অনেকে প্রশ্ন করছিলেন-
চন্ডীতে কি দূর্গা বা কালীপূজায় পশুবলির কথা আছে?
রাজা সুরথ কি দূর্গাপূজায় পশুবলি দিয়েছিলেন?
( চণ্ডী, মার্কেন্ডপুরাণ, কালীকাপুরাণদি শাস্ত্র বিশ্লেষণ)
======================================
সপ্তশতশ্লোকী শ্রীশ্রীচণ্ডী হলো রাজসিক মার্কেন্ডপুরাণের অন্তর্গত একটি অত্যন্ত চমৎকার শাস্ত্র, যেখানে বৈষ্ণবী মাতা দূর্গার বিস্তৃত স্তুতি রয়েছে। এ জড় জগতে সর্বপ্রথম দেবী দূর্গার আনুষ্ঠানিক পূজা করেছিলেন রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য। তাই সুরথ রাজার দূর্গাপূজার কথা এখনো লোকের মুখে মুখে। সে সুরথ রাজা কিভাবে দেবীদূর্গার পূজা করেছিলেন তা মার্কেন্ড ঋষি বর্ণনা করেছেন চণ্ডীতে। কিছু কপট ধর্মব্যবসায়ী চণ্ডীর মাঝখান থেকে দুই একটি শ্লোক তুলে এনে, শুদ্ধ শাস্ত্র সিদ্ধান্ত গোপণ করে- দাবী করেন চণ্ডীতে নাকি পশুবলির বিধান আছে, এবং এ যুক্তিতে তারা সরল ধর্মপ্রাণ সনাতনীদের পথভ্রষ্ট করে নিজেদের মৌসুমী ব্যবসা হাসিল করে। তাদের দাবীকৃত অপপ্রচার সমূহের খন্ডন নিমিত্তে আজকের লিখনি-
——————–
অপযুক্তি- ১:
———————
তথাকথিত ধর্মব্যবসায়ী জাতবামুনগণ চন্ডী হতে নিম্নোক্ত শ্লোক উদ্ধৃতি করে দাবী করেন, চন্ডীতে পশুবলির নির্দেশিকা আছে!
বলি-প্রদানে পূজায়াম্, অগ্নি-কাৰ্য্যে মহোৎসবে।
সৰ্ব্বং মম-এতৎ-চরিতম্, উচ্চার্য্যং শ্রাব্যমেব চ ॥
জানতা-অজানতা বাপি, বলি-পূজাং তথা কৃতাম্ । প্রতীচ্ছিষ্যামি-অহং প্রীত্যা, বহ্নি-হোমং তথা কৃতম্ ॥
[ #চন্ডী ১২।১০-১১; #মার্কেন্ডপুরাণ ৯২।৯-১০]
বঙ্গানুবাদঃ
বলিদানে, পূজায়, অগ্নি-কার্য্যে (যজ্ঞ ও হোমাদিতে) এবং মহোৎসবে আমার এই মাহাত্ম্য পাঠ ও শ্রবণ করবে। পূজা জেনে বা না জেনেও যদি এই মাহাত্ম্য পাঠপূর্ব্বক বলিদান, পূজা এবং হোমাদি করে তা অতি প্রীতিসহকারে আমি গ্রহণ করি ।
অপযুক্তি_খন্ডনঃ
যাদের চেতনা দূষিত, তাদের চিন্তাধারা দূষিত হবে- এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে?! দাবীকৃত উক্ত শ্লোকে ‘বলি’ শব্দ দেখেই মাংসলোলুপগণ লাফিয়ে পড়েন, অথচ তারা ‘বলি’ শব্দের অর্থ কি সেটাই জানে না। ‘বলি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো উপহার। এ উপহার সাত্ত্বিকী, রাজসিক ও তামসিক – তিন প্রকার।
তাহলে প্রশ্ন, চন্ডীতে কোন প্রকার বলির কথা আছে? চন্ডীতে ‘বলি’ শব্দের দ্বারা যে পশুবলিকে বুঝানো হচ্ছে?
চলুন, চন্ডী থেকেই দেখে নিই-
নিরাহারৌ যত-আহারৌ, তন্মনস্কৌ সমাহিতৌ ।
দদতুঃ তৌ #বলিং চৈব, #নিজ_গাত্র_অসৃগ_উক্ষিতম ॥
এবং সম-আরাধয়তোঃ, ত্রিভিঃ বর্ষৈ যত-আত্মনোঃ ।
পরিতুষ্টা জগদ্ধাত্রী, প্রত্যক্ষং প্ৰাহ চণ্ডিকা ॥
[ #চন্ডী ১৩।১১-১২; #মার্কেন্ডপুরাণ ৯৩।৮ ]
বঙ্গানুবাদঃ
সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য নিরাহারে, অল্প আহারে, সমাহিত চিত্তে #নিজ_গাত্র_সিক্ত #রক্ত_বলিরূপে প্রদান করেন। এরূপ সংযতচিত্তে তিন বৎসর আরাধনা করলে পরিতুষ্টা জগদ্ধাত্রী প্রত্যক্ষ রূপে আবির্ভূতা হয়ে বললেন।
#সিদ্ধান্তঃ উক্ত শ্লোকে ‘ বলিং চৈব নিজ গাত্র অসৃগ উক্ষিতম’ দ্বারা বুঝানো হয়েছে #পূজারীর_শরীরের_রক্ত-ই দেবীকে #বলিরূপে নিবেদন করতে হবে। এতে দেবী পরিতুষ্ট হয়ে দর্শন দিবেন!
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, চন্ডীর মধ্যে উল্লেখিত এ শ্লোক লুকিয়ে তথাকথিত মাংসলোলুপ রাক্ষসগণ ভন্ডামী করে। এরা নিজের রক্ত দিয়ে পূজা দিতে ভয়ে ভীরু, এরা নাকি আবার শক্তির উপাসক!! নিজের রক্ত দিয়ে পূজা করার সাহস হয় না এদের, তাই অবলা পশুর উপর ছুরী চালিয়ে নিজের মিথ্যা বীরত্ব প্রকাশ করে! ছি!
——————
অপযুক্তি ২:
——————-
নিজেদের অপকর্মের সাফাই গাইতে তথাকথিত এ সকল ধর্মব্যবসায়ী মাংসলোলুপগণ চন্ডী হতে আরেকটি অপযুক্তি দেখায়-
পশু-পুষ্প-অর্ঘ্য-ধূপৈঃ চ, গন্ধ-দীপৈঃ তথা-উত্তমৈঃ।
বিপ্ৰাণাং ভোজনৈঃ হোমৈঃ, প্রোক্ষণীয়ৈঃ অহর্নিশম্ ॥
অন্যৈঃ চ বিবিধৈঃ ভোগৈঃ, প্রদানৈঃ বংসরেণ যা।
প্রীতিঃ মে ক্রিয়তে সাম্মিন্, সকৃৎ সুচরিতে শ্রুতে ॥
[ চন্ডী ১২।২১-২২; মার্কেন্ডপুরাণ ১৯-২১ ]
বঙ্গানুবাদঃ
উত্তম পশু, পুষ্প, অর্ঘ্য, ধূপ, দীপ, গন্ধ, ব্রাহ্মণ ভোজন, দিবা-রাত্রি প্রোক্ষণীয় দ্রব্যাদি দিয়ে বিধিপূর্ব্বক অগ্নিতে হোম, অন্যান্য নানাবিধ উপচার প্রদান করতঃ একবৎসর পূজাতে যেরূপ প্রসন্ন হই একবার মাত্র এই মাহাত্ম্য শ্রবণে সেরূপ প্রীতিলাভ করি।
অপপ্রচারকগণের দাবী এ শ্লোকে ‘পশু’ শব্দ দ্বারা পশুবলির কথা বলা হচ্ছে!
অপযুক্তি_খন্ডন:
প্রথমত উক্ত শ্লোকে ‘বলি’ শব্দের উল্লেখ নেই। যাদের চেতনা অখাদ্য-কুখাদ্যে নিমজ্জিত, সে সকল মাংসলোভীগণই ‘পশু’ শব্দ দেখলেই, তাদের চোখে ‘মাংস’ এর দৃশ্য ভাসমান হয়!
কিন্তু আদৌ উক্ত শ্লোকে পশুবলি কিংবা পশুমাংসের কথা বলাই হয় নি। চন্ডীর উক্ত শ্লোকে ‘পশু’ শব্দ দ্বারা যজ্ঞে পশু ব্যবহারকে বুঝানো হয়েছে। যজ্ঞকালে যজ্ঞাহুতি শেষে যজমান ভগবানের প্রতিনিধি তথা যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণকে পশুদান করে যজ্ঞকালে জ্ঞাতে অজ্ঞাতে হয়ে যাওয়া পাপ হতে মুক্ত হয়। দূর্গাপূজায় অষ্টমী ও দশমী তিথিতে অগ্নিহোম যজ্ঞ শেষে ব্রাহ্মণকে গো-দান, অশ্ব-দান, হস্তি-দান প্রভৃতি পশুদানের বিধান আছে এবং একেক দানে একেক ফল লাভ হয়। যজ্ঞ প্রারম্ভে যেমন যজমান চুল, নখ কর্তন করে স্নানান্তে শুচি হয়, তেমনি যজ্ঞের পূর্বে যজ্ঞে ব্যবহৃত সকল সামগ্রীকে শুচি করে নিতে হয়। যজ্ঞে ব্যবহৃত পশুভেদে তাদের নখ, খুর, পশম, চুল ইত্যাদি অঙ্গ (বিজ্ঞানের ভাষায় বহিঃকঙ্কালতন্ত্র) চ্ছেদন করে তাদের স্নান করিয়ে যজ্ঞের জন্য শুচি করা হয়। শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর যজ্ঞে পশুব্যবহার সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন-
‘পশোরালভন কিঞ্চিদঙ্গচ্ছেদনমের ন তু হিংসা বধঃ।’
অর্থাৎ, পশুর কিঞ্চিৎ অঙ্গচ্ছেদনই যজ্ঞে দেবতার উদ্দেশ্য বিধান, একে বারে বধ নহে।
(#সারার্থদর্শিন্যাখা-টীকয়া, ভা.১১।৫।১৩)
এভাবে অশ্ব,গর্দভ,মহিষাদি পশুর খুর/নখ ও লম্বা কেশ চ্ছেদন, ভেড়া, মেষাদি পশুর পশম চ্ছেদন দ্বারা এ সমস্ত পশুকে যজ্ঞের জন্য সংস্কার করা হয়, তখন এ সকল পশুকে শাস্ত্রীয় ভাষায় বলে ‘প্রোক্ষিপ্ত পশু’। যেহেতু বেদমন্ত্র দ্বারা এ সকল পশুকে প্রক্ষেপণ করা হয়, তাই এ সকল পশুর উপর যজ্ঞপতি বিষ্ণুর অধিকার থাকে, যজমান যজ্ঞ শেষে এ সকল পশুকে বিষ্ণুর প্রতিনিধি যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণ/ বৈষ্ণবকে দান করেন। বেদমন্ত্র দ্বারা প্রোক্ষিপ্ত এ সকল পশু স্বয়ং ব্রহ্মতুল্য ( অর্থাৎ, বিষ্ণুর ন্যায় জ্ঞাত)। তাই, যদি কেউ যজ্ঞে সংস্কৃত পশুকে হত্যা করে, তবে তিনি ব্রহ্মহত্যা মহাপাপে জর্জরিত হয় এবং ইহলোক ও পরলোকে অতিশয় দুঃখ-যাতনা ভোগ করতে থাকে।
কালিকা উপপুরাণে বলা হয়েছে-
হস্তেন ছেদয়েদ যস্তু প্রোক্ষিতং সাধকঃ পশুম।
পক্ষিণং বা ব্রহ্মবধ্যামবাপ্লোতি সুদঃসহাম।
[ #কালিকাপুরাণ, ৬৭ অধ্যায়, শ্লোক ২৮]
অনুবাদ-
যে সাধক প্রোক্ষিপ্ত(যজ্ঞের জন্য সংস্কারকৃত) পশু বা পক্ষীকে স্বহস্তে ছেদ করেন, তিনি ব্রহ্মহত্যা পাপে আক্রান্ত হন প্রাপ্ত হয়ে অতিশয় দুঃখ ভোগ করেন।
তাই কেউ যদি এরূপ পাপকর্ম হতে বাঁচতে চায় তবে সে মায়ের উদ্দেশ্য কোন প্রকার পশুবলি দিবে না। কিন্তু বলি ব্যতীত মায়ের পূজা হয় না। তাই উক্ত কালিকাপুরাণে বিধান দেওয়া হয়েছে, যারা পশুবলির পাপ হতে বাঁচতে চায় এবং একই সাথে কালীকে প্রসন্ন করতে চান তারা #কুমড়া_ও_ইক্ষু(আখ)-কেই_সাত্ত্বিকী_বলি হিসেবে দেবীকে নিবেদন করবেন। দেখুন কি বলা আছে কালিকা উপপুরাণে
কুষ্মান্ডমিক্ষুদগুঞ্চ মদ্যমাসবমেবচ।
এতে বলি সমাঃ প্রোক্তাস্তৃপ্তৌ ছাগসমাঃ সদা।।
[#কালিকাপুরাণ-৬৭ অধ্যায়, শ্লোক ২৫]
অনুবাদঃ
কুষ্মান্ড(কুমড়া) ও ইক্ষুদন্ড, মদ্য(পুষ্পমধু) ও আসব(পুষ্প আসব) ইহারাও বলি এবং ছাগসমা তৃপ্তিকারক।।
কালীকাপুরাণে আরো বলা হয়েছে-
“হে ভৈরব! ঘৃতময় পিষ্টক(পীঠা) বা যবচুর্ণ দিয়ে ব্যাঘ্র, মনুষ্য অথবা সিংহাদি পশুর প্রতিমূর্তি নিৰ্মাণ করে তাহাকে পূর্বোক্ত মন্ত্র দ্বারা সংস্কৃত করবে এবং চন্দ্রহাস অস্ত্র দ্বারা তাহার ছেদ করিবে। “
[#কালিকাপুরাণ-৬৭ অধ্যায়, শ্লোক ৫৫]
কালীকাপুরাণে ‘পশুবলি’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে উক্ত
শ্লোকগুলো উদ্ধৃত হলেও ধর্মব্যবসায়ীগণ সুকৌশলে উক্ত শ্লোকগুলো গোপণ করে কপটচারীটা করে!!!
চন্ডী তথা রাজসিক মার্কেন্ড পুরাণে সুরথ রাজার দূর্গাপূজার যে উপাখ্যানটি বর্ণিত আছে, সে একই উপাখ্যান সবিস্তারে আরেক রাজসিক পুরাণ- শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে উল্লেখ আছে। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ হলো রাজসিক পুরাণসমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। সেখানে সুরথ রাজার দূর্গাপূজা সম্পর্কে বলতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে-
বলিদানেন বিপ্রেন্দ্র দূর্গাপ্রীতির্ভবেন্নৃণাং
হিংসাজন্যঞ্চ পাপঞ্চ লভতে নাত্রসংশয়ঃ।।১০
উৎসর্গকৰ্ত্তা দাতা চ ছেত্তা পোষ্টা চ রক্ষকঃ।
অগ্রপশ্চান্নিবদ্ধা চ সপ্তৈ তে বধভাগিনঃ ॥১১
যো যং হন্তি সতং হন্তি চেতি বেদোক্ত মেবচ।
কুৰ্ব্বস্তি বৈষ্ণবী পূজাং বৈষ্ণবাস্তেন হেতুনা ॥১২
এবং সংপূজ্য সুরথঃ পূর্ণং বর্বঞ্চ ভক্তিতঃ।
কবচঞ্চ গলে বদ্ধা তুষ্টাব পরমেশ্বরীং।। ১৩
স্তোত্রেণ পরিতুষ্টা সা তস্য সাক্ষাদ্বভূবহ।
স দদর্শ পুরোদেবীং গ্রীষ্মসূর্য্যসম প্রভাং।। ১৪
[ #শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখন্ড, ৬৫।১০-১৪]
বঙ্গানুবাদঃ
বলিদানে( উপহার প্রদানে) দেবী দূর্গার প্রীতিলাভ হয়, কিন্তু কেউ যদি #পশুবলি দেয় তবে যে জীবহিংসা হয় তাতে মানবগনের যে #পাপ সঞ্চার হয় তাতে আর কোন সন্দেহ নেই। উৎসর্গকর্তা, দাতা, ছেত্তা, পোষক, রক্ষক এবং অগ্র ও পশ্চাৎ নিবন্ধা এই সপ্তজন পশুবলির বধভাগী বলিয়া নির্দিষ্ট আছে। বেদে নির্দিষ্ট আছে, যে যাহাকে বিনাশ করে সে তাহার হন্তা(হত্যাকারী) হয়। বৈষ্ণবগণ অত্যন্ত শাস্ত্রবিচক্ষণ, এইজন্য বৈষ্ণব মহাত্মারা বৈষ্ণবী দূর্গাদেবীর সাত্ত্বিকী পূজা করিয়া থাকেন। এ কথা জেনে, রাজর্ষি সুরথ পূর্নসংব্তসল এইরূপ(সাত্তিকীপূজা) ভক্তিভাবে দেবী দূর্গার পূজা করে গলদেশে কবচ ধারন পূর্বক সেই পরমেশ্বরীর(দেবী দূর্গার) পূজা করিলেন। সে স্তুতিতে পরিতুষ্ট হয়ে গ্রীষ্মকালীন সূর্যের ন্যায় প্রভাসম্পন্না দেবীদূর্গা তার নিকট আবির্ভূত হলে তিনি দূর্গার দর্শন লাভে সমর্থ হন।
ব্রহ্মবৈবর্ত মহাপুরাণে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, শুধু পশুবধ কর্তাই নয়, যিনি পশু উৎসর্গ করবেন অর্থাৎ যজমান, যিনি পশুবলির জন্য পশু দান করেন, যিনি পশুবলির জন্য পশুপালন করেন, যিনি পশুবলির জন্য পশু রক্ষা করেন এবং যিনি পশুবলির জন্য পশুর সামনে ও পিছনে বন্ধন করেন, তারা সকলেই পশুবধের পাপে আক্রান্ত হবে। অনেকে দাবী করে, (স্বকল্পিত!) বক্ষ্যমান তন্ত্রমন্ত্র পাঠ করলে ছেদকর্তা পশুবলির পাপ হতে মুক্ত হন। যুক্তির খাতিরে যদি মেনে নেওয়া হয়-ও ছেদকর্তা পাপমুক্ত হচ্ছেন, তবুও ব্রহ্মবৈবর্ত মহাপুরাণের স্পষ্ট সিদ্ধান্ত, যিনি যজ্ঞের যজমান, পশুবলির জন্য পশুদাতা, পশুপালক,পশুরক্ষক এবং অগ্র ও পশ্চাৎ বন্ধনকারীগণের পাপমুক্তির কোন বিধান শাস্ত্রে নেই। অতএব, পাষণ্ডগণের সে সকল অপযুক্তি স্রোতে কূল পায় না।
অতএব, চণ্ডী, মার্কেন্ডপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের নিরীক্ষে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান, সুরথ রাজা দূর্গাদেবীর পূজায় কোন প্রকার পশুবলি দেন নি। তিনি পশুবলি বিহীন পূজা দ্বারা দেবীকে সন্তুষ্ট করেছিলেন।
সংস্কৃতে একই শব্দের ভিন্নার্থ হয়। তন্ত্রে ‘মাংস’ শব্দ দ্বারা পশুমাংসকে না বুঝিয়ে ‘মাংস’ শব্দ দ্বারা ‘রসনাযুক্ত বাক্য’ তথা ‘পঙ্কিল বাক্য/ কুবাক্য’-কে বুঝিয়েছে। যে সাধক কুবাক্য বলা হতে নিজেকে বিরত রাখে, তিনিই মাংসসাধক নামে খ্যাত।
“মা শব্দাদ্রসনা জ্ঞেয় তদংশান রসনা প্রিয়ান্।
সদা যো ভক্ষয়েদ্দেবী স এব মাংস-সাধকঃ।।”
( #জ্ঞানসঙ্কলিনী তন্ত্র)
বঙ্গানুবাদঃ
‘মা’ শব্দে রসনা, আর তার অংশ অর্থ বাক্য। যিনি রসনাযুক্ত বাক্য অর্থাৎ কুবাক্য ভক্ষণ(সংযম) করেন— তিনিই মাংস-সাধক। খেচরী মুদ্রা দ্বারা জিহ্বাকে তালু-মূল ভেদ ক’রে উপরে উঠিয়ে যিনি বাক্য সংযম করেন—তিনি মাংস-সাধক।
দেবীপুরাণে দেবীদূর্গা বলেছেন-
“ওরে সুরোত্তম! মানবগণ স্বাত্ত্বিকভাব অবলম্বন করে আমার পূজা করবে, আমাকে বলি বা আমিষ অম্ল প্রদান করিবে না। আমার প্রীতিকামী মানবেরা নিরামিষ নৈবেদ্য ও বেদাঙ্গসম্মত স্তোত্র দ্বারা আমার মহাপূজা করিবে। আমার পূজায় বিপুল জপ, যজ্ঞ, বহু ব্রাহ্মণ ভোজন, হিংসাদি পরিবর্জ্জন ও মনের সুসংযমন প্রয়োজন।” ( #দেবীপুরাণ)
শাক্তগণ পবিত্র বেদের রাত্রিসূক্তের অভিমানী দেবী হিসেবে গণ্য করেন দেবী কালিকাকে। সেই রাত্রিসুক্তে গবাদি পশুগণের জন্য মঙ্গল ও সুখ কামনা করা হয়েছে। ফলতঃ সেই গবাদি পশুকে রক্ত রঞ্জিত করে মন্দিরকে কসাইখানায় পরিণত করা খুবই জঘন্য ও স্ববিরোধী কর্ম। পবিত্র বেদের রাত্রিসুক্তে প্রার্থনা করা হয়েছে-
নি গ্রামাসো অবিক্ষত নি পদ্বন্তো নিপক্ষিণঃ।
নি শ্যেনাসঃ চিৎ অর্থিনঃ ॥
[ #ঋগ্বেদ, ১০ম মন্ডল, ১০ম অনুবাক, ১২৭ সূক্ত, মন্ত্র-৫]
বঙ্গানুবাদঃ
আপনার অপার করুণায় আপামর গ্রামবাসিগণ, গবাদি পশু-পাখিগণ ও কামার্থিগণ এবং শ্যেনাদিও সুখে শয়ন করুক।
এমনকি দূর্গাদেবীর পতি মহাযোগী শিবও নির্দেশ দিয়েছেন, ছাগাদি পশুবলিদান ব্যতীত দেবী দূর্গার পূজা করতে-
শিব উবাচঃ
শুভে চৈবাশ্বিনে মাসি মহামায়াঞ্চ পূজয়েৎ।
সৌবর্ণাং রাজতীং বাপি বিষ্ণুরূপা বলিং বিনা।।
[#পদ্মপুরাণ,পাতালখন্ড, ৪৯।৩৪]
বঙ্গানুবাদ
ভগবান শিব বললেন- মানবগণ শুভ আশ্বিন মাসে সুবর্ণময়ী বা রজতময়ী বিষ্ণুস্বরূপা দেবী মহামায়াকে ছাগাদি বলিদান ব্যতীত পূজা করবে।
( নবভারত প্রকাশনি অনুবাদ)
তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, শিব যদি দেবীর পূজায় পশুবলি দিতে বারণ করেন, তবে কোন প্রকার বলি দিতে হবে? কারণ, বলি বিনা তো দেবীর পূজা হয় না।
এরপর মহাযোগী শিব বলেছেন, দেবতাদের উদ্দেশ্য কৃষ্ণপ্রসাদই বলিরূপে নিবেদন করতে হবে, যদি কেউ পশুবলি দেয়, তবে সে নরকে যাবে।
শ্রী শিব উবাচঃ
হরের্ভুক্তাবশেষেণ বলিস্তেভ্যো বিনিক্ষিপেৎ।
হোমঞ্চৈব প্ৰকুব্বীত তচ্ছেষেণৈব বৈষ্ণবঃ ।
হযরের্নিবেদিতং সম্যগদেবেভ্যো জুহুয়াদ্ধবিঃ॥
পিতৃভ্যশ্চাপি তদ্দদ্যাৎ সর্ব্বমান্নত্যমাপ্নুয়াৎ।
প্রাণিনাং পীড়নং যত্তদ্বিদুষাং নিরয়ায় বৈ ॥
অদত্তঞ্চৈব যৎকিঞ্চিৎ পরস্বং গৃহ্যতে নরৈঃ ।
স্তেয়ং তদ্বিদ্ধি গিরিজে নরকসৈব কারণম্ ॥
[ #পদ্মপুরাণ, উত্তরখন্ড, ২৫৩। ১০৭-১০৯]
বঙ্গানুবাদঃ
ভগবান শিব বললেন, “হরির ভুক্তাবশেষ (বিষ্ণুপ্রসাদ) দ্বারা দেবতাদের বলিপ্রদান করবে, ভুক্তাবশিষ্ট(বিষ্ণুপ্রসাদ) হবি দ্বারা দেবতাদের হোম করবে । হরিকে সম্যক্রূপে নিবেদন করে পরে দেবগণকে হবি হোম করবে। পিতৃগণকেও তা-ই প্রদান করবে। এইরূপে কৃতকাৰ্য্য সমস্তই অনস্ত ফলপ্রদ হয়ে থাকে। প্রাণি গণের পীড়নকে বিজ্ঞগণ নরকভোগের কারণ হিসেবে ব্যাখা করে থাকেন। অপর প্রাণীর থেকে মানুষ নিষ্ঠুর আচরণ আশা করে না, কিন্তু মনুষ্য যদি নিষ্ঠুর ব্যবহার যদি সে অন্য জীবের উপর করে,তবে হে গিরিজে! সে মনুষ্য অবশ্যই নরকভোগী হবে।”
তবুও কিছু ঘাড় ট্যারা পাষণ্ড আছে, যারা ষাঁড়ের মতো ট্যারামি করে বেড়ায়, এদের দাবী, পশুবলি দিলে যে নরকে যেতে হবে, শাস্ত্রের এ সকল বাক্য তারা মানবেন না, কারণ হিসেবে তারা বলে, তারা নাকি বামমার্গী। এ সকল ঘাড়ট্যারা বামচারীরা সর্বদা প্রামাণ্য শাস্ত্র উপেক্ষা করে ধর্মের নামে মনকল্পিত আচার করে বেড়ায়। তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে, বামমার্গীগণ অবশ্যই নরকপ্রাপ্ত হবেন।
বিষ্ণুপূজাবিহীনশ্চ বিপ্রশ্চন্ডালবদ্ভবেৎ।
বামামন্ত্রোপাসকশ্চ ব্রাহ্মণো নরকং ব্রজেৎ।।
[ #শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, শ্রীকৃষ্ণজন্মখন্ড, ৬৫।৬৯]
বঙ্গানুবাদঃ
যে ব্রাহ্মণ বিষ্ণুপূজা করেন না, তিনি চণ্ডালে পরিণত হন এবং যে সকল ব্রাহ্মণ বামা-মন্ত্রোপাসক তারা অবশ্যই নরক প্রাপ্ত হয়।
‘চণ্ডীতে স্পষ্টভাবে বলেছে, সুরথ রাজা নিজের শরীর কেটে সে রক্ত দেবীকে বলিরূপে নিবেদন করেছেন। তোমরা শক্তির উপাসক, নিজেদের সাহসী ভাবো, তাহলে সুরথ রাজার মতো নিজের শরীর কেটে রক্ত বের করে পূজা দাও?! তা না করে অবলা জীবের উপর দেখাচ্ছো নিজের বীরত্ব? এ তোমাদের সাহসের বড়ায়? হাস্যকর!’
যারা মাতা দূর্গাকে পিশাচিনী বানিয়ে, অশ্লীল পোষাক পড়িয়ে, মদ-মাংস-মাদক দিয়ে দেবীর পূজা করে, মধ্যরাত্রে ডিজে বাজিয়ে মন্দিরকে নাইটক্লাবে পরিণত করে অসভ্য আচরণ করে বেড়ায়, তারাই মনকল্পিত আদর্শে পরিচালিত হয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ সাত্ত্বিকী পন্থা অবলম্বন না করে নিষ্কৃষ্ট পন্থাগামী হয় এবং বারংবার জন্মমৃত্যুর চক্রে ঘূর্ণিপাক খায়। গীতায় তাই বলা হয়েছে-
ঊর্ধ্বং গচ্ছন্তি সত্ত্বস্থা মধ্যে তিষ্ঠন্তি রাজসাঃ।
জঘন্যগুণবৃত্তিস্থা অধো গচ্ছন্তি তামসাঃ।।
[ #শ্রীমদ্ভগবদগীতা ১৪/১৮ ]
অনুবাদঃ
চণ্ডী যে মার্কেন্ডপুরাণের অন্তর্গত, সে মার্কেন্ডপুরাণকে অনেকে মহাভারতের অনুভাষ্যও বলে থাকেন। সে মহাভারতেও যজ্ঞে পশুবলির ফলে যে নরকগতি প্রাপ্ত হয়, তার উল্লেখ আছে-
ইজ্যা যজ্ঞশ্রুতিকৃতৈর্ষো মার্গৈরবুধোঽধমঃ।
হন্যাজ্জস্তূন্মাংসগৃঘ্নঃ স বৈ নরকভাঙনরঃ ॥
[ #মহাভারত, অনুশাসন পর্ব, ১০০।৭৬; ভীষ্মদেব উক্তি ]
বঙ্গানুবাদঃ
মূর্খ, অধম ও মাংসলোভী যে লোক, দেবপূজা ও যজ্ঞের আচারে বেদের দোহাই দিয়ে প্রাণিহিংসা করে, সেই লোক নিশ্চয় নরকভাগী হয় ॥
আমাদের দেবীমাতা দূর্গা সকল জীবের মাতৃস্বরূপা। আমাদের মাতা রাক্ষসী নন যে তিনি নিজের সন্তানের রক্ত পান করবেন। তিনি সমস্ত জীবের রক্ষার্থে অসুরনাশ করেছিলেন এবং অসুরনাশের নিমিত্তে তিনি রক্তবীজবধের জন্য রুধির পান করেছিলেন। তিনি কোন নিরীহ জীবের রক্ত পান করেন না, করেন নি, করবেনও না।
যা দেবী সর্ব্ব ভূতেষু, মাতৃ-রূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।
[ শ্রী শ্রী চণ্ডী, ৫।৭৩ ]
বঙ্গানুবাদঃ
যিনি সৰ্ব্বভূতে মাতৃ (জননী) রূপে অবস্থিতা, তাঁকে নমস্কার,তাঁকে নমস্কার, তাঁকে নমস্কার, তাঁকে বারংবার নমস্কার।
वन्दे गुरु परम्परा, मध्व-गौড়ीয় परम्परा
जয় वैष्णव परम्परा