার রুপে আবির্ভুত হয়ে হিরন্যকশিপুকে হত্যা করলেন।” যার বর্ণনা এমনকি বেদে পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে।
শ্রীকৃষ্ণকে সনাতনী শাস্ত্রে পরমেশ্বর,পরমাত্মা,
পরমব্রহ্ম,ভগবান বলা হয়েছে, কেননা শ্রীকৃষ্ণ নিজে নিজে সৃষ্টি হয়েছেন। তিনিই বিষ্ণুরুপ ধারন করেন।আবার তিনিই নৃসিংহ,শ্রীরাম, বলরাম,বামন,পরশুরাম ইত্যাদি বিভিন্ন রুপে যুগে যুগে আবির্ভূত হন।
সুতরাং দেবকী মাতা এবং বসুদেব হল শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছানুসারে নির্বাচিত পিতামাতা।শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৩/৩৬-৪৩ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুসারে, “যারা শ্রীকৃষ্ণকে ( যিনি স্বয়ং বিষ্ণু) পুত্ররুপে লাভ করার জন্য ১২ হাজার বছর তপস্যা করেছিলেন।তাদের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান তাদের বর প্রদান করেছিলেন যে,তারা দ্বাপর যুগে তাদের সন্তানরুপে তাকে প্রাপ্ত হবেন।”
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনায় বেদ এবং গীতা শাস্ত্রের শিক্ষা অনুযায়ী, শ্রীকৃষ্ণ যদিও অজ বা জন্মহীন, তথাপি তিনি দুষ্টের দমন, সন্তের রক্ষা এবং ধর্ম সংস্থাপন করবার জন্য যুগেযুগে বিভিন্ন রুপে বা অবতাররুপে জন্মগ্রহণ করেন বা আবির্ভুত হন,যার বর্ননা প্রতিটি সনাতন শাস্ত্রে বর্ণিত আছে।
হরে কৃষ্ণ।প্রনাম।