যত মত তত পথ!? কতটা গ্রহনযোগ্য এই কথাটা?

@reallygreatsite

বর্তমানে ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বাণী “যত মত তত পথ” কথাটি ব্যবহার করে যুবসমাজ ধর্মান্তরণের নতুন পথ খুজে পেয়েছে। তাই, এ বিষয়ে আলোকপাতের যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই “যত মত তত পথ” কথাটি শাস্ত্র সিদ্ধান্তের সাথে কতটা সাদৃশ্যপূর্ণ?!?

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন-

ये यथा मां प्रपद्यन्ते तांस्तथैव भजाम्यहम् ।
मम वर्त्मानुवर्तन्ते मनुष्याः पार्थ सर्वशः ॥

যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।
[ গীতা ৪।১১ ]
অনুবাদ: যারা যেভাবে আমার প্রতি আত্মসমর্পণ করে, আমি তাদেরকে সেভাবেই পুরস্কৃত করি। হে পার্থ! সকলেই সর্বতোভাবে আমার পথ অনুসরণ করে।

[অর্থাৎ শ্রীভগবান বলছেন,যারা যেভাবে আমার প্রতি আত্মসমর্পণ করে, আমি তাদেরকে সেভাবেই পুরস্কৃত করি।যেমন,যশোদা মা তিনি পূর্ব জন্মে কঠোর তপস্যা করেছিলেন ব্রহ্মাজীর নিকট।পরাৎপর-পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যিনি সর্ব কারণের পরম কারণ,তাকে সন্তান রুপে পাওয়া জন্য।ভগবান ভক্তের সেই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার জন্য বালক রুপে লীলাবিলাস করেছেন।

ভগবানের জন্ম আমাদের মতো না।ভগবান গীতাতে ৪র্থ অধ্যায়ে ৬নাম্বার শ্লোকে বলেছেন। তিনি “অজ” অর্থাৎ তিনি জন্মরহিত,তার জন্ম নেই তবুও তিনি ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার জন্য জন্মের অভিনয় করেন।ভগবান যখন প্রহল্লাদ মহারাজ কে রক্ষা করার জন্য “নৃসিংহ”রুপে অবতীর্ণ হন তখন তিনি একটা স্তম্ভ/পিলারের ভিতর থেকে আভির্ভূত হন।ভগবানের মাতা পিতা নেই।যাদের আমরা পিতা মাতা বলি তারা ভগবানের বাৎসল্য রসের ভক্ত।

  • ভগবান কে সন্তান রুপে আরাধনা করা যায়-(বাৎসল্য রস)(মা যশোদা,মা দেবকী ভগবান কে পুত্র রুপে কামনা করেছিল, সেই মনোবাঞ্ছা ভগবান পূর্ন করেছিলেন)
  • ভগবান কে পতি/স্বামী রুপে আরাধনা করা যায়-(মাধুর্য রস)(গোপীরা ভগবান কে পতি রুপে কামনা করেছিলেন তাদেরও মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছেন ভগবান)
  • ভগবান কে বন্ধু রুপে আরাধনা করা যায়-(সখ্য রস)(অর্জুন)
  • ভগবান কে প্রভু রুপে আরাধনা করা যায়-(দাস্য রস)(হনুমান)
  • ভক্ত ভগবানের আইন লঙ্ঘনের শাস্তির ভয়ে,শাস্তির ভয় মনোভাব নিয়ে ভগবানের আরাধনা করতে পারে-(শান্ত রস)

আমরা দেখলাম ভগবান কে যে, যেভাবে আরাধনা করেন ভগবান তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছেন।
“সকলেই সবর্তোভাবে আমার পথ অনুসরণ করেন”
এই কথাটার অর্থ বিকৃত করা উচিৎ নয়। কোন সকলের কথা বলছেন ভগবান? সেই সকল যারা ভগবান কে পতি,সন্তান,বন্ধু,প্রভু,ভগবান রুপে আরাধনা করছেন অর্থাৎ মাধুর্য,বাৎসল্য,সখ্য,দাস্য,শান্ত রসে যে যেভাবেই আরাধনা করছেন তারা সকলেই সবর্তোভাবে ভগবানের পথ অনুসরণ করছেন]

শ্রীভগবান বলছেন –

येऽप्यन्यदेवताभक्ता यजन्ते श्रद्धयान्विता: ।
तेऽपि मामेव कौन्तेय यजन्त्यविधिपूर्वकम् ॥

যেহপ্যন্যদেবতাভক্তা যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ।
তেহপি মামেব কৌন্তেয় যজন্ত্যবিধিপূর্বকম্।।
[ গীতা ৯।২৩]
অনুবাদ: হে কৌন্তেয়! যারা অন্য দেবতাদের ভক্ত এবং শ্রদ্ধা সহকারে তাঁদের পূজা করে, প্রকৃতপক্ষে তারা অবিধি পূর্বক আমারই পূজা করে।

[অর্থাৎ শ্রীভগবান বলেছেন দেব-দেবীরা আমার থেকে আলাদা নয়,তারা আলাদা আলাদা ভগবান নয়,আমি বিহীন তাদের অস্তিত্ব নেই,“মামৈবাংশ”তারা আমারি বিভিনাংশ।কিন্তু যারা বিভিন্ন দেবদেবীর উপাসনা করছেন, সেই অল্পবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিরা পরোক্ষ ভাবে তারা আমারি পূজা করছেন,”অবিধি পূর্বক” যদিও বিধি নেই।।গাছকে পুষ্ট করতে হলে,কেউ যদি গাছের গোড়াতে জল না দিয়ে গাছের পাতায় জল দেয়, তাহলে সেই ব্যাক্তির বুদ্ধির অভাব আছে বলে বুঝতে হবে।গাছের গোড়াতে জল দিলে যেমন সমস্ত গাছ পুষ্ট হয়,উদরে খাদ্য দিলে যেমন সমস্ত শরীর পুষ্ট হয়।তেমনি সমস্ত কিছুর উৎস শ্রীভগবান কে আমাদের সন্তুষ্ট করতে হবে, আলাদা করে কারো পূজা করার দরকার নেই।(যস্মিন তুষ্টে জগৎ তুষ্ট)]

আরো স্পষ্ট করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেনঃ

यान्ति देवव्रता देवान्पितॄन्यान्ति पितृव्रता: ।
भूतानि यान्ति भूतेज्या यान्ति मद्याजिनोऽपि माम् ॥

যান্তি দেবব্রতা দেবান্ পিতৃন্ যান্তি পিতৃব্রতাঃ।
ভূতানি যান্তি ভুতেজ্যা যান্তি মদযাজিনোহপি মাম্।।
[ গীতা ৯।২৫ ]
অনুবাদ: দেবতাদের উপাসকেরা দেবলোক প্রাপ্ত হবেন; পিতৃপুরুষদের উপাসকেরা পিতৃলোক লাভ করেন; ভুত- প্রেত আদির উপাসকেরা ভূতলোক লাভ করেন; এবং আমার উপাসকেরা আমাকেই লাভ করেন।

[অর্থাৎ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে আমাদের স্পষ্ট ভাবে বলে দিলেন,যে ব্যক্তি আমার আরাধনা না করে বিভিন্ন দেবদেবীর আরাধনা করে,সে কিন্তু আমার কাছে আসবে না,সে দেবলোক বা স্বর্গে যাবেন।স্বর্গে গেলে পূন্য শেষ হলে,আবার চলে আসতে হবে।কিন্তু ভগবানের কাছে একবার গেলে ফিরে আসতে হয় না।

সেই কথা ভগবান বলছেন-

मामुपेत्य तु कौन्तेय पुनर्जन्म न विद्यते ॥ १६ ॥ মামুপেত্য তু কৌন্তেয় পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।।১৬।।
অনুবাদঃ হে কৌন্তেয়! আমাকে প্রাপ্ত হলে আর পুনর্জন্ম হয় না।-[গীতা ৮।১৬]
তারপরও, যে ব্যক্তিরা মনে করবে আমার পিতাই ভগবান।আর যারা পিতাকেই শুধু আরাধনা করবে তারাও আমার কাছে আসবে না,তারা পিতৃলোক লাভ প্রাপ্ত হবেন।

শ্রীমদ্ভাগবতে-[৩/১০/৮] বলা হয়েছে ১৪ টি ভূবণ নিয়ে আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ড তথা পাতাল,রসাতল,মহাতল,তলাতল,সুতল,বিতল,অতল,ভূলোক,ভুবর্লোক,স্বর্গলোক,মহর্লোক,জনলোক,তপলোকসত্যলোক বা ব্রহ্মলোক।

শ্রীভগবান গীতাতে বলছেনआब्रह्मभुवनाल्ल‍ोका: पुनरावर्तिनोऽर्जुन । আব্রহ্মভুবনাল্লোকাঃ পুনরাবর্তিনোহর্জুন।
অনুবাদঃ হে অর্জুন! এই ভুবন থেকে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত সমস্ত লোকই পুনরাবর্তনশীল অর্থাৎ পুনর্জন্ম হয়।-[গীতা ৮।১৬]

তাই আমরা যদি এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ লোক ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হই আমাদের এই জগতে আবার আসতে হবে।কিন্তু ভগবানের কাছে গেলে আর ফিরে আসতে হবে না,এই দুঃখের জগতে।যে ব্যক্তি ভূত প্রেত কে ভগবান ভেবে আরাধনা করছেন তারাও আমাকে না ভূত লোক প্রাপ্ত হবেন।কিন্তু যারা আমার আরাধনা করছেন শুধু তারাই আমার কাছে আসবে।ভগবান এই শ্লোকে স্পষ্ট ভাবে বলেছেন,যে শুধু আমার উপাসকেরাই আমার কাছে আসবেন।

এই কথা তিনি ৭ম অধ্যায়েও বলেছেন-
देवान्देवयजो यान्ति मद्भ‍क्ता यान्ति मामपि ॥ २३ ॥ দেবান্ দেবযজো যান্তি মদ্ভক্তা যান্তি মামপি।।২৩।।
অনুবাদঃ দেবোপাসকগণ দেবলোক প্রাপ্ত হন, কিন্তু আমার ভক্তেরা আমার পরম ধাম প্রাপ্ত হন।-(গীতা ৭।২৩)]

একই কথা ভগবান ২বার বলেছেন-আমার উপাসকেরাই আমার ধাম প্রাপ্ত হবেন [৯/২৫,৭/২৩] কারণ এই কথাটি ভগবান বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বুঝতে বলেছেন আমাদের।
যেখানে দেবদেবীর আরাধনা করে আমরা ভগবানের কাছে যেতে পারবো না,শুধু মাত্র ভগবানের উপাসনা করেই ভগবানের কাছে যেতে হবে।সেখানে সাধারণ মানুষের উপাসনা করলে আমরা ভগবানের কাছে যেতে পারবো?!?

তাহলে সব পথ দিয়ে; যে কারো আরাধনা করে পরমেশ্বরের কাছে যাওয়া যাবে..? যত মত তত পথ নয়…⁉️

না, পথ একটাই, সেইটা কোন পথ? মহারাজ যুধিষ্ঠির উত্তরে বলেছেনঃ
“মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ”
অর্থাৎ, মহাজনদের নির্দেশিত পন্থাই প্রকৃত পথ।

শ্রীমদ্ভাগবতেও তাই বলা হয়েছে,

द्वादशैते विजानीमो धर्मं भागवतं भटा: ।
गुह्यं विशुद्धं दुर्बोधं यं ज्ञात्वामृतमश्नुते ॥

দ্বাদশৈতে বিজানীমো ধর্মংভাগবতং ভটাঃ।
গুহ্যং বিশুদ্ধং দুর্বোধং যং জ্ঞাত্বামৃতমশ্নুতে॥
[শ্রীমদ্ভাগবত ৬।৩।২১]
অনুবাদ: শ্রীযমরাজ তাঁর দূতদের বলছেন “আমরা এই বারো জন প্রকৃত ধর্মের তত্ত্ব জানি। হে ভৃত্যগণ, এই দিব্য ধর্ম যা ভাগবত-ধর্ম বা ভগবৎ প্রেম ধর্ম নামে পরিচিত, তা জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা কলুষিত নয়। তা অত্যন্ত গোপনীয় এবং সাধারণ মানুষের পক্ষে দুর্বোধ্য, কিন্তু কেউ যদি ভাগ্যক্রমে তা হৃদয়ঙ্গম করার সুযোগ পায়, তা হলে সে তৎক্ষতাৎ মুক্ত হয়ে পরমেশ্বর ভগবানের আনন্দময় ধামে ফিরে যায়।

কারা সেই দ্বাদশ মহাজন?

स्वयम्भूर्नारद: शम्भु: कुमार: कपिलो मनु: ।
प्रह्लादो जनको भीष्मो बलिर्वैयासकिर्वयम् ॥
স্বয়ম্ভূর্নারদঃ শম্ভুঃ কুমারঃ কপিলো মনুঃ।
প্রহ্লাদো জনকো ভীষ্মো বলির্বৈয়াসকির্বয়ম্॥
[শ্রীমদ্ভাগবত ৬।৩।২০]
অনুবাদ: স্বয়ম্ভূ,নারদ মুনি,শম্ভু,কুমার,কপিলদেব,মহর্ষি মনু,প্রহ্লাদ,রাজর্ষি জনক,ভীষ্মদেব,বলিমহারাজ,বৈয়াসকি (শুকদেব গোস্বামী),যমরাজ।
তাই, বিচার করুন,সিদ্ধান্ত নিন।
বিচার আপনার,সিদ্ধান্ত আপনার।।

তাই মহাজনদের নির্দেশিত পন্থাই প্রকৃত পথ,আসুন আমরা কৃষ্ণ/বিষ্ণুর শুদ্ধ ভক্তের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত শাস্ত্র অধ্যায়ন করি। এই দূর্লভ মনুষ্য জন্ম সার্থক করি।
॥হরে কৃষ্ণ॥

সংকলনে: শুভ দেবনাথ

[ বি:দ্র: স্বধর্মম্-এর অনুমোদন ব্যাতীত এই গবেষণামূলক লেখার কোনো অংশ পুনরুৎপাদন, ব্যবহার, কপি পেস্ট নিষিদ্ধ। স্বধর্মম্-এর সৌজন্যে শেয়ার করার জন্য উন্মুক্ত ]

নিবেদক-
° স্বধর্মম্: প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন °

Avatar of Ankon Nath

Ankon Nath

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments