অর্থ, ধন-সম্পদ কি আমাদের প্রকৃতপক্ষে সুখী করতে পারে?
এবিষয়ে বৈদিক শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত এই যে, জাগতিক কোনো বস্তুই (অর্থসম্পদ) জীবকে প্রকৃতপ্রকৃতপক্ষে সুখী করতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত জীবগণ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্তিপূর্ণ সেবায় নিযুক্ত না হচ্ছে। জড় জগতে সমস্ত বদ্ধ জীবগণ তাদের স্বরূপে সবাই চিন্ময় আত্মা। আর আত্মা হচ্ছেন পরমাত্মার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নিত্য অবিচ্ছেদ্য অংশসদৃশ। “মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ” এই জড় জগতে বদ্ধ জীবসমূহ আমার সনাতন বিভিন্নাংশ। (ভ:গী: ১৫/৭) “জীবের স্বরূপ হয় কৃষ্ণের নিত্যদাস” (চৈ:চ: মধ্য:/২০/১০৮) পরমাত্মা সচ্চিদানন্দময় (সৎ, চিৎ, আনন্দ), পরমাত্মার অংশ হওয়ায় আত্মাও হলেন সচ্চিদানন্দময়। যেহেতু প্রকৃত সত্ত্বায় জীবের সুখ-শান্তি আনন্দময় বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সেহেতু জড় জগতের সমস্ত জীবই বিশেষ করে মনুষ্য সমাজের লোকেরা কেউ-ই দুঃখ পেতে ইচ্ছুক নয়। তবুও পরম সত্য পরমেশ্বর ভগবান সম্বন্ধে কোনোরূপ জ্ঞান না থাকায় অবিদ্যার বশবর্তী হয়ে প্রত্যকেই সুখ-শান্তি-আনন্দের সন্ধানে এদিকসেদিক দৌড়াচ্ছে। তাই ভবিষ্যপুরাণ দৃঢ়ভাবে বর্ণনা করছেন- “ধন দ্বারাও সুখ প্রাপ্তি ঘটে না। প্রথমে অর্থ উপার্জনে কষ্ট হয় তৎপরে তা রক্ষা করতে কষ্ট হয়। অতএব অর্থ উপার্জন ও ব্যয় উভয় ক্ষেত্রেই কষ্ট হয়। অর্থের দ্বারা এই সংসারে সুখ বস্তুতঃ লাভ করা যায় না।।৯৫।। অর্থবান্ লোকের চোরের থেকে, জলের থেকে, অগ্নি থেকে, নিজ আত্মীয়দের থেকে এবং রাজার থেকে নিত্য মৃত্যুতুল্য ভয় হয়। আকাশে গমন করলে পক্ষিগণের দ্বারা ভূমিতে গমন করলে শ্বাপদ প্রাণীদের দ্বারা, জলে গমন করলে মৎস্যের দ্বারা নিজ মাংস ভক্ষিত হবে এরূপ ভয় অর্থবান্ লোকের থাকে। এর তাৎপর্য হল বিত্তবান্ লোককে সমস্ত জগৎ ভক্ষণ করে”।।৯৬-৯৭।। (ভবিষ্যপুরাণ: উত্তর-পর্ব/৩/৯৫-৯৭) সম্পাদনায়: প্রবীর চৈতন্য চন্দ্র দাস। [লেখার স্বত্ব স্বধর্মম্ কর্তৃক সংরক্ষিত। কেবল স্বধর্মম্ এর স্বত্ব উল্লেখ পূর্বক হুবহু কপি ও লিংক শেয়ারের জন্য অনুমোদিত।]
পুত্র লাভের উপায় সম্বন্ধে বৈদিক শাস্ত্র কি বলে?
আমাদের “বৈদিক সনাতন ধর্ম” যে অত্যন্ত প্রামাণিক তা আর বলার অপেক্ষা থাকে না। এমন কোনো বিষয়ে মুনি-ঋষিদের দিকনির্দেশনা ও আলোচনা খুঁজে পাবেন না যা বিজ্ঞানসম্মত নয় কিংবা যৌক্তিক নয়। বর্তমান বিশ্বের আধুনিক বিজ্ঞান যা নিয়ে গবেষণা করছে সুষ্ঠু ফলাফল পাওয়ার আশায়। সেসকল বিষয়ে এক ধাপ এগিয়ে আমাদের বৈদিক মুনি-ঋষিদের সুস্পষ্ট অভিমত ও সিদ্ধান্ত শাস্ত্রে পূর্ব হতেই দেওয়া আছে। এমনকি বৈদিক শাস্ত্রে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যা নিয়ে গবেষণা করার শক্তিও বর্তমান বিজ্ঞানীদের নেই, অথচ সেইসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বর্ণিত রয়েছে শাস্ত্রে। শুধুমাত্র তা দৃষ্টিগোচর না থাকায় নিজ ধর্ম সম্পর্কে হীনমন্যতায় ভোগেন জিজ্ঞাসুরা। বর্তমান আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীরাও সন্তান উৎপাদন প্রসঙ্গে গর্ভের সন্তান পুত্র না-কি কন্যা হবে এবিষয়ে ক্রোমোজম নামক Dioxyribo Nuclic Acid; DNA ’র প্রভাব বর্ণনা করেন। তো অনেককেই দেখা যায় পুত্র প্রাপ্তির উপায় হিসেবে শাস্ত্রের দিকনির্দেশনা জানতে চান। এবিষয়ে শুধুমাত্র মনুসংহিতা ৩য় অধ্যায়ের ৪৬-৪৯ তম শ্লোকে যেসকল বিধিনিষেধ বর্ণিত হয়েছে তা হুবহু তুলে ধরা হলো- “স্ত্রীলোকের ঋতু ষোড়শ রাত্রি স্বাভাবিক জানিবে। তন্মধ্যে শোণিতস্রাবযুক্ত চারি রাত্রি অতিনিন্দিত হয়।।৪৬।। তন্মধ্যে প্রথম চারি রাত্রি ও একাদশ এবং ত্রয়োদশ রাত্রি এই ছয় রাত্রি ঋতুমতী স্ত্রীগমন নিষিদ্ধ, তদ্ব্যতীত অপর দশ রাত্রিতে গমন প্রশস্ত জানিবে।। ৪৭।। এই পূর্ব্বোক্ত দশ রাত্রির মধ্যে ছয়, আট, দশ প্রভৃতি যুগ্ম দিনে স্ত্রীতে গমন করিলে পুত্র জন্মে, এবং পাঁচ, সাত প্রভৃতি অযুগ্ম দিনে গমন করিলে কন্যা জন্মে। অতএব পুত্রপ্রার্থী ব্যক্তি ঋতুকালে যুগ্ম দিনে স্ত্রীগমন করিবে।।৪৮।। পুরুষের বীর্য্যাধিক্য হইলে অযুগ্ম রাত্রিতেও পুত্র জন্মে, স্ত্রীর বীর্যাধিক্য হইলে যুগ্ম রাত্রিতেও কন্যা হয়। যদি উভয়ের বীর্য্যের সাম্য থাকে, তাহা হইলে ক্লীব অথবা জমজ পুত্র-কন্যা হয়। যদি উভয়েরই বীর্য্য অসার বা অল্প হয়, তাহা হইলে গর্ভ হয় না”।।৪৯।। সম্পাদনায়: প্রবীর চৈতন্য চন্দ্র দাস। লেখার স্বত্ব স্বধর্মম্ কর্তৃক সংরক্ষিত। কেবল স্বধর্মম্ এর স্বত্ব উল্লেখ পূর্বক হুবহু কপি ও লিংক শেয়ারের জন্য অনুমোদিত।
সোমবারে একাদশী: হরি-হরের অনন্ত কৃপা
সোমবারে একাদশী: হরি-হরের অনন্ত কৃপা চারটি কারণে একাদশী একটি নিত্য ব্রত। যথা, ১. শ্রী হরির সন্তোষ ২. শাস্ত্রের নির্দেশ ৩. নিষিদ্ধ আহার ত্যাগ ৪. ব্রত না করলে অপরাধ এই চারটি কারণে একাদশী সকলেরই কর্তব্য। সমস্ত শাস্ত্রে এই সিদ্ধান্ত রয়েছে যে, কেবল বৈষ্ণব নয়, সমস্ত নারী-পুরুষ তথা শৈব, শাক্ত, গাণপত্য, সৌর সকলেরই একাদশী যত্নসহকারে পালনীয় উদাহরণস্বরূপ, বিষ্ণু ভক্ত কুন্তীদেবী ও শিবভক্ত গান্ধারী উভয়েরই যত্নসহকারে একাদশী পালনের উল্লেখ বিদ্যমান। এমনকি একাদশী বৈকুণ্ঠেও পালন করতে হয়। এই একাদশী তিথি মহাদেব শিবের অত্যন্ত প্রিয়। তিনি শাস্ত্রে বহু স্থানে একাদশীর মহিমা ব্যক্ত করেছেন। . নারদীয় পুরাণে, ও পদ্মপুরাণে মহাদেব শিবের একই উক্তিতে একাদশীতে উপবাসের নির্দেশ রয়েছে- রটন্তীহ পুরাণানি ভূয়ো ভূয়ো বরাননে। না ভোক্তব্যং না ভোক্তব্যং সম্প্রাপ্তে হরিবাসরে॥ [ হরিভক্তিবিলাস ১২।১২, পদ্মপুরাণ উক্তি] অনুবাদ: হে পার্বতী, সমস্ত শাস্ত্রে বার বার একাদশীতে অন্নভোজন না করার নির্দেশ রয়েছে। . স্কন্দপুরাণে উমা দেবীকে মহাদেব বলছেন- মাতৃহা পিতৃহা চৈব ভ্রাতৃহা গুরুহা তথা। একাদশ্যাস্তু যো ভূঙ্ক্তে বিষ্ণুলঝচ্চ্যুতো ভবের॥ [ হরিভক্তিবিলাস ১২।২১, স্কন্দপুরাণ উক্তি] অনুবাদ: যারা একাদশী পালন করে না, তারা মাতা, পিতা, গুরু, ভ্রাতা সকলের হত্যার পাপ লাভ করে। এমনকি অচ্যুতধাম বৈকুণ্ঠেও একাদশীতে অন্নভোজন করলে পতন ঘটে। এই নির্দেশ হল মানুষের জন্য। তাই সকলেরই যত্নসহকারে একাদশী পালন করা উচিত। একাদশী ও সোমবার মহাদেবের উভয়ই প্রিয় তাই যদি কখনো একাদশী ও সোমবার একই দিবসে ঘটে, তবে তা শ্রী শিবের অত্যন্ত প্রীতিকর। তাই যারা মহাদেবের উপাসক, তাদের উচিত এই দিন আরো যত্নসহকারে একাদশী পালন করা। এবং কখনো একাদশী বর্জন করা উচিত নয়। কেননা প্রভু শিব বলেছেন, ” আমার ভক্ত হয়ে যে একাদশী তিথিতে ভোজন করে, সেই পাপ বুদ্ধি যেন আমার লিঙ্গ পূজা না করে। কারণ- যে তিথি বিষ্ণুপ্রিয়া, তাহা নিশ্চিতভাবে আমার প্রিয়, সে তিথিতে যে উপবাস না করে, সে মহাপাপী।” [ স্কন্দপুরাণ,প্রভাসখণ্ডে প্রভাসক্ষেত্রমাহাত্ম্যম্, ৩৫২।২৮-২৯ ] মদ্ভক্তোহপি হি যো ভূত্বা ভুঙক্ত একাদশীদিনে। মল্লিঙ্গস্যার্চ্চনং কার্য্যং ন তেন পাপবুদ্ধিনা।। যা তিথির্দয়িতা বিষ্ণোঃ সা তিথির্ম্মম বল্লভা। ন তাং চোপীষয়েদযস্তু স পাপিষ্ঠতারাধিকা।। এমনকি একাধিক ব্রত উপস্থিত হলে সর্বাগ্রে একাদশী ব্রত কে প্রাধান্য দিতে হয়। যিনি একাদশী বাদ দিয়ে অন্য ব্রত পালন করেন, তিনি যেন অমৃত ছেড়ে বিষ গ্রহণ করলেন, এভাবে কড়াভাবে বলা আছে শাস্ত্রে। তাই একাদশী অবশ্যই পালন করতে হবে। . এ সম্পর্কে পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে- একাদশীসমং কিঞ্চিৎ পাপত্রাণং ন বিদ্যতে। একাদশীসমং কিঞ্চিদ্ ব্রতং নাস্তি শুভেক্ষণে ॥৮ একাদশীং পরিত্যজ্য যো হ্যন্যদ্ ব্রতমাচরেৎ। স করস্থং মহারাজ্যং ত্যক্ত্বা ভৈক্ষ্যন্ত্ত যাচতে ॥৯ [পদ্মপুরাণ, উত্তরখণ্ড, ২৩৪।৮-৯] অনুবাদ: শিব বললেন, “একাদশীর তুল্য উত্তমব্রতও আর কোনো নেই; যে মানব একাদশী পরিত্যাগ করে অন্য ব্রতাচরণ করে, হে শুভেক্ষণে! সে যেন হাতের কাছে মহারাজ্য পরিত্যাগ করে ভিক্ষাযাচ্ঞা করে।” স্কন্দপুরাণে মহাদেব আরো বলেছেন, যদি কোনো বর্ণাশ্রম পালনকারী, তীর্থভ্রমণকারী, শৈব, সৌর বা অন্যদেবোপাসক প্রমাদবশত একাদশী পালন না করে, তার বর্ণাশ্রম নিষ্ফল, তীর্থ নিষ্ফল, শিবাজি দেবতার পূজাও নিষ্ফল। কেননা তাকে আর ঐসব বলে গণ্য করা যায় না। অতএব সকলেরই কর্তব্য পরম ভক্তি সহকারে প্রতিটি একাদশী পালন করা। এর মধ্যে শিবের উপাসকগণের সোমবারে একাদশী আরো যত্নসহকারে পালন করা উচিত, শিবব্রতের কারণে সোমবারে একাদশী পরিত্যাগ করা উচিত নয়। ।। হরে কৃষ্ণ ।। [ বি:দ্র: স্বধর্মম্-এর অনুমোদন ব্যাতীত এই লেখার কোনো অংশ পুনরুৎপাদন, ব্যবহার, কপি পেস্ট নিষিদ্ধ। স্বধর্মম্-এর সৌজন্যে শেয়ার করার জন্য উন্মুক্ত ] নিবেদক- ° স্বধর্মম্: প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন °
আমার পরিচিত একজন ভুলবশত গোমাংস খেয়েছেন, কি করা উচিত তার?
আমার পরিচিত একজন ভুলবশত গোমাংস খেয়েছেন, কি করা উচিত তার? হরে কৃষ্ণ প্রভু। এখানে বেশ কিছু জিনিস বিবেচ্য। ১. প্রথমত তিনি স্বেচ্ছায় আহার করেননি, তাই স্বাভাবিকভাবেই ভগবান সহজেই তাকে ক্ষমা করবেন। কারণ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরম কৃপাময়। ২. তবুও, জেনে হোক, না জেনে হোক, বিষভক্ষণ করলে যেমন মৃত্যু হয়, পাপও জেনে বা না জেনে করলেও ফলিত হয়। তাই অবশ্যই পাপ হয়েছে। তবে এর ক্ষমা লাভ করা যেতে পারে। ৩. শাস্ত্রে বলা হয়েছে, মাংস আহার, প্রাণীহত্যা, ক্রয়, বিক্রয় সবই সমান পাপ। যেকোনো মাংসাহারকারী এজন্য নরকে যাবে। কেউ যদি গোমাংস আহার করে, তাকে ঐ গরুর যতগুলো লোম থাকে তার সমপরিমাণ বছর নরকে থাকতে হয়। ৪. কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, সর্বধর্মান্ পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ, সমস্ত কিছু ত্যাগ করে কেবল আমার আশ্রয় গ্রহণ কর, অহং তাং সর্বপাপেভ্য মোক্ষয়িষ্যামি, আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে রক্ষা করব, মা শূচ, শোক করোনা। অতএব আপনার ভাই যদি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হয়ে তাঁর নির্দেশনা অনুসরণ করে, তবে তাঁর অবশ্যই পাপ থেকে মুক্তি ও সদ্গতি হবে। ৫. এই বিষয়ে জানিয়ে রাখি, আগেকার দিনে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চান্দ্রায়ণ ব্রত নামে একটি বহু কঠিন প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো, যেটা কলিযুগে কার্যকর নয়। ৬. উনি এখন কী কী করতে পারেন? উনি চাইলেই সম্পূর্ণরূপে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত নির্দেশনাবলি অনুসরণ করতে পারেন, অথবা ধীরে ধীরে প্রচেষ্টা করতে পারেন যতটা তার সম্ভব। সনাতন ধর্মের চারটি মূল স্তম্ভ, সত্য-দয়া-তপ-শৌচ। এই চারটি পালন করার জন্য চারটি পাপ বর্জন করতে হয়, যথা: ক. দ্যূতক্রীড়া বা জুয়া খেলা বন্ধ খ. মাংসাহার বর্জন গ. নেশা বর্জন ঘ. বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক বর্জন। উনি এখান থেকে যেকোনো যতটা সম্ভব ধীরে ধীরে চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সরাসরি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কোনো সেবায় যুক্ত হওয়া। যেমন গীতাতেই কৃষ্ণ নির্দেশ দিয়েছেন, ১. সততং কীর্তয়ন্তো মাম্, সবসময় আমার নাম জপ ও কীর্তন করে ২. গীতা অধ্যয়ন কর, ৩. আমার ভক্ত হও, আমার পূজা কর। পত্রং পুষ্পং অর্থাৎ ফুল ও তুলসী নিয়মিত অর্পণ কর। ৪. শাস্ত্রবিধি অনুসরণ কর। তাই তিনি যদি এখন থেকে প্রতিদিন হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ শুরু করেন, ২ মালা করেই শুরু করুক, ধীরে ধীরে বাড়াতে পারেন। নিয়মিত গীতা পড়বেন। এক্ষেত্রে আমাদের গীতা ক্লাস আছে অনলাইনে, সেখানেও যুক্ত হতে পারেন। গৃহে প্রতিদিন রাধাগোবিন্দ কে ফুল তুলসী দিতে পারেন। আর অন্যান্য শাস্ত্রে বিভিন্ন ব্রত যেমন একাদশী, দামোদর মাস পালন করতে পারেন। আমি বুঝতে পারছি, তিনি অবশ্যই খুব হতাশ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ভগবান অনেক দয়ালু তিনি অবশ্যই ক্ষমা করে দেবেন, তবে কিছু সংশোধন মূলক কার্য তো করতেই হবে। সেক্ষেত্রে তিনি এই চারটি বিষয় অনুসরণ করতে পারেন অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয় হলো, এখন কার্তিক মাসব্যাপী দামোদর ব্রত চলছে। আজ ১১ দিন হয়েছে, আরো কিছুদিন আছে। তাই তিনি চাইলেই দামোদর ব্রতে অংশ নিতে পারেন। তিনি প্রতিদিন জপ, গীতা অধ্যয়ন, ফুল তুলসী নিবেদন, এবং এই মাসে বিশেষ করে প্রদীপ দান করতে পারেন। সারাবছরই এইসব কার্য মহাপুণ্যদায়ক আর দামোদর মাসে তা বহুগুণ বেশি এবং সমস্ত পাপ নাশ করে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিশ্চিত করেছেন, যদি কোনো ব্যক্তি এভাবে নিয়মিত তাঁর সাথে যুক্ত হয়, তিনি ঐ ব্যক্তির সমস্ত পাপ দূর করবেন। এখানে একটি বিষয় হলো, বিধর্মীরা সবসময় এইরকম কাজ করতে উৎসুক। তারা সবসময় চায় অন্যদের ধর্ম নষ্ট করতে। যদিও গোমাংস ভক্ষণ করলেই কেউ অন্য ধর্মের হয়ে যায় না, কিন্তু নিজের ধর্মচ্যুতি ঘটে। তাই ভবিষ্যতে এইরকম লোকেদের সংস্পর্শ থেকে সচেতন থাকা খুবই আবশ্যক। প্রাচীনকাল থেকেই ওরা ছলে বলে কৌশলে লোকেদের গোমাংস আহার করাচ্ছে, আর সমাজের লোকেরা কোনো প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা না করে তাদের ধর্মছাড়া, সমাজছাড়া করছে, এটা হিন্দুদের বোকামী। শাস্ত্রে সবকিছুর সমাধান দেওয়া হয়েছে। বিশেষত বাংলাদেশে, যেখানে একই রান্নাঘরে গোমাংস ও অন্য মাংস রান্না হয়, সেখানে কোনো নিশ্চয়তা নেই যে দুটো রান্নার পাত্র কখনো মিক্স হয়ে যায়নি। আবার যেখানে গোমাংস রান্না হয় না, সেখানেও অনেক সময় তেলের বদলে কোরবানির গরুর চর্বি ব্যবহার করা হয়, তাই বাইরের খাবার বিষয়ে সতর্ক থাকার বিকল্প নেই। ।। হরে কৃষ্ণ ।। [ বি:দ্র: স্বধর্মম্-এর অনুমোদন ব্যাতীত এই লেখার কোনো অংশ পুনরুৎপাদন, ব্যবহার, কপি পেস্ট নিষিদ্ধ। স্বধর্মম্-এর সৌজন্যে শেয়ার করার জন্য উন্মুক্ত ] নিবেদক- ° স্বধর্মম্: প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন °
শ্রীরামচন্দ্র কি স্বৈরাচারী শাসক ছিলেন?
প্রভু শ্রীরামচন্দ্র কি স্বৈরাচারী শাসক ছিলেন? না। রামায়ণে এ সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে, প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের শাসন চলাকালীন একদা একসময় রাজ্যের প্রজারা কেমন আছেন বর্ণনা করতে, শ্রীভরত করজোড়ে প্রভু শ্রীরামচন্দ্রকে বললেন- জীর্ণানামপি সত্ত্বানাং মৃত্যুর্নায়াতি রাঘব। অরোগপ্রসবা নার্যো বওুষ্মস্তো হি মানব।।১৯।। হর্ষশ্চাভ্যধিকো রাজঞ্জনস্য পরবাসিনঃ। কালে বর্ষতি পর্জন্যঃ পাতয়ান্নমৃতং পরঃ।।২০।। বাতাশ্চাপি প্রবাস্ত্যেতে স্পর্শযুক্তাঃ সুখাঃ শিবাঃ। ঈদৃশো নশ্চিরং রাজা ভবেদিতি নরেশ্বরঃ।।২১।। কথয়ন্তি পরে রাজন্ পৌরজানপদস্তেথা। [ শ্রীমদবাল্মীকি রামায়ণ, উত্তরকাণ্ড ৪১।১৯-২২] বঙ্গানুবাদ: হে রাঘব, নারীগণ বিনা কষ্টেই প্রসব করছেন। সকল মানুষকেই হৃষ্টপুষ্ট দেখা যাচ্ছে। হে রাজন্ ! পুরবাসীদের মধ্যে আনন্দ ছড়িয়ে রয়েছে। মেঘ ঠিক সময়মতো অমৃত সমান জলবর্ষণ করছে। বায়ু এমনভাবে বইছে যে, তার স্পর্শ শীতল ও সুখদায়ক মনে হচ্ছে। রাজন্ ! নগর ও জনপদের লোকে বলা-বলি করছে যে, পুরীতে চিরকাল ধরে এমনই প্রভাবশালী রাজা যেনো থাকে। . শ্রীমদ্ভাগবতে প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের রাজত্ব সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে- নাধিব্যাধিজরাগ্লানিদুঃখশোকভয়ক্লমাঃ। মৃত্যুশ্চানিচ্ছতাং নাসীদ্ রামে রাজন্যধোক্ষজে।। [ শ্রীমদ্ভাগবত ৯।১০।৫৩ ] বঙ্গানুবাদ: ভগবান শ্রীরামচন্দ্র যখন এই পৃথিবীতে রাজত্ব করেছিলেন, তখন (প্রজাদের) সমস্ত দৈনিক এবং মানসিক ক্লেশ, ব্যাধি, জড়া, সন্তাপ, দুঃখ, শোক, ভয় ও ক্লান্তি সম্পূর্ণরুপে অনুপস্থিত ছিল। এমনকি ইচ্ছা না করলে মৃত্যুও কারো কাছে উপস্থিত হতো না। . রামায়ণে যুদ্ধকাণ্ডে এ সম্পর্কে আরো উল্লেখ রয়েছে- ন পর্যদেবন্ বিধবা ন চ ব্যালকৃতং ভয়ম্। জনন ব্যাধিজং ভয়ং চাসীদ্ রামে রাজ্যং প্রশাসতি৷৷ নির্দস্যুরভবল্লোকো নানর্থং কশ্চিদস্পৃশৎ। নচস্ম বৃদ্ধা বালানাং প্রেতকার্যাণি কুর্বতে।। সর্বং মুদিতমেবাসীৎ সর্বো ধর্মপরোহভবৎ। রামমেবানুপশ্যন্তো নাভ্যহিংসন্ পরস্পরম্।। [ শ্রীমদবাল্মীকি রামায়ণ, যুদ্ধকাণ্ড ১২৮।৯৮-১০০] বঙ্গানুবাদ: প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের রাজত্বকালে কোনদিন বিধবাদের বিরহ-বিলাপ শোনা যায়নি। সর্পাদি শ্বাপদের ভয় অথবা রোগভয় কখনও প্রাদুর্ভূত হয়নি। সমগ্র রাজ্যের কোথাও চোর-ডাকাতের নাম পর্যন্ত শোনা যেত না। রাজ্যে কেউ অনর্থকারী কার্যে লিপ্ত হোত না কিংবা বৃদ্ধগণের কদাপি নবীনদের জন্য অন্ত্যেষ্টি সৎকার করার প্রয়োজন পড়ত না। সকলে সদা আনন্দে থাকত এবং ধর্মাচরণ করত। প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের শাসনে একে অন্যকে হিংসা করত না। অর্থাৎ প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের রাজত্বকালে প্রজাদের সুখের কোনো অভাব ছিলো না। প্রজারাও চাচ্ছিলেন পুরীতে চিরকাল ধরে এমনই প্রভাবশালী রাজা যেনো থাকে। ।। হরে কৃষ্ণ ।। [ বি:দ্র: স্বধর্মম্-এর অনুমোদন ব্যাতীত এই লেখার কোনো অংশ পুনরুৎপাদন, ব্যবহার, কপি পেস্ট নিষিদ্ধ। স্বধর্মম্-এর সৌজন্যে শেয়ার করার জন্য উন্মুক্ত ] নিবেদক- ° স্বধর্মম্: প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন °
বৈষ্ণব সম্প্রদায় কি পরমেশ্বর ভগবানের “নির্গুণ ও সগুণ” উভয় সত্তাকেই স্বীকার করেন?
প্রশ্নঃ বৈষ্ণব সম্প্রদায় কি পরমেশ্বর ভগবানের নির্গুণ ও সগুণ উভয় সত্তাকেই স্বীকার করেন? উত্তরঃ হ্যাঁ। তারা এই উভয় দর্শনকেই স্বীকার করেন। প্রশ্নঃ তবে তা কিভাবে, ব্যাখ্যা করুন। উত্তরঃ এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ তাঁর ‘শ্রীঈশোপনিষদের’ ৫ম মন্ত্রের ভক্তিবেদান্ত ভাষ্যে। আপনাদের সুবিধার্থে উক্ত ভাষ্য এখানে তুলে ধরা হলো। শ্রীঈশোপনিষদঃ মন্ত্র-৫ তদেজতি তন্নৈজতি তদ্ দূরে তদ্বন্তিকে। তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ ॥ তৎ-সেই পরমেশ্বর ভগবান; এজতি-সচল; তৎ-তিনি; ন-না; এজতি-সচল; তৎ-তিনি; দূরে-দূরে; তৎ-তিনি; উ-ও; অন্তিকে-অতি নিকটে; তৎ-তিনি; অন্তঃ-অন্তরে; অস্য-এর; সর্বস্য-সব কিছুর; তৎ-তিনি; উ-ও; সর্বস্য-সব কিছুর; অস্য– এর; বাহ্যতঃ-বাইরেও। অনুবাদঃপরমেশ্বর ভগবান সচল এবং অচল। তিনি বহু দূরে রয়েছেন, আবার সন্নিকটেও অবস্থান করছেন। তিনি সকল বস্তুর অন্তরে এবং বাইরে অবস্থান করেন। তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে ভগবান অচিন্ত্য শক্তির দ্বারা যে অপ্রাকৃত কার্যকলাপ প্রদর্শন করেন তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পরস্পর-বিরোধী কথা উল্লেখ করে ভগবানের অচিন্ত্য শক্তির প্রমাণ করা হয়েছে। তিনি সঞ্চরণশীল এবং সঞ্চরণশীল নন। এই প্রকার পরস্পর-বিরোধী বৈশিষ্ট্য ভগবানের অচিন্ত্য শক্তিকে ইঙ্গিত করে। আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের দ্বারা আমরা এই ধরনের পরস্পর-বিরোধী উক্তির সমন্বয় সাধন করতে পারি না। আমাদের সীমিত জ্ঞান দ্বারা আমরা কেবল ভগবান সম্বন্ধে কিছু কল্পনা করতে পারি। মায়াবাদ সম্প্রদায়ের নির্বিশেষবাদী দার্শনিকেরা ভগবানের নির্বিশেষ কার্যকলাপ মাত্র গ্রহণ করেন এবং তাঁর সবিশেষ রূপকে বাতিল করে দেন। কিন্তু ভাগবত সম্প্রদায় ভগবানের সবিশেষ ও নির্বিশেষ উভয় রূপকেই স্বীকার করেন। ভাগবতগণ তাঁর অচিন্ত্য শক্তিসমুহকেও স্বীকার করেন, কেন না এই শক্তিসমূহ ব্যতিরেকে ‘পরমেশ্বর’ কথাটির কোন অর্থই হয় না। যেহেতু আমরা ভগবানকে স্বচক্ষে দর্শন করতে পারি না, আমাদের মনে করা উচিত নয় যে, তাই ভগবানের কোনও সবিশেষ সত্তা নেই। এই যুক্তি খণ্ডন করে শ্রীঈশোপনিষদ আমাদের সতর্ক করেছেন যে, ভগবান যেমন আমাদের থেকে অতি দূরে তেমনি তিনি অতি নিকটেও অবস্থান করেন। ভগবানের ধাম জড় আকাশ থেকে বহু দূরে এবং এমন কি এই জড় আকাশ পরিমাপ করার কোন উপায় আমাদের জানা নেই। জড় আকাশ যদি বহু বহু দূর বিস্তৃত হয়, তা হলে জড় আকাশের অতীত চিদাকাশকে জানার কোন প্রশ্নই ওঠে না। চিদাকাশ যে জড় ব্রহ্মাণ্ডের বহু দূরে অবস্থিত, তা ভগবদ্গীতায়ও (১৫/৬) প্রতিপন্ন হয়েছে। কিন্তু ভগবান এত দূরে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও, মুহূর্তমধ্যে তিনি বায়ু অথবা মন অপেক্ষা দ্রুত গতিতে আমাদের কাছে আবির্ভূত হতে পারেন। তিনি এত দ্রুত চলতে পারেন যে, কেউ তাঁকে অতিক্রম করতে পারে না। এই বিষয়টি পূর্বোক্ত মন্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে। তবুও ভগবান যখন আমাদের কাছে আবির্ভূত হন তখন আমরা তাঁকে অবজ্ঞা করি। ভগবদ্গীতায় পরমেশ্বর ভগবান এই বিচার- বুদ্ধিহীন অবস্থার নিন্দা করে বলেছেন যে, মূর্খরাই কেবল তাঁকে মরণশীল ব্যক্তি বলে অনুমান করে উপহাস করে। (গীতা ৯/১১) তিনি মরণশীল ব্যক্তি নন, তেমনই তিনি আমাদের সামনে জড়া প্রকৃতিজাত দেহ নিয়ে আবির্ভূত হন না। তথাকথিত অনেক পণ্ডিত আছেন যাঁরা মনে করেন, ভগবান যখন জগতে আবির্ভূত হন, তখন তিনি সাধারণ মানুষের মতোই জড়দেহ ধারণ করেন। তাঁর অচিন্ত্য শক্তির কথা না জেনেই, মূর্খরা ভগবানকে সাধারণ মানুষের সমপর্যায়ভুক্ত বলে বিবেচনা করে। অচিন্ত্য শক্তিসম্পন্ন বলে ভগবান যে কোন উপায়েই আমাদের সেবা গ্রহণ করতে পারেন, এবং তাঁর বিভিন্ন শক্তিকে স্বেচ্ছায় রূপান্তরিত করতে পারেন। অবিশ্বাসীরা তর্ক করে যে, ভগবান-স্বয়ং কোন মতেই মূর্তি পরিগ্রহ করতে পারেন না এবং যদি তিনি সক্ষম হন, তবে তিনি জড়া প্রকৃতিজাত রূপ নিয়ে অবতরণ করেন। ভগবানের অচিন্ত্য শক্তিকে বাস্তব বলে স্বীকার করলেই এই যুক্তির অসারতা প্রতিপন্ন হয়। এমন কি ভগবান যদি জড়া প্রকৃতির আকার নিয়ে আমাদের কাছে উপস্থিতও হন, তবুও তাঁর পক্ষে সেই জড় শক্তিকে চিন্ময় শক্তিতে রূপান্তরিত করা খুব সহজ। যেহেতু জড়া ও পরা শক্তি উভয়েরই উৎস এক, তাই উৎসের ইচ্ছা অনুসারেই শক্তিগুলির যথাযথ ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন, ভগবান মাটি, পাথর কিংবা কাঠের অর্চা-বিগ্রহের মধ্যে আবির্ভূত হতে পারেন। এই সমস্ত শ্রীবিগ্রহ কাঠ, পাথর বা অন্য কোন পদার্থ থেকে প্রকাশিত হলেও তা দেবমূর্তি নয়, যা অপৌত্তলিকরা দাবি করেন। আমাদের বর্তমান অসম্পূর্ণ প্রাকৃত অবস্থায় ত্রুটিযুক্ত দর্শন-শক্তির কারণে আমরা পরমেশ্বর ভগবানকে দর্শন করতে পারি না। কিন্তু ভগবৎ-দর্শনে ইচ্ছুক জড় দৃষ্টিসম্পন্ন ভক্তবৃন্দের কাছে তিনি কৃপা করে তথাকথিত জড় বিগ্রহ-রূপে তাঁদের সেবা গ্রহণের জন্য আবির্ভূত হন। কারও মনে করা উচিত নয় যে, যারা পৌত্তলিক তাঁরা ভগবদ্ভক্তির নিম্নতম পর্যায়ে বিরাজ করছেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা ভগবৎ উপাসনাই করছেন এবং তিনি তাঁদের কাছে সহজগম্যভাবে আবির্ভূত হতে সম্মত হয়েছেন। অর্চা-বিগ্রহ উপাসকের মনগড়া নয়, তা তাঁর সকল আনুষঙ্গিক সহ নিত্য বর্তমান। একমাত্র শুদ্ধ অন্তঃকরণ- বিশিষ্ট ভক্তই এই সত্য অনুধাবন করতে পারেন, নাস্তিকের দ্বারা তা সম্ভব নয়। ভগবদ্গীতায় (৪/১১) শ্রীভগবান বলেছেন যে, ভক্তের শরণাগতির মাত্রা অনুসারেই তিনি তাঁর ভক্তের সঙ্গে সম্পর্কিত হন। তাঁর শরণাগত ভক্ত ভিন্ন অন্য কারও কাছে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন না। সুতরাং শরণাগত ভক্তের কাছে তিনি অত্যন্ত সুলভ, কিন্তু যারা শরণাগত নয়, তাদের কাছ থেকে তিনি বহু বহু দূরে অবস্থান করেন এবং তাদের কাছে তিনি একান্তই দুর্লভ। এই প্রসঙ্গে শাস্ত্রে বর্ণিত সগুণ এবং নির্গুণ শব্দ দুটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সগুণ শব্দের অর্থ এই নয় যে, ভগবান যখন এই জগতে আবির্ভূত হন, তখন তিনি জড়া প্রকৃতির নিয়মের অধীন হন, যদিও তিনি উপলভ্য এবং প্রাকৃত রূপেই আবির্ভূত হন। সকল শক্তির উৎস হওয়ায়, তাঁর কাছে জড়া শক্তি ও চিন্ময় শক্তির মধ্যে কোন ভেদ নেই। সকল শক্তির নিয়ন্তা বলে, আমাদের মতো তিনি কখনও সেই শক্তিগুলির দ্বারা প্রভাবিত হন না। জড় শক্তি তাঁর নির্দেশেই কাজ করে; তাই তিনি তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জড় শক্তিকে চালনা করতে পারেন, কিন্তু তিনি স্বয়ং কখনও এই জড় শক্তির গুণদ্বারা প্রভাবিত হন না। আবার পরিশেষে তিনি কখনও নিরাকার হয়ে যান না। প্রকৃতপক্ষে তিনি নিত্য শ্রীবিগ্রহ-সম্পন্ন আদিপুরুষ। তাঁর নির্বিশেষ রূপ বা ব্রহ্মজ্যোতি হচ্ছে তাঁর দেহনিঃসৃত জ্যোতি, ঠিক যেমন-সূর্যরশ্মি হচ্ছে সূর্যদেবতার দেহনিঃসৃত জ্যোতি। প্রহ্লাদ মহারাজ শৈশবে যখন তাঁর ঘোর নাস্তিক পিতা হিরণ্যকশিপুর সম্মুখে ছিলেন, তখন তাঁর পিতা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, “তোমার ভগবান কোথায়?” প্রহ্লাদ মহারাজ যখন উত্তর দিলেন, ভগবান সর্বত্র বিরাজমান, তখন তাঁর পিতা ক্রুদ্ধস্বরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁর ঈশ্বর এই রাজপ্রাসাদের কোন একটি স্তম্ভের মধ্যে আছে কি না। এবং শিশু প্রহ্লাদ বললেন, “হ্যাঁ আছেন।” তৎক্ষণাৎ সেই নাস্তিক অসুর তাঁর সম্মুখে স্তম্ভটি ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ করলে তার ভিতর থেকে তৎক্ষণাৎ অর্ধ নর, অর্ধ সিংহ অবতার নৃসিংহ মূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে হিরণ্যকশিপুকে বধ করেন। এভাবেই ভগবান সমস্ত কিছুর মধ্যে রয়েছেন এবং তাঁর বিভিন্ন শক্তির দ্বারা তিনি সব কিছু সৃষ্টি করেন। তাঁর ঐকান্তিক ভক্তকে কৃপা প্রদর্শন করার জন্য তাঁর অচিন্ত্য শক্তির দ্বারা তিনি যে কোন স্থানে আবির্ভূত হতে পারেন। ভগবান নৃসিংহ ফটিক স্তম্ভের মধ্যে থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাঁর ভক্ত প্রহ্লাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করবার জন্যে, নাস্তিক হিরণ্যকশিপুর আদেশে নয়। একজন নাস্তিক ভগবানকে আবির্ভূত হওয়ার জন্য আদেশ করতে পারে না, কিন্তু ভগবান তাঁর ভক্তকে কৃপা প্রদর্শনের জন্য সব সময়, সর্বত্র আবির্ভূত হন। তেমনই, ভগবদ্গীতায় (৪/৮) বলা হয়েছে যে, বিশ্বাসীদের রক্ষা এবং অবিশ্বাসীদের বিনাশ করবার জন্য ভগবান আবির্ভূত হন। অবশ্যই নাস্তিকদের
ছাগল-মহিষ বলি নয়! কালীসাধক রামপ্রসাদ ৬ রিপুকে বলি দিতে বলেছেন !!
ছাগল-মহিষ বলি নয়! কালীসাধক রামপ্রসাদ ৬ রিপুকে বলি দিতে বলেছেন !! হিন্দু সমাজের অন্যতম সংস্কারক কালীসাধক রামপ্রসাদ সেন পশুবলি কুপ্রথা বিরুদ্ধে ছিলেন সরব। ধর্মের মিথ্যা দোহাই দিয়ে পশুহত্যা করে মন্দিরকে কসাইখানায় পরিনত করাকে নিন্দার দৃষ্টিতে দেখতেন শুদ্ধ সরল হৃদয় মাতৃসাধক রামপ্রসাদ সেন। নিজের ভিতরে থাকা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য নামক ষড় রিপুরূপী অসুরকে বলি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন মায়ের আশীর্বাদপুষ্ট এ কালীসাধক, রচনা করেন কালবিজয়ী একাধিক রামপ্রসাদী শ্যামাসঙ্গীত। “মেষ ছাগল মহিষাদি, কাজ কী রে তোর বলিদানে । তুমি জয় কালী জয় কালী বলে, বলি দেও ষড় রিপুগণে ॥ তুমি জয় কালী বলি দেও করতালি, মন রাখো সেই শ্রীচরণে ॥” তামসিক পুজারীরা কামনা বাসনা চরিতার্থে অবলা জীবের রক্ত কালীর নিকট মানত করে। কালীসাধক রামপ্রসাদ তাদের সর্তক করে বলেছেন অবলা জীবের জীবন নিয়ে মা কালীর সাথে ঘুষের ব্যবসা চলবে না। কারণ, মা কখনো সন্তানের রক্ত চান না। “মেষ-মহিষ আর ছাগলছানা। জানিস মুক্তকেশী কালী আমার। কারো কাছে ঘুষ খাবেনা।।” যুগে যুগে হিন্দু সমাজে মহান কিছু সমাজ সংস্কারকের মুহুর্মুহু প্রচেষ্টায় হিন্দু সমাজ হতে যেরূপে সতীদাহ কিংবা নরবলির মতো কুপ্রথার বিলুপ্তি ঘটেছে, ঠিক তেমনিভাবে বর্তমানে জাগ্রত সচেতন হিন্দু সমাজের অবারিত প্রচেষ্টায় তামসিক পূজা বহুলাংশে কমে গেছে, ধীরে ধীরে পূজায় পশুবলি, মদ-মাদক সেবন কিংবা ডিজে বাজানোর মতো কুপ্রথা অনেক কমেছে। আশা করা যায়, অতি অল্প সময়ের মধ্যে এ সমস্ত কুপ্রথা থেকে সনাতনী সমাজ মুক্ত হবে, সমুন্নত হবে সাত্ত্বিক চেতনা। ।। হরে কৃষ্ণ ।। [ বি:দ্র: স্বধর্মম্-এর অনুমোদন ব্যাতীত এই লেখার কোনো অংশ পুনরুৎপাদন, ব্যবহার, কপি পেস্ট নিষিদ্ধ। স্বধর্মম্-এর সৌজন্যে শেয়ার করার জন্য উন্মুক্ত ] নিবেদক- ° স্বধর্মম্: প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন °
বৈদিক শাস্ত্রে কোথায় শ্রীমতি রাধারাণীর উল্লেখ রয়েছে?
বৈদিক শাস্ত্রে কোথায় শ্রীমতি রাধারাণীর উল্লেখ রয়েছে? বেদ সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। বেদ বা শ্রুতি শাস্ত্র প্রধানত চার প্রকার- ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। প্রত্যেক বেদ-এর চারটি করে অংশ থাকে। যথা- সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ। সনাতন শাস্ত্রে শ্রীমতি রাধারাণীকে ‘বৃষভানুনন্দিনী’, ‘বার্ষভানবী’ ‘গান্ধর্ব্বী’ ইত্যাদি নামে সম্বোধন করা হয়েছে। শ্রুতি বা বেদ শাস্ত্রে বিশেষ করে ঋগ্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদীয় গোপালতাপনী উপনিষদে শ্রীমতি রাধারাণীর বহু উল্লেখ দেখা যায়। এছাড়াও নারদীয় মহাপুরাণ, পদ্ম মহাপুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত মহাপুরাণ, বরাহপুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, ব্রহ্মান্ড পুরাণ, গর্গ-সংহিতা, সনৎকুমার সংহিতা ও নারদ-পঞ্চরাত্র ইত্যাদি শাস্ত্রেও বিশেষভাবে শ্রীমতি রাধারাণীর মহিমা বর্ণিত রয়েছে। শ্রুতি বা বেদ শাস্ত্রে শ্রীমতি রাধারাণী – স্তোত্রং রাধানাং পতে গির্বাহো বীর যস্য তে। বিভূতিরস্তু সূনৃতা ॥ [ ঋগ্বেদ সংহিতা ১।৩০।৫; সামবেদ সংহিতা, উত্তরার্চিক ১৬।৩।৮ ; সামবেদ-১৬০০ ] বঙ্গানুবাদ: হে রাধাপতি (ঐশ্বর্যের পতি), হে বীর! প্রশস্তি দ্বারা স্তুত, যে তোমার স্তুতি করে সে সমৃদ্ধি ও আনন্দ লাভ করে। অর্থাৎ তাঁর সত্য রূপা প্রিয় সমৃদ্ধি লাভ হয়। ইদং হ্যন্বোজসা সুতং রাধানাং পতে। পিবা ত্বাস্য গিৰ্বণঃ ॥ [ ঋগ্বেদ সংহিতা ৩।৫১।১০; সামবেদ সংহিতা, উত্তরার্চিক ২।৩।১ ; সামবেদ-৭৩৭ ] বঙ্গানুবাদ: হে রাধাপতি (ঐশ্বর্যের পতি), হে স্তুতিপ্রিয়! তেজ দ্বারা সম্পন্ন এই মধুর সোমরস তোমার পানের জন্য। তুমি এসে পান কর। তস্য মধ্যে হি শ্রেষ্ঠা গান্ধর্ব্বীত্যুবাচ। তং হি বৈ তাভিরেরং বিচার্য্য।। [ অথর্ববেদীয় গোপালতাপনী উপনিষদ, উত্তরবিভাগ, মন্ত্র ৯ ] বঙ্গানুবাদ: গোপীদিগের মধ্যে গান্ধর্ব্বী ( রাধারাণীর একটি নাম) নামে এক প্রধানা গোপী তাঁদের সাথে বিচার করে জিজ্ঞাসা করলেন। দ্বে পার্শ্বে চন্দ্রাবলী রাধিকা চেতি যস্যাংশেন লক্ষ্মীদুর্গাদিকা শক্তিরিতি। [ অথর্ববেদ, পুরুষবোধিনী উপনিষদ, ১ম প্রপাঠক ] বঙ্গানুবাদ: “তাঁর(শ্রীকৃষ্ণের) দুই পাশে চন্দ্রাবলী ও রাধিকা। এই রাধিকা হলেন কৃষ্ণের স্বরূপশক্তি যার অংশে লক্ষ্মী দুর্গাদি শক্তি।” এ শ্রুতি মন্ত্রে লক্ষ্মী,দূর্গা প্রাকৃত দেবী নন। ইনারা চিন্ময়ধামস্থিত মহালক্ষ্মী, মহাদূর্গাদি দেবী। তস্যাদ্যা প্রকৃতী রাধিকা নিত্যা নির্গুণা সর্বালঙ্কারশোভিতা প্রসন্নাশেষলাবণ্যসুন্দরী । অস্মদাদীনাং জন্ম তদধীনং অস্যাংশাদ বহুবো বিষ্ণুরুদ্রাদয়ো ভবন্তি । [ অথর্ববেদ, পুরুষবোধিনী শ্রুতি, ৩য় প্রপাঠক ] বঙ্গানুবাদ: সেই পরমপুরুষের আদ্যা প্রকৃতি রাধিকা। তিনিও শ্রীকৃষ্ণের নিত্যা অর্থাৎ কেবল দ্বাপরে কুব্জাদির ন্যায় কৃষ্ণ লীলা সঙ্গিনী নন। শ্রীকৃ্ষ্ণের ন্যায় তিনিও নির্গুণা অর্থাৎ গুণাতীত। সর্ব অলঙ্কারে সুশোভিতা, প্রসন্না অশেষলাবণ্যবতী আমাদের সকলের আদি, তাঁর অংশে কোটি বিষ্ণুরুদ্রাদির জন্ম হয়। . পুরাণ শাস্ত্রে শ্রীমতি রাধারাণী: অথর্ববেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদ-৭।১।২ মন্ত্রে, পুরাণ ও ইতিহাস শাস্ত্রকে পঞ্চম বেদ বলা হয়েছে, “ইতিহাসপুরাণং পঞ্চমং বেদানাং”। দেবী কৃষ্ণময়ী প্রোক্তা রাধিকা পরদেবতা। সর্বলক্ষ্মীস্বরূপা সা কৃষ্ণাহ্লাদস্বরূপিণী।। [ পদ্মপুরাণ, পাতালখন্ড, ৫০।৫৩ ] বঙ্গানুবাদ: দেবী রাধিকা কৃষ্ণময়ী। তাই তিনি পরদেবতা রূপে কথিতা হন। তিনি সর্বলক্ষ্মীরূপিণী এবং কৃষ্ণের হ্লাদিনী স্বরূপা। . পদ্মপুরাণে আরো উল্লেখ রয়েছে – কথিতুং তৎফলং পুণ্যং ন শক্নোত্যপি নারদ । কোটিজন্মাৰ্জ্জিতং পাপং ব্রহ্মহত্যাদিকং মহৎ। কুৰ্ব্বন্তি যে সকৃদ্ভক্ত্যা তেষাং নশ্যতি তৎক্ষনাৎ।। [ পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মখণ্ড ৭।৭] বঙ্গানুবাদ: যে সকল মানুষ ভক্তিভরে একবার মাত্র এই মহাপবিত্র শ্রীরাধাষ্টমী ব্রত পালন করে থাকেন, সেই সকল মানুষের কোটি জন্মের ব্রহ্মহত্যাদি সমস্ত মহাপাপ তৎক্ষনাৎ বিনাশ হয়ে যায়। . পদ্মপুরাণে আরো উল্লেখ হয়েছে – বামপার্শ্বে স্থিতাং তস্য রাধিকাঞ্চ স্মরেত্ততঃ। নীলচোলকসংবীতাং তপ্তহেমসমপ্রভাম্।। পট্টাঞ্চলেনাবৃতার্দ্ধ-সুস্মেরাননপঙ্কজাম্। কান্তবক্তে ন্যস্তনেত্রাং চকোরীর চলেক্ষণাম।। [ পদ্মপুরাণ, পাতালখন্ড, অধ্যায় ৫০, শ্লোক ৪৪,৪৫ ] বঙ্গানুবাদ: ভক্ত স্মরণ করবে- পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের বামভাগে রাধিকা বিরাজমান রয়েছেন, তাঁর পরিধান-নীলবসন, উত্তপ্ত স্বর্ণের ন্যায় তাঁর দেহপ্রভা; তাঁর ঈষৎ হাসিযুক্ত মুখপদ্ম আঁচলে অর্ধাবৃত। চকোরী পাখি যেমন চন্দ্রের অমৃত কিরণ পান করেন, তেমনি শ্রীমতি রাধিকা তার চঞ্চল নেত্রযুগল দ্বারা নিজ কান্ত(স্বামী) কৃষ্ণের মুখচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে তার রূপমাধুর্য্যসুধা আস্বাদন করছেন। . পদ্মপুরাণে আরও বলা হয়েছে- ততঃ সারিশুকানাঞ্চ শ্রুত্বা বাগাহবং মিথঃ। নির্গচ্ছতস্ততঃ স্থানাদগন্তুকামৌ গৃহং প্রতি ॥ কৃষ্ণঃ কান্তামনুজ্ঞাপ্য গবামভিমুখং ব্রজেৎ। সা তু সূর্যাগৃহৎ গচ্ছেৎ সখীমণ্ডলসংযুতা ॥ [ পদ্মপুরাণ, পাতালখন্ড, অধ্যায় ৫২, শ্লোক ৭৬,৭৭ ] বঙ্গানুবাদ: রাধার ভ্রূভঙ্গী দর্শন ও কৃষ্ণের প্রতি তিরস্কার বাক্য শ্রবণ করার নিমিত্ত শুক-সারিকা- পক্ষিগণ সেখানে উপস্থিত হয়ে নিজেরাই আবার বাগ্যুদ্ধ বাধিয়ে দিলো। রাধা- কৃষ্ণ তাদের বাগযুদ্ধ শ্রবণ করে গৃহগমনাভিলাষে সেখান হতে বহির্গত হন। কৃষ্ণ তার কান্তা(পত্নী) শ্রীমতি রাধিকার অনুমতি নিয়ে গাভীবৃন্দের অভিমুখে গমন করেন। শ্রীমতি রাধা সখীগণসমভিব্যাহারে সূর্য্য পূজা করার জন্য সূর্য্য-গৃহে গমন করেন। . নারদীয় মহাপুরাণে উল্লেখ রয়েছে – কদাচিৎ তয়া সার্দ্ধ স্থিতস্য মুনিসত্তম কৃষ্ণস্য। বামভাগাৎ জাতো নারায়ণঃ স্বয়ম্।। রাধিকায়াশ্চ বামাংগান্মহালক্ষ্মীভূব হ। ততঃ কৃষ্ণো মহালক্ষ্মীং দত্ত্বা নারায়ণায় চ।। বৈকুন্ঠ স্থাপযামাস শশ্বত্পালনকর্মণি।। [ নারদীয় মহাপুরাণ, পূর্বভাগ, ৩।৮৩।১২-১৪ ] বঙ্গানুবাদ: হে মুনিসত্তম, কোনো এক সময় অর্ধাঙ্গিনী রাধা সহিত অবস্থানকালে কৃষ্ণের বামাঙ্গ থেকে নারায়ণ জাত হলো আর শ্রীমতি রাধিকার বামাঙ্গ হতে মহালক্ষ্মীর আবির্ভাব হলো। কৃষ্ণ তখন মহালক্ষ্মী নারায়ণকে প্রদান করলেন এবং বৈকুণ্ঠে স্থিতি প্রদান করে নিত্য পালনকার্যে নিযুক্ত করলেন। . স্কন্দপুরাণে উল্লেখ রয়েছে – বৃষভানুসুতাকান্তবিহারে কীর্ত্তনশ্রিয়া। সাক্ষাদিব সমাবৃত্তে সর্ব্বেহনন্যদৃশোহভবন।। [ স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুখন্ড, শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম, অধ্যায় ২ ৩১ ] বঙ্গানুবাদ: বৃষভানুর কণ্যা শ্রীমতি রাধিকার কান্ত(পতি) সাক্ষাৎ কৃষ্ণের বিহারভূমি কীর্ত্তনসমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ হলো এবং সকলেই যেন অনন্য নয়ন হয়ে সেই উৎসব দর্শন করিতে লাগিলেন। শিব পুরাণে বলা হয়েছে- কালবতীসুতা রাধা সাক্ষাদগোলোকবাসিনী। গুপ্তস্নেহানিবদ্ধা সা কৃষ্ণপত্নী ভবিষ্যতি।। [ শিব মহাপুরাণ, রুদ্রসংহিতা, পার্বতীখন্ড, অধ্যায় ২ শ্লোক ৪০; সনদকুমার উক্তি] বঙ্গানুবাদ: সাক্ষাৎ গোলকনিবাসিনী রাধা কলাবতীর কণ্যা হয়ে শ্রীকৃষ্ণের সহিত গোপণে স্নেহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ভবিষ্যতে কৃষ্ণপত্নী হবেন। . ব্রহ্মবৈবর্ত মহাপুরাণে উল্লেখ রয়েছে – স্বয়ং রাধা কৃষ্ণপত্নী কৃষ্ণবক্ষঃস্থলস্থিতা । প্রাণাধিষ্ঠাতৃদেবী চ তস্যৈব পরমাত্মনঃ।। [ ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখন্ড, অধ্যায় ৪৮, শ্লোক ৪৭ ] বঙ্গানুবাদ: শ্রীমতী রাধিকা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের পত্নীরূপে অবস্থিতা। নিরন্তর তিনি পরমব্রহ্ম কৃষ্ণের বক্ষঃস্থলে স্থিতি করেন, ফলতঃ সেই রাধা পরাৎপর কৃষ্ণের প্রাণাধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে নির্দিষ্টা আছেন। . ব্রহ্মবৈবর্ত মহাপুরাণে আরো উল্লেখ রয়েছে – তদা ব্রহ্মা তয়োর্মধ্যে প্রজ্বাল্য চ হুতাশনম্ । হরিং সংস্মৃত্য হবনং চকার বিধিনা বিধিঃ ॥উত্থায় শয়নাৎ কৃষ্ণ উবাস বহ্নিসন্নিধৌ । ব্ৰহ্মণোক্তেন বিধিনা চকার হবনং স্বয়ম্ ॥প্রণম্য চ হরিং রাধাং দেবানাং জনকঃ স্বয়ম্। [ ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, কৃষ্ণজন্মখণ্ড ১৫।১২৪-১২৬ ] বঙ্গানুবাদ: ব্রহ্মা ভক্তিপূর্ব্বক রাধাকৃষ্ণকে প্রণাম করলেন এবং তাঁদের মধ্যে অগ্নি প্রজ্বলিত করে শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করে বিবিধক্রমে হোম করতে লাগলেন । তখন কৃষ্ণ শয্যা হতে উত্থান করে অগ্নি সমীপে উপবেশনপূর্ব্বক ব্রহ্মোক্ত বিধিক্রমে স্বয়ং হোম করতে আরম্ভ করলেন। এরপর বেদকর্ত্তা ব্রহ্মা শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকাকে প্রণাম করলেন। . ব্রহ্মবৈবর্ত মহাপুরাণে আরো উল্লেখ রয়েছে – মূঢ়া রায়াণপত্নী ত্বাং বক্ষ্যন্তি জগতীতলে’ [ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, কৃষ্ণজন্মখন্ড, অধ্যায় ৩, শ্লোক ১০৩ ] বঙ্গানুবাদ: ভূতলে যারা মূঢ় (মূর্খ), তারাই শ্রীমতি রাধিকাকে রায়াণ(আয়ান) এর পত্নী বলে মনে করে। . ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে উল্লেখ রয়েছে – রাধাকৃষ্ণেতি দ্বেনাম সুস্মৃতোগোপ নন্দিনী। মহাপাপোপ পাপৌঘ কোটিশো যাস্তি সংক্ষয়ং। মৎসাযুজ্য পদমিতো মোদতে দেববৎ সদা।। [ ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, উত্তরখণ্ড, রাধাহৃদয় ১৩।৭৪ ] বঙ্গানুবাদ: শ্রীকৃষ্ণ বললেন, হে গোপনন্দিনী রাধে, রাধা-কৃষ্ণ এই দুুই নাম যে ব্যাক্তি স্মরণ করেন,মহাপাপ ও উপপাপ প্রভৃতি কোটিপাপ তাঁর বিনষ্ট হবে। মৃত্যুর পর ইহলোক ত্যাগ করে তিনি আমার ধাম (চিন্ময় জগতের গোলক বৃন্দাবন ধাম) প্রাপ্ত হয়ে দেবতার মতো পরমানন্দে দিন যাপন করবেন। শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণে উল্লেখ রয়েছে – অনয়ারাধিতো নূনং ভগবান হরিরীশ্বরঃ। যন্ নো বিহায় গোবিন্দঃ প্রীতো যামনয়দ্রহঃ।। [ শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ ১০।৩০।২৮] বঙ্গানুবাদ: এই বিশেষ গোপী নিশ্চয়ই
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু যে “স্বয়ং শ্রীহরি” শাস্ত্রে কোথায় বলা হয়েছে?
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু যে স্বয়ং শ্রীহরি, তার ৩২ টি প্রামাণিক শাস্ত্রীয় প্রমাণ: কি পন্ডিত, কি তপস্বী, কিবা গৃহী, যতি। চৈতন্য-বিমুখ যেই, তার নাই গতি।। [ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা ১২।৭২ ] কৃষ্ণভক্তিবিহীনানাং পাপ্মনা গ্রসিতাত্মনাম্ ॥ ৬০ ॥ কলৌ নষ্ট দৃশাং নৈব জনানাং কুত্রচিদ্ গতিঃ । ইতি মত্বা কৃপাসিন্ধুরংশেন কৃপযা হরিঃ ॥ ৬১ ॥ প্রচ্ছন্নো ভক্তরূপেণ কলাববতরিষ্যতি । ভুবং প্রাপ্তে তু গোবিন্দশ্চৈতন্যাখ্যো ভবিষ্যতি ॥ ৬২ ॥ তস্য কর্মাণি মনুজাঃ কীর্তযিষ্যন্তি কেচন । বহির্মুখা নমংস্যন্তে প্রচ্ছন্নং পরমেশ্বরম্ ॥ ৬৩।। গৌরাঙ্গো নাদগম্ভীরঃ স্বনামামৃতলালসঃ । দয়ালুঃ কীর্তনগ্রাহী ভবিষ্যতি সচীসুতঃ ॥ ৬৪ ॥ [ কৃষ্ণযামল তন্ত্র, অধ্যায় ২৮, শ্লোক ৬০-৬৪] অনুবাদ: কলিযুগ কৃষ্ণভক্তিবিহীন এবং লোকেদের পাপ দ্বারা গ্রস্থ, তাই কলিহত জীবের দুর্গতির কথা চিন্তা করে কৃপাসিন্ধু ভগবান স্বয়ং অবতীর্ণ হয়ে ভক্তরূপে নিজেকে প্রচ্ছন্নভাবে লীলা করবেন। পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে তিনি ‘চৈতন্য’ নামে বিখ্যাত হবেন এবং তাঁর কর্মাদি বিভিন্ন লোকেরা কীর্তন করবে। বহির্মুখ লোকেরাও সে প্রচ্ছন্ন পরমেশ্বরকে নমস্কার করবে। সে ভগবান ‘গৌরাঙ্গ‘ নিজ নামের অমৃত আস্বাদনের লালসায় সংকীর্তন ধর্ম প্রচারের জন্য ভবিষ্যতে শচীমাতার পুত্ররূপে আবির্ভূত হবেন। কৃষ্ণ নাহি মানে, তাতে দৈত্য করি মানি । চৈতন্য না মানিলে তৈছে দৈত্য তারে জানি।। [ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৮।৯ ] শ্লোকার্থ: যদি কেউ শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান বলে না মানে, তবে সে একটি দৈত্য। তেমনই, যে শ্রীচৈতন্যদেবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলে মানতে না চায়, তাকেও একটি দৈত্য বলেই জানতে হবে। ৩২ টি প্রামাণিক শাস্ত্রীয় প্রমাণ: প্রমাণ-(১) দিবিজা ভুবি জায়ধ্বং জায়ধ্বং ভক্তরূপিণঃ। কলৌ সঙ্কীর্তনারম্ভে ভবিষ্যামি শচীসুতঃ।। কৃতে জপৈ মংম প্রীতি স্ত্রেতায়াং হোম-কর্মভিঃ । দ্বাপরে পরিচর্য্যাভিঃ কলৌ সংকীর্ত্তনৈরপি ॥ ২৬॥ [ বায়ুপুরাণ,শেষখন্ড ১৪।২৮ ] [বারানশি চুম্বিকা এডিশান] অনুবাদ: হে দেবগণ, তোমরা সকলে ভক্তরূপ ধারণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে হরিনাম সঙ্কীর্তন আরম্ভ করো। তোমাদের সঙ্কীর্তনে আমি শচীগর্ভ হতে জন্মগ্রহণ করবো। সত্যযুগে জপ-ধ্যান, ত্রেতাযুগে হোম, দ্বাপর যুগে পূজাদি এবং কলিযুগে সংকীর্তনের দ্বারাই আমি প্রীত হই। . প্রমাণ-(২) তদাপ্যহং ভবিষ্যামি গঙ্গাদ্বারে কলের্ধুরি।। [ বায়ুপুরাণ ২৩।৫১] [নবভারত] অনুবাদ: তখন কলির প্রথমে আমি (ভগবান) গঙ্গাধারে আবির্ভূত হইব। . প্রমাণ-(৩) মহেন্দ্র তব যা পত্নী শচী নাম্না মহোত্তমা। দদৌ তস্যৈ বরং বিষ্ণুভবিতাস্মি সুতঃ কলৌ।। তদাজ্ঞয়া চ সা দেবীং পুরীং শান্তিময়ীং শুভাম্। গৌড়দেশে চ গঙ্গায়া কূলে লোকনিবাসিনীম্।। [ ভবিষ্যপুরাণ, দ্বিতীয়খণ্ড, ১৭।৬০,৬১ ] অনুবাদ: জীব বললেন- হে মহেন্দ্র, ভগবান বিষ্ণু আপনাকে বর দান স্বরূপ উত্তম শচী দিয়েছিলেন, আপনার আদেশে তিনি গৌড়দেশে গঙ্গাতীরে জন্ম লাভ করবে এবং আমি পুত্ররূপে কলিযুগে তোমার কাছে আবির্ভূত হব। . প্রমাণ-(৪) ভবিষ্যামি শচীপুত্রঃ কলৌ সংকীর্ত্তনাগমে। হরিনাম প্রদানেন লোকান্ সংতারয়াম্যহম।। [ ব্রহ্মযামলঃ তন্ত্র, ১।২১ ] অনুবাদ: কলিতে সংকীর্তন যজ্ঞের প্রারম্ভে শচীপুত্র রূপে আবির্ভূত হইয়া আমি হরিনাম প্রদান করত জনসমূহকে নিস্তার করিয়া থাকি। . প্রমাণ-(৫) অহমেব দ্বিজশ্রেষ্ঠ নিত্যং প্রচ্ছন্নবিগ্রহঃ। ভগবদ্ভক্তরূপেণ লোকান্ রক্ষামি সর্ব্বদা।।৩৫। [ বৃহন্নারদীয়পুরাণ ৫।৩৫ ] অনুবাদ: ভগবান বলিলেন,”হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ! আমিই ভগবানের ভক্তরূপে (ভক্তাবতার শ্রীচৈতন্য) দেহ গোপনপূর্ব্বক সর্ব্বদাই লোকসমূহের রক্ষা করি।” . প্রমাণ-(৬) কৃষ্ণবর্ণং ত্বিষাকৃষ্ণং সাঙ্গোপাঙ্গাস্ত্রপার্ষদম্। যজ্ঞৈঃ সংকীৰ্তনপ্রায়ৈজন্তি হি সুমেধসঃ ৷৷ [ শ্রীমদ্ভাগবত ১১।৫।৩২ ] অনুবাদ: যে পরমেশ্বর ভগবান ‘কৃষ’ ও ‘ণ’ শব্দাংশ দুটি নিরন্তর উচ্চারণ করেন, কলিযুগের বুদ্ধিমান মানুষেরা তাঁর উপাসনার নিমিত্ত সমবেতভাবে নাম-সংকীর্তন করে থাকেন। যদিও তাঁর গাত্রবর্ণ অ-কৃষ্ণ, তবুও তিনি স্বয়ং কৃষ্ণ। তিনি সর্বদা তাঁর পার্ষদ, সেবক, সংকীর্তনরূপ অস্ত্র ও ঘনিষ্ঠ সহচর পরিবৃত থাকেন। . প্রমাণ-(৭) উর্দ্ধাম্নায় তন্ত্রে গৌর মন্ত্র ও গৌর উপাসনা বিধি বর্ণিত আছে- শ্রী নারদ উবাচ। কৃষ্ণরূপেন ভগবান্ কলৌ পাপপ্রণাশকৃৎ। গৌররূপেন ভগবান্ ভাবিতঃ পূজিতস্তথা।। ওঁ গৌরায় নম ইত্যেষ মন্ত্রো লোকেষু পূজিতঃ। [ উর্দ্ধাম্নায় সংহিতা, ৩য় অধ্যায় ] অনুবাদ: শ্রী নারদ বললেন! শ্রীকৃষ্ণ নামের দ্বারা ভগবান পাপ সমূহ নাশ করেন, ও গৌর রূপে ভগবান পূজিত হন। ‘ওঁ গৌরায় নমঃ’– এই মন্ত্র দ্বারা তিনি সর্বলোক দ্বারা পূজিত হন। . প্রমাণ-(৮) পূণ্য ক্ষেত্রে নবদ্বীপে ভবিষ্যামি শচীসূতঃ। [ কৃষ্ণযামল তন্ত্র, ২৮।৬২,৬৩,৬৪,৬৫,৬৬ ] অনুবাদ: পূন্যক্ষেত্রে নবদ্বীপে আমি শচীদেবীর পুত্ররূপে আবির্ভূত হব। . প্রমাণ-(৯) শ্যামঞ্চ গৌরং বিদিতং দ্বিধা মহস্তবৈ সাক্ষাৎ পুরুষোত্তমোত্তম৷ গোলকধামাধিপতিং পরেশং পরাৎপরং ত্বাং শরণং ব্রজাম্যহম্।। [ গর্গসংহিতা,গোলকখণ্ড ১৬।২৭ ] অনুবাদ: হে সাক্ষাৎ পুরুষোত্তম! শ্যাম ও গৌর তোমার দ্বিবিধ তেজ, তুমি গোলোকধামপতি পরেশ পরাৎপর; আমি তোমার শরণ লইলাম। . প্রমাণ-(১০) গঙ্গায়া দক্ষিণেভাগে নবদ্বীপে মনোরমে। কলিপাপ বিনাশায় শচীগর্ভে সনাতনি।। জনিষ্যতি প্রিয়ে! মিশ্রপুরন্দরগৃহে স্বয়ম্। ফাল্গুনে পৌণমাস্যাঞ্চনিশায়াংগৌরবিগ্রহঃ।। [ বিশ্বসার তন্ত্র, উত্তরাখন্ড, ১১ পটল ] অনুবাদ: দেব দেবী পার্ব্বতীকে বলেছেন- হে প্রিয়ে! কলিকলুষ বিনাশের নিমিত্ত গঙ্গা দক্ষিণ তীরবর্ত্তী অতি মনোরম নবদ্বীপ গ্রামে ফাল্গুনী পূর্ণিমা নিশিতে মিশ্র পুরন্দর গৃহে শচীদেবীর গর্ভে স্বয়ং ভগবান গৌররূপে অবতীর্ণ হবেন। . (প্রমাণ-১১) সতত পরম দেবো, শ্রী শচীদেবী নন্দন,দ্বিনেত্র দ্বিভুজ গৌর, তপ্ত জাম্বুনদ প্রভা।। [ সতাভাতাতন্ত্র, ৫।৪১ ] অনুবাদ: তখন সেই পরম দেব, যিনি শচীদেবীর পুত্র, যার দুই চক্ষু, দুই হাত, যার প্রভা তপ্ত জাম্বুনদের ন্যায়। . শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিলো ‘বিশ্বম্ভর’। তাঁর মাতার নাম শচীদেবী, তাই তাকে ‘শচীসূত’ নামেও ডাকা হয়। তাঁর গাত্রবর্ণ তপ্ত স্বর্ণের ন্যায় গৌরবর্ণ হওয়ায় তাঁকে ‘গৌর’, ‘হেমাঙ্গ’, ‘গৌরাঙ্গ’ ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। প্রমাণ-(১২) বিশ্বম্ভর বিশ্বেন মা ভরসা পাহি স্বাহা। [ অথর্ববেদ, ২য় কাণ্ড, ৩য় অনুবাক, ৬ সূক্ত, ৫ মন্ত্ৰ ] অনুবাদ: হে বিশ্বম্ভর,সকল পোষণ শক্তির দ্বারা আমাকে মৃত্যু থেকে রক্ষা কর। স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে আহুতি দিচ্ছি। . প্রমাণ-(১৩-১৫) ঋগ্বেদ সংহিতা,(১।১৬।৫), (৮।৪।৩), (৪।৫৮।২)- এই সকল মন্ত্রে স্পষ্ট ভাবে পরমব্রহ্মের “গৌর” নাম রয়েছে। . প্রমাণ-(১৬) চৈতন্যরূপশ্চৈতন্যশ্চেতনাগুণবর্জ্জিতঃ। অদ্বৈতাচারনিপুণোহদ্বৈতঃ পরমনায়কঃ।। [ নারদপঞ্চরাত্র,চতুর্থরাত্র, ৮।১৫৪ ] অনুবাদ: চৈতন্যরূপ, চৈতন্য, চেতনাগুণবর্জ্জিত, অদ্বৈতাচারনিপুণ, অদ্বৈত, পরমনায়ক। . প্রমাণ-(১৭) মহাপ্রলয়কারী চ শচীসূতজয়প্রদঃ।। [ নারদপঞ্চরাত্র,চতুর্থরাত্র, ৮।১৫৪ ] অনুবাদ: মহাপ্রলয়কারী, শচীসূত, জয়প্রদ। . প্রমাণ-(১৮) শচীসুতঃ জয়প্রদঃ।। [ গৌতমীয় তন্ত্র,গোপালসহস্রনাম স্ত্রোত্র ] অনুবাদ: শচীপুত্র জয় যুক্ত হোন। . প্রমাণ-(১৯) নমো ভুম্যাদিরূপায় নমশ্চৈতন্যরূপিণে।৫৯। [ বৃহন্নারদীয়পুরাণ ৪।৫৯ ] অনুবাদ: পৃথিবী প্রভৃতি সমস্ত তোমার রূপ, তুমি চৈতন্য স্বরূপ, তোমাকে নমস্কার। . পদ্মপুরাণের উত্তরখন্ডে শ্রীহরিকে ‘চৈতন্য’, ‘বিশ্বম্ভর’ ইত্যাদি নামে সম্বোধন করা হয়েছে যা চৈতন্য মহাপ্রভুকেই নির্দেশ করে। যথা- প্রমাণ-(২০) পুরাণপুরুষঃ প্রত্যকচৈতন্যঃ পুরুষোত্তমঃ।। [ পদ্মপুরাণ,উত্তরখণ্ড ৭১।১৩১] অনুবাদ: পুরাণপুরুষ, প্রত্যকচৈতন্য, পুরুষোত্তম। . প্রমাণ-(২১) বিশ্বম্ভরস্তীর্থপাদঃ পুণ্যশ্রবণকীৰ্ত্তনঃ। [ পদ্মপুরাণ,উত্তরখণ্ড ৭১।১৫৬ ] অনুবাদ: বিশ্বম্ভর, তীর্থপাদ, পুণ্যশ্রবণকীৰ্ত্তন। . প্রমাণ-(২২) মহাভারত-উক্ত প্রমাণ- (ইতিহাস) আনুশাসনিক-পৰ্বনি (৬নং)দানধর্মে-ভীষ্ম-যুধিষ্ঠির সংবাদে বিষ্ণুসহস্রনাম প্রসঙ্গে- সুবর্ণবর্ণো হেমাঙ্গো বরাঙ্গশ্চন্দনাঙ্গদী। ৯২।। সন্ন্যাসকৃচ্ছমঃ শান্তো নিষ্ঠাশান্তি-পরায়ণঃ।।৭৫।। [ মহাভারত, অনুশাসন পর্ব, দানধর্ম, অধ্যায় ১৪৯।৯২,৭৫ ] অনুবাদ : হরিনাম প্রচার উপলক্ষে “কৃষ্ণ” এই উত্তম বর্ণদ্বয় সর্বদা বর্ণন করেন বলিয়া তাঁহার একটি নাম সুবর্ণবর্ণ; তাঁহার অঙ্গ স্বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল বলিয়া তাঁহার একটি নাম হেমাঙ্গ; সাধারণ লোক অপেক্ষা তাঁহার অঙ্গ শ্রেষ্ঠ বলিয়া তাঁহার একটি নাম বরাঙ্গ; চন্দনের অঙ্গদ (কেয়ূর) পরিধান করেন বলিয়া তাঁহার নাম চন্দনাঙ্গদী; সন্ন্যাসগ্রহণ করেন বলিয়া তাঁহার নাম সন্ন্যাসকৃৎ; ভগবন্নিষ্ঠ-বুদ্ধি বলিয়া তাঁহার নাম শম; অচঞ্চল-চিত্ত বলিয়া তাঁহার নাম শান্ত; কৃষ্ণভক্তিতে নিষ্ঠা ও নিবৃত্তিপরায়ণ বলিয়া তাঁহার নাম নিষ্ঠাশান্তি-পরায়ণ। এই সকল নামে অভিহিত হওয়ায় কলিতে গৌরাঙ্গাবতার সূচিত হইয়াছে। . প্রমাণ-(২৩) স হোবাচ । রহস্যং তে বদিষ্যামি – জাহ্নবীতীরে নবদ্বীপে গোলোকাথ্যে ধাম্নি গোবিন্দো দ্বিভুজো গৌরঃ সর্বাত্মা মহাপুরুষো মহাত্মা মহাযোগী
তুলসীকাষ্ঠের প্রদীপ নিবেদনের মহিমা
তুলসীকাষ্ঠের প্রদীপ নিবেদনের মহিমা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রদীপ নিবেদনের অনন্ত মহিমা অসংখ্য শাস্ত্রে উল্লিখিত রয়েছে। তুলা, ঘি, তিল, সরিষা বা কুসুম্ভ তেল, কর্পূর দ্বারা প্রদীপ নিবেদন ভগবানের অত্যন্ত প্রিয়। কিন্তু তুলসীকাষ্ঠ দ্বারা নিবেদিত প্রদীপ ভগবানের অত্যন্ত প্রিয়, কেননা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সব থেকে প্রিয় উপকরণ হচ্ছেন কৃষ্ণপ্রিয়া তুলসী। শাস্ত্রে কি নির্দেশনা রয়েছে? পদ্মপুরাণে বর্ণনা করা হয়েছে, যদি কেউ শুষ্ক তুলসী কাষ্ঠের মাধ্যমে ভগবানকে শ্রীকৃষ্ণকে প্রদীপ নিবেদন করে, তাহলে সাধারণ প্রদীপ নিবেদনের চেয়ে ভগবান এক্ষেত্রে লক্ষগুণ বেশি সন্তুষ্ট হন। প্রহ্লাদসংহিতায় উল্লেখ আছে, তুলসীপাবকেনৈব দীপং যঃ কুরুতে হরেঃ। দীপলক্ষসহস্রাণাং পুণ্যং স্তবতি দৈত্যজ॥ অনুবাদ: হে দৈত্যকুমার প্রহ্লাদ, যিনি তুলসীকাষ্ঠের প্রদীপ দ্বারা শ্রীহরিকে আরতি নিবেদন করেন, তার একটি দীপ দানেই শ্রী হরি এক সহস্র লক্ষ (১০ কোটি) প্রদীপ নিবেদনের সমান সন্তুষ্ট হন। অর্থাৎ সহস্র লক্ষ দীপ নিবেদন করলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যতটা সন্তুষ্ট হন, একটি তুলসীকাঠের প্রদীপ নিবেদন করলে তার থেকেও অধিক সন্তুষ্ট হন। কেন করা উচিত? শ্রীমদ্ভাগবত (২।৩।১০)-এ বলা হয়েছে, সকাম, নিষ্কাশন, মোক্ষকামী সকলেরই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করা উচিত। অতএব কোনো ফল লাভের আশায় হোক, অথবা নিষ্কামভাবে কেবল কৃষ্ণের সন্তুষ্টির জন্য হোক, কৃষ্ণের আদেশে সকলেরই তুলসীকাষ্ঠ দ্বারা প্রদীপ নিবেদন করা উচিত। কে বা কারা করতে পারে? তুলসীকাঠের প্রদীপ নিবেদন করা ভগবানকে তুলসী নিবেদনেরই মতো। অগস্ত্য সংহিতায় বলা হয়েছে- ন তস্য নরকক্লেশো যোঽর্চ্চয়েত্তুলসীদলৈঃ। পাপিষ্ঠো বা অপাপিষ্ঠঃ সত্যং সত্যং না সংশয়॥ অনুবাদ: মহা পাপাত্মা ব্যক্তিও শ্রীহরিকে তুলসী নিবেদন করলে তাঁকে আর নরকযাতনা লাভ করতে হয় না। শ্রীহরির কৃপায় সে ধীরে ধীরে ধর্মাত্মায় পরিণত হয়। অতএব, যেকোনো ব্যক্তি, সে আমিষাহারী, অশৌচ হোক, অস্নাত হোক, যবন হোক বা অন্যান্য পাপাচারে রত থাকুক, সেও ভগবানকে তুলসী নিবেদনের অধিকারী। তাই সকলেই তুলসীপত্র, তুলসী মঞ্জরী, তুলসীকাঠের প্রদীপ নিবেদন করার অধিকারী। সারাবছরই প্রদীপ নিবেদন মঙ্গলময়। দামোদর মাস, পুরুষোত্তম মাস, বৈশাখ মাস, মাঘ মাসে অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আর বিশেষত এই সব মাসে সকলেরই বেশি বেশি কৃষ্ণ সেবা করা উচিত। তাই সকলেই এই মাসে তুলসী কাঠের প্রদীপ নিবেদন করতে পারবেন। কীভাবে তৈরী করবেন তুলসীকাঠের প্রদীপ? ১. প্রথমে শুকনো তুলসীবৃক্ষ খোঁজ করতে হবে। অনেকেরই অভিজ্ঞতা রয়েছে অনেকসময় তুলসীবৃক্ষ শুষ্ক হয়ে যায়, সব পাতা ঝরে যায়, তুলসী দেহত্যাগ করেন, সেই শুষ্ক বৃক্ষ জলে ভাসিয়ে বা মাটিতে পুতে দেয়া হয়। প্রদীপের জন্য এরকম শুষ্ক তুলসী সংগ্রহ করতে হবে। যদি তাজা বৃক্ষ থেকে কাঠ সংগ্রহ করা হয়, সেটাতে অপরাধ হয়ে হিতে বিপরীত হবে! তাই এখন থেকে শুকনো তুলসী বৃক্ষ যত্ন করে সংরক্ষণ করবেন। ২. শুকনো তুলসীর ডাল ধুয়ে শুঁকিয়ে নিতে পারেন। ৩. শুকনো ডাল গুলো ৬ বা ৭ ইঞ্চি করে কেটে নিতে হবে। (আরো বড় কাটা যেতে পারে, কিন্তু বেশি ছোট কাটা হলে প্রদীপের আগুনের আঁচ হাতে লাগতে পারে) ৪. এবার তুলা নিয়ে একেকটি ডালে সমানভাবে পেচাতে হবে। সবগুলো ডালে তুলো পেচিয়ে এভাবে সলতে বানিয়ে রেখে দিতে পারেন। ৫. প্রদীপ নিবেদনের আগে তুলা পেচানো তুলসীর ডালের সলিতাগুলো ঘিয়ে ডুবিয়ে তারপর অতিরিক্ত ঘি সরিয়ে দিয়ে সলিতাগুলোর মাথায় কর্পূর লাগাতে হবে। ৬. এরপর কর্পূরে আগুন জ্বালালে আস্তে আস্তে পুরো সলিতাটিয় জ্বলে উঠবে, সেক্ষেত্রে আগুন জ্বালানোর শুরু থেকেই প্রদীপ নিবেদন শুরু করা উচিত। ৭. নতুনদের জন্য সতর্কতা হিসেবে দামোদর-প্রদীপ-নিবেদনের আগেই একদিন সলিতা তৈরি করে প্রদীপ নিবেদন করে চেষ্টা করে দেখতে পারেন, সলিতার জন্য তুলসী কাঠ আরো বড় করে কাটা লাগবে কীনা, বা তুলা আরো বেশি পেচাতে হবে কীনা, ঘি আরো অধিক লাগবে কীনা ইত্যাদি। প্রয়োজনে প্রদীপের মধ্যেও তুলসীকাঠের সলিতাগুলো নিয়ে নিবেদন করতে পারেন। ৮. আরতি নিবেদনের জন্য, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীনিতাইগৌর, শ্রীনৃসিংহদেব, শ্রীবিষ্ণুকে চরণে চারবার, উদরে দুইবার, মস্তকে তিনবার এবং সর্বাঙ্গে সাতবার প্রদীপ নিবেদন করতে হয়। আর, শ্রীমতী রাধারাণী, শ্রীলক্ষ্মীদেবী, শ্রীতুলসীদেবীকে সর্বাঙ্গে সাতবার প্রদীপ নিবেদন করা উচিত। শ্রীরাধাকৃষ্ণের পর শ্রীজগন্নাথ-বলদেব-সুভদ্রাকে (প্রত্যেককে সাতবার করে), এরপর শ্রীনৃসিংহদেব ও তারপর শ্রীনিতাইগৌরকে প্রদীপ নিবেদন করতে হয়। এরপর তুলসীদেবীকে নিবেদনের পর শ্রীগুরুপরম্পরাকে ভগবৎপ্রসাদরূপে মুখমণ্ডলে সাতবার বা পাঁচবার নিবেদন করতে হবে। নিজে তুলসীকাঠের সলিতার প্রদীপ নিবেদনের মহিমা জেনে ভগবানকে নিবেদন করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিবিধান করুন, অন্যের নিকট এই বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে উৎসাহিত করে তার ও আপনার নিজের ভগবানকে আরো অধিক সন্তুষ্ট করার জগৎমঙ্গলময় সুযোগ গ্রহণ করুন। ।। হরেকৃষ্ণ ।। [ বি:দ্র: স্বধর্মম্-এর অনুমোদন ব্যাতীত এই গবেষণামূলক লেখার কোনো অংশ পুনরুৎপাদন, ব্যবহার, কপি পেস্ট নিষিদ্ধ। স্বধর্মম্-এর সৌজন্যে শেয়ার করার জন্য উন্মুক্ত ] নিবেদক- ° স্বধর্মম্: প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন °