চিন্ময় জগৎ কি? চিন্ময় জগত বা ভগবদ্ধাম সম্পর্কে আলোচনা করুন।

চিন্ময় জগতঃ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা শাস্ত্রে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দুটি জগতের কথা বর্ণনা করেন- অপরা প্রকৃতি বা জড় জগৎ এবং পরা প্রকৃতি বা চিন্ময় জগৎ।চতুর্দশ ভূবন সমন্বিত যেখানে আমরা বর্তমানে বসবাস করছি, সেটিকে বলা হয় জড় জগৎ বা অপরা প্রকৃতি।আর এ জড় জগতের বিপরীতে রয়েছে সমগ্র জীবের পরম গন্তব্য পরা প্রকৃতি বা চিন্ময় জগৎ।সে চিন্ময় জগতকে ভগবদ্ধাম বা ভগবানের ধামও বলা হয়। সেই চিন্ময় জগতে নিত্য আনন্দ বর্তমান।সেখানে সমস্ত জীব জন্ম,মৃত্যু, জরা, ব্যাধি,ত্রিতাপ ক্লেশ (আদিভৌতিক,আদিদৈবিক, আধ্যত্মিক) থেকে সর্বদা মুক্ত। অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধিমে পরাম্। জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ।। -(গীতা ৭/৫ঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ) অনুবাদঃ হে মহাবাহো! এই অপরা প্রকৃতি ( জড় জগৎ) ব্যতীত আমার আর একটি পরা প্রকৃতি(চিন্ময় জগৎ) রয়েছে। সেই প্রকৃতি চৈতন্য-স্বরূপা ও জীবভূতা; সেই শক্তি থেকে সমস্ত জীব নিঃসৃত হয়ে এই জগৎকে ধারণ করে আছে।” কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় কঠ উপনিষদ শাস্ত্রেও চিন্ময় জগত সম্পর্কে বলা হয়েছে.. ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোহয়মগ্নিঃ।তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।। – (কঠ উপনিষদ ২/২/১৫) অনুবাদঃ চিন্ময় জগতে সূর্য প্রকাশিত হয় না,চন্দ্র ও তাঁরাগনও সেখানে প্রকাশিত হয় না,এমনকি বিদ্যুৎও ঝলকায় না,তাহলে এই লৌকিক অগ্নিই কিভাবে সেখানে প্রকাশিত হতে পারে, তার প্রকাশের দ্বারাই সমস্ত (সূর্য চন্দ্র তারকাদি) কিছু প্রকাশিত হয়,তার জ্যোতিতেই সম্পূর্ণ চিন্ময় জগৎ প্রকাশিত হয়।” ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান, ব্রহ্মসংহিতা সহ বিভিন্ন সনাতনী শাস্ত্র অনুসারে চিন্ময় জগতের সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে গোলক বৃন্দাবন নামক কৃষ্ণলোক, যেখানে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তারই অভিন্ন প্রকাশ শ্রীমতি রাধারাণী, বলরাম সহ অসংখ্য ভক্তবৃন্দ দ্বারা পরিবৃত।গোলক বৃন্দাবনের অধোদিকে বৈকুন্ঠলোক,এই বৈকুন্ঠ লোকে ভগবান শ্রীনারায়ন মাতা লক্ষ্মী সহ অসংখ্য ভক্তবৃন্দ দ্বারা পরিবৃত। এরপর রয়েছে শিবলোক,এখানে ভগবান সদাশিব, যিনি স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু তিনি অসংখ্য ভক্তবৃন্দ দ্বারা পরিবৃত। অথর্ববেদীয় গোপালতাপনী উপনিষদে চিন্ময় জগতের গোলক বৃন্দাবন সম্পর্কে বলা হয়েছে… তমেকং গোবিন্দং সচ্চিদানন্দ বিগ্রহং পঞ্চপদং বৃন্দাবনসুরভূরুহতলাসীনং সততং সমরুদগণোহহং পরময়া স্তুত্যা তোষয়ামি।। -(গোপালতাপনী উপনিষদঃ পূর্ব ২/৩৫) অনুবাদঃ যিনি গোলক বৃন্দাবনের কল্পতরুমূলে সমাসীন আছেন,সতত আমি মরুদগনের সহিত পরম স্তুতি দ্বারা পঞ্চপদাত্মক সেই গোবিন্দদেবের(শ্রীকৃষ্ণের) সন্তোষ বিধান করি। অষ্টাদশ পুরানের শাস্ত্রের ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানে চিন্ময় জগতের গোলক বৃন্দাবন ধাম এবং তার অধোদেশে বৈকুন্ঠ এবং শিবধাম সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরন পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে… সূর্য্যকোটিপ্রভং নিত্যমসখ্যং বিশ্বব্যাপকম। স্বেচ্ছাময়স্য চ বিভোস্তজ্জ্যোতবরুজ্জ্বলং মহৎ।। জ্যোতিরভ্যন্তরে লোকত্রয়মেব মনোহরম। অদৃশ্য যোগিবি স্বপ্নে দৃশ্য গম্যঞ্চ বৈষ্ণবৈঃ।। যোগেন ধৃতমীশেন চান্তরীক্ষস্থিতং পরম। আধিব্যাধিজরামৃত্যুশোকবীতিবিবর্জিত।। সদ্রত্মরচিতাসংখ্যমন্দিরৈঃ পরিশোবিত। লয়ে কৃষ্ণযুতং সৃষ্টৌ গোপগোপীভিরাবৃতম।। তদধো দক্ষিনে সব্যে পঞ্চাশংকোটিযোজনাৎ। বৈকুন্ঠং শিবলোকঞ্চ তৎসমং সুমনোহরম।। কোটিযোজনবিস্তীনং বৈকুন্ঠং মন্ডলাকৃতম। লয়ে শূণ্যঞ্চ সৃষ্টৌ চ লক্ষ্মীনারায়নন্বিতম।। গোলকাভ্যন্তরে জ্যোতিঃ সর্ব্বতেজোগুণান্বিতম। চতুর্ভুজৈ পার্ষদৈশ্চ জন্মমৃত্যুবিবর্জ্জিতৈ।। সব্যে চ শিবলোকশ্চ কোটিযোজনবিস্তৃতম। লয়ে সৃষ্টৌ চ সপার্ষদশিবান্বিতম।। – (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানঃ ব্রহ্মখন্ড ২/৪-১১) অনুবাদঃ কোটিসূর্যের প্রভাসমন্বিত চিন্ময় জগৎ,যার অভ্যন্তরে স্বেচ্ছাময় পরমেশ্বর ভগবান বিরাজমান।সেই উজ্জ্বল জ্যোতির অভ্যন্তরে অবস্থিত মনোহর ত্রিলোক( গোলক বৃন্দাবন, বৈকুন্ঠ এবং শিবধাম)।যোগীগন স্বপ্নেও সেই চিন্ময় জগতকে দর্শন করতে পারে না,কিন্তু বৈষ্ণবগন সেই জগৎ দর্শন করতে পারে এবং সেখানে গমন করতে পারে।সে জগৎ আধিভৌতিক, আদি দৈবিক, আধ্যত্মিক ক্লেশ থেকে মুক্ত।জরা,মৃত্যু, শোক বিবর্জিত। সে জগত অসংখ্য রত্মখচিত মন্দির দ্বারা পরিবৃত।সে জগতের মধ্যে গোলক বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ অসংখ্য গোপ গোপী সমন্বিত হয়ে সৃষ্টির সময় থেকে অবস্থান করছেন।গোলক বৃন্দাবনের অধোদেশে(“তদধো”- তৎ+ অধ)পঞ্চাশ কোটি যোজন দক্ষিণে অবস্থিত বৈকুন্ঠ।গোলক বৃন্দাবনের মতোই মনোরম বৈকুন্ঠ এবং শিবলোক ।বৈকুন্ঠের পরিধি কোটি যোজন বিস্তৃত। সৃষ্টির সময় থেকে বৈকুন্ঠে নারায়ন লক্ষ্মী সমন্বিত রুপে বিরাজমান।সে বৈকুন্ঠে বিষ্ণুর পার্ষদগন চতুর্ভুজ, তারা জন্মমৃত্যু বর্জিত।শিবলোক কোটিযোজনবিস্তৃত,এবং সে লোক সৃষ্টির সময় থেকে স্বপার্ষদ শিব সমন্বিত।” ব্রহ্মসংহিতা শাস্ত্রেও চিন্ময় জগত সম্পর্কে স্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায়।সেখানে বলা হয়েছে… গোলকনাম্নি নিজধাম্নি তলে চ তস্য দেবী-মহেশ-হরি-ধামসু-তেষু তেষু। তে তে প্রভাবনিচয়া বিহিতাশ্চ যেন গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি॥ -(ব্রহ্মসংহিতা-৫/৪৩ঃব্রহ্মা) অনুবাদঃ এই চৌদ্দভুবন বিশিষ্ট দেবীধাম বা জড় জগৎ।তার উপরে রয়েছে (চিন্ময়জগৎ) শিবধাম,তার উপরে বৈকুন্ঠধাম এবং সবার উপরে গোলক নামক কৃষ্ণধাম।সেই সমস্ত ধামে বিভিন্ন প্রভাব সমূহ যিনি বিধান করেছেন,সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি। চিন্তামনিপ্রকরসন্মসু কল্পবৃক্ষ- লক্ষাবৃতেষু সুরভীরভিপালয়ন্তম। লক্ষ্মীসহস্রশতসম্ভ্রমসেব্যমানং গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।। -( ব্রহ্মসংহিতা ৫/২৯, ব্রহ্মা) অনুবাদঃ লক্ষ লক্ষ কল্পবৃক্ষ দ্বারা আবৃত চিন্তামণিকর গঠিত গৃহসমূহে সুরভী অর্থাৎ কামধেনুগণকে যিনি পালন করছেন এবং শত সহস্র লক্ষ্মীগণ(গোপীগন) কর্তৃক সাদরে যিনি সেবিত হচ্ছেন সে আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি। আনন্দচিন্ময়রসপ্রতিভাবিতাভি- স্তাভির্য এব নিজরূপতয়া কলাভিঃ। গোলোক এব নিবসত্যখিলাত্মভূতো গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।।৩৭।। -( ব্রহ্মসংহিতা ৫/৩৭, ব্রহ্মা) অনুবাদঃ আনন্দচিন্ময়রস কর্তৃক প্রতিভাবিতা, স্বীয় চিৎরুপের অনুরূপা শ্রীরাধিকা ও তৎকায়ব্যূহরূপা সখীবর্গের সহিত যে অখিলাত্মভূত শ্রীগোবিন্দ নিত্য স্বীয় গোলোকধামে বাস করেন, সেই আদিপুরুষকে আমি ভজনা করি।।৩৭।। শ্রিয়ঃ কান্তাঃ কান্তঃ পরমপুরুষঃ কল্পতরবো দ্রুমা ভূমিশ্চিন্তামনিগণময়ী তোয়মমৃতম।। কথা গানং নাট্যং গমনমপি বংশী প্রিয়সখী চিদানন্দং জ্যোতি পরমপি তদাস্বাদ্যমপি চ।। স যত্র ক্ষীরাব্ধিঃ স্রবতি সুরভীভ্যশ্চ সুমহান্ নিমেষার্ধাখ্যো বা ব্রজতি ন হি যত্রাপি সময়ঃ। ভজে শ্বেতদ্বীপং তমহমিহ গোলকমিতি যং বিদন্তস্তে সন্তঃ ক্ষিতিবিরলচারাঃ কতিপয়ে।। –(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৫৬ঃ ব্রহ্মা) অনুবাদঃ যে স্থানে চিন্ময়ী লক্ষ্মীগন( গোপীগণ) কান্তারুপা,পরমপুরুষ কৃষ্ণই একমাত্র কান্ত,বৃক্ষমাত্রই চিদগত কল্পতরু,ভূমিমাত্রই চিন্তামণি ( চিন্ময় মণিবিশেষ),জলমাত্রই অমৃত,কথামাত্রই গান,গমনমাত্রই নাট্য,বংশী – প্রিয়সখী,জ্যোতি- চিদানন্দময়,আহার মাত্রই আস্বাদনীয়( সুস্বাদু),যে স্থানে কোটি কোটি সুরভী হতে চিন্ময় মহা – ক্ষীরসমুদ্র নিরন্তর স্রাবিত হচ্ছে,ভূত ও ভবিষ্যৎরুপ খন্ডত্ব রহিত চিন্ময় কাল নিত্য বর্তমান, সুতারাং নিমেষার্ধ প্রাপ্ত হয় না,সেই শ্বেতদ্বীপরুপ পরমপীঠকে আমি ভজনা করি।সেই ধামকে এই জড় জগতে বিরলচর অতি স্বল্পসংখ্যাক সাধুব্যক্তিই গোলক বলে জানেন। হরে কৃষ্ণ।প্রনাম প্রচারে- স্বধর্মম্ : Connect to the inner self.
নরক কি? নরক সম্পর্কে আলোচনা করুন।

নরকঃ মনুষ্য জীবের পাপকর্মের ফল স্বরুপ যে স্থান পরমেশ্বর ভগবান কতৃর্ক নির্ধারিত আছে, তাকে নরক বলা হয়। শ্রীমদ্ভাগবতের ৫/২৬/৫ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুসারে, গর্ভোদক সমুদ্রের উপরে অথাৎ ব্রহ্মান্ডের ৭ টি অধঃলোকের মধ্যবর্তী স্থানে নরকের অবস্থান। “অন্তরাল এব ত্রিজগত্যাস্ত দিশি দক্ষিণস্যামধস্তাত্তুমেরু পরিষ্টাচ্চ জলাদ্যস্যামগ্নিষ্বাত্তাদয়ঃ পিতৃগণা দিশি স্বানাং গোত্রাণাং পরমেণ সমাধিনা সত্যা এবাশিষ আশাসানা নিবসন্তি ॥”৫ ॥ -(শ্রীমদ্ভাগবতের ৫/২৬/৫) অনুবাদ-সমস্ত নরক ত্রিলোকের অন্তরালে অবস্থিত। দক্ষিণ দিকে ভূমণ্ডলের অধঃভাগে এবং গর্ভোদক সমুদ্রের উপরিভাগে নরকের অবস্থান। পিতৃলোকও সেই প্রদেশে অর্থাৎ গর্ভোদক সমুদ্র এবং নিম্নলোকের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। অগ্নিষ্বাত্তা আদি পিতৃগণ পরম সমাধিযোগে ভগবানের ধ্যান করেন এবং তাঁদের গোত্রভূত ব্যক্তিদের মঙ্গল কামনা করেন। শ্রীমদ্ভাগবত পুরান সহ অষ্টাদশ পুরান,বেদ, উপনিষদ, রামায়ন, মহাভারত,গীতা ইত্যাদি বহুবিধ সনাতনী শাস্ত্রে নরক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ভগবদগীতা ১/৪১ এবং ৪৩ নং শ্লোকে নরক সম্পর্কে বলা হয়েছে… সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্নানাং কুলস্য চ। পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিন্ডোদকক্রিয়াঃ।।৪১।। -(গীতা ১/৪১ঃ অর্জুন) অনুবাদঃ বর্ণসঙ্কর উৎপাদন বৃদ্ধি হলে কুল ও কুলঘাতকেরা নরকগামী হয়।সেইকুলে পিন্ডদান ও তর্পণক্রিয়া লোপ পাওয়ার ফলে তাদের পিতৃপুরুষেরাও নরকে অধঃপতিত হয়। উৎসন্নকুলধর্মাণাং মনুষ্যাণাং জনার্দন। নরকে নিয়তং বাসো ভবতীত্যনুশুশ্রুম।।৪৩।। -(গীতা ১/৪৩ঃ অর্জুন) অনুবাদঃ হে জনার্দন!আমি পরম্পরাক্রমে শুনেছি যে, যাদের কুলধর্ম বিনষ্ট হয়েছে, তাদের নিয়ত নরকে বাস করতে হয়। শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৭ শ্লোকে ২৮ টি নরকের কথা শ্রীল শুকদেব গোস্বামী বর্ণনা করেন। তত্র হৈকে নরকানেকবিংশতিং গণয়ন্তি অথ তাংস্তেরাজন্নামরূপলক্ষণতোহনুক্রমিষ্যামস্তামিম্রোহ ন্ধতামিম্রো রৌরবো মহারৌরবঃ কুন্তীপাকঃ কালসূত্রমসিপত্রবনং সূকরমুখমন্ধকূপঃ কৃমিভোজনঃ সন্দংশস্তপ্তসূর্মিবজ্রকণ্টকশাল্মলী বৈতরণী পৃয়োদঃ প্রাণরোধো বিশসনং লালাভক্ষঃ সারমেয়াদনমবীচিরয়ঃপানমিতি। কিঞ্চ ক্ষারকদমো রক্ষোগণভোজনঃ শূলপ্রোতো দন্দশূকোহ বটনিরোধনঃ পর্যাবর্তনঃ সূচীমুখমিত্যষ্টাবিংশতির্নর কাহবিবিধযাতনাভূময়ঃ ॥ -(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৭) অনুবাদঃ কেউ কেউ বলেন যে, ২১টি নরক রয়েছে, এবং অন্য কেউ বলেন ২৮টি। হে রাজন, আমি তাদের নাম, রূপ এবং লক্ষণ অনুসারে বর্ণনা করব। সেগুলি হচ্ছে-তামিস্র, অন্ধতামিস্র, রৌরব, মহারৌরব, কুম্ভীপাক, কালসূত্র, অসিপত্রবন, সূকরমুখ, অন্ধকূপ, কৃমিভোজন, সন্দংশ, তপ্তসূর্মি, বজ্রকণ্টক-শাল্মলী, বৈতরণী, পূয়োদ, প্রাণরোধ, বিশসন, লালাভক্ষ, সারমেয়াদন, অবীচি, অয়ঃপান, ক্ষারকর্দম, রক্ষোগণ-ভোজন, শূলপ্রোত, দন্দশূক, অবটনিরোধন, পর্যাবর্তন এবং সূচীমুখ। এইগুলি জীবের দণ্ডভোগের স্থান। এরপর শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৮-৩৬ নং শ্লোকে মুক্তপূরুষ শ্রীল শুকদেব গোস্বামী কিরুপ পাপকর্মে যুক্ত হওয়ার ফলে পাপীগণকে যমদূতগন কোন কোন নরকে নিক্ষেপ করে কঠিন শাস্তি প্রদান করেন তার বিস্তীত বিবরণ প্রদান করেন। নিম্নে তা আলোচনা করা হল- ১/ তামিস্র নরকঃ তত্র যস্তু পরবিত্তাপত্যকলত্রাণ্যপহরতি স হি কালপাশবদ্ধো যম- পুরুষৈরতিভয়ানকৈস্তামিস্রে নরকে বলান্নিপাত্যতে অনশনানুদপানদণ্ডতাড়ন- সন্তর্জনাদিভির্যাতনাভির্যাত্যমানো জন্তুর্যত্র কশ্মলমাসাদিত একদৈব মূর্ছামুপযাতি তামিস্রপ্রায়ে ॥ ৮।। –(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৮) অনুবাদঃ হে রাজন, যে ব্যক্তি অপরের ধন, স্ত্রী ও পুত্র অপহরণ করে, অত্যন্ত ভয়ঙ্কর যমদূতেরা তাকে কালপাশে বেঁধে বলপূর্বক তামিস্র নরকে নিক্ষেপ করে। এই তামিস্র নরক ঘোর অন্ধকারে আচ্ছন্ন; সেখানে যমদূতেরা পাপীকে ভীষণভাবে প্রহার, তাড়ন এবং তর্জন করে। সেখানে তাকে অনশনে রাখা হয় এবং জল পান করতে দেওয়া হয় না। এইভাবে ক্রুদ্ধ যমদূতদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে সে মূর্ছিত হয়। ২/ অন্ধতামিস্র নরকঃ এবমেবান্ধতামিস্রে যস্তু বঞ্চয়িত্বা পুরুষং দারাদীনুপযুঙক্তে যত্র শরীরী নিপাত্যমানো যাতনাস্থো বেদনয়া নষ্টমতির্নষ্টদৃষ্টিশ্চ ভবতি যথা বনস্পতিবৃশ্চমানমূলস্তস্মাদগ্ধতামিস্রং তমুপদিশন্তি।। ৯ ॥ -(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৯) অনুবাদঃ যে ব্যক্তি পতিকে বঞ্চনা করে তার স্ত্রী-পুত্র উপভোগ করে, সে অন্ধতামিস্র নরকে পতিত হয়। বৃক্ষকে ভূপাতিত করার পূর্বে যেমন তার মূল ছেদন করা হয়, তেমনই সেই পাপীকে ঐ নরকে নিক্ষেপ করার পূর্বে যমদূতেরা নানা প্রকার যন্ত্রণা প্রদান করে। এই যন্ত্রণা এতই প্রচণ্ড যে, তার ফলে তার বুদ্ধি এবং দৃষ্টি নষ্ট হয়ে যায়। সেই জন্যই সেই নরককে পণ্ডিতেরা অন্ধতামিস্র বলেন। ৩/রৌরব নরকঃ যত্ত্বিহ বা এতদহমিতি মমেদমিতি ভূতদ্রোহেণ কেবলং স্বকুটুম্বমেবানুদিনং প্রপুষ্ণাতি স তদিহ বিহায় স্বয়মেব তদণ্ডভেন রৌরবে নিপততি ॥১০৷৷ যে ত্বিহ যথৈবামুনা বিহিংসিতা জন্তবঃ পরত্র যমযাতনামুপগতং ত এব রুরবো ভূত্বা তথা তমেব বিহিংসন্তি তস্মাস্ত্রেীরবমিত্যাহুঃ রুরুরিতি সর্পদিতিক্রুরসত্ত্বস্যাপদেশঃ ॥ ১১ ॥ -(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/১০-১১) অনুবাদঃযে ব্যক্তি তার জড় দেহটিকে তার স্বরূপ বলে মনে করে, তার নিজের দেহ এবং দেহের সম্পর্কে সম্পর্কিত আত্মীয়-স্বজনদের ভরণ-পোষণের জন্য দিনের পর দিন অপর প্রাণীর হিংসা করে, সেই ব্যক্তি মৃত্যুর সময় তার দেহ এবং আত্মীয়-স্বজনদের পরিত্যাগ করে, প্রাণী হিংসাজনিত পাপের ফলে রৌরব নরকে নিপতিত হয়।এই জীবনে যে হিংসা-পরায়ণ ব্যক্তি অন্য প্রাণীদের যন্ত্রণা দেয়, মৃত্যুর পর যখন সে তার কৃত কর্মের ফলে যম-যাতনা প্রাপ্ত হয়, তখন সেই সমস্ত প্রাণীসমূহ, যাদের হিংসা করা হয়েছে, তারা ‘রুরু’ হয়ে তাকে পীড়া দেয়। এই জন্য পণ্ডিতেরা সেই নরককে রৌরব নরক বলেন। রুরু প্রাণীকে এই পৃথিবীতে দেখা যায় না, তারা সর্পের থেকেও হিংস্র। ৪/মহারৌরব নরকঃ এবমেব মহারৌরবো যত্র নিপতিতং পুরুষং ক্রব্যাদা নাম রুরবস্তং ক্রব্যেণ ঘাতয়ন্তি যঃ কেবলং দেহন্তরঃ ॥ ১২।। –(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/১২) অনুবাদঃ যারা অন্যদের কষ্ট দিয়ে নিজেদের দেহ ধারণ করে, তাদের মহারৌরব নরকে দণ্ডভোগ করতে হয়। সেই নরকে ক্রব্যাদ নামক রুরু পশুরা তাদের যন্ত্রণা দিয়ে মাংস আহার করে। ৫/কুম্ভিপাক নরকঃ যস্ত্বিহ বা উগ্রঃ পশুন পক্ষিণো বা প্রাণত উপরন্ধয়তি তমপকরুণং পুরুষাদৈরপি বিগর্হিতমমূত্র যমানুচরাঃ কুম্ভীপাকে তপ্ততৈলে উপরন্ধয়ন্তি । ১৩ ॥ –(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/১৩) অনুবাদঃ যে সমস্ত নিষ্ঠুর মানুষ তাদের দেহ ধারণের জন্য এবং জিহ্বার তৃপ্তি সাধনের জন্য নিরীহ পশু-পক্ষীকে হত্যা করে রন্ধন করে, সেই প্রকার ব্যক্তিরা নর- মাংসভোজী রাক্ষসদেরও ঘৃণিত। মৃত্যুর পর যমদূতেরা কুন্তীপাক নরকে ফুটন্ত তেলে তাদের পাক করে। ৬/কালসূত্র নরকঃ যস্ত্বিহ ব্রহ্মধ্রুক্ স কালসূত্রসংজ্ঞকে নরকে অযুতযোজনপরিমণ্ডলে তাম্রময়ে তপ্তখলে উপর্যধস্তাদগন্যর্কাভ্যামতিতপ্যমানেহভিনিবেশিতঃ ক্ষুৎপিপাসাভ্যাং চ দহ্যমানান্তবহিঃশরীর আস্তে শেতে চেষ্টতেহবতিষ্ঠতি পরিধাবতি চ যাবন্তি পশুরোমাণি তাবদ্বর্ষসহস্রাণি ॥ ১৪ ॥ -(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/১৪) অনুবাদঃ ব্রহ্মঘাতীকে কালসূত্র নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়, যার পরিধি ৮০,০০০ মাইল এবং যা তাম্রনির্মিত। নীচ থেকে অগ্নি এবং উপর থেকে প্রখর সূর্যের তাপে সেই তাম্রময় ভূমি অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়। সেখানে ব্রহ্মঘাতীকে অন্তরে এবং বাইরে দগ্ধ করা হয়। অন্তরে সে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় দগ্ধ হয় এবং বাইরে সে প্রখর সূর্যকিরণ ও তপ্ত তাম্রে দগ্ধ হতে থাকে। তাই যে কখনও শয়ন করে, কখনও উপবেশন করে, কখনও উঠে দাঁড়ায় এবং কখনও ইতস্তত বিচরণ করে। এইভাবে একটি পশুর শরীরে যত লোম রয়েছে, তত হাজার বছর ধরে তাকে যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়। ৭/অসিপত্রবন নরকঃ যস্ত্বিহ বৈ নিজবেদপথাদনাপদ্যপগতঃ পাখগুং চোপগতস্তমসিপত্রবনং প্রবেশ্য কশয়া প্রহরস্তি তত্র হাসাবিতস্ততো ধাবমান উভয়তোধারৈস্তালবনাসিপত্রৈশ্ছিদ্যমানসর্বাঙ্গো হা হত্যেহম্মীতি পরময়া বেদনয়া মূর্ছিতঃ পদে পদে নিপততি স্বধর্মহা পাখণ্ডানুগতং ফলং ভুঙক্তে ।। ১৫৪।। –(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/১৫) অনুবাদঃআপৎকাল উপস্থিত না হলেও যে ব্যক্তি স্বীয় বেদমার্গ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পাষণ্ড ধর্ম অবলম্বন করে, যমদূতেরা তাকে অসিপত্রবন নামক নরকে নিক্ষেপ করে বেত্রাঘাত করতে থাকে। প্রহারের যন্ত্রণায় সে যখন সেই নরকে ইতস্তত ধাবিত হয়, তখন উভয় পার্শ্বের অসিতুল্য তালপত্রের ধারে তার সর্বাঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত হয়। তখন সে “হায়, আমি এখন কি করব। আমি এখন কিভাবে রক্ষা পাব।” এই বলে আর্তনাদ করতে করতে পদে পদে মূর্ছিত হয়ে পড়তে থাকে। স্বধর্ম ত্যাগ করে পাষণ্ড মত অবলম্বনের ফল এইভাবে ভোগ করতে হয়। ৮/সূকরমূখ যস্ত্বিহ বৈ রাজা রাজপুরুষো বা অদণ্ড্যে দণ্ডং প্রণয়তি ব্রাহ্মণে বা শরীরদণ্ডং স পাপীয়ান্নরকেহ মুত্র সুকরমুখে নিপততি তত্রাতি- বলৈবিনিষ্পিষ্যমাণাবয়বো যথৈবেহেক্ষুখণ্ড আর্তস্বরেণ স্বনয়ন্ কচিক্ষুর্জিতঃ কশ্মলমূপগতো যথৈবেহাদৃষ্টদোষা উপরুদ্ধাঃ ॥ ১৬ ॥ -(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/১৬) অনুবাদঃ ইহলোকে যে রাজা বা রাজপুরুষ দণ্ডদানের অযোগ্য
ঈশ্বর সাকার নাকি নিরাকার???

ঈশ্বর সাকার নাকি নিরাকার – যারা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে স্বীকার করে তাদের বলা হয় আস্তিক।সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ বা শ্রুতি।বেদ প্রধানত চার প্রকার-ঋগ্,যর্জু(শুক্ল,কৃষ্ণ),সাম, অথর্ব।আবার প্রতিটি বেদের চারটি অংশ -সংহিতা,ব্রাহ্মণ,আরণ্যক,উপনিষদ।বেদ ছাড়াও সনাতন ধর্মের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ হল-স্মৃতি,ইতিহাস(রামায়ণ, মহাভারত),পুরাণ,শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা,পঞ্চরাত্র ইত্যাদি। সমগ্র সনাতনী শাস্ত্র অনুসারে সৃষ্টিকর্তা- ঈশ্বর,পরমেশ্বর, পরমব্রহ্ম, পরমাত্মা,ভগবান ইত্যাদি নামে পরিচিত। বেদ সহ সমগ্র সনাতনী শাস্ত্রে সে ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা হলেন সাকার (চিন্ময় শরীরধারী) এবং নিরাকার (বিনাশশীল দেহশূণ্য) উভয়ই। সাকার শব্দের অর্থ হল যার আকার বা দেহ বা শরীর রয়েছে।অথাৎ সাকার শব্দে যিনি মস্তক,চক্ষু, কর্ণ,হস্ত,পদ ইত্যাদি ইন্দ্রিয় বা রূপ বা আকার সমন্বিত। এবং নিরাকার শব্দের অর্থ হল যার আকার বা দেহ নেই।অথাৎ নিরাকার শব্দে যিনি মস্তক(মাথা),চক্ষু(চোখ),কর্ণ( কান),হস্ত(হাত),পদ(পা) ইত্যাদি ইন্দ্রিয় দেহ সমন্বিত নয়।ঈশ্বর সাকার নাকি নিরাকার এ সম্পর্কে শুক্ল যজুর্বেদীয় বৃহদারণ্যক উপনিষদ এবং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ শাস্ত্রে স্পষ্ট ধারনা প্রদান করা হয়েছে। “দ্বে বাব ব্রহ্মণো রুপে মূর্তং চৈবামূতং। চ মর্ত্যং চামৃতং চ স্থিতং চ যচ্চ সচ্চ ত্যচ্চ।।” -বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২/৩/১(শুক্ল যজুর্বেদ) অনুবাদঃ”ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের দুটি রুপ-মূর্ত ( মূর্তিমান বা সাকার) এবং অমূর্ত(অমূর্তিমান বা নিরাকার)। তিনি মর্ত্য ও অমৃত।তিনি স্থিতিশীল, গতিশীল,সৎ(সত্তাশীল) এবং ত্যৎ(অব্যক্ত)।” সর্বেন্দ্রিয় গুণাভাসং সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম। সর্বস্য প্রভুমীশানং সর্বস্য শরণং সুহৃৎ।। ১৭ -শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/১৭(কৃষ্ণ যজুর্বেদ),শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৩/১৫ অনুবাদঃ ঈশ্বর সমস্ত ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়ের গুণের অর্থাৎ চক্ষুকর্ণাদি দ্বারা গ্রহণযোগ্য জ্ঞানের প্রকাশক কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি সমস্ত জড় ইন্দ্রিয়বিবর্জিত, তিনি সকলেরই প্রভু এবং নিয়ন্তা। তিনি সকলের শরণ বা রক্ষক ও সকলের সুহৃৎ। উপরোক্ত শুক্ল যজুর্বেদীয় বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২/৩/১ এর মতই কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/১৭ অনুসারে ঈশ্বর হলেন সাকার বা দেহ বা ইন্দ্রিয় সমন্বিত, এবং একইসাথে সে ঈশ্বর হলেন নিরাকার বা দেহহীন বা ইন্দ্রিয়শূণ্য।শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/১৭ মন্ত্রের ভাষ্য প্রদান করতে গিয়ে শ্রীরঙ্গরামানুজ বর্ণনা করেন – সর্বেন্দ্রিয়গুণৈঃ সর্বেন্দ্রিয়জন্য জ্ঞানৈঃ আভাস: প্রকাশো যস্য তৎ তথোক্তং ইন্দ্রিয়বৃত্ত্যাদি জ্ঞাতুং সমর্থমিত্যর্থঃ, সর্বেন্দ্রিয়ত্বমপি ঐচ্ছিকমেব ন স্বাভাবিকমিত্যাহ সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতমিতি, সর্বস্য প্রভুত্ব সর্বফলপ্রদানত্বেন…” অনুবাদঃ সর্বেন্দ্রিয় গুণ এর অর্থ হল সমস্ত ইন্দ্রিয় গুলির দ্বারা অনুভূত জ্ঞান। এই জ্ঞানের প্রকাশ যার মধ্যে আছে তিনিই সর্বেন্দ্রিয়গুণাভাস। তিনি বিভিন্ন ইন্দ্রিয়জনিত জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত বিষয় জানতে সমর্থ। তার এই সর্বেন্দ্রিয়ত্ব অবস্থা তার ইচ্ছাধীন, জীবের মতো স্বাভাবিক নয়। এজন্য তিনি সর্বেন্দ্রিয় বিবর্জিত। তিনি সকলের প্রভু। মানে তিনি সর্ব ফল প্রদাতা। শ্রীমদ্ভাগবত১১/৪/৪ শ্লোকেও পরমেশ্বর ভগবানকে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রকাশক বা দেহধারী বলা হয়েছে। যৎকায় এষ ভুবনত্রয়সন্নিবেশো যস্যেন্দ্রিয়ৈস্তনুভূতামুভয়েন্দ্রিয়াণি। জ্ঞানং স্বতঃ শ্বসনতো বলমোজ ঈহা সত্বাদিভিঃ স্থিতিলয়োদ্ধব আদিকর্তা। ৪ শ্রীমদ্ভাগবতঃ ১১/৪/৪ অনুবাদ:- তাঁর শরীরের মধ্যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ত্রিভুবন মণ্ডলের সুবিন্যস্ত আযোজন করা হয়েছে। তাঁর দিব্য ইন্দ্রিয়াদির মাধ্যমে সকল দেহধারী জীবের জ্ঞান ও কর্ম সম্পর্কিত ইন্দ্রিয়গুলি সক্রিয় হয়ে উঠে। তাঁর শুদ্ধ চেতনা থেকে বদ্ধ জীবের জ্ঞান, এবং তাঁর শক্তিমান শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া থেকে দেহধারী জীবাত্মার শারীরিক ক্ষমতা, ইন্দ্রিয়ানুভূতির ক্ষমতা এবং দেহবদ্ধ সীমায়িত ক্রিয়াকলাপ সৃষ্টি হতে থাকে। জড়া প্রকৃতির সত্ব, রজ এবং তমোগুণাদির আধারের মাধ্যমে তিনিই একমাত্র গতিনির্ধারক সত্তা। আর সেইভাবেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, স্থিতি- এবং প্রলয় সাধিত হয়ে থাকে। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/১৭ মন্ত্রে বর্ণিত “সর্বেন্দ্রিয় গুণাভাসং” যার অর্থ হল – ঈশ্বর সমস্ত ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়ের গুণের অর্থাৎ চক্ষুকর্ণাদি দ্বারা গ্রহণযোগ্য জ্ঞানের প্রকাশক” এবং “সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম” যার অর্থ হল- তথাপি তিনি সমস্ত জড়/বিনাশশীল ইন্দ্রিয় বিবর্জিত, লাইনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।যার মাধ্যমে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে,পরমেশ্বর ভগবানের চক্ষু, কর্ণ,মস্তক ইত্যাদি সমস্ত ইন্দ্রিয় রয়েছে,অথাৎ তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রকাশকারী বা দেহধারী।কিন্তু জীবের অথাৎ আমাদের ইন্দ্রিয়ের মতোই তাঁর ইন্দ্রিয়গুলি জড়/বিনাশশীল নয়।তাঁর (ঈশ্বরের) ইন্দ্রিয়গুলি অপ্রাকৃত (চিন্ময়)। আমাদের হৃদয়ঙ্গম করতে হবে যে, তাঁর (ঈশ্বরের)ইন্দ্রিয়গুলি ঠিক আমাদের মত নয়। আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়জাত কর্মের উৎস যদিও তিনি, কিন্তু তাঁর ইন্দ্রিয়গুলি দিব্য ও কলুষমুক্ত। এই সম্পর্কে গীতা ১৩/১৫ শ্লোকের তাৎপর্যে শ্রীল প্রভুপাদ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে ৩/১৯নং মন্ত্রে ‘অপাননিপাদো জবনো গ্রহীতা’ বাক্যাংশ উল্লেখ করে খুব সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেন, পরমেশ্বর ভগবানের জড় জাগতিক কলুষযুক্ত কোন হাত নেই, কিন্তু তবুও তাঁর হাত আছে এবং সে হাত দিয়ে তিনি তাঁর উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত সমস্ত নৈবেদ্য গ্রহণ করেন। এটিই হচ্ছে বদ্ধ জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে পার্থক্য। ভগবানের জড় চক্ষু নাই কিন্তু তার চক্ষু আছে- তা না হলে তিনি দেখতে পান কি করে? তিনি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছু দেখতে পান। তিনি সমস্ত জীবের হৃদয়ে বিরাজ করেন এবং অতীতেই আমরা কি করেছি, এখন আমরা কি করছি এবং আমাদের ভবিষ্যতে কি হবে তা সবই তিনি জানেন। “ সুতারাং বেদ ইত্যাদি সনাতনী শাস্ত্র অনুসারে ঈশ্বর হলেন সাকার,কারন তিনি চিন্ময় বা অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয় সমন্বিত। আবার অন্যদিকে ঈশ্বর নিরাকার কারন তার কোন জড় জাগতিক বা জড় কলুষযুক্ত ইন্দ্রিয় নেই,অথাৎ বিনাশশীল কোন দেহ নেই কেননা তাঁর ইন্দ্রিয়সমূহ অপ্রাকৃত। বৈদিক শাস্ত্রে অনভিজ্ঞ কিছু ব্যক্তি বেদাদি শাস্ত্র সম্পূর্ণভাবে অধ্যয়ন না করে অথবা বেদে বর্ণিত ঈশ্বরের নিরাকার তত্ত্বকে স্বীকার করে বেদের যে যে মন্ত্রে ঈশ্বরকে সাকার বা দেহধারী বলা হয়েছে সেসমস্ত বর্ণনা সমূহকে সরাসরি বা মূখ্য অর্থে অনুবাদ না করে গৌণ বা নিজেদের কাল্পনিক মতবাদে অনুবাদ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার করছে যে ঈশ্বর কখনো সাকার বা দেহধারী নয়,তিনি নাকি শুধুই নিরাকার বা বিনাশশীল দেহশূণ্য একটি বিষয়। অথচ বেদ অনুসারে ঈশ্বর সাকার ও নিরাকার উভয়ই। মনুসংহিতাতে বলা হয়েছে, একই বিষয়ে দুটি পরস্পর বিপরীত বাক্য থাকলে দুটিকে ধর্ম বা সত্য মনে করতে হবে।এ দুটি বাক্যের একটি সত্য আর অন্যটি মিথ্যা মনে করে মিথ্যাকে সত্য করতে কল্পনা বা গৌণ অনুবাদ করা উচিত নয়। শ্রুতিদ্বৈধং তু যত্র স্যাত্তত্র ধর্মাবুভৌ স্মতৌ। উভাবপি হি তৌ ধমৌ সম্যগুক্তৌ মনীষিভি।। -মনুসংহিতা ২/১৪ অনুবাদঃ যেখানে দুটি শ্রুতি বা বেদ বচনের পরস্পর বিরুদ্ধ উপদেশ থাকলে সেখানে দুটিকেই ধর্ম বলে গ্রহণ করতে হবে ( যেমন- বেদে ঈশ্বরকে সাকার এবং নিরাকার উভয়ই বলা হয়েছে,ইত্যাদি)।কারন মনিষীগণ বলে গিয়েছেন, ঐ দুটি ধর্ম, ঐ দুটি দোষহীন। এরা সনাতন ধর্ম প্রচার ক্ষেত্রে আধুনিক বিজ্ঞানকে হাতিয়ার বা প্রামানিক হিসেবে প্রচার করে,অথচ আধুনিক বিজ্ঞান অনুসারে প্রাণযুক্ত বিষয় অথচ যার শরীর বা দেহকে স্বীকার করা হচ্ছে না(এমনকি একটি ব্যাকটেরিয়ারও একটি শরীর বা দেহ আছে, যা স্বাভাবিক চোখে দেখা যায় না,কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখা যায়), তাহলে তা হল শূণ্য বিষয়। অথাৎ মস্তক(মাথা),হস্ত(হাত),পদ(পা) ইত্যাদি ইন্দ্রিয় সমন্বিত কাউকে যদি স্বীকার করা না হয়, তাহলে তা প্রাণ বা অস্তিত্বশূণ্য। পৃথিবীতে এমন কোন প্রাণযুক্ত বিষয় দেখা যাবে না,যেটির ইন্দ্রিয় বা আকার নেই।যেমন বলা যায়,রাষ্ট্র জড়া প্রকৃতির মধ্যে একটি নির্দিষ্ট আয়তন সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। তাঁর কোন ক্ষমতা নেই নিজে নিজে পরিচালিত হওয়ার। ঈশ্বরকে রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীর সাথে তুলনা করা যায়। রাষ্ট্রকে যেমন রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী পরিচালনা করেন, ঠিক তেমনই এই জড়া প্রকৃতি পরমেশ্বর ভগবানের দ্বারা সৃষ্ট ।আর সে প্রকৃতিকে যিনি পরিচালনা করছেন তাকে ঈশ্বর বলা হয়।প্রধানমন্ত্রীর যেমন হাত,পা,চোখ,নাক সব ইন্দ্রিয় আছে, ঠিক তেমনই এই সমগ্র জগৎ যার ইচ্ছায় পরিচালিত হচ্ছে তার হাত,পা,চোখ, নাক,মাথা ইত্যাদি সমস্ত ইন্দ্রিয় আছে। তথাকথিত নিরাকারবাদীদের মত অনুসারে যদি আমি বলি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীনরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী
স্বর্গ কি? স্বর্গ সম্পর্কে আলোচনা করুন। কেন মুক্তিকামী ব্যক্তি স্বর্গলোক কামনা করে না ???

আজকাল কিছু শাস্ত্রজ্ঞানহীন ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার করছে যে, স্বর্গ ও নরক নামে নাকি কোন কিছু নেই।তাদের কথা শুনলে আমাদের হাসি পায়।কারন সনাতনী সমগ্র শাস্ত্রে স্বর্গ এবং নরক সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে। নিম্নে স্বর্গ সম্পর্কে আলোচনা করা হল- স্বর্গঃ স্বর্গ হল জীবের পুন্যফলে লভ্য চতুর্দশ ভুবনের মধ্যে একটি সুখময় স্থান।বেদ(শ্রুতি),স্মৃতি,ইতিহাস(মহাভারত, রামায়ন) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা , অষ্টাদশ পুরাণ, পঞ্চরাত্র ইত্যাদি বিভিন্ন শাস্ত্রে স্বর্গের বর্ণনা পাওয়া যায়।শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৩৮ নং শ্লোকে চতুর্দশ ভূবন বিশিষ্ট এই ব্রহ্মান্ডের কথা আলোচনা করা হয়েছে। অথাৎ আমাদের এই ব্রহ্মান্ডে রয়েছে ৭ টি উদ্ধলোক ও ৭ টি অধঃলোক। ব্রহ্মান্ডের ৭ টি উদ্ধলোক সমূহ হল – ভূলোক( পৃথিবী),ভূবলোক, স্বর্গলোক(ইন্দ্রলোক), মহলোক, জনলোক, তপলোক এবং সত্যলোক(ব্রহ্মলোক)। এবং ৭ টি অধলোক হল -অতল,বিতল,সুতল,তলাতল, রসাতল, মহাতল এবং পাতাল (“এতাবানেবান্ডকোশো যশ্চতুর্দশধা পুরাণেষু বিকল্পিত উপগীয়তে” – শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/৩৮) ঋগ্বেদের ৩/৬২/১০ মন্ত্রে এ ব্রহ্মান্ডের উদ্ধলোকের তিনটি লোকের মধ্যে স্বর্গলোকের বিবরন পাওয়া যায়। ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ । –ঋগ্বেদ ৩/৬২/১০ অনুবাদঃ যিনি ভুলোক,ভুবলোক এবং স্বর্গলোক এই ত্রিলোকের স্রষ্টা,অথাৎ সমস্ত বিশ্বলোকের প্রসবিতা, সেই সচ্চিদানন্দঘন পরমব্রহ্মের বরনীয় জ্যোতিকে আমরা ধ্যান করি।তিনি আমাদের মন ও বুদ্ধিকে শুভ কার্যে প্রেরনা প্রদান করুন। এছাড়াও বেদের বহু মন্ত্রে স্বর্গলোকের বর্ণনাপাওয়া যায়।ভগবদগীতা ২/২ নং শ্লোকে পরমাত্মা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে স্বর্গলোক বা ইন্দ্রলোক সম্পর্কে বর্ণনা প্রদান করেন। কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্। অনার্যজুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরমর্জুন।। -(ভগবদগীতা ২/২,ভগবান শ্রীকৃষ্ণ) অনুবাদঃপ্রিয় অর্জুন, এই ঘোর সঙ্কটময় যুদ্ধস্থলে যারা জীবনের প্রকুত মূল্য বোঝে না, সেই সব অনার্যের মতো শোকানল তোমার হৃদয়ে কিভাবে প্রজ্বলিত হল? এই ধরনের মনোভাব তোমাকে স্বর্গলোকে উন্নীত করবে না, পক্ষান্তরে তোমার সমস্ত যশরাশি বিনষ্ট করবে। ত্রৈবিদ্যা মাং সোমপাঃ পূতপাপা যজ্ঞৈরিষ্ট্বা স্বর্গতিং প্রার্থয়ন্তে। তে পুন্যমাসাদ্য সুরেন্দ্রলোকম্ অশ্নন্তি দিব্যান্ দিবি দেবভোগান্।। -(গীতা ৯/২০,ভগবান শ্রীকৃষ্ণ) অনুবাদঃ ত্রিবেদজ্ঞগণ যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা আমাকে আরাধনা করে যজ্ঞাবশিষ্ট সোমরস পান করে পাপমুক্ত হন এবং স্বর্গে গমন প্রার্থনা করেন। তাঁরা পুণ্যকর্মের ফলস্বরূপ ইন্দ্রলোক লাভ করে দেবভোগ্য দিব্য স্বর্গসুখ উপভোগ করেন। তে তং ভুক্ত্বা স্বর্গলোকং বিশালং ক্ষীণে পুণ্যে মর্ত্যলোকং বিশন্তি।এবং ত্রয়ীধর্মমনুপ্রপন্না গতাগতং কামকামা লভন্তে।। –(গীতা ৯/২১,ভগবান শ্রীকৃষ্ণ) অনুবাদঃ তাঁরা সেই বিপুল স্বর্গসুখ উপভোগ করে পুণ্য ক্ষয় হলে মর্ত্যলোকে ফিরে আসেন। এভাবেই ত্রিবেদোক্ত ধর্মের অনুষ্ঠান করে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের আকাঙ্ক্ষী মানুষেরা সংসারে কেবলমাত্র বারংবার জন্ম-মৃত্যু লাভ করে থাকেন। উপরোক্ত আলোচনায় এভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদগীতায় স্বর্গলোকের বর্ণনা প্রদান করেন,এবং সাথে সাথে স্বর্গকামীগনের অভিলাষিত স্বর্গলোকে গমন করার জন্য অনুৎসাহী করে গীতা ৭/৫ এবং গীতা ১৫/৬ নং শ্লোকে স্পষ্টভাবে তার স্বীয় ধাম চিন্ময় পরা প্রকৃতি গোলক বৃন্দাবন ও বৈকুন্ঠ ধামে ফিরে যাওয়ার জন্য আমাদের উৎসাহিত করেন,যেখানে গেলে আর কখনো আমাদের এই অপরা প্রকৃতি বা জড় জগতে ফিরে আসতে হবে না। অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধিমে পরাম্। জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ।। -(গীতা ৭/৫ঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ) অনুবাদঃ হে মহাবাহো! এই অপরা প্রকৃতি ( জড় জগৎ) ব্যতীত আমার আর একটি পরা প্রকৃতি(চিন্ময় জগৎ) রয়েছে। সেই প্রকৃতি চৈতন্য-স্বরূপা ও জীবভূতা; সেই শক্তি থেকে সমস্ত জীব নিঃসৃত হয়ে এই জগৎকে ধারণ করে আছে। ন তদ্ ভাসয়তে সূর্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ। যদ্ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।।” -(গীতা ১৫/৬ঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ) অনুবাদঃ সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি বা বিদ্যুৎ আমার সেই পরম ধামকে আলোকিত করতে পারে না। সেখানে গেলে আর জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না। হরে কৃষ্ণ। প্রনাম। স্বধর্মম্ : Connect to the inner self.
কিভাবে জগন্নাথদেব পুরীধামে প্রকটিত হয়েছিল? (পর্ব ২)

পুরীধামে পরমেশ্বর ভগবান জগন্নাথদেবের প্রকাশঃ ১ম পর্বের পর- স্কন্দ পুরাণ,বিষ্ণুক্ষেত্র, পুরুষোত্তমক্ষেত্র মাহাত্ম্য, সপ্তম অধ্যায়ের ৭৯-৯৮ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ীঃ “ক্রমে বিদ্যাপতি পর্বতের সন্নিকট ভূমিতে আরোহন করলেন( নামলেন),কিন্তু সেই মুকুন্দদেব দর্শনোৎসুক বিপ্র চারিদিকে অনুসন্ধান করেও পথ প্রাপ্ত হলেন না।এরপর কুশপত্র বিছিয়ে মুকুন্দদেবের( বিষ্ণু) দর্শন আকাঙ্ক্ষায় তার শরনাগত হলেন।বিদ্যাপতি পর্বতের পঞ্চিমভাগ থেকে পরষ্পর ভগবদ্ভক্তি বিষয়ক আলাপ করছিলেন,তাদের সেই অলৌকিক বাক্য শ্রবণ করেন।এরপর বিদ্যাপতি আনন্দিত হয়ে সেই বাক্য অনুসরন করে গমন করেন।সে স্থান শবরজাতির বাসগৃহসমূহে চতুর্দিকে বেষ্টিত,তা তিনি দর্শন করেন।তিনি ক্রমে সেই স্থানে বিনীতভাবে প্রবেশ করে, সে স্থানের বৈষ্ণবদের দর্শন করেন।পরে বিশ্বাবসু নামে একজন বৃদ্ধ শবর হরিপূজা সমাপন করে পূজাবশিষ্ঠ চন্দনাদি দ্বারা শোভিত হয়ে গিরি মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন,তাকে বিদ্যাপতির নয়নগোচর হল।বিশ্বাবসু সে ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতিকে জিজ্ঞেস করেন,হে বিপ্র আপনি কোথা থেকে এই দুর্গম কাননে এসেছেন? আপনি ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কাতর ও শ্রান্ত।অতত্রব কিছু সময় এই স্থানে সুখে অবস্থান করুন।বিশ্বাবসু দ্বিজকে পাদ্য,আসন, অর্ঘ্য অর্পন করে বিনয় বাক্যে বললেন,হে বিপ্র আপনি ফল দ্বারা, না পাক করে আহার করবেন? আপনার যা অভিরুচি তাই প্রস্তুত করে দিব।শবর এই কথা বললে বিদ্যাপতি বললেন, আমার ফল ও পাকে কোন প্রয়োজন নাই।হে সাধো!যে কারনে দূর থেকে এসেছি তা সফল করুন।আমি অবন্তী পুরবাসী ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজার পুরোহিত।বিষ্ণুর দর্শন মানসে এসেছি।রাজসন্নিধানে তীর্থপর্য্যটকদিগের সমাজে তীর্থক্ষেত্রপ্রসঙ্গে এই তীর্থের একটি প্রস্তাব করেন।রাজা উৎকন্ঠিত হয়ে আমাকে এই স্থানে অবস্থিত নীলমাধব হরিকে দর্শন করতে প্রেরণ করেন। আমি তাকে দর্শন করে সংবাদ নিয়ে যতক্ষণ তার কাছে যাচ্ছি না,ততক্ষণ অনাহারে থাকব।এই কারনে আমাকে সেই বিষ্ণুর দর্শন করাও।” অষ্টম অধ্যায় ১-৭৮ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ীঃ জৈমিনি বললেন,বিদ্যাপতি এই কথা বললে শবর চিন্তিত হলেন যে,আহা! আমাদের দুর্দিন উপস্থিত হল।ব্রাহ্মণ যদি নীলমাধবকে দর্শন করে তাহলে সকলেই জানতে পারবে, যদি না দেখায় ব্রাহ্মণ আমাকে অভিশাপ দিয়ে চলে যাবে।সকল জাতির মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ, বিশেষত ইনি অতিথি, এনার অভিলাষ পূর্ণ না হলে আমার উভয় লোকই বিফল হবে।বিশ্বাবসু এই বিবেচনা করে ব্রাহ্মণকে বললেন,ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে নরপতি এই ক্ষেত্রে বাস করবেন, এই বৃত্তান্ত আমরা পূর্বেই শুনেছি।আপনি যেহেতু তার পূর্বে নীলমাধবকে দর্শন করলেন তখন আপনি তার থেকেও অধিক ভাগ্যবান।অতত্রব হে ব্রাহ্মণ,আসুন আমরা পর্বতের উপরিভাগে গমন করি।এই কথা বলে শবরপতি বিদ্যাপতির হাত ধরে অতি সঙ্কীর্ণ একটি মাত্র পথ দিয়ে পাথর ও কাটাতে আবৃত দুর্গম ও প্রায় অন্ধকারময় পথে চলতে লাগলেন।এই পথে যেতে যেতে শবর কুন্ডের তটে উপস্থিত হলেন।কুন্ড দর্শন করে ব্রাহ্মণকে ( বিদ্যাপতি) বললেন, হে দ্বিজোত্তম, এই মহাতীর্থের নাম রৌহিন।তার পূর্বে এক মহৎ অক্ষয় বৃক্ষ আছে।তার ছায়া প্রাপ্ত হলে ব্রহ্মহত্যার পাপ ক্ষয় হয়।নিকুঞ্জের(পুষ্পবাগানে শোভিত) ভিতরে ঐ দেখ সাক্ষাৎ জগন্নাথ( বিষ্ণু)।তাকে দর্শন করে সঞ্চিত পাপ হতে মুক্ত হও। জৈমিনি বললেন, অত্যন্ত বুদ্ধিমান বিদ্যাপতি শ্রীহরিকে দর্শন করে নত মস্তকে প্রনাম করে একাগ্রমনে ও অত্যন্ত আনন্দিত চিত্তে হরিকে স্তব করলেন।এরপর শবর বিশ্বাবসুকে বললেন, হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ, প্রভুকে দর্শন করে আপনি কৃতার্থ হয়েছেন,এক্ষণে আমরা গৃহে গমন করি।বনমধ্যে হিংস্র জন্তুর বসবাস,তাই এখানে থাকা আমাদের উচিত হবে না।সূর্যাস্থ হওয়ার পূর্বে গৃহে গমন করি। হে দ্বিজগণ,বিশ্বাবসু এই বলে ব্রাহ্মণের হস্ত ধারন ধরে গৃহে গমন করলেন।ব্রাহ্মণ অতিথিকে প্রাপ্ত হয়ে বিবিধ ভোজ্যদ্রব্য দ্বারা ভোজন করালেন।এরপর বিদ্যাপতি ( ব্রাহ্মণ) বিশ্বাবসুকে বললেন,আমি এখান থেকে গমন করলে ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজা এখানে এসে বাস করবেন।তিনি ভগবানের প্রীতিবিধানের নিমিত্তে এখানে বৃহৎ প্রাসাদ নির্মাণ করবেন।এরপর শবর বললেন,হে সখে, আপনি ইন্দ্রদ্যুম্ন নৃপতির আগমন বিষয়ে যা বললেন তা এ ক্ষেত্রে বহু পূর্ব থেকে জনশ্রুতি আছে।কিন্তু মাধবকে এই নৃপতি( ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজা) দর্শন করতে পারবেন না,যেহেতু কিছুদিনের মধ্যে ভগবান স্বর্ণবালুকা দ্বারা আবৃত হবেন।ভগবান অন্তর্হিত হবেন, যমের কাছে এই প্রতিজ্ঞা করেন।কিন্তু আপনি মহাভাগ্যবান,তাই আপনি ভগবানকে দর্শন করলেন।হে মিত্র, ইন্দ্রদ্যুম্ন নৃপতির আগমনের পূর্বে তিনি যে অন্তর্হিত হবেন,রাজার নিকট এ বিষয়ে কখনো বলবেন না।সেই রাজা এখানে আগমন করে পরমেশ্বরকে দর্শন করতে না পেয়ে প্রয়োগপবেশন ব্রতে ব্রতী হয়ে গদাধরকে(বিষ্ণু)স্বপ্নে দর্শন করবেন।তিনি তার আদেশক্রমে ব্রহ্মার দ্বারা প্রভুর চারটি রুপ প্রতিষ্ঠিত করে ভক্তিসহকারে পূজা করবেন।এরপর বিদ্যাপতি ও বিশ্বাবসু শয্যায় গমন করলেন।প্রভাত( সকাল) হলে বিদ্যাপতি মাধবকে দর্শন করে ইন্দ্রদ্যুম্নের প্রাসাদ অভিমুখে যাত্রা করলেন।” চলবে… জয় জগন্নাথ। হরে কৃষ্ণ। প্রণাম
কিভাবে জগন্নাথদেব পুরীধামে প্রকটিত হয়েছিল ? (পর্ব ১)

পুরীধামে পরমেশ্বর ভগবান জগন্নাথদেবের প্রকাশঃ সামবেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদ ৭/১/২ অনুসারে পুরাণসমূহ হল পঞ্চম বেদ “ইতিহাসপুরাণং পঞ্চমং বেদানাং” ইতিহাস (রামায়ন ও মহাভারত) এবং পুরাণসমূহ(অষ্টাদশ পুরাণ) হল পঞ্চম বেদ।বেদের লিপিকার পরমেশ্বর ভগবানের শক্ত্যাবেশ অবতার শ্রীল ব্যাসদেব অষ্টাদশ পুরাণ শাস্ত্র লিপিবদ্ধ করেন।স্কন্দ পুরাণ হল অষ্টাদশ পুরাণ শাস্ত্রের মধ্যে একটি। স্কন্দ পুরাণের বিষ্ণুক্ষেত্র, পুরুষোত্তম ক্ষেত্র মাহাত্ম্য, প্রথম অধ্যায় থেকে সপ্তবিংশ অধ্যায় পর্যন্ত বিষ্ণুভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কিভাবে পুরুষোত্তম ক্ষেত্র পুরীধামে জগন্নাথদেব (শ্রীকৃষ্ণ),বলদেব (বলরাম),সুভদ্রা ও সুদর্শনের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার বিস্তৃত বিবরণ প্রদান করা হয়েছে। আমরা অধ্যায়ভিত্তিক ধারাবাহিক ভাবে তা জানার প্রচেষ্টা করব। স্কন্দ পুরাণ,বিষ্ণুক্ষেত্র, পুরুষোত্তম ক্ষেত্র মাহাত্ম্য, প্রথম অধ্যায়ের ১- ৫ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুসারে, “একসময় মুনিগণ মহর্ষি জৈমিনি ঋষিকে সম্বোধন করে প্রশ্ন করেন, হে মহাত্মা, আপনি সকল শাস্ত্রজ্ঞ ও সমুদয় তীর্থের মাহাত্ম্য অবগত। ইতিপূর্বে তীর্থকতন প্রস্তাবে পরম পবিত্র পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। এই ক্ষেত্রে স্বয়ং নারায়ণ দারুময় কলেবর পরিগ্রহপূর্বক বিরাজমান আছেন। সে ক্ষেত্রটি কোন ব্যক্তি নির্মাণ করেন, তা সবিস্তারে আমাদের কাছে বর্ণনা করুন?সেই সাক্ষাৎ নারায়ণ স্বয়ং ভগবান পরমপুরুষ হয়েও কি কারনে দারুময়রুপে সেই ক্ষেত্রে বিরাজমান আছেন?আপনার নিকট তা শ্রবনে আমাদের কৌতুহল হয়েছে,সে কারনে আপনি পরমবাগ্মী ও সর্বলোকের গুরু।এরপর জৈমিনি ঋষি মুনিগনকে সম্বোধন করে বলতে লাগলেন- জৈমিনি উবাচ।শৃনুধ্বং মুনয় সর্বেব রহস্যং পরমং হি তৎ।অবৈষ্ণনাং শ্রবণে ভক্তিস্তত্র ন জায়তে।। ৬।।যস্য সঙ্কীর্ত্তনাদেব সকলং লীয়তে তম।স্কন্দেন কথিতং পূর্ব্বং শ্রুত্বা শম্ভোমুখাম্বুজাৎ।।৭।।সমক্ষৎ সিদ্ধদেবৌব সভায়াং মন্দরোদরে।অহমপ্যগমং তত্র দেবদেবং সমচ্চির্তুম।যথাশ্রুতং কথয়তো দেবানাং পুরতো ময়া।।৮।। অনুবাদঃ জৈমিনি বললেন,হে মুনিগণ,সেই পরমরহস্য ক্ষেত্রের বিবরন শ্রবণ করে অবৈষ্ণব বা অভক্তদের ভক্তি লাভ হয় না।পুরাকালে কার্তিকেয় মহাদেবের মুখপদ্ম হতে শ্রবণ করে মন্দরপর্বতে সিদ্ধগণ দেবগণের সভাতে তা বর্ণনা করেন,যা শ্রবণ করে তমগুণ দূরীভূত হয়।আমি তখন সেই দেবদেব মহাদেবের পূজা করার নিমিত্তে সেখানে গমন করেছিলাম।তাই আমি তা কার্তিকের মুখ থেকে শ্রবণ করেছিলাম,তা এখন অবিকল বর্ণনা কর়ছি,শ্রবণ করুন। এরপর ৯-৪৪ নং শ্লোক পর্যন্ত প্রথম অধ্যায়,২য়-৫ম অধ্যায় পর্যন্ত পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে মুনিগণ জৈমিনি ঋষিকে বললেন,হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ! কোন দেশে সেই পুরুষোত্তম ক্ষেত্রটি বিদ্যমান,যেখানে নারায়ন সাক্ষাৎ দারুরুপী প্রকাশিত? এর উত্তরে জৈমিনি বললেন,উৎকল ( বর্তমান নাম উড়িষ্যা বা পুরী) নামে একটি পরমপবিত্র বিখ্যাত দেশ আছে,তাতে অনেক তীর্থ ও পূণ্যস্থান বর্তমান।সেই দেশটি দক্ষিণ সমুদ্রের তীরে অবস্থিত।সেখানের লোকসকল সদাচারে বিখ্যাত। ৭ম অধ্যায়ের ১-৭৮ শ্লোকের বর্ণনা অনুযায়ী, মুনিরা জৈমিনি ঋষিকে প্রশ্ন করেন,হে মহর্ষি কোন যুগে ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজা ছিলেন? কোন দেশে ওনার নগর? তিনি কি প্রকারে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে গমন করেন? কি নিমিত্তে বিষ্ণুবিগ্রহ নির্মাণ করেন? এই সকল যথার্থরুপে বিস্তৃত ভাবে বর্ণনা করুন। জৈমিনি উবাচ। আসীৎ কৃতযুগে বিপ্রা ইন্দ্রদ্যুম্নো মহানৃপ। সূর্য্যবংশে স ধর্ম্মাত্মা সৃষ্ট পঞ্চমপুরুষ।।৬।। অনুবাদঃ জৈমিনি বললেন,সত্যযুগে সূর্য্যবংশে জাত ইন্দ্রদ্যুম্নো নামে এক রাজা ছিলেন।সেই ধর্মাত্মা ব্রহ্মার পঞ্চম পুত্র। তিনি সত্যবাদী,সদাচারী, নিষ্পাপ ও সাত্ত্বিকশ্রেষ্ঠ।তিনি প্রজাদেরকে সন্তানের ন্যায় প্রতিপালন করতেন।তিনি ছিলেন জিতেন্দ্রিয় এবং বৈষ্ণব। পারমার্থিক মুক্তিকামনায় ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজসূয় মহাযজ্ঞ এবং শত অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন।এইরুপ সকল গুনবিশিষ্ট পৃথিবীপালক সেই রাজা দ্বিতীয় অমরাবতীর ন্যায় সর্বরত্নযুক্ত সুবিখ্যাত অবন্তী নগরীতে বাস করতেন।তিনি সে নগরে বাস করে কায় মনো বাক্যে বিষ্ণুর প্রতি অচলাভক্তি প্রদর্শন করেছিলেন। একদা নরপতি ( ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজা) দেবার্চ্চনগৃহে শ্রীপতি বিষ্ণুর পূজার সময়ে পন্ডিত এবং তীর্থযাত্রা প্রস্তাবকারীগণসহ পুরোহিতকে সমাদরে জিজ্ঞাসা করলেন- আদৃতো ব্যাজহারেদং জ্ঞায়তাং ক্ষেত্রমুত্তমম। যত্র সাক্ষাৎ জগন্নাথং পশ্যাম্যেতেন চক্ষুষা।। ১৮।। অনুবাদঃ জানেন উত্তম ক্ষেত্রধাম কোথায়? যেখানে সাক্ষাৎ জগন্নাথদেবকে এই চর্মচক্ষুদ্বারা দর্শন করা যায়? পুরোহিত সেই বিষ্ণুভক্ত নৃপশ্রেষ্ঠ কতৃর্ক এইপ্রকার জিজ্ঞসিত হয়ে তীর্থযাত্রিদের প্রতি দৃষ্টিপাতপূর্বক প্রশ্ন করেন,হে তীর্থযাত্রীগণ,আপনারা সর্বদা তীর্থ ভ্রমণ করেন,আপনারা ধার্মিক ও বহুদেশদর্শী,এই রাজা যা আদেশ করছেন, তা কি আপনারা শ্রবণ করেছেন? রাজন্ননেকতীর্থানি ব্যচাবিষমহং প্রভো।আশৈশবাৎ ক্ষিতিতলে শ্রুতান্যন্যৈশ্চ তীর্থগেঃ।।২২।।ওড্রদেশ ইতি খ্যাতে বর্ষে ভারতসংজ্ঞকে দক্ষিনস্যোদধেস্তীরে ক্ষেত্র পুরুষোত্তম।।২৩।। অনুবাদঃ তীর্থযাত্রীগনের মধ্যে একজন বললেন,হে রাজন, আমি শিশুকাল থেকে এই ভূমন্ডলে বহু তীর্থ ভ্রমন করে়ছি এবং অন্যান্য তীর্থগামী ব্যক্তির নিকটেও শুনে়ছি যে,এই ভারতবর্ষের বিখ্যাত ওড্রদেশের ( বর্তমান নাম উড়িষ্যা/পুরী) দক্ষিণ সমুদ্রের তীরে শ্রীপুরুষোত্তম নামে উত্তম ক্ষেত্র আছে। তার মধ্যে নীলগিরি নামে এক পর্বত আছে।তার চতুর্দিক বনে আবৃত।তার অগ্রভাগে চতুর্দিকে একক্রোশ পরিমাণ এক কল্পবৃক্ষ আছে,ঐ বৃক্ষের ছায়াস্পর্শে ব্রহ্মহত্যার পাপ বিনষ্ট হয়।তার পঞ্চিমে রৌহিন নামে বিখ্যাত এক কুন্ড আছে। তস্য প্রাকৃতমাস্থায় নীলেন্দ্র মনিনির্ম্মিতা।। ২৬।। তনু শ্রীবাসুদেবস্য সাক্ষন্মুক্তি প্রদায়িনী।২৭।। অনুবাদঃ সেখানে অথাৎ ঐই কুন্ডের তীরে নীলকান্তমণি নির্মিত ভগবান বাসুদেবের মুর্তি বিদ্যমান।।তা সাক্ষাৎ মুক্তিপ্রদ। যে ব্যক্তি সেই কুন্ডে স্নান করে পুরুষোত্তমকে সেবা করে, সে সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল প্রাপ্ত হয়ে মুক্তিলাভ করে।তার পঞ্চিমদিকে শবরদীপক নামে বিখ্যাত একটি শ্রেষ্ঠ আশ্রম আছে,যেখানে সাক্ষাৎ জগন্নাথ ( বিষ্ণু)শঙ্খ,চক্র,গদা ধারণপূর্বক অবস্থান করছেন।হে রাজন,আপনি বিষ্ণুভক্ত এবং সতত দৃঢ়ব্রত,এজন্য আপনাকে উপদেশ দেওয়ার নিমিত্তে এ স্থানে আমি আগমন করেছি।এক্ষণে আপনার নিকট ধন ও ভূমি প্রার্থনা করতে আসিনি।আমার এ কথা অলীক বিবেচনা না করে পুরুষোত্তমস্থ পুরুষোত্তমের ভজনা করুন।সেই জটিল তপস্বী এই উপদেশ দান করে সকল দর্শকদের নিকট হতে সত্ত্বর অন্তর্ধান হলেন।রাজা নিতান্ত বিস্ময়ে ব্যাকুল হলেন যে,আমি এখন কিরুপে জীবন নির্বাহ করব? এইরুপ চিন্তা করে রাজা পুরোহিতকে বললেন,হে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ আমি বিস্ময়কর এ বৃত্তান্ত শ্রবন করে যে স্থলে সেই গদাধর আছেন, সেখানে আমার বুদ্ধি সত্ত্বরগামিনী হয়েছে।পুরোহিত বললেন, আমি প্রতিজ্ঞা করছি,যাতে সেই সাক্ষাৎ মুক্তিদাতা কেশবকে চর্মচক্ষু দ্বারা দর্শন করতে আপনি পারেন,তা আমি অবশ্যই করব।সেই মহাপূণ্য পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে আমরা সকলে গমন করে তাতে বাস করতে পারি,সেরুপ যত্ন করব।ব্রাহ্মণের সেই বাক্য শ্রবণ করে রাজা বললেন,আপনার নিকট এরুপ বাক্য শ্রবণ করে সেই ক্ষেত্রে ভগবানের নিকট বাস করব,এই প্রতিজ্ঞা করছি।অতএব আপনার ভ্রাতা সেখানে গমন করে আমাদের মঙ্গল বিধান করুন।রাজা এ কথা বলে অন্তঃপুরে অত্যন্ত আনন্দচিত্তে গমন করেন। এরপর পুরোহিত সেই সকল ব্যক্তিকে রাজার আজ্ঞাক্রমে যথাযোগ্য সন্মান সহকারে স্বীয় আশ্রমে বিদায় দিলেন।এরপর ভ্রাতা বিদ্যাপতিকে স্বস্ত্যায়নপূর্বক শুভক্ষণে প্রেরণ করেন। জৈমিনি বললেন,হে বিপ্রগণ, বিদ্যাপতি রথে আরোহন করে জগন্নাথদেবকে চিন্তা করতে করতে বায়ুবেগে গমন করতে লাগলেন।হে বিপ্রগণ, বহুদিন গত হলে অপরাহ্ণে পথিমধ্যে ভূমন্ডলের পবিত্রতাজনক ও ভূবনের মঙ্গলজনক ওড্রদেশ( বর্তমান উড়িষ্যা) দর্শন করলেন।এই প্রকারে বন,গিরি,দূর্গ ও পথসকল দর্শন করতে করতে সূর্যাস্ত্র সময়ে মহানদীর তীরে উপস্থিত হলেন।হে বিপ্রগণ! বিদ্যাপতি রথ থেকে ভূমিতে আরোহন করে আহ্নিক ক্রিয়া সমাপন করে,সন্ধ্যা উপাসনা সম্পন্ন করে মধুসূদনকে চিন্তা করলেন এবং রথপৃষ্টে স্থিতিপূর্বক রাত্রিযাপন করেন।এরপর বিদ্যাপতি প্রাতঃকৃত্য সমাপন করে গোবিন্দকে চিন্তা করতে করতে রথে আরোহন করে সে স্থান প্রস্থান করলেন।তারপর উভয়দিক পথ দর্শন করতে করতে শ্রোত্রিয়,যাজ্ঞিক ও ব্রহ্মতেজস্বীদিগের যুপকাষ্ঠ দ্বারা শোভিত গ্রামে আগমন করেন।হে দ্বিজগন!ব্রাহ্মণ( বিদ্যাপতি) কিছুদূর গিয়ে নীলাচল পর্বত দেখলেন,ঐই পর্বতটি কল্পবটশোভিত,চতুর্পাশ্বে কাননশ্রেণী।ঐই পর্বতে সাক্ষাৎ মুর্তিমান বিষ্ণুর বাসস্থান। “ … চলবে। জয় জগন্নাথ। হরে কৃষ্ণ। প্রনাম।
কেন ‘ব্রহ্মসংহিতা’কে প্রামানিক বৈদিক শাস্ত্র বলা হয়?!

আজকাল কিছু শাস্ত্রজ্ঞানহীন ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার করছে যে ব্রহ্মসংহিতা নাকি কোন প্রামাণিক শাস্ত্র নয়।প্রকৃত অর্থে তাদের এ ধরনের মন্তব্য সনাতনী শাস্ত্র সমন্ধে তাদের মুর্খতার পরিচায়ক।আসুন আমরা শ্রীল ব্যাসদেবকৃত অষ্টাদশ পুরানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান শাস্ত্র থেকে ব্রহ্মসংহিতার প্রামানিকতা জানার চেষ্ঠা করি। এবং পুরানসংখ্যানাং চতুর্লক্ষমুদাহৃতম। অষ্টাদশ পুরানানাং নাম চৈতদ্বিদুবুর্ধাঃ।।২১।। এবঞ্চোপপুরাণামাষ্টাদশ প্রকীর্ত্তিতা। ইতিহাসো ভারতনঞ্চ বাল্মীকিকাব্যমেব চ।।২২।। পঞ্চকং পঞ্চরাত্রাণাং কৃষ্ণমাহাত্ম্যপূর্ব্বকম্। বশিষ্টং নারদীয়ঞ্চ কপিলং গৌতমীয়কম্।।২৩।। পরং সনৎকুমারীয়ৎ পঞ্চরাত্রঞ্চ পঞ্চকম্। পঞ্চমী সংহিতান্যঞ্চ কৃষ্ণভক্তিসমন্বিতা।।২৪।। ব্রহ্মণশ্চ শিবস্যাপি প্রহ্লাদস্য তথৈব চ। গৌতমস্য কুমারস্য সংহিতাঃ পরিকীত্তির্তা।। ২৫।। – (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানঃ শ্রীকৃষ্ণ জন্মখন্ড, ১৩০/২১-২৫) অনুবাদঃ পূর্বোক্ত ক্রমে অষ্টাদশ পুরানের নাম পন্ডিতগন বলেছেন।পুরানের ন্যায় অষ্টাদশ উপপুরান,ভারত,বাল্মিকী প্রণীত কাব্য ইতিহাস প্রকীর্তিত হয়েছে।শ্রীকৃষ্ণ মাহাত্ম্যপূ্র্ণ পাঁচটি পঞ্চরাত্র হল-বশিষ্ট,নারদ,কপিল,গৌতম এবং সনৎকুমার বিরচিত।ব্রহ্ম, শিব, প্রহ্লাদ, গৌতম এবং সনৎকুমার কর্তৃক কৃষ্ণভক্তি সমন্বিত পাঁচটি সংহিতা পরিকীর্তিত হয়েছে। উপরোক্ত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানের শ্রীকৃষ্ণ জন্মখন্ডের,১৩০ তম অধ্যায়ের ২১-২৪ নং শ্লোকে শ্রীল সূত গোস্বামী শৌনক ঋষিকে অষ্টাদশ পুরান, অষ্টাদশ উপপুরান, ইতিহাস শাস্ত্র -মহাভারত, রামায়ন, বশিষ্ট,নারদ,কপিল,গৌতম এবং সনৎকুমারকৃত শ্রীকৃষ্ণ মাহাত্ম্যপূ্র্ণ পঞ্চরাত্র শাস্ত্রের কথা বর্ণনা করেন। এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান শাস্ত্রের শ্রীকৃষ্ণ জন্মখন্ডের ১৩০ তম অধ্যায়ের ২৫ নং শ্লোকে স্পষ্টভাবে ব্রহ্ম,শিব,প্রহ্লাদ,গৌতম এবং সনৎকুমারকৃত কৃষ্ণভক্তি সমন্বিত সংহিতা শাস্ত্রের কথা বর্ণনা করেন।সুতারাং শ্রীল সূত গৌস্বামী ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান শাস্ত্রের সংহিতা শাস্ত্রের মধ্যে কৃষ্ণভক্তি বিষয়ক শিবসংহিতা,প্রহ্রাদ সংহিতা,গৌতম সংহিতা,সনৎকুমার সংহিতার সাথে ব্রহ্মসংহিতা শাস্ত্রের নাম উল্লেখ করেছেন। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলার ৯ম অধ্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ ভারত পরিক্রমাকালে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ত্রিবাঙ্কুর জেলায় তিরুবত্তর গ্রামে অবস্থিত আদিকেশব মন্দির দর্শনে এসে সেখানে ভক্তদের সাথে ইষ্টগোষ্ঠী করছিলেন। তখন সেখানকার ভক্তরা তাকে জানায় ঠিক এই(গৌড়ীয়) সিদ্ধান্তই একটি গ্রন্থে লেখা আছে। এই বলে তারা ব্রহ্মসংহিতা গ্রন্থ দেখান। ব্রহ্মসংহিতার প্রতিটি শ্লোকে অল্প অক্ষরে অনেক সিদ্ধান্ত বর্ণনা রয়েছে দেখে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই গ্রন্থটি লিখিয়ে নেন। সেই দিন চলি’ আইলা পয়স্বিনীতীরে। স্নান করি’ গেল আদিকেশব মন্দিরে ॥ ২৩৪ মহাভক্তগণসহ তাহা গোষ্ঠী কৈল। ব্রহ্মসংহিতাধ্যায়পুথি তাহা পাইল ॥ ২৩৭ পুঁথি পাঞা প্রভুর হৈল আনন্দ অপার । কম্পাশ্রু স্বেদ স্তম্ভ পুলক বিকার ॥ ২৩৮ সিদ্ধান্তশাস্ত্র নাহি ব্রহ্মাসংহিতার সম | গোবিন্দমহিমা জ্ঞানের পরম কারণ ॥ ২৩৯ ।। অল্পাক্ষরে কহে সিদ্ধান্ত অপার সকল। বৈষ্ণবশাস্ত্রমধ্যে অতি সার ॥ ২৪০ ।। -(শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতঃমধ্যলীলা ৯/২৩৪-২৩৮) এই ব্রহ্মসংহিতা গ্রন্থকে অনেকে কাল্পনিক গ্রন্থ বলে থাকেন। কিন্তু শ্রীমধবাচার্য্য তার ভাগবৎ তাৎপর্য্য নির্ণয় ও ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে ব্রহ্মসংহিতা থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তাই ব্রহ্মসংহিতা নামে একটি গ্রন্থ পূর্ব থেকে ছিল তা প্রমাণিত হয়, যা থেকে শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু ৫ম অধ্যায়টি লিখে আনেন। ভাগবত ১১/১১/৫ শ্লোকের টীকায় শ্রীআনন্দতীর্থ মধ্বাচার্য্যপাদ শ্রীব্রহ্মসংহিতা থেকে উদ্ধৃত করেছেন। বদ্ধজীব সম্পর্কে ব্ৰহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে- বদ্ধা জীবা ইমে সর্বে পূর্ববন্ধসমন্বয়াৎ। নিত্যমুক্তত্বতো বিষ্ণুমুক্তনামা সদোদিতঃ। অবদ্ধত্বাদমোক্ষোঽপি দীপ্যতেঽসৌ রবিথা।। ইতি ব্রহ্মসংহিতায়াম্।। (ভাগবত তাৎপৰ্য্য নির্ণয় গোবিন্দাচার্য্য সংস্করণ পৃঃ ৬৬৯) যত্রানবসরোঽন্যত্র পদং তত্র প্রতিষ্ঠিতম্। বাক্যঞ্চেতি সতাং নীতিঃ সাবকাশে ন তদ্ভবেৎ।। ইতি ব্রহ্মসংহিতায়াম।। (ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ১.১.১, গোবিন্দাচার্য্য সংস্করণ পৃঃ৫) অনুবাদ: যেখানে যে পদ এর অর্থ বাক্যের অভীষ্ট লক্ষ্য যে তাৎপর্য্যে সেই তাৎপর্য্যেই মানতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তবে অন্য অর্থ কল্পনা করতে হবে। ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে। বৈশেষ্যা তদ্বাদস্তদ্বাদঃ ভাষ্য পার্থিবানাং শরীরাণামর্দ্ধেন পৃথিবী স্মৃতা।ইতরেঽর্দ্ধত্রিভাগিন্য আপস্তেজস্তু ভাগতঃ।ইতি সামান্যতো জ্ঞেয়ো ভেদশ্চ প্রতিপুরুষম্।স্বর্গাস্থানাং শরীরাণামর্দ্ধং তেজ উদাহৃতমিতি।।ইতি চ ব্রহ্মসংহিতায়াম।। (ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ২/৪/২২, গোবিন্দাচার্য্য সংস্করণ পৃঃ১১৬) অনুবাদ: পার্থিব শরীরে পৃথিবীর অর্দ্ধাংশ, অবশিষ্ট অর্দ্ধাংশের তিনভাগ জল, এবং এক ভাগ তেজ। এভাবে প্রতিপুরুষেই সামান্যতঃ ভুতবিভাগ জানতে হবে। স্বর্গস্থ শরীরে তেজ এর অর্দ্ধভাগ কথিত হয়। সুতরাং, উপরোক্ত আলোচনায় ব্রহ্মসংহিতা একটি প্রামানিক সনাতনী বৈদিক শাস্ত্র। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানের উক্ত শ্লোকে ব্রহ্মসংহিতাকে কৃষ্ণভক্তি বিষয়ক শাস্ত্র বলা হয়েছে। আমরা যখন ব্রহ্মসংহিতা পড়ি তখন আমরা দেখতে পায়,ব্রহ্মসংহিতার প্রতিটি শ্লোক ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে গভীর ভাবে সম্পর্কযুক্ত। ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ সর্বকারণকারণম্ । – ব্রহ্মসংহিতা ৫/১ঃ ব্রহ্মা বিঃদ্রঃ – বৃহৎব্রহ্মসংহিতা বলে একটি গ্রন্থ পাওয়া যায় সেটি নারদপঞ্চরাত্রের অংশ। তাতে দশটি অধ্যায় আছে। এই গ্রন্থটি শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভূ সংগৃহীত ব্ৰহ্মসংহিতা নয়। মধ্বাচার্য্য উদ্ধৃত শ্লোকগুলি সেই গ্রন্থে পাওয়া যায়না। মধ্ব সম্প্রদায়ের প্রখ্যাত পন্ডিত গোবিন্দাচাৰ্য্য এই শ্লোকগুলিকে untraceable reference বলেছেন তাই শ্রীমধ্বাচার্য্য উদ্ধৃত শ্লোক গুলি সেই লুপ্ত গ্রন্থের ই অংশ যা থেকে শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু ৫ম অধ্যায়টি লিখে আনেন। ।।হরে কৃষ্ণ।।।।প্রনাম।। – অর্জুন সখা দাস – সদ্গুন মাধব দাস