শৌচ/শুচিতাঃ
সনাতন ধর্মের চারটি স্তম্ভের মধ্যে ‘শৌচ’ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।শৌচ মানে ‘শুচিতা বা পবিত্রতা’। মানবের শুচিতা দুই প্রকার – বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ। দেহের বাহ্যিক শুচিতা হলো – নিয়মিত একবার বা দুইবার স্নান করা, মল ত্যাগের পর স্নান করা, প্রস্রাব করার পর হাত, পা, মুখ জল দ্বারা ধৌত করা এবং দ্বাদশ অঙ্গে হরিমন্দির বা ঊর্ধ্বপুন্ড্র তিলক ধারণ করা।
আর দেহের অভ্যন্তরীণ শুচিতা অর্থ হলো মন ও বুদ্ধিকে পবিত্র রাখা। কারন মন ও বুদ্ধির পবিত্রতা হলো ভগবানের কাছে যাওয়ার খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি মাধ্যম। অভ্যন্তরীণ শুচিতা রক্ষা করা যায় অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করে নিয়মিত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, শ্রীমদ্ভাগবত, ঈশোপনিষদ আদি বৈদিক শাস্ত্র অধ্যয়ন করা এবং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত দিব্যনাম সমন্বিত ‘হরে কৃষ্ণ’ মহামন্ত্র জপ ও কীর্তন করার মাধ্যমে। সেই সাথে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিয়মিত মাথা নত করে প্রণাম করা, তাঁর শ্রীচরণকমলে পুষ্প ও তুলসী প্রদান করা এবং উপাদেয় ফল, জল, অন্নাদি দিয়ে তাঁকে ভোগ নিবেদন করে, তা প্রসাদরূপে আস্বাদন করার মাধ্যমে।
অসৎ সঙ্গ ত্যাগ হলো শুচিতার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। অসৎসঙ্গ ত্যাগ না করলে মন ও বুদ্ধি অপবিত্র হয়ে যায়। আর মন ও বুদ্ধি অপবিত্র হলে আমাদের মন কখনো পারমার্থিক কার্যকলাপে অংশগ্রহন করতে চায় না।
অসৎসঙ্গ তিন প্রকার:
১. বিবাহ-বর্হিভূত স্ত্রীলোকের সাথে যারা যৌনসঙ্গ করে অথবা এসব কর্মে লিপ্ত ব্যক্তিদের সঙ্গ করে (অবৈধ স্ত্রীসঙ্গী)।
অবৈধ-সঙ্গের শাস্তি সম্পর্কে ( মহাভারত, অনুশাসন পর্ব ১০৪।২১, ২২) বলা হয়েছে-
ন হীদৃশমনাযুষ্যং লোকে কিংচন বিদ্যতে।
যাদৃশং পুরুষস্যেহ #পরদারোপসেবনম্।।
যাবন্তো রোমকুপাঃ স্যুঃ স্ত্রীণাং গত্রেষু নির্মিতাঃ।
তাবদ্ বর্ষসহস্ত্রাণি নরকং পর্যুপাসতে।।
অনুবাদঃ পরস্ত্রীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের কারণে মানুষের আয়ু খুব শিগ্রই শেষ হয়ে যায়। এই পৃথিবীতে পরস্ত্রীর_সঙ্গে_অবৈধ_সম্পর্কের_ফলে যে আয়ু নষ্ট হয় এর সমান পুরুষের আয়ু নষ্ট করার দ্বিতীয় আর কোনো কার্য নেই। ( মৃত্যুর পরে ) সেই ব্যভিচারী স্ত্রীর শরীরে যত রোমকুপ থাকে, ঠিক তত হাজার বছর সেই ব্যভিচারি পুরুষকে নরকে থাকতে হয়।
অবৈধ সম্পর্কের শাস্তি সম্পর্কে (গরুড়পুরাণ, উত্তরখণ্ড ৫।৪) বলা হয়েছে-
স্ত্রীঘাতো গর্ভপাতী চ পুলিন্দো রোগবান্ ভবেন্।
অগম্যাগমনাত্ষণ্ঢ়ো দুশ্চর্মা গুরুতল্পগঃ।।
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি স্ত্রীকে হত্যা এবং গর্ভপাত বা গর্ভের বাচ্চা-নষ্ট করে ঐ পাপী পরবর্তী জন্মে নিম্নযোনীতে জন্মগ্রহণ করে। অগম্যাগমন করলে ( অর্থাৎ যে স্ত্রী বা নারীর সাথে সম্ভগ নিষিদ্ধ, তার সাথে যদি কেউ অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয় ) সেই পাপী পরবর্তী জন্মে নপুংসক হয়ে জন্মগ্রহণ করে থাকে এবং যে পাপী গুরুপর্ত্নী গমন করে সে পরবর্তী জন্মে কুষ্ঠ বা চর্ম রোগে পীড়িত হতে থাকে।
অবৈধ সম্পর্কের শাস্তি সম্পর্কে ( শিবপুরাণ, উমাসংহিতা ১৬।১২ ) বলা হয়েছে-
অগম্যাগামী যশ্চান্তে যাতি সপ্তবলং দ্বীজ।
অনুবাদঃ যে অধম পাপী অগম্যাগামী_স্ত্রীর ( অর্থাৎ যে স্ত্রী বা নারীর সাথে সম্ভগ নিষিদ্ধ, তার সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয় ) সেই পাপী, মৃত্যুর পরে সপ্তবল নামক নরকে নিমজ্জিত হবে।
অবৈধ-সঙ্গের শাস্তি সম্পর্কে(শ্রীমদ্ভাগবত ৫।২৬।২০ ) বলা হয়েছে-
यस्त्विह वा अगम्यां_स्त्रियमगम्यं_वा_पुरुषं_योषिदभिगच्छति तावमुत्र कशया ताडयन्तस्तिग्मया सूर्म्या लोहमय्या पुरुषमालिङ्गयन्ति स्त्रियं च पुरुषरूपया सूर्म्या ॥
যত্ত্বিহ বা অগম্যাং_স্ত্রিয়মগম্যং_বা_পুরুষং_যোষিদভিগচ্ছতি তাবমুত্র কশয়া তাড়য়ন্তস্তিন্ময়া সূর্য্যা লোহময্যা পুরুষমালিঙ্গয়ন্তি স্ত্রিয়ং চ পুরুষরূপয়া সূর্য্যা ॥
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি অগম্যা_স্ত্রীতে_এবং_যে_স্ত্রী_অগম্য পুরুষে_অভিগমন ( তথা অবৈধ সঙ্গ ) করে, পরলোকে যমদূতেরা তাদের তপ্তসূর্মি নামক নরকে নিয়ে গিয়ে চাবুক দিয়ে প্রহার করে এবং তারপর পুরুষকে তপ্ত লৌহময় স্ত্রীমূর্তি ও স্ত্রীকে সেই প্রকার পুরুষ-মূর্তির দ্বারা আলিঙ্গন করায়। এটিই অবৈধ যৌন সঙ্গের দণ্ড।
অবৈধ সঙ্গের শাস্তি সম্পর্কে(বিষ্ণুপুরাণ ৩।১১।১২৫ ) বলা হয়েছে-
পরদারান্ন গচ্ছেচ্চ মনসাপি কথঞ্চন ।
কিমু বাচাঙ্গিবন্ধোঽপি নাস্তি তেষু ব্যবায়িনাম্।।
অনুবাদঃ পরস্ত্রীর সঙ্গে তো বাক্যেই নয়, মনে মনেও (অবৈধ যৌন) সঙ্গের অভিলাষ করবে না, কারণ তাতে মৈথুনকারীর অস্থিবন্ধনও হয় না (অর্থাৎ তাকে পরের জন্মে অস্থি-শূন্য কীট জন্ম নিতে হয়)।
যে রাজ্যে অবৈধ স্ত্রীসঙ্গী থাকে না, সে রাজ্য সম্বন্ধে বলা হয়েছে-
যস্য স্তেনঃ পুরে নাস্তি নান্যস্ত্রীগো ন দুষ্টবাক্।
ন সাহসিকদণ্ডঘ্নৌ স রাজা শক্ৰলোকভাক্॥
– (মনুস্মৃতি ৮/৩৮৬)
অনুবাদঃ যাঁর রাজ্যে চোর, পরদারগামী, বাক্পারুষ্যকারী, সাহসকারী ও দণ্ডপারুষ্যকারী নেই, তিনি (পরলোকে) ইন্দ্রলোকভাগী হন।
২. যারা শাস্ত্র অনুযায়ী জীবন যাপন না করে পাপপূর্ণ জীবনযাপন করে অথবা এমন জীবনযাপনে অভ্যস্ত ব্যক্তির সঙ্গ করে (অসাধু)।
এমন ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে গীতায় বলা হয়েছে-
य: शास्त्रविधिमुत्सृज्य वर्तते कामकारत: ।
न स सिद्धिमवाप्नोति न सुखं न परां गतिम् ॥
যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ ।
ন স সিদ্ধিমবাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম্ ॥
– (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৬/২৩)
অনুবাদঃ যে শাস্ত্রবিধি_পরিত্যাগ_করে_কামাচারে_বর্তমান থাকে, সে সিদ্ধি, সুখ অথবা পরাগতি লাভ করতে পারে না।
तस्माच्छास्त्रं प्रमाणं ते कार्याकार्यव्यवस्थितौ ।
ज्ञात्वा शास्त्रविधानोक्तं कर्म कर्तुमिहार्हसि ॥
তস্মাচ্ছাস্ত্রং প্রমাণং তে কার্যাকার্যব্যবস্থিতৌ ।
জ্ঞাত্বা শাস্ত্রবিধানোক্তং কর্ম কর্তুমিহার্হসি ॥
– (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৬/২৪)
অনুবাদঃ অতএব, কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ। অতএব শাস্ত্রীয়_বিধানে কথিত হয়েছে যে কর্ম, তা জেনে তুমি সেই কর্ম করতে যোগ্য হও।
৩.যারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন বা ঈর্ষা পরায়ণ।
অর্থাৎ, যারা সনাতনী শাস্ত্র অনুসারে শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর রূপে মান্য না করে সাধারণ মানুষ মনে করে, সেসব ব্যক্তি অথবা তাদের সঙ্গকারী ব্যক্তি (ভগবৎ-বিদ্বেষী)।পরমেশ্বরের ঈশ্বরত্ব অস্বীকারকারী এমন মূর্খদের সম্বন্ধে গীতায় বলা হয়েছে-
अवजानन्ति मां #मूढा मानुषीं तनुमाश्रितम् ।
परं भावमजानन्तो मम भूतमहेश्वरम् ॥
অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্ ।
পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম্ ॥
– (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৯/১১)
অনুবাদঃ আমি যখন মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হই, #মূর্খেরা আমাকে অবজ্ঞা করে৷ তারা আমার পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয় এবং তারা আমাকে সর্বভূতের মহেশ্বর বলে জানে না।
অসৎসঙ্গত্যাগ, এই বৈষ্ণব-আচার।
‘স্ত্রীসঙ্গী’ এক ‘অসাধু, ‘কৃষ্ণাভক্ত’ আর।।
– (শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত, মধ্যলীলা ২২/৮৭)
শ্রীমদ্ভাগবত শাস্ত্রে অবৈধ স্ত্রীসঙ্গকে অধর্ম বা পাপকর্ম বলা হয়েছে
द्यूतं पानं स्त्रिय:_सूना यत्राधर्मश्चतुर्विध: ॥
দ্যূতং পানং স্ত্রীয়_সূনা যত্রাধর্মশ্চতুর্বিধ ॥।
– (শ্রীমদ্ভাগবত ১/১৭/৩৮)
এই তিনশ্রেনীর অসৎসঙ্গীর মধ্যে কেউ যদি একটি শ্রেনীর সঙ্গ করে তাহলে তার মন ও বুদ্ধি অপবিত্র হয়ে যাবে। তাই সকল মুক্তিকামী ও সুখকামী ব্যাক্তির প্রয়োজন অসৎসঙ্গ থেকে সর্বদা নিজেকে বিরত রেখে কৃষ্ণভক্তের সঙ্গ করা।
হরে কৃষ্ণ,প্রনাম।
©️ স্বধর্মম্ ™️