নিরাকারবাদীরা পরম ব্রহ্মের সচ্চিদানন্দ স্বরূপকে জানতে পারে না কেন?

20241015 221321 Svadharmam

🔴👉 নির্বিশেষবাদীরা (নিরাকারবাদী) বেদ-বেদান্তে পারদর্শী হয়েও ভগবানের স্বরূপ উপলব্ধি করতে না পারায় (কেবল নিরাকার মনে করায়) অন্তিমে মূ*র্খ হিসেবেই পরিগনিত হয়! ⚠️🔴 এই প্রসঙ্গে শ্রীল প্রভুপাদ তার ভগবদগীতার বিজ্ঞান যোগের ২৪ নং শ্লোকের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্যে নিরাকারবাদীদের অবস্থা সম্পর্কে যা আলোকপাত করেছেন সেটার অংশবিশেষ নিম্নে তুলে ধরা হলো। 👇 [{ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর স্বরূপে অর্জুনের সঙ্গে এখানে কথা বলছেন, অথচ নির্বিশেষবাদীরা এতই মূর্খ যে, অন্তিমে ভগবানের কোন রূপ নেই বলে তারা তর্ক করে। শ্রীরামানুজাচার্যের পরম্পরায় মহিমাময় ভগবদ্ভক্ত শ্রীযামুনাচার্য এই সম্পর্কে একটি অতি সমীচীন শ্লোক রচনা করেছেন। তিনি বলেছেন- “ত্বাং শীলরূপচরিতৈঃ পরমপ্রকৃষ্টৈঃ সত্ত্বেন সাত্ত্বিকতয়া প্রবলৈশ শাস্ত্রৈঃ। প্রখ্যাতদৈব পরমার্থবিদাং মতৈশ্চ নৈবাসুরপ্রকৃতয়ঃ প্রভবন্তি বোদ্ধুম্ ॥” “হে ভগবান! মহামুনি ব্যাসদেব, নারদ আদি ভক্তেরা তোমাকে পরমেশ্বর ভগবান বলে জানেন। বিভিন্ন বৈদিক শাস্ত্র উপলব্ধির মাধ্যমে তোমার গুণ, রূপ, লীলা আদি সম্বন্ধে অবগত হওয়া যায় এবং জানতে পারা যায় যে, তুমিই পরমেশ্বর ভগবান। কিন্তু রজ ও তমোগুণের দ্বারা আচ্ছাদিত অভক্ত অসুরেরা কখনই তোমাকে জানতে পারে না, কারণ তোমার তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করতে তারা সম্পূর্ণ অসমর্থ। এই ধরনের অভক্তেরা বেদান্ত, উপনিষদ আদি বৈদিক শাস্ত্রে অত্যন্ত পারদর্শী হতে পারে, কিন্তু তাদের পক্ষে পুরুষোত্তম ভগবানকে জানতে পারা সম্ভব নয়।” (স্তোত্ররত্ন: ১২)] ব্রহ্মসংহিতাতে বলা হয়েছে যে, কেবল বেদান্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন করার মাধ্যমে পরমেশ্বর ভগবানকে জানতে পারা যায় না। ভগবানের কৃপার ফলেই কেবল তিনি যে পরম পুরুষোত্তম, সেই সম্বন্ধে অবগত হওয়া যায়।} {যে সমস্ত অভক্ত বেদান্ত ও বৈদিক শাস্ত্র সম্বন্ধে তাদের কল্পনাপ্রসূত মতবাদ পোষণ করে এবং যাদের অন্তরে কৃষ্ণভাবনামৃতের লেশমাত্র নেই, তারাও অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন এবং তাদের পক্ষে ভগবানের সবিশেষ রূপ অবগত হওয়া অসম্ভব। যারা মনে করে যে, পরমেশ্বর ভগবান নিরাকার, তাদের অবুদ্ধয়ঃ (ভ:গী: ৭/২৪) বলা হয়েছে অর্থাৎ এরা পরম-তত্ত্বের পরম রূপকে জানে না। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে যে, অদ্বয়-জ্ঞানের সূচনা হয় নির্বিশেষ ব্রহ্ম থেকে, তারপর তা পরমাত্মার স্তরে উন্নীত হয়, কিন্তু পরম-তত্ত্বের শেষ কথা হচ্ছে পরম পুরুষোত্তম ভগবান।} {নির্বিশেষবাদীরা তাই পরমতত্ত্ব সম্পর্কে অবগত না হয়ে মনে করে যে, শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন দেবকী ও বসুদেবের সন্তান মাত্র, অথবা একজন রাজকুমার, অথবা একজন অত্যন্ত শক্তিশালী জীব মাত্র। ভগবদ্গীতায় (৯/১১) ভগবান এই ভ্রান্ত ধারণার নিন্দা করে বলেছেন, “অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্…।” অনুবাদ: “অত্যন্ত মুঢ় লোকগুলিই কেবল আমাকে একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করে আমাকে অবজ্ঞা করে।” প্রকৃতপক্ষে, ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা করে কৃষ্ণভাবনা অর্জন না করলে এখনই শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করতে পারা যায় না। শ্রীমদ্ভাগবতে (১০/১৪/২৯) এই কথা প্রতিপন্ন করে বলা হয়েছে- “অথাপি তে দেব পদাম্বুজদ্বয় প্রসাদলেশানুগৃহীত এব হি। জানাতি তত্ত্বং ভগবন্মহিম্নো ন চান্য একোহপি চিরং বিচিন্বন।।” অনুবাদ: “হে ভগবান! আপনার শ্রীচরণ-কমলের কণামাত্রও কৃপা যে লাভ করতে পারে, সে আপনার মহান পুরুষত্বের উপলব্ধি অর্জন করতে পারে। কিন্তু যারা পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে উপলব্ধির উদ্দেশ্যে কেবলই জল্পনা-কল্পনা করে, তারা বহু বছর ধরে বেদ অধ্যয়ন করতে থাকলেও আপনাকে জানতে সক্ষম হয় না।” কেবলমাত্র জল্পনা-কল্পনা আর বৈদিক শাস্ত্রের আলোচনার মাধ্যমে পরম পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের নাম-রূপ-লীলা আদি জানতে পারা যায় না। তাঁকে জানতে হলে অবশ্যই ভক্তিযোগের পন্থা অবলম্বন করতে হয়। কেউ যখন “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে” -এই মহামন্ত্র কীর্তন করার মাধ্যমে ভক্তিযোগ অনুশীলন শুরু করে সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনামৃতে মগ্ন হয়, তখনই কেবল পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে জানা যায়।}] উপস্থাপনায়: প্রবীর চৈতন্য চন্দ্র দাস [ বি:দ্র: স্বধর্মম্-এর অনুমোদন ব্যতীত এই গবেষণামূলক লেখার কোনো অংশ পুনরুৎপাদন, ব্যবহার, কপি পেস্ট নিষিদ্ধ। স্বধর্মম্-এর সৌজন্যে শেয়ার করার জন্য উন্মুক্ত ] নিবেদক- ° স্বধর্মম্: প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন °

হিন্দুরা কেন গরুকে এতো সম্মান করে, কেন হিন্দুরা গোহত্যা করে না?!?

Untitled design Svadharmam

হিন্দুরা কেন গরুকে মা বলে? গরুর দুধ খেলেও, মাংস কেন খাও না? গরুর চামড়ার তৈরি পণ্য কেন ব্যবহার করেন? শাস্ত্রে কোথায় গোহত্যা নিষিদ্ধ? বিধর্মীদের দ্বারা কথিত এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হন না এমন কোনো হিন্দু মানুষ খুজে পাওয়া দুষ্কর। কেউ আবার এসব প্রশ্নের যথার্থ উত্তর না জানার ফলে হীনমন্যতায় ভুগেন ও স্বধর্মের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। এভাবে ধীরে ধীরে কারও মানসিকতা ধর্মান্তরের দিকে এগোতে থাকে। কারণ বিধর্মীদের এমন সামান্য কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় বিধর্মীরা এই সুযোগে তাদের ধর্মের গুন গেয়ে বৈদিক ধর্ম সম্পর্কে অপব্যাখ্যা করে মগজ ধোলাই করে ধর্মান্তরিত করতে থাকে। তাই এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে, নিজ বিশ্বাসকে শক্তিশালী করতে ও নিন্দুকদের দাঁতভাঙা জবাব দিতে পড়ুন . প্রশ্ন- হিন্দুরা কেন গরুকে মা বলে? গাভীকে কেন মা’’ ডাকা হয়; যেহেতু বিধর্মীরা সম্পূর্ণভাবে তমগুনাচ্ছন্ন হওয়ার ফলে এই দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থতা বিশ্লেষণে সক্ষম নয়, তাই আদিযুগ থেকেই তাদের এমন প্রশ্ন ছিলো। চৈতন্য চরিতামৃত আদিলীলা/১৭/১৫৩ নং শ্লোকে মুসলমান চাঁদকাজির সাথে বিতর্কের মধ্যে উক্ত প্রশ্নের খুব সুন্দর যৌক্তিক উত্তর দেখা যায়। মহাপ্রভু তাকে বলেছেন- প্রভু কহে, গোদুগ্ধ খাও, গাভী তোমার মাতা। বৃষ অন্ন উপজায়, তাতে তেঁহো পিতা ॥১৫৩৷৷ সরলার্থ: মহাপ্রভু বললেন, “আপনি গরুর দুধ খান; সেই সূত্রে গাভী হচ্ছে আপনার মাতা। আর বৃষ (ষাড়) অন্ন উৎপাদন করে, যা খেয়ে আপনি জীবন ধারণ করেন; সেই সূত্রে সে আপনার পিতা। তাই গরু গাভী কিংবা ষাড়, বৈদিক সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বলা বাহুল্য কেবল (গোমাতা) গরুকেই মা ডাকা হয় বিষয়টি এমন নয়। পবিত্র “বেদ’’ আমাদেরকে মনুষ্যত্বের অধিকারী ও বিবেকবান হতে শেখায় তাই বেদ শাস্ত্রে ০৭ (সাত) ধরণের মায়ের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। চাণক্য পণ্ডিত বলেন- “আদৌ-মাতা গুরুঃ পত্নী ব্রাহ্মণী রাজ-পত্নীকা।ধেনর ধাত্রী তথা পৃথ্বী সপ্তেতা মাতর স্মৃতা ॥” ১) জন্মদাত্রী ২) ধাত্রী ৩) ধরিত্রী ৪) গোমাতা ৫) বেদমাতা ৬) ব্রাহ্মণ পত্নী ৭) রাজমাতা তার মধ্যে গাভী বা গোমাতা অন্যতম। গরুকে মা’’ বলা হয়, বিষয়টি ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়- জন্মের পর থেকে আমরা মায়ের দুধ খাই ২-৩ বছর পর্যন্ত অতঃপর, আমাদের পুষ্টি নির্ভর করে গাভীর দুধের উপর। গরুর দুধের চেয়ে উৎকৃষ্ট দুধ আর নেই। বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রই তা জানেন। যেহেতু, মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে গরুর দুধই আমাদের পুষ্টি যোগায় সেহেতু, এমন উপকারী গাভীকে মায়ের সম্মান প্রদর্শন করার বিষয়টি বৈদিক শাস্ত্রে দেখতে পাওয়া আশ্চর্যজনক কিছু নয়! বরং বিবেকবান ব্যক্তি মাত্রই গাভীকে মায়ের সম্মান প্রদর্শন করেন। প্রশ্ন- গরুর দুধ খেলেও, মাংস কেন খাও না? যেকেউ’ই মায়ের দুধ পান করে বড় হয়, কিন্তু তাই বলে কি সে মায়ের মাংস ভক্ষন করে?!? না, কখনই করে না। তো কিভাবে যাঁকে মা’’ বলে সম্মান প্রদর্শন করা হয় তাকে হত্যা করে তার মাংস ভক্ষণ করে কেউ? এটা পাশবিক ও বর্বরতা ছাড়া কিছুই হতে পারে না। এখন ভাবতে পারেন তাহলে ষাড় গরু হত্যা/ভক্ষণ করা যেতে পারে? এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু চাঁদকাজীকে আরও কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলেন– পিতা – মাতা মারি’ খাও এবা কোন্ ধর্ম। কোন্ বলে কর তুমি এমত বিকর্ম ॥১৫৪॥ সরলার্থ: যেহেতু বৃষ ও গাভী আপনার পিতা ও মাতা, তা হলে তাদের হত্যা করে তাদের মাংস খান কি করে? এটি কোন ধর্ম? কার বলে আপনি এই পাপকর্ম করছেন? (চৈতন্য চরিতামৃত: আদিলীলা/১৭/১৫৪) পূর্বোক্ত চৈতন্য চরিতামৃত বর্ণনায় আমরা দেখতে পেয়েছি বৃষকে কেন পিতার সাথে তুলনা করা হয়েছে। তো একটু গভীর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখুন বৈদিক সভ্যতায় জমি চাষাবাদের জন্য বৃষ (ষাড়) ব্যবহৃত হয়। গাভী যেমন মায়ের পরিপূরক হিসেবে আমাদের দুধ প্রদান করেন এবং তেমনিভাবে পরিবারে পিতা যেমন কঠোর পরিশ্রম করে খাদ্যের যোগান দেন সেভাবে একটি ষাড় জমি চাষবাসের দ্বারা খাদ্য উৎপাদনে সহযোগিতা করে, তাই বৃষকে পিতা বলা হয়। বেদে গোহত্যা ষাড় হউক বা গাভী অর্থাৎ, গরুকে হত্যা করা কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। যদি কোনো সংস্কৃতি এমন উপকারী প্রাণীকে হত্যা করে তার মাংস ভক্ষণ করতে শিখায়, সেটা কোনো সভ্য সংস্কৃতি হতেই পারে না। অতএব, বৈদিক শাস্ত্র আমাদের উপকারীর উপকার শিকার করতে শিখায়। যে গরু/গাভী আমাদের এহেন উপকার করে তাকে আমরা হত্যা করতে পারিনা। এজন্যই বৈদিক সংস্কৃতি, শিক্ষা মহান! প্রশ্ন- গরুর চামড়ার তৈরি পণ্য কেন ব্যবহার করেন? সোজা উত্তর- যারা ধর্ম জানেন, সাধুরা গরুর চামড়ার তৈরি পণ্য ব্যবহার করেন না। কোনো ব্যক্তি যদি করে থাকে তবে সেটা তার ব্যাক্তিগত অজ্ঞতার কারণে, বিশেষ কোনো পরিস্থিতির কারণে কিংবা নিজের ইন্দ্রিয়তৃপ্তির জন্য ব্যবহার করেন। তবে শাস্ত্রে গো থেকে প্রাপ্ত সমস্ত কিছুকেই পরম পবিত্র ঘোষণা করা হয়েছে। তেমনি গো চর্মকেও পবিত্র বলা হয়েছে। মৃদঙ্গে তা ব্যবহৃত হয়, যে মৃদঙ্গ ভগবদ্কীর্তনে ভগবানের প্রীতি বিধানে বাদিত হয়। এক্ষেত্রে, বোঝার বিষয় হচ্ছে- চামড়া সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গোহত্যা করা হয়না, কিংবা কারও ব্যক্তিগত ইন্দ্রিয় উপভোগের জন্য তা করা হয়না। প্রাকৃতিকভাবেই মৃত গরুর চর্ম মৃদঙ্গে ব্যবহৃত হয়। সুক্ষ্ম বিষয়টি হচ্ছে, সেই গরু যাঁর শরীরের চর্ম ভগবানের প্রীতি বিধানার্থে ব্যবহৃত মৃদঙ্গে যুক্ত হয়, সেটা তার জন্য পরম সৌভাগ্যজনক। প্রশ্ন- শাস্ত্রে কোথায় গোহত্যা নিষিদ্ধ? বেদ শাস্ত্রে গোহত্যা বিষয়ে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং গোহত্যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বটে। পাশাপাশি বৈদিক শাস্ত্রে যেকোনো পশুকে নির্বিচারে হত্যা কিংবা তার মাংস ভক্ষণে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নিম্নরূপ- গোমাতাকে কোন কারণে হত্যা করা যাবে না, তাদের জল, সবুজ তৃণ দিয়ে সমৃদ্ধ করতে হবে। (ঋগ্বেদ: ১/১৬৪/৪০) “যিনি রুদ্রগণের মাতা, বসুগণের দুহিতা, আদিত্যের ভগিনী, অমৃতের আবাস্থল, হে জলগণ! সেই নির্দোষ অদিতি গো’দেবীকে (গাভী) হিংসা (হত্যা) করিও না।” (ঋগ্বেদ: ৮/১০১/১৫) “হে অঘ্না (বধের অযোগ্য) গাভী! তুমি সর্বদা তৃণ ভক্ষণ পূর্বক বিচরণ করতে থাকো এবং শুদ্ধ জল পান করতে থাকো।” (অথর্ববেদ: ৭/৭৩/১১) “গাভীর মাংস ভক্ষণ অনুচিত” (অথর্ববেদ: ৯/৮/৯) “গাভী অবধ্য অর্থাৎ, হত্যার অযোগ্য” (অথর্ববেদ: ৬/৭০/১,২) “গাভীর অপর নাম অঘ্ন্যা, এরা অবধ্য অর্থাৎ হত্যার অযোগ্য। যে এই সকল গাভী ও বৃষকে হত্যা করে সে মহাপাপ করে।” (মহাভারত: শান্তিপর্ব/২৬২/৪৭) “যে মানুষ শাস্ত্রীয় নিষেধ অগ্রাহ্য করিয়া মাংস বিক্রয়ের জন্য গো’বধ করে কিংবা গো-মাংস ভক্ষণ করে অথবা যাহারা মাংসার্থী হইয়া গো’বধের জন্য গো’ঘাতককে অনুমতি করে; তাহাদের মধ্যে ঘাতক, খাদক ও অনুমতিদাতা সেই গরুর যতগুলি লোম থাকে, তত বৎসর নরকে নিমগ্ন থাকে॥” (মহাভারত: অনুশাসন পর্ব/৫৯/৬৫,৬৬) “গাভী ও ষাঁড় কদাপি ভক্ষণযোগ্য নয়।” (শতপথ ব্রাহ্মণ: ৩/১/২/২১) অথর্ববেদ ২য় কান্ড ২৬ নং সূক্তে গো তথা পশুদিগকে রক্ষার বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে এবং অথর্ববেদ: ৭ম কাণ্ড ৭৫ নং সূক্তে গাভীকে যত্ন করে পালন ও যেন কোনোভাবে কারো আক্রমনের শিকার যেন না হয় তার বর্ণনা দেখা যায়। এছাড়াও বৈদিক শাস্ত্রসমূহের অজস্র জায়গায় গোহত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে ও নিষেধাজ্ঞার যথার্থ কারণও বর্ণিত রয়েছে। এইতো সেদিন ৫’’শ বছর পূর্বে বেদ শাস্ত্রের অগাধ ও অপ্রতিরোধ্য পাণ্ডিত্যের অধিকারী শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নবাব চাঁদকাজীর সাথে বিতর্ককালে বলেছেন- “গো-অঙ্গে যতলোম, তত সহস্র বৎসর। গোবধী রৌরব মধ্যে পচে নিরন্তর।।” – (চৈ:চ: আদি: ১৭/১৬৬) সরলার্থ: “যে ব্যক্তি গো/গরু হত্যা করে, তাদের সকলকেই সেই নিহত গরুর লোম পরিমিত বৎসরকাল রৌরব নরকে নিমগ্ন থাকতে

বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ; তিঁনিই হচ্ছেন সর্বব্যাপী এক এবং অদ্বিতীয় পরম ব্রহ্ম পরমেশ্বর ভগবান।

20240725 214213 Svadharmam

💗 বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ 💗 তিঁনিই হচ্ছেন এক এবং অদ্বিতীয় পরমেশ্বর ভগবান। যাঁকে পৃথিবীর সমস্ত পরমার্থবাদীরা বিভিন্ন উপায়ে লাভ করার চেষ্টা করছেন। অনেকে তাঁকে কোনোরূপেই জানতে পারছেন না এবং নাস্তিকে পরিণত হচ্ছেন। কেউ কেউ তাঁর দিব্য অঙ্গজ্যোঁতি দর্শন করে তাঁকে নিরাকার রূপহীন মনে করে থেমে গিয়ে তাঁর দ্বিভুজ শ্যামসুন্দর মুরলীধর রূপকে জানতে পারছেন না। কেউবা আবার এই পরম পুরুষের সর্বব্যাপী বিরাট বিশ্বরূপের বিস্তৃতিকেই সর্বস্ব ভাবছেন। সেই পরমেশ্বর ভগবান কর্তৃক পরিচালিত হয়ে ভগবদ্তত্ত্বজ্ঞান প্রচারের জন্য এই পৃথিবীর সমস্ত অঞ্চলে কোনো না কোনো #বার্তাবাহক এসেছেন এবং সেই সেই অঞ্চলের অধিবাসীদের জ্ঞানের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী বোধগম্য উপায়ে ভগবদ্ সম্বন্ধীয় জ্ঞান প্রদান করেছেন। পৃথিবীর মধ্যভাগ ও পশ্চিমীয় অঞ্চল মানুষ বসবাসের জন্য প্রতিকূল। সেখানে যথেষ্ট স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় থাকে না, হয়তো প্রচুর উত্তাপ, নয়তো হিমবাহ। পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির উপর ভিত্তি করেই বেড়ে উঠা মানুষের চেতনা বিকশিত হয়। বিশেষত সেইসব অঞ্চলের মানুষের অবৈদিক খাদ্যাভ্যাসের প্রাধান্যতার কারণেই আদিকাল হতে তাদের চেতনা আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ জ্ঞান ধারণের জন্য পর্যাপ্ত হয়না। অতএব, সেই অঞ্চলের মানুষদের ভগবদ্ বিষয়ক অতি সাধারণ জ্ঞান প্রদান করা হয়। যেমন: ভগবান একজন, তিঁনি সর্বশক্তিমান এবং তাঁকে মান্য করা উচিত, ইত্যাদি। ভগবান সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব তাদের প্রদান করা হয় না। কারণ, পৃথিবীর সমস্ত অঞ্চলে একইরকম পরিবেশ থাকে না। পরিবেশের উপর ভিত্তি করে উৎপাদন হয় ফলে সেইমতন খাদ্যাভ্যাস তৈরি হয়। ভগবদ্তত্ত্বজ্ঞান উপলব্ধির পথে খাদ্যগ্রহনের প্রক্রিয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। যেরকম খাদ্য আমরা গ্রহণ করি সেরকম চেতনা ও আচরণ তৈরি হয়। তাই আমরা সেইভাবেই নূন্যতম ও উচ্চতর জ্ঞান আহরণ করতে পারি। অপরপক্ষে পৃথিবীর প্রাচ্যদেশীয় অঞ্চলের পরিবেশ মনুষ্যজাতির জন্য সর্বাধিক অনুকূল। তাই, এই প্রাচ্যের মনুষ্যজাতিকে দেওয়া হয়েছে ভগবদ্তত্ত্ব বিজ্ঞানের চরম সিদ্ধান্ত- “বেদ-বেদান্তাদি সমস্ত শাস্ত্র” তাতে বর্ণিত হয়েছে ভগবান সম্বন্ধীয় পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব। জড় ও চেতন বস্তু কি? আত্মা কি? পরমাত্মা কি? প্রকৃতি কি? কাল ও কর্ম কি? তাই সমস্ত বেদের সারস্বরূপ ভগবদ্গীতা’তে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই ঘোষণা দিচ্ছেন-  “আমিই সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য বিষয়, আমি সমস্ত বেদান্ত কর্তা ও বেদবেত্তা।” (ভ:গী : ১৫/১৫) বৈদিক শাস্ত্রে (অথর্বেদান্তর্গত, গোপালতাপনী উপনিষদ: ১/১) উল্লেখ আছে- সচ্চিদানন্দরূপায় কৃষ্ণায়ক্লিষ্টকারিণে। নমো বেদান্তবেদ্যায় গুরবে বুদ্ধিসাক্ষিণে ॥ “আমি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি জ্ঞাপন করছি, যাঁর অপ্রাকৃত রূপ হচ্ছে সৎ, চিৎ ও আনন্দময়। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি, কারণ তাঁকে জানার অর্থ সমগ্র বেদকে জানা এবং সেই কারণেই তিনি হচ্ছেন পরম গুরু।” অথর্বেদান্তর্গত, গোপালতাপনী উপনিষদে আরও বলা হয়েছে,  “কৃষ্ণো বৈ পরমং দৈবতম্ ; শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান।” (গোপালতাপনী  উপনিষদ: ১/৩)    “একো বশী সর্বগঃ কৃষ্ণ ঈড্য; পরব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণ এক অর্থাৎ সজাতীয় বিজাতীয় স্বগত ভেদ রহিত, এ নিমিত্ত সকলই  ইহাঁর বশীভূত  একোঅপি সন্ বহুধা  হো বিভাতি। শ্রীকৃষ্ণ এক, কিন্তু তিনি অনন্ত রূপ ও অবতারের মাধ্যমে প্রকাশিত হন।” (গোপালতাপনী উপনিষদ: ১/২১)   সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রাদিতে তাহলে কি বর্ণিত হয়েছে দেখা যাক- শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সগুণ ব্রহ্ম। (মহাভারত: আদি/১/৭২) অসিত ও দেবল ঋষি উল্লেখ করছেন- “ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ই প্রজা সৃষ্টিকারী প্রজাপতি এবং সকল লোকের একমাত্র রচয়িতা।” (মহাভারত: বনপর্ব/১২/৫০)  দেবর্ষি নারদ  উল্লেখ করছেন- “ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সকল লোকের স্রষ্টা ও সমস্ত ভাবের প্রকাশক। ইনি সাধ্যগণ এবং দেবগণেরও প্রভু, দেবদেব ব্রহ্মা এবং শিবেরও অধীশ্বর” (মহাভারত: ভীষ্মপর্ব/৬৭/২)  মার্কণ্ডেয় ঋষি বলছেন- “শ্রীকৃষ্ণ যাজ্ঞিকগণের যজ্ঞ ও তপস্বীগণের তপস্যা। (মহাভারত: ভীষ্মপর্ব/৬৭/৩)  ভৃগু ঋষি উল্লেখ করছেন: “আপনি দেবগণেরও দেবতা এবং বিষ্ণুরূপী আপনার রূপটি আদি ও  সুন্দর।” (মহাভারত: ভীষ্মপর্ব/৬৭/৪)  মহর্ষি বেদব্যাস‌ও বর্ণন করছেন- শ্রীকৃষ্ণই বসুগণের বাসুদেব, ইন্দ্রকে স্বর্গ রাজ্য  প্রদানকারী  এবং দেবগণেরও পরম দেবতা। (মহাভারত: ভীষ্মপর্ব/৬৭/৫) ঋষি অঙ্গিরা উল্লেখ করছেন- “শ্রীকৃষ্ণ সর্বভূতের সৃষ্টিকর্তা” (মহাভারত: ভীষ্মপর্ব/৬৭/৬)  অসিতদেবল বলেছেন- শ্রীকৃষ্ণই সমস্ত জগতে ব্যাপ্ত সনাতন পুরুষ (মহাভারত: ভীষ্মপর্ব/৬৭/৮)  তাই ভগবদ্গীতাতে আমরা এটি দেখতে পাই যে, মহাত্মা অর্জুনও উপরিল্লিখিত ঋষি-মহর্ষি গণের উদ্ধৃতি দিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে আমাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন যে, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন বেদের সেই পরম জ্ঞাতব্য বিষয় পরম ঈশ্বর। “ অর্জুন বললেন- তুমি পরম ব্রহ্ম, পরম ধাম, পরম পবিত্র ও পরম পুরুষ৷ তুমি নিত্য, দিব্য, আদি দেব, অজ ও বিভু। দেবর্ষি নারদ, অসিত, দেবল, ব্যাস আদি ঋষিরা তোমাকে সেভাবেই বর্ণনা করেছেন এবং তুমি এখন আমাকে তা বলছ।” (ভ:গী: ১০/১২-১৩) শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণে বর্ণিত রয়েছে- “কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং” শ্রীকৃষ্ণ’ই হচ্ছেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান। (শ্রীমদ্ভাগবত:১/৩/২৮) শ্রীমদ্ভাগবত তথা সমস্ত বেদে’ই প্রতীয়মান হয় যে বাসুদেব-শ্রীকৃষ্ণ’ই হলেন পরাৎপর পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর ভগবান। এতোসব প্রমাণাদি থাকার পরও “মায়া অপহৃতজ্ঞানা” (ভ:গী:৭/১৫) ব্যক্তিদের চেতনা আচ্ছাদিত, কলুষিত, তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাদের কাছে সাধারণ মনুষ্যরূপে প্রতীত হন। এজন্য স্বয়ং ভগবান বলেছেন- “আমি সকলের কাছে প্রকাশিত হই না। আমি আমার অন্তরঙ্গা শক্তি যোগমায়ার দ্বারা আবৃত থাকি” (ভ:গী : ৭/২৫) শ্রীবিষ্ণুপুরাণ: ৬ষ্ট অংশ ৫ম অধ্যায় ৭৬ নং শ্লোকে শ্রীল পরাশর মুনি বর্ণনা দিচ্ছেন- “হে মৈত্রেয়! এইভাবে এই মহান ‘ভগবান’ শব্দ পরব্রহ্মস্বরূপ শ্রীবাসুদেবেরই বাচক, আর কারোর নয়।।৭৬।। ঋগ্বেদ: ১ম মন্ডল/১৬৪ নং সূক্তম্/৪৬ নংঋক্ বর্ণনা করছেন- “একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি” সেই এক পরমেশ্বরকে বহু নামে অবিহিত করা হয়।”  আর বলা বাহুল্য তাঁর সেই নাম তাঁর বিভিন্ন অপ্রাকৃত রূপ-লীলা’র উপর প্রতিষ্ঠিত। বেদ-এ সেই পরমপুরুষ পরমাত্মাকে কোথাও ডাকা হচ্ছে গোবিন্দ নামে, কোথাও তাঁকে বলা হচ্ছে বাসুদেব, কোথাওবা শ্রীবিষ্ণু। এসবই হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত দিব্য নাম। এমনকি আদি শঙ্করাচার্য বিবেক চূড়ামণিতে সেই গোবিন্দের নিকট প্রণতি নিবেদন করে তিঁনি বলছেন- “সমস্ত বেদান্তশাস্ত্রের সিদ্ধান্তে যার কথা বলা হয়েছে, যিনি বাক্যমনাতীত পরমানন্দসরূপ সদ্গুরু, সেই পরমাত্মা গোবিন্দকে আমি প্রণাম করি।” (বিবেকচূড়ামণি-১) “পৃথিবীতে থেকে যিনি পৃথিবী পরিচালনা করেন কিন্তু পৃথিবী যাঁকে জানতে পারে না, শ্রুতির দ্বারা বেদ যে অমলস্বরূপ জগতের স্বামী, নিয়ামক, ধ্যেয় এবং দেবতা, মনুষ্য ও মুনি ঋষিগণের মোক্ষ প্রদানকারী বলে জানিয়েছেন, সেই শরণাগত পালক, নিখিল ভুবনেশ্বর শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র আমার নয়নগোচর হোন। (আদি শংকরাচার্য- কৃষ্ণাষ্টকম্/৪) বেদে বারবার সেই পরমাত্মার স্তুতি বন্দনার কথা বলা হয়েছে, তাঁকে জানার জন্য বলা হয়েছে তবুও কিছু বেদাধ্যয়নকারী সেই পরমাত্মার প্রকৃত স্বরূপকে জানতে পারেন না। অথচ ভক্তিযোগ অনুশীলনের দ্বারা এটা খুব সহজেই বুঝতে পারা যায় যে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সেই “একং এবং অদ্বিতীয়ম্ পরম পুরুষঃ”। वेदाहमेतं पुरुषं महान्त- मादित्यवर्ण तमसः परस्तात् । तमेव विदित्वाऽतिमृत्युमेति नान्यः पन्था विद्यतेऽयनाय ।। “পরমেশ্বর ভগবানকে জানবার ফলেই জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়। এছাড়া আর কোনই পথ নেই।” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ: ৩/৮) ভগবদ্গীতা পড়লে আমরা দেখতে পাই স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেটি নিশ্চিত করছেন যে, প্রকৃতপক্ষে তিঁনিই সেই পরম তত্ত্ব- “ভক্তির দ্বারা কেবল স্বরূপত আমি যে রকম হই, সেরূপে আমাকে কেউ তত্ত্বত জানতে পারেন। এই প্রকার ভক্তির দ্বারা আমাকে তত্ত্বত জেনে, তার পরে তিনি আমার ধামে প্রবেশ করতে পারেন।”(ভ:গী : ১৮/৫৫) “হে অর্জুন যিনি আমার এই প্রকার দিব্য জন্ম এবং কর্ম যথাযথ ভাবে জানেন, তাঁকে আর দেহ ত্যাগ করার পর পুনরায় জন্ম গ্রহন করতে হয় না তিনি আমার নিত্য ধাম লাভ করে।”(ভ:গী: ৪/৯) “হে অর্জুন এই ভুবন থেকে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত সমস্ত লোকই পুনরাবর্তনশীল অর্থাৎ, পুনর্জন্ম হয়। কিন্তু হে কৌন্তেয়! আমাকে প্রাপ্ত হলে আর পুনর্জন্ম হয় না।”(ভ:গী: ৮.১৬) “বহু জন্মের

মহাভারতের দৃষ্টিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ!

Svadharmam Image

🟠 মহাভারতের দৃষ্টিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ! শ্রীকৃষ্ণ যে স্বয়ং পরমেশ্বর তা সম্বন্ধে দুয়েকটা উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করা যাক- ‘পাপকর্ষণ জন্য সচ্চিদানন্দরূপী কৃষ্ণই পরমদেবতা। গোশব্দ নানার্থপ্রযুক্ত ভূমি এবং বেদ, ইহাতে যিনি বিখ্যাত ও দ্রষ্টা, তিনি গোবিন্দ, মৃত্যু ইহাকে গোশব্দের অধিষ্ঠানরূপে জ্ঞাত হইয়া ভয়প্রাপ্ত হয়।” (অথর্ববেদান্তর্গত, গোপালতাপনী উপনিষদ: ৮) “ঈশ্বর পরম কৃষ্ণ সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ।।” (ব্রহ্মসংহিতা: ৫/১) “এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ং।।” (শ্রীমদ্ভাগবত:১/৩/২৮) “সর্বে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ং।।” (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ: শ্রীকৃষ্ণজন্মখন্ড/১১৭/১২) “একেলা ঈশ্বর কৃষ্ণ আর সব ভৃত্য” (শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত: আদিলীলা ৫/১৪২)। 🌿 এবার আসি সর্বজনীন প্রামাণিক শাস্ত্র মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণকে আসলে কেমন রূপে আমরা দেখতে পাই, তা আজকের আলোচনায় স্পষ্ট করা হবে। মহাভারত: ভীষ্মপর্ব/৬৪ নং অধ্যায়ে দেখা যায় যখন কৌরবশ্রেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র তার সারথি সঞ্জয়ের নিকট যুদ্ধের বর্ণনা শুনছিলেন, তার এককালে তিনি সঞ্জয়ের নিকট যুদ্ধের পরিস্থিতি জানার জন্য এভাবে প্রশ্ন করেন- “ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, সঞ্জয়! পান্ডবগণের কার্য্য দেবগণের পক্ষেও অতিদুষ্কর। ইহা শুনিয়া আমার গুরুতর ভয় ও বিস্ময় জন্মিয়াছে।।১।। 👉 এরকমভাবে ধৃতরাষ্ট্র তার আরও ভয় ও আশংকার কারণ ব্যক্ত করে সঞ্জয়কে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন যে, কিরুপে পান্ডবগণ অজেয় হয়ে উঠছে, কিভাবেই’বা তারা কৌরবপক্ষীয় সমস্ত বড় বড় রথি-মহারথি যোদ্ধাদের পরাজিত-নিহত করে দিচ্ছে, তাদের জয়ের পিছনে কোন শক্তি কাজ করছে, ইত্যাদি। ধৃতরাষ্ট্রের দ্বারা জিজ্ঞাসিত হলে সঞ্জয় তার উত্তর প্রদান করেন যে, পান্ডুপুত্রগণ তথা পান্ডবরা কোনো অধর্ম করছেন না, ধর্মের পথে থেকেই যুদ্ধ করছেন এজন্য তারা জয়ী হচ্ছেন, সর্বোপরি শ্রীকৃষ্ণ তাদের সঙ্গে রয়েছেন। আর অন্যদিকে দুর্যোধনাদি কৌরবেরা পাপাচারে লিপ্ত অধর্মপরায়ণ তাই যুদ্ধে তাদের ক্ষয় হচ্ছে। সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে পূর্বের বিষয়ে স্মরণ করে আরও কিছু কথা বললেন যে- আপনার পুত্রদের অবৈধ কার্যের বিষয়ে আপনাকে তখন বারবার অবগত, সতর্ক করা হলেও যেহেতু তখন আপনি কোনোকিছুই শোনেননি তাই এখন আপনি তার ফল ভোগ করুন। এভাবে বলে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের করা প্রশ্নের উত্তরে তারই কর্মফলকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। অতঃপর সঞ্জয় পুনরায় ধৃতরাষ্ট্রের নিকট কুরুক্ষেত্রের পরিস্থিতি সম্বন্ধে বর্ণনা দিয়ে বলতে লাগলেন। দুর্যোধন যুদ্ধে নিজেদের পক্ষে মহারথী ভীষ্ম, দ্রোণ, শল্য, কৃপ, অশ্বত্থামাসহ আরও অনেকে যারা ত্রিভূবন জয় করতেও সমর্থ তারা থাকা সত্ত্বেও পান্ডবরা কিভাবে বারবার জয়ী হচ্ছিল তা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে ভীষ্মদেবের নিকট বিনম্রভাবে তার রহস্য জানতে চাইলে ভীষ্মদেব উত্তরে তাকে পান্ডবদের সাথে সন্ধি করার জন্য বললেন এবং মুনিগনের উদ্ধৃতি দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের পরমেশ্বরত্ব ও সর্বশক্তিমত্ত্বা স্থাপন করে বললেন- “ত্রিভুবনে এমন প্রাণী ছিলো না, বর্তমানে নাই, ভবিষ্যতে হইবে না, যে প্রাণী কৃষ্ণকর্তৃক রক্ষিত পান্ডবগণকে জয় করিতে পারে।।৪০।।” 👉 তো উক্ত শ্লোকে স্পষ্টতই পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের সর্বশক্তিমত্তা প্রকাশিত হচ্ছে। এটা সামান্যতম দূরদর্শী হলেই বুঝতে পারা যায়। তো এরপর ভীষ্মদেব শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনার জন্য পূর্বকালে গন্ধমাদন পর্বতে ঋষি, দেবতাদিগণ সম্মিলিত হয়ে তন্মধ্যে উপবিষ্ট ব্রহ্মাজির সাথে একটি আলোচনার বর্ণনা দিলেন- “তাহাদের মধ্যে উপবিষ্ট ব্রহ্মা দর্শন করিলেন- তেজে উজ্জ্বল ও উৎকৃষ্ট একখানা বিমান আকাশে অবস্থান করিতেছে।।৪৩।। তখন ব্রহ্মা ধ্যানে তাহার বিষয় জানিয়া, সংযত ও হৃষ্ট চিত্ত হইয়া এবং অঞ্জলি বন্ধন করিয়া আদিপুরুষ পরমেশ্বরকে নমস্কার করিলেন ॥৪৪॥ তাহার পর দেবতারা ও ঋষিরা ব্রহ্মাকে দণ্ডায়মান দেখিয়া এবং আকাশে অত্যাশ্চর্য্য বস্তু দেখিতে থাকিয়া সকলেই কৃতাঞ্জলি হইয়া দাঁড়াইলেন॥৪৫॥ পরে বেদজ্ঞশ্রেষ্ঠ, জগতের সৃষ্টিকর্তা ও পরমধৰ্ম্মবিৎ ব্রহ্মা যথানিয়মে সেই পরমদেবতাকে নমস্কার করিয়া বলিতে লাগিলেন-॥৪৬॥ ‘ভগবান্। যে হেতু আপনি বিশ্বাবসু, বিশ্বব্যাপী, বিশ্বমূর্তি, বিষক্-সেন, বিশ্বকর্মা, স্বাধীন, বিশ্বেশ্বর, বাসুদেব, মায়াশালী এবং নানাবিধ ক্রীড়াযুক্ত, সেই হেতু আমি আপনার শরণাপন্ন হইতেছি ॥৪৭।। 🌿 এভাবেই ব্রহ্মা সেই পরম ব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণের নিকট প্রপত্তি স্বীকার করে, তাঁর স্তুতি করে বিশদ বর্ণনা দিলেন। কিভাবে পরম-ঈশ্বর, পরম-ব্রহ্ম সৃষ্টিকার্য্য সম্পাদন করেন কিভাবেই’বা তিঁনি ব্রহ্মাজিরও উৎপত্তির কারণ। যা উক্ত অধ্যায়ের পরবর্তী শ্লোকগুলোতে বিদ্যমান। সেই অত্যাশ্চর্য বিমানসহ ব্যক্তি যখন অন্তর্হিত হলেন তখন পরবর্তীতে ঋষি, দেবতাদিগণ জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলেন সেই দিব্য পুরুষ কে। তাদের প্রত্যুত্তরে ব্রহ্মা বললেন- (মহাভারত ভীষ্মপর্বের পরবর্তী ৬৫ নং অধ্যায়ে বর্ণিত) “দেবশ্রেষ্ঠগণ। সেই যিনি পরম বস্তু এবং যে পরম বস্তু অতীতকালে ছিলেন, বর্তমানে আছেন, ভবিষ্যতেও থাকিবেন, আর যে পরম বস্তু ত্রিভুবনের প্রভু ও ‘ব্রহ্ম’ নামে অভিহিত, তিনি প্রসন্ন হইয়া আমার সহিত আলাপ করিলেন। আমিও জগতের প্রতি অনুগ্রহ করিবার জন্য সেই জগৎপতির নিকট প্রার্থনা করিলাম ॥৬-৭॥ “সমগ্র জগতের প্রভু আমিও সেই নারায়ণেরই জ্যেষ্ঠপুত্র; অতএব দেব-গণ। জগতের মহেশ্বর সেই বাসুদেব তোমাদের পুজনীয়ই হইবেন ॥১৩।। সুতরাং দেবশ্রেষ্ঠগণ! ‘ইনি মানুষ’ এইরূপ মনে করিয়া কখনও তোমরা, মহাশক্তিশালী ও শঙ্খ-চক্র-গদাধারী সেই নারায়ণকে অবজ্ঞা করিও না ॥১৪৷। ইনি পরমগোপনীয়, ইনি পরম বস্তু, ইনি পরম ব্রহ্ম এবং ইনি পরম যশ ॥১৫৷৷ ইনি নিত্য, ইনি অব্যক্ত, ইনি চিরস্থায়ী তেজ এবং ঋষিরা যাঁহাকে পুরুষ বলেন, ইনি সেই পদার্থ; কিন্তু ইহাকে জানা যায় না ॥১৬৷৷ ইনি পরম তেজ, ইনি পরম সুখ এবং ইনি পরম সত্য-ইহা বেদ বলিয়াছেন।।১৭।। অতএব অমিতবিক্রমশালী ও জগদীশ্বর এই বাসুদেবকে মানুষ মনে করিয়া ইন্দ্রপ্রভৃতি দেবতারা কিংবা অন্যান্য লোকেরা যেন ইহাকে অবজ্ঞা করেন না॥১৮।। যে লোক অজ্ঞানবশতঃ এই হৃষীকেশকে কেবল মানুষ বলিবে, সে লোক মূঢ়বুদ্ধি এবং তাহাকে সকলে পুরুষাধম বলিবে॥১৯।। মনুষ্যদেহধারী, মহাযোগী ও মহাত্মা বাসুদেবকে যে লোক অবজ্ঞা করিবে, লোকে তাহাকে তমসাচ্ছন্ন বলিবে ॥২০॥ এই অধ্যায়ে আরও দেখা যায় ভীষ্মদেব বলছেন এইসমস্তই তিঁনি মুনিগনদের নিকট তো শুনেছেনই আবার শাস্ত্রবিশারদ! জমদগ্নীনন্দন রাম, জ্ঞানী মার্কন্ডেয়, ব্যাস এবং নারদের নিকটেও শুনেছেন। তাহলে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে সমস্ত মহান মহান ব্যক্তিগণ শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান হিসেবেই জানতেন, এমনকি এভাবে ভীষ্মদেব দুর্যোধনের নিকট শ্রীকৃষ্ণের পরমেশ্বরত্ব বর্ণনা করার দরুন দুর্যোধনও সেই বিষয়ে অবগত ছিলেন, কিন্তু দারুনভাবে মোহগ্রস্ত থাকার ফলে এসব তোয়াক্কা করেননি। তাই আজকালও দেখা যায় শিশুপাল, দুর্যোধনাদির মতো কিছু লোকজন শ্রীকৃষ্ণকে কেবল মনুষ্যরূপে জেনে থাকে। অথবা জেনে-বুঝেই মোহগ্রস্ত হওয়ায় শ্রীকৃষ্ণের পরমেশ্বরত্ব স্বীকার না করার মতো মারাত্মক দুষ্কর্ম্মে লিপ্ত হয়। অতএব, সেই সমস্ত অবাঞ্চিতদের দ্বারা বিভ্রান্ত না হয়ে ভীষ্ম আদি মহাজনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কৃষ্ণভক্তিতে যুক্ত থাকুন।। হরেকৃষ্ণ।। উপস্থাপনে প্রবীর চৈতন্যচন্দ্র দাস Join with us 👇 Web: https://svadharmam.com/ Facebook Page:- স্বধর্মম্ : Connect to the inner self Facebook Group :- ° স্বধর্মম্ : প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন °

পৌত্তলিকতা! মূর্তিপূজকরাই কি পৌত্তলিক?!

Svadharmam Image

প্রশ্ন: পৌত্তলিকতা! মূর্তিপূজকরাই কি পৌত্তলিক? উত্তর: ঈশ্বরোপাসনার বিপরীত হিসেবে পৌত্তলিকতার বিষয়টি জড়িত। সহজ ভাষায় পৌত্তলিকতা হচ্ছে- বেদে বর্ণিত ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর উপাসনা করা। এসম্বন্ধে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় কেবলমাত্র নিম্নোক্ত দুইদলের ব্যক্তিরা মূর্তিতে পূজা করাকেই পৌত্তলিকতা মনে করে। ১) যারা বেদের সিদ্ধান্ত জানেনা। ২) যারা বেদের অপব্যাখ্যাকারী। তারা বলে থাকে মূর্তিপূজক মানেই হচ্ছে পৌত্তলিক। অথচ শাস্ত্র অনুমোদিত পন্থায় মূর্তিতে পূজা তথা সাকার উপাসনাকারীরা কখনোই পৌত্তলিক নন, তা নিচের আলোচনায় স্পষ্টীকরণ হবে। তবে অননুমোদিত (অনুমোদন ব্যতীত) পন্থায় উপাসনা করাটা সমীচীন নয় এবং মনগড়া কাল্পনিকভাবে কোনো কাল্পনিক স্বরূপের উপাসনা করা নিঃসন্দেহে পৌত্তলিকতা। অথচ, সেইসব দলের লোকজন 🔸পৌত্তলিকতা কি 🔸এর সংজ্ঞা কি? তা ভালোভাবে না জেনে এবং এর বাস্তবিক বৈশিষ্ট্য বুঝতে না পেরে সর্বজনীনভাবে সকল সবিশেষবাদীদের তথা সাকার উপাসকদের পৌত্তলিক বলে আখ্যা দিয়ে থাকে। এ সংক্রান্তে শ্রীকেদারনাথ দত্ত কর্তৃক প্রকাশিত “শ্রী শ্রীচৈতন্য_শিক্ষামৃত” গ্রন্থে (৫ম বৃষ্টি, পৃষ্ঠা নং-১১২) খুব সুন্দরভাবে পৌত্তলিক ও পৌত্তলিকতার বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পড়ুন নিম্নরূপ: “ভক্তদিগের ভগবৎ স্বরূপ প্রতিভূ যে যথাযথ তাহা ভক্তগণ বিশুদ্ধ ভক্তি বৃদ্ধিরূপ ফল দ্বারা অনুক্ষণ পরীক্ষা করিতেছেন। বিদ্যুৎ পদার্থের সহিত বিদ্যুৎ যন্ত্রের যে প্রকৃত সম্বন্ধ তাহা কেবল বিদ্যুৎ ফলকোৎপতি রূপ ফল দ্বারাই লক্ষিত হয়। তদ্বিষয়ে যাহারা অনভিজ্ঞ তাহারা বিদ্যুৎযন্ত্র দেখিলে কি বুঝিবে? যাহাদের হৃদয়ে ভক্তি নাই, তাহারা শ্রীবিগ্রহকে পুত্তলিকা বৈ আর কি বলিতে পারে! ভক্তদিগের সিদ্ধান্ত এই যে শ্রীবিগ্রহ সেবকেরা “পৌত্তলিক নন। তবে পৌত্তলিক কে, ইহার সংক্ষেপ বিচার করা যাউক। ভগবৎ স্বরূপের সহিত সম্বন্ধহীন বস্তুকে যাহারা উপাসনা করে তাহারা পৌত্তলিক। তাহারা পঞ্চ (০৫) প্রকার- ১। বস্তুজ্ঞানাভাবে যাহারা জড়কে ঈশ্বর বলিয়া পূজা করে। ২। জড়কে তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া জড়-বিপরীত ভাবকে ঈশ্বর বলিয়া যাহারা পূজা করে। ৩। ঈশ্বরের স্বরূপ নাই স্থির করিয়াছে, কিন্তু স্বরূপ ব্যতীত চিন্তার বিষয় পাওয়া যায় না, তজ্জন্য যাহারা উপাসনা সুলভ করিবার জন্য ঈশ্বরের জড়ীয় রূপ কল্পনা করে। ৪। যাহারা চিত্ত বৃত্তির শুদ্ধতা ও উন্নতির জন্য ঈশ্বর কল্পনা করত তাহার একটী কল্পিত মূর্তির ধ্যান করে। ৫। জীবকে যাহারা ঈশ্বর বলিয়া পূজা করে। 🔴 অসভ্য বন্য জাতিগণ, অগ্নি পূজকগণ ও জোভ সেটার্ণ প্রভৃতি গ্রহপূজক গ্রীক দেশীয় ব্যক্তিগণ প্রথম শ্রেণীর পৌত্তলিক। যে সময়ে ঈশ্বরের স্বরূপ উদয় হয় নাই অথচ জীবের ঈশ্বর বিশ্বাস স্বভাবতঃ থাকে, সেই সময় পান বশতঃ যে চাকচিক্য বিশিষ্ট বস্তুতে ঈশ্বর পূজা দেখা যায় তাহাই ঐ শ্রেণীর পৌত্তলিকতা। অধিকার বিচারে ঐ রূপ পৌত্তলিকতার নিন্দা নাই। 🔴 জড়ীয় জ্ঞানের অত্যন্ত আলোচনা ক্রমে যুক্তিদ্বারা সমস্ত জড়ীয় গুণের বিপরীত একটা নির্বিশেষ ভাবকে যখন ঈশ্বর বলিয়া বিশ্বাস হয়, তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর পৌত্তলিকতা উপস্থিত হয়। নিরাকার বাদী মাত্রই ঐ শ্রেণীর পৌত্তলিক। নির্বিশেষ ভাব কখনই ঈশ্বরের স্বরূপ বা স্বরূপ সম্বন্ধীয় ভাব হইতে পারেনা। ঈশ্বরের অনন্ত বিশেষের মধ্যে নির্বিশেষতাকে একটা বিশেষ বলিলে স্বরূপ সম্বন্ধীয় ভাব হইতে পারে। ঈশ্বরের স্বরূপ জড়-বিলক্ষণ বটে, কিন্তু জড়-বিপরীত নয়। 🔴 চরমে নির্বাণকে যাঁহারা লক্ষ্য করিয়া বিষ্ণু, শিব, প্রকৃতি, গণেশ ও সূর্য্যের সগুণমূর্তি সকলকে সাধনের উপায় বলিয়া কল্পনা করেন, তাঁহারা ঈশ্বরের নিত্য স্বরূপ মানেন না, অতএব কল্পিত মূর্তি সেবা করত তৃতীয় শ্রেণীর পৌত্তলিক মধ্যে পরিগণিত হন। আজকাল যাহাকে পঞ্চ উপাসনা বলিয়া বলা যায় তাহা এই শ্রেণীর পৌত্তলিকতা। 🔴 কোন গুণকে অবলম্বন করত তদ্বিপরীত ধর্ম যে গুণশূন্যতা তাহা কিরূপে লভ্য হইতে পারে তাহা বোধ গম্য হয় না। যোগীদিগের কল্পিত বিষ্ণু মূর্তি ধ্যানই চতুর্থ শ্রেণীর পৌত্তলিকতা। তদ্দ্বারা অন্য কোন লাভ হইতে পারে, কিন্তু ভগবানের নিত্য স্বরূপ সাক্ষাৎকার রূপ পরম লাভ হয়না। 🔴 যাঁহারা জীবকে ঈশ্বর বলিয়া পূজা করেন তাঁহারা পঞ্চম শ্রেণীর পৌত্তলিক। শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর শিক্ষা মতে ইহা অপেক্ষা আর বৃহৎ অপরাধ নাই। যে সকল জীব পূজার্হ তাঁহাদিগকে ভগবদ্ভক্ত বলিয়া পুজা করিলে, আর জীবে ঈশ্বর বুদ্ধিরূপ অপরাধ করিতে হয়না। (শ্রীরাম নৃসিংহাদির স্বরূপ ভজন যে পৌত্তলিক ব্যাপার নয় তাহা মৎকৃত শ্রীকৃষ্ণ সংহিতা পাঠ করিলে বুঝিতে পারিবেন।) উক্ত পাঁচ প্রকার পৌত্তলিকেরা যে কেবল ভগবৎ স্বরূপের নিন্দা করিয়া থাকে তাহা নয়, তাহারা অকারণ পরস্পরের নিন্দা করে। প্রথম শ্রেণীর পৌত্তলিক জড়ীয় আকাশের সর্ব্বব্যাপিত্ব গুণকেই ঈশ্বরের প্রধান গুণ মনে করিয়া ভগবৎ স্বরূপের অবহেলা করে এবং কল্পিত ও পরিমিত দেবাকার সকলের নিন্দা করিতে থাকে। ইহার মূল তাৎপর্য্য এই যে সমান অধিকারেই সাপত্ন্য ভাবও তজ্জনিত কলহ অনিবার্য্য হইয়া পড়ে। পৌত্তলিক মাত্রেই পৌত্ত-লিকের নিন্দা করেন। অপৌত্তলিক, স্বরূপলব্ধ, ভগবদ্ভক্তের কোন পৌত্তলিকের প্রতি বিদ্বেষ নাই। তিনি এই মাত্র মনে করেন যে যে পর্যন্ত স্বরূপ লাভ হয় নাই, সে পর্যন্ত কল্পনা বৈ আর কি করিবে? কল্পনা করিতে করিতে সাধু সঙ্গ ক্রমে কল্পনাকে হেয় জ্ঞান করিয়া স্বরূপ জ্ঞান হইবে। তখন আর বিবাদ করিবে না।” তথ্য উপস্থাপনে প্রবীর চৈতন্যচন্দ্র দাস Join with us 👇 Web: https://svadharmam.com/ Facebook Page:- স্বধর্মম্ : Connect to the inner self Facebook Group :- ° স্বধর্মম্ : প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন °

গৌড়ীয় দর্শনে বেদ (পর্ব-৫)

20240626_030157

নিম্বার্ক বেদান্ত বেদান্তসূত্রের সবথেকে জনপ্রিয় ভাষ্যগুলির মধ্যে বেশিরভাগই বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ভাষ্য। শংকরাচার্যের অদ্বৈতবাদকে পূর্ণরূপে খণ্ডন করে এবং তা থেকে পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে বৈষ্ণব বেদান্ত দাঁড়িয়ে আছে। শৈব, শাক্ত, গাণপত্য ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মধ্যে শাক্তমতটি বিভিন্ন পুরাণ ও উপপুরাণ, মূলতঃ তন্ত্রের উপর নির্ভরশীল; গাণপত্য মতটি কিছু উপপুরাণ ও অর্বাচীন উপনিষদের উপর নির্ভরশীল। শাক্ত ও গাণপত্য মতের বেদান্ত ভাষ্য থাকলেও তাতে অতটাও শক্তিশালী যুক্তিপূর্ণ স্বতন্ত্রতা দেখা যায় না। তাছাড়া এই দুটি মতের বৈদিক অস্তিত্বও নেই। শৈবমতের স্বপক্ষে পুরাণের পাশাপাশি কিছু শ্রুতিপ্রমাণ দেখানো হলেও সেগুলি আবার বৈষ্ণবেরা খণ্ডন করে দেখিয়েছেন যে, সেগুলি আসলে বিষ্ণুকেই উদ্দেশ্য করে- তা নাহলে শ্রুতির অন্য অংশের সাথেই বিরোধ হয়। শৈব, শাক্ত ও গাণপত্য মতের বেদান্ত ভাষ্য শেষপর্যন্ত অদ্বৈতবাদের সাথে স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে পারে না। কিন্তু বৈষ্ণব বেদান্ত সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র ও স্বতঃস্ফূর্ত। পূর্ববর্তী বহু প্রবন্ধে বৈষ্ণব বেদান্ত আলোচনা করা হয়েছে। পূর্ববর্তী ৪ টি পর্বে সংক্ষেপে বেদ, বেদান্ত সূত্র এবং ৩ বৈষ্ণব আচার্যের বেদান্ত দর্শন সম্বন্ধে আমরা আলোচনা করেছিলাম। এই পর্বে আমরা আচার্য শ্রীনিম্বাদিত্য এবং তাঁর বেদান্ত দর্শন বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করবো। “সা জিহ্বা যা হরিং স্তৌতি তচ্চিত্তং যত্তদর্পনম। তাবেব কেবলৌ শ্লাঘ্যৌ যৌ তৎপুজাকরৌ করৌ ।। অর্থাৎ, সেই জিহ্বাই জিহ্বা যে কেবলমাত্র শ্রীহরির স্তব করে, সেই চিত্তই চিত্ত যে চিত্ত শ্রীহরিতে সমর্পিত, সেই হস্তদ্বয় কেবল শ্লাঘ্য যে হস্তদ্বয় শ্রীবিষ্ণুর পূজায় রত হইয়াছে। (শ্রীল পূর্ণ প্রজ্ঞের কৃষ্ণামৃতমহার্ণবম-৭৪)   চিন্ত্য দ্বৈতাদ্বৈত সিদ্ধান্ত (শ্রী নিম্বাদিত্য) : চার বৈষ্ণব মহাসম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনতম সম্প্রদায় হলো এই নিম্বাদিত্য বা নিম্বার্ক সম্প্রদায়। দ্বাপর যুগের শেষ দিকে স্বয়ং ভগবান ভৌমলীলা সংগুপ্ত করে স্বধাম গোলোকোদ্দেশ্যে প্রস্থান করলে এই ধন্য ভারত ভূমিতে কলি তার পার্ষদ হিংসা, মিথ্যা, দ্বেষ, কাম, ক্রোধ ইত্যাদি সহ প্রভূত অধার্মিক শক্তি সহযোগে এই পূণ্য ভূমির ধর্মাকাশ পাপের কুয়াশায় তমসাচ্ছন্ন করতে শুরু করে। কলির প্রভাবে প্রায় প্রত্যেকেই ভাগবত ধর্মচ্যুত হয়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র মত এবং পন্থায় আকৃষ্ট হতে থাকে। এমতাবস্থায় শ্রী ভগবান তাঁর সুদর্শন চক্রের এক অবতারকে পরম বৈষ্ণব শ্রীমদ আরুনি এবং বৈষ্ণবী জয়ন্তী দেবীর আলয়ে প্রেরণ করলেন। নিম্বাদিত্য বা নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের উদ্ভব ভগবানের পরম ভক্ত এবং ব্রহ্মাজীর মানস পুত্রগণ অর্থাৎ ব্রহ্মার চতুষ্কুমার সনক, সনন্দ, সনাতন এবং সনত কুমার হতে, যেটি আচার্য নিম্বার্ক তাঁর বেদান্ত দর্শনের প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয় পাদের অষ্টম সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আচার্য শ্রীল নিম্বাদিত্য প্রবর্তিত বেদান্ত ভাষ্যের নাম “বেদান্ত পারিজাত সৌরভ” । পরবর্তীতে শ্রীল আচার্যের শিষ্য শ্রীল শ্রীনিবাসাচার্য্য এটির কিঞ্চিৎ বিস্তৃত করেন এবং নাম দেন “বেদান্ত কৌস্তভ”। আচার্য্য শ্রীনিম্বাদিত্যের প্রচারিত সিদ্ধান্ত “চিন্ত্য দ্বৈত-অদ্বৈত সিদ্ধান্ত” নামে পরিচিত। তাঁর মতে ব্রহ্ম-জীব ও জগৎ স্বরূপত এবং ধর্মত যুগপৎ ভিন্ন এবং অভিন্ন। এই ভেদ এবং অভেদ সমানভাবে সত্য, নিত্য ও অবরুদ্ধ। অর্থাৎ জীবেশ্বরে বা পরমাত্মায় নিত্য ভেদ এবং অভেদ বর্তমান। এই নিত্য ভেদ এবং অভেদের মতবাদ বা শিক্ষা ভগবান চৈতন্য মহাপ্রভুও দিয়ে গেছেন। কতিপয় অসৎ অসূয়াপরায়ণ ব্যক্তি নিজ মূর্খামি বশে শ্রীল নিম্বার্কাচার্য্যের চিন্ত্য ভেদাভেদবাদ এবং শ্রীমন্মহাপ্রভু দ্বারা প্রবর্তিত অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্বকে একই মনে করে শ্রীমন্মহাপ্রভুর প্রিয় পার্ষদ শ্রীল রুপ গোস্বামীর অনুগত গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের দর্শনকে নিম্বার্ক সম্প্রদায়ভুক্ত বলে মিথ্যা প্রচার করে থাকে। যাই হোক এই বিষয় সম্বন্ধে একটি আলাদা প্রবন্ধ করার ইচ্ছা রাখছি।   শ্রীল নিম্বার্কাচার্য্যের সিদ্ধান্ত: ঈশ্বর : ভ্রম, প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা, করণাপাটব, মোহ, তন্দ্রাদি অষ্টাদশ দোষ ভগবৎ তত্ত্বে নাই। তিনি নির্দ্দোষ-নির্গুণ। সচ্চিদানন্দ স্বরূপে তিনি নিত্য তাঁর নিজ ধাম গোলক বৃন্দাবনে স্বরূপ শক্তি শ্রীমতি রাধারানী সহিত বিরাজমান। তিনি নিত্য অপ্রাকৃত বিগ্রহস্বরূপ। তিনি অপ্রাকৃত চিন্ময় তত্ত্ব সৎ-চিদ-আনন্দময় তাই জড় বুদ্ধির দৃষ্টিতে তিনি নিরাকার বলে প্রতীত হন, কারণ জড় জাগতিক উপাদান দিয়ে তিনি গঠিত নন। কিছু পাষন্ড ব্যক্তি সুকৃতির অভাবে বা ভগবৎ বিদ্বেষের কারণে তাঁর এই অপ্রাকৃত আকৃতি প্রাকৃত বুদ্ধি দ্বারা গ্রহণ করতে সদা ব্যর্থ হন। এরাই বেদের “না তস্য প্রতিমা অস্তি” বেদের এই মন্ত্রের মুখ্য অর্থ ব্যতিরেকে গৌণ অর্থ করে থাকে। তারা তাদের জড় বুদ্ধি দ্বারা প্রতিমা শব্দার্থ করে জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে, তাদের কাছে প্রতিমা অর্থে নির্জীব পুতুল। কিন্তু এক্ষেত্রে মুখ্য অর্থে প্রতিমা কথার অর্থ হলো তুলনা বা উপমা। অর্থাৎ এই মন্ত্রে মুখ্য অর্থ দাঁড়ায় “সে পরম অদ্বয় তত্ত্বের উপমা বা তুলনা জাগতিক দৃষ্টিতে নেই। কোনো প্রাকৃতিক বা জাগতিক বস্তু দ্বারা তিনি গঠিত নন। বেদ মূলত জড় জাগতিক তিন গুনকেই অধিক গুরুত্ব প্রদান করেন কিন্তু পরাৎপর অখিলেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ত্রিগুণাতীত তাই এক্ষেত্রে সহজেই বোঝা যায় যে উক্ত মন্ত্রের অর্থ এই দাঁড়ায় যে ত্রিগুণাতীত ভগবানের জাগতিক হিসাবে কোনো তুলনা হয়না বা ত্রিগুণান্তর্গত জাগতিক দৃষ্টিতে তাঁর কোনো উপমা নেই। যাই হোক এভাবেই মূর্খ ব্যক্তিরা প্রতি ক্ষেত্রেই মুখ্য অর্থ পরিত্যাগ করে গৌণ অর্থ নির্ধারন করে থাকেন। এখানে শ্রীল নিম্বার্কাচার্য্যের উক্তি এবং এই বেদ মন্ত্রের সমন্বয় সাধিত হলো। গোলোক চতুর্ব্যূহ, পরব্যোম চতুর্ব্যূহ এবং অন্যান্য চতুর্ব্যূহাংশ কৃষ্ণের অংশ এবং কৃষ্ণ স্বয়ং অংশী। তিনি প্রাকৃতিক জড় বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিগণের নিকট নিরাকার কিন্তু অপ্রাকৃতিক ভক্ত চক্ষুর নিকট তিনি সাকার। তিনিই সমস্ত সৌন্দর্য্য এবং মাধুর্য্যের মূল উৎস। রাধালিঙ্গিত সেই পরমতত্ত্বই সর্ব কারণের পরম কারণ। তিনি স্বরূপ শক্তি সর্ব্বোলক্ষ্মীময়ী কীর্তিদাসুতা এবং তাঁর কায় ব্যূহস্বরূপ সহস্র সহস্র সখীগণ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে প্রত্যেকের নিত্য আরাধ্য। তিনি সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র, সর্ব্বশক্তিমান, সর্ব্বেশ্বরেশ্বর। তিনি ব্রহ্মা শিবাদি দেবগন দ্বারা নিত্য বন্দিত। (উল্লেখ্য পাষণ্ডগণ বলে থাকে শ্রীমতি রাধারানী এবং সখীবৃন্দ গৌড়ীয় বৈষ্ণব দ্বারা বানানো বা কল্পনা মাত্র -যদি তাই হবে তবে আজ হতে ৫৫০০ বছর পূর্বে শ্রীল নিম্বার্কাচার্য্য কেনো শ্রীমতি এবং তাঁর সখি মঞ্জরীদের কথা বলে গেলেন?, তাদের আরও বক্তব্য হলো ব্রহ্মা,দূর্গা এবং শিবাদি দেবগন কৃষ্ণের চরণ বন্দনাকারী দাস এই উক্তি গুলিও গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের সাজানো মিথ্যা ভাষণ, মহাপুরান শ্রীমদ্ভাগবত মিথ্যা, ব্রহ্ম সংহিতা মিথ্যা-যদি তাই হবে তবে ভাগবত এবং ব্রহ্ম সংহিতার বচন আচার্য্য নিম্বার্কের সাথে মিলে যায় কিভাবে? ৫৫০০ বছর পূর্বে নিশ্চই গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় আত্মপ্রকাশ করেনি !) জীব : আচার্য্য নিম্বার্কের সিদ্ধান্তানুযায়ী পরমাত্মা এবং জীবাত্নার মধ্যে অংশী ও অংশ এবং জ্ঞ ও অজ্ঞ ইত্যাদি নিত্য ভেদ বর্তমান। অংশী অর্থে পরমেশ্বর, জীবাত্মাগণ যাঁর অংশদ্ভুত তিনি অংশী এবং জীবাত্মা তাঁর নিত্য অংশ। “জ্ঞ” অর্থে পরমেশ্বর পরমাত্মা এবং অজ্ঞ অর্থে পরমাত্মার জীবাত্মা। “অংশো নানাব্যপদেশান্যথা চাহি দাশকিতবাদিত্বমধীয়ত একে” (ব্রহ্ম সূত্র- ২|৩|৪২) ব্রহ্ম সূত্রের এই সূত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিজ ভাষ্যে শ্রীল আচার্য্য বললেন ” জীব এবং পরমাত্মার অংশাংশি বা ভেদাভেদ ভাব নিত্য বর্তমান। জীব পরমাত্মার নিত্য অংশ, কারণ জ্ঞ- অজ্ঞ – ঈশ্বর ও জীব উভয়েই অজ এবং নিত্য ইত্যাদি । আবার “তত্ত্বমসি” ইত্যাদি শ্রুতিতে জীব ও ব্রহ্মের অভেদ বলা হয়েছে। সুতরাং এক্ষেত্রে ভেদ এবং অভেদ দুই স্বীকার করা হোয়েছে। অতএব জীব এবং ব্রহ্মে অংশাংশি বা ভেদ অভেদ সম্বন্ধ বর্তমান । সুতরাং শ্রুতিতে কেবলাদ্বৈতবাদ স্থান পায়না। জীব অণু চৈতন্য এবং পরমেশ্বর বৃহচ্চৈতন্য , অণু চৈতন্য সর্ব্বদাই বৃহচ্চৈতন্যের নিয়ন্ত্রণাধীন। জীব তিন প্রকারের ১) মুক্ত,২) বদ্ধমুক্ত এবং ৩) বদ্ধ। মুক্তজীব: যারা শ্রীকৃষ্ণের চরণে সম্পূর্ণ সমর্পিত তারা মুক্ত। বদ্ধমুক্ত : যারা পূর্বে মায়াধীন বা মায়াবদ্ধ ছিল।

মৃগয়ার উদ্দেশ্য কি? মাংসাহার নাকি লোক কল্যাণ?

448993340_494286626501762_9171595380647725788_n

আমাদের মধ্যে অনেকে ভেবে থাকেন, ক্ষত্রিয় রাজারা বুঝি পশুমাংস ভক্ষণের উদ্দেশ্যে মৃগয়া করতেন। এমনকি কিছু অতি উৎসাহী ব্যক্তিও পাওয়া যায় মাঝে মাঝে, যারা রামায়ণ/মহাভারত থেকে শ্রীরামচন্দ্র বা পান্ডবদের মৃগয়ার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে দাবী করে বসেন, তারাও নাকি মাংসভোজী ছিলেন! যারা এরূপ ভাবেন, তারা ‘ক্ষত্রিয়’ ও ‘ব্যাধ’ জাতির মধ্যকার পার্থক্য বুঝেন না। পশুশিকার করে পশুমাংস ভক্ষণ ও বিক্রি করা ব্যাধ(কসাই) জাতির কর্ম। এটি গর্হিত কর্ম, এ ধরনের নিন্দিত কর্মকারীদের অস্পৃশ্য গণ্য করা হতো। তাই এ সমস্ত ব্যাধ জাতিদের নগরীর মধ্যেও বসবাস করতে দেওয়া হতো না। নগরীর বাইরে বনের মধ্যে তাদের বাস করতে হতো। অপরদিকে ক্ষত্রিয়ের কর্ম উদ্দেশ্য মহৎ। সমস্ত মনুষ্য এবং জীবকূলের রক্ষা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। ধর্মার্থে মৃগয়া ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য, কিন্তু মাংসাহারের জন্য মৃগয়ার বৈধতা নেই ক্ষত্রিয়ের। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র স্বয়ং ক্ষত্রিয়ের মৃগয়া ধর্ম বর্ণনাকালে তা উল্লেখ করেছেন- রাজ্ঞাঞ্চ মৃগয়া ধর্ম্মে বিনা আমিষভোজনম্ ॥ [পদ্মপুরাণ:পাতালখন্ড/৭০।১৯৬ (নবভারত)] বঙ্গানুবাদঃ শ্রীরাম বললেন, ‘ধর্মার্থে রাজা কর্তৃক মৃগয়ার বিধান থাকলেও আমিষভক্ষণের জন্য মৃগয়ার বিধান নেই।’ Raghava said, “Hunting without eating the flesh (of the animal killed) is the rule in the hunting done by a king.” [Padma Purana, Patal Khand, 116/199, Motilal Banarasidass Press] প্রশ্ন-১: তাহলে প্রশ্ন উঠে, রাজারা যদি পশুমাংস আহারই না করবেন, তবে কিরূপ ধর্ম পালনের জন্য তারা মৃগয়া করতেন? উত্তরঃ মূলত লোক কল্যাণার্থে ৪টি কারণে ক্ষত্রিয়রা মৃগয়া করতেন- ১) রাজা কেবল কোন রাজ্যের বসবাসরত মানুষের অধিপতি নয়, সে রাজ্যের অন্যান্য জীব জন্তুদেরও অধিপতি। মানুষের মতো পশুপাখিদের মধ্যেও অন্তঃ ও আন্তঃ বিরোধ প্রায়ই দেখা যায়, যা প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্টের জন্য দায়ী হয়ে পড়ে। তাই রাজা মৃগয়া করে জীবজন্তদের মধ্যকার এরূপ দ্বন্দ্বের নিরশন করেন। দৃষ্টান্ত: বাল্মীকি রামায়ণের কিষ্কিন্ধাকান্ডের ১৮ নং সর্গে বর্ণিত আছে, বানর সাম্রাজ্য নিয়ে বালী ও সুগ্রীব নামক দুই বানরের মধ্যে যুদ্ধ হলে রামচন্দ্র মৃগয়া দ্বারা বালীকে বধ করে বানরকূলের অন্তঃদ্বন্দ্বের নিরশন করেন। ২) পূর্ব যুগসমূহে অসুরেরা বিভিন্ন জন্তুর (যেমন: মৃগ,অজ,খরগোশ ইত্যাদি) রূপ ধারণ করে বনে বিচরণ করতো এবং সুযোগ পেলে মুনি ঋষিদের বধ করতো। ক্ষত্রিয় রাজারা এ সমস্ত পশুরূপী অসুরদের বধ করে মুনি ঋষিদের সুরক্ষা দান করতেন। দৃষ্টান্ত: বাল্মীকি রামায়ণের অরণ্যকাণ্ডের ১০ম সর্গে আমরা দেখতে পাই, দন্ডকারণ্যে মুনি ঋষিরা রামচন্দ্রের নিকট প্রার্থনা করেন, মৃগরূপী অসুরদের নাশ করে তাদের রক্ষা করতে। রামচন্দ্র তাদের অভয়দান করেন এবং সমস্ত দন্ডকারণ্য অসুরমুক্ত করেন। এছাড়াও মারীচাদি অসুরদের মৃগরূপ ধারণ করে রাম-লক্ষ্মণের উপর আক্রমণের একাধিক উপাখ্যান বর্ণিত আছে। রামচন্দ্র এসব অসুরদের বধ করতেন। ৩) ‘কস্তুরী মৃগ’ নামক এক বিশেষ প্রকারের মৃগ আছে, যার নাভীতে এক বিশেষ প্রকার গ্রন্থী থাকে। পরিণত বয়সে এ গ্রন্থ থেকে অতীব সুগন্ধ ছড়ায়। এ সুগন্ধ এতোই মনোহর যে তা সমস্ত জীব জন্তুদের আকৃষ্ট করে। কিন্তু কস্তুরী মৃগ নিজে বুঝে না যে এ গন্ধ তার নাভী থেকে আসছে। সে পাগলের মতো খানা-পিনা ছেড়ে ছাটাছুটি করতে থাকে। এভাবে দুর্বল হয়ে এক সময় মারা যায়। মারা গেলে মহামূল্যবান কস্তুরী নষ্ট হয়ে যায়। এ কস্তুরী ওষুধ ও পারফিউম তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। বনের মধ্যে পাগলা কস্তুরী মৃগের সামনে কোন মনুষ্য পড়লে এর আক্রমণে অকালমৃত্যু বরণ করতে হতো। তাই তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অতীব জরুরি হয়ে পড়ে। সেজন্য নির্দিষ্ট মৌসুমে রাজাদের মৃগয়ায় গিয়ে এ কস্তুরী মৃগদের বধ করতে হতো। ৪) এছাড়া নরমাংসভোজী বাঘ্র, সিংহ, ভাল্লুকাদি হিংস্র জীবের উৎপাত শুরু হলেও তাদের বধের জন্য ক্ষত্রিয় রাজারা মৃগয়া করতেন। দৃষ্টান্ত: শ্রীমদ্ভাগবতমের ১০ম স্কন্ধের ৫৬-৫৭ অধ্যায় হতে আমরা জানতে পারি, সত্রাজিৎ এর ভাইকে বনমধ্যে সিংহ বধ করলে শ্রীকৃষ্ণ মৃগয়ায় গিয়ে সিংহকে বধ করে এবং জাম্বুবান নামক ভাল্লুকরাজকে যুদ্ধে পরাজিত করে সত্রাজিতের হারানো সামন্তক মণি উদ্ধার করেন। প্রশ্ন-২: মৃগয়ায় শিকার করা জন্তুদের কি করা হতো? উত্তর: ১) মৃগয়ায় বধ হওয়া জন্তুদের চামড়া বিশেষ করে হরিণ ও বাঘের চামড়া মুনি ঋষিদের দান করা হতো। এর উপর বসে তারা যখন তপস্যা করতেন। এছাড়া মৃগচর্ম, ব্যাঘ্রচর্ম মুনি ঋষিরা পরিধান করতেন। এমনকি মহাদেব শিবও ব্যাঘ্র চর্ম পরিধান করে তপস্যা করেন। গীতাতেও মৃগচর্মের উপর বসে তপস্যার বিধান আছে। এভাবে মুনি ঋষি তপস্বীগণ যখন এসমস্ত বধ্য জীবের চর্মের উপর তপস্যা করতো, সে পুণ্য প্রভাবে এ সমস্ত জীবেরা উত্তম গতি প্রাপ্ত হতো। ২) মৃগয়ায় বধ হওয়া পশুর দেহের উপর নানাবিধ গবেষণা করা হতো। প্রাণীর অভ্যন্তরীন গঠন, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যাবলি ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য মৃত জন্তু ঋষিকূলে পাঠানো হতো। সেখানে তারা যজ্ঞে বসে এ সমস্ত মৃত পশুদের শুদ্ধি করে নানা প্রকার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পর্যবেক্ষণ করতো এবং নানা গ্রন্থি হতে প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে নানা রোগের ওষুধি প্রস্তুত করা হতো। ৩) মৃগয়ায় যে পশুমাংস পাওয়া যেত তা যজ্ঞের পর রাজ-কুকুর, রাজ-শকুন, রাজ-চিল ইত্যাদি মাংসাশী পশুপাখিদের খাওয়ানো হতো। একে শাস্ত্রের ভাষায় ‘ভূতযজ্ঞ’ বলা হয়। এভাবে বিধিবৎ মৃগয়া দ্বারা প্রভূত লোক-কল্যাণ সাধিত হতো। প্রশ্ন-৩ মৃগয়ায় যে পশুবধ হচ্ছে তাতে কি সত্যিই পাপ হয় না? মৃগয়াকালে তো নির্দোষ জীবেরও বধ হতে পারে। উত্তর: লোক কল্যাণার্থে মৃগয়া উদ্দেশ্য হলেও মৃগয়াকালে অনেক সময় নির্দোষ জীবেরও বধ হয়ে যায়। রামায়ণে দেখা যায় রাজা দশরথ কিংবা মহাভারতে দেখতে পাই রাজা পান্ডুর দ্বারাও মৃগয়াকালে ভুলে ঋষিহত্যা পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিলো। তাই মৃগয়াকালে কম বেশি পাপ হয়েই থাকে। এ পাপ হতে বাঁচতে ক্ষত্রিয়কে শেষ বয়সে সংসার ত্যাগ করে ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য তপস্যায় নিজেকে নিয়োজিত করতে হয়। শ্রীকৃষ্ণ উবাচ- ক্ষাত্রধর্মস্থিতাে জন্তুন্যবধীরমগয়াদিভিঃ। সমাহিতস্তত্তপসা জহঘং মদুপাশিতঃ ॥ [শ্রীমদ্ভাগবতম ১০/৫১/৬২] অনুবাদঃ পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ রাজা মুচুকুন্দকে বললেন, “যেহেতু তুমি ক্ষত্রিয়ের নীতি অনুসরণ করেছিলে, তাই মৃগয়া ও অন্যান্য কর্তব্য সম্পাদনের সময় তুমি প্রাণী হত্যা করেছ। আমাতে শরণাগত হয়ে থেকে যত্ন সহকারে তপস্যা পালনের দ্বারা তোমার সঞ্চিত পাপরাশি পরাভূত করা উচিত।” প্রশ্ন-৪: কোন ক্ষত্রিয় যদি লোককল্যাণার্থ মৃগয়া না করে ইন্দ্রিয় তৃপ্তির কোন মৃগয়া করে তবে তার পরিণতি কি হবে? উত্তরঃ এর উত্তরে মনুস্মৃতিতে বর্ণিত আছে, “যে লোক নিজের সুখের জন্য হিংসারহিত হরিণ প্রভৃতি নিরীহ পশুদের হত্যা করেন, সে লোক জীবিত কিংবা মৃত্যুর পর কোন অবস্থাতেই সুখী হতে পারেন না।” [ মনুসংহিতা, অধ্যায় ৫, শ্লোক ৪৫ ] মনুসংহিতায় ক্ষত্রিয়দের পক্ষে পাপের সম্ভাবনা আছে এরূপ দশটি পাপের কথা বলা হয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে মৃগয়া যেহেতু বধকার্য্য, এর মাধ্যমে ক্ষত্রিয় খুব সহজেই দূষিত হয়ে যেতে পারে এবং পাপভাগী হতে পারে- পানমক্ষাঃ স্ত্রিয়শ্চৈব মৃগয়া চ যথাক্ৰমম্। এতৎ কষ্টতমং বিদ্যাচ্চতুষ্কং কামজে গণে৷৷ [মনুস্মৃতি ৭।৫০] অনুবাদ: ক্ষত্রিয়ের দশটি কামজ দোষের মধ্যে মদ্যপান, পাশাখেলা, স্ত্রীসম্ভোগ (ব্যভিচার অর্থে) এবং মৃগয়া—এই চারটিকে যথাক্রমে অত্যন্ত দূষ্য এবং কষ্টতম বলে বুঝতে হবে।। তাই, মহাভারতে ক্ষত্রিয় রাজের প্রতি মহামন্ত্রী বিদূরের উপদেশ তারা যেন লোকরক্ষা ব্যতীত আসক্তি বশত মৃগয়া না করেন। সপ্ত দোষাঃ সদা রাজ্ঞা হাতব্যা ব্যসনোদয়াঃ। প্রায়ণো যৈবিনশ্যন্তি কৃতমূলা অপীশ্বরাঃ ॥ স্ত্রিয়োহ’ক্ষা মৃগয়া পানং বাকপারুষ্যাঞ্চ পঞ্চমম্। মহচ্ছ দণ্ডপারুষ্যমর্থদূষণমেব চ ॥ [মহাভারত, উদযোগপর্ব, ৩৩।৯৭-৯৮] অনুবাদ: সপ্তবিধ দোষ যথা- স্ত্রীসঙ্গ, দ্যূতক্রীড়া, মৃগয়া, মদ্যপান, কটু কথা বলা, নিষ্ঠুরভাবে গুরুতর দণ্ড করা এবং ঘুষ প্রভৃতি গ্রহণ করা ॥ সুপ্রতিষ্ঠিত প্রভুরাও যেগুলি

ভারত ভূমির প্রকৃত ধর্ম কি? হিন্দুধর্ম নাকি সনাতন বৈষ্ণব ধর্ম?

277755653_135112489081556_5005084771574902321_n

ভারত ভূমির প্রকৃত ধর্ম কি?! হিন্দুধর্ম নাকি সনাতন বৈষ্ণব ধর্ম?! বর্তমানে বহুল আলোচিত বিতর্ক- আমাদের ধর্মের প্রকৃত নাম কি?! আমাদের ধর্ম হিন্দু না সনাতন?! আবার অনেকে কেন বলছেন আমাদের ধর্ম বৈষ্ণব?! শাস্ত্রে আমাদের ধর্মের নাম কি বলেছে?! শুনতে হয়তো অদ্ভূত লাগতে পারে, আমাদের ধর্মের কোন শাস্ত্রেই ‘হিন্দু’ শব্দের কোন উল্লেখ নেই। বেদেও নেই, স্মৃতিতেও নেই, পুরাণ কিংবা ভারতের আদি ইতিহাস- মহাভারতেও নেই। আরো অদ্ভুত তথ্য হলো- সতের শতকের আগে পর্যন্ত ‘হিন্দু’ শব্দটির কোন অস্তিত্বই ছিলো না। উনিশ শতকের আগে অভিধানে হিন্দু বলে কোন শব্দই ছিলো না। ‘হিন্দু’ শব্দটি অতি আধুনিক শব্দ, অথচ ভারতভূমিতে বসবাসকারী জনগনের বৈদিক সংস্কৃতি এতোই সুপ্রাচীন যে কালের হিসেবে গণনা করা যায় না। আমাদের ধর্মের নাম সনাতন, আরো বিশেষভাবে বললে- সনাতন বৈষ্ণব ধর্ম। আমাদের ধর্ম শাস্ত্রগুলোতে সরাসরিভাবেই এর নামকরণ করা হয়েছে। হিন্দু শব্দটি কেবল জাতি বিশেষকে বুঝায়, ধর্মকে নয়। ধর্ম হিসেবে ব্যবহারের জন্য ‘হিন্দু’ শব্দের ব্যুৎপত্তিই হয় নি, এ শব্দের উৎপত্তি হয়েছিলো বিশেষ জাতিকে বুঝাতে। দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে বিদেশী শাসকদের অধীনে দাস্যত্ব করতে করতে আমরা নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ভুলে নিজেদেরকে বিদেশীদের দেওয়া নামে পরিচয় দিতে অধিক গর্ববোধ করি। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। [ পোস্টের শেষাংশে আমাদের ধর্ম কেন ‘হিন্দু’ নয় তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখা করা হয়েছে ] মহাভারতের যুদ্ধের অন্তে যুধিষ্ঠীরের অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন হলে যুধিষ্ঠীর মহারাজ শ্রীকৃষ্ণকে এ ভারতভূমির পরম ও সর্বোত্তম শ্রেষ্ঠ ধর্ম – সনাতন বৈষ্ণব ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন- ভগবন্! বৈষ্ণবাধর্ম্মাঃ কিংফলাঃ কিংপরাষণাঃ। কিংধর্ম্মসধিকৃত্যাথ ভবতোৎপাদিতাঃ পুবা ॥৩॥ পবিত্রাঃ কিল তে ধর্ম্মাঃ সর্বপাপপ্রণাশনাঃ। সর্বধর্ম্মোত্তমাঃ পুণ্যা ভগবংস্ত্বন্মুখোদ্‌গতাঃ ॥৫॥ [মহাভারত: আশ্বমেধিক পর্ব/১১৭/৩,৫ ] অনুবাদ: যুধিষ্ঠির বললেন, ” হে ভগবান কৃষ্ণ! বৈষ্ণবধর্মের ফল কি? তাহার আশ্রয় কি? এবং তুমি কোন আচার অবলম্বন করে এই ধর্ম উৎপাদন করেছো? ভগবান! তোমার মুখনির্গত এই বৈষ্ণবধর্ম পবিত্র, সর্বপাপনাশক ও দানধর্ম, অহিংসাধর্ম, পিতৃধর্ম, পতিধর্ম, বর্ণাশ্রম ধর্ম ইত্যাদি যত প্রকার পুন্যধর্ম আছে তা সে ধর্মেরই জাত, তাই এ বৈষ্ণবধর্ম সর্বশ্রেষ্ঠ।” দ্রষ্টব্য: এ শ্লোকে ‘সর্বোধর্ম্মোত্তমাঃ’ শব্দ দ্বারা বৈষ্ণব ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে আক্ষ্যা দেওয়া হয়েছে। ‘ভগবংস্ত্বন্মুখোদগতা’ শব্দের দ্বারা বুঝানো হয়েছে এ ধর্ম স্বয়ং ভগবানের শ্রীমুখ হতে নিঃসৃত। অর্থাৎ এ সনাতন বৈষ্ণবধর্ম মানুষের সৃষ্টি নয়, এটি ভারতভূমীর সন্তানদের জন্য স্বয়ং ভগবান নিজে তৈরি করেছেন। বৈশম্পায়ন উবাচ। ইত্যেবং কথিতে দেবে ধর্ম্মপুত্রেণ সংসদি। বসিষ্ঠাদ্যাস্তপোযুক্তা মুনয়স্তত্ত্বদর্শিনঃ।। শ্রোতুকামাঃ পরং গুহ্যং বৈষ্ণবং ধর্ম্মমুত্তমম। তথা ভাগবতাশ্চৈব ততস্তং পর্য্যবারয়ন। যুধিষ্ঠির উবাচ । তত্ত্বতস্তব ভাবেন পাদমূলমুপাগতম্ । যদি জানাসি মাং ভক্তং স্নিগ্ধং বা ভক্তবৎসল ! ॥১৩॥ ধৰ্ম্মগুহ্যানি সর্বাণি বেত্তুমিচ্ছাসি তত্ত্বতঃ । ধৰ্ম্মান্ কথয় মে দেব ! য্দ্যনুগ্রহভাগহম্ ॥১৪৷ বৈশম্পায়ন উবাচ । এবং পৃষ্টস্তু ধর্ম্মজ্ঞো ধৰ্ম্মপুত্রেণ কেশবঃ। উবাচ ধৰ্ম্মান্ সূক্ষ্মার্থান্ ধৰ্ম্মপুত্ৰষ্স্য হৰ্ষিতঃ ॥১৫॥ [মহাভারত, আশ্বমেধিক পর্ব, ১১৭। ১১-১২ ] অনুবাদ: বৈশম্পায়ন বলিলেন—সভায় যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে এইরূপ বলিলে, তপস্বী ও তত্ত্বদর্শী বসিষ্ঠপ্রভৃতি মুনিগণ এবং ভগবদ্ভক্ত সাধুগণ পরম গোপনীয় উত্তম বৈষ্ণবধর্ম্ম শুনিবার ইচ্ছা করিয়া আসিয়া কৃষ্ণকে পরিবেষ্টন করিলেন ॥ যুধিষ্ঠির বলিলেন—‘ভক্তবৎসল ! যথার্থই আমি তোমার প্রতি ভক্তিবশতঃ তোমার পাদমূলে আসিয়াছি, তুমি যদি আমাকে ভক্ত ও স্নেহযুক্ত বলিয়া জান এবং আমি যদি তোমার অনুগ্রহভাগী হই, তাহা হইলে আমার নিকট বৈষ্ণবধৰ্ম্ম বল। আমি যথার্থভাবে গুপ্ত সমস্ত বৈষ্ণবধৰ্ম্ম জানিতে ইচ্ছা করি’ ॥ বৈশম্পায়ন বলিলেন—যুধিষ্ঠির এইরূপ প্রশ্ন করিলে, ধর্ম্মত কৃষ্ণ আনন্দিত হইয়া তাঁহার নিকটে এ সূক্ষ্ম ধৰ্ম্ম বলিতে আরম্ভ করিলেন॥ উল্লেখ্য, এ শ্লোকে ‘পরং গুহ্যং বৈষ্ণবং ধর্ম্মমুত্তমম’ শব্দ দ্বারা বৈষ্ণব ধর্মকে সর্বাধিক গোপনীয় ধর্ম আক্ষ্যা দেওয়া হয়েছে। তাই এ বৈষ্ণব ধর্মকে আমরা সাধারণত ‘সনাতন ধর্ম’ বলেই অধিক ডাকি। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণই এ বৈষ্ণব ধর্মকে সনাতন ধর্ম আক্ষ্যা দিয়েছেন মহাভারতে। আমাদের বৈদিক শাস্ত্রের অন্য কোনরূপ মত বা -ism কে সনাতন ধর্ম বলে স্বীকৃতি দেওয়া নেই। ভগবানুবাচ। শৃণু পার্থিব ! তৎ সৰ্ব্বং ধৰ্ম্মসূক্ষ্মং সনাতনম্ । দুর্বিজ্ঞেয়তমং নিত্যং যজ্ঞ যত্র মহাজনাঃ ॥ [ মহাভারত আশ্বমেধিক পর্ব, ১২০।২ ] -ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “রাজা! অভিজ্ঞ লোকেরাও যে বিষয়ে সর্বদা মুগ্ধ হয়ে থাকেন, অত্যন্ত দুর্জ্ঞেয় সেই সূক্ষ্ম সনাতনধর্ম আপনি শ্রবণ করুন।” বৈশম্পায়ন উবাচ। এবং শ্ৰুত্বা বচঃ পুণ্যং সত্যং কেশবভাষিতম । এহৃষ্টমনসো ভূত্বা চিন্তযস্ন্তোহদ্ভূতং পরম্ ॥৫॥ দেবব্রহ্মর্ষণঃ সর্বে গন্ধৰ্বপ্পবসস্তথা। ভূতা যক্ষগ্রহাশ্চৈব গুহ্যকা ভুজগাস্তথা ॥৬॥ বালখিল্যা মহাত্মানো যোগিনস্তত্ত্বদৰ্শিনঃ। তথা ভাগবতাশ্চাপি পঞ্চকলিমুপসিকাঃ ॥৭॥ কৌতূহলসমাবিষ্টাঃ প্রহৃষ্টেদ্ৰিয্যানসাঃ। শ্রোতুকানাঃ পরং ধর্ম্মং বৈষ্ণবংধর্মশাসনস্। হৃদি কর্তৃক তদ্বাক্যং প্রণেমুঃ শিরসা নতাঃ।। [মহাভারত: আশ্বমেধিক পর্ব/১১৮/৫-৮ ] অনুবাদঃ বৈশম্পায়ন বলিলেন—কৃষ্ণোক্ত এইরূপ সত্য ও পুণ্যজনক বাক্য শুনে অত্যন্ত অদ্ভুক্ত হবে এমন ভেবে প্রফুল্ল হয়ে সকল দেবর্ষি, ব্রহ্মর্ষি, গন্ধৰ্ব্ব, অপসরা, ভূত, যক্ষ, গ্রহ, গুহক, নাগ, মহাত্মা যোগী ও তত্ত্বদর্শী বালখিল্য ও দিনের মধ্যে পাঁচটী সময়ে ভগবানের উপাসক সাধুগণ কৌতুকযুক্ত হয়ে উত্তম বৈষ্ণবধৰ্ম্ম শুনার ইচ্ছা করে মস্তক অবনত করে কৃষ্ণকে নমস্কার করলেন॥ ভগবান শুধু আমাদের ভারতভূমীর জন্য ধর্ম সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হন নি, তিনি স্বয়ং এ শাশ্বত সনাতন ধর্মের রক্ষা করছেন। শ্রীমদ্ভগবদগীতায় সে কথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে- ত্বমক্ষরং পরমং বেদিতব্যং ত্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্। ত্বমব্যয়ঃ শাশ্বতধর্মগোপ্তা সনাতনস্ত্বং পুরুষো মতো মে।। [ গীতা ১১।১৮ ] অনুবাদ: তুমি পরম ব্রহ্ম এবং একমাত্র জ্ঞাতব্য। তুমি বিশ্বের পরম আশ্রয়। তুমি অব্যয়, সনাতন ধর্মের রক্ষক এবং সনাতন পরম পুরুষ। এই আমার অভিমত। কেউ হয়তো দাবী করতে পারে, বৈষ্ণব যদি ধর্ম হয়, তবে শৈব, শাক্ত, গাণপত্য কিংবা সৌরাদি অন্যান্য মতও এক একটা ধর্ম। কিন্তু তাদের এ দাবী সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। শৈব ধর্ম, শাক্তধর্ম, গাণপত্য ধর্ম কিংবা সৌর ধর্ম বলে কোন টার্ম সনাতন ধর্মের কোন প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থে নেই। বাস্তবে বৈষ্ণবমত, শৈবমত, শাক্তমত, গাণপত্যমত ও সৌর মত- এ প্রধান পাঁচটি মত ও অন্যান্য বেদানুগামী মত হলো সনাতন বৈষ্ণবধর্মের শাখা, এগুলো স্বতন্ত্র কোন ধর্ম নয়। তাই এগুলোকে আমরা পঞ্চমত বলি, পঞ্চধর্ম বলি না। এগুলোর সমন্বয়েই সনাতন বৈষ্ণব ধর্ম। পরমেশ্বর ভগবান বিষ্ণু স্বয়ং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, প্রকৃতিমাতা দূর্গাদি দেবতাদের নিজের দেহ হতে প্রকাশ করে এদের দ্বারা সমগ্র সৃষ্টি সৃজন-পালন-লয়-বিনির্মান প্রভৃতি কার্য চালনা করেন। এ সমস্ত দেবতা ভেদে একেক মত, একেক পথ। মহাভারতে বৈষ্ণবধর্ম ব্যাখা করতে গিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তারও ব্যাখা দিয়েছেন- “আমি দেবগণের আদি, আমি ব্ৰহ্মাদি দেবগণকে সৃষ্টি করিয়াছি এবং আমি নিজের প্রকৃতিকে অবলম্বন করিয়া সমগ্র জগৎ সৃষ্টি করিয়া থাকি। আমি ব্রহ্মচর্য্যপ্রভৃতি চারিটী আশ্রমের ধর্ম্মস্বরূপ, চাতুর্হোত্রযজ্ঞের ফল ভোগ করি, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও প্রজাপতি এই চারিটী আমার মূর্তি এবং ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ্য, বানগ্রস্থ ও ভিক্ষু—এই চারিটী আশ্রম আমিই সৃষ্টি করিয়াছি ॥ দেবতা, অসুর, মানুষের সহিত সমগ্র জগৎ এইভাবে আমার থেকে উৎপন্ন হয় এবং আমাতেই লয় পায়।” – [ মহাভারত, আশ্বমেধিক পর্ব, ১১৭।৩৮,৫০,৫৯ ] অতএব স্পষ্টতই, ভারতভূমীর বেদানুগামী সভ্য মনুষ্যের ধর্ম যে সনাতন-বৈষ্ণব ধর্ম, সে কথা ভারতের ইতিহাস মহাভারতে উল্লেখ আছে, গীতাতে উল্লেখ আছে, সর্বোপরি পবিত্র বেদেও আমাদের বৈষ্ণব হওয়ারই নির্দেশ দিয়েছে। পবিত্র বেদে বলছে- বৈষ্ণবমসি বিষ্ণবে ত্বা। – [ শুক্ল যজুর্বেদ ৫।২১ ] -(হে মনুষ্য), তোমার পরিচয় তুমি বৈষ্ণব, বিষ্ণুর প্রীতির জন্য তোমাকে নিযুক্ত করছি। বিষ্ণোনুকং বীর্যাণি প্র বোচং যঃ পার্থিবানি বিমমে রজাংসি যো অস্কভায়দুত্তরং সধস্থং বিচক্রমাণস্ত্রেধোরগায়ো বিষ্ণবে ত্বা৷৷ – [ শুক্ল যজুর্বেদ ৫।১৮]

শঙ্করাচার্য্যের একদন্ডী সন্ন্যাস

65761176_2401646736821034_5156774499944759296_n

(A reply to a smārta Brahmin who objected to Prabhupada’s commentary) শঙ্করাচার্য্যের আবির্ভাবের পূর্বে সমস্ত ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ও জৈন মতের বিস্তার এতো ব্যাপক হয়েছিলো বৈদিকধর্ম লুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। প্রকৃত বর্ণাশ্রম ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে কপট আশ্রমধর্ম প্রচলিত হয়েছিলো। যেহেতু বৌদ্ধ-জৈনগণ বেদকে অস্বীকার করেন, তাই তাদের সন্ন্যাস বৈদিকি সন্ন্যাস নয়, তা ছল-সন্ন্যাস। এমনকি তারা বেদোক্ত ত্রিদন্ড কিংবা একদন্ড-ও ধারণ করেন না। এমন সময়ে ভারতভূমিতে শ্রীপাদ শঙ্করাচার্য্যের আবির্ভাব ঘটে, যিনি একদন্ডী সন্ন্যাস পুনঃপ্রবর্তন করেন। শঙ্করাচার্য্যের পরম্পরা হলো: নারায়ণ > বশিষ্ট >পরাশর> বেদব্যাস > ছায়া শুকদেব > গৌড়পাদ > গোবিন্দপাদ> শঙ্করাচার্য্য। এ পরম্পরাটি সন্ন্যাস পরম্পরা নয়। শঙ্করাচার্য্য গোবিন্দপাদের নিকট হতে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন নি। এমনকি শঙ্করাচার্য্যের পূর্বে এ পরম্পরাতে কোন অবিচ্ছিন্ন সন্ন্যাস পরম্পরাই ছিলো না। বশিষ্ট, পরাশর,বেদব্যাস, ছায়া শুকদেবাদি কেউই সন্ন্যাসী ছিলেন না। বশিষ্ট, পরাশর, বেদব্যাস সকলেই গৃহস্থ ছিলেন। গৌড়পাদের গুরু ছায়াশুকও গৃহস্থ । গৌড়পাদের শিষ্য গোবিন্দপাদের চার বর্ণের চারটি পত্নী ছিলো, তার বড় ছেলের নাম শবর, শবরের বড় পুত্র ‘কুমার ভট্ট’ বিখ্যাত স্মার্ত পন্ডিত। গৌড়পাদ ও গোবিন্দপাদ উভয়ই প্রচ্ছন্ন বুদ্ধমতের প্রচারক। অনেকে ভেবে থাকেন, শঙ্করাচার্য্য গোবিন্দপাদের নিকট সন্ন্যাস নিয়েছিলেন, কিন্তু তা ভুল ধারণা। সায়ানাচার্য্য রচিত শঙ্করাচার্য্যের প্রামাণিক জীবনীগ্রন্থ ‘শঙ্কর দিগ্বিজয়’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, শঙ্করাচার্য্য মাতৃ বাক্যদন্ডে (গুরু হতে সন্ন্যাস গ্রহণ ব্যতীত-ই) নিজে নিজে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। প্রমাণ: শঙ্কর তার মাতাকে বললেন- ” এক্ষণে আপানার করিয়া অনুমতি হইলেই তদণ্ডে আমি সমস্ত ত্যাগ চতুর্থাশ্রম গ্রহণ করিতে প্রস্তুত আছি। এইরূপে বালক শঙ্কর স্পষ্ট করিয়া মনের ভাব প্রকাশ করিবার পর, তদীয় জননী পুত্রের সন্ন্যাস গ্রহণে সত্বর অনুমোদন প্রকাশ করিলেন। শীঘ্র অনুমোদন করিবার কারণ এই যে, যদি পুত্র জীবিত থাকে, তবেই তাহার দর্শন পাইতে পারিব। কিন্তু পুত্রের মৃত্যু হইলে আর এই দুরদৃষ্টে পুত্র দর্শন খড়িয়। উঠিবে না।মাতার অনুমতি হইবার পর শঙ্কর তৎক্ষণাৎ মনে মনে সংন্ন্যাস ধৰ্ম্ম গ্রহণ করিলেন।” – (শঙ্কর দিগ্বিজয়, ৫।৬৫-৬৭) গোবিন্দপাদের সাথে সাক্ষাৎ এর পূর্বেই তিনি একদন্ড গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ, গোবিন্দ পাদ থেকে তিনি সন্ন্যাস নেন নি, সুতরাং, স্পষ্টত, তার কোন সন্ন্যাস গুরু নেই। প্রমাণ: “যাহাদিগের আচরণ অত্যন্ত কুৎসিত, সেই সমস্ত অসৎপথাব্লম্বী লোকদিগকে দণ্ডিত করিবার জন্য জগদগুরু শঙ্কর, বাদীগণের উৎপীড়নে একান্ত কৃশাঙ্গী, প্রাচীন বেদবাণীকে অদ্বৈতপথে স্থাপন করিয়া এক দণ্ড গ্রহণ করিলেন। বস্তুতঃ অধার্ম্মিক, বেদবিদ্বেষ্টা, উন্মার্গ গামী লোক দিগকে শাসন করিবার নিমিত্তই তাঁহার দণ্ড গ্রহণ হইয়াছিল।” – (শঙ্কর দিগ্বিজয়, ৫।৮৮) “নবীন, রঞ্জিতবস্ত্র পরিধান করিয়া দন্ডধর শঙ্কর চন্দ্রহহিতা নর্ম্মদা নদীর তটনিকটস্থ গোবিন্দনাথের কাননে প্রবেশ করিলেন।” – (শঙ্কর দিগ্বিজয়, ৫।৯০) পরবর্তীকালে শঙ্করাচার্য্য দশনামী একদন্ডী সন্ন্যাস পরম্পরা প্রবর্তন করেছিলেন এবং ভারতের ৪ স্থানে ৪টি মঠ স্থাপন করেছিলেন। পদ্মপুরাণ, গরুড়পুরাণ, বরাহপুরাণে উল্লেখ আছে, শ্রীহরির অনুপ্রেরণায় শঙ্করাচার্য্য ‘মায়াবাদ’ প্রচার করেছিলেন, ‘মায়াবাদং অসৎ শাস্ত্রং…'(পদ্মপুরাণ,উত্তরখন্ড,১৩৬।৭-১২) ইত্যাদি ব্যাস বাক্য তার প্রমাণ। তাই এ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাস ‘মায়াবাদী সন্ন্যাস’ বলে খ্যাত। মায়াবাদমসচ্ছাস্ত্রং প্রচ্ছন্নং বৌদ্ধমুচ্যতে।। ময়ৈব কথিতং দেবী কলৌ ব্রাহ্মণরূপিণা। অপার্থং শ্রুতিবাক্যানাং দর্শয়ল্লোকগর্হিতম্।। কর্মস্বরূপত্যাজ্যত্বমত্র বৈ প্রতিপাদ্যতে। সর্বকর্মপরিভ্রষ্টং বৈধর্ম্যত্বং তদুচ্যতে।। পরেশজীবয়োরৈক্যং ময়া তু প্রতিপাদ্যতে। ব্রহ্মণোঽস্যস্বয়ং রূপং নির্গুণং বক্ষ্যতে ময়া।।‌ সর্বস্য জগতোঽপ্যত্র মোহনার্থং কলৌ যুগে। বেদার্থবন্মহাশাস্ত্রং মায়য়া যদবৈদিকম্।। ময়ৈব রক্ষ্যতে দেবী জগতাং নাশকারণাৎ। তচ্চাসুরাণাং মোহনার্থং ভগবত এবাজ্ঞয়েতি।। [পদ্মপুরাণ: উত্তরখন্ড/১৩৬।৭-১২ ] অনুবাদ: মহাদেব বলেছেন, “হে দেবী! প্রচ্ছন্ন বুদ্ধমতাবলম্বী মায়াবাদ নামে যে অসৎ শাস্ত্র রয়েছে তা কলিকালে আমিই ব্রাহ্মণমূর্ত্তিতে বলি। আমি শ্রুতিবাক্যের অন্য অর্থ করি ও কর্মকান্ড ত্যাগ করার কথা বলি, তাই একে বিধর্ম্ম বলা হয়। পরমেশ্বর ও জীবের ঐক্য প্রতিপাদন করি ও ব্রহ্ম এর রূপ কে আমি নির্গুণ বলে প্রচার করি, এই সব ই এই জগতকে মোহনের জন্য। হে দেবী মহাশাস্ত্র বেদান্তেও যে অবৈদিক মায়া কল্পনা করেছি তা জগতের নাশের নিমিত্ত। আমি অসুর দের মোহিত করার জন্য ভগবানের আজ্ঞায় এই রূপ অসৎ শাস্ত্র রচনা করি। [ উল্লেখ্য, অধিকাংশ বৈষ্ণব সন্ন্যাসীগণ ত্রিদন্ড ধারণ করেন বিধায় ত্রিদন্ডী সন্ন্যাসকে ‘বৈষ্ণব সন্ন্যাস’ বলা হয়।] সিদ্ধান্ত: শাস্ত্রে প্রাচীনকালে একদন্ডী সন্ন্যাসের কথা থাকলেও তা দ্বাপরান্তে লুপ্তি পায়। কলির প্রারম্ভে বিষ্ণুর মাহামোহাবতার বুদ্ধ ও জিন কর্তৃক ভারতে বৈদিকধর্ম লুপ্ত হয়ে কপট আশ্রম ধর্ম ছড়িয়ে পড়ায় বৈদিক আশ্রম ধর্ম বিলুপ্ত হয়েছিলো। শঙ্করাচার্য্য তখন পুনরায় একদন্ডী সন্ন্যাস প্রবর্তন করেন। কলিকালে শঙ্করাচার্য্য কর্তৃক প্রবর্তিত দশনামী একদন্ডী সন্ন্যাসকে ‘মায়াবাদী সন্ন্যাস’ বলা হয়। কারণ, তা শঙ্করাচার্য্যের মায়াবাদ সিদ্ধান্ত দ্বারা দুষ্ট হয়। শঙ্কর পরবর্তী এ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীগণ শঙ্কর অনুকরণে মায়াবাদ প্রচার করেছেন। অর্থাৎ, কলিকালে শঙ্করাচার্য্য প্রবর্তিত যে একদন্ডী মায়াবাদী সন্ন্যাস (দশনামী সন্ন্যাস) তা প্রাচীন বৈদিক গুরুপরম্পরা ধারায় প্রাপ্ত সন্ন্যাস নয়। তা শঙ্করাচার্য্যের স্বয়ং প্রবর্তিত। প্রাচীনকাল হতে ভারতভূমিতে বৈষ্ণব পরমহংসগণের ত্রিদন্ড সন্ন্যাস ব্যবস্থা চালু ছিলো। দ্বাপরের অন্তকালে শ্রীমদ্ভাগবতমেও একাদশ স্কন্দে উদ্ধবকে শ্রীকৃষ্ণ ত্রিদন্ড সন্ন্যাস সম্পর্কে জ্ঞান দিয়েছিলেন, যার থেকে স্পষ্ট সেকালে ত্রিদন্ড সন্ন্যাসের প্রচলিত ছিলো। অনেক মায়াবাদী স্মার্ত দাবী করেন, ত্রিদণ্ডী সন্ন্যাসের উল্লেখ কেবল পুরাণেই পাওয়া যায়, বেদে-স্মৃতিতে এর উল্লেখ নেই। তাদের ধারণা ভ্রান্ত! বেদ-স্মৃতি-পুরাণের বহুস্থানে ত্রিদন্ডী সন্ন্যাসের উল্লেখ আছে। শুক্লযজুর্বেদীয় জাবালোপনিষদ ১৮ নং মন্ত্র, শাঠ্যায়নীয়োপনিষদের ৭-১১ নং মন্ত্রসমূহে, হারীতস্মৃতি ৬/৬,২৩ শ্লোকসমূহে, লিখিতস্মৃতি ২২ নং শ্লোকে, দক্ষসংহিতা ১।১৩,৩০ নং শ্লোকসমূহে এবং শ্রীমদ্ভাগবতমাদি ব্যাস রচিত মহাপুরাণসমূহে ত্রিদন্ডী বৈষ্ণব সন্ন্যাসের উল্লেখ আছে। শ্রীল প্রভুপাদও তাঁর শ্রীমদ্ভাগবতমের ৪র্থ স্কন্দের ভাষ্যে সেটিই ব্যক্ত করেছেন- “Since time immemorial, the sannyāsa order has carried the tridaṇḍa. Later Śaṅkarācārya introduced the ekadaṇḍi-sannyāsa. A tridaṇḍi-sannyāsī is a Vaiṣṇava sannyāsī, and an ekadaṇḍi-sannyāsī is a Māyāvādī sannyāsī. There are many other types of sannyāsīs, who are not approved by Vedic retuals.” Points to be noted: ১) এখানে ভাগবতম ভাষ্য শ্রীল প্রভুপাদ বলছেন, অনাদিকাল হতে সন্ন্যাস আশ্রমীরা ‘ত্রিদণ্ড’ ধারণ করে আসছেন। (যা শ্রীমদ্ভাগবতমের ১১ স্কন্দেও শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকে ত্রিদণ্ড সন্ন্যাস উপদেশ করেছিলেন তাতেও প্রমাণিত)৷ প্রভুপাদ এখানে বলেন নি যে পূর্বে একদন্ডী বৈদিক সন্ন্যাস ছিলো না। ২) অত:পর ‘Later’ শব্দ দ্বারা প্রভুপাদ কলিকালকে নির্দেশ করে বলেছেন, কলিকালে শঙ্করাচার্য্য একদণ্ডী সন্ন্যাস প্রবর্তন করেছেন। এ বাক্য ‘একদণ্ড’ দ্বারা শ্রীল প্রভুপাদ ইঙ্গিত করেছেন শঙ্করাচার্য্যের নিজের প্রবর্তিত ‘একদণ্ডী মায়াবাদী সন্ন্যাস’কে, যেটি দশনামী সন্ন্যাস নামে পরিচিত। শ্রীল প্রভুপাদ পরের বাক্যেই ‘ekadaṇḍi-sannyāsī is a Māyāvādī sannyāsī’ -দ্বারা তা স্পষ্ট করেছেন। শঙ্করাচার্য্য প্রবর্তিত এ একদণ্ডী সন্ন্যাসীরা যারা শঙ্করাচার্য্যের মায়াবাদকে আশ্রয় করে তা প্রচার করেছেন, তারাই মায়াবাদী সন্ন্যাসী নামে পরিচিত হয়।

গরুড়পুরাণে জগতগুরু শ্রী মধ্বাচার্য্যের আবির্ভাবের ভবিষ্যবাণী!!!

417497069_418343777429381_3086906520898948062_n

গরুড়পুরাণে জগতগুরু শ্রী মধ্বাচার্য্যের আবির্ভাবের ভবিষ্যবাণী!!! শ্রী গরুড়মহাপুরাণে স্বয়ং পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ গরুড়দেবের নিকট উল্লেখ করেছেন, কলিকালে ব্যোম বায়ুদেব মধ্বাচার্য্য রূপে আবির্ভূত হবেন। শ্রীমন্মধ্বাচার্য্যের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিলো বাসুদেব। দীক্ষার পর তিনি ‘মধ্ব’ নামে জগতে বিখ্যাত হন। মধ্বাচার্য্য সম্পর্কিত শ্রীকৃষ্ণের ভবিষ্যৎবাণী- मणिमान्नम दैत्यस्त संकराख्यो भविष्यति ॥ सर्वेषां संकरं यस्तु करिष्यति न संशयः ॥ ७० ॥ तेन संकरनामासी भविष्यति खगेश्वर ॥ धर्मान्भागवतान्सर्वान्विनाशयति सर्वथा ॥ ७१ ॥ तदा भूमौ वासुदेवो भविष्यति न संशयः ॥ यज्ञौर्थैः सदृशो यस्य नास्ति लोके चतुर्दशे ॥ ७२ ॥ [গরুড় মহাপুরাণ, ব্রহ্মখন্ড, অধ্যায় ১৬, শ্লোক ৭০-৭২ ] বঙ্গানুবাদ: শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “কলিকালে মণিমান নামের এক দৈত্য সংকরাচার্য্য রূপে অবতীর্ণ হবেন এবং বিনা সংকোচে সমস্ত শাস্ত্রসিদ্ধান্ত দূষিত করবে। হে পক্ষীরাজ! এ জন্য তার নাম হবে সংকর। ভবিষ্যত যুগে (কলিযুগে) শংকরাচার্য্য অসৎশাস্ত্র প্রচার করে ভাগবতধর্ম কে আচ্ছাদিত করে ফেলবেন। তখন বায়ুদেব ‘বাসুদেব’ (মধ্বাচার্য্যের) রূপে প্রকট হয়ে বিনা দ্বিধায় সে সব মিথ্যাচারকে খন্ডন করে বিশুদ্ধ ভাগবত ধর্ম কে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন। চতুর্দশ ভুবনে এমন কেউ থাকবে না যিনি মধ্বাচার্য্যের সমতুল্য হবেন অথবা তার যুক্তিকে খন্ডন করতে পারেন। “A demon named Manimān will be born as one called Sankara, who will, without doubt, pollute everything. This is why, O king of birds, his name will be Sankara; he will pollute and destroy all Bhāgavata Dharmas. Then (Vāyu) will, without doubt, come into being as ‘Vasudeva’; there will be none in the fourteen worlds to match him. lie will truly be in perfect wisdom. [ বিখ্যাত NEW BHARATIYA BOOK CORPORATION, New Chandrawal (Near Shiva Mandir), Jawahar Nagar, Tamil Nadu, India প্রেস হতে ছাপানো গরুড় মহাপুরাণের সংস্কৃত এডিশান ] বন্দে গুরু পরম্পরা!!! মধ্ব-গৌড়ীয় পরম্পরা!!! জয় বৈষ্ণব পরম্পরা!!! ।। হরে কৃষ্ণ।।