শাস্ত্রে কেন বিষ্ণু ও শিবকে অভেদ বলা হয়েছে?!

image_2024-04-29_121235458

শাস্ত্রে কেন বিষ্ণু ও শিবকে অভেদ বলা হয়েছে?! শাস্ত্রে যেমন গুরুকে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর বলা হয়েছে, শাস্ত্রে যেমন অতিথিকে নারায়ণ বলা হয়েছে, শাস্ত্রে যেমন ব্রাহ্মণকে সাক্ষাৎ বিষ্ণু বলা হয়েছে, শাস্ত্রে যেমন সন্ন্যাসীকে নারায়ণতুল্য বলা হয়েছে, ………..ঠিক তেমনি শিবজী এ জড়জগতে ভগবান বিষ্ণুর প্রতিনিধি রূপে কার্যনির্বাপন করেন, তাই তাকে শ্রীহরির সাথে অভেদ বলা হয়েছে৷ অনেকটা এরকম, আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী যদি প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতে আসেন, তবে তাকে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সমতুল্য মর্যাদা দেওয়া হয়। কারণ তিনি প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধিত্ব করছেন। শ্রীল জীবগোস্বামিপ্রভু প্রমুখ বৈষ্ণবাচার্য্যগণ লিখিয়াছেন- “শুদ্ধভক্তাঃ শ্রীগুরোঃ শ্রীশিবস্থ্য চ ভগবতা সহ অভেদদৃষ্টিং তং প্রিয়তমত্বেনৈব মন্যন্তে।” – ভক্তি সন্দর্ভ ২১৪। অর্থাৎ, “যেহেতু শ্রীগুরু ও শ্রীশিবের ভগবানের অতি প্রিয়তম স্বরূপ, তাই শুদ্ধভক্তগণ ভগবানের সাথে তাদের অভেদ দৃষ্টিতে জানেন।” স্কন্দপুরাণেও বলা হয়েছে- বাসুদেবস্য ভক্তস্য ন ভেদো বিদ্যতেহনয়োঃ। বাসুদেবস্য যে ভক্তাস্তেষাং বক্ষ্যামি লক্ষণম।। [স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুখন্ড-পুরুষোত্তমমাহাত্ম্যম, ১০।৯৫] অনুবাদ: বাসুদেব ও তাঁর ভক্তের মধ্যে কিছুমাত্র ভেদ নেই। ভক্তের সেবা করলেই বাসুদেবের সেবা হয়। যথা বিষ্ণুস্তথাচায়ং নান্তরং বর্ত্ততে ক্বচিৎ। ইতি জ্ঞাত্বা তু ভো বৎস সর্ব্বদা পূজয়েদবুধঃ।। [পদ্মপুরাণ, উত্তরখন্ড, ৬৮।১৯] বঙ্গানুবাদ: যেমন বিষ্ণু, তেমনই বৈষ্ণব, উভয়ের ভেদ কোথাও নেই। বৎস! ইহা বুঝিয়া বিজ্ঞগণ সর্বদা বৈষ্ণবের পূজা করিবেন। সমস্ত শাস্ত্রে ঘোষিত হয়েছে, শিবের তুল্য শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব আর নেই: ‘ বৈষ্ণবানা যথা শম্ভু’ – শম্ভুই সর্বশ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব( শ্রীমদ্ভাগবতম ১২।১৩।১৬) ‘বৈষ্ণবানাং যথা রুদ্র’ – রুদ্রের সমান বৈষ্ণব নেই(স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুখন্ড, বেঙ্কটাচলমাহাত্ম্যম ১৭।১৫) “শঙ্করের সমান কোনো বৈষ্ণব নেই” (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, ব্রহ্মখন্ড ১১।১৬) ”বিষ্ণুই সর্বেশ্বর ও সর্ব দেবোত্তম। শিব হলেন আদিগুরু।”(নারদপঞ্চরাত্র ৪।৩।২১০)  সদাশিব স্বয়ং ‘রাধাকৃষ্ণ যুগল” মন্ত্রে দীক্ষিত। (পদ্মপুরাণ পাতালখন্ড অধ্যায় ৫১) কিন্তু একটা বিষয় কি জানেন তো, আজকাল পিডিএফ পড়ুয়া সাধারণ মানুষ শাস্ত্র সম্পূর্ণ না পড়ে মাঝখান থেকে একটা দুইটা বাক্য দেখেই লাফিয়ে উঠে। ওসব অতি পন্ডিত বাঁদরেরা তাই শাস্ত্রের প্রকৃত অর্থ না জেনে দোষারোপ করে। শাস্ত্র বিচার করার ক্রাইটেরিয়া জানতে হয়। কোন শাস্ত্রের মূল সিদ্ধান্ত কি তা বিচারের জন্য সবচেয়ে সহজ ক্রাইটেরিয়া হলো সে শাস্ত্রের শুরুর ও শেষের বাক্য পর্যালোচনা করে। বৃহন্নারদীয় পুরাণের একেবারে প্রথম শ্লোকগুলোতেই বলা হয়েছে শিবজী শ্রীকৃষ্ণের অংশমাত্র। দেখুন- “কমলার প্রীতিভাজন পরম প্রভু প্রভূত-করুণাসম্পন্ন বৃন্দাবনবিহারী পরমানন্দস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা করি। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর প্রভৃতি যাঁর অংশ, ত্রিভুবনের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়-কর্তা, সেই পরমবিশুদ্ধ চিৎস্বরূপ আদিদেব শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করি।” [ বৃহন্নারদীয়পুরাণ,অধ্যায় ১, শ্লোক ১-২ ] অতএব, শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণ, শিব তাঁর অংশ। অংশ কখনো পূর্ণ হয় না। ব্রহ্মসংহিতায় ব্রহ্মা বলেছেন, শ্রীকৃষ্ণের বিকার হলেন শিব। দুধ থেকে যেরূপ দই হয়, কিন্তু দই থেকে দুধ হয় না, ঠিক একইভাবে শ্রীকৃষ্ণ থেকে শিবের প্রকাশ, শিব হতে কৃষ্ণ হতে পারে না। শ্রীশিব যেহেতু পরম বৈষ্ণব, তাই বিষ্ণু-বৈষ্ণব অভেদ জ্ঞানে তাকে অভেদ বলা হয়েছে, ঠিক যেরূপে গুরুকে পরমব্রহ্ম বলা হয়, অতিথিকে নারায়ণ বলা হয় ইত্যাদি। ।।হরে কৃষ্ণ।। ।।হর হর শম্ভু।।

কৃষ্ণপত্নী রাধিকার সন্ধানে (পর্ব-১): ‘রাধা-কৃষ্ণের গান্ধর্ব বিবাহ’

image_2024-04-28_173104254

ভারতের উত্তর প্রদেশে মথুরা জেলার বৃন্দাবন গ্রামের ভান্ডীর বনে ‘শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ বিবাহস্থলী’ নামক বিখ্যাত মন্দির আছে। এ মন্দিরের বিশেষত্ব হলো- এখানে শ্রী রাধাকৃষ্ণকে স্বকীয়া ভাবে বর-বধূরূপে পূজা করা হয়। মথুরামন্ডলে বৃন্দাবনে ‘বেণু-কূপ’ নামক এক প্রসিদ্ধ কুয়ো রয়েছে যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজের বেণু দ্বারা প্রকট করেছিলেন। এ বেণু-কূপের নিকটে একজোড়া বিরাট ভান্ডীর বটবৃক্ষ হয়েছে। এ বটবক্ষের নিচে শ্রীরাধাকৃষ্ণের ‘গান্ধর্ব” বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিলো এবং এ বিবাহের পৌরহিত্য করেছিলেন স্বয়ং লোকপিতা ব্রহ্মা। বর্তমানে সে বটবৃক্ষদ্বয়ের নিচে ‘রাধাকৃষ্ণ বিবাহস্থলী’ নামক মন্দিরটি রয়েছে। প্রতি বছর ‘ব্যাহুলা উৎসব’ এর সময় এ মন্দিরে শ্রীরাধাকৃষ্ণের বিবাহ মহাধূমধামে উৎযাপন করা হয় এবং এ স্থানটি বৃন্দাবনে তীর্থযাত্রীগণের আকর্ষণের অন্যতম কারণ। এ মন্দির ছাড়াও বৃন্দাবনে ‘শ্রী রাধাবল্লভ লাল মন্দির’ সহ বেশ কয়েকটি মন্দিরে এবং বৃন্দাবন ছাড়াও দক্ষিণভারতের ‘কাঞ্চি কামকোটি পীঠ’ প্রভৃতিতে রাধাকৃষ্ণের গান্ধর্ব বিবাহ উৎসবটি পালিত হয়। সমস্ত ভারতজুড়ে রাধাকৃষ্ণ মন্দির সমূহে বছর বিশেষ বিশেষ সময়গুলোতে বৈবাহিক শৃঙ্গার করা হয়। রাধাকৃষ্ণের এ গান্ধর্ব্ব বিবাহের বর্ণনা একাধিক প্রামাণিক শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে এবং বৈষ্ণব আচার্যগণও তাঁদের নানা লেখনিতেও এর বর্ণনা করেছেন। নিম্নে ‘শ্রীব্রহ্মবৈবর্ত মহাপুরাণ’ ও ‘গর্গসংহিতা’-এর আলোকে এ বিবাহের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হলো- শ্বেত বরাহকল্পের ২৮ তম চতুর্যুগে ব্রজেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র নন্দব্রজে আবির্ভূত হন এবং বসুদেবের কূলগুরু শ্রীগর্গাচার্য্য গোকূলে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের নামকরণ করেন। শ্রীকৃষ্ণের নামকরণ শেষে গর্গমুনি মথুরা নগরে ফিরার সময় তার সাথে বৃষভানু রাজের সাক্ষাৎ হয় এবং গর্গাচার্য্যকে তিনি শ্রীমতি রাধিকার বিবাহের জন্য শ্রেষ্ঠ পুরুষের সন্ধান দিতে বললে মুনি গর্গাচার্য্য ভবিষ্যতবাণী করেন, ভবিষ্যতে লোকপিতা ব্রহ্মা রাধাকৃষ্ণের বিবাহ করাবেন। এরপর একদিন নন্দ মহারাজ ছোটশিশু কৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে নন্দগ্রামের অনতিদূরে গোচারণে যান। শ্রীকৃষ্ণ তখন এক অদ্ভূত লীলা প্রদর্শনের মনস্থির করলেন। হঠাৎ প্রবল ঝড় ও বজ্র-বিদ্যুৎ সম্পাত শুরু হলো। নন্দ মহারাজ চিন্তিত হলেন – পুত্রকে সামলাবেন নাকি গাভীদের রক্ষা করবেন। কৃষ্ণও ভীত হওয়ার ভান করে পিতা নন্দের গলা জড়িয়ে ধরলেন। এ সময় নন্দ শ্রীমতি রাধিকাকে নিকটে আসতে দেখে বিস্মৃত হলেন। কৃষ্ণের নামকরণের সময় গর্গাচার্য্য নন্দ মহারাজকে শ্রীমতি রাধিকার গুণমহিমা কীর্তন করেছিলেন এবং রাধাকৃ্ষ্ণের নিত্য সম্পর্ক অবগত করিয়েছিলেন। নন্দ সজল নয়নে শ্রীমতি রাধিকার স্তব-স্তুতি করলেন এবং বালক শ্রীকৃষ্ণকে শ্রীমতি রাধিকার হাতে অর্পণ করে অনুরোধ করলেন, তিনি যেন কৃষ্ণকে যশোদার নিকট পৌঁছে দেন যাতে করে নন্দ মহারাজ গরুদের গোয়ালে নিয়ে যেতে পারেন নির্বিঘ্নে। রাধিকা নন্দের এ অনুরোধে সম্মত হয়ে কৃষ্ণকে তুলে নিয়ে গোকূলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন এবং পথিমধ্যে যমুনা তীরে একটি মনোজ্ঞ কুঞ্জবিথীকায় পৌঁছালেন। হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন, শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্নিহিত হয়েছেন এবং তখন তিনি কৃ্ষ্ণকে খুঁজতে আরম্ভ করেন। অকস্মাৎ তাঁর সামনে শ্রীকৃষ্ণ প্রকট হলেন নবযৌবনধর ষোল বছরের কিশোর রূপে এবং তিনি মিষ্টিবাক্যে রাধিকার চিত্তহরণ করতে লাগলেন। কিন্তু শ্রীমতি রাধিকা শ্রীকৃষ্ণের সাথে আসন্ন বিচ্ছেদের কথা স্মরণ করে দুঃখিত ছিলেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ মনে মনে ব্রহ্মাকে স্মরণ করলেন। শ্রীকৃষ্ণ স্মরণ মাত্র ব্রহ্মা সত্যলোক হতে সেখানে উপস্থিত হয়ে শ্রীমতি রাধিকাকে অগ্রে অর্চন করে শ্রীকৃষ্ণের চরণবন্দনা করলেন। পূর্বে ব্রহ্মা পুষ্করতীর্থে ৬০ হাজার বছর তপস্যার ফলস্বরূপ এক্ষণে শ্রীমতি রাধিকার চরণযুগল দর্শনের সৌভাগ্য লাভ করেন। তিনি মুহুর্মুহু শ্রীমতি রাধিকার স্তব স্তুতি করলে শ্রীমতি রাধিকা তুষ্ট হয়ে তাকে নিজ অহৈতুকী ভক্তি প্রদান করলেন। যদিও রাধা-কৃষ্ণ পরাৎপর ও প্রীতিযুক্ত দম্পতি এবং পরস্পর অনুরূপ, তথাপি লোকব্যবহার রক্ষার জন্য ব্রহ্মা শ্রীরাধাকৃষ্ণের গান্ধর্ব বিবাহের আয়োজন করলেন এবং নিজে সে বিবাহের পুরোহিত হলেন।গগনমার্গে সমস্ত দেবদেবীগণ এ গান্ধর্ব বিবাহের সাক্ষী হলেন। শ্রীব্রহ্মবৈবর্ত মহাপুরাণে নারায়ণ ঋষি রাধাকৃষ্ণের বিবাহের বর্ণনা এরূপে করেন- তদা ব্রহ্মা তয়োর্মধ্যে প্রজ্বাল্য চ হুতাশনম্ ।হরিং সংস্মৃত্য হবনং চকার বিধিনা বিধিঃ॥উত্থায় শয়নাৎ কৃষ্ণ উবাস বহ্নিসন্নিধৌ।ব্ৰহ্মণোক্তেন বিধিনা চকার হবনং স্বয়ম্॥প্রণম্য চ হরিং রাধাং দেবানাং জনকঃ স্বয়ম্। তাঞ্চ তং কারয়ামাস সপ্তধা চ প্রদক্ষিণম্॥পুনঃ প্রদক্ষিণং রাধাং কারয়িত্বা হুতাশনম্।প্রণম্য চ পুনঃ কৃষ্ণং বাসয়ামাস তাং বিধিঃ।।তস্যা হস্তঞ্চ শ্রীকৃষ্ণং গ্রাহয়ামাস তদ্বিধিঃ।বেদোক্তসপ্তমন্ত্রাংশ্চ পাঠয়ামাস মাধবম্॥সংস্থাপ্য রাধিকাহস্তং হরের্বক্ষসি বেদবিৎ।শ্রীকৃষ্ণহস্তৎ রাধায়াঃ পৃষ্ঠদেশে প্রজাপতিঃ।স্থাপয়িত্বা চ মন্ত্রাংশ্চ পাঠয়ামাস রাধিকা॥পারিজাতপ্রসূনানাং মালামাজানুলম্বিতাম্।শ্রীকৃষ্ণস্য গলে ব্রহ্মা রাধাদ্বারা দদৌ মুদা॥প্ৰণময্য পুনঃ কৃষ্ণং রাধাঞ্চ কমলোদ্ভবঃ।রাধাগলে হরিদ্বারা দদৌ মালাং মনোরমাম্॥পুনশ্চ বাসয়ামাস শ্রীকৃষ্ণং কমলোদ্ভবঃ।তদ্বামপার্শ্বে রাধাঞ্চ সম্মিতাং কৃষ্ণচেতসম্॥পুটাঞ্জলিং কারয়িত্বা মাধবং রাধিকাং বিধিঃ। পাঠয়ামাস বেদোক্তান্ পঞ্চ মন্ত্রাংশ নারদ॥প্ৰণময্য পুনঃ কৃষ্ণং সমর্প্য রাধিকাং বিধিঃ।কন্যকাঞ্চ যথা তাতো ভক্ত্যা তস্থৌ হরেঃ পুরঃ।। [ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, কৃষ্ণজন্মখন্ড, অধ্যায় ১৫, শ্লোক- ১২৩-১৩৩ ] বঙ্গানুবাদ: বিধাতা ভক্তিপূর্ব্বক রাধাকৃষ্ণকে প্রণাম করিলেন এবং তাঁহাদের মধ্যে অগ্নি প্রজ্বলিত করে শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করে বিবিধক্রমে হোম করতে লাগলেন । তখন কৃষ্ণ শয্যা হতে উত্থান করে অগ্নি সমীপে উপবেশনপূর্ব্বক ব্রহ্মোক্ত বিধিক্রমে স্বয়ং হোম করতে আরম্ভ করলেন। বেদকর্ত্তা ব্রহ্মা শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকাকে প্রণাম করে তাঁদেরকে সপ্তবার প্রদক্ষিণ করালেন। পুনর্ব্বার রাধিকাকে অগ্নি প্রদক্ষিণ করিয়ে তাঁকে এবং কৃষ্ণকে প্রণাম করে দেবীকে উপবেশন করালেন। এরপরে ব্রহ্মা রাধিকার হস্ত কৃষ্ণকে ধরতে বললেন, ভগবান্ সেই হস্ত ধারণ করলে তাঁকে বেদোক্ত সপ্ত মন্ত্র পাঠ করালেন। ব্রহ্মা রাধিকার হস্ত কৃষ্ণের বক্ষঃস্থলে ও কৃষ্ণের হস্ত রাধিকার পৃষ্ঠদেশে স্থাপন করে রাধিকাকে মন্ত্রসমূহ পাঠ করালেন, এবং আজানুলম্বিত পারিজাতকুসুমের মালা রাধাদ্বারা কৃষ্ণগলে অর্পণ করালেন। এরপরে কমলোদ্ভব , কৃষ্ণ ও রাধিকাকে প্রণাম করে কৃষ্ণদ্বারা রাধিকা গলেও মনোহর মালা প্রদান করলেন। কমলোদ্ভব কৃষ্ণকে বসিয়ে তাঁর বামপার্শ্বে কৃষ্ণের চিত্তস্বরূপা সস্মিতা রাধিকাকে উপবেশন করালেন এবং হে নারদ! রাধা-কৃষ্ণকে হস্তজোড় করিয়ে, বেদোক্ত পঞ্চম মন্ত্র পাঠ করালেন । অনন্তর কৃষ্ণকে রাধিকা দ্বারা প্রণাম করালেন। পিতা যেরূপ কণ্যাকে প্রদান করে, সেইরূপ বিধাতা ব্রহ্মাও রাধিকাকে কৃষ্ণের হাতে সমর্পণ করে তাঁদের পুরোভাগে অবস্থান করিতে লাগলেন। গর্গসংহিতায় দেবর্ষি নারদ এ গান্ধর্ব বিবাহের বর্ণনা করেছেন এভাবে- শ্রীনারদ উবাচ তদা স উত্থায় বিধির্হুতাশনং প্রজাল্য কুণ্ডে স্থিতয়োন্তয়োঃ পুরঃ।শ্ৰুতেঃ করগ্রাহবিধিং বিধানতো বিধায় ধাতা সমবন্বিতোঽভবৎ।।স বাহয়ামাস হরিঞ্চ রাধিকাং প্রদক্ষিণং সপ্ত হিরণ্যরেতসঃ।ততশ্চ তৌ তে প্ৰণময্য বেদবিত্তৌ পাঠয়ামাস চ সপ্তমন্ত্রকম্।।ততো হরের্ব্বক্ষসি রাধিকায়াঃ করঞ্চ সংস্থাপ্য হরেঃ করং পুনঃ।শ্রীরাধিকায়াঃ কিল পৃষ্ঠদেশকে সংস্থাপ্য মন্ত্রাংশ্চ বিধিঃ প্ৰপাঠয়ন্॥রাধাকরাভ্যাং প্রদদৌ চ মালিকাং কিঞ্জল্কিনীং কৃষ্ণগলেহলিনাদিনীম্‌।হরেঃ করাভ্যাং বৃষভানুজাগলে ততশ্চ বহ্নিং প্রণময্য বেদবিৎ।।সংবাসয়ামাস সুপীঠয়োশ্চ তৌরুতাঞ্জলী মৌনযুতৌ পিতামহঃ।তৌ পাঠয়ামাস তু পঞ্চমন্ত্রকং সমর্প্য রাধাঞ্চ পিতেব কণ্যাকাম্।। [ গর্গসংহিতা, গোলকখন্ডম, অধ্যায় ১৬, শ্লোক ৩০-৩৪ ] বঙ্গানুবাদ: নারদ বলিলেন–তখন ব্রহ্মা উত্থিত হইয়া উপবিষ্ট রাধাকৃষ্ণের সম্মুখে কুণ্ডমধ্যে যথাবিধি অগ্নি প্রজ্জলন করিলেন এবং বৈদিক বিধি অনুসারে পাণিগ্রহণ ক্রিয়া সম্পাদন করাইয়া উপবিষ্ট হইলেন। বেদ-বিধিজ্ঞ ব্রহ্মা রাধাকৃষ্ণের সপ্তবার অগ্নি প্রদক্ষিণ ও তাঁহাদিগের দ্বারা প্রণাম করাইলেন এবং তারপর সপ্তমন্ত্র পাঠ করাইয়া বিবাহ বিধি সম্পন্ন করিলেন। অনন্তর ব্রহ্মা রাধিকার হস্ত কৃষ্ণের বক্ষঃস্থলে এবং কৃষ্ণের হস্ত রাধিকার পৃষ্ঠদেশে সংস্থাপনপূর্ব্বক মন্ত্র পাঠ করাইলেন। বেদজ্ঞ ব্রহ্মা রাধা-করদ্বয় দ্বারা কৃষ্ণের কণ্ঠে ও কৃষ্ণ-করদ্বয় দ্বারা রাধার গলে কেশরযুক্ত কমল-মাল্য প্রদান করাইয়া তাঁহাদের উভয়কেই অগ্নি প্রণাম করাইলেন;তখন তাঁহাদের গললগ্ন মালায় মধুকরগণ লগ্ন হইয়া সুমধুর রব করিয়াছিল। অনন্তর পিতামহ কৃতাঞ্জলি মৌনযুক্ত রাধা কৃষ্ণকে উত্তম আসনে উপবেশন করাইয়া পঞ্চ মন্ত্র পাঠ করাইলেন। পিতা যেমন বরকরে কন্যার্পণ করেন,পিতামহও তদ্রূপ করিয়া রাধাকে কৃষ্ণকরে অর্পণ করিলেন। সে বিবাহে দেবগণ পুষ্পবর্ষণ ও অমরনারীরা বিদ্যাধরীগণের সাথে নৃত্য করলেন; গন্ধৰ্ব্ব, বিদ্যাধর, চারণ ও কিন্নরগণ সুমধুর কৃষ্ণমঙ্গল গান করল। মৃদঙ্গ,বীণা,তানপুরা, বংশী,শঙ্খ,ঢক্কা ও দুন্দুভি বাদ্য তাললয়ে মুহুর্মুহু বাদিত হল; স্বর্গবাসী দেববরগণ উচ্চরবে মঙ্গলময় জয় শব্দ করলেন। বিবাহান্তে

শ্রীকৃষ্ণ কি শুধুই যোগেশ্বর না পরমেশ্বরও?!

image_2024-04-28_172805537

तमेव शरणं गच्छ सर्वभावेन भारत । तत्प्रसादात्परां शान्तिं स्थानं प्राप्स्यसि शाश्वतम् ॥ ‘হে ভারত! সর্বোতভাবে তাঁর শরণাগত হও। তাঁর প্রসাদে তুমি পরা শান্তি এবং নিত্য ধাম প্রাপ্ত হবে।’ গীতা ১৮/৬২ নং শ্লোকের এই ব্যাখ্যা নিয়ে ভগবদগীতার পাঠক হৃদয়ে কৌতূহলের অন্ত নেই!!! স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ এখানে অর্জুনকে কার শরণাগত হওয়ার কথা বলছেন?! উপরিউক্ত শ্লোকের ঠিক আগের অর্থাৎ ১৮/৬১ শ্লোক যদি দেখি— ईश्वर: सर्वभूतानां हृद्देशेऽर्जुन तिष्ठति । भ्रामयन्सर्वभूतानि यन्‍त्रारूढानि मायया ॥ “হে অর্জুন! পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছেন।” এবং, এর পরের শ্লোক অর্থাৎ ১৮/৬২ এ শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নিশ্চয়ই সেই পরমেশ্বরের শরণ গ্রহণ করার কথা বলেছেন যিনি সকলের হৃদয়ে বিরাজ করছেন। তাই নয় কি?! এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তবে তো শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর নন, যদি হতেন তবে তিনি কেন অর্জুনকে —>”আমার(কৃষ্ণের) শরণাগত হও”<— না বলে পরমেশ্বরের শরণ গ্রহণ করার কথা বলেছেন?! তবে একটা বিষয় এখান থেকে মেনে নিতেই হবে যে এই শ্লোক অবশ্যই শ্রীকৃষ্ণ বলছেন। তা না হলে এর অর্থ সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়াবে। অর্থাৎ ভগবদগীতায় “ভগবান উবাচ” বলে যতটি শ্লোক আছে তার প্রবক্তা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। তা না হলে ১৮/৬২ শ্লোককে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?! নিশ্চয়ই একমত হবেন যে এই শ্লোক শ্রীকৃষ্ণই বলছেন। এবার একটু পিছনে তাকানো যাক। আমরা শ্রীমদ্ভগবদগীতার ১৫/১৫ শ্লোকটি যদি দেখি, সেখানে বলা আছে — सर्वस्य चाहं हृदि सन्निविष्टो। “আমি সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থিত”। এবার চিন্তা করে দেখুন তো ১৮/৬১ এবং ১৮/৬২ নং শ্লোক যদি শ্রীকৃষ্ণ বলে থাকেন নিশ্চয়ই এই শ্লোকটিও তিনিই বলেছেন। অতএব শ্রীকৃষ্ণ আগেই পঞ্চদশ অধ্যায়ে বলে গেলেন যে “আমিই সমস্ত জীবের হৃদয়ে বিরাজ করি”। আর পরবর্তীতে অষ্টাদশ অধ্যায়ের ৬১,৬২ নং শ্লোকে বললেন “হে অর্জুন! তুমি সকলের হৃদয়ে বিরাজমান পরমেশ্বরের শরণ গ্রহণ কর”। আবার শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং একটু পরেই অর্থাৎ ১৮/৬৬ শ্লোকে বলছেন सर्वधर्मान्परित्यज्य मामेकं शरणं व्रज । “সকল প্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণ গ্রহণ করো।” এবার তাহলে ঝামেলা তৈরি হলো!!! একবার বলছেন “আমার শরণ গ্রহণ করো” অন্যত্র বলছেন “তাঁর(পরমেশ্বর) শরণ গ্রহণ করো”। এরকম দ্বৈততা কেন?! ভগবদগীতার ১৫/১৫ অনুযায়ী(প্রত্যক্ষ উক্তিতে) এবং ১৮/৬১ শ্লোক অনুযায়ী (পরোক্ষ উক্তিতে) দুজনই যেহেতু একই ব্যক্তি অতএব শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরমেশ্বর। অতঃপর তাঁর এই দ্বৈত উক্তিতে আমাদের আর সন্দেহ থাকার কথা নয়। কারণ পরমেশ্বর যে একইসাথে এক এবং সর্বব্যাপক(পরমাত্মা) রূপে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন তা বৈদিক শাস্ত্র থেকে আমরা জানতে পারি। नामेको बहूनां यो विदधाति कामान् । একো বহূনাং যো বিদধাতি কামান্ ।। (কঠ উপঃ ২/২/১৩, শ্বেতাশ্বতর উপঃ ৬/১৩) ” যিনি এক হইয়াও বহু জীবের কাম সকল বিধান করিয়া থাকেন”। वायुर्यथैको भुवनं प्रविष्टो रूपं रूपं प्रतिरूपो बभूव । एकस्तथा सर्वभूतान्तरात्मा रूपं रूपं प्रतिरूपो बहिश्च ॥ “সর্বভূতের একই অন্তরাত্মা নানা বস্তুভেদে তদ্বস্তুরূপ হইয়াছেন এবং সকল প্রাণীর বাহিরেও অবস্থান করেন।” – কঠোপনিষদ ২/২/১০ तदन्तरस्य सर्वस्य तदु सर्वस्यास्य बाह्यतः ॥ ‘তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বাস্যাস্য বাহ্যতঃ (ঈশোপনিষদ ৫) তিনি সকল বস্তুর ভিতরে বিরাজ করেন, তিনি সকল বস্তুর বাহিরেও অবস্থান করেন। পরমেশ্বরের একইসাথে এক এবং বহুভাবে নিজেকে বিস্তারের যে অচিন্ত্য তত্ত্ব তা আমাদের বোধগম্য হওয়া যদিও কঠিন তবুও শাস্ত্রে কিছু উদাহরণ এর মাধ্যমে আমাদের সেই অচিন্ত্য শক্তির কিঞ্চিত ধারণা দেওয়া হয়েছে। একদেশস্থিতস্যাগ্নের্জ্যোৎস্না বিস্তারিণী যথা । পরস্য ব্রহ্মণঃ শক্তিস্তথেদমখিলং জগৎ ।। (বিষ্ণু পুরাণ ১/২২/৫৩) অনুবাদ: একই স্থানে অবস্থিত অগ্নির প্রভা বা আলোক যেমন সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়, সেই রকম পরব্রহ্মের শক্তি অখিল জগৎ জুড়ে ব্যাপ্ত হয়ে আছে। দীপার্চিরেব হি দশান্তরমভ্যুপেত্য দীপায়তে বিবৃতহেতুসমানধর্মা । (ব্রহ্মসংহিতা ৫/৪৬) অনুবাদ: এক মূল প্রদীপের জ্যোতি অন্য বর্তি বা বাতিগত হয়ে বিবৃত (বিস্তার) হেতু সমান ধর্মের সঙ্গে পৃথক প্রজ্জ্বলিত হয়। পরিশেষে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনিত হলাম যে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এক এবং অদ্বিতীয় স্বরুপ হিসেবে অর্জুনের রথে উপস্থিত হয়ে শ্রীমদ্ভগবদগীতার জ্ঞান দান করেছেন। আবার তিনিই সর্বব্যাপ্ত পরমাত্মা রূপে সকলের হৃদয়ে প্রকাশিত হয়ে সকলের কামনা বিধান করেন। অতএব ভগবদগীতায় কোন আপাতবিরোধী কথা বলা হয়নি। যারা শ্রীকৃষ্ণের পরমেশ্বরত্ব অস্বীকার করেন তাদের কাছেই কেবল এসকল তত্ত্বকে সাংঘর্ষিক বা প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হতে পারে, ভক্তদের কাছে নয়। কিছু ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠী পরমেশ্বরের অসীম, অচিন্ত্য ঐশ্বর্যকে তাদের ক্ষুদ্র জ্ঞান দ্বারা সংজ্ঞায়িত করতে চায় তাঁর(শ্রীকৃষ্ণ) বিরোধিতা করে তাঁকে অবমাননা করে। তবে তাদের বাকচাতুর্য কখনোই ভক্তহৃদয়কে ব্যথিত করতে পারে না। কারণ তাঁরা জানেন, अवजानन्ति मां मूढा मानुषीं तनुमाश्रितम् । “অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্- আমি যখন মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হই, মূর্খেরা আমাকে অবজ্ঞা করে”। – গীতা ৯/১১ ৷৷হরে কৃষ্ণ৷৷ ৷৷প্রণাম৷৷

একাদশী সংক্রান্ত কিছু বিভ্রান্তির নিরসন

Untitled design 1 Svadharmam

একাদশী সংক্রান্ত কিছু বিভ্রান্তির নিরসন বেদে কোথায় উপবাস থাকতে বলেছে?! একাদশীতে কি কি খাওয়া যায়? কোন শাস্ত্রে অনুকল্প খাওয়ার বিধান আছে?! সধবা নারীরা কি একাদশী করতে পারবে?! কৃষ্ণপক্ষের একাদশী থাকবো নাকি শুক্লপক্ষের?! একাদশীর উপবাসে কি ওষুধ খাওয়া যায়?! একাদশীতে শ্রাদ্ধ নিষেধ কেন? ========================================== একাদশীতে অনুকল্প প্রসাদ পাওয়ার বিধান আমাদের বৈদিক শাস্ত্রসমূহের মধ্যে বিস্তারিত ভাবে রয়েছে। একাদশীতে উপবাস করার শাস্ত্রীয় বিধান হলো- যারা সারা দিনরাত ধরে নির্জলা উপবাস করার মতো শারীরিক সামর্থ রয়েছে, তারা নির্জলা উপবাস পালন করবেন। কিন্তু কলিহত জীব আমরা, আমাদের সকলের পক্ষে নির্জলা উপবাস করা সম্ভব হয় না। তাই ভগবান কৃপাবশত আমাদের জন্য একাদশীর দিনে অনুকল্প প্রসাদ গ্রহণের বিধান দিয়েছেন বৈদিক শাস্ত্র সমূহে। যারা নির্জলা উপবাস করতে অসমর্থ, শাস্ত্রে তাদের জল পান করে ব্রত করার বিধান দেওয়া হয়েছে, একে বলে সজলা ব্রত। যারা সজলা ব্রত করতেও অসমর্থ, তাদের জন্য ভগবান বিধান দিয়েছেন- কেউ চাইলে ভগবানকে ফল মূল কন্দ সরাসরি কিংবা রান্না করে ভগবানকে নিবেদন করে সে অনুকল্প প্রসাদ পেতে পারেন। একে বলে সফলা ব্রত। তবে কোন মতেই রবিশস্য ভোজন করা যাবে না একাদশীর ব্রতে। একাদশীর দিনে রবিশস্য ভোজন সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। এবার আসুন বৈদিক শাস্ত্র সমূহ হতে দেখে নিই উক্ত বিধির সপক্ষে প্রমাণসমূহ- ================================ বেদে কোথায় উপবাসের বিধান আছে?! ================================ যদনাশ্বানুপবসেৎ ক্ষোধুকঃ স্যাদ্যষ্বীয়াদ্রদ্রোহস্য পশূনভি মন্যেত। অপোহশ্মাতি। তন্নেবাশিতং নেবানশিতং ন ক্ষোধুকো ভবাতি নাস্র রুদ্রঃ পশূনভি মন্যতে। বজ্ৰো বৈ যজ্ঞঃ ক্ষুৎ খলু বৈ মনুষ্যস্য ভ্রাতৃব্যো যদনাশ্বানুপবসতি বজ্রেণৈব সাক্ষাৎক্ষুধং ভ্রাতৃব্যং হন্তি ॥ [কৃষ্ণযজুর্বেদ, ১/৬/৭] বঙ্গানুবাদ: উপবাসে ক্ষুধা বৃদ্ধি পায় এবং ক্ষুধাগ্নি জীবের ক্ষতি সাধন করে । যদি ক্ষুধা অসহনীয় হয় তবে জলপান করবে। জলপানে ভোজন হয়, আবার হয়না। যজ্ঞ বজ্রসদৃশ, ক্ষুধা মানুষের শত্রু। না খেয়ে উপবাস করলে যজ্ঞরূপ বজ্র তার ক্ষুধারূপ শত্রুকে বিনাশ করে। বেদে বলা হয়েছে, ঈশ্বরের প্রীতির জন্য অনশন(উপবাস) ব্রত করা সকলেরই কর্তব্য। তমেতং বেদান বচনেন ব্রাহ্মণা বিবিদিষন্তি যজ্ঞেন দানেন তপসাংনাশকেনৈতমেব বিদিত্বা মুনির্ভবতি। [বৃহদারণ্যক ঊপনিষদ ৪/৪/২২] বঙ্গানুবাদ: বেদবচন, যজ্ঞ, দান, তপস্যা ও অনশন(উপবাস ব্রত) দ্বারা ব্রহ্মবিদগণ পরমেশ্বরকে জানিতে চাহেন। ইহাকে জানিয়াই মানুষ মুনি হয়। =========================================== কত বছর বয়স থেকে একাদশী ব্রত পালন অবশ্যই করতে হবে?! =========================================== যো ন পূজয়তে দেবং রঘুনাথং রমাপতিম্। স তেন তাড্যতে দণ্ডৈর্যমস্যতি ভয়াবহৈঃ ।। ৬১ অষ্টমানদ্বৎসরাদূর্দ্ধমশীতির্ব্বৎসরো ভবেৎ। তাবদেকাদশী সর্বৈৰ্ম্মানুষৈঃ কারিতামুন। ॥ ৬২ [ পদ্মপুরাণ, পাতালখন্ড, ১৯। ৬১-৬২ (নবভারত) ] বঙ্গানুবাদ:  যে ব্যক্তি রমাপতি দেব রঘুনাথকে পূজা না করে, ভগবান রামচন্দ্রই তাহাকে অতি ভীষণ যমদণ্ডে তাড়িত করেন। ৮ম বর্ষের পর যতদিন পর্যন্ত ৮০ বর্ষ পূর্ণ না হয় ততকাল যে সকল মানবেরই একাদশী ব্রত কর্ত্তব্য তাহা শ্রীরামচন্দ্রই বিধান কারিয়াছেন। অতএব, মনুষ্যমাত্র ৮ থেকে ৮০ বছর পর্যন্ত অবশ্যই একাদশী পালনীয়। ===========================================  একাদশীতে অনুকল্প প্রসাদ পাওয়ার বিধান কোন শাস্ত্রে আছে?! =========================================== শ্রীব্রহ্মবৈবর্ত মহাপুরাণে দেবর্ষি নারদ বলেছেন- ন ভোক্তব্যং ন ভোক্তব্যং ন ভোক্তব্যঞ্চ নারদ। গৃহিভির্ব্রাহ্মনৈরন্নং সম্প্রাপ্তে হরিবাসরে ॥ ৮ গৃহী শৈবশ্চ শাক্তশ্চ ব্রাহ্মণো জ্ঞানদুর্ব্বলঃ। প্রয়াতি কালসূত্রঞ্চ ভুক্ত্বা চ হরিবাসরে ॥ ৯ কৃমিভিঃ শালমানৈশ্চ ভক্ষিতস্তত্র তিষ্ঠতি। বিণ্মূত্রভোজনং কৃত্বা যাবদিন্দ্ৰাশ্চতুৰ্দ্দশ ॥ ১০ জন্মাষ্টমীদিনে চৈব শ্রীরামনবমীদিনে। শিবরাত্রৌ চ যো ভুঙেক্ত সোঽপি দ্বিগুণপাতকীয়।। উপবাসাসমৰ্থশ্চ ফলমূলজলং পিবেৎ। নষ্টে শরীরে স ভবেদন্যথা চাত্মঘাতকঃ ॥ ১২ সকৃদ্ ভুঙেক্ত হবিষ্যান্নং বিষ্ণোনৈবেদ্যমেব চ। ন ভবেৎ প্রত্যবায়ী স চোপবাসফলং লভেৎ ॥১৩ [ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, ব্রহ্মখন্ড, ২৭। ৮-১৩ ] বঙ্গানুবাদ: গৃহী, ব্রাহ্মণ, শৈব, শাক্ত অথবা বৈষ্ণব যাহা কেন হউন না একাদশীতে অন্নাহার করিলে, কালসূত্রে গমন করেন এবং সেই স্থানে শালবৃক্ষ প্রমাণ কৃমিগণকর্তৃক ভক্ষিত ও বিষ্টামূত্রভোজী হইয়া চতুর্দ্দশ ইন্দ্র পর্যন্ত যন্ত্রণা ভোগ করেন। একাদশী ছাড়াও জন্মাষ্টমী, শ্রীরামনবমী ও শিবরাত্রি দিবসে যিনি ভোজন করেন, তিনি ইহা অপেক্ষা দ্বিগুণত্তর পাতকী হন। কিন্তু উপবাস জন্য শরীর নষ্ট হইলে, আত্মহত্যার পাপ হয়, তাই (নির্জলা) উপবাসে অসমর্থ হইলে, ফলমূল ভোজন ও জল পান করিবেন। অথবা একবার বিষ্ণুর নিবেদিত হবিষ্যান্ন ভোজন করিবেন, তাহাতে কিছুমাত্র প্রত্যবায় নাই বরং উপবাসের ফল লাভ করিবেন। গর্গসংহিতাতে গর্গমুনি বলেছেন- অন্নান্ সর্ব্বান বৰ্জ্জয়িত্বা গৌধূমাদ্যাম্নৃপেশ্বর। একাদশ্যাং প্রকুর্ব্বীত ফলাহার মুদা নরঃ ॥ [ গর্গসংহিতা, অধ্যায় ৬১, শ্লোক- ৫০ ] বঙ্গানুবাদ: হে নৃপবর! গোধূমাদি( গম,আটা, ময়দা সহ অন্যান্য) সর্ববিধ অন্ন বর্জন করিয়া মানব একাদশীতে সানন্দে অন্ততঃ ফলাহার করিবে। মহাভারতে বিদূর ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন– অষ্টৈতান্যব্ৰতঘ্নানি আপো মূলং ফলং পয়ঃ। হরির্ব্রাহ্মণকাম্যা চ গুরোর্বচনমৌষধম। [ মহাভারত, উদ্যোগপর্ব, ৩৯।৭০ ] বঙ্গানুবাদ: ফল, মূল, ক্ষীর, ঘৃত, ব্রাহ্মণ কামনা, গুরুর বচন ও ঔষধ এই আটটি ব্রত-নাশক নহে। এছাড়াও পদ্মপুরাণেও মাতা একাদশী শ্রীহরির নিকট প্রার্থনা করেছেন, কেউ যদি অনুকল্প প্রসাদ পেয়েও একাদশীর উপবাস করে তবে শ্রীহরি যেন তাকে বিত্ত, ধর্ম ও মোক্ষ দান করেন। রেফারেন্স: মামুপোষ্যন্তি যে ভক্ত্যা তব ভক্ত্যা জনার্দ্দন। সর্ব্বসিদ্ধির্ভবেত্তেষাং যদি তুষ্টোহসি মে প্রভো।। উপবাসঞ্চ নক্তঞ্চ একভক্তং করোতি চ। তন্য বিত্তঞ্চ ধৰ্ম্মঞ্চ মোক্ষং বৈ দেহি মাধব।। [ পদ্মপুরাণ, উত্তরখন্ড, ৩৮।১০০-১০১, একাদশীদেবী উক্তি ] বঙ্গানুবাদ: দেবী একাদশী শ্রীহরিকে বললেন, ‘ হে জনার্দ্দন! আপনি যদি আমার প্রতি তুষ্ট হইয়া থাকেন তবে আপনার প্রতি ভক্তি করিয়া যাহারা আমার এই একাদশীর দিনে উপবাস করিবে তাহাদের যেন সর্ব্বসিদ্ধি হয়। যে ব্যক্তি (নির্জলা) উপবাস, নক্তাশন বা একাহার করিবে, হে মাধব! তাহাকে আপনি বিত্ত,ধর্ম্ম ও মোক্ষ দান করিবেন। অতএব, একাদশী নির্জলা, সজলা ও সফলা যেকোন ভাবেই থাকা সম্ভব। ব্রতী তার সামর্থ অনুসারে নির্ণয় করবেন তিনি কি রূপে ব্রত পালন করবেন। তিনি চাইলে নির্জলাও করতে পারেন, আবার চাইলে ভগবানকে নিবেদিত (রবিশস্য বিহীন) অনুকল্প প্রসাদও পেতে পারেন। ========================================== একাদশীতে সবজি খাওয়ার বিধান শাস্ত্রে কোথায় আছে?! ========================================== প্রথমে বুঝতে হবে সবজি বলতে কি বুঝায়। আমরা সাধারণত সবজি হিসেবে যা খাই ( যেমনঃ লাউ, পটল, ঝিঙ্গা, ঢেড়স ইত্যাদি) এগুলো আসলে ফল। পুষ্প নিষেকের মাধ্যমে উদ্ভিদের ফল হয়। যে সকল ফলের সেলুলোজ আমরা সরাসরি হজম করতে পারি না, তাদেরকে আমরা রান্ন করে খাই, তাই এ জাতীয় ফলকে আমরা সবজি হিসেবে চিনি। এছাড়া বিভিন্ন রকম কন্দ ( যেমনঃ বাদাম, আলু, মিষ্টি আলু, গাজর, মূলা, কচু ইত্যাদি) -ও আমরা রান্না করে খাই, তাই এদেরও সবজি বলে। অর্থাৎ, উদ্ভিদের ফুল, ফল, পত্র, কন্দ যা আমরা রান্না করে খাই, তা সবজি হিসেবে পরিচিত। শাস্ত্রে আমাদের (রবিশস্য ভিন্ন) ফল, মূল, কন্দ সবই একাদশীর দিন গ্রহণের অনুমোদন দিয়েছে। চলুন দেখে নেওয়া যাক- গর্গসংহিতা: অন্নান্ সর্ব্বান বৰ্জ্জয়িত্বা গৌধূমাদ্যাম্নৃপেশ্বর। একাদশ্যাং প্রকুর্ব্বীত ফলাহার মুদা নরঃ ॥ ৫০ অন্নং ভুঞ্জতি যো রাজন্নেকাদশ্যাং নরাধমঃ। ইহ লোকে স চান্ডালো মৃতঃ প্রাপ্নোতি দুর্গতিম্॥ ৫১ দধি দুগ্ধং তথা মিষ্টং কূটং কর্কটিকাং তথা। বাস্তূকং পদ্মমূলঞ্চ রসালং জানকীফলম্ ॥ ৫২ গঙ্গাফলং পত্রনিম্বুং দাড়িম্বঞ্চ বিশেষতঃ । শৃঙ্গাটকং নাগরঙ্গং সৈন্ধবং কদলীফলম্ ॥ ৫৩ আম্রাতকং চার্দ্রকঞ্চ তুলঞ্চ বদরীফলম্ । জম্বুফল্মামলকং পটোলং ত্রিকুশ তথা ॥ ৫৪ রতালুং শর্করাকন্দমিক্ষুদণ্ডঃ তথৈব চ। দ্রাক্ষাদীনি হি চন্যানি পবিত্রঞ্চ ফলং তথা ॥৫৫ একবারঞ্চ রাজেন্দ্র ভোক্তব্যং হরিবাসরে। তৃতীয়ে প্রহরেঽতীতে প্রস্থস্য চ পলস্য চ। ৫৬ [ গর্গসংহিতা, অধ্যায় ৬১, শ্লোক- ৫০-৫৬ ] বঙ্গানুবাদ: হে নৃপবর! গোধূমাদি অর্থাৎ গম, আটা, ময়দা ইত্যাদি সর্ববিধ অন্ন বর্জন করিয়া মানব একাদশীতে সানন্দে অন্ততঃ ফলাহার করিবে। হে রাজন!

বেদোপনিষদে শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব – ১

Untitled design Svadharmam

বেদের প্রতিপাদ্য একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর উপাসনাই জীবের পরম ধর্ম। বেদে তিনি বিভিন্ন নামে কীর্তিত হয়েছেন। ঈশ্বর একজনই আর এতে কোন সন্দেহ নেই। প্রকৃতপক্ষে দ্বন্দ্বসমূহ মনুষ্যসৃষ্ট, ঈশ্বর সৃষ্ট নয়। বলা হয় যে, ‘নানা মুনির নানা মত। কোন মুনির মত যদি অন্য মুনির থেকে স্বতন্ত্র না হয়, তবে তাঁকে যথার্থ মুনি বলা যায় না। নাসাবৃষির্যস্য মতং ন ভিন্নম্।। – (মহাভারত, বনপর্ব ৩১৩/১১৭) কিন্তু ভগবান এখানে বলেছেন, স্থিতধীমুনি সাধারণ মুনিদের থেকে ভিন্ন। স্থিতধীমুনি সর্বদাই কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন, কেন না তিনি জল্পনা-কল্পনামূলক সমস্ত কার্যকলাপের পরিসমাপ্তি করেছেন। তাঁকে বলা হয় প্রশান্ত-নিঃশেষ-মনোরথান্তর (স্তোত্ররত্ন, ৪৩), অথবা যিনি জল্পনা-কল্পনার স্তর অতিক্রম করে উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, বসুদেব-তনয় ভগবান বাসুদেব বা শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সবকিছু (वासुदेव: सर्वमिति स महात्मा सुदुर्लभ: ॥বাসুদেবঃ সর্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভঃ)। তাঁকে বলা হয় মুনি, যাঁর মন একনিষ্ঠ। তিনি জানেন যে বেদে সর্বদেবতার উপাস্য ভগবান রূপে শ্রীবিষ্ণুকে স্তুতি করা হয়েছে, যেমন ঋগ্বেদে (১/২২/২০) বলা হয়েছেঃ तद्विष्णो॑: पर॒मं प॒दं सदा॑ पश्यन्ति सू॒रय॑: । दि॒वी॑व॒ चक्षु॒रात॑तम् ॥ ওঁ তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়……..“পরমেশ্বর বিষ্ণুই হচ্ছেন পরম সত্য, সুরগণ তাঁর পাদপদ্ম দর্শনে সর্বদা উদগ্রীব। সূর্যের মতোই ভগবান তাঁর শক্তিরাজির বিস্তার করে সর্বত্র ব্যাপ্ত আছেন। শ্রীবিষ্ণু শ্রীকৃষ্ণেরই প্রকাশ বা বিস্তার, শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত, যেমন সকল বেদ-উপনিষদের সার গীতোপনিষদ (সর্বোপনিষদো গাবো), ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণকে বিষ্ণু বলে সম্বোধন করা হয়েছেঃ শমং চ বিষ্ণো (शमं च विष्णो)— ১১/২৪, প্রতপন্তি বিষ্ণো (प्रतपन्ति विष्णो)— ১১/৩০, আদিত্যানাম্ অহং বিষ্ণু (आदित्यानामहं विष्णु)— ১০/২১ ইত্যাদি। শ্রীকৃষ্ণই শ্রীবিষ্ণুরূপে সর্বজীবের অন্তরস্থিত পরমাত্মা— অহমাত্মা গূঢ়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ (अहमात्मा गुडाकेश सर्वभूताशयस्थित:।)– ১০/২০। বিষ্ণুমূর্তি-সমূহ, রাম-নৃসিংহ ইত্যাদি অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই প্রকাশ, অংশ, কলা (রামাদিমূর্তিষু কলানিয়মেন তিষ্ঠন্ – ব্রহ্মসংহিতা ৫/৩৯)। শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং ভগবান (এতে চাংশ কলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্/ एते चांशकला: पुंस: कृष्णस्तु भगवान् स्वयम् । – শ্রীমদ্ভাগবত ১/৩/২৮)। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণপরাৎপর পুরুষ, সেজন্য তাঁর থেকে অসংখ্য ভগবৎ-রূপ বিস্তার হলেও তিনি তাঁর পূর্ণস্বরূপে নিত্যবিরাজমান। যেমনটা শ্রীবৃহদারণ্যক উপনিষদে (৫/১/১) উল্লেখ করা হয়েছে, ॐ । पूर्णमदः पूर्णमिदं पूर्णात्पूर्णमुदच्यते । पूर्णस्य पूर्णमादाय पूर्णमेवावशिष्यते ॥ ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে । পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ।। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (৭/৭, ১৫/১৫) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন: मत्त: परतरं नान्यत्किञ्चिदस्ति धनञ्जय । “মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয়”। वेदैश्च सर्वैरहमेव वेद्यो वेदान्तकृद्वेदविदेव चाहम् ॥ “বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যঃ বেদান্তকৃদ্ বেদবিদেব চাহম্”। ইত্যাদি.. ( হে ধনঞ্জয় ! আমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আর কেহ নাই। আমিই সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য, আমিই বেদান্তকর্তা ও বেদবিৎ ) শ্রীগোপাল পূর্বতাপনী উপনিষদ ২১ মন্ত্রে বলেন- “তস্মাৎ কৃষ্ণ এব পরো দেবস্তং ধ্যায়েৎ। তং রসেৎ তং ভজেৎ তং যজেৎ।। একা বশী সর্বগঃ কৃষ্ণ ঈড্য একোপি সন্ বহুধা যো বিভাতি। তং পীঠস্থং যে তু ভজন্তি ধীরাস্তেষাং সুখং শাশ্বতং নেতরেষাম্।।” সেইজন্য শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর, সেই শ্রীকৃষ্ণকেই ধ্যান করিবে, তাঁর নামই সংকীর্তন করবে (সততং কীর্তয়ন্তো মাং) তাঁকেই ভজন করবে, পূজা করবে। সর্বব্যাপী, সর্ববশকর্তা শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র সকলের পূজ্য। তিনি এক হয়েও মৎস-কূর্মাদি, বাসুদেব সঙ্কর্ষণাদি, কারণার্ণব-গর্ভোদকাদি বহুমূর্তিতে প্রকাশমান হন। শুকদেবাদির ন্যায় যে সকল ধীর পুরুষ তাঁর পীঠমধ্যে অবস্থিত শ্রীমূর্তির পূজা করেন, তাঁরাই নিত্য সুখ লাভে সমর্থবান হন। তত্র কারিকা– “কৃষ্ণাংশঃ পরমাত্মা বৈ ব্রহ্ম তজ্জ্যোতিরেব চ। পরব্যোমাধিপস্তস্যৈশ্বর্যমূর্তির্নসংশয়ঃ।।” শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র সর্বেশ্বর। পরমাত্মা তাঁর অংশ, ব্রহ্ম তাঁর জ্যোতি। পরব্যোমনাথ শ্রীনারায়ণ তাঁরই ঐশ্বর্যবিলাসমূর্তিবিশেষ। এই সিদ্ধান্তে কিছু মাত্র সংশয় নাই ; যেহেতু বেদাদি শাস্ত্র ইহাই নির্দেশ করছেন। যথা তৈত্তিরীয়ে ২/১/২– “সত্যং জ্ঞানমনস্তং ব্রহ্ম। যো বেদনিহিতং গুহায়াং পরমে ব্যোমন্। সোঽশ্লূতে সর্বান্ কামান সহ। ব্রহ্মণা বিপশ্চিতেতি।।” ( সত্য স্বরূপে, চিন্ময়, অসীমতত্ত্বই “ব্রহ্ম”। চিত্তগুহায় অন্তর্যামীরূপে অবস্থিত তত্ত্বই ” পরমাত্মা”। পরব্যোমে অর্থাৎ বৈকুণ্ঠে অবস্থিত তত্ত্বই “নারায়ণ”। এই তত্ত্ব যিনি অবগত আছেন, তিনি ” বিপশ্চিৎ ব্রহ্ম” অর্থাৎ পরব্রহ্ম কৃষ্ণের সহিত যাবতীয় কল্যাণ গুণ প্রাপ্ত হন।) বেদাদি শাস্ত্রে বিভিন্ন নামে শ্রীকৃষ্ণকেই নির্দেশ করেঃ মহাভারতে শান্তিপর্বে মোক্ষধর্মের ৩২৭ অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন যখন অর্জুন বেদ, পুরাণে ভগবানের যে সকল নাম ( ইন্দ্র, অগ্নি, রুদ্র, বিষ্ণু আদি..), লীলা ঋষিরা উল্লেখ করেছেন তা জানতে চেয়ে। শ্রীকৃষ্ণ উবাচঃ “ঋগ্বেদে সযজুর্বেদে তথৈবথর্বসামসু পুরাণে। সোপনিষদে তথৈব জ্যোতিষে অর্জুন।। ৮।। সাংখ্যে চ যোগশাস্ত্রে চ আয়ুর্বেদে তথৈব চ। বহুনি মম নামানি কীর্তিতানি মহার্ষিভিঃ।। ৯।। গৌণানি তত্র নামানি কর্মজানি চ কানি চিত। নিরুক্তম কর্মজ্ঞম চ শৃণুস্ব প্রয়াতো অনঘ।।” ১০।। অর্থাৎ, শ্রীকৃষ্ণ বল্লেন হে অর্জুন! ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ, সামবেদ, পুরাণে, উপনিষদে, জ্যোতিষে, সাংখ্যে শাস্ত্রে, যোগশাস্ত্রে, আয়ুর্বেদে ঋষিরা অসংখ্য যেসব নাম উল্লেখ করেছেন, কিছু নাম আমার স্বরূপ সম্পন্ধিত, কিছু আমার কার্য্য সম্পর্কিত। হে পাপরহিত অর্জুন ! আমি তোমার কাছে সেই সব নাম ও তাদের মাহাত্ম্য বর্ণনা করছি, তুমি তা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করো। ” নরাণাময়নং খ্যাতমঽমেকঃ সনাতনঃ। আপো নারা ইতি প্রোক্তা আপো বৈ নরসূনবঃ। অয়নং মম তৎপূর্বমতো নারায়ণো হ্যহম্।।” ৩৭।। মুক্তিকালে প্রাণিগণের জীবাত্মার আমিই আশ্রয়স্থান ; এইজন্য এক সনাতন আমিই নারায়ণ। অথবা, নার শব্দের অর্থ জল। যেহেতু জল নরের অর্থাৎ ব্রহ্মের পুত্র। সৃষ্টির পূর্বে সেই নার অর্থাৎ জল আমার আশ্রয় ছিল, এইজন্য আমি নারায়ণ। “ছাদয়ামি জগদ্বিশ্বং ভূত্বা সূর্য্য ইবাংশুভিঃ। সর্বভূতাধিবাসশ্চ বাসুদেবস্ততো হ্যহম্।। ৩৮।। গতিশ্চ সর্বভূতানাং প্রজনশ্চাপি ভারত!। ব্যাপ্তা মে রোদসী পার্থ ! কান্তিশ্চাভ্যধিকা মম।। ৩৯ ।। অধিভূতানি চান্তেষু তদিচ্ছংশ্চাস্মি ভারত !। ক্রমণাচ্চাপ্যহং পার্থ ! বিষ্ণুরিত্যভিসংজ্ঞিতঃ।।” ৪০।। আমি সূর্যের ন্যায় হয়ে কিরণ দ্বারা সমগ্র জগৎ আচ্ছাদন করি, এই জন্য আমি বাসুদেব। অথবা আমি সর্বভূতের বাসস্থান বলে “বাসুদেব”। ভরতবংশীয় পৃথানন্দন ! আমি সর্বভূতের গতি বলে ” বিষ্ণু” ; কিংবা আমা হতেই সর্বভূত উৎপন্ন হয় বলে আমি “বিষ্ণু” ; অথবা আমি স্বর্গ ও মর্ত্য ব্যাপিয়া রয়েছি বলে “বিষ্ণু” কিংবা প্রলয়কালে আমি নিজদেহে সমস্ত ভূত প্রবেশ করাতে ইচ্ছা করি বলে আমি “বিষ্ণু” ; অথবা আমি বামন রূপে সমগ্র জগৎ আক্রমণ করেছিলাম বলে আমি বিষ্ণু নামে অভিহিত হয়ে থাকি। স্বর্গ, মর্ত্য ও আকাশবর্তী লোকেরা ইন্দ্রিয়দমননিবন্ধন আমাকে লাভ করবার ইচ্ছা করে, সিদ্ধি কামনা করে সেই জন্য আমি “দামোদর”।। ৪১।। অন্ন, বেদ, জল ও অমৃতকে ” পৃশ্নি” বলা হয়, সেই অন্ন প্রভৃতি সর্বদাই আমার গর্ভে থাকে ; সেই জন্য আমি “পৃশ্নিগর্ভ”।। ৪২।। একদা একত ও দ্বিত নামক দুই ভ্রাতা ত্রিত নামক কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে কূপমধ্যে নিপাতিত করেছিলেন ; তখন তত্রত্য ঋষিরা আমাকে এইরূপ বলেছিলেন যে, হে পৃশ্নিগর্ভ ! আপনি কূপনিপাতিত ত্রিতকে রক্ষা করুন।। ৪৩।। তারপর সেই আদিকালে ব্রহ্মার পুত্র ঋষিশ্রেষ্ঠ ত্রিত ” পৃশ্নিগর্ভ” এই নাম কীর্তন করার জন্যই, কূপ হতে উত্থিত হয়েছিলেন।। ৪৪।। জগতের তাপকারী সূর্য, অগ্নি ও চন্দ্রের যে সকল কিরণ প্রকাশ পায়, সেই গুলিই আমার কেশ। অতএব সর্বজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা আমাকে “কেশব” বলেন।।৪৫।। ।।হরে কৃষ্ণ।। ।।প্রণাম।।