বর্ণসঙ্কর ব্যক্তি কি দীক্ষাগুরু হতে পারেন?~পর্ব-৫

20250317_193852

‘বৈষ্ণবগণ দ্বিজোত্তম’ শাস্ত্রবাক্য জেনেও সমাজে কিছু ধর্মব্যবসায়ী প্রায়ই দাবী তুলেন, ‘শূদ্র কিংবা শূদ্রাধম, বর্ণহীন, অন্ত্যজ, বর্ণসঙ্কর, অসৎকূলজাতগণ বৈষ্ণব হলেও দীক্ষাগুরু হতে পারে না!!’  এরূপ ভাগবতম সিদ্ধান্ত বিরুদ্ধ মত যারা প্রসন করেন, তারা নিশ্চিতরূপে নরকের কীট।

আজ আমরা মহামুনি মতঙ্গ ঋষির দৃষ্টান্ত দেখবো, যিনি বর্ণসঙ্কর হয়েও বৈষ্ণব ধর্ম পালনের মাধ্যমে ব্রহ্মর্ষি হয়েছিলেন এবং অন্যতম বৈষ্ণব দীক্ষাগুরুরূপে জগতবাসীদের করুণা করেছেন।

মতঙ্গ মুনি শূদ্র নাপিতের ঔরসে কামোন্মত্তা ব্রাহ্মণীর গর্ভে জন্ম, অতএব জাতিতে চণ্ডাল ছিলেন। তার জন্ম সম্পর্কে মহাভারতে বলেছে- “ব্রাহ্মণ্যাং বৃষলেন ত্বং মত্তায়াং নাপিতেন হ জাতত্ত্বমসি চাণ্ডালো ’(মহাভারত, অনুশাসন পর্ব, ২৮।১৭)

মতঙ্গ মুনি প্রথম জীবনে ইন্দ্রের তপস্যা করেছিলেন, কিন্তু তাতে অভিষ্ট লাভ না করতে পেরে বিষ্ণুভক্তিতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন এবং মহামুনিতে পরিণত হয়েছিলেন। ‘মুনিশার্দ্দুলো মতঙ্গো বিষ্ণুতৎপরঃ’’( স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুখন্ড, বেঙ্কটাচলমাহাত্ম্যম, ৩৯।২)

মতঙ্গ মুনি ভক্তশ্রেষ্ঠ হনুমানেরও কূলগুরু ছিলেন। স্কন্দপুরাণে (বিষ্ণুখন্ডের বেঙ্কটাচলমাহাত্ম্যের ৩৯ অধ্যায়ে) উল্লেখ আছে, পুত্রলাভ না হওয়ায় বানররাজ কেশরী এবং মাতা অঞ্জনা খুব দুঃখিত ছিলেন। মতঙ্গ মুনি দেবী অঞ্জনাকে তখন মুখ্যপ্রাণ বায়ুর তপস্যায় প্রেরণ করেছিলেন এবং কেশরী-অঞ্জনা বায়ুদেবের তপস্যায় সিদ্ধ হয়ে তিনি মুখ্যপ্রাণকে পুত্র হনুমানরূপে লাভ করেছিলেন।

রামায়ণের কিষ্কিন্ধাকাণ্ডের ৭৩-৭৪ সর্গে মতঙ্গ মুনি ও তার শিষ্যগণের উল্লেখ আছে। মতঙ্গমুনির নিষ্ঠাবান শিষ্যগণ গুরুভক্তি দ্বারা এতই তজস্বী হয়েছিলেন যে গুরুদেবের জন্য বন্য ফলমূল সংগ্রহকালে তাদের শরীর থেকে যে ঘাম মাটিতে পড়তো, সে ঘাম থেকে সুগন্ধি পুষ্পবৃক্ষের জন্ম হতো। সে সমস্ত পুষ্পবৃক্ষের পুষ্প কখনো মলিন হত না। মতঙ্গ মুনি ও তার শিষ্যগণ ভক্তিযোগ পূর্ণ করে মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক নিজেদের মন্ত্রপূত দেহকে অগ্নিতে আহুতি দিয়ে ভগবানের নিত্যধাম প্রাপ্ত হয়েছিলেন। নিত্যধামে গমনকালে তিনি তার শিষ্যা তপস্বীনি শবরীকে আশীর্বাদ করেছিলেন একদিন তিনি সাক্ষাৎ ভগবান রামচন্দ্রের দর্শন পাবেন।

শ্রীরামচন্দ্র মাতা সীতার অন্বেষণকালে মতঙ্গবনে মতঙ্গমুনির আশ্রমে এসেছিলেন এবং  শবরীর নিকট নিত্যধামগত মতঙ্গমুনির সমাধিস্থল, পূজাবেদী, পরিধেয় বস্ত্র দর্শন করে ভগবান রামচন্দ্র আনন্দিত হয়েছিলেন।

শবর কূলে জন্মালেও গুরুদেব মতঙ্গ মুনির সেবার প্রভাবে তপস্বিনী শবরী  সাক্ষাৎ ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে লাভ করেন। ভগবান রাম ভক্ত শবরীর উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করে ভক্তের মানবৃদ্ধি করেন। সাক্ষাৎ ভগবান রামকে সম্মুখে রেখে দর্শন করতে করতে যোগাগ্নিতে জড়দেহকে আহুতি দিয়ে শবরী মাতা দিব্যদেহ ধারণ করে অক্ষয়ধামে গমন করেন। ধন্য গুরু মতঙ্গ!  ধন্য শিষ্যা শবরী!

মতঙ্গ মুনি বর্ণসঙ্কর হয়েও পতিতপাবন দীক্ষাগুরুর এক আদর্শ দৃষ্টান্ত। অতএব যারা বৈষ্ণবকে জাতভেদ দৃষ্টিতে দর্শন করেন তাদের সুমতি হোক, শূদ্রপুত্র মতঙ্গ মুনির কৃপা তাদের উপর বর্ষিত হোক।

 

©ব্রজসখা দাস

Navanila

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments