অর্ধবেলা উপবাস কি শাস্ত্রীয়?

শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু আমাদের আরাধ্য, তাই কৃষ্ণাষ্টমী ও গৌর পূর্ণিমা ব্রত ইস্কনের সকলেই বাধ্যতামূলক পূর্ণ দিবস করবে। অন্যান্য ব্রত যেমন নৃসিংহ চতুর্দশী, রাম নবমী ইত্যাদি ব্রত কেউ চাইলে পূর্ণ দিবস করতে পারে, কিন্তু তাতে বাধ্যবাধকতা নেই। তবে সকল ভক্ত উৎসবান্ত(আবির্ভাবকাল) পর্যন্ত ব্রত ধারণ করবে। এ বিধান হরিভক্তিবিলাসে গোস্বামীবাক্য সিদ্ধ এবং শ্রী নারদীয় মহাপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, বায়ুপুরাণ সহ অসংখ্য শাস্ত্রে আছে। “কেচিচ্চ ভগবজ্জন্ম মহোৎসব দিনে শুভে । ভক্ত্যোৎসবাস্তে কুৰ্ব্বস্তি বৈষ্ণবা ব্রতপারণম্” ॥৪০৫॥ #অনুবাদ– কেহ কেহ পবিত্র পরম উত্তম ভগবানের জন্ম(আবির্ভাব) মহোৎসব দিনে বৈষ্ণবগণ দাস্য ভক্তিসহ উৎসবান্তে ব্রত পারণ করিয়া থাকেন । “তথা চোক্তং গারুড়ে— তিথ্যন্তে চোসবাস্তে বা ব্রতী কুব্বীদ্ধ পারণম্” ৷৷৪০৬ #অনুবাদ— ঐরূপ গরুড়পুরাণে উক্ত আছে – ব্ৰতাচরণকারী পরদিন তিথির অন্তে, অথবা ঐ দিন উৎসবান্তে পারণ করিবেন ৷৷ ৪০৬ ৷৷ “বায়ুপুরাণে চ— যদীচ্ছে সৰ্ব্বপাপানি হস্তং নিরবশেষতঃ । উৎসবান্তে সদা বিপ্র জগন্নাথান্নমাশয়ে” ৷৷ ইতি ৷৷ ৪০৭॥ #অনুবাদ– বায়ুপুরাণেও নিঃশেষে যদি সৰ্ব্ববিধ পাপ ধ্বংস করিতে ইচ্ছা কর, হে বিপ্র! উৎসবান্তে সৰ্ব্বদা জগন্নাথদেবের অন্নপ্রসাদ ভোজন করাইবে । ♦নির্জলা অপবাসে অসমর্থ হবিষ্যান্ন গ্রহণের বিধান রয়েছে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে— ~হরে কৃষ্ণ,ধন্যবাদ~ স্বধর্মম্
ইসকনে নারীদেরকে কি পুরুষদের তুলনায় কম বুদ্ধিমান মনে করা হয়?~পর্ব-২য়

শ্রীল প্রভুপাদের শিক্ষায় নারী ও বুদ্ধিমত্তার ব্যাখ্যা শ্রীল প্রভুপাদ বিভিন্ন সময়ে নারী ও তাদের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। তার বক্তব্য সঠিকভাবে বুঝতে হলে আমাদের বিষয়টি পর্যায়ক্রমে বিশ্লেষণ করতে হবে। এখানে আমরা তার দৃষ্টিভঙ্গি নিম্নলিখিত পাঁচটি ধাপে ব্যাখ্যা করবো: আত্মিক সমতা বনাম ভৌতিক পার্থক্য “কম বুদ্ধিমান” কথাটির প্রকৃত অর্থ বৈদিক সামাজিক ভূমিকা ও দায়িত্ব ভক্তিতে বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা আধুনিক সমাজ ও ইসকনে এর প্রয়োগ শিষ্যাদের প্রতি শ্রীল প্রভুপাদের মনোভাব ———————————————————————————————————————————————— ১. আত্মিক সমতা বনাম ভৌতিক পার্থক্য ক. আত্মিক স্তরে সমতা • বৈদিক শিক্ষায় বলা হয়েছে যে আত্মা (ātmā) নির্জাতীয় – অর্থাৎ, পুরুষ বা নারী হিসাবে কেউ জন্ম নেয় না, বরং আত্মা সবার এক। • শ্রীল প্রভুপাদ সবসময় জোর দিতেন যে কৃষ্ণভাবনামৃত অর্জনে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার আছে। • ইতিহাসে অনেক মহান নারী ভক্ত ছিলেন, যেমন কুন্তী দেবী, দ্রৌপদী, ও জাহ্নবা দেবী, যারা তাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের জন্য প্রসিদ্ধ। শ্রীল প্রভুপাদের উক্তি: “আত্মিকভাবে, সবাই সমান। একজন নারী নিকৃষ্ট নয়; তিনিও একজন আত্মা। কিন্তু শারীরিকভাবে, তার প্রকৃতি ভিন্ন, যেমন একটি শিশুর বুদ্ধি একজন প্রাপ্তবয়স্কের তুলনায় ভিন্ন হয়।” (প্রবচন, লস এঞ্জেলস, ১৯৭৪) খ. ভৌতিক স্তরে পার্থক্য • আত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারী-পুরুষ সমান হলেও, শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে নারী ও পুরুষের ভিন্ন প্রকৃতি আছে। • শ্রীল প্রভুপাদ কখনো কখনো বলতেন যে নারীরা তুলনামূলকভাবে কম বুদ্ধিমান, তবে এটি তাদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত নয়, বরং সাধারণ যুক্তিভিত্তিক চিন্তাভাবনা ও বাস্তবজীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে। ———————————————————————————————————————————————— ২. “কম বুদ্ধিমান” কথাটির প্রকৃত অর্থ ক. বৈদিক দৃষ্টিকোণ থেকে বুদ্ধিমত্তা বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী বুদ্ধিমত্তাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়: ১. ভৌতিক বুদ্ধিমত্তা (Buddhi) – যুক্তি, বিশ্লেষণ, ও বিচক্ষণতা। ২. আধ্যাত্মিক বুদ্ধিমত্তা (Bhakti Buddhi) – কৃষ্ণ ও আত্মার সম্পর্ক বোঝার ক্ষমতা। • শ্রীল প্রভুপাদ যখন বলতেন “নারীরা কম বুদ্ধিমান”, তখন তিনি ভৌতিক বুদ্ধির প্রসঙ্গেই বলতেন। • তিনি মনুসংহিতা (Manu-saṁhitā) থেকে উদ্ধৃতি দিতেন, যেখানে বলা হয়েছে যে নারীরা সাধারণত আবেগপ্রবণ হয়, ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সহজেই প্রভাবিত হতে পারে। খ. আধুনিক বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান অনুযায়ী • আধুনিক গবেষণাও দেখায় যে নারীরা আবেগপ্রবণ বুদ্ধিমত্তায় (emotional intelligence) বেশি পারদর্শী, আর পুরুষরা বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাভাবনায় (logical intelligence) বেশি পারদর্শী। • বৈদিক যুগে এই পার্থক্যের কারণে নারী ও পুরুষের আলাদা সামাজিক ভূমিকা ছিল, কিন্তু এটি কোনোভাবেই নারীর হীনতা প্রকাশ করে না। উদাহরণ: • একজন মা তার সন্তানের প্রতি বিশেষ আবেগপ্রবণ হন, কিন্তু একজন বাবা সাধারণত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, কারণ তিনি তুলনামূলকভাবে বিচার-বিবেচনা বেশি করেন। ———————————————————————————————————————————————— ৩. বৈদিক সামাজিক ভূমিকা ও দায়িত্ব ক. বৈদিক সমাজে নারী ও পুরুষের ভূমিকা • প্রাচীন বৈদিক সমাজে, নারী ও পুরুষের স্পষ্ট আলাদা দায়িত্ব ছিল: • পুরুষ: দর্শন, নেতৃত্ব ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করতেন। • নারী: পরিবার, সন্তান পালন ও ভক্তি কার্যকলাপে মনোনিবেশ করতেন। • “নারীদের কম বুদ্ধিমান” বলা হত এই অর্থে যে তারা বেশি আবেগপ্রবণ, তাই বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে তাদের পিতা, স্বামী বা পুত্রের আশ্রয়ে থাকা উচিত – এটি তাদের নিরাপত্তার জন্য, অপমান করার জন্য নয়। খ. ইসকনে শ্রীল প্রভুপাদের বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি • যদিও তিনি কখনো কখনো বৈদিক ঐতিহ্য অনুসারে কথা বলেছেন, কিন্তু ইসকনে তিনি নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ দিয়েছেন। • নারীরা ইসকনে: • প্রচার ও মন্দির পরিচালনা করেন • কীর্তন ও বক্তৃতা দেন • শাস্ত্র অনুবাদ ও প্রকাশনা করেন উদাহরণ: • আজ ইসকনের অনেক নারী গুরু, আচার্য ও প্রশাসক হিসেবে কাজ করছেন, যা ঐতিহ্যগত বৈদিক সমাজে দেখা যেত না। ———————————————————————————————————————————————— ৪. ভক্তিতে বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা • ভগবদ্গীতা (১০.১০) অনুসারে, কৃষ্ণ বলেন যে যারা তাঁর ভক্ত, তাদের প্রকৃত বুদ্ধি দেন। • শ্রীল প্রভুপাদ জোর দিয়েছিলেন যে সত্যিকারের বুদ্ধিমত্তা হলো কৃষ্ণের প্রতি আত্মসমর্পণ করা। • একজন কৃষ্ণভক্ত নারী প্রকৃতপক্ষে লক্ষ লক্ষ সাধারণ পুরুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। উক্তি: “একজন নারী যদি কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করে, তবে সে লক্ষ লক্ষ সাধারণ পুরুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান।” (প্রবচন, মায়াপুর, ১৯৭৭) ———————————————————————————————————————————————— ৫. আধুনিক সমাজ ও ইসকনে এর প্রয়োগ ক. কাল, স্থান ও পরিস্থিতি অনুযায়ী সমন্বয় • শ্রীল প্রভুপাদ সবসময় পরিস্থিতি অনুযায়ী তার শিক্ষা ব্যাখ্যা করেছেন। • তিনি স্বীকার করেছেন যে আধুনিক সমাজে নারীরা শিক্ষিত ও যোগ্য, তাই তাদের আধ্যাত্মিক বিকাশের সুযোগ থাকা উচিত। খ. লিঙ্গের চেয়ে ভক্তির গুরুত্ব • শ্রীল প্রভুপাদ লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্যের চেয়ে একজনের ভক্তির গুরুত্ব বেশি দিয়েছেন। • ইসকনে, নারী ও পুরুষ উভয়েই ভক্তি, শিক্ষা ও প্রচারের ক্ষেত্রে সমান সুযোগ পেয়েছেন। উদাহরণ: • ইসকনের নারী সাধ্বীরা আজ অনেক ক্ষেত্রে প্রবক্তা ও আচার্য রূপে প্রতিষ্ঠিত। ———————————————————————————————————————————————— ৬. শিষ্যাদের প্রতি শ্রীল প্রভুপাদের মনোভাব 1. পিতৃসুলভ ভালোবাসা ও যত্ন – শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর মহিলা শিষ্যাদের প্রতি গভীর স্নেহ, যত্ন ও সুরক্ষা প্রদান করতেন, যা এক পিতার ভালোবাসাকেও অতিক্রম করত। 2. সম্মান ও উৎসাহ – বৈদিক নীতিগুলি মেনে চললেও, তিনি কখনোই মহিলাদের নিম্নতর মনে করতেন না। বরং, তিনি তাঁদের ভক্তিমূলক সেবায় উৎসাহ দিতেন এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করতেন। 3. ব্যক্তিগত যত্ন – তিনি তাঁদের সুস্থতার খোঁজখবর রাখতেন, স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকতেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী দিকনির্দেশনা ও উৎসাহ প্রদান করতেন। 4. বৈষ্ণবী হিসেবে স্বীকৃতি – তিনি বলেছিলেন যে কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করা মহিলারা সাধারণ নন; তাঁদের বৈষ্ণবী হিসেবে যথাযথ সম্মান দেওয়া উচিত। 5. আধ্যাত্মিক উন্নতি – তাঁর সকল ব্যবহারের লক্ষ্য ছিল তাঁদের কৃষ্ণের নিকটবর্তী করা, যেখানে তিনি সদয়তা, সুরক্ষা ও প্রকৃত আধ্যাত্মিক যত্ন প্রদান করতেন। ———————————————————————————————————————————————— চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত: কিভাবে প্রভুপাদের বক্তব্য বুঝতে হবে? ১. আত্মিকভাবে নারী ও পুরুষ সমান – উভয়েরই কৃষ্ণচেতনা অর্জনের সমান সুযোগ আছে। ২. ভৌতিক স্তরে কিছু পার্থক্য আছে – নারীরা আবেগপ্রবণ, পুরুষরা বিশ্লেষণধর্মী। ৩. ভক্তিই সর্বোচ্চ বুদ্ধিমত্তা – কৃষ্ণকে আত্মসমর্পণ করাই প্রকৃত জ্ঞান। ৪. ইসকনে নারী ক্ষমতায়িত হয়েছে – বৈদিক সমাজের তুলনায় ইসকনে নারীরা অনেক সুযোগ পেয়েছেন। ———————————————————————————————————————————————— শেষ কথা: নারীদের কম বুদ্ধিমান বলার পরিবর্তে, শ্রীল প্রভুপাদ জোর দিয়েছেন যে সত্যিকারের বুদ্ধিমত্তা কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করা। যে নারী বা পুরুষ কৃষ্ণের প্রতি আত্মসমর্পণ করেছেন, তিনিই প্রকৃত জ্ঞানী। ১ম পর্বঃ https://svadharmam.com/why-srimad-bhagavatam-says-that-women-and-sudras-do-not-have-the-ability-to-understand-vedas/ ©শ্রী দেবর্ষি শ্রীবাস দাস
শ্রাদ্ধে মাছ-মাংস নিবেদন নিষিদ্ধ

ন দদ্যাদামিষং শ্রাদ্ধে ন চাদ্যাদ ধর্মতত্ত্ববিৎ । মুন্যন্নৈঃ স্যাৎ পরা প্রীতির্যথা ন পশুহিংসয়া ॥ নৈতাদৃশঃ পরো ধর্মো নৃণাং সদ্ধর্মমিচ্ছতাম্ । ন্যাসো দণ্ডস্য ভূতেষু মনোবাক্কায়জস্য যঃ ॥ [শ্রীমদ্ভাগবতম ৭/১৫/৭-৮] ~ ধর্মতত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে কখনও মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি আমিষ নিবেদন করবেন না, এবং তিনি যদি ক্ষত্রিয়ও হন, তা হলেও স্বয়ং আমিষ আহার করবেন না। যখন ঘি দিয়ে তৈরি উপযুক্ত খাদ্য সাধুদের নিবেদন করা হয়, তখন পিতৃপুরুষ এবং ভগবান অত্যন্ত প্রসন্ন হন। যজ্ঞের নামে পশুহিংসা করা হলে তাঁরা কখনও প্রসন্ন হন না। যাঁরা শ্রেষ্ঠ ধর্মের মাধ্যমে উন্নতি সাধন করতে চান, তাঁদের অন্য সমস্ত জীবদের প্রতি কায়, মন, এবং বাক্যের দ্বারা হিংসা না করতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। তার থেকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম আর নেই। অন্যতম প্রধান স্মৃতিশাস্ত্র ‘কাত্যায়ন স্মৃতিতে’ নিরামিষ দিয়ে অর্থাৎ বিনা আমিষে পিতৃ শ্রাদ্ধ করার নির্দেশ আছে! মহাভারতের অনুশাসন ও আশ্বমেধিক পর্বেও উল্লেখ আছে, পিতৃপুরুষগণ অন্ন দ্বারাই সন্তুষ্ট হন। পদ্মপুরাণের পাতালখন্ডের ৭২ নং অধ্যায়ে উল্লেখ আছে, রামচন্দ্র কর্তৃক মাতা কৌশল্যার শ্রাদ্ধে নিরামিষ দ্রব্যই নিবেদন করা হয়েছিলো, আমিষ নয়। শ্রাদ্ধে জীবহিংসা যেহেতু নরকবাসের কারণ, তাই কলিকালে পিতৃশ্রাদ্ধে মাংস নিবেদন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে শাস্ত্রসমূহ- (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-কৃষ্ণজন্ম খন্ড ১১৫/১০৯)বলা হয়েছে- “এই কলিযুগে অশ্বমেধ যজ্ঞ, গোমেধ যজ্ঞ,সন্ন্যাস আশ্রম(একদন্ডী সন্ন্যাস), শ্রাদ্ধনুষ্ঠানে মাংস নিবেদন ও দেবরের দ্বারা সন্তান প্রাপ্তি সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ”।
বর্ণসঙ্কর ব্যক্তি কি দীক্ষাগুরু হতে পারেন?~পর্ব-৫

‘বৈষ্ণবগণ দ্বিজোত্তম’ শাস্ত্রবাক্য জেনেও সমাজে কিছু ধর্মব্যবসায়ী প্রায়ই দাবী তুলেন, ‘শূদ্র কিংবা শূদ্রাধম, বর্ণহীন, অন্ত্যজ, বর্ণসঙ্কর, অসৎকূলজাতগণ বৈষ্ণব হলেও দীক্ষাগুরু হতে পারে না!!’ এরূপ ভাগবতম সিদ্ধান্ত বিরুদ্ধ মত যারা প্রসন করেন, তারা নিশ্চিতরূপে নরকের কীট। আজ আমরা মহামুনি মতঙ্গ ঋষির দৃষ্টান্ত দেখবো, যিনি বর্ণসঙ্কর হয়েও বৈষ্ণব ধর্ম পালনের মাধ্যমে ব্রহ্মর্ষি হয়েছিলেন এবং অন্যতম বৈষ্ণব দীক্ষাগুরুরূপে জগতবাসীদের করুণা করেছেন। মতঙ্গ মুনি শূদ্র নাপিতের ঔরসে কামোন্মত্তা ব্রাহ্মণীর গর্ভে জন্ম, অতএব জাতিতে চণ্ডাল ছিলেন। তার জন্ম সম্পর্কে মহাভারতে বলেছে- “ব্রাহ্মণ্যাং বৃষলেন ত্বং মত্তায়াং নাপিতেন হ জাতত্ত্বমসি চাণ্ডালো ’(মহাভারত, অনুশাসন পর্ব, ২৮।১৭) মতঙ্গ মুনি প্রথম জীবনে ইন্দ্রের তপস্যা করেছিলেন, কিন্তু তাতে অভিষ্ট লাভ না করতে পেরে বিষ্ণুভক্তিতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন এবং মহামুনিতে পরিণত হয়েছিলেন। ‘মুনিশার্দ্দুলো মতঙ্গো বিষ্ণুতৎপরঃ’’( স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুখন্ড, বেঙ্কটাচলমাহাত্ম্যম, ৩৯।২) মতঙ্গ মুনি ভক্তশ্রেষ্ঠ হনুমানেরও কূলগুরু ছিলেন। স্কন্দপুরাণে (বিষ্ণুখন্ডের বেঙ্কটাচলমাহাত্ম্যের ৩৯ অধ্যায়ে) উল্লেখ আছে, পুত্রলাভ না হওয়ায় বানররাজ কেশরী এবং মাতা অঞ্জনা খুব দুঃখিত ছিলেন। মতঙ্গ মুনি দেবী অঞ্জনাকে তখন মুখ্যপ্রাণ বায়ুর তপস্যায় প্রেরণ করেছিলেন এবং কেশরী-অঞ্জনা বায়ুদেবের তপস্যায় সিদ্ধ হয়ে তিনি মুখ্যপ্রাণকে পুত্র হনুমানরূপে লাভ করেছিলেন। রামায়ণের কিষ্কিন্ধাকাণ্ডের ৭৩-৭৪ সর্গে মতঙ্গ মুনি ও তার শিষ্যগণের উল্লেখ আছে। মতঙ্গমুনির নিষ্ঠাবান শিষ্যগণ গুরুভক্তি দ্বারা এতই তজস্বী হয়েছিলেন যে গুরুদেবের জন্য বন্য ফলমূল সংগ্রহকালে তাদের শরীর থেকে যে ঘাম মাটিতে পড়তো, সে ঘাম থেকে সুগন্ধি পুষ্পবৃক্ষের জন্ম হতো। সে সমস্ত পুষ্পবৃক্ষের পুষ্প কখনো মলিন হত না। মতঙ্গ মুনি ও তার শিষ্যগণ ভক্তিযোগ পূর্ণ করে মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক নিজেদের মন্ত্রপূত দেহকে অগ্নিতে আহুতি দিয়ে ভগবানের নিত্যধাম প্রাপ্ত হয়েছিলেন। নিত্যধামে গমনকালে তিনি তার শিষ্যা তপস্বীনি শবরীকে আশীর্বাদ করেছিলেন একদিন তিনি সাক্ষাৎ ভগবান রামচন্দ্রের দর্শন পাবেন। শ্রীরামচন্দ্র মাতা সীতার অন্বেষণকালে মতঙ্গবনে মতঙ্গমুনির আশ্রমে এসেছিলেন এবং শবরীর নিকট নিত্যধামগত মতঙ্গমুনির সমাধিস্থল, পূজাবেদী, পরিধেয় বস্ত্র দর্শন করে ভগবান রামচন্দ্র আনন্দিত হয়েছিলেন। শবর কূলে জন্মালেও গুরুদেব মতঙ্গ মুনির সেবার প্রভাবে তপস্বিনী শবরী সাক্ষাৎ ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে লাভ করেন। ভগবান রাম ভক্ত শবরীর উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করে ভক্তের মানবৃদ্ধি করেন। সাক্ষাৎ ভগবান রামকে সম্মুখে রেখে দর্শন করতে করতে যোগাগ্নিতে জড়দেহকে আহুতি দিয়ে শবরী মাতা দিব্যদেহ ধারণ করে অক্ষয়ধামে গমন করেন। ধন্য গুরু মতঙ্গ! ধন্য শিষ্যা শবরী! মতঙ্গ মুনি বর্ণসঙ্কর হয়েও পতিতপাবন দীক্ষাগুরুর এক আদর্শ দৃষ্টান্ত। অতএব যারা বৈষ্ণবকে জাতভেদ দৃষ্টিতে দর্শন করেন তাদের সুমতি হোক, শূদ্রপুত্র মতঙ্গ মুনির কৃপা তাদের উপর বর্ষিত হোক। ©ব্রজসখা দাস
শূদ্রকুলে জন্ম নেওয়া ব্যক্তি কি দীক্ষাগুরু হতে পারেন?~পর্ব-৪

জগতে আজকাল বহু দেহাত্মবুদ্ধি মূঢ় লোক নিজেকে বৈষ্ণব ঘোষণা করে বৈষ্ণবদের বৈষ্ণবত্ব, তাঁদের প্রচারক ও গুরু হওয়ার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন করে। তারা প্রতিষ্ঠাশার লোভে পরনিন্দা, পরচর্চা নিয়েই ব্যস্ত অথচ স্বঘোষিত শাস্ত্রবিদ। কিন্তু বেদশাস্ত্র এইরকম ব্যক্তিদের নয় বরং কাদের বৈষ্ণব বলে পরিচয় করা হয়েছে তা জগদ্গুরু সিংহপুরুষ শ্রীশ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর প্রভুপাদ তাঁর “ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব” গ্রন্থে স্বযত্নে লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন— “বৈষ্ণবতা দীনজনের একমাত্র সম্পত্তি। অহঙ্কার, প্রভুত্ব প্রভৃতি অবৈষ্ণবেরই প্রয়াসের বস্তুমাত্র, তাহাতে বৈষ্ণবের লোভ নাই। বৈষ্ণবের সম্পত্তি হরি। জড়াসক্তি-প্রাচুর্য্যে মত্ত এবং ব্রাহ্মণাদির সুলভ সম্মানে, পাণ্ডিত্যে ও ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের সুলভধনাদিতে স্ফীত হইয়া নিষ্কিঞ্চন পরমহংস বৈষ্ণবের প্রতি অনাদরক্রমে কুকর্মফলে অবৈষ্ণবতা-লাভ ঘটে। দীনহীন কাঙ্গাল জড়ভোগে উদাসীন হরিসেবা-পর হরিজনগণ জড়বস্তু-সকলের অধিকারী হইবার বাসনা না করায়, ব্রাহ্মণাদি-জন্ম, ঐশ্বর্য্য, বেদাদি শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য, কন্দর্পতুল্য-রূপের অভিলাষকে অকর্মণ্য জানিয়া ভোগপর বেদপাঠনৈপুণ্যরূপ ব্রাহ্মণত্বাদি কৰ্ম্ম-বাসনা হইতে মুক্ত হইয়া হরিকথা কীর্ত্তন করিয়া থাকেন। বলা বাহুল্য, শ্রুতিপারদর্শিতা-ক্রমে ব্রাহ্মণের সম্মান, অতুল ধন-জন-রাজ্যলাভ-ফলে ক্ষত্রিয়ের ঐশ্বর্য্য এবং কৃষিবাণিজ্যফলে বৈশ্যের ধনের ও রূপের সমৃদ্ধি বৈষ্ণবতার কারণ নহে; ঐগুলি সেবোন্মুখতার অভাবে অবৈষ্ণবতার বর্দ্ধক জড়ভোগপর দামসমূহ-মাত্র বৈষ্ণবগণ তাদৃশ ক্ষুদ্র অধিকার-সমুহের জন্য ব্যস্ত না হওয়াতেই তৃণাদপি সুনীচ ও তদপেক্ষা উন্নতশির তরু অপেক্ষা সহিষ্ণু, স্বয়ং অমানী ও অপরে মানদ হইয়া হরিভক্তি লাভকরিয়াছেন। অধিক কি, আধিকারিক দেবসমূহ প্রাকৃত কৰ্ম্ম-রাজ্যে সর্ব্বোচ্চশৃঙ্গে অধিষ্ঠিত হইয়াও কৰ্ম্মসমাপ্তিতে ভগবদ্ভক্তি-প্রভাবেই বৈষ্ণবপদবী লাভ করিয়া থাকেন।” অতএব যারা নিজেদের বৈষ্ণব বলে মনে করে, জড়জগতে সীমাবদ্ধ বর্ণাশ্রম-ধর্মের সাথে চিজ্জগতের বৈষ্ণবতার তুলনা করে, তারা নিতান্তই অল্পজ্ঞ। শাস্ত্রজ্ঞান ও শাস্ত্রের উপলব্ধি একইসাথে নাও ঘটতে পারে। শ্রীল প্রভুপাদ ভক্তিসিদ্ধান্ত উক্ত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন— “জগতাং গুরবো ভক্তা ভক্তানাং গুরবো বয়ম্। সর্ব্বত্র গুরবো ভক্তা বয়ঞ্চ গুরবো যথা ॥ শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলিলেন, বৈষ্ণবই জগতের গুরু;’ আমি বৈষ্ণবের গুরু। আমি যে-প্রকার সকলের গুরু, ভক্ত-গণও তদ্রূপ সর্বজনের গুরু। শ্রীমদ্বৈষ্ণবগণের সহিত জগতে কোন পূজ্যতম বস্তুর সাদৃশ্য নাই। বৈষ্ণব তদপেক্ষা অর্থাৎ সর্ব্বাপেক্ষা উচ্চতম আদর্শ, ইহাই শাস্ত্রসমূহের চরম সিদ্ধান্ত।” সাধু-বৈষ্ণবের কৃপাতেই শ্রীহরির কৃপা বিদ্যমান, তাই সাধুকৃপাতে অতি অল্পবয়সেই কারো কারো মধ্যে শাস্ত্রের দৃঢ় উপলব্ধি হয়, অথচ তৈলসজ্জিত শ্মশ্রু শুভ্রবর্ণ ধারণ করলেও কারো কারো নানা শাস্ত্র অধ্যয়নের পরেও মর্মার্থ উপলব্ধি হয় না। তাই তারা ভক্তদের নিন্দা, জাতিদ্বেষ নিয়েই নিরত থাকে। এমনকি সমস্ত শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত প্রদর্শিত হলেও তা রূপরঘুনাথের দর্শনের বিরোধী বলে প্রচার করার অপচেষ্টা করে। অথচ রূপরঘুনাথাদি ষড়্গোস্বামীবর্গের অভিন্ন সিদ্ধান্ত এই, বৈষ্ণবে জাতিবুদ্ধি করা যাবে না। “ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব” গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে — অর্চৌ বিষ্ণৌ শিলাধীগুরুষু নরমতিবৈষ্ণবে জাতিবুদ্ধি-বিষ্ণোর্যা বৈষ্ণবানাং কলিমলমথনে পাদতীর্থেহম্বুবুদ্ধিঃ। শ্রীবিষ্ণোর্নান্নি মন্ত্রে সকলকলুষহে শব্দসামান্যবুদ্ধি-বিষ্ণৌ সর্বেশ্বরেশে তদিতরসমধীর্ষস্য বা নারকী সঃ ॥ নিত্যপূজ্য বিষ্ণুবিগ্রহে শিলাবুদ্ধি, বৈষ্ণব-গুরুতে মরণশীল মানব-বুদ্ধি, বৈষ্ণবে জাতিবুদ্ধি অর্থাৎ জাতিবিচার, বিষ্ণু-বৈষ্ণবের পাদোদকে জলবুদ্ধি, সকল কল্মষবিনাশী বিষ্ণুনাম-মন্ত্রে শব্দ-সামান্য-বুদ্ধি এবং সর্বেশ্বর বিষ্ণুকে অপর দেবতার সহ সম-বুদ্ধি-এই ছয়প্রকার বিচারে ভক্ত ও অভক্তের তারতম্য বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিকভাবে সুব্যক্ত আছে। পদ্মপুরাণের এই শ্লোকটি শ্রীভক্তিরসামৃতসিন্ধু সহ বহু গোস্বামীগ্রন্থে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু, “নিজ সৌভাগ্যোদয় না হইলে বস্তু দর্শন করিয়াও দর্শনফল-লাভে অনেক অন্যাভিলাষী, কর্মী ও জ্ঞানী স্বভাবতঃই বঞ্চিত। তাঁহাদের নিজ-নিজ বিধি-নিষেধাদির পণ্যদ্রব্যভারে তাঁহারা এরূপ ভারাক্রান্ত যে, মস্তক উত্তোলন-পূর্বক গুণাতীতবস্তু-চতুষ্টয় দর্শনের সৌভাগ্যে তাঁহারা বঞ্চিত। সেই শোচ্যজীবগণ নিজ সঙ্কীর্ণতায় আবদ্ধ থাকিয়া ভক্তিপথে অগ্রসর হইতে পারেন না। তাঁহারা জগতে ভক্তি বা ভক্ত নিতান্ত বিরল জানিয়া তল্লাভের যত্ন-পর্য্যন্ত ত্যাগ-পূর্বক নিজের অধমতাকেই বহুমানন করেন এবং ভক্তের চরণে অপরাধ করিয়া নিজের অবনতির পথ পরিষ্কার করেন মাত্র।” বৈষ্ণবের আচারে উত্তম-কনিষ্ঠাদি তারতম্য থাকতে পারে। কিন্তু অপসম্প্রদায় বহির্ভূত তথা সৎসম্প্রদায়ে দীক্ষিত ব্যক্তি যে সংস্থারই অনুগামী হোক, তিনি বৈষ্ণব, তাতে সংশয় নেই। তাই হরিভক্তিবিলাসে’র মধ্যে এই শ্লোকটি গোস্বামীগণের দ্বারা উদ্ধৃত হয়েছে, গৃহীত-বিষ্ণুদীক্ষাকো বিষ্ণু-পূজাপরো নরঃ। বৈষ্ণবোহভিহিতোহভিজ্ঞৈরিতরোহম্মাদবৈষ্ণবঃ ॥ “শ্রীবিষ্ণুমন্ত্রে দীক্ষিত ও শ্রীবিষ্ণু-পূজাপরায়ণ ব্যক্তি অভিজ্ঞগণ কর্তৃক ‘বৈষ্ণব’ বলিয়া কথিত হন, তদ্ব্যতীত অপরে ‘অবৈষ্ণব’।” অতএব বৈষ্ণবভক্তদের প্রতি দেহাত্মবুদ্ধি স্থাপন করা অবশ্যই অপরাধজনক। বৈষ্ণবেরা তো মহৎ ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেও, মহারূপবান হয়েও, পরমবিদ্বান হয়েও কখনো এর গর্ব করেন না। কেননা তাঁরা জানেন, ভক্তদের কেবল কৃষ্ণের ইচ্ছাক্রমেই বিভিন্নভাবে বিভিন্নস্থানে জন্ম হয়। কলিযুগে মহাপ্রভুর পার্ষদগণ পাণ্ডববর্জিত গঙ্গাবর্জিত স্থানে এবং নিম্নকুলে আবির্ভূত হয়ে জগদুদ্ধার করেছেন, আবার পবিত্র স্থানে মহৎকুলেও এসেছেন। এর ফলে সেই কুল ও দেশেরই উদ্ধার হয়েছে, কেননা ভাগবতের সিদ্ধান্ত অনুসারে পবিত্র স্থানের মাহাত্ম্য স্থান নয়, বরং তীর্থী বৈষ্ণবগণের ফলেই লাভ হয়। কলিযুগে মহাপ্রভুকে সহায়তা করতে বহু বহু ভক্ত সময়ে সময়ে এই জগতে আবির্ভূত হচ্ছেন। তাই যারা মহাপ্রভুর সময়কালের দৃষ্টান্তসমূহকেও দৈব বলা যায় না, বরং সর্ব সময়কালের ভক্তদেরও দৃষ্টান্তরূপে গ্রহণ করা উচিত। ভক্ত দেহ, স্থান, কাল, পাত্রের অতীত। তাই তাদের প্রতি জাতিদ্বেষ নিতান্তই অন্যায়। শ্রী সিদ্ধান্ত সরস্বতী প্রভুপাদ তাই প্রমাণ দেখিয়েছেন, যথা— ♦“স্কন্দপুরাণে— হে নৃপোত্তম, যে ভাগবত-বৈষ্ণবকে উপহাস করে, তাহার অর্থ, ধৰ্ম্ম, যশ ও পুত্রসকল নিধন প্রাপ্ত হয়। যে মূঢ়গণ মহাত্মা বৈষ্ণবগণের নিন্দা করে, মহারৌরব-সংজ্ঞক নরকে পতিত হয়। তাহারা পিতৃ-পুরুষ-সহ বৈষ্ণবগণকে যে ব্যক্তি হনন করে, নিন্দা করে, বিদ্বেষ করে, অভিবাদন করে না, ক্রোধ করে এবং দেখিলে আনন্দিত হয় না, এই ছয় ব্যবহারই তাহার পতনের কারণ। ♦অমৃতসারোদ্ধারে— বৈষ্ণবগণকে পীড়া দিলে সজ্জাতি-জন্ম-প্রভৃতি যাহা কিছু সৎকর্মার্জিত পুণ্যফল থাকে, তৎসমস্তই নষ্ট হইয়া যায়। ♦দ্বারকামাহাত্ম্যে— যে পাপিষ্ঠগণ মাহাত্মা-বৈষ্ণবগণের নিন্দা করে, তাহারা যমশাসন-প্রভাবে সুতীব্র করপত্রদ্বারা ফালিত হয়। শত শত জন্মে বিষ্ণুপূজা করিয়া থাকিলেও বৈষ্ণবের অপমানকারী দুর্বৃত্তের প্রতি বিশ্বাত্মা শ্রীহরি প্রসন্ন হন না। ♦স্কান্দে— হে মহীপাল, বৈষ্ণবকে অগ্রে সম্মানপূর্ব্বক পরে যে ব্যক্তি অবজ্ঞা করে, সে স্ববংশে বিনষ্ট হয়। ♦ব্রহ্মবৈবর্ত্তে কৃষ্ণজন্মখণ্ডে— যাহারা হৃষীকেশ বা পুণ্যাশ্রয় তাঁহার ভক্ত-বৈষ্ণবগণের নিন্দা করে, তাহাদের শতজন্মার্জিত পুণ্য নিশ্চয় বিনষ্ট হয়। সেই পাপিগণ কুম্ভীপাক-নামক মহাঘোর নরকে কীটপুঞ্জ-দ্বারা ভক্ষিত হইয়া যাবচ্চন্দ্র-দিবাকর পচ্যমান হইয়া থাকে। বৈষ্ণব-নিন্দককে দর্শন করিলে দ্রষ্টার সমুদয় পুণ্য নিশ্চয় নষ্ট হয়। তাদৃশ অবৈষ্ণবকে দর্শন করিয়া গঙ্গাস্নান-পূর্বক সূর্য্য দর্শন করিলে বিদ্বজ্জন শুদ্ধিলাভ করেন। ♦শ্রীরামানুজ বলেন, ভগবানের পূজাপেক্ষা বৈষ্ণবের পূজা উত্তম, বিষ্ণুর অপমান অপেক্ষা বৈষ্ণবের অপমান গুরুতর অপরাধ, কৃষ্ণপাদোদকাপেক্ষা ভক্তের পাদোদক অধিকতর পবিত্র। বৈষ্ণবের পূজাপেক্ষা আর অন্য পুরুষার্থ নাই। বৈষ্ণববিদ্বেষ অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ আর কিছুই নাই; উহাতে নিজের বিনাশ হয়। ♦শ্রীচৈতন্যভাগবতে (ম ৫।১৪৫, ১০।১০২)— যত পাপ হয় প্রজা-জনেরে হিংসিলে। তার শতগুণ হয় বৈষ্ণবে নিন্দিলে॥ যে পাপিষ্ঠ বৈষ্ণবের জাতিবৃদ্ধি করে। জন্ম জন্ম অধম-যোনিতে ডুবি’ মরে ॥” অতএব আজ শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর প্রভুপাদের মহিমান্বিত আবির্ভাব মহোৎসবের আয়োজনে আমরা সকল বৈষ্ণবমতানুসারী ব্যক্তিদের অনুরোধ করব, বিষ্ণুনামে দীক্ষিত হরিপরায়ণ ভক্তদের নিন্দা, দ্বেষ, জাতিবুদ্ধি ত্যাগপূর্বক মহাপ্রভুর সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে হরিভজনে প্রবৃত্ত হোন। এই জগতে আমরা ক্ষণিকের অতিথি। ভক্তনিন্দায় তাই কালক্ষেপণ না করে হরিভজন করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। ইহাই শ্রী সিদ্ধান্ত সরস্বতীর উপদেশ। হরে কৃষ্ণ © স্বধর্মম্ ™
শূদ্রকুলে জন্ম নেওয়া ব্যক্তি কি দীক্ষাগুরু হতে পারেন?~পর্ব-৩

প্রায়শ দেখা যায়, জাতিব্রাহ্মণ ও ধর্মব্যবসায়ী দাম্ভিক ব্যক্তিগণ বৈষ্ণবের বর্ণ নিয়ে প্রশ্ন তোলার স্পর্ধা করেন এবং ধর্মানুগ ভক্তগণকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করেন। এরূপ ভাগবতদ্বেষীদের বিভ্রান্তিকর প্রচার নিরসনে এ লেখনি— বৈষ্ণবের বর্ণ কি? শ্রীমন্মধ্বাচার্য বর্ণকে দুইভাবে ব্যাখা করেছেন, যথা— ১) ঔপাধ্যায়িক বর্ণ (জন্ম দ্বারা জাতি) ২) পারমার্থিক বর্ণ (গুণ-কর্ম ভিত্তিক বর্ণ) ঔপাধ্যায়িক বর্ণ: দৈহিক জন্ম দ্বারা জাতিত্ব নির্ধারিত হয়। এর মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র চারটি জাতি। এদের মধ্যে যদি এক জাতির সাথে অপর জাতির দৈহিক মিলন ঘটে তবে তাকে বর্ণসঙ্কর বলে। বর্ণসঙ্কর অনুলোম ও প্রতিলোম দুই প্রকার। ঔরসদাতা হলেন পিতা, গর্ভধারিণী হলেন মাতা। চণ্ডাল,পুলিন্দ, পুক্কস, খস, যবন, সৌন্ধ, কাম্বোজ, শবর, ক্ষর প্রভৃতি বর্ণসঙ্করের উদাহরণ। পারমার্থিক বর্ণ (গুণ-কর্মানুসারে বর্ণ): যস্য যল্লক্ষণং প্রোক্তং পুংসো বর্ণাভিব্যঞ্জকম্। যদন্যত্রাপি দৃশ্যেত তৎ তেনৈব বিনির্দিশেৎ ৷ [শ্রীমদ্ভাগবতম ৭।১১। ৩৫] অনুবাদ: যদি কেউ ভাগবত বর্ণনা অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রের লক্ষণগুলি প্রদর্শন করেন, তা হলে তাঁকে ভিন্ন বর্ণের বলে মনে হলেও এই লক্ষণ অনুসারে তাঁর বর্ণ নির্দিষ্ট হবে। ব্যক্তি সদ্গুরু চয়ন করে তাঁর নিকট আশ্রিত হন। আশ্রিত ব্যক্তির গুণ পর্যবেক্ষণ করে গুরু তাকে মন্ত্রদান করেন। তখন গুরু হন পিতা, মাতা হলেন গায়ত্রীমন্ত্র। শিষ্য ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে গুরুগৃহে অবস্থান করেন এবং গুরু গুণবিচার করে তাদের বিদ্যাদান করেন। গুণ-কর্মানুসারে সে বর্ণপ্রাপ্ত হয়। বিশ্বামিত্রাদি মুনিগণ পারমার্থিক বর্ণ পরিচয়েই ত্রিলোক বিখ্যাত। ———————————————————————————————————————————————— বৈষ্ণবের বর্ণ: বৈষ্ণবের গুণ-কর্মানুসারে বর্ণ হয় না। বৈষ্ণব গুণাতীত, কর্মবন্ধনহীন। তার সাথে ঘটন-অঘটন সবই শ্রীহরির ইচ্ছাধীন, মায়াধীন নন। বৈষ্ণব দীক্ষা দ্বারা শ্রীহরির বংশে ব্যক্তির যে জন্ম হয়, তা দ্বারা তার দ্বিজত্ব সিদ্ধ হয়। বৈষ্ণব দীক্ষা প্রাপ্ত ব্যক্তির ঔপাধ্যায়িক বর্ণের পরিবর্তে পারমার্থিক বর্ণ লাভ করেন। দেহগত গোত্রপরিচয় পরিবর্তিত হয়ে তাঁর গোত্র হয় ‘অচ্যুত গোত্র’ (ভাগবত ৪।২১।১২)। তাঁর বর্ণ হয় ‘বৈষ্ণব’ বর্ণ বা ‘হংস বর্ণ’৷ ———————————————————————————————————————————————— বৈষ্ণবের গোত্র— সর্বত্রাস্খলিতাদেশঃ সপ্তদ্বীপৈকদণ্ডধূক। অন্যত্র ব্রাহ্মণকুলাদন্যত্রাচ্যুতগোত্রতঃ ॥ শ্রীমদ্ভাগবত ৪.২১.১২ অনুবাদ: মহারাজ পৃথু ছিলেন সপ্তদ্বীপ-সমন্বিত পৃথিবীর একচ্ছত্র সম্রাট। তাঁর অপ্রতিহত আদেশ সাধু, ব্রাহ্মণ ও অচ্যূতগোত্রভূক্ত বৈষ্ণব ব্যতীত অন্য কেউ লঙ্ঘন করতে পারত না। || অতএব, বৈষ্ণবের পরিচয় হলো— পিতা: বৈষ্ণব দীক্ষাগুরু কূল: হরিবংশ গোত্র: অচ্যুত গোত্র বর্ণ: হংস বর্ণ / বৈষ্ণব বর্ণ ———————————————————————————————————————————————— যেকোন বর্ণের ব্যক্তি বৈষ্ণব হলে দ্বিজে পরিণত হন। প্রমাণ— বিষ্ণুভক্তাশ্চ যে কেচিৎ সর্ব্বে বর্ণা দ্বিজতয়ঃ। কথিতং মম গার্গ্যেণ গৌতমেন সুমন্তুনা॥ [ স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুখন্ড, মার্গশীর্ষমাসমাহাত্ম্য, ১১।১৭, রাজা বীরবাহু উক্তি ] অনুবাদ: যে কোন বর্ণের ব্যক্তি যদি বিষ্ণুভক্ত হন, তবে তিনিই দ্বিজ। এই কথা- গার্গ্য, গৌতম ও সুমন্তু আমার নিকট বলেছেন। ———————————————————————————————————————————————— বৈষ্ণব বর্ণ যে ব্রাহ্মণাদি চার বর্ণের বাইরে, পৃথক বর্ণ তার প্রমাণ— ব্রহ্মক্ষত্রিয়বিটশূদ্রাশ্চতস্রো জাতয়ো যথা। স্বতন্ত্রজাতিরেকা চ বিশ্বেষু বৈষ্ণবাভিধা॥ [ ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, ব্রহ্মখণ্ড, ১১।৪৩ ] বঙ্গানুবাদঃ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র নামে যেরূপ চারটি জাতি আছে তদ্রূপ সমগ্র বিশ্বে ‘বৈষ্ণব’ নামক একটি স্বতন্ত্র জাতি আছে। ললাটাদ্বৈষ্ণবো জাতঃ ব্রাহ্মণো মুখদেশতঃ ৷ ক্ষত্রিয় বাহুমূলাচ্চ ঊরুদেশাচ্চ বৈশ্য বৈ ৷৷ জাতো বিষ্ণোঃ পদাচ্ছুদ্রঃ ভক্তিধর্ম্মবিবর্জিতঃ৷ তস্মাদ্বৈ বৈষ্ণবঃ খ্যাতঃ চতুর্ব্বর্ণেষু সত্তমঃ ৷৷ [ বৃহদ্বিষ্ণুযামল তন্ত্র ] অনুবাদ: শ্রী ভগবান্ বিষ্ণুর ললাট হইতে বৈষ্ণব, মুখ হইতে ব্রাহ্মণ,বাহু হইতে ক্ষত্রিয়,ঊরুদেশ হইতে বৈশ্য ,পদদেশ হইতে ভক্তিধর্ম্মবিবর্জিত শূদ্রের উৎপত্তি হইয়াছে ৷ ইহার মধ্যে যিনি বৈষ্ণব বলিয়া খ্যাত, তিনি চতুর্বর্ণ হইতেও সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বোত্তম ৷ ———————————————————————————————————————————————— বৈষ্ণব ব্রাহ্মণাদি চার বর্ণের থেকেও শ্রেষ্ঠ। প্রমাণ- ‘সৰ্ব্বেষাষ্ণৈব বর্ণানাং বৈষ্ণবঃ শ্রেষ্ঠ উচ্যতে।’ [ পদ্মপুরাণ, উত্তরখন্ড, ৬৮।৪ ] বঙ্গানুবাদঃ সৰ্ব্ব বর্ণ মধ্যে বৈষ্ণবই শ্ৰেষ্ঠ বলিয়া কথিত। তস্মাদ্বৈ বৈষ্ণবঃ খ্যাতঃ চতুর্ব্বর্ণেষু সত্তমঃ ৷৷ [ বৃহদ্বিষ্ণুযামল তন্ত্র ] অনুবাদ : যিনি বৈষ্ণব বলিয়া খ্যাত, তিনি চতুর্বর্ণ হইতে সর্বোত্তম ৷ ব্রাহ্মণাঃ ক্ষত্রিয়া বৈশ্যাঃ শূদ্রা অন্যেহন্ত্যজাস্তথা। হরিভক্তিপ্রপন্না যে তে কৃতার্থা ন সংশয়ঃ।।২ হরেরভক্তো বিপ্রোঽপি বিজ্ঞেয়ঃ শ্বপচাধিক। হরের্ভক্তঃ শ্বপাকোঽপি বিজ্ঞেয়ো ব্রাহ্মণাধিকঃ স কথং ব্রাহ্মণো যস্তু হরিভক্তিবিবর্জিত। স কথং শ্বপচো যস্তু হরিভক্তিপরায়ণঃ ॥৩ অব্যাজেন যদা বিষ্ণুঃ শ্বপাকেনাপি পুজ্যতে।। তদা পশ্যেত্তমপ্যেষশ্চতুর্ব্বেদিদ্বিজাধিকম্। ৪ [ পদ্মপুরাণ, ক্রিয়াযোগসারঃ, ৫।২-৪, ব্যাস উক্তি] বঙ্গানুবাদঃ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র বা অন্য অন্ত্যজ জাতি-যাহারাই হরিভক্তিপ্রপন্ন, তাহারাই নিশ্চিত ধন্য। হরিভক্তিহীন ব্রাহ্মণও চন্ডাল অপেক্ষা অধম বলিয়া বিজ্ঞেয়। আর হরিভক্ত চন্ডালও ব্রাহ্মণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া জানিবে। যিনি হরি ভক্তিহীন, তিনি কিরূপে ব্রাহ্মণ হইবেন? আর যে হরিভক্তিপরায়ণ, সে কিরূপে চন্ডাল হইবে? যে মুহূর্তে চন্ডালও অকপট ভাবে বিষ্ণুপূজা করে, তখন বিষ্ণু তাহাকে চতুর্ব্বেদী ব্রাহ্মণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ হিসেবে অবলোকল করেন। বিপ্রাদ দ্বিষড়গুণযুতাদরবিন্দনাভ- পাদারবিন্দবিমুখাৎ শ্বপচং বরিষ্ঠম্ মন্যে তদর্পিতমনোবচনেহিতার্থ- প্রাণং পুনাতি স কুলং ন তু ভূরিমানঃ ॥ [ শ্রীমদ্ভাগবতম ৯।৯।১০ ] বঙ্গানুবাদঃ ভগবানের শ্রীপাদপদ্ম-বিমুখ অভক্ত-ব্রাহ্মণ বারোটি ব্রাহ্মণোচিত গুণে ভূষিত হলেও তার অপেক্ষা যাঁর মন, বাক্য, কর্ম, ধন এবং প্রাণ ভগবান শ্রীহরিতে অর্পিত, সেই চণ্ডালও শ্রেষ্ঠ। এই প্রকার চন্ডালভক্ত-ও সেই রকম ব্রাহ্মণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, কারণ ভগবদভক্ত তাঁর কুল পবিত্র করতে পারে, কিন্তু সেই অতি গর্বান্বিত ব্রাহ্মণ নিজেকেও পবিত্র করতে পারে না, নিজের ব্রাহ্মণকূল উদ্ধার তো দূরের কথা। (উল্লেখ্য: এ শ্লোকটি মহাভারতের ‘সনৎসুজাত উপপর্বে’-ও বর্ণিত) ———————————————————————————————————————————————— বর্ণসঙ্কর বৈষ্ণব কি দীক্ষাগুরু হতে পারে? প্রামাণিক শাস্ত্র হতে বহু বহু দীক্ষাগুরুর দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই, যারা জন্ম দ্বারা বর্ণসঙ্কর হলেও পরবর্তীতে বিষ্ণুভক্তির অনুশীলন করে মহান বৈষ্ণবাচার্য্যে পরিণত হয়েছেন এবং দীক্ষাগুরু হয়ে বৈষ্ণবধর্মের প্রচার করেছেন। আসুন, আমরা ৩টি শাস্ত্র দৃষ্টান্ত দেখি! ১) শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস: মহর্ষি বেদব্যাসের পিতা পরাশর মুনি ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং মাতা সত্যবতী ছিলেন ক্ষত্রিয় উত্থানপাদের ঔরস ও মৎস্যগর্ভে জাত। তিনি ব্রহ্ম-মধ্ব-গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান দীক্ষাগুরু। ২) মহামুনি মতঙ্গ: শূদ্র নাপিতের ঔরসে কামোন্মত্তা ব্রাহ্মণীর গর্ভে জন্ম, অতএব জাতিতে চণ্ডাল ছিলেন। ৩) ঋষিশৃঙ্গ মুনি: ঋষিশৃঙ্গ মুনি ছিলেন বিভাশুক মুনি ও ব্যাশা পুত্র। তথাপি তিনি ত্রিলোকে পূজ্য ছিলেন এবং রাজা দশরথের যজ্ঞদীক্ষাগুরু ছিলেন। পদ্মপুরাণেও অসৎকূলেজাত মহান বৈষ্ণব দীক্ষাগুরুগণের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে- ব্রহ্মোবাচ। সচ্ছ্রোত্রিয়কুলে জাতো হ্যক্রিয়ো নৈব পূজিতঃ।। অসৎক্ষেত্রকুলে পূজ্যো ব্যাসবৈভাণ্ডকৌ যথা …. বেশ্যাপুত্রো বসিষ্ঠশ্চ অন্যে সিদ্ধা দ্বিজাদয়ঃ ॥ [ পদ্মপুরাণ, সৃষ্টিখন্ডম, ৪৬।২৭-২৮] অনুবাদ: ব্রহ্মা কহিলেন,- “শ্রোত্রিয় কুলজাত হয়েও যিনি অসৎ কর্মে লিপ্ত হন তিনি পূজ্য নহে, পরন্তু ব্যাসদেব ও ঋষ্যশৃঙ্গের ন্যায় অসৎকূলজ ব্যক্তিও সদাচার পরায়ণ হইলে পূজ্য হইয়া থাকেন…….বেশ্যাপুত্র বশিষ্ঠও সমাজে সমধিক সম্মান পান, এরকম আরও বহু বহু সিদ্ধ দ্বিজ আছে।” ———————————————————————————————————————————————— হয়গ্রীব পাঞ্চরাত্রে বলেছে, শৈব, সৌর, অনৈচ্ছিক, নগ্ন, বর্ণসঙ্কর, অপবিত্র, বৃদ্ধ, কুৎচ্ছিৎ অঙ্গ, মহাপাতকী চিহ্নযুক্ত ব্যক্তি গুরু হতে পারেন না। তাহলে সমাজে বর্ণসঙ্করগণ কিরূপে গুরু হচ্ছেন? উত্তরঃ হয়গ্রীব পাঞ্চরাত্রের উক্ত শ্লোকে যে সকল দোষ চিহ্নিত হয়েছে সেগুলো সকল অবৈষ্ণব ব্যক্তির ক্ষেত্রে বুঝতে হবে। যেমন, শুকদেব গোস্বামী ‘নগ্ন’ হয়েও, ব্যাসদেব-অষ্টবক্রমুনি ইত্যাদিগণ মুনি দেখতে সুদর্শন না হলেও, বিশ্বামিত্রের মতো ‘ব্রহ্মঘাতি’ ব্যক্তিও কিংবা বশিষ্ঠাদি মুনির মতো ‘বৃদ্ধ’ হয়েও দীক্ষাগুরু হওয়ার ভুরী ভুরী দৃষ্টান্ত আছে। অতএব, হয়গ্রীব পাঞ্চরাত্রের উক্ত বাক্যের দোষগুলো অবৈষ্ণবের জন্য বুঝতে হবে। ঠিক একই কারণে, হয়গ্রীব শাস্ত্রের উক্ত শ্লোকে বর্ণসঙ্কর দ্বারা অবৈষ্ণব বর্ণসঙ্করকে বুঝিয়েছে। যোনীগত বর্ণসঙ্করের জন্মদোষ থাকায় তিনি দীক্ষাদানে অযোগ্য। কিন্তু বর্ণসঙ্করী ব্যক্তি যদি বিষ্ণুভক্তিকে আশ্রয় করে নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব হন, তবে তার সমস্ত দোষ দূরীভূত হয়ে যায় এবং তিনি দীক্ষা দ্বারা বৈষ্ণবধর্মের প্রচার করে ত্রিজগতকে পবিত্র করেন। প্রমাণ- বৈষ্ণবেষু
শূদ্রকুলে জন্ম নেওয়া ব্যক্তি কি দীক্ষাগুরু হতে পারেন?~পর্ব-২

শ্রী নম্মালবর বা শঠকোপ আলবর শ্রী সম্প্রদায়ের ১২ জন মহান আচার্যের একজন, যাদের বাক্য ও উপদেশ এই সম্প্রদায়ে বেদের মতো মহান বলে মান্য করা হয়। শ্রী নম্মালবর শূদ্র সৎগোপ কুলে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাঁর মহান বিষ্ণুভক্তির বলে ব্রাহ্মণকুলের গুরু হয়েছিলেন। নম্মালবর শূদ্রকূলে জন্মেও বৈষ্ণব সংস্কার ধারণ করতেন, ব্রাহ্মণের ন্যায় নবগুণে যজ্ঞোপবীত ধারণ করতেন। তিনি ৩০৫৯ খ্রিস্টপূর্বে অর্থাৎ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্বধাম প্রত্যাবর্তনের মাত্র অর্ধশত বছর পরেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। এবং জন্ম থেকে তিনি কোনো কথা বলেননি এবং চোখ খোলেননি। তাই সকলে তাকে মূক ও অন্ধ বলে মনে করতেন। শিশুকালে নম্মালবর একদিন একটি তেঁতুল গাছের নিচে বসে কৃষ্ণভজন করছিলেন, তখন একদিন মধুরকবি নামক একজন কৃষ্ণভক্ত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সর্ব তীর্থ ভ্রমণ করে গৃহে প্রত্যাবর্তনের পথে হঠাৎ বহু দূর থেকে আলোকচ্ছটা দেখতে পেয়ে সেখানে আগমন করেন। হঠাৎ অন্তর থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে মধুরকবি তাঁকে সাংখ্যযোগের ভিত্তিতে একটি ধাঁধা জিজ্ঞেস করেন, “মৃতদেহে যদি ক্ষুদ্র কিছু জন্য নেয় তা কি এই দেহে বাস করে ও আহার করে?” নম্মালবর তাঁকে এর উত্তর দিয়ে প্রথমবারের মতো কথা বলেন, “হ্যাঁ বাস করবে, আহারও করবে।” এরপর তিনি সেই ক্ষুদ্র বস্তুকে আত্মা, মৃতদেহকে জড় দেহ এবং বাস ও আহার করাকে কর্তা ও ভোক্তা জ্ঞান করা হিসেবে বিশ্লেষণ করে চরমে কৃষ্ণভক্তিই সার বলে স্থাপন করেন। একটি শিশুর মুখে সাংখ্যতত্ত্ব শ্রবণ করে মধুরকবি তাঁকে মহান পণ্ডিত ও মহান কৃষ্ণভক্ত বলে উপলব্ধি করতে পেরে তাঁর চরণাশ্রয় করলেন এবং তাঁর নিকট বৈষ্ণবমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। যদিও মধুরকবি বয়সে জ্যেষ্ঠ ছিলেন ও নম্মালবর শিশু ছিলেন, তবুও মধুরকবি বয়স ও বর্ণ বিচার না করেই বৈষ্ণবের চরণাশ্রয় করেন এবং নাম্মাবরের চরণাশ্রয়ে তপস্যা করে নিজেও আলোয়ার হয়েছেন। কিংবদন্তী এই, নম্মালবর মধুরকবি আলবরকে রামানুজ আচার্যের সম্বন্ধে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। পরবর্তীকালে আরো বহু ব্যক্তি নম্মালবরের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি এমনই মহান ভক্ত ছিলেন যে, বলা হয়, তাঁর অনুসারীদের জন্যেই শ্রী নারায়ণ এই কলিযুগে প্রথম বৈকুণ্ঠের দ্বার উন্মোচন করেছিলেন । শঠকোপ যোগী বা নম্মালবর বৈশাখ মাসে শুক্লপক্ষের চতুর্থী তিথিতে বিশাখা নক্ষত্রে আবির্ভূত হন। প্রতি বছর তাঁর আবির্ভাব নক্ষত্র মহা ধুমধামে শ্রী সম্প্রদায়ে পালিত হয় এবং নবসূত্র যজ্ঞোপবীত প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্য উপাচারের দ্বারা সেবিত হন। কৃষ্ণ ভজনে নাহি জাতি-কুলাদি বিচার। সৎগোপকুলে জাত শ্রী নম্মালবর শঠকোপ যোগী সকলকে সৎবুদ্ধি দিন এবং শঠতা দূরীভূত করুন। হরে কৃষ্ণ। ~ মধুর গৌরকিশোর দাস © স্বধর্মম্ ™
শূদ্রকুলে জন্ম নেওয়া ব্যক্তি কি দীক্ষাগুরু হতে পারেন?~পর্ব-১

সাম্প্রতিক সময়ে শূদ্রকুলে জন্মগ্রহণ করা ব্যক্তি দীক্ষাগুরু হতে পারে না, এমন বিষয় নিয়ে প্রচুর চর্চা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু শাস্ত্রে এর ভূরিভূরি দৃষ্টান্ত আছে, যেখানে বৈষ্ণবগণ শূদ্র কুলে আবির্ভূত হয়েও ব্রাহ্মণের দীক্ষাগুরু হয়েছিলেন। পর্যায়ক্রমে আমরা তাদের বিষয়ে প্রকাশ করব। গৌড়ীয় পরম্পরায় শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর মহাশয় একজন বিখ্যাত আচার্য যিনি শূদ্র কায়স্থকুলে আবির্ভূত হলেও কৃষ্ণভক্তির প্রভাবে ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের একজন মহান দীক্ষাগুরুতে পরিণত হয়েছিলেন। নরোত্তম দাস ঠাকুর বহু স্মার্ত ব্রাহ্মণকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করেছিলেন। ঠাকুর মহাশয়ের দীক্ষা ও শিক্ষা লাভ, প্রচার ও বিগ্রহসেবা: শ্রী নরোত্তম দাস বৃন্দাবনে মহাপ্রভুর পার্ষদ শ্রীল লোকনাথ গোস্বামীর নিকট দীক্ষা ও শ্রীল জীব গোস্বামীর নিকট শিক্ষা লাভ করে গৌড়ীয় শাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি ‘ঠাকুর মহাশয়’ উপাধি লাভ করেন। এরপর গুরুবর্গের নির্দেশে তিনি কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের জন্য পুনরায় পূর্ববঙ্গে ফিরে আসেন। ঠাকুর মহাশয় তাঁর আবির্ভাব স্থান খেতুরী অঞ্চলে ছয়টি মন্দির স্থাপন করেছিলেন। এই উপলক্ষে তৎকালীন সময়ের সমস্ত বৈষ্ণব খেতু্রীগ্রামে নিয়ন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে গৌর পূর্ণিমায় এত বিশাল মহোৎসব হয়েছিল যে তা এখনও ইতিহাসে বিখ্যাত এবং শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু ও তাঁর প্রধান পার্ষদগণ তখন প্রকট না থাকলেও আকাশপথে আবির্ভূত হয়ে সেই উৎসবে ঠাকুর মহাশয়ের কীর্তনে নৃত্য করেছিলেন যা উপস্থিত বহু ভক্ত দর্শন করেছিলেন। যদিও ঠাকুর মহাশয় বাহ্যত শূদ্রকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁর গুরুদেবের আদেশে এভাবে শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া-গৌরাঙ্গ, শ্রীবল্লবীকান্ত, শ্রীরাধারমণ, শ্রীব্রজমোহন, শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধাকান্ত — এই ছয় বিগ্রহ স্থাপন করেছিলেন এবং এভাবে বৈষ্ণবদীক্ষায় দীক্ষিত ব্যক্তি যেকোনো কুলে জন্মগ্রহণ করেও বিগ্রহসেবার অধিকারী হয় এই শাস্ত্রীয় বাক্যের উপযুক্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। শূদ্রগৃহে জন্ম নিয়ে ব্রাহ্মণ সন্তানদের দীক্ষা দেওয়ায় তিনি জাতি ব্রাহ্মণদের প্রবল বিরোধের সম্মুখীন হন। কিন্তু খেতুরী মহোৎসবে শ্রী নিত্যানন্দ প্রভুর পুত্র শ্রীবীরচন্দ্র প্রভু স্বয়ং বহু শাস্ত্র প্রমাণাদি সহযোগে বলেন কৃষ্ণ দীক্ষা গ্রহণ করলে দ্বিজত্ব প্রাপ্তি হয় এবং নরোত্তম দাস ঠাকুর যদিও শূদ্র কুলোদ্ভব কিন্তু বীরচন্দ্র প্রভু তাকে ব্রাহ্মণ বলে ঘোষণা করেন ও তার বক্ষে জ্যোতির্ময় যজ্ঞোপবীত সকলকে দর্শন করান। শ্রীপ্রেমবিলাসে (১৯ বিলাসে) উল্লেখ আছে— এই নরোত্তম কায়স্থ কুলোদ্ভব হয়। শূদ্র বলি কেহ কেহ অবজ্ঞা করয়॥ কৃষ্ণভক্ত জন হয় ব্রাহ্মণ হৈতে বড়। যিঁহো শাস্ত্র জানে তিঁহো মানে করি দৃঢ়॥ কৃষ্ণ দীক্ষায় দ্বিজত্ব লাভ শাস্ত্রের বচন। ইথে অবিশ্বাস যায় নরক ভবন॥ কুষ্ঠরোগী ব্রাহ্মণকে কৃপা: শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর নাম প্রচার এবং দীক্ষামন্ত্র দান করে গুরুরূপে সেবা করছিলেন, যা স্বভাবতই বহু লোকের মনঃপুত হয়নি। এখনকার দিনেও এরকম ব্যক্তি রয়েছে, অতএব সেই সময়ের আর কি কথা। একদিন এক কুষ্ঠরোগী ব্রাহ্মণ নরোত্তম দাস ঠাকুরের ভজনতলীতে আগমন করে হাত জোড় করে বিনীতভাবে বলতে লাগলেন, “ঠাকুর, আমি এক অহংকারী ব্রাহ্মণ, আমি আপনার সমালোচনা ও বিদ্রূপ করেছি এবং এই অপরাধের ফলে এইরকম যন্ত্রণাদায়ক রোগ লাভ হয়েছে আমি যতই ঔষধ গ্রহণ করি না কেন, এই রোগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি প্রাপ্ত হচ্ছে। তাই আমি মনোকষ্টে পদ্মায় আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেই রাতে আমার আরাধ্যা ভগবতী দেবী স্বপ্নে আমাকে রোগের কারণ অবগত করে আপনার নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করতে কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আমি মহাপাপী, ক্ষমার অযোগ্য। আপনি আমাকে উদ্ধার করুন।” ব্রাহ্মণের এই আর্তনাদ দেখে ঠাকুরের হৃদয় বিগলিত হয়ে গেল। ঠাকুর মহাশয় তাকে ভূমি থেকে তুলে হরে কৃষ্ণ কীর্তন করতে করতে আলিঙ্গন করলেন। তখন সেই ব্রাহ্মণও কৃষ্ণপ্রেম লাভ করে কীর্তন করতে করতে হাত তুলে নৃত্য করতে লাগলেন। যখন ব্রাহ্মণের বাহ্যজ্ঞান ফিরে এলো, তিনি দেখলেন তার দেহ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে। তখন সেই ব্রাহ্মণ ঠাকুর মহাশয়ের নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন এবং অহংকারশূন্য হয়ে কৃষ্ণভক্তি করতে লাগলেন। সেই অঞ্চলের লোকজন এই ঘটনা শুনতে পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং সকলেই নরোত্তম দাস ঠাকুরের মহিমা উপলব্ধি করতে পারলেন। তাঁরা বলতে লাগলেন— কেহ কার প্রতি কহে, হও সাবধান। শ্রীনরোত্তমেরে না করিহ শূদ্রজ্ঞান॥ কেহ কহে মত্ত হৈয়া বিপ্র অহংকারে। নরোত্তম হেন রত্ন নারি চিনিবারে ॥ (নরোত্তম বিলাস, নবম বিলাস) হরিরাম, রামকৃষ্ণ ও শিবানন্দ উদ্ধার: শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর মহাশয়ের কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের ফলে কালক্রমে এই অঞ্চলের বহু লোক নিতাই-গৌরের প্রেমভক্তি গ্রহণ করতে লাগল। ঠাকুর মহাশয় তাদের দীক্ষা দিয়ে উদ্ধার করলেন। বহু ব্রাহ্মণসন্তানও ঠাকুর মহাশয়ের নিকট দীক্ষা নিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে হরিরাম আচার্য, রামকৃষ্ণ আচার্য, গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তী বিখ্যাত। এছাড়াও জগন্নাথ আচার্য, শিবানন্দ আচার্য, রূপ নারায়ণ প্রভৃতি পণ্ডিতগণও অগ্রগণ্য। হরিরাম ও রামকৃষ্ণ ঠাকুর আশ্রয়ে কৃষ্ণভক্তি ও শাস্ত্রশিক্ষা করতে থাকলে তাদের পিতা শিবানন্দ আচার্য অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। তিনি তাদের ভর্ৎসনা করতে লাগলেন, “ব্রাহ্মণ হয়ে কায়স্থের পায়ে ধরতে তোদের লজ্জা করল না? আর সে কোথাকার কোন বৈষ্ণব, যে কিনা ব্রাহ্মণকে শিষ্য করার দুঃসাহস করেছে?” তখন দুই ভাই পিতাকে বললেন, “পিতা, আপনি দয়া করে শান্ত হোন, আপনি পণ্ডিতগণসহ শাস্ত্রবিচার আয়োজন করুন, আমরা শাস্ত্রের বিচারে এর উত্তর দেবো। সেই বিচারে যদি আপনার মত শ্রেষ্ঠ হয়, তাহলে আমরা প্রায়শ্চিত্তও করব।” শিবানন্দ তখন আরো দুইজন পণ্ডিতকে আমন্ত্রণ করে শাস্ত্রবিচার আয়োজন করেন এবং পরাজিত হন। তখন তিনি মিথিলা থেকে এক বিখ্যাত পণ্ডিত মুরারি মহাশয়কে আমন্ত্রণ করেন, কিন্তু শ্রীগুরুদেবের আশির্বাদে হরিরাম ও রামকৃষ্ণ তাঁকেও ভাগবতের সিদ্ধান্ত দ্বারা পরাজিত করেন। মুরারি মহাশয় তখন লজ্জায় স্থান ত্যাগ করেন। সেদিন রাতে শিবানন্দ আচার্যের পূজিতা দুর্গাদেবী তাকে স্বপ্নে বললেন, “যারা শ্রীহরির প্রিয় ভক্ত, তাঁরাই আমার প্রিয়। তুই যদি রক্ষা পেতে চাস, তাহলে শ্রী নরোত্তমের নিকট ক্ষমা ভিক্ষা কর।” পরদিন পরিবারের বাকি সকলকে নিয়ে শিবানন্দ আচার্য শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুরের চরণাশ্রয় গ্রহণ করলেন। গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তী ও মণিপুরী বৈষ্ণব হরিরাম ও রামকৃষ্ণের প্রচারের ফলে গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তী ঠাকুর মহাশয়ের চরণাশ্রয় করেন এবং অল্পসময়ে ভক্তিশাস্ত্রে মহাপণ্ডিত হন। তিনি পরবর্তী সময়ে মণিপুরী সম্প্রদায়ে কৃষ্ণভক্তি প্রচার করেছিলেন, যার ফলে আজও সেখানে কৃষ্ণভক্তির প্রবাহ দেখা যায়। রূপ নারায়ণ ও রাজা নরসিংহ ক্রমে ক্রমে নরোত্তম দাস ঠাকুরের ব্রাহ্মণ শিষ্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগলো। অনেক প্রধান ব্রাহ্মণ নরোত্তম দাস ঠাকুরের প্রেমভক্তির বন্যায় নিজেকে ভাসিয়ে দিলেন। এতে স্মার্ত ব্রাহ্মণ সমাজ ঠাকুর মহাশয়ের প্রতি কুপিত হতে লাগলেন। কারণ ঠাকুর মহাশয়ের শিষ্য সংখ্যা এতোই বেড়েছে যে, তাকে আর একঘরে করে দিলেও কোনো লাভ হবে না। শ্রীনরোত্তম দাস ঠাকুর মহাশয়ের মহিমা দেখে স্মার্ত ব্রাহ্মণ সমাজ ঈর্ষায় দগ্ধ হতে লাগল। তাই সকলেই রাজা নরসিংহের কাছে গিয়ে নালিশ করল, “মহারাজ, আপনি যদি ব্রাহ্মণ সমাজকে না বাঁচান, তবে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। রাজা কৃষ্ণানন্দ দত্তের পুত্র নরোত্তম শুদ্র হয়ে ব্রাহ্মণদের শিষ্য করছে এবং জাদু-মন্ত্র দিয়ে সকলকে মুগ্ধ করছে।” রাজা নরসিংহ বললেন, “আমি আপনাদের রক্ষা করব। আমায় কী করতে হবে বলুন?” ব্রাহ্মণগণ বললেন, “মহাদিগবিজয়ী পণ্ডিত শ্রীরূপনারায়ণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা খেতুরিতে গিয়ে নরোত্তমকে পরাস্ত করব। এ কাজে আপনি আমাদের সাহায্য করুন।” রাজা নরসিংহ বললেন, “আমিও আপনাদের সাথে যাবো।” রাজা তার সভাসদ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ ও সভাপণ্ডিত রূপনারায়ণ সহ বিষয়টি আলোচনা করলেন এবং স্থির করলেন সবাইকে নিয়ে খেতুরি অভিমুখে যাত্রা করবেন। স্মার্ত ব্রাহ্মণগণ দিগ্বিজয়ী রূপনারায়ণকে সঙ্গে নিয়ে খেতুরি গ্রামের দিকে যাত্রা করলেন। একজন লোক এসে তা শ্রীনরোত্তম ও শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজ আদি সকল ভক্তকে জানালেন। এদিকে এ
যোগেশ্বরেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ~২য় পর্ব

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি কংস, শিশুপাল, শকুনি, দুর্যোধনাদি অসুরদের মতো পূর্বজন্মের ঈর্ষাপরায়ণ, বিষ্ণুবিদ্বেষী কতিপয় ব্যক্তি ইহজন্মেও অবচেতন মনের সেই প্রবৃত্তির জন্য তাঁকে (শ্রীকৃষ্ণ) সাধারণ মনুষ্য বানাতে ব্যতিব্যস্ত। তারা নানা ফন্দি আঁটে তাঁর ভগবত্তাকে নস্যাৎ করার জন্য। এই নির্বোধদের এমনই এক দাবি, “শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর নন। তিনি যোগযুক্ত হয়ে অর্থাৎ যোগের দ্বারা পরমেশ্বরের সাথে যুক্ত হয়ে ভগবদ্গীতার জ্ঞান প্রদান করেছিলেন”। অথচ পুরো ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ যে ঠিক কখন যোগযুক্ত হলেন আর কখন তার স্বাভাবিক স্বরূপ(মনুষ্য~অর্বাচীনদের ভাষ্যমতে)-এ ফিরে এলেন তার কোন ইয়ত্তা আমরা খুঁজে পাই না। এই নির্বোধরাও এই বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলতে পারে না। সমগ্র গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অসংখ্যবার নিজেকে পরমেশ্বর, জীবের অন্তরাত্মা, পরমব্রহ্ম দাবি করেছেন। আবার গুটিকয়েক জায়গায় তিনি পরোক্ষভাবে পরমাত্মা’র শরণ গ্রহণ করার কথাও বলেছেন(গীতাঃ ১৮/৬১-৬২)। এবং এই দুটি শ্লোকের ব্যাখ্যাও আমরা ১ম পর্বে করেছি। ১ম পর্বঃ https://svadharmam.com/krishna-is-the-supreme-personality-of-godhead/ ⚫ মূর্খদের দাবি অনুযায়ী যদি ধরেও নেই যে, “শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মার সঙ্গে যোগের দ্বারা যুক্ত হয়ে গীতার জ্ঞান প্রদান করেছিলেন” তবে সেই দাবী অনুযায়ী ১৮/৬১-৬২ শ্লোক বিবেচনা করলে দেখা যায় উক্ত শ্লোক দুটি শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মার সহিত যোগবিযুক্ত অবস্থায় বলেছেন। সেজন্য নিজেকে শুধুই শ্রীকৃষ্ণ ভেবেছেন ও অর্জুনকে পরমাত্মার শরণ গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন । কিন্তু পরক্ষণেই আবার ১৮/৬৬ শ্লোকে পরমাত্মার সহিত যোগযুক্ত হয়ে পরমাত্মায় একাত্ম হয়ে গিয়ে (মূর্খমতে) নিজের (পরমেশ্বরের) শরণ গ্রহণ করার কথা বলেছেন। ⚫ তবে কি শ্রীকৃষ্ণ মুহুর্তেই যোগযুক্ত ও বিযুক্ত(যোগমুক্ত) হয়ে যান??? এইসব হাস্যকর, রম্য দাবি শুনে মনে হয় যেন “ইসব হাস্যকর, রম্য দাবি শুনে মনে হয় যেন “শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মার সঙ্গে যোগযুক্ত হওয়ার জন্য যে Internet Connection Providers/Device ব্যবহার করতেন তার সিগন্যাল খুবই দুর্বল ছিল!। তা নাহলে তিনি কখন যে যোগযুক্ত হচ্ছেন (Connected) আর কখন যোগমুক্ত (Disconnected) হচ্ছেন তা বুঝা খুব মুশকিল।” যদিও ভগবদ্গীতায় কয়েক জায়গায়(১১/৮-৯; ১৮/৭৮) ভগবানকে “যোগেশ্বর” বলা হয়েছে। তা এই পর্বে আলোচনা করা হবে যে, শ্রীকৃষ্ণকে কেন “যোগেশ্বর বলা হয়েছে?”। দ্রঃ আমরা শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান জ্ঞানে এবং ভগবদ্গীতা’র “ভগবান উবাচ” বলে যত শ্লোক আছে তা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণেরই মুখনিঃসৃত বিবেচনা করেই মূর্খদের দাবি খণ্ডণ করবো। ———————————————————————————————————————————————— শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত যোগ শক্তির অধীশ্বরঃ যেহেতু পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অণিমা-মহিমাদি অষ্টসিদ্ধি ও সমস্ত শক্তির প্রবর্তক – ♦মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে; গীতা ১০/৮ ~ আমার থেকেই সমস্ত কিছু প্রবর্তিত হয়েছে তাই শ্রীকৃষ্ণই সমস্ত যোগ শক্তির অধীশ্বর অর্থাৎ যোগেশ্বর। যেমন শ্রীমদ্ভাগবতের বহু জায়গায় শ্রীকৃষ্ণকে ‘যোগেশ্বর’(১০/১৪/২১, ১/৮/১৪, ১/৮/৪৩), ‘যোগাধীশ’(১০/১৯/১২), ‘যোগবীর্যং’(১০/১৯/১৪) সম্বোধন করা হয়েছে। ———————————————————————————————————————————————— শ্রীকৃষ্ণই সকল জীবের হৃদ্যন্তস্থ পরমাত্মাঃ যারা অণিমা, মহিমা আদি বিভিন্ন যোগশক্তি লাভের আশায় যম, নিয়ম প্রাণায়াম আদি অষ্টাঙ্গ যোগ অনুশীলন করেন তাঁদেরও অন্তিম লক্ষ্য বিষয়ে উপদেশ প্রদান করে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন– ♦যোগীনামাপি সর্বেষাম মদ্গতেন অন্তরাত্মনা গীতা ৬/৪৭ ~যোগীদের মধ্যে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা সহকারে আমার(শ্রীকৃষ্ণের) ভজনা করেন। ♦সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টো গীতা ১৫/১৫ আমি(শ্রীকৃষ্ণ) সকলের হৃদয়ে অবস্থান করি তাই সেইসব যোগীদের তথা সকল জীবের হৃদয়ে অবস্থিত অন্তরাত্মা শ্রীকৃষ্ণই। ———————————————————————————————————————————————— শ্রীকৃষ্ণই যোগেশ্বরেশ্বরঃ অনেক সময় সিদ্ধ যোগী(কর্দম মুনি, শুকদেব গোস্বামী) বা পরমেশ্বর ভগবানের শক্ত্যাবেশ অবতার(নারদ, ব্যসদেব, পরশুরাম) অথবা ভগবানের শুদ্ধভক্ত(যাঁরা ইতিমধ্যেই ব্রহ্মভূত স্তর প্রাপ্ত হয়েছেন) তাঁদের ক্ষেত্রেও (ভক্তিযোগেন, সেবতে…..ব্রহ্মভূয়ায়, কল্পতে; গীতাঃ১৪/২৬) “যোগেশ্বর” সম্বোধন ব্যবহৃত হয়। কারণ তাঁরা বিশেষ কার্যসিদ্ধির জন্য পরমেশ্বরের দ্বারা কৃপাপ্রাপ্ত। তাই তাঁরাও পরমেশ্বরের অনন্ত যোগশক্তির ক্ষীয়োদংশ প্রতিফলিত করেন। যেমন শ্রীমদ্ভাগবতের তৃতীয় স্কন্ধে বর্ণিত আছে যে, কর্দম মুনি নিজেকে নয়টি রূপে বিভক্ত করেছিলেন। আবার কখনও শিব, ব্রহ্মা আদি মহান দেবতাদেরকেও মহান যোগী, পরম যোগী, যোগেশ্বর বলা হয়। কেননা তাঁরাও নিরন্তর শ্রীহরির ধ্যানে মগ্ন থাকেন। কপর্দ্দী জটীলো মুণ্ডঃ শ্মশানগৃহসেবকঃ॥ উগ্রব্রতধরো রুদ্রো যোগী পরমদারুণঃ। দক্ষক্রতুহরশ্চৈব ভগনেত্রহরস্তথা॥ নারায়ণাত্মকো জ্ঞেয়ঃ পাণ্ডবেয় যুগে যুগে॥ মহাভারত, শান্তিপর্ব ৩২৭।১৮-২১ অনুবাদ: যিনি বিশাল জটাজুটযুক্ত, শ্মশানবাসী, কঠোরব্রতপরায়ণ, পরমযোগী রুদ্র যিনি দক্ষযজ্ঞ নাশ করেছিলেন, ভগের চোখ উৎপাটন করেছিলেন তিনি নারায়ণের অংশস্বরূপ। দিষ্ট্যা জনার্দন ভবানিহ নঃ প্রতীতো যোগেশ্বরৈরপি দুরাপগতিঃ সুরেশৈঃ। শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৪৮/২৭ অনুবাদঃ হে জনার্দন, আমাদের মহা সৌভাগ্যের দ্বারা এখন আপনি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছেন, কারণ যোগেশ্বরগণ এবং দেবেন্দ্রগণও অতি কষ্টের দ্বারা কেবল এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন। তাই পরমেশ্বর ভগবান এই সমস্ত যোগেশ্বরগণেরও ঈশ্বর। যেমনটা বলা হচ্ছে শ্রীমদ্ভাগবতমে— ন চৈবং বিস্ময়ঃ কার্যো ভবতা ভগবত্যজে। যোগেশ্বরেশ্বরে কৃষ্ণে যত এতদ্বিমুচ্যতে ॥ শ্রীমদ্ভাগবত ১০/২৯/১৬ অনুবাদঃ জন্মরহিত যোগেশ্বরেশ্বর পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে তোমার বিস্মিত হওয়া উচিত নয়। শেষ পর্যন্ত এই ভগবানই জগতকে মুক্তি প্রদান করেন। বীক্ষ্য তান্ বৈ তথাভূতান্ কৃষ্ণো যোগেশ্বরেশ্বরঃ। ঈক্ষয়ামৃতবর্ষিণ্যা স্বনাথান্ সমজীবয়ৎ ॥ শ্রীমদ্ভাগবত ১০/১৫/৫০ অনুবাদঃ সেই যোগেশ্বরগণেরও ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণ সেই সমস্ত ভক্তদের প্রতি অনুকম্পা অনুভব করেছিলেন। এভাবেই তিনি তাঁদের প্রতি তাঁর অমৃতবৎ কৃপাদৃষ্টি বর্ষণের দ্বারা তৎক্ষণাৎ তাঁদের পুনর্জীবিত করেছিলেন। নাসাং দ্বিজাতিসংস্কারো ন নিবাসো গুরাবপি। ন তপো নাত্মমীমাংসা ন শৌচং ন ক্রিয়াঃ শুভাঃ । তথাপি হু্যত্তমঃশ্লোকে কৃষ্ণে যোগেশ্বরেশ্বরে। ভক্তির্দৃঢ়া ন চাম্মাকং সংস্কারাদিমতামপি ॥ শ্রীমদ্ভাগবত ১০/২৩/৪৩-৪৪ অনুবাদঃ এই নারীগণের কখনও উপনয়নাদি সংস্কার হয়নি, তারা ব্রহ্মচারীরূপে গুরুর আশ্রমে বাস করেনি, তারা কোনও তপশ্চর্যার অনুষ্ঠান করেনি, তারা আত্মার বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে বিচার-বিশ্লেষণ করেনি, শৌচাচার অথবা পুণ্য ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানেও যুক্ত নয়, তবুও উত্তমশ্লোক ও যোগেশ্বরেরও ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাদের দৃঢ় ভক্তি রয়েছে। পক্ষান্তরে, এই সমস্ত প্রক্রিয়ার অনুষ্ঠান করেও ভগবানের প্রতি আমাদের এরূপ ভক্তি নেই। যুধিষ্ঠির উবাচ কিং ন আচরিতং শ্রেয়ো ন বেদাহমধীশ্বর। যোগেশ্বরাণাং দুর্দর্শো যন্নো দৃষ্টঃ কুমেধসাম্ ॥ শ্রীমদ্ভাগবত: ১০/৫৮/১১ অনুবাদঃ রাজা যুধিষ্ঠির বললেন-হে অধীশ্বর, আমি জানি না, আমরা মূর্খেরা কোন্ পুণ্যকর্ম করেছি যার ফলে যোগেশ্বরগণেরও দুর্লভদর্শন আপনাকে আমরা দর্শন করতে পারছি। নৃগ রাজার প্রার্থনা সত্বং কথং মম বিভোেহক্ষিপথঃ পরাত্মা যোগেশ্বরৌঃ শ্রুতিদৃশামলহৃদ্বিভাব্যঃ । সাক্ষাদধোক্ষজ উরুব্যসনান্ধবুদ্ধেঃ স্যান্মেহনুদৃশ্য ইহ যস্য ভবাপবর্গঃ ৷৷ শ্রীমদ্ভাগবত: ১০/৬৪/২৬ অনুবাদঃ হে সর্বশক্তিমান, এখানে আমার সামনে আমার দু’নয়ন আপনাকে দর্শন করছে, এটা কিভাবে সম্ভব হল? আপনি পরমাত্মা, যাকে মহা-যোগেশ্বরগণ তাঁদের শুদ্ধ-অন্তরে কেবলমাত্র চিন্ময় বেদনয়নের মাধ্যমেই ধ্যান করেন। তা হলে, হে অধোক্ষজ, জাগতিক জীবনের দুঃসহ দুর্বিপাকে আমার বুদ্ধি অক্ষম হয়ে পড়লেও কিভাবে আপনি প্রত্যক্ষরূপে আমার দৃষ্টি গোচর হলেন? যিনি এই পৃথিবীতে তাঁর জড় জাগতিক বন্ধন ছিন্ন করেছেন, কেবলমাত্র তিনিই তো আপনাকে দর্শনে সমর্থ হন। ———————————————————————————————————————————————– অনেকেই আবার মনে করেন “শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর গীতার জ্ঞান ভুলে গিয়েছিলেন। তাই তিনি পুনরায় যোগযুক্ত হয়ে “অনুগীতা” প্রদান করেছিলেন।” এর খণ্ডন/উওর দেওয়া হয়েছে লিংকঃ https://svadharmam.com/does-krishna-forgot-the-transendental-knowledge/ ———————————————————————————————————————————————— শ্রীকৃষ্ণের চেয়ে উত্তম যোগী কেউ নেইঃ যেহেতু পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ এই জগতে ধর্ম সংস্থাপনের জন্য যুগে যুগে অবতরণ করেন তাই তিনি লোকশিক্ষার জন্য (যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠ, গীতাঃ৩/২১) বহুবিধ যাগ-যজ্ঞ, তপস্যা, বিদ্যানুশীলন, গুরুগ্রহণ ও নানা সামাজিক অনুষ্ঠান করেন। এবং যেহেতু তাঁর আরেক নাম অসমোর্ধ তাই তিনি যে আচরণই করেন না কেন তা নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ। তাই তিনি শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, শ্রেষ্ঠ বন্ধু, শ্রেষ্ঠ সন্তান, শ্রেষ্ঠ শিষ্য এবং শ্রেষ্ঠ যোগীও। কৃষ্ণ কৃষ্ণ মহাযোগিন্ বিশ্বাত্মন্ বিশ্বভাবন। প্রপন্নাং পাহি গোবিন্দ শিশুভিশ্চাবসীদতীম্ ৷৷ শ্রীমদ্ভাগবত ১০।৪৯।১১ অনুবাদঃ কৃষ্ণ, কৃষ্ণ। হে পরম যোগী! হে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরমাত্মা ও রক্ষক। হে গোবিন্দ! দয়া করে আপনার শরণাগত আমাকে রক্ষা করুন। সর্বং নরবরশ্রেষ্ঠৌ সর্ববিদ্যাপ্রবর্তকৌ। সকৃন্নিগদমাত্রেণ তৌ সঞ্জগৃহতুনূপ ॥ শ্রীমদ্ভাগবত
রাসলীলা’র অন্তর্নিহিত তাৎপর্য-(২য় পর্ব)

আপ্তকাম, হৃষিকেশ(ইন্দ্রিয়াধিপতি), জগৎপতি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সর্বোৎকৃষ্ট নর-লীলা ‘রাস’।যা ইন্দ্রিয়তর্পণপরায়ণ সাধারণ মানুষের কাম-ক্রীড়ার মতো মনে হলেও বস্তুত তা জড়াতীত। কেননা এই ‘রাস’ কীর্তনের শ্রোতা-বক্তা উভয়েই ছিলেন সুব্রত(নিষ্ঠা সহকারে ব্রহ্মচর্য ব্রতাদি পালনকারী)। উন্নতস্তরের মানুষের কাছে সহজেই বোধগম্য যে, ভগবানের অপ্রাকৃত লীলাবিলাস বিষয়ে অজ্ঞ মানুষদের মনেই কেবল এই সকল সন্দেহের উদয় হবে। তাই অনাদিকাল থেকেই মহান ঋষিবর্গ ও পরীক্ষিৎ মহারাজের মতো উন্নত রাজারা ভাবীকালের জন্য প্রামাণ্য উত্তর প্রস্তুত রাখবার উদ্দেশ্যে এই সমস্ত প্রশ্ন প্রকাশ্যেই উত্থাপন করেছিলেন। এ পর্বে আমরা শুকদেব-পরীক্ষিত মহারাজের সেই কথোপকথন শ্রবণ করবো। যা আলোচিত হয়েছে শ্রীমদ্ভাগবত এর ১০/৩৩/২৬-৩৬ শ্লোকে। শ্রীপরীক্ষিদুবাচ সংস্থাপনায় ধর্মস্য প্রশমায়েতরস্য চ । অবতীর্ণো হি ভগবানংশেন জগদীশ্বরঃ ॥ ২৬ ॥ স কথং ধর্মসেতুনাং বক্তা কর্তাভিরক্ষিতা। প্রতীপমাচরদ্ ব্রহ্মন্ পরদারাভিমর্শনম্ ॥ ২৭ ॥ অন্বয়: শ্রীপরীক্ষিৎ উবাচ – শ্রীপরীক্ষিৎ মহারাজ বললেন; সংস্থাপনায় – স্থাপন করার জন্য; ধর্মস্য – ধর্মের, প্রশমায় – দমন করার জন্য; ইতরস্য – অধর্মের; চ – এবং, অবতীর্ণঃ – অবতরণ করেন (পৃথিবীতে); হি – বস্তুত; ভগবান্ – পরমেশ্বর ভগবান; অংশেন – তাঁর অংশপ্রকাশ (শ্রীবলরাম) সহ; জগৎ – সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের, ঈশ্বরঃ – প্রভু; সঃ – তিনি; কথম্ – কিভাবে; ধর্ম-সেতুনাম্ – ধর্ম-মর্যাদার; বক্তা – বক্তা, কর্তা – কর্তা; অভিরক্ষিতা – স্বাক্ষক, প্রতীপম্ – বিপরীত; আচরৎ – আচরণ করলেন; ব্রাহ্মন্ – হে ব্রাহ্মহ্মণ, শুকদেব গোস্বামী, পর – অন্যদের, দার – পত্নীদের, অভিমর্শনম্ – স্পর্শ করলেন। অনুবাদ: পরীক্ষিৎ মহারাজ বললেন-হে ব্রাহ্মণ, যিনি পরমেশ্বর ভগবান, জগদীশ্বর, ধর্ম সংস্থাপন ও অধর্মের বিনাশের জন্য যাঁর অংশপ্রকাশ সহ এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে যিনি সমাজধর্মের মূল বক্তা, কর্তা ও সংরক্ষক, তিনি তা হলে কিভাবে পরস্ত্রীদের স্পর্শ করে প্রতিকূল আচরণ করলেন? ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য: শুকদেব গোস্বামী যখন বলছিলেন, তখন পরীক্ষিৎ মহারাজ লক্ষ্য করলেন যে, গঙ্গাতীরের সেই সমাবেশে উপবিষ্ট কিছু ব্যক্তি ভগবানের কার্যাবলী সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করছিলেন। এই সকল সন্দেহগ্রস্ত ব্যক্তিরা ছিল কর্মী, জ্ঞানী ও অন্যান্যরা, যারা ভগবানের ভক্ত নয়। তাদের সেই সন্দেহগুলি নিরসনের জন্য তাদের পক্ষ থেকে পরীক্ষিৎ মহারাজ এই প্রশ্নটি করেছিলেন। আপ্তকামো যদুপতিঃ কৃতবান্ বৈ জুগুপ্সিতম্। কিমভিপ্রায় এতন্নঃ সংশয়ং ছিন্ধি সুব্রত ॥ ২৮ ॥ অন্বয় আপ্তকামঃ-আত্ম-তৃপ্ত, যদুপতি- যদু বংশের অধিপতি, কৃতবান্- করলেন, বৈ-অবশ্যই। জুগুস্পিতম্-এই ধরনের নিন্দনীয়, কিম্-অভিপ্রায়ঃ-কি উদ্দেশ্যে, এতৎ-এই। নঃ-আমাদের, সংশয়ম্- সন্দেহ; ছিদ্ধি- ছেদন করুন, সুব্রত- হে নিষ্ঠাবান ব্রতপালনকারী। অনুবাদ হে নিষ্ঠাবান ব্রহ্মচারী, আত্মতৃপ্ত যদুপতি কি উদ্দেশ্যে এই ধরনের নিন্দিত আচরণ করেন, দয়া করে তা বর্ণনা করে আমাদের সন্দেহ অঞ্জন করুন। তাৎপর্য উন্নতস্তরের মানুষের কাছে সহজেই বোধগম্য যে, ভগবানের অপ্রাকৃত লীলাবিলাস বিষয়ে অজ্ঞ মানুষদের মনেই কেবল এই সকল সন্দেহের উদয় হবে। তাই অনাদিকাল থেকেই মহান ঋষিবর্গ ও পরীক্ষিৎ মহারাজের মতো উন্নত রাজারা ভাবীকালের জন্য প্রামাণ্য উত্তর প্রস্তুত রাখবার উদ্দেশ্যে এই সমস্ত প্রশ্ন প্রকাশ্যেই উত্থাপন করেছিলেন। শ্রীশুক উবাচ ধর্মব্যতিক্রমো দৃষ্ট ঈশ্বরাণাঞ্চ সাহসম্। তেজীয়সাং ন দোষায় বহ্নেঃ সর্বভুজো যথা ॥ ২৯ ॥ অন্বয় শ্রীশুকঃ উৰাচ-শ্রীল শুকদেব গোস্বামী বললেন, ধর্ম-ব্যতিক্রমঃ–ধর্মনীতির ব্যতিক্রম; দৃষ্টঃ-দেখা যায়, ঈশ্বরাণাম্- শক্তিশালী নিয়ন্তাগণের, চ-ও, সাহসম্-দুঃসাহস, তেজীয়সাম্-চিন্ময়ভাবে তেজস্বী, ন-না, দোষায়-দোষের; বহ্নেঃ -অগ্নির; সর্ব-সর্ব, ভুজঃ-ভক্ষণ; যথা-যেমন। অনুবাদ শ্রীশুকদেব গোস্বামী বললেন-ঐশ্বরিক শক্তিমান নিয়ন্তাদের কার্যকলাপের মধ্যে আমরা আপাতদৃষ্টিতে সমাজনীতির দুঃসাহসিক ব্যতিক্রম লক্ষ্য করলেও, তাতে তাঁদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় না, কারণ তাঁরা আগুনের মতোই সর্বভুক হলেও নির্দোষ হয়ে থাকেন। তাৎপর্য মহান তেজস্বী ব্যক্তিত্বগণ আপাতদৃষ্ট সমাজনীতি লঙ্ঘনের ফলে অধঃপতিত হন না। শ্রীধর স্বামী এই প্রসঙ্গে অন্যত্র ব্রহ্মা, ইন্দ্র, সোম, বিশ্বামিত্র ও অন্যান্যদের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। আগুন সবকিছুই ভক্ষণ করে, কিন্তু তার ফলে আগুনের প্রকৃতির কোন পরিবর্তন হয় না। তেমনই, মহান ব্যক্তির আচরণের কোনও অনিয়ম হলেও তাঁর মর্যাদাহানি হয় না। যাই হোক, পরবর্তী শ্লোকে শুকদেব গোস্বামী সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করেছেন যে, আমরা যদি ব্রহ্মাণ্ড শাসনকারী শক্তিমান পুরুষদের অনুকরণ করার চেষ্টা করি, তবে তার ফল হবে ভয়াবহ। নৈতৎ সমাচরেজ্জাতু মনসাপি হ্যনীশ্বরঃ। বিনশ্যত্যাচরন্মৌঢ্যাদ্ যথারুদ্রোহব্ধিজং বিষম্ ॥ ৩০ ॥ অন্বয় ন-না, এতৎ- এই; সমাচরেৎ-অনুষ্ঠান করা উচিত; জাতু-কখনও; মনসা-মনে মনে; অপি-ও; হি-নিশ্চিতভাবে, অনীশ্বরঃ- যে ঈশ্বর নয়, বিনশ্যতি-বিনাশ প্রাপ্ত হয়; আচরন মৌঢ্যাৎ-মূঢ়তা প্রযুক্ত আচরণ করে; যথা-যেমন; অরুদ্রঃ-যে রুদ্রদেব নয়; অব্ধিজম্- সমুদ্র হতে উৎপন্ন; বিষম্-বিষ। অনুবাদ যে ঈশ্বর নয়, তার কখনই মনে মনেও ঈশ্বরের আচরণের অনুকরণ করা উচিত নয়। যদি মুঢ়তাবশত কোনও সাধারণ মানুষ এই ধরনের আচরণের অনুকরণ করে, তা হলে সে নিজেকেই কেবল ধ্বংস করবে, যেমন রুদ্রদেব না হয়েই রুদ্রের মতো সমুদ্রপরিমাণ বিষ পান করার চেষ্টার ফলে মানুষ নিজেকেই বংস করে। তাৎপর্য রুদ্র অর্থাৎ ভগবান শিব একবার সমুদ্রপরিমাণ বিষ পান করেছিলেন, আর তার ফলে এক আকর্ষণীয় নীল চিহ্ন তাঁর কণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু আমরা যদি তেমন বিষের এক ফোঁটাও পান করি, আমরা সঙ্গে সঙ্গে মারা যাব। তাই আমাদের যেমন শিবের লীলা অনুকরণ করা উচিত নয়, তেমনি গোপীগণের সঙ্গে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাদিও অনুকরণ করা উচিত নয়। আমাদের পরিষ্কারভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে যে, ধর্মসংস্থাপনের জন্য অবতীর্ণ ভগবান কৃষ্ণ আমাদের কাছে প্রতিপাদন করার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে যে, নিশ্চিতভাবে তিনিই ভগবান, আমরা নই। সেটি অবশ্যই স্পষ্টভাবে প্রদর্শিত হওয়া উচিত। ভগবান তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তির সঙ্গে উপভোগ করেন আর এইভাবে আমাদের পারমার্থিক স্তরে আকর্ষণ করেন। আমাদের কৃষ্ণকে অনুকরণ করার চেষ্টা করা উচিত নয়, কারণ তা হলে অপরিসীম দুঃখ পেতে হবে। ঈশ্বরাণাং বচঃ সত্যং তথৈবাচরিতং ক্বচিৎ। তেষাং যৎ স্ববচোযুক্তং বুদ্ধিমাংস্তৎ সমাচরেৎ ॥ ৩১ ॥ অন্বয় ঈশ্বরাণাম্-পরমেশ্বর ভগবানের শক্তি প্রদত্ত সেবক, বচঃ-কথা; সত্যম্- সত্য, তথা এব-ও, আচরিতম্- তারা যা করে, কচিৎ-কখনও, তেষাম্-তাদের। যৎ- যাঃ স্ব বচঃ –তাদের নিজ কথার সঙ্গে, যুক্তম- সামঞ্জস্যপূর্ণ, বুদ্ধিমান- যিনি বুদ্ধিমান; তৎ-সেই, সমাচরেৎ-পালন করা উচিত। অনুবাদ পরমেশ্বর ভগবানের শক্তিপ্রদত্ত সেবকদের কথা সকল সময়েই সত্য আর সেই কথার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তাঁদের আচরণ অনুকরণযোগ্য। অতএব তাঁদের নির্দেশ পালন করা বুদ্ধিমান ব্যক্তিগণের উচিত। তাৎপর্য ঈশ্বর শব্দটাকে সচরাচর সংস্কৃত অভিযানে “প্রভু, পরিচালক, রাজ্য” এবং “সমর্থ, সম্পাদনে ক্ষমতাসম্পন্ন” রূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। শ্রীল প্রভুপাদ সাধারণত ঈশ্বর শব্দটিকে “নিয়ন্তা” রূপে অনুবাদ করতেন যা চমৎকারভাবে “পরিচালক বা রাজা” এবং “সমর্থ ব্য সম্পাদনে ক্ষমতাসম্পন্ন” মুখ্যত এই দুই প্রাথমিক ধারণারই সমন্বয় সাধন করে। কোনও পরিচালক অযোগ্য হতে পারেন কিন্তু একজন নিয়ন্ত্রক হন তিনিই, যিনি প্রভু বা পরিচালকরূপে প্রকৃতপক্ষে ঘটনাটিকে সংঘটিত করান। সর্বকারণের পরম কারণ ভগবান কৃষ্ণ নিশ্চিতভাবেই তাই পরমনিয়ন্তা বা পরমেশ্বর। ঈশ্বর বা শক্তিমান পুরুষেরা যে আমাদের ব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করেন, সেই বিষয়ে সাধারণ মানুষেরা, বিশেষত পশ্চিমী দেশগুলিতে সচেতন নন। ব্রহ্মাণ্ড সম্বন্ধে আধুনিক নির্বিশেণবাদী ধারণা অনুযায়ী বর্ণনা করা হয় যে, প্রাণহীন মহাজগতে পৃথিবী অনর্থক ভাসছে। এইভাবে আমরা জীবনের এক অনিশ্চিত চরম লক্ষ্য নিয়েই নিজেদের সংরক্ষণ করছি আর বংশরক্ষার প্রক্রিয়ায় জন্ম দিচ্ছি এবং পরের পর নিজস্ব ‘চরম লক্ষ্য’ সংরক্ষণ ও জন্মদানের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থেকে একটি অর্থহীন ঘটনাশৃঙ্খল বা ধারা তৈরি হয়ে চলেছে। অজ্ঞ জড়বাদীদের উদ্ভাবিত এই ধরনের নিখালা এবং অর্থহীন জগতের তুলনায় যে প্রকৃত মহা-জগৎ রয়েছে, তা জীবন প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ এবং সবিশেষ ব্যক্তি জীবন এবং প্রকৃতপক্ষে ভগবানের অস্তিত্বে পরিপূর্ণ, যে ভগবান এই সকল অস্তিত্ব ধারণ করে আছেন ও পালন করছেন। পরমেশ্বর