বসুদেবের পুত্র শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর হোন কিভাবে?

অনেকেই এর প্রশ্ন করেন যে, “পরমেশ্বর হচ্ছেন সকল কিছুর উৎস। তিনিই আদিপুরুষ। তবে তাঁর পিতা-মাতা থাকতে পারে কি করে?” উত্তরঃ দেখুন, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই ভগবদ্গীতায় বলেছেন— পিতাহমস্য জগতো মাতা ধাতা পিতামহঃ । বেদ্যং পবিত্রম্ ওঙ্কার ঋক্ সাম যজুরেব চ ॥ গীতাঃ ৯/১৭ অনুবাদ : আমিই এই জগতের পিতা, মাতা, বিধাতা ও পিতামহ৷ আমি জ্ঞেয় বস্ত্ত, শোধনকারী ও ওঙ্কার৷ আমিই ঋক্, সাম ও যজুর্বেদ। অর্থাৎ, যদি কেউ তাঁর পিতা হোন, তবে তিনি তাঁর পিতারও পিতা অর্থাৎ পিতামহ। সেই পরম সত্য আরও দৃঢ়ভাবে স্থাপন করেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ-পিতা বসুদেব। শ্রীকৃষ্ণের কাছে বসুদেব যে প্রার্থনা করেছেন তার দ্বারাই এই তত্ত্ব সহজে হৃদয়ঙ্গম করা যাবে। শ্রীমদ্ভাগবতে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের কাছে বসুদেবের প্রার্থনা; বেশ কয়েক জায়গায় উল্লেখ আছে। তন্মধ্যে কংসের কারাগারে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের সময় ও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে “সূর্যগ্রহণ” এর সময় যখন কুরু, যাদব, বৃষ্ণিবংশীয় সকলে কুরুক্ষেত্রের পবিত্র তীর্থস্থানে সমবেত হয়েছিলেন তখনও বসুদেব এমন স্তুতি করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণের কাছে। বসুদেব কতৃক শ্রীকৃষ্ণের স্তুতিঃ শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের ৮৫তম অধ্যায়ে এই ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। “কিভাবে শ্রীবলরাম সহ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পিতাকে দিব্য জ্ঞান প্রদান করেছিলেন, তাঁর মাতার মৃত পুত্রদের উদ্ধার করেছিলেন, এই অধ্যায়ে তা বর্ণনা করা হয়েছে। দর্শনার্থী ঋষিরা শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা করছেন শ্রবণ করে বসুদেব তাঁকে ও বলরামকে তাঁর পুত্ররূপে গণ্য করা থেকে বিরত হয়ে পরমেশ্বর ভগবানরূপে তাঁর সর্বশক্তিমানতা, সর্ববিরাজমানতা ও সর্বজ্ঞতার স্তুতি করলেন। তাঁর পুত্রদ্বয়ের মহিমা কীর্তনের পর বসুদেব শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে পতিত হলেন এবং তিনি যে তাঁর পুত্র, এই ধারণা দূর করার জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করলেন। পরিবর্তে, শ্রীকৃষ্ণ বসুদেবকে ভগবৎ-বিজ্ঞানের শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে সেই ধারণাটির পুনরুদ্ধার করলেন এবং সেই সকল নির্দেশ শ্রবণ করে বসুদেব শান্ত ও সন্দেহমুক্ত হলেন। ” কৃষ্ণ কৃষ্ণ মহাযোগিন্ সঙ্কর্ষণ সনাতন। জানে বামস্য যৎ সাক্ষাৎ প্রধানপুরুষৌ পরৌ ॥ ৩ ॥ অনুবাদঃ [বসুদেব বললেন–]হে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ, মহাযোগী, হে সনাতন-স্বরূপ সঙ্কর্ষণ, আমি জানি যে আপনারা দুজন হচ্ছেন ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও সৃষ্টির উপাদান সমূহের কারণ স্বরূপ। যত্র যেন যতো যস্য যস্মৈ যদ্যদ্যথা যদা। স্যাদিদং ভগবান্ সাক্ষাৎ প্রধান পুরুষেশ্বরঃ । ৪ ॥ অনুবাদঃ আপনি পরমেশ্বর ভগবান যিনি প্রকৃতি ও প্রকৃতির স্রষ্টা (মহাবিষ্ণু) উভয়ের অধীশ্বররূপে প্রকাশিত হন। যা কিছু বর্তমান, যেভাবে এবং যখনই তা উৎপন্ন হয়, তা আপনার মধ্যে, আপনার দ্বারা, আপনার থেকে, আপনার উদ্দেশ্যে এবং আপনার সম্বন্ধে সৃষ্ট হয়। এতন্নানাবিধং বিশ্বমাত্মসৃষ্টমধোক্ষজ। আত্মনানুপ্রবিশ্যাত্মন্ প্রাণো জীবো বিভর্য্যজ ॥ ৫ ॥ অনুবাদঃ হে অধোক্ষজ, আপনার থেকে আপনি এই সমগ্র বিচিত্র বিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন এবং তারপর আপনার পরমাত্মা স্বরূপে তার মধ্যে আপনি প্রবেশ করেছেন। হে জন্মরহিত পরমাত্মা, এইভাবে সকলের প্রাণ ও জ্ঞানরূপে আপনি সৃষ্টিকে পালন করছেন। অনুবাদঃ প্রাণ ও বিশ্বসৃষ্টির অন্যান্য পদার্থসমূহ যে শক্তিই প্রদর্শন করুক না কেন প্রকৃতপক্ষে তা সকলই পরমেশ্বর ভগবানের নিজ শক্তি কারণ প্রাণ ও বস্তু উভয়ই তাঁর অধীন ও তাঁর উপর নির্ভরশীল এবং পরস্পর হতে ভিন্নও। এইভাবে, জড়জগতে সক্রিয় সমস্ত কিছুই পরমেশ্বর ভগবান দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ৬।। অনুবাদঃ চন্দ্রের দীপ্তি, অগ্নির তেজ, সূর্যের প্রভা, নক্ষত্রসমূহের ঝিকিমিকি, বিদ্যুতের ঝলকানি, পর্বতের স্থিরত্ব এবং ভূমির আধার শক্তি ও গন্ধ-এই সমস্ত কিছু প্রকৃতপক্ষে আপনি। ৭।। অনুবাদঃ হে প্রভু, আপনি জল ও জলের স্বাদ এবং তৃষ্ণার তৃপ্তিজনক শক্তি ও জীবন প্রদাতা। আপনি বায়ুর ওজ, বল, চেষ্টা ও গতিরূপে প্রকাশিত হওয়ার মাধ্যমে নিজের শক্তিসমূহ প্রদর্শন করেন। ৮।। অনুবাদঃ আপনি দিকসমূহ ও তাদের সমন্বয়কারী শক্তি, সর্বব্যাপ্ত আকাশ ও তদাশ্রয় শব্দ-তন্মাত্র। আপনি আদি নাদ, বর্ণ, ওম এবং শ্রাব্য ভাষা যে শব্দ দ্বারা নির্দিষ্ট বিষয়সমূহ বাক্যরূপ প্রাপ্ত হয়। ৯।। অনুবাদঃ আপনি ইন্দ্রিয়সমূহের বিষয় প্রকাশিকা শক্তি, তাদের অধিষ্ঠাতৃ দেবতা এবং এই সকল দেবতাদের অধিষ্ঠান শক্তি। আপনি বুদ্ধির মীমাংসা শক্তি এবং জীবের যথার্থ প্রতিসন্ধান শক্তি। ১০।। অনুবাদঃ আপনি জড় উপাদান সমূহের কারণ স্বরূপ তামসিক অহঙ্কার; আপনি দেহজ ইন্দ্রিয়সমূহের কারণ-স্বরূপ রাজসিক অহঙ্কার; আপনি সকল দেবতাদের কারণস্বরূপ সাত্ত্বিক অহঙ্কার এবং আপনি সমস্ত কিছুর ভিত্তিস্বরূপ অপ্রকাশিত সামগ্রিক জড়াশক্তি। ১১।। অনুবাদঃ মূল বস্তু থেকে প্রস্তুত রূপান্তরিত দ্রব্যের উপাদানসমূহ যেমন অপরিবর্তিত দৃশ্যমান হয়, তেমনই আপনিও এই জগতের সকল নম্বর বস্তুর মধ্যে একমাত্র অবিনশ্বর সত্তা। ১২।। অনুবাদঃ সত্ত্ব, রজ, তম নামক জড়া প্রকৃতির গুণসমূহ তাদের সামগ্রিক কার্যসমূহ সহ আপনার যোগমায়ার সুবিন্যস্ততা দ্বারা পরমব্রহ্মস্বরূপ আপনার মধ্যে সাক্ষাৎ প্রকাশিত। ১৩।। অনুবাদঃ এইভাবে এইসকল সৃষ্ট বস্তু, জড়াপ্রকৃতির রূপান্তর সমূহ, একমাত্র যখন জড়াপ্রকৃতি তাদেরকে আপনার মধ্যে প্রকাশ করে তখন ছাড়া বিদ্যমান থাকে না, সেই সময় আপনিও তাদের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করেন। কিন্তু সৃষ্টির এরূপ একান্ত সময় ব্যতীত, আপনিই একমাত্র পরমার্থস্বরূপ রূপে বিরাজিত থাকেন। ১৪।। অনুবাদঃ এই জগতের জাগতিক গুণাবলীর অনবরত প্রবাহ মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যারা আপনাকে, সমস্ত কিছুর তারা প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞ। পরমাত্মা, তাদের পরম শ্রেষ্ঠ গতিরূপে জানতে ব্যর্থ হয়, তাদের অজ্ঞতার জন্য জাগতিক কর্মবন্ধন এরূপ আত্মাদের জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ভ্রমণ করতে বাধ্য করে। ১৫।। অনুবাদঃ সৌভাগ্যক্রমে আত্মা এক সুস্থ মানব জীবন প্রাপ্ত হবার দুর্লভ সুযোগ প্রাপ্ত হতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার পক্ষে কোনটি শ্রেয় সেই বিষয়ে যদি সে বিভ্রান্ত হয়, হে ভগবান, আপনার মোহিনী মায়া তার সমগ্র জীবন নষ্ট করার জন্য তাকে প্রভাবিত করবে। ১৬।। অনুবাদঃ আপনি এই সমগ্র জগতকে স্নেহ রজ্জু দ্বারা বন্ধন করেন আর মানুষ যখন তাদের জড় দেহ বিষয়ে বিবেচনা করে, তারা মনে করে যে “এই আমি” এবং যখন তারা তাদের সন্তান ও অন্যান্য সম্পর্কিত বিষয়ে বিবেচনা করে তারা মনে করে “এই সকলই আমার”। ১৭।। অনুবাদঃ আপনারা দুইজন বস্তুত আমাদের পুত্র নন, পরন্তু ভূভারভূত ক্ষত্রিয়দের বিনাশার্থ আপনারা প্রকৃতি পুরুষের ঈশ্বর হয়েও মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন, যা আপনি জন্মসময়ে বলেছিলেন। ১৮।। অনুবাদঃ অতএব, হে দীনবন্ধু, এখন আমি আপনার পাদপদ্মের শরণাগত হয়েছি যে পাদপদ্ম সকল শরণাগতজনের সংসারভয় দূরীভূত করে। যথেষ্ট ইন্দ্রিয় উপভোগের লালসা, যা আমাকে এই মর্ত্যশরীরে আত্মবুদ্ধিযুক্ত করেছে। তাই হে ভগবান, আপনাকে আমার পুত্র বলে মনে করেছি। ১৯।। অনুবাদঃ প্রকৃতপক্ষে সূতিকাগৃহে অবস্থানের সময়ে আপনি আমাদের বলেছিলেন যে, আপনি জন্মরহিত ভগবান, পূর্ববর্তী যুগেও কয়েকবার আমাদের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আপনার নিজ ধর্ম রক্ষার্থে এই সকল দিব্য দেহসমূহ প্রকাশের পর আপনি তাদের অন্তর্হিত করেন, এইভাবে আপনি মেঘের মতো প্রকাশিত ও অন্তর্হিত হন। হে পরম-বন্দিত সর্বব্যাপ্ত ভগবান, আপনার ঐশ্বর্যময় বিস্তারের অতীন্দ্রিয় মোহিনী-শক্তিকে কে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে? ২০।। অতএব, শ্রীকৃষ্ণ-পিতা বসুদেব স্বয়ং স্বীকার করলেন যে, প্রকৃতপক্ষে শ্রীকৃষ্ণ তার পুত্র নন, বরং তিনিই সৃষ্টির উৎস, পালক ও সংহারক। একই প্রার্থনা তিনি করেছিলেন কংসের কারাগারে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের সময়। তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের(বসুদেব-দেবকী) পূর্বজন্মের ইতিহাস শুনিয়েছিলেন। কোন্ তপস্যার বলে তাঁরা কৃষ্ণকে তাঁদের পুত্ররূপে লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। যা শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের তৃতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে। আগ্রহী পাঠকগণ তা পড়ে দেখতে পারেন। এইভাবে প্রমাণিত হলো যে, বসুদেবের পুত্র হলেও শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর ভগবান এবং শ্রীকৃষ্ণ কীভাবে যুগপৎ পিতা ও পিতামহের ভূমিকা পালন করেন। হরে কৃষ্ণ। প্রচারেঃ স্বধর্মম্ ™
ভগবদ্গীতা সম্বন্ধে প্রক্ষিপ্তবাদের প্রতিবাদ

দেশের ও বিদেশের অনেক মনস্বীই বলিয়া থাকেন যে, ভগবদ্গীতা মহাভারতের ভীষ্মপর্বে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। এ সম্বন্ধে গীতার প্রারম্ভেই কিছু আলোচনা করা একান্ত উচিত মনে করিয়া বাদী ও প্রতিবাদীর উক্তি-প্রত্যুক্তিচ্ছলে তাহা এস্থানে লিপিবদ্ধ করা হইল। প্রক্ষিপ্তবাদী: মহাশয়! ভগবদ্গীতাটা যে ভীষ্মপর্কে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে, তাহা জানেন? প্রতিবাদী: কি করিয়া জানিব; কাহাকেও প্রক্ষিপ্ত করিতে দেখি নাই, শুনা কথারও কোন মূল্য নাই, প্রক্ষেপের যুক্তিও খুঁজিয়া পাই না। প্রক্ষিপ্তবাদী: কেন প্রক্ষেপের যুক্তি খুঁজিয়া পাইবেন না, ভীষ্মপর্বের যে স্থানে গীতা সন্নিবেশিত আছে, সে স্থানে গীতা উঠিবার কোন প্রসঙ্গই নাই। প্রতিবাদী: প্রসঙ্গ নাই একথা আমরা স্বীকার করিতে পারি না। কারণ, কুরুপাণ্ডব-উভয়পক্ষ যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত হইয়া কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়াছেন এবং ভীষ্ম কুরুপক্ষের প্রধান সেনাপতির পদ গ্রহণ করিয়াছেন ইত্যাদি সমস্ত ঘটনাই ধৃতরাষ্ট্র জানেন এবং যুদ্ধের সমগ্র বৃত্তান্ত জানিয়া আসিয়া তাহা বলিবার জন্য সঞ্জয়ের উপরে আদেশও করিয়াছেন। এই অবস্থায় দশম দিনের যুদ্ধে ভীষ্ম নিপতিত হইলে, সঞ্জয় আসিয়া ধৃতরাষ্ট্রের নিকট বলিলেন-“মহারাজ! ভীষ্ম আজ শিখণ্ডীর হন্তে যুদ্ধে নিপতিত হইয়াছেন” ইহা শুনিয়া ধৃতরাষ্ট্র বহুতর বিলাপ করিয়া যুদ্ধের আদ্যন্ত বৃত্তান্ত শুনিবার ইচ্ছায় সঞ্জয়ের নিকট জিজ্ঞাসা করিলেন- “আমার পুত্রেরা ও পাণ্ডবেরা যুদ্ধ করিবার ইচ্ছায় কুরুক্ষেত্রে সমবেত হইয়া প্রথমে কি করিলেন?” ধৃতরাষ্ট্রের এই প্রশ্নই ত গীতা উঠিবার প্রসঙ্গ। এইরূপ প্রসঙ্গ লইয়াই ত মহাভারতের এবং অন্যান্য উপাখ্যানময় গ্রন্থের উপাখ্যানগুলি উঠিয়াছে। প্রক্ষিপ্তবাদীঃ সে যাহা হউক, উভয়পক্ষের যোদ্ধারাই অস্ত্র শস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া আপন আপন সেনাপতির আদেশের প্রতীক্ষা করিতেছেন, সে আদেশ হইলেই যুদ্ধ আরম্ভহয়। এমন সময়ে উভয় সৈন্তের মধ্যস্থানে থাকিয়া পাওবপক্ষের প্রধান সহায় কৃষ্ণ গীতা বলিতে আরম্ভ করিলেন, আর প্রধান যোদ্ধা অর্জুন তাহা শুনিতে থাকিলেন। ‘ধান ভাণতে মহীপালের গীত আরম্ভ হইয়া গেল’ মহাযুদ্ধারম্ভে অধ্যাত্মবিষয়ের আলোচনা চলিতে থাকিল! এমন ঘটনা কি কখনও সম্ভব হইতে পারে? বক্তা ও শ্রোতা উভয়েই নিরুদ্বেগ না হইলে, গীতার মত বিষয়ের আলোচনা হইতেই পারে না। প্রতিবাদীঃ মহাশয়। এই ভীষ্মপর্বেরই প্রথম অধ্যায় পর্যালোচনা করিলে বোধ হয় আপনি এরূপ অসামঞ্জস্যের অবতারণা করিতেন না। উভয়পক্ষ মিলিত হইয়া যুদ্ধের প্রারম্ভে যে সকল নিয়ম করিয়াছিলেন, তাহা ভীষ্মপর্বের প্রথম অধ্যায়ে লিখিত আছে। তাহার মধ্যে এই কথাটুকুও আছে যে, “সমাভাষ্য প্রহর্ত্তব্যং ন বিশ্বস্তে ন বিহ্বলে’ অর্থাৎ ‘আমরা বলিয়া কহিয়া বিপক্ষের উপরে প্রহার করিব এবং কোন বিপক্ষ বিশ্বস্ত বা বিহ্বল থাকিলে, তাহার উপরে প্রহার করিব না‘। সুতরাং কৃষ্ণ ও অর্জুনের এইরূপ দৃঢ় বিশ্বাসই, ছিল যে, আমাদিগকে না জানাইয়া কেহই প্রহার করিবে না। অতএব কৃষ্ণ ও অর্জুন উভয়েই তখনও নিরুদ্বেগ ছিলেন বলিয়া তাঁহাদের অধ্যাত্মবিষয়ের আলোচনাও সম্ভবপর হইয়াছিল। প্রক্ষিপ্তবাদীঃ মহাশয়। আসামিপক্ষের অনেক উকীলেরই মনে মনে এমন প্রতিজ্ঞা থাকে যে, ‘আমার মক্কেল দোষীই হউন আর নির্দোষই হউন, আমি তাঁহাকে নির্দোষ বলিয়াই প্রতিপন্ন করিব’ আপনারও যদি সেইরূপই প্রতিজ্ঞা থাকে যে, আমি গীতাকে মূলগ্রন্থ বলিয়াই প্রতিপন্ন করিব, তাহা হইলে আমার আর আলোচনার প্রয়োজন নাই। প্রতিবাদীঃ ‘গ্রন্থকার জীবিত নাই বা উপস্থিত নাই, গ্রন্থ নিজেও অচেতন পদার্থ বলিয়া কোন প্রতিবাদ করিতে পারিবে না। সুতরাং এই সুযোগে গবেষকনাম বাহির করিয়া লই’ এইরূপ ইচ্ছার বশবর্তী হইয়া আপনারাও যদি মূলগ্রন্থ গীতাকে প্রক্ষিপ্ত বলিতে চান, তাহা হইলে আমারও বিবাদে প্রয়োজন নাই। তবে, সর্বপ্রযত্নে গীতাকে মূলগ্রন্থ বলিয়াই প্রতিপন্ন করিতে হইবে এরূপ কোন প্রতিজ্ঞা আমার নাই বা সেরূপ ইচ্ছাও নাই। প্রক্ষিপ্তবাদীঃ তাহা হইলে বলুন দেখি, যে দুর্য্যোধন বাল্যকাল হইতেই বিদ্বেষের বশবর্তী হইয়া বিষপ্রয়োগ, জলে নিক্ষেপ এবং অগ্নিতে দগ্ধ করিয়া মারিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিয়াছে, সেই দুর্য্যোধন প্রভৃতিরই “সমাভাষ্য প্রহর্ত্তব্যং ন বিশ্বস্তে ন বিহ্বলে” এই কথাটুকুর উপরে বিশ্বাস করিয়া ঐরূপ সময়ে কৃষ্ণ ও অর্জুনের মত লোকচরিত্রাভিজ্ঞ বুদ্ধিমান লোকদের অন্নমনস্ক হওয়া কি সম্ভবপর হয়? প্রতিবাদীঃ অবশ্বই হয়। কেন না, সে সময়ে অসাধারণ ধার্মিক ভীষ্ম কৌরবপক্ষের ‘প্রধান সেনাপতি ছিলেন এবং তিনিও সেই নিয়মপ্রবর্তকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। সুতরাং তাঁহার আদেশ ব্যতীত কৌরবপক্ষের কাহারও কিছু করিবার ক্ষমতা ছিল না। তা’র পর কৃষ্ণ ও অর্জুন কচি খোকা ছিলেন না। উভয়েই অতিরথ ও অদ্বিতীয় মহাবীর ছিলেন একথা সকলেই জানিত। অতএব দৌড়াইয়া যাইয়া তাঁহাদিগকে সংহার করিবার সাহস বা তীর ছুটাইয়া মারিয়া ফেলিবার ভরসা কাহারও হয় নাই, কিংবা তাঁহারাও সেরূপ আশঙ্কা করেন নাই। তাই তাঁহাদের গীতার আলোচনায় অন্তমনস্ক হওয়া অসম্ভর হয় নাই। প্রক্ষিপ্তবাদীঃ আচ্ছা যা হোক। পুরাণরচয়িতা বেদব্যাস চিরকালই সাপের গল্প ও ব্যাঙের গল্প প্রকৃতিই লিখিয়া আসিয়াছেন, এ অবস্থায় তিনি যে গীতার মত সমস্ত সম্প্রদায়ের উপযোগী মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করিতে পারিয়াছিলেন, ইহা কি করিয়া বিশ্বাস করিতে পারি? প্রতিবাদীঃ এইবার আধুনিক রুচির অনুরূপ কথাই বলিয়া ফেলিয়াছেন। প্রক্ষিপ্তবাদীঃ আপনার সেকেলে ধরণের কথা শুনিব বলিয়া। প্রতিবাদীঃ মহাশয়। সে কাল যে হিন্দুর সুবর্ণযুগ ছিল, তাহা জানেন? সে যাহা হউক, বেদব্যাস কেবল পুরাণই রচনা করিয়া যান নাই, তিনি অধ্যাত্মবিষয়ের চরম গ্রন্থ বেদান্তদর্শন এবং পাতঞ্জলভাষ্যপ্রভৃতিও লিখিয়া গিয়াছেন। প্রক্ষিপ্তবাদীঃ তবে কি আপনি মনে করেন যে, বেদব্যাস একজনই ছিলেন? প্রতিবাদীঃ বেদব্যাস একজন বা অনেক জন ছিলেন, এই বিষয় লইয়া আলোচনা করা এ প্রবন্ধের উদেশ্য নহে; তবে এই মাত্র বলিতে পারি যে, এই মহাভারতেরই উদ্যোগপর্ব্বে ‘সানৎসুজাত-‘নামে যে অধ্যাত্মশাস্ত্র দেখিতে পাই, তাহা যদি বেদব্যাস রচনা করিতে পারিয়া থাকেন, তবে এই গীতাও যে তিনি রচনা করিতে পারিয়াছিলেন, এবিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। বেদব্যাসের মত জ্ঞানী লেখক ভারতবর্ষে আর কেহ জন্মিয়াছিলেন বলিয়াও মনে হয় না। প্রক্ষিপ্তবাদীঃ সে যাহা হউক। শুনিতে পাই – জাভাদ্বীপের মহাভারতে নাকি ভগবদ্গীতা নাই। সুতরাং ভগবদ্গীতা যদি মহাভারতের মৌলিক অংশই হইত, তবে জাভাদ্বীপের মহাভারতেও তাহা অবশ্যই থাকিত। প্রতিবাদীঃ অবশ্যই থকিত একথা বলিতে পারেন না। কারণ, জাভাদ্বীপবাসীরা প্রথমে হিন্দু ছিল, মধ্যে বৌদ্ধ হইয়াছিল, পরে মুসলমান হইয়াছে। এ অবস্থায় তাহারা যখন হিন্দু ছিল, তখন তাহাদের মহাভারতে ভগবদ্গীতা ছিল বলিয়াই মনে করা যাইতে পারে; তা’র পর তাহারা যখন বৌদ্ধ এবং মুসলমান হইয়াছিল, সম্ভবতঃ তখন তাহাদের মহাভারত হইতে গীতা এবং ঐরূপ ঈশ্বরের মূর্তিবোধক অংশগুলি নিষ্কাশিত হইয়াছিল। কেন না, বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মতে ঈশ্বরের মূর্ত্তি নাই; অথচ ভগবদ্গীতার বক্তা কৃষ্ণ আপনাকে(নিজেকে) বহু স্থানে ঈশ্বর বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন এবং অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখাইয়া তাহা প্রমাণিতও করিয়াছেন, আবার পার্থসারথিমূর্তিতে সকলের দৃষ্টিগোচরও হইয়াছেন। এ ক্ষেত্রে বৌদ্ধ ও মুসলমানদের ঐ গীতা যে বিরক্তিকর হইবে, তাহাতে আর সন্দেহ কি?। আর এক কথা, জাভাদ্বীপের ভাষায় সে দেশের মহাভারতের যখন অনুবাদ হইয়াছিল, তদবধি তাহাদের মহাভারতে বহু উপাখ্যান নূতন প্রবেশ করিয়াছে, অনেক বিষয় নিষ্কাশিত হইয়াছে এবং বহু স্থান অত্যন্ত বিকৃত হইয়াছে। এ অবস্থায় সে দেশের মহাভারতে গীতা না থাকিলেও তাহা গীতার অমৌলিকতা প্রমাণিত করিতে পারে না। প্রক্ষিপ্তবাদীঃ ভাল। গীতার মৌলিকতা সম্বন্ধে আপনি কোন নির্দোষ যুক্তি দেখাইতে পারেন কি? প্রতিবাদীঃ অবশ্যই পারি। মহাভারতের পূর্বাপর স্থানগুলি পর্যালোচনা করিয়া দেখিলে দেখা যাইবে যে, অন্যান্য স্থানে যেরূপ ভাষা, যেমন ভাব, যে প্রকার ছন্দ এবং যে জাতীয় অপাণিনীয় (আর্য) প্রয়োগ আছে, গীতাতেও সেইরূপই সে সমস্ত আছে। প্রক্ষিপ্তবাদীঃ এ সকল বিষয়ে যথেষ্ট মতভেদও আছে। প্রতিবাদীঃ থাক, শঙ্করাচার্য্য, শ্রীধরস্বামী ও মধুসূদনসরস্বতীপ্রভৃতি যোগী মহাপুরুষগণ নিঃশঙ্কচিত্তেই এই গীতার ভাষ্য ও টীকা রচনা করিয়া গিয়াছেন। ইহাতেও গীতার মৌলিকতাই প্রমাণিত হয়। প্রক্ষিপ্তবাদীঃ গীতা প্রক্ষিপ্ত বা মৌলিকগ্রন্থ এ বিষয়ে শঙ্করপ্রভৃতি কোন অনুসন্ধান করিয়াছিলেন বলিয়া মনে
যোগেশ্বরেশ্বর শ্রীকৃষ্ণই আদিপুরুষ পরমব্রহ্ম

ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায় প্রারম্ভঃ পরব্রহ্ম, পুরুষোত্তম, অধোক্ষজ, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্ঠমী তিথিতে স্বধর্মম্ পরিবারে পক্ষ থেকে সবাইকে জানাই কৃষ্ণপ্রীতি ও শুভেচ্ছা। “পরমেশ্বরের জন্ম তিথি” এই বাক্যটা শুনলে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে “পরমেশ্বরের আবার জন্ম হয় নাকি? তিনি তো অজ, নিত্য শ্বাশ্বত”। হ্যাঁ, সেই অজ পরমেশ্বর কিভাবে তাঁর দিব্য জন্ম-কর্ম (জন্ম কর্ম চ মে দিব্যম্, গীঃ ৪/৯) সম্পাদন করেন এবং কেন করেন তার উওর ভক্তদের অজানা নয়(পরিত্রাণায় সাধুনাম..বিনাশায় চ..)। এসব কথা বলা আজকের অভিপ্রায় নয়। আজকে আমরা তাদের জন্যই এই লেখা উৎসর্গ করছি যারা যুগ যুগ ধরে পৌণ্ড্রক, শিশুপালের মতো শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে তাঁর ভগবত্তাকে অস্বীকার করার নিত্য নতুন ফন্দি আঁটছে। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ এই পাখণ্ডদের কিছু দাবি খণ্ডণ করাই এই লেখনীর উদ্দেশ্য। পাখণ্ড দাবিঃ পাখণ্ডদের দাবি শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর নন, তিনি কেবলই একজন মানব/মহামানব বা মহাপুরুষ(জীব) এবং একজন যোগী ছিলেন। তিনি পরমেশ্বরের সাথে যোগযুক্ত অবস্থায় কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে অর্জুনের সামনে ভগবদ্গীতার জ্ঞান প্রদান করেছিলেন। অর্থাৎ কেবল একজন বার্তাবাহকের মতো পরমেশ্বরের জ্ঞানকে শ্রীকৃষ্ণ উচ্চারণ বা আবৃত্তি করেছিলেন মাত্র। তাই তিনি “যোগেশ্বর” অর্থাৎ “যোগ যুক্ত ঈশ্বর”। এই দাবির স্বপক্ষে তারা কিছু যুক্তি উপস্থাপন করে। যেমনঃ ১) পরমেশ্বর ভগবান অজ, অশরীরী, নিরাকার। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের জন্ম-মৃত্যু সব আছে। তাই তিনি পরমেশ্বর হতে পারেন না। ২) ভগবদ্গীতায় তাঁকে বহু জায়গায় “যোগেশ্বর” বলা হয়েছে। ৩) ভগবদ্গীতার ১৮/৬২ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ নিজে অর্জুনকে পরমাত্মার শরণ গ্রহণ কথা বলেছেন। ৪) শ্রীকৃষ্ণ, কুরুক্ষত্রের যুদ্ধের পর ভগবদ্গীতার জ্ঞান ভুলে গিয়েছিলেন। যা মহাভারতে বর্ণিত আছে। যুক্তি খণ্ডণঃ এখানে বলে নেওয়া ভালো যে, পাখণ্ডদের উক্ত দাবি অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ হয় নিজে জীবরূপে/যোগীরূপে (বিপক্ষের দাবী অনুযায়ী) ভগবদ্গীতার ৫৭৪টি শ্লোক বলেছেন। নয়তো যদি তাঁকে পরমেশ্বর হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয় তবে এই ৫৭৪টি শ্লোক তাঁর অর্থাৎ পরমেশ্বর ভগবান কতৃক উক্ত হয়েছে। এর মাঝামাঝি অর্থাৎ যদি বলা হয় “তিনি কিছু শ্লোক জীব স্বরূপ হয়ে আবার কিছু শ্লোক পরমেশ্বরের হয়ে বলেছেন” এমন দাবি নিতান্তই অযৌক্তিক এবং বালখিল্য। কেননা এমন ধারণা তাদের মনোধর্মপ্রসূত। এই দাবি মানলে আমাদেরকে স্পষ্ট করে বলতে হবে যে তিনি এই শ্লোক থেকে এই পর্যন্ত যোগযুক্ত ছিলেন। আর এই শ্লোক থেকে এই পর্যন্ত যোগবিযুক্ত অবস্থায় বলেছেন। ক্ষণে যোগযুক্ত হয়েছেন আর ক্ষণেই যোগবিযুক্ত হয়েছেন এমন দাবি হাস্যকর। এইসব হাস্যকর, রম্য দাবি শুনে মনে হয় যেন “শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মার সঙ্গে যোগযুক্ত হওয়ার জন্য যে Internet Connection Providers/Device ব্যবহার করতেন তার সিগন্যাল খুবই দুর্বল ছিল!। তা নাহলে তিনি কখন যে যোগযুক্ত হচ্ছেন (Connected) আর কখন যোগমুক্ত (Disconnected) হচ্ছেন তা বুঝা খুব মুশকিল।” 😀 😀 আমরা শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর জ্ঞানেই ভগবদ্গীতার “ভগবান উবাচ” দ্বারা যে ৫৭৪টি শ্লোক স্বীকার করবো এবং পাখণ্ডদের দাবি খণ্ডণ করবো। ————————————————————————————————————————- ১ম দাবিঃ পরমেশ্বর ভগবান অজ, অশরীরী, নিরাকার। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের জন্ম-মৃত্যু সব আছে। তাই তিনি পরমেশ্বর হতে পারেন না। খণ্ডণঃ পরমেশ্বর ভগবান যে অজ হয়েও দিব্য জন্ম লাভ করেন তার কথা তিনি নিজেই বলেছেন। অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন্ । প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া ।। ভঃগীঃ ৪/৬ অনুবাদ: যদিও আমি জন্মরহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময় রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই। এবং তারপরেই ভগবান তাঁর বহুল পঠিত, আলোচিত শ্লোক দুটি উচ্চারণ করলেন। যথাঃ যদা যদা হি ধর্মস্য..(ভঃগীঃ ৪/৭) এবং পরিত্রাণায় সাধূনাং..(ভঃগীঃ ৪/৮)। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম যে সাধারণ মানুষের মতো নয়; তার অচিন্ত্য এবং দিব্য তার প্রমাণ তিনি তার পরের শ্লোকেই দিয়েছেন। জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ । ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন ।। ভঃগীঃ ৪/৯ অর্থ:- হে অর্জুন ! যিনি আমার এই প্রকার দিব্য জন্ম ও কর্ম যথাযথভাবে জানেন, তাঁকে আর দেহত্যাগ করার পর পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না, তিনি আমার নিত্য ধাম লাভ করেন। [একটা মজার বিষয় হলো, পাখণ্ড’রা ভগবদ্গীতার এই শ্লোকগুলিকেও স্বীকার করে না। ’প্রক্ষিপ্ত’ অথবা ‘বেদ বিরোধীব’ দাবি করে পশ্চাৎগমন করে।] অন্যভাবে এও বলা যায় যে বৈদিক শাস্ত্রে জীবাত্মাকেও অজ (অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো, ভঃগীঃ ২/২০) বলা হচ্ছে। তথাপি জীবের জন্ম-মৃত্যু হয়। তবে জীবের এবং পরমাত্মার জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্যও আছে। বহূনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন । তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ ।। ভঃগীঃ ৪/৫ অনুবাদঃ হে পরন্তপ অর্জুন ! আমার ও তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে ৷ আমি সেই সমস্ত জন্মের কথা স্মরণ করতে পারি, কিন্তু তুমি পার না। তাই পরমেশ্বরকে জড় চক্ষু দ্বারা দেখা যায় না বলে তাঁকে অশরীরী, অকায়ম্ যেমন বলা হয় তেমনি তার রূপ, তনু ইত্যাদির কথাও কিন্তু বৈদিক শাস্ত্রে আছে। যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যঃ । তস্য এষ আত্মা বিবৃণুতে তনূং স্বাম্ ।। কঠ উঃ ১/২/২৩ অনুবাদঃ ইনি(পরমেশ্বর) যাকে স্বীকার করেছেন তার কাছেই তাঁর প্রকৃত স্বরূপ প্রকটিত করেন। হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্। তৎ ত্বং পূষন্নপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে॥ – (ঈশোপনিষদ মন্ত্র ১৫) “হে ভগবান, হে সর্বজীব পালক, আপনার উজ্জ্বল জ্যোতির দ্বারা আপনার প্রকৃত মুখারবিন্দ আচ্ছাদিত। কৃপা করে সেই আচ্ছাদন দূর করুন এবং আপনার শুদ্ধ ভক্তের নিকট নিজেকে প্রদর্শন করুন।” তদ্ দিব্যমচিন্ত্যরূপম্ -(মুণ্ডকোপনিষদ্ ৩/১/৭) “তাঁর(পরমব্রহ্মের) সেই রূপ দিব্য, অচিন্তনীয়” যৎ তে রূপং কল্যাণতমং তৎ তে পশ্যামি যোহসাবসৌ পুরুষঃ সোহহমস্মি॥ – (ঈশোপনিষদ মন্ত্র ১৬) “কৃপা করে আপনার অপ্রাকৃত রশ্মির জ্যোতি অপসারণ করুন যাতে আপনার আনন্দময় রূপ আমি দর্শন করতে পারি। আপনি সনাতন পুরুষোত্তম ভগবান।” কেনোপনিষদে পরব্রহ্ম দেবতাদের মিথ্যা অভিমান চূর্ণ করার জন্য তাদের সামনে যক্ষরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তদ্ধৈষাং বিজজ্ঞৌ তেভ্যো হ প্রাদুর্বভূব তন্ন ব্যজানত কিমিদং যক্ষমিতি।। কেনোপনিষদ্ঃ ৩/২ সেই পরব্রহ্ম (দেবতাদের যুদ্ধজয়ের মিথ্যা অভিমান সম্পর্কে) এই বিষয়ে অবগত হয়ে তাঁদের(অগ্নি, বায়ু, ইন্দ্র আদি দেবতা) সামনে যক্ষরূপে আবির্ভূত হলেন। ত্রীণি পদা বি চক্রমে বিষ্ণু র্গোপা অদাভ্যাঃ। অতো ধর্মাণি ধারয়ন্॥ – (ঋগ্বেদ ১/ ২২/১৮) “বিষ্ণু রক্ষক, তাঁকে কেহ আঘাত করতে পারে না, তিনি ধর্ম সমুদয় ধারণ করে তিন পদ পরিক্রমা করেছিলেন।” সর্বতঃ পাণিপাদন্তৎ সর্বতোহক্ষিশিরোমুখম্। সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি।। -শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/১৬,শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৩/১৪ অনুবাদঃ তাঁর (ঈশ্বর) হস্ত, পদ, চক্ষু, মস্তক ও মুখ সর্বত্রই এবং তিনি সর্বত্রই কর্ণযুক্ত। জগতে সব কিছুকেই পরিব্যাপ্ত করে তিনি বিরাজমান। পরমেশ্বর সাকার নাকি নিরাকার এই আলোচনা এখানে করে এই লেখাকে দীর্ঘায়িত করতে চাই না। তবে এই সংক্রান্ত আমাদের অন্যান্য লেখাগুলো পড়তে পারেন। যদিও শ্রীকৃষ্ণকে যাঁরা পরমেশ্বর হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন(বাসুদেব সর্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভ। ভঃগীঃ ৭/১৯) তাঁরা ইতিমধ্যেই সমস্ত বেদান্তের সার জেনে গিয়েছেন কেননা শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বলেছেন – বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যো বেদান্তকৃদ্ বেদবিদেব চাহম্ ॥ ভঃগীঃ ১৫/১৫ অনুবাদ : আমিই সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য এবং আমিই বেদান্তকর্তা ও বেদবিৎ। অতএব পরমেশ্বরের সাকার রূপ যে শাস্ত্রসম্মত তার প্রমাণ দেওয়া হলো এবং শ্রীকৃষ্ণ অজো হয়েও কিভাবে জন্মগ্রহণ করতে পারেন তা প্রমাণিত হল। ————————————————————————————————————————- ২য় দাবিঃ পাখণ্ডীদের ২য় দাবি “শ্রীকৃষ্ণকে ভগবদ্গীতার ৯/৫, ১১/৮-৯; ১৮/৭৮ এছাড়াও আরও কয়েকটি শ্লোকে তাঁকে
অর্ধবেলা উপবাস কি শাস্ত্রীয়?

শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু আমাদের আরাধ্য, তাই কৃষ্ণাষ্টমী ও গৌর পূর্ণিমা ব্রত ইস্কনের সকলেই বাধ্যতামূলক পূর্ণ দিবস করবে। অন্যান্য ব্রত যেমন নৃসিংহ চতুর্দশী, রাম নবমী ইত্যাদি ব্রত কেউ চাইলে পূর্ণ দিবস করতে পারে, কিন্তু তাতে বাধ্যবাধকতা নেই। তবে সকল ভক্ত উৎসবান্ত(আবির্ভাবকাল) পর্যন্ত ব্রত ধারণ করবে। এ বিধান হরিভক্তিবিলাসে গোস্বামীবাক্য সিদ্ধ এবং শ্রী নারদীয় মহাপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, বায়ুপুরাণ সহ অসংখ্য শাস্ত্রে আছে। “কেচিচ্চ ভগবজ্জন্ম মহোৎসব দিনে শুভে । ভক্ত্যোৎসবাস্তে কুৰ্ব্বস্তি বৈষ্ণবা ব্রতপারণম্” ॥৪০৫॥ #অনুবাদ– কেহ কেহ পবিত্র পরম উত্তম ভগবানের জন্ম(আবির্ভাব) মহোৎসব দিনে বৈষ্ণবগণ দাস্য ভক্তিসহ উৎসবান্তে ব্রত পারণ করিয়া থাকেন । “তথা চোক্তং গারুড়ে— তিথ্যন্তে চোসবাস্তে বা ব্রতী কুব্বীদ্ধ পারণম্” ৷৷৪০৬ #অনুবাদ— ঐরূপ গরুড়পুরাণে উক্ত আছে – ব্ৰতাচরণকারী পরদিন তিথির অন্তে, অথবা ঐ দিন উৎসবান্তে পারণ করিবেন ৷৷ ৪০৬ ৷৷ “বায়ুপুরাণে চ— যদীচ্ছে সৰ্ব্বপাপানি হস্তং নিরবশেষতঃ । উৎসবান্তে সদা বিপ্র জগন্নাথান্নমাশয়ে” ৷৷ ইতি ৷৷ ৪০৭॥ #অনুবাদ– বায়ুপুরাণেও নিঃশেষে যদি সৰ্ব্ববিধ পাপ ধ্বংস করিতে ইচ্ছা কর, হে বিপ্র! উৎসবান্তে সৰ্ব্বদা জগন্নাথদেবের অন্নপ্রসাদ ভোজন করাইবে । ♦নির্জলা অপবাসে অসমর্থ হবিষ্যান্ন গ্রহণের বিধান রয়েছে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে— ~হরে কৃষ্ণ,ধন্যবাদ~ স্বধর্মম্
ইসকনে নারীদেরকে কি পুরুষদের তুলনায় কম বুদ্ধিমান মনে করা হয়?~পর্ব-২য়

শ্রীল প্রভুপাদের শিক্ষায় নারী ও বুদ্ধিমত্তার ব্যাখ্যা শ্রীল প্রভুপাদ বিভিন্ন সময়ে নারী ও তাদের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। তার বক্তব্য সঠিকভাবে বুঝতে হলে আমাদের বিষয়টি পর্যায়ক্রমে বিশ্লেষণ করতে হবে। এখানে আমরা তার দৃষ্টিভঙ্গি নিম্নলিখিত পাঁচটি ধাপে ব্যাখ্যা করবো: আত্মিক সমতা বনাম ভৌতিক পার্থক্য “কম বুদ্ধিমান” কথাটির প্রকৃত অর্থ বৈদিক সামাজিক ভূমিকা ও দায়িত্ব ভক্তিতে বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা আধুনিক সমাজ ও ইসকনে এর প্রয়োগ শিষ্যাদের প্রতি শ্রীল প্রভুপাদের মনোভাব ———————————————————————————————————————————————— ১. আত্মিক সমতা বনাম ভৌতিক পার্থক্য ক. আত্মিক স্তরে সমতা • বৈদিক শিক্ষায় বলা হয়েছে যে আত্মা (ātmā) নির্জাতীয় – অর্থাৎ, পুরুষ বা নারী হিসাবে কেউ জন্ম নেয় না, বরং আত্মা সবার এক। • শ্রীল প্রভুপাদ সবসময় জোর দিতেন যে কৃষ্ণভাবনামৃত অর্জনে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার আছে। • ইতিহাসে অনেক মহান নারী ভক্ত ছিলেন, যেমন কুন্তী দেবী, দ্রৌপদী, ও জাহ্নবা দেবী, যারা তাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের জন্য প্রসিদ্ধ। শ্রীল প্রভুপাদের উক্তি: “আত্মিকভাবে, সবাই সমান। একজন নারী নিকৃষ্ট নয়; তিনিও একজন আত্মা। কিন্তু শারীরিকভাবে, তার প্রকৃতি ভিন্ন, যেমন একটি শিশুর বুদ্ধি একজন প্রাপ্তবয়স্কের তুলনায় ভিন্ন হয়।” (প্রবচন, লস এঞ্জেলস, ১৯৭৪) খ. ভৌতিক স্তরে পার্থক্য • আত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারী-পুরুষ সমান হলেও, শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে নারী ও পুরুষের ভিন্ন প্রকৃতি আছে। • শ্রীল প্রভুপাদ কখনো কখনো বলতেন যে নারীরা তুলনামূলকভাবে কম বুদ্ধিমান, তবে এটি তাদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত নয়, বরং সাধারণ যুক্তিভিত্তিক চিন্তাভাবনা ও বাস্তবজীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে। ———————————————————————————————————————————————— ২. “কম বুদ্ধিমান” কথাটির প্রকৃত অর্থ ক. বৈদিক দৃষ্টিকোণ থেকে বুদ্ধিমত্তা বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী বুদ্ধিমত্তাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়: ১. ভৌতিক বুদ্ধিমত্তা (Buddhi) – যুক্তি, বিশ্লেষণ, ও বিচক্ষণতা। ২. আধ্যাত্মিক বুদ্ধিমত্তা (Bhakti Buddhi) – কৃষ্ণ ও আত্মার সম্পর্ক বোঝার ক্ষমতা। • শ্রীল প্রভুপাদ যখন বলতেন “নারীরা কম বুদ্ধিমান”, তখন তিনি ভৌতিক বুদ্ধির প্রসঙ্গেই বলতেন। • তিনি মনুসংহিতা (Manu-saṁhitā) থেকে উদ্ধৃতি দিতেন, যেখানে বলা হয়েছে যে নারীরা সাধারণত আবেগপ্রবণ হয়, ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সহজেই প্রভাবিত হতে পারে। খ. আধুনিক বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান অনুযায়ী • আধুনিক গবেষণাও দেখায় যে নারীরা আবেগপ্রবণ বুদ্ধিমত্তায় (emotional intelligence) বেশি পারদর্শী, আর পুরুষরা বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাভাবনায় (logical intelligence) বেশি পারদর্শী। • বৈদিক যুগে এই পার্থক্যের কারণে নারী ও পুরুষের আলাদা সামাজিক ভূমিকা ছিল, কিন্তু এটি কোনোভাবেই নারীর হীনতা প্রকাশ করে না। উদাহরণ: • একজন মা তার সন্তানের প্রতি বিশেষ আবেগপ্রবণ হন, কিন্তু একজন বাবা সাধারণত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, কারণ তিনি তুলনামূলকভাবে বিচার-বিবেচনা বেশি করেন। ———————————————————————————————————————————————— ৩. বৈদিক সামাজিক ভূমিকা ও দায়িত্ব ক. বৈদিক সমাজে নারী ও পুরুষের ভূমিকা • প্রাচীন বৈদিক সমাজে, নারী ও পুরুষের স্পষ্ট আলাদা দায়িত্ব ছিল: • পুরুষ: দর্শন, নেতৃত্ব ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করতেন। • নারী: পরিবার, সন্তান পালন ও ভক্তি কার্যকলাপে মনোনিবেশ করতেন। • “নারীদের কম বুদ্ধিমান” বলা হত এই অর্থে যে তারা বেশি আবেগপ্রবণ, তাই বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে তাদের পিতা, স্বামী বা পুত্রের আশ্রয়ে থাকা উচিত – এটি তাদের নিরাপত্তার জন্য, অপমান করার জন্য নয়। খ. ইসকনে শ্রীল প্রভুপাদের বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি • যদিও তিনি কখনো কখনো বৈদিক ঐতিহ্য অনুসারে কথা বলেছেন, কিন্তু ইসকনে তিনি নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ দিয়েছেন। • নারীরা ইসকনে: • প্রচার ও মন্দির পরিচালনা করেন • কীর্তন ও বক্তৃতা দেন • শাস্ত্র অনুবাদ ও প্রকাশনা করেন উদাহরণ: • আজ ইসকনের অনেক নারী গুরু, আচার্য ও প্রশাসক হিসেবে কাজ করছেন, যা ঐতিহ্যগত বৈদিক সমাজে দেখা যেত না। ———————————————————————————————————————————————— ৪. ভক্তিতে বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা • ভগবদ্গীতা (১০.১০) অনুসারে, কৃষ্ণ বলেন যে যারা তাঁর ভক্ত, তাদের প্রকৃত বুদ্ধি দেন। • শ্রীল প্রভুপাদ জোর দিয়েছিলেন যে সত্যিকারের বুদ্ধিমত্তা হলো কৃষ্ণের প্রতি আত্মসমর্পণ করা। • একজন কৃষ্ণভক্ত নারী প্রকৃতপক্ষে লক্ষ লক্ষ সাধারণ পুরুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। উক্তি: “একজন নারী যদি কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করে, তবে সে লক্ষ লক্ষ সাধারণ পুরুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান।” (প্রবচন, মায়াপুর, ১৯৭৭) ———————————————————————————————————————————————— ৫. আধুনিক সমাজ ও ইসকনে এর প্রয়োগ ক. কাল, স্থান ও পরিস্থিতি অনুযায়ী সমন্বয় • শ্রীল প্রভুপাদ সবসময় পরিস্থিতি অনুযায়ী তার শিক্ষা ব্যাখ্যা করেছেন। • তিনি স্বীকার করেছেন যে আধুনিক সমাজে নারীরা শিক্ষিত ও যোগ্য, তাই তাদের আধ্যাত্মিক বিকাশের সুযোগ থাকা উচিত। খ. লিঙ্গের চেয়ে ভক্তির গুরুত্ব • শ্রীল প্রভুপাদ লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্যের চেয়ে একজনের ভক্তির গুরুত্ব বেশি দিয়েছেন। • ইসকনে, নারী ও পুরুষ উভয়েই ভক্তি, শিক্ষা ও প্রচারের ক্ষেত্রে সমান সুযোগ পেয়েছেন। উদাহরণ: • ইসকনের নারী সাধ্বীরা আজ অনেক ক্ষেত্রে প্রবক্তা ও আচার্য রূপে প্রতিষ্ঠিত। ———————————————————————————————————————————————— ৬. শিষ্যাদের প্রতি শ্রীল প্রভুপাদের মনোভাব 1. পিতৃসুলভ ভালোবাসা ও যত্ন – শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর মহিলা শিষ্যাদের প্রতি গভীর স্নেহ, যত্ন ও সুরক্ষা প্রদান করতেন, যা এক পিতার ভালোবাসাকেও অতিক্রম করত। 2. সম্মান ও উৎসাহ – বৈদিক নীতিগুলি মেনে চললেও, তিনি কখনোই মহিলাদের নিম্নতর মনে করতেন না। বরং, তিনি তাঁদের ভক্তিমূলক সেবায় উৎসাহ দিতেন এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করতেন। 3. ব্যক্তিগত যত্ন – তিনি তাঁদের সুস্থতার খোঁজখবর রাখতেন, স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকতেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী দিকনির্দেশনা ও উৎসাহ প্রদান করতেন। 4. বৈষ্ণবী হিসেবে স্বীকৃতি – তিনি বলেছিলেন যে কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করা মহিলারা সাধারণ নন; তাঁদের বৈষ্ণবী হিসেবে যথাযথ সম্মান দেওয়া উচিত। 5. আধ্যাত্মিক উন্নতি – তাঁর সকল ব্যবহারের লক্ষ্য ছিল তাঁদের কৃষ্ণের নিকটবর্তী করা, যেখানে তিনি সদয়তা, সুরক্ষা ও প্রকৃত আধ্যাত্মিক যত্ন প্রদান করতেন। ———————————————————————————————————————————————— চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত: কিভাবে প্রভুপাদের বক্তব্য বুঝতে হবে? ১. আত্মিকভাবে নারী ও পুরুষ সমান – উভয়েরই কৃষ্ণচেতনা অর্জনের সমান সুযোগ আছে। ২. ভৌতিক স্তরে কিছু পার্থক্য আছে – নারীরা আবেগপ্রবণ, পুরুষরা বিশ্লেষণধর্মী। ৩. ভক্তিই সর্বোচ্চ বুদ্ধিমত্তা – কৃষ্ণকে আত্মসমর্পণ করাই প্রকৃত জ্ঞান। ৪. ইসকনে নারী ক্ষমতায়িত হয়েছে – বৈদিক সমাজের তুলনায় ইসকনে নারীরা অনেক সুযোগ পেয়েছেন। ———————————————————————————————————————————————— শেষ কথা: নারীদের কম বুদ্ধিমান বলার পরিবর্তে, শ্রীল প্রভুপাদ জোর দিয়েছেন যে সত্যিকারের বুদ্ধিমত্তা কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করা। যে নারী বা পুরুষ কৃষ্ণের প্রতি আত্মসমর্পণ করেছেন, তিনিই প্রকৃত জ্ঞানী। ১ম পর্বঃ https://svadharmam.com/why-srimad-bhagavatam-says-that-women-and-sudras-do-not-have-the-ability-to-understand-vedas/ ©শ্রী দেবর্ষি শ্রীবাস দাস
শ্রাদ্ধে মাছ-মাংস নিবেদন নিষিদ্ধ

ন দদ্যাদামিষং শ্রাদ্ধে ন চাদ্যাদ ধর্মতত্ত্ববিৎ । মুন্যন্নৈঃ স্যাৎ পরা প্রীতির্যথা ন পশুহিংসয়া ॥ নৈতাদৃশঃ পরো ধর্মো নৃণাং সদ্ধর্মমিচ্ছতাম্ । ন্যাসো দণ্ডস্য ভূতেষু মনোবাক্কায়জস্য যঃ ॥ [শ্রীমদ্ভাগবতম ৭/১৫/৭-৮] ~ ধর্মতত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে কখনও মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি আমিষ নিবেদন করবেন না, এবং তিনি যদি ক্ষত্রিয়ও হন, তা হলেও স্বয়ং আমিষ আহার করবেন না। যখন ঘি দিয়ে তৈরি উপযুক্ত খাদ্য সাধুদের নিবেদন করা হয়, তখন পিতৃপুরুষ এবং ভগবান অত্যন্ত প্রসন্ন হন। যজ্ঞের নামে পশুহিংসা করা হলে তাঁরা কখনও প্রসন্ন হন না। যাঁরা শ্রেষ্ঠ ধর্মের মাধ্যমে উন্নতি সাধন করতে চান, তাঁদের অন্য সমস্ত জীবদের প্রতি কায়, মন, এবং বাক্যের দ্বারা হিংসা না করতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। তার থেকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম আর নেই। অন্যতম প্রধান স্মৃতিশাস্ত্র ‘কাত্যায়ন স্মৃতিতে’ নিরামিষ দিয়ে অর্থাৎ বিনা আমিষে পিতৃ শ্রাদ্ধ করার নির্দেশ আছে! মহাভারতের অনুশাসন ও আশ্বমেধিক পর্বেও উল্লেখ আছে, পিতৃপুরুষগণ অন্ন দ্বারাই সন্তুষ্ট হন। পদ্মপুরাণের পাতালখন্ডের ৭২ নং অধ্যায়ে উল্লেখ আছে, রামচন্দ্র কর্তৃক মাতা কৌশল্যার শ্রাদ্ধে নিরামিষ দ্রব্যই নিবেদন করা হয়েছিলো, আমিষ নয়। শ্রাদ্ধে জীবহিংসা যেহেতু নরকবাসের কারণ, তাই কলিকালে পিতৃশ্রাদ্ধে মাংস নিবেদন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে শাস্ত্রসমূহ- (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-কৃষ্ণজন্ম খন্ড ১১৫/১০৯)বলা হয়েছে- “এই কলিযুগে অশ্বমেধ যজ্ঞ, গোমেধ যজ্ঞ,সন্ন্যাস আশ্রম(একদন্ডী সন্ন্যাস), শ্রাদ্ধনুষ্ঠানে মাংস নিবেদন ও দেবরের দ্বারা সন্তান প্রাপ্তি সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ”।
বর্ণসঙ্কর ব্যক্তি কি দীক্ষাগুরু হতে পারেন?~পর্ব-৫

‘বৈষ্ণবগণ দ্বিজোত্তম’ শাস্ত্রবাক্য জেনেও সমাজে কিছু ধর্মব্যবসায়ী প্রায়ই দাবী তুলেন, ‘শূদ্র কিংবা শূদ্রাধম, বর্ণহীন, অন্ত্যজ, বর্ণসঙ্কর, অসৎকূলজাতগণ বৈষ্ণব হলেও দীক্ষাগুরু হতে পারে না!!’ এরূপ ভাগবতম সিদ্ধান্ত বিরুদ্ধ মত যারা প্রসন করেন, তারা নিশ্চিতরূপে নরকের কীট। আজ আমরা মহামুনি মতঙ্গ ঋষির দৃষ্টান্ত দেখবো, যিনি বর্ণসঙ্কর হয়েও বৈষ্ণব ধর্ম পালনের মাধ্যমে ব্রহ্মর্ষি হয়েছিলেন এবং অন্যতম বৈষ্ণব দীক্ষাগুরুরূপে জগতবাসীদের করুণা করেছেন। মতঙ্গ মুনি শূদ্র নাপিতের ঔরসে কামোন্মত্তা ব্রাহ্মণীর গর্ভে জন্ম, অতএব জাতিতে চণ্ডাল ছিলেন। তার জন্ম সম্পর্কে মহাভারতে বলেছে- “ব্রাহ্মণ্যাং বৃষলেন ত্বং মত্তায়াং নাপিতেন হ জাতত্ত্বমসি চাণ্ডালো ’(মহাভারত, অনুশাসন পর্ব, ২৮।১৭) মতঙ্গ মুনি প্রথম জীবনে ইন্দ্রের তপস্যা করেছিলেন, কিন্তু তাতে অভিষ্ট লাভ না করতে পেরে বিষ্ণুভক্তিতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন এবং মহামুনিতে পরিণত হয়েছিলেন। ‘মুনিশার্দ্দুলো মতঙ্গো বিষ্ণুতৎপরঃ’’( স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুখন্ড, বেঙ্কটাচলমাহাত্ম্যম, ৩৯।২) মতঙ্গ মুনি ভক্তশ্রেষ্ঠ হনুমানেরও কূলগুরু ছিলেন। স্কন্দপুরাণে (বিষ্ণুখন্ডের বেঙ্কটাচলমাহাত্ম্যের ৩৯ অধ্যায়ে) উল্লেখ আছে, পুত্রলাভ না হওয়ায় বানররাজ কেশরী এবং মাতা অঞ্জনা খুব দুঃখিত ছিলেন। মতঙ্গ মুনি দেবী অঞ্জনাকে তখন মুখ্যপ্রাণ বায়ুর তপস্যায় প্রেরণ করেছিলেন এবং কেশরী-অঞ্জনা বায়ুদেবের তপস্যায় সিদ্ধ হয়ে তিনি মুখ্যপ্রাণকে পুত্র হনুমানরূপে লাভ করেছিলেন। রামায়ণের কিষ্কিন্ধাকাণ্ডের ৭৩-৭৪ সর্গে মতঙ্গ মুনি ও তার শিষ্যগণের উল্লেখ আছে। মতঙ্গমুনির নিষ্ঠাবান শিষ্যগণ গুরুভক্তি দ্বারা এতই তজস্বী হয়েছিলেন যে গুরুদেবের জন্য বন্য ফলমূল সংগ্রহকালে তাদের শরীর থেকে যে ঘাম মাটিতে পড়তো, সে ঘাম থেকে সুগন্ধি পুষ্পবৃক্ষের জন্ম হতো। সে সমস্ত পুষ্পবৃক্ষের পুষ্প কখনো মলিন হত না। মতঙ্গ মুনি ও তার শিষ্যগণ ভক্তিযোগ পূর্ণ করে মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক নিজেদের মন্ত্রপূত দেহকে অগ্নিতে আহুতি দিয়ে ভগবানের নিত্যধাম প্রাপ্ত হয়েছিলেন। নিত্যধামে গমনকালে তিনি তার শিষ্যা তপস্বীনি শবরীকে আশীর্বাদ করেছিলেন একদিন তিনি সাক্ষাৎ ভগবান রামচন্দ্রের দর্শন পাবেন। শ্রীরামচন্দ্র মাতা সীতার অন্বেষণকালে মতঙ্গবনে মতঙ্গমুনির আশ্রমে এসেছিলেন এবং শবরীর নিকট নিত্যধামগত মতঙ্গমুনির সমাধিস্থল, পূজাবেদী, পরিধেয় বস্ত্র দর্শন করে ভগবান রামচন্দ্র আনন্দিত হয়েছিলেন। শবর কূলে জন্মালেও গুরুদেব মতঙ্গ মুনির সেবার প্রভাবে তপস্বিনী শবরী সাক্ষাৎ ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে লাভ করেন। ভগবান রাম ভক্ত শবরীর উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করে ভক্তের মানবৃদ্ধি করেন। সাক্ষাৎ ভগবান রামকে সম্মুখে রেখে দর্শন করতে করতে যোগাগ্নিতে জড়দেহকে আহুতি দিয়ে শবরী মাতা দিব্যদেহ ধারণ করে অক্ষয়ধামে গমন করেন। ধন্য গুরু মতঙ্গ! ধন্য শিষ্যা শবরী! মতঙ্গ মুনি বর্ণসঙ্কর হয়েও পতিতপাবন দীক্ষাগুরুর এক আদর্শ দৃষ্টান্ত। অতএব যারা বৈষ্ণবকে জাতভেদ দৃষ্টিতে দর্শন করেন তাদের সুমতি হোক, শূদ্রপুত্র মতঙ্গ মুনির কৃপা তাদের উপর বর্ষিত হোক। ©ব্রজসখা দাস
শূদ্রকুলে জন্ম নেওয়া ব্যক্তি কি দীক্ষাগুরু হতে পারেন?~পর্ব-৪

জগতে আজকাল বহু দেহাত্মবুদ্ধি মূঢ় লোক নিজেকে বৈষ্ণব ঘোষণা করে বৈষ্ণবদের বৈষ্ণবত্ব, তাঁদের প্রচারক ও গুরু হওয়ার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন করে। তারা প্রতিষ্ঠাশার লোভে পরনিন্দা, পরচর্চা নিয়েই ব্যস্ত অথচ স্বঘোষিত শাস্ত্রবিদ। কিন্তু বেদশাস্ত্র এইরকম ব্যক্তিদের নয় বরং কাদের বৈষ্ণব বলে পরিচয় করা হয়েছে তা জগদ্গুরু সিংহপুরুষ শ্রীশ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর প্রভুপাদ তাঁর “ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব” গ্রন্থে স্বযত্নে লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন— “বৈষ্ণবতা দীনজনের একমাত্র সম্পত্তি। অহঙ্কার, প্রভুত্ব প্রভৃতি অবৈষ্ণবেরই প্রয়াসের বস্তুমাত্র, তাহাতে বৈষ্ণবের লোভ নাই। বৈষ্ণবের সম্পত্তি হরি। জড়াসক্তি-প্রাচুর্য্যে মত্ত এবং ব্রাহ্মণাদির সুলভ সম্মানে, পাণ্ডিত্যে ও ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের সুলভধনাদিতে স্ফীত হইয়া নিষ্কিঞ্চন পরমহংস বৈষ্ণবের প্রতি অনাদরক্রমে কুকর্মফলে অবৈষ্ণবতা-লাভ ঘটে। দীনহীন কাঙ্গাল জড়ভোগে উদাসীন হরিসেবা-পর হরিজনগণ জড়বস্তু-সকলের অধিকারী হইবার বাসনা না করায়, ব্রাহ্মণাদি-জন্ম, ঐশ্বর্য্য, বেদাদি শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য, কন্দর্পতুল্য-রূপের অভিলাষকে অকর্মণ্য জানিয়া ভোগপর বেদপাঠনৈপুণ্যরূপ ব্রাহ্মণত্বাদি কৰ্ম্ম-বাসনা হইতে মুক্ত হইয়া হরিকথা কীর্ত্তন করিয়া থাকেন। বলা বাহুল্য, শ্রুতিপারদর্শিতা-ক্রমে ব্রাহ্মণের সম্মান, অতুল ধন-জন-রাজ্যলাভ-ফলে ক্ষত্রিয়ের ঐশ্বর্য্য এবং কৃষিবাণিজ্যফলে বৈশ্যের ধনের ও রূপের সমৃদ্ধি বৈষ্ণবতার কারণ নহে; ঐগুলি সেবোন্মুখতার অভাবে অবৈষ্ণবতার বর্দ্ধক জড়ভোগপর দামসমূহ-মাত্র বৈষ্ণবগণ তাদৃশ ক্ষুদ্র অধিকার-সমুহের জন্য ব্যস্ত না হওয়াতেই তৃণাদপি সুনীচ ও তদপেক্ষা উন্নতশির তরু অপেক্ষা সহিষ্ণু, স্বয়ং অমানী ও অপরে মানদ হইয়া হরিভক্তি লাভকরিয়াছেন। অধিক কি, আধিকারিক দেবসমূহ প্রাকৃত কৰ্ম্ম-রাজ্যে সর্ব্বোচ্চশৃঙ্গে অধিষ্ঠিত হইয়াও কৰ্ম্মসমাপ্তিতে ভগবদ্ভক্তি-প্রভাবেই বৈষ্ণবপদবী লাভ করিয়া থাকেন।” অতএব যারা নিজেদের বৈষ্ণব বলে মনে করে, জড়জগতে সীমাবদ্ধ বর্ণাশ্রম-ধর্মের সাথে চিজ্জগতের বৈষ্ণবতার তুলনা করে, তারা নিতান্তই অল্পজ্ঞ। শাস্ত্রজ্ঞান ও শাস্ত্রের উপলব্ধি একইসাথে নাও ঘটতে পারে। শ্রীল প্রভুপাদ ভক্তিসিদ্ধান্ত উক্ত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন— “জগতাং গুরবো ভক্তা ভক্তানাং গুরবো বয়ম্। সর্ব্বত্র গুরবো ভক্তা বয়ঞ্চ গুরবো যথা ॥ শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলিলেন, বৈষ্ণবই জগতের গুরু;’ আমি বৈষ্ণবের গুরু। আমি যে-প্রকার সকলের গুরু, ভক্ত-গণও তদ্রূপ সর্বজনের গুরু। শ্রীমদ্বৈষ্ণবগণের সহিত জগতে কোন পূজ্যতম বস্তুর সাদৃশ্য নাই। বৈষ্ণব তদপেক্ষা অর্থাৎ সর্ব্বাপেক্ষা উচ্চতম আদর্শ, ইহাই শাস্ত্রসমূহের চরম সিদ্ধান্ত।” সাধু-বৈষ্ণবের কৃপাতেই শ্রীহরির কৃপা বিদ্যমান, তাই সাধুকৃপাতে অতি অল্পবয়সেই কারো কারো মধ্যে শাস্ত্রের দৃঢ় উপলব্ধি হয়, অথচ তৈলসজ্জিত শ্মশ্রু শুভ্রবর্ণ ধারণ করলেও কারো কারো নানা শাস্ত্র অধ্যয়নের পরেও মর্মার্থ উপলব্ধি হয় না। তাই তারা ভক্তদের নিন্দা, জাতিদ্বেষ নিয়েই নিরত থাকে। এমনকি সমস্ত শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত প্রদর্শিত হলেও তা রূপরঘুনাথের দর্শনের বিরোধী বলে প্রচার করার অপচেষ্টা করে। অথচ রূপরঘুনাথাদি ষড়্গোস্বামীবর্গের অভিন্ন সিদ্ধান্ত এই, বৈষ্ণবে জাতিবুদ্ধি করা যাবে না। “ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব” গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে — অর্চৌ বিষ্ণৌ শিলাধীগুরুষু নরমতিবৈষ্ণবে জাতিবুদ্ধি-বিষ্ণোর্যা বৈষ্ণবানাং কলিমলমথনে পাদতীর্থেহম্বুবুদ্ধিঃ। শ্রীবিষ্ণোর্নান্নি মন্ত্রে সকলকলুষহে শব্দসামান্যবুদ্ধি-বিষ্ণৌ সর্বেশ্বরেশে তদিতরসমধীর্ষস্য বা নারকী সঃ ॥ নিত্যপূজ্য বিষ্ণুবিগ্রহে শিলাবুদ্ধি, বৈষ্ণব-গুরুতে মরণশীল মানব-বুদ্ধি, বৈষ্ণবে জাতিবুদ্ধি অর্থাৎ জাতিবিচার, বিষ্ণু-বৈষ্ণবের পাদোদকে জলবুদ্ধি, সকল কল্মষবিনাশী বিষ্ণুনাম-মন্ত্রে শব্দ-সামান্য-বুদ্ধি এবং সর্বেশ্বর বিষ্ণুকে অপর দেবতার সহ সম-বুদ্ধি-এই ছয়প্রকার বিচারে ভক্ত ও অভক্তের তারতম্য বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিকভাবে সুব্যক্ত আছে। পদ্মপুরাণের এই শ্লোকটি শ্রীভক্তিরসামৃতসিন্ধু সহ বহু গোস্বামীগ্রন্থে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু, “নিজ সৌভাগ্যোদয় না হইলে বস্তু দর্শন করিয়াও দর্শনফল-লাভে অনেক অন্যাভিলাষী, কর্মী ও জ্ঞানী স্বভাবতঃই বঞ্চিত। তাঁহাদের নিজ-নিজ বিধি-নিষেধাদির পণ্যদ্রব্যভারে তাঁহারা এরূপ ভারাক্রান্ত যে, মস্তক উত্তোলন-পূর্বক গুণাতীতবস্তু-চতুষ্টয় দর্শনের সৌভাগ্যে তাঁহারা বঞ্চিত। সেই শোচ্যজীবগণ নিজ সঙ্কীর্ণতায় আবদ্ধ থাকিয়া ভক্তিপথে অগ্রসর হইতে পারেন না। তাঁহারা জগতে ভক্তি বা ভক্ত নিতান্ত বিরল জানিয়া তল্লাভের যত্ন-পর্য্যন্ত ত্যাগ-পূর্বক নিজের অধমতাকেই বহুমানন করেন এবং ভক্তের চরণে অপরাধ করিয়া নিজের অবনতির পথ পরিষ্কার করেন মাত্র।” বৈষ্ণবের আচারে উত্তম-কনিষ্ঠাদি তারতম্য থাকতে পারে। কিন্তু অপসম্প্রদায় বহির্ভূত তথা সৎসম্প্রদায়ে দীক্ষিত ব্যক্তি যে সংস্থারই অনুগামী হোক, তিনি বৈষ্ণব, তাতে সংশয় নেই। তাই হরিভক্তিবিলাসে’র মধ্যে এই শ্লোকটি গোস্বামীগণের দ্বারা উদ্ধৃত হয়েছে, গৃহীত-বিষ্ণুদীক্ষাকো বিষ্ণু-পূজাপরো নরঃ। বৈষ্ণবোহভিহিতোহভিজ্ঞৈরিতরোহম্মাদবৈষ্ণবঃ ॥ “শ্রীবিষ্ণুমন্ত্রে দীক্ষিত ও শ্রীবিষ্ণু-পূজাপরায়ণ ব্যক্তি অভিজ্ঞগণ কর্তৃক ‘বৈষ্ণব’ বলিয়া কথিত হন, তদ্ব্যতীত অপরে ‘অবৈষ্ণব’।” অতএব বৈষ্ণবভক্তদের প্রতি দেহাত্মবুদ্ধি স্থাপন করা অবশ্যই অপরাধজনক। বৈষ্ণবেরা তো মহৎ ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেও, মহারূপবান হয়েও, পরমবিদ্বান হয়েও কখনো এর গর্ব করেন না। কেননা তাঁরা জানেন, ভক্তদের কেবল কৃষ্ণের ইচ্ছাক্রমেই বিভিন্নভাবে বিভিন্নস্থানে জন্ম হয়। কলিযুগে মহাপ্রভুর পার্ষদগণ পাণ্ডববর্জিত গঙ্গাবর্জিত স্থানে এবং নিম্নকুলে আবির্ভূত হয়ে জগদুদ্ধার করেছেন, আবার পবিত্র স্থানে মহৎকুলেও এসেছেন। এর ফলে সেই কুল ও দেশেরই উদ্ধার হয়েছে, কেননা ভাগবতের সিদ্ধান্ত অনুসারে পবিত্র স্থানের মাহাত্ম্য স্থান নয়, বরং তীর্থী বৈষ্ণবগণের ফলেই লাভ হয়। কলিযুগে মহাপ্রভুকে সহায়তা করতে বহু বহু ভক্ত সময়ে সময়ে এই জগতে আবির্ভূত হচ্ছেন। তাই যারা মহাপ্রভুর সময়কালের দৃষ্টান্তসমূহকেও দৈব বলা যায় না, বরং সর্ব সময়কালের ভক্তদেরও দৃষ্টান্তরূপে গ্রহণ করা উচিত। ভক্ত দেহ, স্থান, কাল, পাত্রের অতীত। তাই তাদের প্রতি জাতিদ্বেষ নিতান্তই অন্যায়। শ্রী সিদ্ধান্ত সরস্বতী প্রভুপাদ তাই প্রমাণ দেখিয়েছেন, যথা— ♦“স্কন্দপুরাণে— হে নৃপোত্তম, যে ভাগবত-বৈষ্ণবকে উপহাস করে, তাহার অর্থ, ধৰ্ম্ম, যশ ও পুত্রসকল নিধন প্রাপ্ত হয়। যে মূঢ়গণ মহাত্মা বৈষ্ণবগণের নিন্দা করে, মহারৌরব-সংজ্ঞক নরকে পতিত হয়। তাহারা পিতৃ-পুরুষ-সহ বৈষ্ণবগণকে যে ব্যক্তি হনন করে, নিন্দা করে, বিদ্বেষ করে, অভিবাদন করে না, ক্রোধ করে এবং দেখিলে আনন্দিত হয় না, এই ছয় ব্যবহারই তাহার পতনের কারণ। ♦অমৃতসারোদ্ধারে— বৈষ্ণবগণকে পীড়া দিলে সজ্জাতি-জন্ম-প্রভৃতি যাহা কিছু সৎকর্মার্জিত পুণ্যফল থাকে, তৎসমস্তই নষ্ট হইয়া যায়। ♦দ্বারকামাহাত্ম্যে— যে পাপিষ্ঠগণ মাহাত্মা-বৈষ্ণবগণের নিন্দা করে, তাহারা যমশাসন-প্রভাবে সুতীব্র করপত্রদ্বারা ফালিত হয়। শত শত জন্মে বিষ্ণুপূজা করিয়া থাকিলেও বৈষ্ণবের অপমানকারী দুর্বৃত্তের প্রতি বিশ্বাত্মা শ্রীহরি প্রসন্ন হন না। ♦স্কান্দে— হে মহীপাল, বৈষ্ণবকে অগ্রে সম্মানপূর্ব্বক পরে যে ব্যক্তি অবজ্ঞা করে, সে স্ববংশে বিনষ্ট হয়। ♦ব্রহ্মবৈবর্ত্তে কৃষ্ণজন্মখণ্ডে— যাহারা হৃষীকেশ বা পুণ্যাশ্রয় তাঁহার ভক্ত-বৈষ্ণবগণের নিন্দা করে, তাহাদের শতজন্মার্জিত পুণ্য নিশ্চয় বিনষ্ট হয়। সেই পাপিগণ কুম্ভীপাক-নামক মহাঘোর নরকে কীটপুঞ্জ-দ্বারা ভক্ষিত হইয়া যাবচ্চন্দ্র-দিবাকর পচ্যমান হইয়া থাকে। বৈষ্ণব-নিন্দককে দর্শন করিলে দ্রষ্টার সমুদয় পুণ্য নিশ্চয় নষ্ট হয়। তাদৃশ অবৈষ্ণবকে দর্শন করিয়া গঙ্গাস্নান-পূর্বক সূর্য্য দর্শন করিলে বিদ্বজ্জন শুদ্ধিলাভ করেন। ♦শ্রীরামানুজ বলেন, ভগবানের পূজাপেক্ষা বৈষ্ণবের পূজা উত্তম, বিষ্ণুর অপমান অপেক্ষা বৈষ্ণবের অপমান গুরুতর অপরাধ, কৃষ্ণপাদোদকাপেক্ষা ভক্তের পাদোদক অধিকতর পবিত্র। বৈষ্ণবের পূজাপেক্ষা আর অন্য পুরুষার্থ নাই। বৈষ্ণববিদ্বেষ অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ আর কিছুই নাই; উহাতে নিজের বিনাশ হয়। ♦শ্রীচৈতন্যভাগবতে (ম ৫।১৪৫, ১০।১০২)— যত পাপ হয় প্রজা-জনেরে হিংসিলে। তার শতগুণ হয় বৈষ্ণবে নিন্দিলে॥ যে পাপিষ্ঠ বৈষ্ণবের জাতিবৃদ্ধি করে। জন্ম জন্ম অধম-যোনিতে ডুবি’ মরে ॥” অতএব আজ শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর প্রভুপাদের মহিমান্বিত আবির্ভাব মহোৎসবের আয়োজনে আমরা সকল বৈষ্ণবমতানুসারী ব্যক্তিদের অনুরোধ করব, বিষ্ণুনামে দীক্ষিত হরিপরায়ণ ভক্তদের নিন্দা, দ্বেষ, জাতিবুদ্ধি ত্যাগপূর্বক মহাপ্রভুর সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে হরিভজনে প্রবৃত্ত হোন। এই জগতে আমরা ক্ষণিকের অতিথি। ভক্তনিন্দায় তাই কালক্ষেপণ না করে হরিভজন করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। ইহাই শ্রী সিদ্ধান্ত সরস্বতীর উপদেশ। হরে কৃষ্ণ © স্বধর্মম্ ™
শূদ্রকুলে জন্ম নেওয়া ব্যক্তি কি দীক্ষাগুরু হতে পারেন?~পর্ব-৩

প্রায়শ দেখা যায়, জাতিব্রাহ্মণ ও ধর্মব্যবসায়ী দাম্ভিক ব্যক্তিগণ বৈষ্ণবের বর্ণ নিয়ে প্রশ্ন তোলার স্পর্ধা করেন এবং ধর্মানুগ ভক্তগণকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করেন। এরূপ ভাগবতদ্বেষীদের বিভ্রান্তিকর প্রচার নিরসনে এ লেখনি— বৈষ্ণবের বর্ণ কি? শ্রীমন্মধ্বাচার্য বর্ণকে দুইভাবে ব্যাখা করেছেন, যথা— ১) ঔপাধ্যায়িক বর্ণ (জন্ম দ্বারা জাতি) ২) পারমার্থিক বর্ণ (গুণ-কর্ম ভিত্তিক বর্ণ) ঔপাধ্যায়িক বর্ণ: দৈহিক জন্ম দ্বারা জাতিত্ব নির্ধারিত হয়। এর মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র চারটি জাতি। এদের মধ্যে যদি এক জাতির সাথে অপর জাতির দৈহিক মিলন ঘটে তবে তাকে বর্ণসঙ্কর বলে। বর্ণসঙ্কর অনুলোম ও প্রতিলোম দুই প্রকার। ঔরসদাতা হলেন পিতা, গর্ভধারিণী হলেন মাতা। চণ্ডাল,পুলিন্দ, পুক্কস, খস, যবন, সৌন্ধ, কাম্বোজ, শবর, ক্ষর প্রভৃতি বর্ণসঙ্করের উদাহরণ। পারমার্থিক বর্ণ (গুণ-কর্মানুসারে বর্ণ): যস্য যল্লক্ষণং প্রোক্তং পুংসো বর্ণাভিব্যঞ্জকম্। যদন্যত্রাপি দৃশ্যেত তৎ তেনৈব বিনির্দিশেৎ ৷ [শ্রীমদ্ভাগবতম ৭।১১। ৩৫] অনুবাদ: যদি কেউ ভাগবত বর্ণনা অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রের লক্ষণগুলি প্রদর্শন করেন, তা হলে তাঁকে ভিন্ন বর্ণের বলে মনে হলেও এই লক্ষণ অনুসারে তাঁর বর্ণ নির্দিষ্ট হবে। ব্যক্তি সদ্গুরু চয়ন করে তাঁর নিকট আশ্রিত হন। আশ্রিত ব্যক্তির গুণ পর্যবেক্ষণ করে গুরু তাকে মন্ত্রদান করেন। তখন গুরু হন পিতা, মাতা হলেন গায়ত্রীমন্ত্র। শিষ্য ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে গুরুগৃহে অবস্থান করেন এবং গুরু গুণবিচার করে তাদের বিদ্যাদান করেন। গুণ-কর্মানুসারে সে বর্ণপ্রাপ্ত হয়। বিশ্বামিত্রাদি মুনিগণ পারমার্থিক বর্ণ পরিচয়েই ত্রিলোক বিখ্যাত। ———————————————————————————————————————————————— বৈষ্ণবের বর্ণ: বৈষ্ণবের গুণ-কর্মানুসারে বর্ণ হয় না। বৈষ্ণব গুণাতীত, কর্মবন্ধনহীন। তার সাথে ঘটন-অঘটন সবই শ্রীহরির ইচ্ছাধীন, মায়াধীন নন। বৈষ্ণব দীক্ষা দ্বারা শ্রীহরির বংশে ব্যক্তির যে জন্ম হয়, তা দ্বারা তার দ্বিজত্ব সিদ্ধ হয়। বৈষ্ণব দীক্ষা প্রাপ্ত ব্যক্তির ঔপাধ্যায়িক বর্ণের পরিবর্তে পারমার্থিক বর্ণ লাভ করেন। দেহগত গোত্রপরিচয় পরিবর্তিত হয়ে তাঁর গোত্র হয় ‘অচ্যুত গোত্র’ (ভাগবত ৪।২১।১২)। তাঁর বর্ণ হয় ‘বৈষ্ণব’ বর্ণ বা ‘হংস বর্ণ’৷ ———————————————————————————————————————————————— বৈষ্ণবের গোত্র— সর্বত্রাস্খলিতাদেশঃ সপ্তদ্বীপৈকদণ্ডধূক। অন্যত্র ব্রাহ্মণকুলাদন্যত্রাচ্যুতগোত্রতঃ ॥ শ্রীমদ্ভাগবত ৪.২১.১২ অনুবাদ: মহারাজ পৃথু ছিলেন সপ্তদ্বীপ-সমন্বিত পৃথিবীর একচ্ছত্র সম্রাট। তাঁর অপ্রতিহত আদেশ সাধু, ব্রাহ্মণ ও অচ্যূতগোত্রভূক্ত বৈষ্ণব ব্যতীত অন্য কেউ লঙ্ঘন করতে পারত না। || অতএব, বৈষ্ণবের পরিচয় হলো— পিতা: বৈষ্ণব দীক্ষাগুরু কূল: হরিবংশ গোত্র: অচ্যুত গোত্র বর্ণ: হংস বর্ণ / বৈষ্ণব বর্ণ ———————————————————————————————————————————————— যেকোন বর্ণের ব্যক্তি বৈষ্ণব হলে দ্বিজে পরিণত হন। প্রমাণ— বিষ্ণুভক্তাশ্চ যে কেচিৎ সর্ব্বে বর্ণা দ্বিজতয়ঃ। কথিতং মম গার্গ্যেণ গৌতমেন সুমন্তুনা॥ [ স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুখন্ড, মার্গশীর্ষমাসমাহাত্ম্য, ১১।১৭, রাজা বীরবাহু উক্তি ] অনুবাদ: যে কোন বর্ণের ব্যক্তি যদি বিষ্ণুভক্ত হন, তবে তিনিই দ্বিজ। এই কথা- গার্গ্য, গৌতম ও সুমন্তু আমার নিকট বলেছেন। ———————————————————————————————————————————————— বৈষ্ণব বর্ণ যে ব্রাহ্মণাদি চার বর্ণের বাইরে, পৃথক বর্ণ তার প্রমাণ— ব্রহ্মক্ষত্রিয়বিটশূদ্রাশ্চতস্রো জাতয়ো যথা। স্বতন্ত্রজাতিরেকা চ বিশ্বেষু বৈষ্ণবাভিধা॥ [ ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, ব্রহ্মখণ্ড, ১১।৪৩ ] বঙ্গানুবাদঃ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র নামে যেরূপ চারটি জাতি আছে তদ্রূপ সমগ্র বিশ্বে ‘বৈষ্ণব’ নামক একটি স্বতন্ত্র জাতি আছে। ললাটাদ্বৈষ্ণবো জাতঃ ব্রাহ্মণো মুখদেশতঃ ৷ ক্ষত্রিয় বাহুমূলাচ্চ ঊরুদেশাচ্চ বৈশ্য বৈ ৷৷ জাতো বিষ্ণোঃ পদাচ্ছুদ্রঃ ভক্তিধর্ম্মবিবর্জিতঃ৷ তস্মাদ্বৈ বৈষ্ণবঃ খ্যাতঃ চতুর্ব্বর্ণেষু সত্তমঃ ৷৷ [ বৃহদ্বিষ্ণুযামল তন্ত্র ] অনুবাদ: শ্রী ভগবান্ বিষ্ণুর ললাট হইতে বৈষ্ণব, মুখ হইতে ব্রাহ্মণ,বাহু হইতে ক্ষত্রিয়,ঊরুদেশ হইতে বৈশ্য ,পদদেশ হইতে ভক্তিধর্ম্মবিবর্জিত শূদ্রের উৎপত্তি হইয়াছে ৷ ইহার মধ্যে যিনি বৈষ্ণব বলিয়া খ্যাত, তিনি চতুর্বর্ণ হইতেও সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বোত্তম ৷ ———————————————————————————————————————————————— বৈষ্ণব ব্রাহ্মণাদি চার বর্ণের থেকেও শ্রেষ্ঠ। প্রমাণ- ‘সৰ্ব্বেষাষ্ণৈব বর্ণানাং বৈষ্ণবঃ শ্রেষ্ঠ উচ্যতে।’ [ পদ্মপুরাণ, উত্তরখন্ড, ৬৮।৪ ] বঙ্গানুবাদঃ সৰ্ব্ব বর্ণ মধ্যে বৈষ্ণবই শ্ৰেষ্ঠ বলিয়া কথিত। তস্মাদ্বৈ বৈষ্ণবঃ খ্যাতঃ চতুর্ব্বর্ণেষু সত্তমঃ ৷৷ [ বৃহদ্বিষ্ণুযামল তন্ত্র ] অনুবাদ : যিনি বৈষ্ণব বলিয়া খ্যাত, তিনি চতুর্বর্ণ হইতে সর্বোত্তম ৷ ব্রাহ্মণাঃ ক্ষত্রিয়া বৈশ্যাঃ শূদ্রা অন্যেহন্ত্যজাস্তথা। হরিভক্তিপ্রপন্না যে তে কৃতার্থা ন সংশয়ঃ।।২ হরেরভক্তো বিপ্রোঽপি বিজ্ঞেয়ঃ শ্বপচাধিক। হরের্ভক্তঃ শ্বপাকোঽপি বিজ্ঞেয়ো ব্রাহ্মণাধিকঃ স কথং ব্রাহ্মণো যস্তু হরিভক্তিবিবর্জিত। স কথং শ্বপচো যস্তু হরিভক্তিপরায়ণঃ ॥৩ অব্যাজেন যদা বিষ্ণুঃ শ্বপাকেনাপি পুজ্যতে।। তদা পশ্যেত্তমপ্যেষশ্চতুর্ব্বেদিদ্বিজাধিকম্। ৪ [ পদ্মপুরাণ, ক্রিয়াযোগসারঃ, ৫।২-৪, ব্যাস উক্তি] বঙ্গানুবাদঃ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র বা অন্য অন্ত্যজ জাতি-যাহারাই হরিভক্তিপ্রপন্ন, তাহারাই নিশ্চিত ধন্য। হরিভক্তিহীন ব্রাহ্মণও চন্ডাল অপেক্ষা অধম বলিয়া বিজ্ঞেয়। আর হরিভক্ত চন্ডালও ব্রাহ্মণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া জানিবে। যিনি হরি ভক্তিহীন, তিনি কিরূপে ব্রাহ্মণ হইবেন? আর যে হরিভক্তিপরায়ণ, সে কিরূপে চন্ডাল হইবে? যে মুহূর্তে চন্ডালও অকপট ভাবে বিষ্ণুপূজা করে, তখন বিষ্ণু তাহাকে চতুর্ব্বেদী ব্রাহ্মণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ হিসেবে অবলোকল করেন। বিপ্রাদ দ্বিষড়গুণযুতাদরবিন্দনাভ- পাদারবিন্দবিমুখাৎ শ্বপচং বরিষ্ঠম্ মন্যে তদর্পিতমনোবচনেহিতার্থ- প্রাণং পুনাতি স কুলং ন তু ভূরিমানঃ ॥ [ শ্রীমদ্ভাগবতম ৯।৯।১০ ] বঙ্গানুবাদঃ ভগবানের শ্রীপাদপদ্ম-বিমুখ অভক্ত-ব্রাহ্মণ বারোটি ব্রাহ্মণোচিত গুণে ভূষিত হলেও তার অপেক্ষা যাঁর মন, বাক্য, কর্ম, ধন এবং প্রাণ ভগবান শ্রীহরিতে অর্পিত, সেই চণ্ডালও শ্রেষ্ঠ। এই প্রকার চন্ডালভক্ত-ও সেই রকম ব্রাহ্মণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, কারণ ভগবদভক্ত তাঁর কুল পবিত্র করতে পারে, কিন্তু সেই অতি গর্বান্বিত ব্রাহ্মণ নিজেকেও পবিত্র করতে পারে না, নিজের ব্রাহ্মণকূল উদ্ধার তো দূরের কথা। (উল্লেখ্য: এ শ্লোকটি মহাভারতের ‘সনৎসুজাত উপপর্বে’-ও বর্ণিত) ———————————————————————————————————————————————— বর্ণসঙ্কর বৈষ্ণব কি দীক্ষাগুরু হতে পারে? প্রামাণিক শাস্ত্র হতে বহু বহু দীক্ষাগুরুর দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই, যারা জন্ম দ্বারা বর্ণসঙ্কর হলেও পরবর্তীতে বিষ্ণুভক্তির অনুশীলন করে মহান বৈষ্ণবাচার্য্যে পরিণত হয়েছেন এবং দীক্ষাগুরু হয়ে বৈষ্ণবধর্মের প্রচার করেছেন। আসুন, আমরা ৩টি শাস্ত্র দৃষ্টান্ত দেখি! ১) শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস: মহর্ষি বেদব্যাসের পিতা পরাশর মুনি ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং মাতা সত্যবতী ছিলেন ক্ষত্রিয় উত্থানপাদের ঔরস ও মৎস্যগর্ভে জাত। তিনি ব্রহ্ম-মধ্ব-গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান দীক্ষাগুরু। ২) মহামুনি মতঙ্গ: শূদ্র নাপিতের ঔরসে কামোন্মত্তা ব্রাহ্মণীর গর্ভে জন্ম, অতএব জাতিতে চণ্ডাল ছিলেন। ৩) ঋষিশৃঙ্গ মুনি: ঋষিশৃঙ্গ মুনি ছিলেন বিভাশুক মুনি ও ব্যাশা পুত্র। তথাপি তিনি ত্রিলোকে পূজ্য ছিলেন এবং রাজা দশরথের যজ্ঞদীক্ষাগুরু ছিলেন। পদ্মপুরাণেও অসৎকূলেজাত মহান বৈষ্ণব দীক্ষাগুরুগণের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে- ব্রহ্মোবাচ। সচ্ছ্রোত্রিয়কুলে জাতো হ্যক্রিয়ো নৈব পূজিতঃ।। অসৎক্ষেত্রকুলে পূজ্যো ব্যাসবৈভাণ্ডকৌ যথা …. বেশ্যাপুত্রো বসিষ্ঠশ্চ অন্যে সিদ্ধা দ্বিজাদয়ঃ ॥ [ পদ্মপুরাণ, সৃষ্টিখন্ডম, ৪৬।২৭-২৮] অনুবাদ: ব্রহ্মা কহিলেন,- “শ্রোত্রিয় কুলজাত হয়েও যিনি অসৎ কর্মে লিপ্ত হন তিনি পূজ্য নহে, পরন্তু ব্যাসদেব ও ঋষ্যশৃঙ্গের ন্যায় অসৎকূলজ ব্যক্তিও সদাচার পরায়ণ হইলে পূজ্য হইয়া থাকেন…….বেশ্যাপুত্র বশিষ্ঠও সমাজে সমধিক সম্মান পান, এরকম আরও বহু বহু সিদ্ধ দ্বিজ আছে।” ———————————————————————————————————————————————— হয়গ্রীব পাঞ্চরাত্রে বলেছে, শৈব, সৌর, অনৈচ্ছিক, নগ্ন, বর্ণসঙ্কর, অপবিত্র, বৃদ্ধ, কুৎচ্ছিৎ অঙ্গ, মহাপাতকী চিহ্নযুক্ত ব্যক্তি গুরু হতে পারেন না। তাহলে সমাজে বর্ণসঙ্করগণ কিরূপে গুরু হচ্ছেন? উত্তরঃ হয়গ্রীব পাঞ্চরাত্রের উক্ত শ্লোকে যে সকল দোষ চিহ্নিত হয়েছে সেগুলো সকল অবৈষ্ণব ব্যক্তির ক্ষেত্রে বুঝতে হবে। যেমন, শুকদেব গোস্বামী ‘নগ্ন’ হয়েও, ব্যাসদেব-অষ্টবক্রমুনি ইত্যাদিগণ মুনি দেখতে সুদর্শন না হলেও, বিশ্বামিত্রের মতো ‘ব্রহ্মঘাতি’ ব্যক্তিও কিংবা বশিষ্ঠাদি মুনির মতো ‘বৃদ্ধ’ হয়েও দীক্ষাগুরু হওয়ার ভুরী ভুরী দৃষ্টান্ত আছে। অতএব, হয়গ্রীব পাঞ্চরাত্রের উক্ত বাক্যের দোষগুলো অবৈষ্ণবের জন্য বুঝতে হবে। ঠিক একই কারণে, হয়গ্রীব শাস্ত্রের উক্ত শ্লোকে বর্ণসঙ্কর দ্বারা অবৈষ্ণব বর্ণসঙ্করকে বুঝিয়েছে। যোনীগত বর্ণসঙ্করের জন্মদোষ থাকায় তিনি দীক্ষাদানে অযোগ্য। কিন্তু বর্ণসঙ্করী ব্যক্তি যদি বিষ্ণুভক্তিকে আশ্রয় করে নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব হন, তবে তার সমস্ত দোষ দূরীভূত হয়ে যায় এবং তিনি দীক্ষা দ্বারা বৈষ্ণবধর্মের প্রচার করে ত্রিজগতকে পবিত্র করেন। প্রমাণ- বৈষ্ণবেষু
শূদ্রকুলে জন্ম নেওয়া ব্যক্তি কি দীক্ষাগুরু হতে পারেন?~পর্ব-২

শ্রী নম্মালবর বা শঠকোপ আলবর শ্রী সম্প্রদায়ের ১২ জন মহান আচার্যের একজন, যাদের বাক্য ও উপদেশ এই সম্প্রদায়ে বেদের মতো মহান বলে মান্য করা হয়। শ্রী নম্মালবর শূদ্র সৎগোপ কুলে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাঁর মহান বিষ্ণুভক্তির বলে ব্রাহ্মণকুলের গুরু হয়েছিলেন। নম্মালবর শূদ্রকূলে জন্মেও বৈষ্ণব সংস্কার ধারণ করতেন, ব্রাহ্মণের ন্যায় নবগুণে যজ্ঞোপবীত ধারণ করতেন। তিনি ৩০৫৯ খ্রিস্টপূর্বে অর্থাৎ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্বধাম প্রত্যাবর্তনের মাত্র অর্ধশত বছর পরেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। এবং জন্ম থেকে তিনি কোনো কথা বলেননি এবং চোখ খোলেননি। তাই সকলে তাকে মূক ও অন্ধ বলে মনে করতেন। শিশুকালে নম্মালবর একদিন একটি তেঁতুল গাছের নিচে বসে কৃষ্ণভজন করছিলেন, তখন একদিন মধুরকবি নামক একজন কৃষ্ণভক্ত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সর্ব তীর্থ ভ্রমণ করে গৃহে প্রত্যাবর্তনের পথে হঠাৎ বহু দূর থেকে আলোকচ্ছটা দেখতে পেয়ে সেখানে আগমন করেন। হঠাৎ অন্তর থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে মধুরকবি তাঁকে সাংখ্যযোগের ভিত্তিতে একটি ধাঁধা জিজ্ঞেস করেন, “মৃতদেহে যদি ক্ষুদ্র কিছু জন্য নেয় তা কি এই দেহে বাস করে ও আহার করে?” নম্মালবর তাঁকে এর উত্তর দিয়ে প্রথমবারের মতো কথা বলেন, “হ্যাঁ বাস করবে, আহারও করবে।” এরপর তিনি সেই ক্ষুদ্র বস্তুকে আত্মা, মৃতদেহকে জড় দেহ এবং বাস ও আহার করাকে কর্তা ও ভোক্তা জ্ঞান করা হিসেবে বিশ্লেষণ করে চরমে কৃষ্ণভক্তিই সার বলে স্থাপন করেন। একটি শিশুর মুখে সাংখ্যতত্ত্ব শ্রবণ করে মধুরকবি তাঁকে মহান পণ্ডিত ও মহান কৃষ্ণভক্ত বলে উপলব্ধি করতে পেরে তাঁর চরণাশ্রয় করলেন এবং তাঁর নিকট বৈষ্ণবমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। যদিও মধুরকবি বয়সে জ্যেষ্ঠ ছিলেন ও নম্মালবর শিশু ছিলেন, তবুও মধুরকবি বয়স ও বর্ণ বিচার না করেই বৈষ্ণবের চরণাশ্রয় করেন এবং নাম্মাবরের চরণাশ্রয়ে তপস্যা করে নিজেও আলোয়ার হয়েছেন। কিংবদন্তী এই, নম্মালবর মধুরকবি আলবরকে রামানুজ আচার্যের সম্বন্ধে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। পরবর্তীকালে আরো বহু ব্যক্তি নম্মালবরের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি এমনই মহান ভক্ত ছিলেন যে, বলা হয়, তাঁর অনুসারীদের জন্যেই শ্রী নারায়ণ এই কলিযুগে প্রথম বৈকুণ্ঠের দ্বার উন্মোচন করেছিলেন । শঠকোপ যোগী বা নম্মালবর বৈশাখ মাসে শুক্লপক্ষের চতুর্থী তিথিতে বিশাখা নক্ষত্রে আবির্ভূত হন। প্রতি বছর তাঁর আবির্ভাব নক্ষত্র মহা ধুমধামে শ্রী সম্প্রদায়ে পালিত হয় এবং নবসূত্র যজ্ঞোপবীত প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্য উপাচারের দ্বারা সেবিত হন। কৃষ্ণ ভজনে নাহি জাতি-কুলাদি বিচার। সৎগোপকুলে জাত শ্রী নম্মালবর শঠকোপ যোগী সকলকে সৎবুদ্ধি দিন এবং শঠতা দূরীভূত করুন। হরে কৃষ্ণ। ~ মধুর গৌরকিশোর দাস © স্বধর্মম্ ™
Views Today : 198
Total views : 118865
Who's Online : 2
Your IP Address : 216.73.216.136