একশ্রেণীর মূর্খ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার করছে, শাস্ত্রে নাকি রাধারাণীর কোন কথাই বলা হয় নি। বৈষ্ণব চারটি সম্প্রদায়ের মধ্যে শুধুমাত্র ব্রহ্ম-মাধ্ব সম্প্রদায়ভুক্ত গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ বিশেষ করে শ্রীচৈতন্যদেব, জয়দেবের গীতগোবিন্দ এবং বড়ু চন্ডিদাসের কৃষ্ণ কীর্তন বা বিভিন্ন ধরণের পদাবলী থেকে রাধারাণীর অস্তিত্ব নির্মাণ করেছেন।
অথচ সে সমস্ত মূর্খদের অপপ্রচার শাস্ত্র অনুসারে শতভাগ মিথ্যা। কেননা বেদ, নারদীয় পুরাণ, পদ্ম পুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, বরাহ পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, ব্রহ্মান্ড পুরাণ, গর্গ-সংহিতা, সনৎকুমার সংহিতা এবং নারদ-পঞ্চরাত্র ইত্যাদি শাস্ত্রে বিশেষভাবে শ্রীমতি রাধারাণীর মহিমা বর্ণিত রয়েছে।নিম্নোক্ত লিংকে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে…
এছাড়াও শ্রী,ব্রহ্ম,রুদ্র এবং কুমার – এ চারটি সম্প্রদায়ের সকল আচার্যগণ, এবং আদি শঙ্করাচার্যও শ্রীমতী রাধারাণীর অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন নি, বরং সে সমস্ত সম্প্রদায়ের মহান আচার্যগণ তাদের লিখিত বিভিন্ন গ্রন্থে শ্রীমতী রাধারাণীর মহিমা বর্ণনা করেছেন।এখন আমরা চারটি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মহান আচার্য এবং শঙ্করাচার্যের লিখিত বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে শ্রীমতী রাধারাণীর মহিমা আলোচনা করব।
শ্রী সম্প্রদায়ের প্রমুখ আচার্য হলেন শ্রীরামানুজ, ব্রহ্ম সম্প্রদায়ের প্রমুখ আচার্য হলেন শ্রীমধ্বাচার্য, রুদ্র সম্প্রদায়ের মহান আচার্য হলেন শ্রীবল্লভাচার্য্য এবং কুমার/চতুষ্কুমার সম্প্রদায়ের মহান আচার্য হলেন শ্রীনিম্বাকার্চার্য।
শ্রী সম্প্রদায় পরম্পরায় আচার্য শ্রীবেদান্তদেশিক আচার্য তাঁর রচিত যাদব অভ্যুদয় গ্রন্থের ৯/৯০, ১০/৭১ শ্লোকে শ্রীমতী রাধারাণীর মহিমা বর্ণনা করেন-
নিরপেক্ষ ইবৈষ নীলয়া
রসিকঃ পালিকয়া সরাধয়া।
পৃথগত্র কিমেতদুচ্যতে
কুহকঃ কশ্চিদসৌ কুলস্য নঃ।।
~ যাদব অভ্যুদয় ৯/৯০
অনুবাদ: শ্রীকৃষ্ণ অরসিক অর্থাৎ নীরস হৃদয়ে নীলা, পালিকা, ও রাধিকার সাথে অদ্ভুত আচরণ করলে তারা তখন অন্য গোপীদের জিজ্ঞাসা করলেন এই কি আমাদের কৃষ্ণ? তখন অন্য গোপীরা উত্তর দিলেন, এ মনে হয় আমাদের কুলের কেউ নয়। অবশ্যই কোনো কপট বঞ্চক ব্যক্তি।
দেবকী দনুজস্থণা দিব্যম ধাম ব্রজাঙ্গণম্। রমারাধাদয়শ্চেতি রাশিভেদৈর্ন ভিদ্যসে।।
~ যাদব অভ্যুদয় ১০/৭১
অনুবাদ: হে ভগবান, আপনি নরসিংহ অবতারে দৈত্যরাজের সভা গৃহের স্তম্ভ থেকে জন্ম নিয়েছিলেন, এই অবতারে দেবকী আপনার জননী। আপনার পরমধাম বৈকুন্ঠ আপনার আবাস, এই অবতারে ব্রজভূমি আপনার আবাস । পরা বাসুদেব রূপে যেমন আপনার দয়িতা শ্রীরমাদেবী, এই অবতারে শ্রীরাধা, নীলাদেবী প্রমুখ আপনার দয়িতা। প্রত্যেক অবতারেই আপনার এইরূপ, এতে কোন পার্থক্য নেই।
এরপর হল কুমার সম্প্রদায়।এই সম্প্রদায়ের মহান আচার্য নিম্বাকার্চার্য তাঁর রচিত বেদান্ত দশশ্লোকী গ্রন্থে শ্রীমতী রাধারাণীর মহিমা বর্ণনা করেন-
অঙ্গেতু বামে বৃষভানুজাং মুদা
বিরাজমানামনুরূপসৌভগাম।
সখীসহস্রৈঃ পরিসেবিতাং
সদা স্মেরম দেবীং সকলেষ্টকামদাম্।।
~ বেদান্ত দশশ্লোকী ৫
অনুবাদ: সে পরম পুরুষের বামভাগে বৃষভানু রাজার কন্যা রাধা অবস্থিত, তিনি অনুরুপ সৌভাগ্য এবং নিয়তিশয় আনন্দের শ্রীমূর্তি। এবং তিনি সর্বদা অনেক সখীগন কর্তৃক সেবিতা, এবং তিনি সকল অভিষ্ট প্রদান করেন, তাই তিনি পরম দেবী।
এরপর হল রুদ্র সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের মহান আচার্য হলেন বল্লভাচার্য্য। তাঁর পুত্র বিট্ঠলেশ্বর (বিট্ঠলনাথ) শ্রীমতী রাধারাণীকে নিয়ে অনেক স্তোত্র রচনা করেন।সেগুলি হল-স্বামিণী স্তোত্র, স্বামিণ্যষ্টকম, রাধাকৈঙ্কর্য্য প্রার্থনা চতুঃশ্লোকী, স্বামিণী প্রার্থনা ষটপদী।
যদৈব শ্রীরাধে রহসি
মিলতি ত্বাং মধূপতিঃ।
তদৈবাকার্য্যাহহং
নিজচরণদাস্যে নিগদিতা।।
~ স্বামিণী স্তোত্রম্ ১
অনুবাদ: শ্রীরাধে তুমি যখনই মধুপতি অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের সাথে মিলিত হবে তখনই আমাকে চরনদাসীরূপে বিবিধ সেবাকার্যে নিয়োজিত করবে।
এছাড়াও শ্রীবল্লভাচার্য্য দ্বারা রচিত পুরুষোত্তম সহস্রনাম স্তোত্রে শ্রীমতী রাধারাণীর মহিমা বর্ণনা করেন-
কৃষ্ণ ভাব ব্যাপ্ত বিশ্বগোপীভাবিত বেশ দৃক।
রাধা বিশেষ সম্ভোগপ্রাপ্ত দোষ নিবারকঃ।।
~ পুরুষোত্তম সহস্রনাম স্তোত্রম্ ১৮৩
অনুবাদ: রাসলীলার সময় কৃষ্ণভাবে ভাবিত গোপীগণের হৃদয়ে যখন অহংকার সৃষ্টি হয়েছিল,তখন শ্রীকৃষ্ণ তাদের ত্যাগ করেছিলেন।যার ফলে গোপীগণ শ্রীকৃষ্ণকে হারিয়ে বিষম দুঃখ প্রাপ্ত হয়েছিলেন, তখন শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণ দ্বারা বিশেষ সন্মান প্রাপ্ত হয়েছিলেন।যার ফলে তিনি বিবিধ অপবাধ থেকে মুক্তি প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
এরপর হল ব্রহ্ম-মাধ্ব সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের মহান আচার্য শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তার মুখবিগলিত প্রেমামৃত রসায়ণ স্তোত্রে শ্রীমতী রাধারাণীর মহিমা বর্ণনা করেন-
রাসোল্লাসমদন্মত্তো রাধিকারতিলম্পটঃ।
অলক্ষিত কুটীরস্থো রাধা সর্বস্ব সম্পূটঃ।।
~ প্রেমামৃত রসায়ণ স্তোত্রম্ ২৬
এরপর আদি শঙ্করাচার্য তার বিবিধ লিখিত গ্রন্থে শ্রীমতি রাধারাণীর মহিমা বর্ণনা করেন-
পরব্রহ্মাপীড়ঃ কুবলয়-দলোৎফুল্ল-নয়নো
নিবাসী নীলাদ্রৌ নিহিত-চরণোহনন্ত-শিরসি ।
রসানন্দী রাধা-সরস-বপুরালিঙ্গন-সুখো
জগন্নাথঃ স্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে ॥ ৬ ॥
~ জগন্নাথাষ্টকম ৬
অনুবাদ: যিনি পরমার্চনীয় পরব্রহ্ম, যাঁর নেত্রযুগল নীল-কমলদলের ন্যায় উৎফুল্ল, যিনি নীলাচলে অবস্থান করছেন, যিনি অনন্তের শিরে পদার্পণ করে রয়েছেন, যিনি প্রেমানন্দময় এবং যিনি শ্রীরাধিকার রসময়- দেহালিঙ্গনসুখে সুখী, সেই প্রভু জগন্নাথদেব (শ্রীকৃষ্ণ) আমার নয়ন-পথের পথিক হোন ।
জলান্ত কেলিকারি চারু রাধিকাঙ্গ রাগিণী ।
স্বভর্তুরন্য দুর্লভাঙ্গতাঙ্গতাংশ ভাগিনী।।
জলচ্যুতাচ্যুতাঙ্গরাগ লম্পটালি শালিনী
বিলোল রাধিকা কুচান্ত চম্পকালি মালিনী।।
~ যমুনাষ্টকম ৬,৭
এভাবেই সমস্ত প্রামাণিক পরম্পরাগত আচার্যগণ শ্রীমতী রাধারাণীর বন্দনা/ কীর্তিগাথা গেয়েছেন, যা আধুনিক সময়ের তথাকথিত পন্ডিতদের বোধগম্যতার যথেষ্ট ঊর্ধ্বে।
(স্বধর্মম্ কর্তৃক সংকলিত ও অনুবাদিত। স্বধর্মম্-এর সৌজন্য সহকারে শেয়ার করার জন্য অনুমোদিত)