শূদ্রগণ কি পরমেশ্বরকে লাভ করতে পারবে না?

20250626_104528

সমাজ ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্য ৪টি বর্ণ ও ৪টি আশ্রমের কথা বৈদিক শাস্ত্রে নির্দেশিত হয়েছে। তন্মধ্যে ৪টি বর্ণ হলো- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। কেবল শূদ্র বর্ণকে লক্ষ্য রেখেই করে এই আলোচনা উপস্থাপিত হলো।

লক্ষ্য করলেই দেখবেন কোনো সমাজে শিক্ষিত থেকে শুরু করে নিরক্ষর সকল ধরনের মানুষ বিদ্যমান থাকেন। এই বৈচিত্র্যতা আবহমান কালের। নিরক্ষর-স্বাক্ষর প্রত্যেকেই যার যার অবস্থান থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী সমাজে অবদান রেখে যাচ্ছেন। এক শ্রেণী ছাড়া আরেক শ্রেণীর মানুষ চলতে পারে না৷ ইংরেজিতে একটি বাক্য আছে, “Man cannot live alone.” যেমন- অসুক বিসুখ হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া লাগে। আবার সেই ডাক্তার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়ের জন্য ব্যবসায়ীর শরণাপন্ন হন, সেই ব্যবসায়ী আবার পণ্য আমদানির জন্য কৃষকের শরণাপন্ন হন, আবার উভয়েই কোনো কারণে অনিরাপদ বোধ করলে থানা পুলিশ ইত্যাদি নিরাপত্তা বাহিনীর শরণাপন্ন হন। এভাবেই সমাজে প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষ একে অপরের পরিপূরক হিসেবে অবদান রাখছেন। এরকমই বৈদিক সমাজ ব্যবস্থায় অবদান রাখা চারটি বর্ণের একটি হচ্ছে শূদ্র।

প্রশ্ন: শূদ্র বর্ণের কর্ম কি?

উত্তর: ❝পরিচর্যাত্মকং কর্ম শূদ্রাস্যাপি স্বভাবজম্___পরিচর্যাত্মক কর্ম শূদ্রের স্বভাবজাত।❞ (ভ:গী: ১৮/৪৪)

প্রশ্ন: কেউ শূদ্র কি-না তা কিভাবে চিহ্নিত করা যায়?

উত্তর: উপরোক্ত শ্লোকে শূদ্র লক্ষণ বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ, যাদের কোনোরূপ বুদ্ধিভিত্তিক উন্নত কর্মে যুক্ত হওয়ার যোগ্যতা নেই অথচ তারা বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যক্তিদের শ্রম বা সেবা দিয়ে সহযোগিতা করতে পারেন, তাদেরকেই শূদ্র হিসেবে গণ্য করা হয়।

প্রশ্ন: শূদ্র হিসেবে গণ্য করায় একজন মানুষকে ছোট করা হচ্ছে?

উত্তর:

চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্॥

ভগবদগীতায় (৪/১৩) বলা আছে যে এই বর্ণ- প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে বিভক্ত। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই বিভাগগুলোর উদ্দেশ্য কখনোই কাউকে ছোট করা নয়। এই ক্ষেত্র পার্থক্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে সকল ক্ষেত্রের লোক যাতে তার তার সামর্থ্য অনুযায়ী সমাজে অবদান রাখতে পারে সেজন্যই। এরকম ব্যবস্থা সকল পর্যায়েই দেখতে পাওয়া যায়। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায়ও এটি লক্ষ্য করা যায় যে- সবাই একই ক্ষেত্রে কর্ম করছেন না। কর্মক্ষেত্রের ভিন্নতা বরাবরই রয়েছে। কেউতো এই ব্যবস্থাতে প্রশ্ন তোলেন না, কেন একজন উচ্চপদস্থ ও আরেকজন নিম্ন? ঐটা কি বৈষম্য নয়?

প্রশ্ন: আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় এরকম ক্ষেত্র তৈরির উদ্দেশ্য হচ্ছে যেন সমাজে সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় কিন্তু বর্ণবিভাগের কি উদ্দেশ্য?

উত্তর: না, আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় সাম্য বা শান্তি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না, বিপরীতে সকল ক্ষেত্রেই বৈষম্য ও হানাহানি দেখা যাচ্ছে এবং তা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে, এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগই নেই। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার গলদটা এখানেই যে- এইরকম ভিন্ন ভিন্ন কর্ম দ্বারা মানুষ কেবলই রাষ্ট্র ও নিজের ভরণপোষণে ব্যস্ত, একারণেই এই ধরনের সমাজ ব্যবস্থায় ব্যাপক বৈষম্য দেখা যায়। অথচ, বৈদিক সমাজ ব্যবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ দ্বারা নিযুক্ত কর্মে মানুষের কেন্দ্রে থাকেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। সকলেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধানে কর্ম করে থাকেন, যার ফলে সকলেই তৃপ্ত থাকেন। বৈদিক সমাজ ব্যবস্থায় যে বর্ণবিভাগ রয়েছে তাতে প্রত্যেক বর্ণের মানুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিধিনিষেধ, কঠোর ও শিথিল রাখা হয়েছে। ব্রাহ্মণের জন্য যা অনুমোদিত ক্ষত্রিয়ের জন্য তা নিষিদ্ধ, বৈশ্যের জন্য যা অনুমোদিত শূদ্রের জন্য নিষিদ্ধ, প্রত্যেকের বিধিনিষেধে কিছু পার্থক্য রাখা হয়েছে। তবে এই বর্ণব্যবস্থায় কে কি কর্ম করছেন এর দ্বারা উঁচুনিচু ভেদাভেদ তৈরি করা হয় না। কেননা, প্রত্যেকেই তার সামর্থ্য অনুযায়ী পরমেশ্বর ভগবানের সেবা সন্তুষ্টি বিধান করছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- একটি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে যা অনবরত কার্য করছে এবং অন্তিমে উদরে খাদ্য প্রেরণ করছে। তো উদর ব্যতীত বাকিসব অঙ্গ যার যার ক্ষেত্র অনুযায়ী উদরকে তৃপ্ত রাখছেন বলেই সম্পূর্ণ শরীর পরিপুষ্ট হয়ে সকল অঙ্গে শক্তি প্রদান করছে। এভাবেই সমাজ ব্যবস্থাকে সাম্যের দিকে পরিচালিত করতে হলে যথাযথ কেন্দ্রকে খুজে বের করে সেই কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে কর্ম নিবেদন করতে হবে। তবেই সাম্য শান্তি দুটোই প্রতিষ্ঠিত হবে। পবিত্র বেদ পরমেশ্বর ভগবানকে সেই কেন্দ্র হিসেবে বর্ণনা করেছে। অতএব বৈদিক বর্ণ ব্যবস্থায় কেউ শূদ্র হোক কিংবা ব্রাহ্মণ এটা কোনো বড়-ছোট ব্যাপার নয়। বড় ব্যাপার হচ্ছে সকলেই পরমেশ্বর ভগবানকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হচ্ছে কি-না সেটা।

প্রশ্ন: শূদ্রেরাও কি তাহলে পরমেশ্বরকে লাভ করতে পারবে?

উত্তর: হ্যাঁ! অবশ্যই। কেননা? যেহেতু সমস্ত বর্ণ ও আশ্রমের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে যে- প্রত্যেকেই যেন নিজ নিজ যোগ্যতায় নিজ নিজ বর্ণ অনুসারে শাস্ত্রোক্ত কর্মের মাধ্যমে পরমেশ্বর ভগবানকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে, আর এভাবেই সকল বর্ণের লোকেরা শ্রীবিষ্ণুর পরম পদ লাভ করতে পারেন।

ঠিক যেভাবে শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে উদরপূর্তিতে সহায়তা করছে। উদর পূর্ণতা পেলেই সমস্ত শরীরে শক্তি সঞ্চারিত হচ্ছে। তাই ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র সকল বর্ণের মনুষ্যের উচিত সমস্ত কিছুর কেন্দ্র, পরম উৎস শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত থাকা। শ্রীল প্রভুপাদ এবিষয়ে তাঁর ভগবদ্গীতায় ব্যাখ্যা করেছেন-

❝সকলেরই মনে রাখা উচিত যে, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের ঈশ্বর হৃষীকেশের দ্বারা তারা ভিন্ন ভিন্ন বিশেষ ধরনের কর্মে নিযুক্ত রয়েছে এবং সেই সকল কর্মের ফলের দ্বারা পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপাসনা করা কর্তব্য। কেউ যদি সর্বদাই পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে এভাবেই চিন্তা করেন, তা হলে ভগবানের কৃপার ফলে তিনি অচিরেই পূর্ণজ্ঞান লাভ করবেন। সেটিই হচ্ছে জীবনের পরম সিদ্ধি। ভগবদ্গীতায় (১২/৭) ভগবান বলেছেন- তেষামহং সমুদ্ধর্তা। এই প্রকার ভক্তকে উদ্ধার করার ভার পরমেশ্বর ভগবান নিজেই গ্রহণ করেন। সেটিই হচ্ছে জীবনের পরম সিদ্ধি। যে কোন রকম কর্মেই নিযুক্ত থাকুন না কেন, যদি তিনি পরমেশ্বর ভগবানের সেবা করেন, তা হলে তিনি পরম সিদ্ধি লাভ করতে পারবেন।❞ (ভ:গী: ১৮/৪৬ ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য)

✍️ প্রবীর চৈতন্য চন্দ্র দাস।
© স্বধর্মম্™

Prakash

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments