ঈশ্বর পুরুষ নাকি নারী

IMG-20250318-WA0010

ঈশ্বর পুরুষ নাকি নারী?

বেদের বর্ণনায় ঈশ্বর হল সাকার। সাকার মানে যার আকার বা রুপ বা ইন্দ্রিয় রয়েছে। বেদে ঈশ্বরের মস্তক, হস্ত, পদ, কর্ণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের সুন্দর বর্ণনা ব্যক্ত করা হয়েছে।

দিবো বা বিষ্ণো উত বা পৃথিব্যা মহো বা বিষ্ণু উরোরন্তরিক্ষাৎ। উভো হি হস্তা বসুনা পূনস্বা প্রযচ্ছ দক্ষিণাদোত সব্যাদ্বিষ্ণবে দ্বা।।

(শুক্ল যজুর্বেদ ৫।১৯)

অনুবাদঃ হে ঈশ্বর ( বিষ্ণু),আপনি দ্যুলোক হইতে কি ভূলোক হইতে কিংবা অনন্ত প্রসারী অন্তরিক্ষলোক হইতে পরমধন লইয়া উভয় হস্তকে পূর্ণ করুন। আর দক্ষিণ ও বাম হস্ত দ্বারা অবাধে অবিচারে সেই পরমধন প্রদান করুন,আপনাকে প্রাপ্তির নিমিত্তে উপাসনা করি।

উপরোক্ত শুক্ল যজুর্বেদের মন্ত্রের মতোই সমগ্র বেদে অসংখ্যবার পরমেশ্বর ভগবানের সাকার রুপের বর্ণনা প্রদত্ত হয়েছে। এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে নিমোক্ত লিংকে পাঠ করুন-

ঈশ্বর সাকার নাকি নিরাকার?https://svadharmam.com/ls-godhead-impersonal-or-non-impersonal/

এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারে, সে ঈশ্বর কি পুরুষ নাকি নারী?

এর উত্তর হল মহাভারতের শান্তিপর্বে – ২১৮/৯০ শ্লোক অনুযায়ী ” ঈশ্বর কখনো পুরুষ বা নারী কোনটি নয়, তিনি হলেন জ্ঞানস্বরুপ।” অর্থাৎ বেদ শব্দের অর্থ হল জ্ঞান। বেদ শাস্ত্রে  ঈশ্বর হলেন সাকার। আর বেদ শাস্ত্র অনুসারে সে ঈশ্বর হলেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বা শ্রীবিষ্ণু।

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে নিমোক্ত লিংকে পাঠ করুন-

বেদে কি শ্রীকৃষ্ণের কথা বলা হয়েছে? বেদ অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ কি পরমেশ্বর ভগবান?
https://svadharmam.com/is-the-vedas-mentioned-sri-krishna-according-to-the-vedas-shri-krishna-is-godhead/

এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট করা হয়েছে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা শাস্ত্রে।ভগবদগীতা ১৩/২১-২২, ১৫/১৬ শ্লোক অনুসারে পুরুষ শব্দে জীবকে নির্দেশ করা হয়েছে।

      কার্যকারণকর্তৃত্বে হেতুঃ প্রকৃতিরুচ্যতে।

 পুরুষঃ সুখদুঃখানাং ভোক্তৃত্বে হেতুরুচ্যতে।।২১।।

                      –(গীতা ১৩/২১)

শব্দার্থঃ কার্য-কার্য; কারণ-কারণ; কর্তৃত্বে-কর্তৃত্ব বিষয়ে; হেতুঃ- হেতু; প্রকৃতিঃ- জড় প্রকৃতিকে; উচ্যতে- বলা হয়; পুরুষঃ- জীবকে; সুখ-সুখ; দুঃখানাম্-দুঃখের; ভোতৃত্বে- ভোগ বিষয়ে; হেতুঃ- হেতু; উচ্যতে-বলা হয়।

অনুবাদঃ সমস্ত জড় কার্য ও কারণের কর্তৃত্ব বিষয়ে প্রকৃতিকে হেতু বলা হয়, তেমনই জড় সুখ ও দুঃখের ভোগ বিষয়ে জীবকে (পুরুষঃ)  হেতু বলা হয়।

     পুরুষঃ প্রকৃতিস্থো হি ভুক্তে প্রকৃতিজান্ গুণান্।
     কারণং গুণসঙ্গোহস্য সদস্যানিজন্মসু ।। ২২ ।।

                  -(গীতা ১৩/২২)

শব্দার্থঃ পুরুষঃ- জীব; প্রকৃতিস্থঃ- জড় প্রকৃতিতে অবস্থিত হয়ে; হি- অবশ্যই; ভুক্তে-ভোগ করে; প্রকৃতিজান্-প্রকৃতিজাত; গুণান্- গুণসমূহ; কারণম্ – কারণ; গুণসঙ্গঃ- প্রকৃতির গুণের সঙ্গপ্রভাবে; অস্য-এই জীবের; সদসদ- ভাল ও মন্দ; যোনি- যোনিতে; জন্মসু- জন্ম হয়।

অনুবাদঃ জড় প্রকৃতিতে অবস্থিত হয়ে জীব (পুরুষ)  প্রকৃতিজাত গুণসমূহ ভোগ করে। প্রকৃতির গুণের সঙ্গপ্রভাবে তার সৎ ও অসৎ যোনিসমূহে জন্ম হয়।

    দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ।

   ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি কুটস্থোহক্ষর উচ্যতে ॥১৬॥

                   (গীতা ১৫/১৬)
শব্দার্থঃ দৌ-দুই; ইমৌ-এই সকল; পুরুষৌ-জীবসমূহ; লোকে- জগতে; ক্ষরঃ- বিনাশী; চ- এবং; অক্ষরঃ- অবিনাশী; এব- অবশ্যই; চ এবং; ক্ষরঃ-বিনাশী; সর্বাণি-সমস্ত; ভূতানি- জীবসমূহ; কূটস্থঃ- একাত্মভাবে যুক্ত; অক্ষরঃ- অবিনাশী; উচ্যতে- বলা হয়।

অনুবাদঃ ক্ষর ও অক্ষর দুই প্রকার জীব (পুরুষ)রয়েছে। এই জড় জগতের সমস্ত জীবকে ক্ষর, এবং চিৎ-জগতের(চিন্ময় জগৎ) সমস্ত জীবকে অক্ষর বলা হয়।

এরপর ভগবদগীতা ১৫/১৭ শ্লোক অনুসারে ঈশ্বর  যেহেতু জড় জগতের জীব (ক্ষর) এবং চিন্ময় জগতের জীবের (অক্ষর) সৃষ্টিকর্তা তাই তাকে উত্তম পুরুষ বলা হয়েছে।

     উত্তমঃ পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃত ।
  যো লোকত্রয়মাবিশ্য বিভর্ত্যব্যয় ঈশ্বরঃ ॥১৭॥

(গীতা ১৫/১৭)

শব্দার্থঃ উত্তমঃ- উত্তম; পুরুষঃ- পুরুষ; তু- কিন্তু; অন্যঃ- অন্য; পরম-পরম; আত্মা-আত্মা; ইতি- এভাবে; উদাহৃতঃ- বলা হয়; যঃ-যিনি; লোক- ভুবনে; ত্রয়ম্-তিন; আবিশ্য- প্রবিষ্ট হয়ে; বিভর্তি-পালন করছেন; অব্যয়ঃ- অব্যয়; ঈশ্বরঃ-ঈশ্বর।

অনুবাদঃ এই উভয় থেকে ভিন্ন উত্তম পুরুষকে বলা হয় পরমাত্মা,যিনি ঈশ্বর ও অব্যয় এবং ত্রিজগতের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে পালন করছেন।

এছাড়াও ভগবদগীতা ১৫/১৮ শ্লোক অনুসারে ঈশ্বররুপে শ্রীকৃষ্ণ যেহেতু জড় জগতের জীব (ক্ষর) থেকে পৃথক বা স্বতন্ত্র(অতীত) এবং চিন্ময় জগতের জীবের (অক্ষর)থেকেও মহান(উত্তম),তাই এই জড় জগতে এবং বেদ শাস্ত্রে তাঁকে পুরুষোত্তম অর্থাৎ জড় জগত এবং চিন্ময় জগতের সমস্ত জীব বা পুরুষ থেকে উত্তম বলা হয়েছে।

   যস্মাৎ ক্ষরমতীতোহহমক্ষরাদপি চোত্তমঃ।

অতোহস্মি লোকে বেদে চ প্রথিতঃ পুরুষোত্তমঃ॥১৮॥

(গীতা ১৫/১৮)
শব্দার্থঃ যস্মাৎ- যেহেতু; ক্ষরম্- ক্ষরের; অপি-ও; চ-এবং; অতীতঃ- অতীত; অহম্-আমি; অক্ষরাৎ- অক্ষর থেকে; অস্মি-হই; লোকে- জগতে; উত্তমঃ- উত্তম; বেদে-বৈদিক শাস্ত্রে; অতঃ-অতএব; চ-এবং; প্রথিতঃ- খ্যাত; পুরুষোত্তমঃ -পুরুষোত্তম নামে।

অনুবাদঃ যেহেতু আমি ক্ষরের(জড় জগতের জীব) অতীত এবং অক্ষর (চিন্ময় জগতের জীব)থেকেও উত্তম, সেই হেতু এই জগতে ও বেদে আমি পুরুষোত্তম নামে বিখ্যাত।

উপরোক্ত আলোচনার ভগবদগীতার বিষয়টি আরো স্পষ্ট করা হয়েছে সামবেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদে। ছান্দোগ্য উপনিষদ ৮/১২/৩ মন্ত্রে বলা হয়েছে, জড়দেহের যখন মৃত্যু হয় তখন পরমাত্মা বা ঈশ্বরও সে দেহ পরিত্যাগ করে ভগবানের দেহ থেকে প্রকাশিত যে ব্রহ্মজ্যোতি, সে জ্যোতিতে পরমাত্মা প্রবেশ করে,তাই পরমাত্মা বা ঈশ্বরকে উত্তম পুরুষ বা পুরুষোত্তম বলা হয়।

তাবদেষ সম্প্রসাদোহ স্মাচ্ছরীরাৎ  সমুখায় পরং জ্যোতিরূপং সম্পদ্য স্বেন রূপেণাভিনিষ্পদ্যতে স উত্তমঃ পুরুষঃ

অনুবাদঃ দেহ থেকে বেরিয়ে এসে পরমাত্মা (ঈশ্বর) ব্রহ্মজ্যোতিতে প্রবেশ করেন; তখন তিনি তাঁর চিন্ময় স্বরূপে অবস্থান করেন। সেই পরমকে (ঈশ্বর)বলা হয় উত্তম পুরুষ বা পুরুষোত্তম

সংস্কৃত ভাষায় উত্তম শব্দের সমার্থক শব্দ হল “পরম” অথাৎ শ্রেষ্ঠ। তাই ভগবদ্গীতা ১৩/২৩ শ্লোকে ঈশ্বর বা পরমেশ্বরকে  পরম পুরুষ নামেও অভিহিত করা হয়েছে।

     উপদ্রষ্টানুমন্তা চ ভর্তা ভোক্তা মহেশ্বরঃ।

পরমাত্মেতি চাপ্যুক্তো দেহেহস্মিন্ পুরুষঃ পরঃ।।

(গীতা ১৩/২৩)
শব্দার্থঃ উপদ্রষ্টা-সাক্ষী; অনুমন্তা- অনুমোদনকারী; চ-ও; ভর্তা-পালক; ভোক্তা- ভোগকর্তা; মহেশ্বরঃ- পরমেশ্বর ভগবান; পরমাত্মা- পরমাত্মা; ইতি-এভাবে; চ- এবং; অপি-ও; উক্তঃ- বলা হয়; দেহে-দেহে; অস্মিন্ এই; পুরুষঃ- পুরুষ; পরঃ- পরম।

অনুবাদঃ এই শরীরে আর একজন পরম পুরুষ রয়েছেন,যিনি হচ্ছেন উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর এবং তাকে পরমাত্মাও বলা হয়।

পরিশেষে উপরোক্ত বেদ এবং গীতার আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়ে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে,জড় জগতের যে পুরুষ, নারী এবং উভয়লিঙ্গরুপে দৃশ্যমান জীবসমূদয় বিদ্যমান তারা ঈশ্বর বা পরমেশ্বর থেকে পৃথক বা স্বতন্ত্র, এবং চিন্ময় জগতের জীবের (অক্ষর)থেকেও মহান(উত্তম)। তাই গীতা এবং বেদ শাস্ত্রে ঈশ্বর বা পরমেশ্বরকে উত্তম পুরুষ বা পুরুষোত্তম বলা হয়েছে।সেইসাথে সংস্কৃত ভাষায় উত্তম শব্দের সমার্থক শব্দ হল “পরম” অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ। তাই ভগবদ্গীতা ১৩/২৩ শ্লোকে ঈশ্বর বা পরমেশ্বরকে পরম পুরুষ নামেও অভিহিত করা হয়েছে।

আবার সে উত্তম পুরুষ (পুরুষোত্তম)  বা পরম পুরুষকে বেদে “পুরুষ” শব্দে বন্দনা করা হয়েছে। যেমনটি সনাতনী শাস্ত্রে আত্মা শব্দে জীবকে নির্দেশ করা হয়েছে,কিন্তু শাস্ত্রে বিভিন্ন স্থানে আত্মা শব্দে পরমাত্মাকেও নির্দেশ করা হয়েছে( গীতা ৬/২৯) ।

        সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি।
    ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ ।। ২৯ ৷৷ 

                  ( গীতা ৬/২৯)
শব্দার্থঃ সর্বভূতস্থম্- সমস্ত প্রাণীতে স্থিত; আত্মানম্-পরমাত্মাকে; সর্ব-সমস্ত; ভূতানি- জীবসমূহ; চ-ও; আত্মনি-আত্মায়; ঈক্ষতে-দর্শন করেন; যোগযুক্তাত্মা- কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত; সর্বত্র-সর্বত্র; সমদর্শনঃ-সমদর্শন।

অনুবাদঃ প্রকৃত যোগী সর্বভূতে পরমাত্মাকে (আত্মা) দর্শন করেন এবং পরমাত্মাতে সব কিছু দর্শন করেন। সেই পরব্রহ্মরূপ পরমাত্মাকে যোগযুক্ত আত্মা সর্বত্রই দর্শন করেন।

এইভাবে বেদসহ বিভিন্ন সনাতনী শাস্ত্রে পরম পুরুষ বা পুরুষোত্তম ভগবানকে “পুরুষ”শব্দে  সম্বোধন করা হয়েছে।

      সহস্রশীর্ষা পুরুষাঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রাপাৎ।
       স ভূমিং বিশ্বতো বৃত্বাত্যতিষ্ঠদ্দশাঙ্গুলম্।।

  – (ঋগ্বেদ১০/৯০/১,শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/১৪)

শব্দার্থঃ সহস্রশীর্ষা-অনন্ত মস্তক, পুরুষঃ – পরমাত্মা, সহস্রাক্ষঃ অনন্তনেত্র, সহস্রপাৎ -অনন্ত চরণ বিশিষ্ট, সঃ – তিনি, ভূমিং- ব্রহ্মাণ্ড, বিশ্বতো- বিশ্ব,বৃত্বা-ব্যাপ্ত হয়ে, অতি -উর্দ্ধে, অতিষ্ঠৎ- অবস্থান করছেন, দশাঙ্গুলম- পঞ্চভূত ও পঞ্চতন্মাত্ররূপ দশ অবয়ব যুক্ত

অনুবাদঃ পুরুষ (ঈশ্বর) সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু এবং সহস্র পদযুক্ত, তিনি এই বিশ্ব জগৎ এ পরিব্যাপ্ত হয়ে এই পঞ্চভূত, পঞ্চতন্মাত্র রূপী দশ অবয়ব দ্বারা নির্মিত ব্রহ্মান্ড কে অতিক্রম করে পরমপদে স্থিত আছেন।

 হরে কৃষ্ণ।  প্রণাম।

Avatar of Sadgun Madhav Dash

Sadgun Madhav Dash

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments