বেদ শাস্ত্রে গরু/গোহত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে কি?!
আজকাল কিছু অসনাতনী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার করছে যে বেদে নাকি গরু বা গো হত্যার করার বিধান দেয়া হয়েছে। তাদের কথা শুনলে আমাদের হাসি পাই।কারন তারা কখনো বেদ অধ্যয়ন না করে বেদ নিয়ে মিথ্যা অপপ্রচার করে সাধারন সনাতনীদের বিভ্রান্ত করছে। প্রকৃতপক্ষে বেদে বহুবার গো পালন করতে উপদেশ দেয়া হয়েছে, এবং সাথে সাথে গোহত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে।তাই সনাতনী সমাজে পন্ডিতগন দ্বারা অনাদিকাল থেকে গোহত্যা এবং গোমাংস ভোজনকে মহাপাপ রুপে সম্পূর্ণভাবে নিষেধ করা হয়েছে। গোহত্যা যে মহাপাপ এ সম্পর্কে ব্রহ্ম-মধ্ব-গৌড়িয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের একজন মহান আচার্য শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেন, “গো অঙ্গে যত লোম,তত সহস্র বৎসর। গোবধী রৌরব মধ্যে পচে নিরন্তর।।” – (চৈ. চঃ আদি.১৭/১৬৬) অনুবাদ: গরুর দেহে যত লোম আছে তত হাজার বছর গোহত্যাকারী রৌরব নামক নরকে অকল্পনীয় দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করবে। আসুন আমরা বেদ শাস্ত্র থেকে গোহত্যা করার নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে জানার চেষ্ঠা করি: বেদের বর্ণনায় গরু /গোহত্যা নিষেধ: “অনাগো হত্যা বৈ ভীমা কৃতো মা নো গাম অশ্বম পুরুষং বধী” অনুবাদ: নির্দোষের হত্যা অবশ্যই ভয়ানক।গরু, অশ্ব এবং মনুষ্যকে হত্যা করো না। – (অথর্ববেদ ১০/১/২৯) “গোঘাতম ক্ষেত্রে যঃ গাম বিকৃন্তন্তম” অনুবাদ: গো ঘাতক অথাৎ গো হত্যাকারী, যিনি ক্ষুধার জন্য গরুকে হত্যা করে,তাকে ছেদন করো। – (শুক্ল যজুর্বেদ ৩০/১৮) आ॒रे ते॑ गो॒घ्नमु॒त पू॑रुष॒घ्नं “আরে তে গোদনমুত পুরুষঘ্নম।” অনুবাদ: গরু বা গো হত্যাকারী ও নরহত্যাকারী দূর হও। – (ঋকবেদ ১/১১৪/১০) “গাং মা হিংসীরদিতিং বিরাজম” অনুবাদ: গরু অদিতি, তা বধের অযোগ্য, তাকে হিংসা কর না। – (শুক্ল যজুর্বেদ ১৩/৪৩) “ঘৃত দুহ্যনামদিতিং জনায়াগ্নে মা হিংসীঃ পর মে ব্যোমন।” অনুবাদ: মানুষকে যে ঘৃত দান করে তার নাম অদিতি,সে কারনে তাকে ( গাভী) হত্যা করো না। – (শুক্ল যজুর্বেদ ১৩/৪৬) प्र नु वो॑चं चिकि॒तुषे॒ जना॑य॒ मा गामना॑गा॒मदि॑तिं वधिष्ट ॥ “প্র নু বোচং চিকিতুষে জনায় মা গামনাগামমদিতিং মা বধিষ্ট।।” অনুবাদ: আমি বিবেকবান মনুষ্যের প্রতি এই উপদেশ দিই যে, নিরাপরাধ গরু এবং ( অনাগমং) অসীম গুনে সমৃদ্ধ গাভীকে হত্যা করো না (অদিতিং মা )। – (ঋকবেদ ৮/১০১/১৫) ।।হরে কৃষ্ণ।। ।।প্রনাম।। – সদগুন মাধব দাস
শ্রীমদ্ভাগবতে কেন “স্ত্রী, শুদ্রের বেদের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নেই” বলা হয়েছে?!
ইদানীং কিছু আর্য নামধারী পাষণ্ডী অমল পুরাণ শ্রীমদ্ভাগবতসহ অষ্টাদশ পুরাণের অমল ভাষ্য হৃদয়ঙ্গম করতে না পেরে জনসমাজে এর নিন্দা ও মিথ্যাচার করছে। এ পর্বে আমরা এই পাষণ্ডীদের মিথ্যাচারের জবাব দেব। প্রতিপক্ষের দাবিঃ শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের ১/৪/২৫ শ্লোকে বলা হয়েছে — স্ত্রী, শূদ্র এবং দ্বিজোচিত গুণাবলীবিহীন ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভূত মানুষদের বেদের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম( বুঝার) করার ক্ষমতা নেই, তাই তাদের প্রতি কৃপাপরাবশ হয়ে মহর্ষি বেদব্যাস মহাভারত নামক ইতিহাস রচনা করলেন, যাতে তারা তাদের জীবনের পরম উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পারে। তাই, এখানে নারী ও শুদ্রের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে শ্রীমদ্ভাগবত তাদের বেদাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। খণ্ডণঃ উক্ত দাবি খণ্ডণে আমরা এই লেখণীকে দুইভাগে বিভক্ত করবো। প্রথম ভাগে নারীদের বেদাধিকার প্রসঙ্গে এবং দ্বিতীয়ভাগে শুদ্রের বেদাধিকার প্রসঙ্গে আলোচনা করা হবে। স্ত্রীজাতির বেদাধিকারঃ ♦ জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।। – (রামায়ণ- ৬/১২৪/১৭) মমতাময়ী মাতৃমণ্ডলী কোমলতায়, ভালোবাসায়, স্নেহে, যত্নে, ধৈর্যে, আত্মত্যাগে বরাবরই অতুলনীয়। আমাদের সকলেরই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় মায়ের কাছ থেকে। তাই তাঁদের চরণে প্রণাম রেখেই এই আলোচনা শুরু করছি। প্রথমেই উক্ত শ্লোকের শব্দের অন্বয় ও শব্দার্থ দেখে নিব। ♦ “স্ত্রীশূদ্রদ্বিজবন্ধূনাং ত্রয়ী ন শ্রুতিগোচরা। কর্মশ্রেয়সি মূঢ়ানাং শ্রেয় এবং ভবেদিহ। ইতি ভারতমাখ্যানং কৃপয়া মুনিনা কৃতম্।।” শব্দার্থ: স্ত্রী– স্ত্রী জাতি, শূদ্র– শ্রমিক শ্রেণী, দ্বিজ বন্ধূনাম– দ্বিজোচিত গুণাবলীবিহীন দ্বিজকুলোদ্ভূত মানুষ, ত্রয়ী– তিন, ন– না, শ্রুতিগোচরা– বোধগম্য, কর্ম– কার্যকলাপে, শ্রেয়সি-কল্যান সাধনে, মূঢ়ানাম-মূর্খদের, শ্রেয়ঃ-পরম কল্যাণ, এবম-এইভাবে, ভবেৎ– প্রাপ্ত হয়, ইহ– এটির দ্বারা, ইতি– এইভাবে বিবেচনা করে, ভারতম– মহাভারত, আখ্যানম– ঐতিহাসিক তথ্য, কৃপয়াঃ– কৃপাপূর্বক, মুনিনা– মুনির দ্বারা, কৃতম– রচিত হয়েছিল। অনুবাদ: স্ত্রী, শূদ্র এবং দ্বিজোচিত গুণাবলীবিহীন ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভূত মানুষদের বেদের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম( বুঝার) করার ক্ষমতা নেই,তাই তাদের প্রতি কৃপাপরাবশ হয়ে মহর্ষি বেদব্যাস মহাভারত নামক ইতিহাস রচনা করলেন,যাতে তারা তাদের জীবনের পরম উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পারে। শ্রীমদ্ভাগবতের এই শ্লোকে ‘স্ত্রী’ অর্থে একজন সাধারণ স্ত্রী ‘র বৈশিষ্ঠ্যই গ্রহণ করতে হবে। কেননা শ্রীমদ্ভাগবতাদি অষ্টাদশ পুরাণে, মহাভারতে এমন অনেক উত্তমা স্ত্রীদের কথা উল্লেখ পাওয়া যায় যারা বেদাদি শাস্ত্র অধ্যয়ন এবং অধ্যাপনা করতেন। অষ্টাদশ পুরাণ ও ইতিহাস গ্রন্থে নারীদের বেদাদি শাস্ত্র অধ্যয়নের প্রমাণঃ শ্রীমদ্ভাগতে ৪/১/৬৪ শ্লোকে ব্রহ্মবাদিনী কন্যা’র উল্লেখ করা হয়েছে ♦ “তেভ্যো দধার কন্যে দ্বে বয়ুনাং ধারিনীং স্বধা। উভে তে ব্রহ্মবাদিন্যৌ জ্ঞানবিজ্ঞানপারগে।।” – [শ্রীমদ্ভাগবত ৪/১/৬৪] অনুবাদ: স্বধা, তারঁ বয়ুনা এবং ধারিনী নামক দুটি কন্যা হয়।তারাঁ উভয়েই ছিলেন ব্রহ্মবাদিনী এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞানে পারদর্শী। ♦ “তেভ্যঃস্বধা সুতে জজ্ঞে মেনাং বৈ ধারিনীং তথা। তে উভে ব্রহ্মবাদিনৌ যোগিন্যাবপ্যুভে দ্বিজ।।” – বিষ্ণুপুরান ১/১০/১৯ অনুবাদ: তাদের দ্বারা মেনা এবং ধারিনী নামক দুই কন্যা উৎপন্ন করেন। তাঁরা দুই জনেই উত্তম জ্ঞান এবং সর্বগুণসম্পন্না,ব্রহ্মবাদিনী ও যোগিনী ছিলেন। বিষ্ণপুরানের এ শ্লোকে ব্রহ্মবাদিনী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে,যার অর্থ হল বেদ সম্পর্কে যারা আলোচনা করেন।ব্রহ্মা থেকে জাত প্রজাপতি দক্ষের কন্যা হল স্বধা। এই স্বধার কন্যা হল মেনা বা বয়ুনা এবং ধারিণী।তারা উভয়ই বেদ জ্ঞানে অভিজ্ঞ ছিল, যার কারনে তারা বেদ নিয়ে আলোচনা করতেন। ♦ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে এক নারীর কথা বলা হয়েছে, যিনি ছিলেন কুশধ্বজ এবং মালাবতীর কন্যা। তিনি অনর্গল বেদমন্ত্র পাঠ করতে পারতেন। ♦ “সততং মীর্তিমন্তশ্চ বেদাশ্চত্বার এব চ। সন্তি যস্যাশ্চ জিহ্বাগ্রে সা চ বেদবতী স্মৃতা।।” – [ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, প্রকৃতিখন্ড, ১৪/৬৫] অনুবাদ: এই পূণ্য পাপনাশক পবিত্র আখ্যান তোমাকে বলিলাম।মূর্ত্তিমান বেদচতুষ্টয় তাঁহার জিহ্বাগ্রে সতত স্ফুরিত হওয়ায়, তিনি বেদবতী বলিয়া উক্ত হইয়াছে। ♦ মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে ১২৪তম অধ্যায়ে (হরিসিদ্ধান্তবাগীশকৃত) ‘বিদুলা’ নামে এক নারীর উল্লেখ পাওয়া যায় যিনি বেদাদি বহু শাস্ত্রে পারঙ্গত ছিলেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ইতিহাসে নারীদের অবদানঃ অধ্যাপিকা ঊমা বন্দোপাধ্যার রচিত “গোড়ীয় বৈষ্ণব নারী” নাম্নী একটি বই রয়েছে যেখানে তিনি ১০০ জনেরও বেশি নারীদের উল্লেখ করেছেন যারা গৌড়ীয় ইতিহাসে অসামান্য অবদান রেখেছেন। এখানে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের নাম দেওয়া হলো- জাহ্নবা দেবী(শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর পত্নী) সীতাদেবী(শ্রীঅদ্বৈত আচার্যের পত্নী ) চৈতন্য মহাপ্রভুর বরিষ্ঠ পার্ষদরা অপ্রকটের পর এই দুজন বৈষ্ণবী গৌড়ীয় ধারার প্রচার ও প্রসারে নেতৃত্ব প্রদান করেন। গৌরাঙ্গপ্রিয়া দেবী(শ্রীনিবাস আচার্য্যের পত্নী) হেমলতা /কৃষ্ণপ্রিয়া ঠাকুরাণী(শ্রীনিবাস আচার্য্যের কন্যা) তিনি একজন সহজিয়া ভাগবত পাঠক “রূপ কবিরাজ”-কে শাস্ত্রার্থ করে পরাজিত করে তার সহজিয়া সিদ্ধান্ত প্রচার বন্ধ করেন। এছাড়াও হেমলতা ঠাকুরাণী একজন আচার্যানীর ভূমিকা পালন করেন ও বহু শিষ্য গ্রহণ করেন। জাহ্ণবাদেবীর পুত্রবধু সুভদ্রা দেবী (অনঙ্গকদম্বাবলী নামে শতক কাব্য রচনা করেন) ইসকনে নারীদের গায়ত্রী দীক্ষা ও আচার্যানীর ভূমিকাঃ *আপনারা নিশ্চয় সকলে অবগত আছেন যে, ইসকনে নারীদের গায়ত্রী দীক্ষা দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে ১৯৬৮ সালের ১১ই অগাস্ট মন্ট্রিলে দেওয়া দীক্ষানুষ্ঠানে শ্রীল প্রভুপাদের দেওয়া প্রবচন থেকে প্রাসঙ্গিক অংশটুকু আপনাদের সামনে তুলে ধরছি– So then this is the beginning of initiation, and those who have chanted at least for one year, then the next initiation is to offer him Gāyatrī mantra. Some of the students, boys and girls, will be offered this Gāyatrī mantra. And when the Gāyatrī mantra is offered men, they are offered also sacred thread, and girls, they are not offered sacred thread. If their husband is a brāhmaṇa, she automatically becomes brāhmaṇa, because wife is considered to be the half, better half. She is the better portion. So she automatically becomes better brāhmaṇa. [laughter] So better brāhmaṇa does not require any thread. Reference: Initiations and Gāyatrī of Devotees এছাড়া কিছুদিন আগে একজন নারী আচার্যপদে অভিষিক্ত হয়েছেন এবং শিষ্য গ্রহণ করা শুরু করেছেন। ২০২২সালের ১৯শে অগাস্ট জন্মাষ্ঠমী তিথিতে শ্রীমত্যা নারায়ণী দেবী দাসী দীক্ষাগুরুরুপে প্রথম শিষ্যা গ্রহণ করেন। এবার প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে শ্রীল প্রভুপাদ কেন শ্রীমদ্ভাগবতের উক্ত শ্লোকের তাৎপর্যে নারীদের বেদপাঠ নিষেধ বা তাদের অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন বললেন?! মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাঃ শুনতে অপ্রিয় হলেও সত্য যে, সাধারণত স্ত্রীজাতি শৃঙ্গার, কৌতুক, সাংসারিক গল্প ইত্যাদিতেই মেতে থাকতে পছন্দ করেন। এবং এটা যে নতুন কোন তথ্য নয় তা আপনারা সবাই জানেন। আধ্যাত্মিকথার কথা নাই বা বললাম, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও নারীদের নিয়ে বিভিন্ন জনপ্রিয় কৌতুক ভিডিও রয়েছে। যেমন বর্তমানে জনপ্রিয় ট্রেন্ডিং ফানি ভিডিও “Women” দেখেন নাই এমন নেটিজেন কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। তাই এই বিষয়টি একটি “Open Secret” ও বলা যেতে পারে। আজকে নারীরা একাডেমিক পড়াশুনা, চাকরী এমনকি কোন কোন দেশ পরিচালনা করছেন। এক্ষেত্রে তাদের সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করা যদিও বেমানান মনে হতে পারে কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বুদ্ধির চেয়ে আবেগের দ্বারা তাড়িত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। শ্রীল প্রভুপাদ তাই শ্রীমদ্ভাগবতের উক্ত শ্লোকের তাৎপর্যে এমন সাধারণ বৈশিষ্ঠ্য সম্পন্ন ‘স্ত্রী’জাতির কথাই বলেছেন, উত্তমা স্ত্রীদের কথা নয়। এবং স্বাভাবিকভাবেই এরা উন্নততর দর্শন আলোচনার চাইতে গল্প/উপাখ্যান শ্রবণ/অধ্যয়ন করতে বেশি উৎসাহী। এখানে আলোচ্য শ্লোকে “ন শ্রুতিগোচরা” মানে এই নয় যে, তাদের কানে বেদের বাণী প্রবেশ করে না। বরং তারা শুনলেও তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে না এমনটাই বুঝিয়েছে। আর তাই শ্রীল ব্যাসদেবও তাদের সেই স্বাভাবিক আচরণের কথা মাথায় রেখেই রামায়ণ, মহাভারত আদি ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছেন, যাতে তারা তা শ্রবণে এবং অধ্যয়নে আগ্রহী হয়। এবং পরবর্তীতে কোন তত্ত্বদ্রষ্টা
প্রাচীন গুরুকূল শিক্ষাব্যবস্থা ও সরস্বতী পূজা
█▒▒▒ প্রাচীন গুরুকূল শিক্ষাব্যবস্থা ও সরস্বতী পূজা ▒▒▒█ ‘ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে’ (न हि ज्ञानेन सदृशं पवित्रमिह विद्यते।) (গীতা ৪।৩৮) অর্থাৎ, ‘জ্ঞানের মতো পবিত্র বস্তু আর নেই।’ কে জ্ঞান লাভের অধিকারী?! গীতায় ভগবান বলছেন, ‘শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ’ (श्रद्धावाँल्लभते ज्ञानं तत्परः संयतेन्द्रियः।) (গীতা ৪।৩৯) অর্থাৎ ‘যার ইন্দ্রিয় সংযত ও যিনি জ্ঞান অর্জনের প্রতি শ্রদ্ধাবান, তিনিই জ্ঞান লাভ করেন।’ বস্তুতই অসংযত ইন্দ্রিয় ব্যক্তির নিকট জ্ঞান জীবজগতের ক্ষতির কারণ। তাই প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা ‘গুণ-বিচারিক’ মানদন্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো। এ পুণ্যভূমির প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো ‘গুরুকূল’ কেন্দ্রিক। গুরুকূলগুলোতে বিদ্যা অর্জনের জন্য কে ধনীর ছেলে আর কে দরিদ্রের ছেলে তা নিয়ে বৈষম্য যাতে না হয়, তাই গুরুকূলে প্রবেশের দিন হতেই বিদ্যার্থীদের সকলের পারিবার প্রদত্ত বস্ত্র অলঙ্কার খুলে নিয়ে দেওয়া হতো ব্রহ্মচারী বস্ত্র, সকলে এক আশ্রমে থাকতো, একই খাবার ভক্ষণ করতো, একই কায়দায় বিদ্যার্জন করতো। এভাবে গুরুকূলে সকল বিদ্যার্থীর মধ্যে সমতা আনায়ন হতো। দরিদ্রের ছেলে নিজেকে হীন ভাবতো না, ধনীর ছেলেরও আরাম আয়েশ ভোগ করে অহংকার প্রদর্শনের সুযোগ থাকতো না। গুরুকূলে বিদ্যাগ্রহণের অধিকার সমাজের সকলেরই ছিলো, কিন্তু কে কতটুকু বিদ্যা লাভ করতে পারবে তা ছিলো যোগ্যতা অর্জন সাপেক্ষে। অসংযত ইন্দ্রিয় ও অশ্রদ্ধাবান ব্যক্তি বিদ্যালাভের অযোগ্য। তাই গুরুকূলগুলোতে বিদ্যালাভের পূর্বে বিদ্যার্থীদের গুণবিচার করা হতো। মহাভারতের শান্তিপর্বে এর বর্ণনা আছে। গুরু বিদ্যাভিলাষী ব্যক্তির গুণবিচার করে দেখতেন- এ বালক আদৌ বিদ্যালাভের জন্য যথেষ্ট উপযোগী নাকি বিদ্যালম্ভের পূর্বে এর আরো কিছু আচরণগত সুসংস্কার লাভের প্রয়োজন। যদি বিদ্যার্থী অভিলাষীর আচরণগত পারিবারিক সুসংস্কার গ্রহণযোগ্য হতো, তবে তাকে গুরুকূলে ‘আশ্রিত’ করা হতো। আর যাদের আচরণগত-ব্যবহারিক-পারিবারিক সুসংস্কার থাকতো না, তাদের ‘আকাঙ্ক্ষী’ হিসেবে গণ্য করে পরিবারের কাছে পারিবারিক শিক্ষার জন্য পাঠানো হতো এবং এরা নিয়মিত গুরুকূলের সাধু সন্ন্যাসীদের সান্নিগ্ধ্যে যাতায়াত করে আচার-আচরণ শিখতো। যারা ‘আশ্রিত’ শ্রেণীর বিদ্যাভিলাষী তারা ১ বছর যাবত গুরুকূলে স্থায়ীভাবে থেকে গুরুকে পর্যবেক্ষণ করতো, গুরুও তাদের পর্যবেক্ষণ করতো। এভাবে গুরু শিষ্যকে এবং শিষ্য গুরুকে ১ বছর যাবত পর্যবেক্ষণ করে যদি নিশ্চিত হতো এ গুরু সদগুরু এবং এ শিষ্য সদশিষ্য, তবেই গুরু তাকে উপনয়ন সংস্কার প্রদান করে গুরুকূলের স্থায়ী শিষ্য করতেন এবং তখন থেকে শিষ্যরা ‘ব্রহ্মচারী’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতেন। গুরুকূলে সকল শিক্ষার্থীকে ৬৪ কলা (বিদ্যা) প্রাথমিক জ্ঞান দেওয়া হতো। গুরুকূলে কেবল বেদবিদ্যা কিংবা অস্ত্রবিদ্যার শিক্ষা হতো তা নয়, এখানে সংগীত, নৃত্য, রন্ধন, কৃষি প্রভৃতি সমস্ত প্রকার বিদ্যারই শিক্ষা দেওয়া হতো। কারণ জীবনের কখন যে কোন বিদ্যার প্রয়োজন হয়, তা তো বিধাতা বৈ কেউ জানে না। তাই অজ্ঞাতবাসে ভীমের পক্ষে রন্ধনশালার প্রধান রাধুনি, অর্জুনের পক্ষে নৃত্যশিল্পী, নকুল-সহদেবের পক্ষে অশ্বশালা-হস্তিশালা সামলানোর দায়িত্ব পালন কিংবা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ব্রাহ্মণ দ্রোণাচার্য্য-কৃপাচার্যের দেশরক্ষায় অস্ত্রধারণ, কর্ণের রথের সারথিত মৃত্যু হলে শল্যরাজের পক্ষে কর্ণের সারথির দায়িত্ব পালনও কঠিন কিছু ছিলো না। যখন প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হতো, তখন স্বভাব ও গুণানুসারে চয়ন করা হতো কোন বিদ্যার্থীকে কোন বিদ্যায় উচ্চ (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) পর্যায়ের জ্ঞান দেওয়া হবে। মহাভারত পাঠে আমরা জানতে পারি, দ্রোণাচার্য্য শিক্ষার্থীদের পক্ষীর চক্ষু বিদীর্ণের পরীক্ষা নিয়ে চয়ন করেছিলেন অর্জুনাদি শিষ্যদের তিনি ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী করবেন, ভীম-দুর্যোধনাদি শিষ্যদের গদা চালন বিদ্যা, যুধিষ্ঠীরাদিকে নীতিবিদ্যায় পারদর্শী করবেন। মোদ্দা কথা, গুণ বিচার না করে কোন বিদ্যাই প্রদান করা হতো না। কিছু উদাহরণ দেখা যাক। বেদব্যাসী মহাভারতের শান্তিপর্বের প্রথম দুই অধ্যায়ে উল্লেখ আছে, সুতপুত্র কর্ণ পান্ডব-কৌরবদের সাথেই গুরু দ্রোণের গুরুকূলে অস্ত্রশিক্ষা করতেন। কিন্তু অর্জুনের সাথে পারদর্শীতায় পেরে উঠছিলেন না তিনি। অস্ত্র চালনার পারদর্শিতা হেতু অর্জুন বহু দুর্লভ অস্ত্র দ্রোণাচার্য্যের নিকট হতে আগে আগে লাভ করে ফেলতো । কিন্তু কর্ণ তা লাভ করতে পারায় ঈর্ষাণ্বিত হতো এবং একদিন তিনি দ্রোণাচার্য্যের নিকট গিয়ে ব্রহ্মাস্ত্র লাভের বাসনা করেন। অর্জুনের প্রতি কর্ণের ঈর্ষাপরায়ণতা বুঝতে পেরে দ্রোণাচার্য্য তাকে ব্রহ্মাস্ত্রের জ্ঞান দান করতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে কর্ণ গুরুকূল ত্যাগ করে এবং মিথ্যা পরিচয় দিয়ে পরশুরামের নিকট ব্রহ্মাস্ত্রাদি লাভ করে। কিন্তু ঈর্ষাপরায়ণতার জন্য তিনি অধর্মের সঙ্গ করে জগত বিধ্বংসে দুর্যোধনকে সাহায্য করতে থাকে। মিথ্যাচারে প্রাপ্ত অস্ত্রবিদ্যা জীবনের শেষ সময়ে সে বিস্মৃত হয় এবং করুণ মৃত্যু লাভ করেন। এ ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, গুরুকূলে গুণবিচারে শিক্ষাব্যবস্থার যথার্থতা। আরেকটি উপাখ্যান বলি। মহাভারতের শান্তিপর্বেই বর্ণিত আছে তা। নিষাদকুলের একলব্য অস্ত্রবিদ্যা লাভ করতে আসলেও একলব্যের মধ্যে আচরণগত ত্রুটি থাকায় গুণবিচারপূর্বক দ্রোণাচার্য্য তাকে অস্ত্রশিক্ষা দেন নি । কিন্তু একলব্য লুকিয়ে লুকিয়ে অস্ত্রশিক্ষা করতো এবং একদিন অর্জুনের নিকট ধরা পড়ে যায় একলব্য। যেহেতু একলব্য শত্রুরাষ্ট্র মগধের বাসিন্দা ছিলো তাই রাজকুমারদের সাময়িক শিক্ষার উপর গোপণ নজরদারীর অপরাধে একলব্যকে হস্তিনাপুরের শাসনতন্ত্র ‘মৃত্যুদন্ড’ দিতো। কিন্তু গুরু তো উদার হন, আকাশ হতেও মহান। যেহেতু একলব্য পূর্বেই দ্রোণাচার্য্যকে মনে মনে আপন গুরু করে নিয়েছেন তাই তাকে রক্ষার জন্য দ্রোণাচার্য্য এক সুন্দর কর্ম করলেন। চাতুরী করে বললেন, তার দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে গুরুদক্ষিণা দিতে। এতে একলব্য পান্ডব-কৌরবদের গুরুভাই হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে এবং মৃত্যুদন্ড হতে রক্ষা পায়। দ্রোণাচার্য্য গুরুদক্ষিণা চাওয়া মাত্র একলব্য তার বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদান করেন গুরুর চরণে। গুরু দ্রোণাচার্য্য এভাবে একলব্যের শ্রদ্ধা ও ইন্দ্রিয় সংযমত্বের পরীক্ষা নেন এবং একলব্য উত্তীর্ণ হন। তাই দ্রোণাচার্য্য একলব্যকে অস্ত্রবিদ্যা দানের জন্য মনস্থিত করলেন এবং রৈবত পর্বতে গিয়ে তিনি একলব্যকে অস্ত্রবিদ্যার জ্ঞান দিতেন। একলব্য দক্ষিণ হস্তের মধ্যমা-তর্জনী দ্বারা অদ্ভুদ কায়দায় অস্ত্রচালনা কৌশল রপ্ত করেছিলেন এবং পরবর্তীতে মগদ রাজ জরাসন্ধের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ উপাখ্যান ব্যাসদেবের শিষ্য শ্রীমধ্বাচার্য্যেকৃত ‘মহাভারত তাৎপর্য নির্ণয়’ ভাষ্যে বর্ণিত আছে। এভাবে গুরুকূলে শিক্ষা লাভ করে যোগ্যতা অনুসারে শিষ্যের কর্ম নির্ধারিত হতো। স্নাতক পাস করা এসব শিষ্যদের গুণ-কর্মে বর্ণ নির্ধারিত হতো। ফলে সমাজের কারো সুযোগ থাকতো না জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের ভিত্তিতে কারো নিন্দা করার। কয়েকটি উদাহরণ দেখা যাক। রামায়ণে দেখা যায়, মন্ত্রী সুমন্ত্র ছিলেন সুতবংশের, তথাপি তিনি দশরথের গুরুকূলের মিত্র, উপদেষ্টা এবং অযোধ্যার প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। বিদূরের জন্ম ছিলো দাসীর গর্ভে কিন্তু ভীষ্মদেবের নিকট শিক্ষা অর্জন করে তিনি হস্তিনাপুরের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, আজও বিদূরনীতি সমাজে সুপ্রসিদ্ধ। দ্রোণাচার্য্যের ছেলে অশ্বত্থমা ব্রাহ্মণকূলে জন্মেও ক্ষত্রিয় রাজা হয়েছিলেন। এমন উদাহরণ বহু দেওয়া যায়। এবার নারীশিক্ষার ব্যাপারে কিছু বলা যাক। অনেকেই ভেবে থাকেন, প্রাচীন ভারতে নারীশিক্ষা বুঝি উপেক্ষিত ছিলো। কিন্তু এ ধারণা অমূলক। বৃহদারণ্যক উপনিষদে নারী পন্ডিত ‘গার্গি’র কথা জানা যায় যিনি যাজ্ঞবল্ক্যের সাথে শাস্ত্রার্থ করেছিলেন। শুধুমাত্র ঋকবেদেই প্রায় ৩০ জন বিদূষী নারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ঘোশা, অপালা, লোপামুদ্রা, বিশ্ববারা, নিবাবরী, জুহু, কদ্রু, পৌলমী প্রভৃতি বৈদিক যুগের নারীদের কথা জানা যায়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বেদবতীর কথা জানা যায়, যার জিহ্বা হতে বেদ মন্ত্র অনবরত উচ্চারিত হতো। বাল্মীকি রামায়ণেও কৌশল্যাকে এবং শ্রীমদ্ভাগবতমে কশ্যপ মুনির পত্নী দিতিকে মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক অগ্নিযজ্ঞ করতে দেখা যায়। জ্ঞানের পীঠস্থলী মিথিলায় ছিলো নারী শিক্ষার জন্য বিখ্যাত ছিলো। পাঞ্চালের রাজা দ্রুপদ কর্তৃক তার কণ্যা শিখন্ডীকে অস্ত্রশিক্ষার ব্যবস্থার কথা মহাভারতে জানা যায়। মহাভারতের যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সময়ে ভারতে নারীশিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটে। অদ্বৈত আচার্য্যের পত্নী সীতাঠাকুরাণী, নিত্যানন্দ প্রভুর পত্নী জাহ্নবা ঠাকুরাণী, শ্রীনিবাস আচার্যের দ্বিতীয় স্ত্রী গৌরাঙ্গপ্রিয়া দেবী
বাংলাভাষা বিশ্বায়নে শ্রীল প্রভুপাদের অবদান
বাংলাভাষা বিশ্বায়নে শ্রীল প্রভুপাদের অবদান পৃথিবীতে বর্তমানে প্রচলিত সহস্রাধিক ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধ একটি ভাষা। বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জনগণের মাতৃভাষা বাংলা। মাতৃভাষায় কথা বলার জন্য পৃথিবীতে একমাত্র বাঙালিদেরই প্রাণ বিসর্জনের ইতিহাস রয়েছে। সেই রক্তাক্ত ইতিহাস স্মরণে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে সারা বিশ্বে পালিত হয়। অগণিত কবি-সাহিত্যিকের ক্ষুরধার লেখনীতে বাংলা ভাষার সাহিত্য ভাণ্ডারও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র প্রেমধর্মের প্রচারক ও সমাজ সংস্কারক শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩খ্রি.)। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং ভক্তভাব অঙ্গীকার করে বঙ্গভূমিতে আর্বিভূত হন। সমাজ যখন জাতিভেদ, বর্ণভেদ প্রথার কষাঘাতে জর্জরিত, তখন বৈদিক সাম্যবাদের বাণী প্রচার করে তিনি এক বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের পথ প্রদর্শন করেন। তাঁর প্রচারিত বৈষ্ণবদর্শন সমাজে অহিংসা, প্রেম, মৈত্রী, সাম্য ও শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করে। তাঁর অমিয় চরিতগাঁথা সকলকে এমনভাবে আকৃষ্ট করে যে, বাংলা সাহিত্যে তাঁকে নিয়ে এক নবযুগের সূচনা হয়, যা ‘চৈতন্যযুগ’ (১৫০০-১৭০০ খ্রি.) নামে প্রসিদ্ধ। তাঁকে কেন্দ্র করেই শ্রীলোচন দাস ঠাকুর কর্তৃক রচিত হয়েছিল ‘চৈতন্যমঙ্গল’ নামে বাংলা সাহিত্যের প্রথম জীবনীগ্রন্থ। এরপর একে একে মুরারীগুপ্তের কড়চা, বৃন্দাবন দাস ঠাকুর রচিত শ্রীচৈতন্যভাগবত, নরহরি সরকার ঠাকুরের শ্রীভক্তিরত্নাকর, নরোত্তম দাস ঠাকুর বিরচিত বাংলা গীতাবলিসহ অন্যান্য বৈষ্ণবকবিগণের রচিত বিভিন্ন পদ্যাবলি ও ভক্তিগীতি। চৈতন্যদেব সম্পর্কিত যত গ্রন্থ রয়েছে, তার মধ্যে শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী কর্তৃক রচিত ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থটি বিশেষ সমাদৃত এবং তা বাংলা সহিত্যের জীবনীগ্রন্থগুলোর অন্যতম। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, “পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম। সর্বত্র প্রচার হইবে মোর নাম॥” শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর এই বাণীর সার্থক রূপকার আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও আচার্য কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ। তিনি ছিলেন একজন বাঙালি সন্ন্যাসী। বাঙালির সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষাকে তিনি বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন। শ্রীল প্রভুপাদ ৭০ বছর বয়সে বিশ্বব্যাপী মহাপ্রভুর দর্শন প্রচারের নিমিত্তে আমেরিকায় পাড়ি জমান। সেখানেই এক নতুন আধ্যাত্মিক বিপ্লবের শুভারম্ভ হয়, যার মূল উপকরণ ছিল শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, শ্রীমদ্ভাগবত ও শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের দর্শন। শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীচৈতন্যদেবের দর্শন ও তাঁর জীবনী গ্রন্থ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। শ্রীল প্রভুপাদের অনূদিত এই গ্রন্থ বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষার এক বিপ্লব সৃষ্টি করে। বর্তমানে পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই বললেই চলে যেখানে শ্রীচৈতন্যদেবের আদর্শ ও শিক্ষা প্রচারিত হচ্ছে না। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের পদ্যসুধা আস্বাদনের জন্য বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ভাষার মানুষ বাংলা ভাষা শিক্ষার অনুশীলন করতে শুরু করছে। বাংলায় মহাপ্রভুর শিক্ষা ও অপ্রাকৃত জীবনদর্শন উপলব্ধি করে তারা তাদের জীবনধারা পরিবর্তন করছে। শ্রীল প্রভুপাদ কর্তৃক ইংরেজি অনুবাদের পরবর্তীকালে তাঁর শিষ্যগণ জার্মান, ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ানসহ বিভিন্ন ভাষায় বাংলা সাহিত্যের অনন্য কীর্তি শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের অনুবাদ করেন। শুধু শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতই নয়, মহাপ্রভুর জীবনাদর্শ নিয়ে রচিত অন্যান্য গ্রন্থ এবং শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের গ্রন্থাবলিসহ অসংখ্য বাংলা গ্রন্থ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। বাংলা ভাষার এত সমৃদ্ধ সাহিত্যভাণ্ডার বিশ্ববাসীকে এমন বিমুগ্ধ করেছে, যার ফলে তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে ও বাংলা ভাষা অনুশীলন করছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ছয়শোরও অধিক ইস্কন মন্দিরে সকাল-সন্ধ্যা আরতি-কীর্তনসমূহ বাংলা ভাষায় গাওয়া হয়। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ নির্বিশেষে সকলেই সেই কীর্তন গাইছে, আনন্দে নৃত্য করছে ও বাংলায় বিরচিত ভজন ও গ্রন্থাবলি থেকে পাঠ করে তা শ্রবণ করছে। এভাবে প্রতিনিয়ত তারা বাংলা ভাষার ব্যবহার করছে। তাই বাংলা ভাষা আজ বিশ্বজুড়ে সগৌরবে স্বমহিমায় বিরাজ করছে। ২০১৫ সালে কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে শ্রীল প্রভুপাদের পাশ্চাত্য যাত্রার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশ্বের ১০৫টি দেশের ভক্তবৃন্দ সমবেতভাবে বৈষ্ণবকবি নরোত্তম দাস ঠাকুর কর্তৃক বাংলা ভাষায় রচিত গুরুবন্দনা ‘শ্রীগুরুচরণপদ্ম’ পরিবেশন করে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড-এ স্থান করে নেয়। বাংলা ভাষার বিশ্বায়নে ইস্কনের এই উদ্যোগ এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ভাষা ও সংস্কৃতি একটি জাতির অস্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত। বাংলা ভাষা এমনই এক ভাষা, যে ভাষা বহু কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও লেখকের লেখনীতে সমৃদ্ধ হয়েছে। বাঙালি জাতির এ এক অনন্য সৌভাগ্য যে, পরমেশ্বর শ্রীচৈতন্যদেব এই বঙ্গভূমিতে জন্মগ্রহণ করে বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির গরিমা বৃদ্ধি করেছেন। আজ তারই দর্শন শ্রীল প্রভুপাদ কর্তৃক প্রচারিত হয়েছে। যার কারণে আজ বাংলা ভাষা পৃথিবীব্যাপী অগণিত মানুষের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষার মহিমা আরো ছড়িয়ে পড়ুক এই হোক আমাদের প্রত্যাশা। ।।হরেকৃষ্ণ।। – অক্ষয়লীলা মাধব দাস
গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের মন্ত্র পরম্পরা
গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের মন্ত্র পরম্পরা রূপানুগ গৌড়ীয় বৈষ্ণবের শ্রীগুরুপরম্পরাতে একসাথে রয়েছে মন্ত্রদীক্ষা পরম্পরা এবং ভাগবত শিক্ষাপরম্পরা। সম্পূর্ণ গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের প্রধান প্রধান আচার্যগণকে একটি ক্রমবদ্ধ ধারায় প্রকাশ এবং বংশানুক্রমিক গুরুপারম্পর্য খণ্ডন করে এই ভাগবত পরম্পরা অনবদ্যভাবে একটি আদর্শ গুরুপ্রণালী উপস্থাপন করছে। প্রতিটি প্রাচীন পরম্পরাই ভাগবত পরম্পরা। পূর্বে আচার্য শংকর কর্তৃক প্রদর্শিত পরম্পরা, শ্রীসম্প্রদায়ে আলোয়াড় পরম্পরা, ব্যাস-মধ্ব পরম্পরা প্রভৃতির কোনটিই সম্পূর্ণ মন্ত্রপরম্পরা নয়। মন্ত্র গুরু ও শিক্ষাগুরু ভিন্ন হতেই পারেন। গৌড়ীয় সম্প্রদায়ে সখ্যরসভুক্ত শ্রীল হৃদয়চৈতন্য প্রভুর মন্ত্রশিষ্য শ্রীল শ্যামানন্দ প্রভু মাধুর্যরসে শ্রীরূপমঞ্জরীর অনুগত। যাই হোক এই প্রবন্ধে সংক্ষেপে ভাগবত পরম্পরার আচার্যবর্গের মন্ত্রদীক্ষা ও শিক্ষা বর্ণনা করা হল। এই শিক্ষা পরম্পরা আলোচনা করলে খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায়- ভাগবত পরম্পরা সর্বৈব সঠিক ও যুক্তিযুক্ত। শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী প্রভুপাদ যুক্তিগ্রাহ্য ভাবে এই ভাগবত পরম্পরা প্রকাশ করেছিলেন। গৌড়ীয় পরম্পরা ১) স্বয়ং ভগবান শ্রীগৌরসুন্দর মহাপ্রভু: • মন্ত্রদীক্ষা ও শিক্ষা অভিনয় : শ্রীল ঈশ্বরপুরী (মাধবেন্দ্রপুরীর শিষ্য) • মন্ত্র : দশাক্ষরী মন্ত্র • সন্ন্যাস সংস্কার : শ্রীল কেশব ভারতী • সন্ন্যাস নাম : শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ২) শ্রীল স্বরূপ দামোদর গোস্বামী : • পূর্বনাম : শ্রীপুরুষোত্তম আচার্য • মন্ত্রদীক্ষা : অজ্ঞাত • শিক্ষা : শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। • বেশ : বারাণসীতে চৈতন্যানন্দের কাছ থেকে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। কিন্তু যোগপট্ট ধারণ করেননি। মহাপণ্ডিত, রসাচার্য এই স্বরূপ দামোদরের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ছাড়া কোন রচনা মহাপ্রভুকে নিবেদন করা হত না। ৩) শ্রীল রূপ গোস্বামী এবং শ্রীল সনাতন গোস্বামী : • দীক্ষা : সনাতন গোস্বামীর গুরু বিদ্যাবাচস্পতি । রূপ গোস্বামী সনাতনের শিষ্য ছিলেন। • শিক্ষা : শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু • মহাপ্রভুর প্রদত্ত নাম : “রূপ” ও “সনাতন” • বেশ : শ্রীরূপ সনাতন প্রমুখ গোস্বামীগণ মহাপ্রভুর অনুমোদনেই শ্বেত বহির্বাস ধারণ করেন। এই বেশ পরবর্তীতে “বাবাজী” বেশ বলে পরিচিত হয়। আসলে এটি প্রচ্ছন্ন সন্ন্যাস বেশ। “গোস্বামী” উপাধিটিও সন্ন্যাস উপাধি। শ্রীরূপ গোস্বামী হলেন সর্বপ্রধান গৌড়ীয় রসাচার্য। জগতে তিনিই প্রচার করে চৈতন্যমনোভিষ্ট পূরণ করেন। শ্রীরূপ স্বরূপের প্রত্যক্ষ কৃপাপ্রাপ্ত। ৪। শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামী • মন্ত্রদীক্ষা : শ্রীঅদ্বৈত প্রভুর শিষ্য শ্রীল যদুনন্দন আচার্য। • শিক্ষা : শ্রীল স্বরূপ দামোদর গোস্বামী এবং শ্রীরূপ-সনাতন। ৫। শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী : • দীক্ষা : জানা যায় না। • শিক্ষা : শ্রীরূপাদি ষড় গোস্বামী। • বেশ : জানা যায় না। • নিত্য ব্রজলীলায় তিনি শ্রীললিতার যূথে শ্রীরূপমঞ্জরীর অনুগতা কস্তুরিকা মঞ্জরী। তিনি অষ্টমঞ্জরীর অন্যতমা। কবিরাজ গোস্বামী শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের প্রায় প্রতিটি পরিচ্ছেদের ভণিতায় “রূপ-রঘুনাথ”-এর শ্রীচরণে কৃপা প্রার্থনা করেছেন। তাঁর ভাই যখন শ্রীল মীনকেতন রামদাসের চরণে অপরাধ করেন, তখন শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি গৃহত্যাগ করে ব্রজে গমন করেন। ৬৷ শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর মহাশয় : • মন্ত্র দীক্ষা : শ্রীল লোকনাথ গোস্বামী • মন্ত্রপরম্পরা : শ্রী অদ্বৈত আচার্য প্রভু > শ্রীল লোকনাথ গোস্বামী > শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর। • ভাগবত শিক্ষা : শ্রীল জীব গোস্বামী প্রভু • বেশ : অজ্ঞাত • শ্রীল রূপ গোস্বামীই তাঁর গুরুরূপা সখী। এ সম্পর্কে বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি তাঁর পদে বারবার শ্রীরূপের চরণাব্জে সমর্পিত হতে চেয়েছেন। ৭)শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর : • মন্ত্রদীক্ষা : শ্রীল রাধারমণ চক্রবর্তী • মন্ত্রপরম্পরা : শ্রীল নরোত্তম > শ্রীল গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তী > শ্রীল কৃষ্ণচরণ চক্রবর্তী > শ্রীল রাধারমণ চক্রবর্তী > শ্রীল চক্রবর্তীপাদ। • শিক্ষা : শ্রীল নরোত্তম ঠাকুরের পরম্পরাসূত্রে শ্রীল কৃষ্ণচরণ চক্রবর্তীর কাছে। • বেশ : শ্রীহরিবল্লভ দাস নামে ইনি বিরক্তবেশ গ্রহণ করেন। ৮। শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ : • মন্ত্রদীক্ষা : শ্রীল রাধাদামোদর দেব গোস্বামী • মন্ত্রপরম্পরা : শ্রীল গৌরসুন্দর, নিত্যানন্দ প্রভু > শ্রীল হৃদয়চৈতন্য প্রভু > শ্রীল শ্যামানন্দ প্রভু > শ্রীল রসিকানন্দ প্রভু > শ্রীল রসিকানন্দের প্রশিষ্য শ্রীল রাধাদামোদর দেব > শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ। • ভাগবত শিক্ষা : কিছুকাল রাধাদামোদর দেবের কাছে শিক্ষা করেন। পরবর্তীতে শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুরের নিকটে ভাগবত শিক্ষা নেন। • বেশ : বিদ্যাভূষণ প্রভু বেশ নিয়ে “একান্তী গোবিন্দ দাস” নামে পরিচিত হন। তিনি বেদান্তসূত্রের “গোবিন্দ ভাষ্য” রচনা করেন। ইহা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বেদান্তভাষ্য। ৯। শ্রীল জগন্নাথ দাস বাবাজি : • মন্ত্রদীক্ষা : অনেকে বলেন বৃন্দাবনের শৃঙ্গারবটের জগদানন্দ গোস্বামী। জগদানন্দ গোস্বামীর বেশগুরু ছিলেন গোবর্ধনের কৃষ্ণদাস বাবাজি। কিন্তু দৈনিক নদীয়া প্রকাশ, ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২ অনুসারে নিতাইবংশের রাসবিহারী গোস্বামী ছিলেন তাঁর পাঞ্চরাত্রিকী গুরু। • বেশ : গোবর্ধনের সূর্যকুণ্ড নিবাসী শ্রীল মধুসূদন দাস বাবাজি ছিলেন এনার বেশগুরু। • বেশ পরম্পরা : শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ > শ্রীল উদ্ধবদাস বাবাজি > শ্রীল মধুসূদন দাস বাবাজি > শ্রীল জগন্নাথ দাস বাবাজি • ভজন : বাবাজি মহারাজ দীর্ঘকাল সূর্যকুণ্ডে নিজ বেশগুরুর শিক্ষায় ভজন করেছেন। পরবর্তীতে কোলদ্বীপ (বর্তমান শহর নবদ্বীপে) এসে অবস্থান করেন। সেখানে তাঁর সমাধি আছে। ১০৷ শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর : • মন্ত্রদীক্ষা : শ্রীবংশীবদনানন্দের পুত্র রামাই পণ্ডিতের বংশের বিপিনবিহারী গোস্বামী। এনার পাট বাঘনাপাড়ায়। • মন্ত্রপরম্পরা : ঈশ্বরী জাহ্ণবী > রামচন্দ্র > রাজবল্লভ > কেশবচন্দ্র > রুদ্রেশ্বর > দয়ারাম > মহেশ্বরী গোস্বামিনী > গুণমঞ্জরী গোস্বামিনী > যজ্ঞেশ্বর > বিপিনবিহারী গোস্বামী > ঠাকুর ভক্তিবিনোদ • ভজনশিক্ষা : শ্রীল জগন্নাথ দাস বাবাজি। • বেশ : অপ্রকটের কিছু পূর্বে শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজির কাছে বেশ প্রার্থনা করেন। বাবাজি মহারাজের নির্দেশে শ্রীল জগন্নাথ দাস বাবাজির প্রসাদী ডোর কৌপীন গ্রহণ করেন। ১১৷ শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজি : • মন্ত্রদীক্ষা : অদ্বৈত বংশীয় নিমাইচাঁদ গোস্বামী। • মন্ত্রপরম্পরা : মাধবেন্দ্রপুরী > অদ্বৈত প্রভু > শ্রীকৃষ্ণমিশ্র > দোলগোবিন্দ (শ্রীপাট উথলী) > গোপীনাথ > রাধাগোবিন্দ > কেশব > শুকদেব > রাধারমণ > নিমাইচাঁদ গোস্বামী > গৌরকিশোর বাবাজি > প্রভুপাদ ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী। • বেশ : শ্রীল ভাগবত দাস বাবাজি • বেশ পরম্পরা : শ্রীল জগন্নাথ দাস বাবাজি> শ্রীল ভাগবত দাস বাবাজি > শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজি। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর এবং সিদ্ধ গৌরকিশোর বাবা পরস্পর পরস্পরকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। ঠাকুর মহাশয় ছিলেন বাবাজি মহারাজের বেশগুরুর সতীর্থ। ১২৷ শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী প্রভুপাদ : • মন্ত্রদীক্ষা : শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজি। • মন্ত্রপরম্পরা : গৌরকিশোর বাবার পরম্পরা • বেশ : ত্রিদন্ড বৈষ্ণব সন্ন্যাস • বেশ পরম্পরা : “ভক্তিসিদ্ধান্ত বৈভব” গ্রন্থ মতে উপযুক্ত সন্ন্যাস গুরুর অভাবে নিজ মন্ত্রগুরুর আলেখ্য সমীপে শ্রীগান্ধর্বিকা গিরিধারীকে সাক্ষী রেখে কাষায় বস্ত্র ধারণ করেন। শ্রীরামানুজাচার্যও বরদবিষ্ণুকে সাক্ষী রেখে ত্রিদন্ড ও যতিবেশ ধারণ করেন। এই বিষয়ে বিস্তারিত কথা এই পেজে যথাসময়ে প্রকাশিত হবে।
“কুরুক্ষেত্রের মহিমা” কোন বেদে বর্ণিত আছে?!
শ্রীল প্রভুপাদ কেন বলেছিলেন “বেদে কুরুক্ষেত্রের মহিমা বর্ণিত আছে”? শ্রীল অভয়চরণারভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ তাঁর ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ’র ১/১ শ্লোকের ভাষ্যে বলেছেন “বেদে বলা হয়েছে, কুরুক্ষেত্র হচ্ছে অতি পবিত্র স্থান, যা দেবতারাও পূজা করে থাকেন।” এখন, এই কথাটা তিনি কেন বললেন?! এটা সত্য নাকি মিথ্যা?! এ নিয়ে একদল শেয়াল পণ্ডিত উপহাস করছে যে, এমন কথা নাকি বেদের কোথাও লেখা নাই। প্রতিপক্ষের এমন দাবি আজকে খণ্ডণ করা হবে। এই আর্টিকেলে যা যা থাকছে — প্রভুপাদ ছাড়া এমন কথা আর কেউ কি বলেনি?! বেদের কোথায় কুরুক্ষেত্রের মহিমা উল্লেখ আছে?! স্মৃতিশাস্ত্র ও ইতিহাস গ্রন্থে কোথায় কুরুক্ষেত্রের মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে?! প্রথমেই দেখবো শ্রীল প্রভুপাদ ছাড়া আর কে কে এই ধরণের কথা বলেছেন: বাংলাতে অন্যতম জনপ্রিয় শ্রীজগদীশ চন্দ্র ঘোষ ও ঊপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাদের উক্ত শ্লোকের ভাষ্যে একই কথা স্বীকার করেছেন। নিচে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ভাষ্যটি হুবুহু তুলে ধরা হলো— কুরুক্ষেত্র একটি চক্র বা জনপদ। ঐ চক্র এখনকার স্থানেশ্বর বা থানেশ্বর নগরের দক্ষিণবর্তী। আম্বালা নগর হইতে উহা ১৫ ক্রোশ দক্ষিণ। পানিপাট হইতে উহা ২০ ক্রোশ উত্তর। কুরুক্ষেত্র ও পানিপাট ভারতবর্ষের যুদ্ধক্ষেত্র, ভারতের ভাগ্য অনেক বার ঐ ক্ষেত্রে নিষ্পত্তি পাইয়াছে। “ক্ষেত্র” নাম শুনিয়া ভরসা করি, কেহ একখানি মাঠ বুঝিবেন না। কুরুক্ষেত্র প্রাচীন কালেই পঞ্চ যোজন দৈর্ঘ্যে এবং পঞ্চ যোজন প্রন্থে। এই জন্য উহাকে সমন্তপঞ্চক বলা যাইত। চক্রের সীমা এখন আরও বাড়িয়া গিয়াছে। কুরু নামে এক জন চন্দ্রবংশীয় রাজা ছিলেন। তাঁহা হইতেই এই চক্রের নাম কুরুক্ষেত্র হইয়াছে। তিনি দুর্য্যোধনাদির ও পাণ্ডবদিগের পূর্ব্বপুরুষ; এজন্য দুর্য্যোধনাদিকে কৌরব বলা হয়, এবং কখন কখন পাণ্ডবদিগকেও বলা হয়। তিনি এই স্থানে তপস্যা করিয়া বর লাভ করিয়াছিলেন, এই জন্য ইহার নাম কুরুক্ষেত্র। মহাভারতে কথিত হইয়াছে যে, তাঁহার তপস্যার কারণেই উহা পুণ্যতীর্থ। ফলে চিরকালই কুরুক্ষেত্র পুণ্যক্ষেত্র বা ধর্মক্ষেত্র বলিয়া প্রসিদ্ধ। শতপথ ব্রাহ্মণে আছে, “দেবাঃ হ বৈ সত্রং নিষেদুরগ্নিরিন্দ্রঃ সোমো মখো বিষ্ণুর্বিশ্বেদেবা অন্যত্রেবাশ্বিভ্যাম্। তেষাং কুরুক্ষেত্রং দেবযজনমাস। তস্মাদাহুঃ কুরুক্ষেত্রং দেবযজনম্।” অর্থাৎ দেবতারা এইখানে যজ্ঞ করিয়াছিলেন, এজন্য ইহাকে ‘দেবতাদিগের যজ্ঞস্থান’ বলে। মহাভারতের বনপর্ব্বের তীর্থযাত্রা পর্ব্বাধ্যায়ে কথিত হইয়াছে যে, কুরুক্ষেত্র ত্রিলোকীর মধ্যে প্রধান তীর্থ। বনপর্ব্বে কুরুক্ষেত্রের সীমা এইরূপ লেখা আছে-“উত্তরে সরস্বতী, দক্ষিণে দূষদ্বতী; কুরুক্ষেত্র এই উভয় নদীর মধ্যবর্তী।” (৮৩ অধ্যায়) মনুসংহিতায় বিখ্যাত ব্রহ্মাবর্তেরও ঠিক সেই সীমা নিদ্দিষ্ট হইয়াছে।- সরস্বতীদূষদ্বত্যোর্দেবনদ্যোর্যন্তরং। তং দেবনির্মিতং দেশং ব্রহ্মাবর্তং প্রচক্ষতে || ২। ১৭। অতএব, কুরুক্ষেত্র এবং ব্রহ্মাবর্ত একই। কালিদাসের নিম্নলিখিত কবিতাতে তাহাই বুঝা যাইতেছে। ব্রহ্মাবর্তং জনপদমথচ্ছায়য়া গাহমানঃ ক্ষেত্রং ক্ষত্রপ্রঘনপিশুনং কৌরবং তদ্ভজেথাঃ। রাজন্যানাং শিতশরশতৈর্যত্র গাণ্ডীবধন্বা ধারাপাতৈত্ত্বমিব কমলান্যভ্যবর্ষন মুখানি || [মেঘদূত ৪৯] বেদের কোথায় কুরুক্ষেত্রের মহিমা উল্লেখ আছে? উত্তর: শুক্ল যজুর্বেদীয় “জাবাল উপনিষদ” এর প্রথম মন্ত্রে বলা হচ্ছে – “কুরুক্ষেত্রং দেবানাং দেবযজনং” – [শুক্লযজুর্বেদীয়ঃ জাবাল উপনিষদ-১] অর্থাৎ, কুরুক্ষেত্র এতই মহিমান্বিত যে, দেবতারাও এখানে যজ্ঞ করতে আসেন। এছাড়া শুক্লযজুর্বেদীয় “শতপথ ব্রাহ্মণ” থেকে কুরুক্ষেত্রের মহিমা উপরের অংশে দেখানো হয়েছে। স্মৃতিশাস্ত্র ও ইতিহাস গ্রন্থে কোথায় কুরুক্ষেত্রের মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে?! পুরাণ ও মহাভারত আদি ইতিহাস গ্রন্থেও কুরুক্ষত্রের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে আমাদের এই পবিত্র কুরুক্ষেত্রের ইতিহাস জানা দরকার। কুরুক্ষেত্র পূর্বে সমন্তপঞ্চক, ব্রহ্মাবর্ত [মনুসংহিতায় (২/১৭)], ব্রহ্মর্ষিদেশ [মনুসংহিতায় (২/১৯)] ইত্যাদি নামে প্রসিদ্ধ ছিল। পরশুরাম একুশ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করিয়া এই স্থানে পিতৃ-তর্পণ করিয়াছিলেন । দুর্যোধনাদির পূর্বপুরুষ বিখ্যাত কুরু রাজা এই স্থানে হল-চালনা করিয়া এই বর লাভ করিয়াছিলেন যে, যে-ব্যক্তি এই স্থানে তপস্যা করিবে অথবা যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিবে, সে স্বর্গে গমন করিবে । তদবধিই ইহার নাম কুরুক্ষেত্র । প্রাচীন গ্রন্থাদীতে সর্বত্রই কুরুক্ষেত্রকে ধর্মক্ষেত্র বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে । বনপর্বের তীর্থযাত্রা পর্বাধ্যায়ে কুরুক্ষেত্রকে তিন লোকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে; সুতরাং ‘ধর্মক্ষেত্র’ এই বিশেষণটি একান্ত সুসঙ্গত ও প্রয়োজনীয় । সরস্বতী ও দৃষদ্বতী নদীর মধ্যবর্তী প্রদেশ । স্বায়ম্ভূব-মনুর সময়ে এরই নাম ব্রহ্মাবর্ত । পরে নাম হয় সমন্তপঞ্চক। এছাড়াও নিম্নোক্ত শাস্ত্রে কুরুক্ষেত্রের মহিমার উল্লেখ পাওয়া যায়: বামন পুরাণ/কুরুক্ষেত্রমাহাত্ম্য নামক অধ্যায় মহাভারত/শল্যপর্ব/কুরুক্ষেত্রের মাহাত্ম্য কথন মহাভারত/আদিপর্ব/২য় অধ্যায় [হরিসিদ্ধান্তবাগীশ] মহাভারত/বনপর্ব/যুধিষ্ঠিরের তীর্থভ্রমণ [হরিসিদ্ধান্তবাগীশ] অতএব, কুরুক্ষেত্র সম্পর্কে কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ যথার্থই বলেছেন। এবং তাঁর বাক্য যে মোটেও শাস্ত্রবিরুদ্ধ নয় ইহাই প্রমাণিত হলো।
একাদশী করা কি শাস্ত্রসম্মত নয়?!
একাদশী করা কি শাস্ত্রসম্মত নয়?! গীতার ৬/১৬ শ্লোকে কি বলেছে নাকি একাদশী ব্রত থাকা নিষেধ?! একাদশী ব্রত কি অতি অনাহারের মধ্যে পড়ে?! একাদশী ব্রতের নিয়ম জানেন তো?! উপবাসের প্রসঙ্গে কৃষ্ণযজুর্বেদের ১/৬/৭ নং মন্ত্রে বলেছে যারা সামর্থবান তারা নির্জলা উপবাস করবে। এতে অসমর্থ হলে জল পান করবে। শাস্ত্রে আরো বলছে, যারা তাতেও অসমর্থ তারা সাচ্ছন্দে ফল-মূল-কন্দ সবজী গ্রহণ করতে পারবে। শাস্ত্রে একাদশী থাকার থেকে সমস্ত প্রকারের দিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত দিয়েছে। যে যার সামর্থ অনুসারে একাদশী পালন করতে পারবে। “উপবাসে ক্ষুধা বৃদ্ধি পায় এবং ক্ষুধাগ্নি জীবের ক্ষতি সাধন করে । যদি ক্ষুধা অসহনীয় হয় তবে #জলপান করবে। জলপানে ভোজন হয়, আবার হয়না। যজ্ঞ বজ্রসদৃশ, ক্ষুধা মানুষের শত্রু। না খেয়ে উপবাস করলে যজ্ঞরূপ বজ্র তার ক্ষুধারূপ শত্রুকে বিনাশ করে।” [কৃষ্ণযজুর্বেদ, ১/৬/৭] উপবাসাসমৰ্থশ্চ ফলমূলজলং পিবেৎ। নষ্টে শরীরে স ভবেদন্যথা চাত্মঘাতকঃ ॥ ১২ – [শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, ব্রহ্মখন্ড, ২৭।১২] অনুবাদ: উপবাস জন্য শরীর নষ্ট হইলে, আত্মহত্যার পাপ হয়, তাই (নির্জলা) উপবাসে অসমর্থ হইলে, ফলমূল ভোজন ও জল পান করিবেন। কই শাস্ত্রে তো একাদশীতে অতি অনাহার থাকতে বলা হয় নি!!! একাদশী হলো নিয়মিত উপবাস৷ কোন যন্ত্রকে সঠিকভাবে কার্যক্রম রাখতে নির্দিষ্ট সময় পর পর বিরতি দিতে হয়। আমাদের দেহের পাকস্থলী সারা দিনরাত খাদ্য পরিপাকে ব্যস্ত থাকে। তাই মাসে ২ দিন তাকে বিশ্রাম দেওয়া হয়, যাকে আমরা একাদশী বলে চিনি। একাদশী ব্রত থাকলে শরীরের অপ্রয়োজনীয় চর্বি ঝরে যায়, শরীর সতেজ হয়, হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়। অতএব, ফেসবুক কেন্দ্রিক ধর্মচর্চা না করে একটু শাস্ত্র অধ্যয়ন করুন, মন্দিরে যান। যতই ফেসবুক নানা গ্রুপে ঘুরে ঘুরে অনলাইন কেন্দ্রিক ধর্মচর্চা করবেন, তত নিজে বিভ্রান্ত হবেন, সমাজটাকেও পঁচাবেন। পরিশেষে, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন – যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ। ন স সিদ্ধিমবাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম ॥ যে শাস্ত্রবিধি পরিত্যাগ করে কামাচারে বর্তমান থাকে, সে সিদ্ধি, সুখ অথবা পরাগতি লাভ করতে পারে না। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৬।২৩ তস্মাচ্ছাস্ত্রং প্রমাণং তে কার্যাকার্যব্যবস্থিতৌ। জ্ঞাত্বা শাস্ত্রবিধানোক্তং কর্ম কর্তুমিহাইসি॥ অতএব, কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ। অতএব শাস্ত্রীয় বিধানে কথিত হয়েছে যে কর্ম, তা জেনে তুমি সেই কর্ম করতে যোগ্য হও। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৬।২৪ অগণিত শাস্ত্রে বিষ্ণুব্রত একাদশী পালনের নির্দেশ রয়েছে। এই নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। ।।হরে কৃষ্ণ।। সংকলন: নবনীল ঘনশ্যাম দাস লেখার স্বত্ব স্বধর্মম্ কর্তৃক সংরক্ষিত। কেবল স্বধর্মম্ এর স্বত্ব উল্লেখ পূর্বক হুবহু কপি ও লিংক শেয়ারের জন্য অনুমোদিত