বেদ অপৌরুষেয়। স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান হতে প্রকাশিত হয়েছেন। বেদ বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত, বেদই সংস্কৃত সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন এবং হিন্দু তথা সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। “বেদ” এর অপর নাম “শ্রুতি” এর কারণ হিসেবে বলা যায় “বেদ” লিপিবদ্ধ হওয়ার পূর্বে বেদের বাণী সমূহ গুরুশিষ্য পরম্পরায় শ্রবণের মাধ্যমে সংরক্ষিত হতো। যারা সেই বাণী শ্রবণের দ্বারা হৃদয়ে ধারণ করতেন তাঁদের বলা হতো শ্রুতিধর। পরবর্তীতে দ্বাপরযুগের শেষে আসন্ন কলিযুগের প্রয়োজন বিবেচনায় এই সমস্ত বেদকে লিপিবদ্ধ করেন মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, যিঁনি ব্যাসদেব নামে সমাদৃত।
কিন্তু, আজকালের তথাকথিত মহর্ষি ও নামধারী আর্যরা দাবী করেন বেদ’ সমূহের কিছু বিভাগ কোনো বেদ’ই নয়, কি আশ্চর্যজনক কথা!
যেমন- কৃষ্ণ-যজুর্বেদ এবং অষ্টাদশ পুরাণ সমূহকে তারা স্বীকারই করেন না। এগুলা নাকি মনুষ্যসৃষ্ট এবং অষ্টাদশ পুরাণ সমূহ নাকি অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ ঘটনায় ভর্তি! যদিও এমন নগণ্য কিছু ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা রয়েছে এবং এর থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার যথেষ্ট উপযোগিতাও রয়েছে, কিন্তু সেই সকল অনার্যদের যেহেতু তা উপলব্ধির জন্য বিশুদ্ধ চেতনা নেই তাই তারা আসলে এগুলোকে বাদ দিয়ে স্ব-মতাদর্শের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ও প্রায়োগিক এমন কিছু বিভাগকেই কেবল মান্য করেন। আজকে আমরা দেখবো তাদের নির্দিষ্ট মান্য শাস্ত্র সমূহেই’বা পুরাণ শাস্ত্র সম্পর্কে কি নির্দেশ রয়েছে।
স্মৃতিশাস্ত্র (ধর্মশাস্ত্র) তথা অষ্টাদশ পুরাণ সমূহকে নিয়ে যাদের দ্বিধা রয়েছে তাদের নিমিত্তে স্মৃতিশাস্ত্রের প্রাধাণ্যতা ও প্রামাণিকতা সম্পর্কিত কিছু তথ্য বর্ণিত হলো:
- “চারটি বেদ ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত, ঠিক তেমনই পুরাণ, ইতিহাস, গাথা, তার থেকে সৃষ্ট।”
– (অথর্ববেদ ১৫/৬/১১-১২)
- “যেমন আর্দ্র ইন্ধন দ্বারা প্রজ্বলিত অগ্নি হইতে নানা রকম ধূম নির্গত হয়, তেমনি ঋগ্বেদ যজুর্বেদ সামবেদ অথর্ববেদ, ইতিহাস, পুরাণ, বিদ্যা (সঙ্গীত বা কলাবিদ্যা), উপনিষদ, শ্লোক, সূত্র, অনুব্যাখ্যান, ব্যাখ্যান এই সমস্ত সেই মহাভূত হইতে নির্গত ; এইসকল ইহারই নিঃশ্বাস।”
– (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২/৪/১০)
- “ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, ইতিহাস, পুরাণ, বিদ্যা (সঙ্গীত বা কলাবিদ্যা), উপনিষদ, শ্লোক, সূত্র, অনুব্যাখ্যান, ব্যাখ্যান ইষ্ট, হোম, অশন, পানীয়, ইহলোকে, পরলোক, সর্বভূত – এই সমস্ত বাক্ দ্বারাই জানা যায়। বাক্ই পরমব্রহ্ম। যিনি ইহা জানিয়া বাকে্র উপাসনা করেন, বাক্ তাকে পরিত্যাগ করে না।
– (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪/১/২)
- “তাহার পর আদিত্যের উত্তরদিকের যে রশ্মিগুসমূহ, তাহারাই ইহার উত্তর মধুনাড়ী; অথর্বাঙ্গিরস মন্ত্রসমূহ মধুকর; ইতিহাস পুরাণই পুষ্প। সেই যজ্ঞীয় জলই পুষ্পের অমৃত।”
– (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩/৪/১)
- “সেই অথর্বাঙ্গিরস মন্ত্রসমূহ ইতিহাস ও পুরাণকে উত্তপ্ত করিয়াছিলেন। অভিতপ্ত সেই ইতিহাস ও পুরাণ হইতে যশ, তেজ, ইন্দ্রিয়সামর্থ্য, বীর্য ও অন্নরূপ রস উৎপন্ন হইয়াছিলো।”
– (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩/৪/২)
- “ইতিহাস ও পুরাণ পঞ্চম বেদ”
– (ছান্দোগ্য উপনিষদ: ৭/১/২; ৭/১/৪; ৭/২/১; ৭/৭/১)
- “ইতিহাস ও পুরাণ দ্বারা বেদকে বন্ধিত করিবে; না হইলে ‘এ আমাকে প্রহার করিবে’ ইহা ভাবিয়া বেদ অল্পজ্ঞ লোক হইতে ভয় পাইয়া থাকেন।”
– (মহাভারত: আদি/০১/২২৯)
- “বেদকে শ্রুতি ও ধর্মশাস্ত্রকে স্মৃতি বলা হয়, ঐ শ্রুতি ও স্মৃতি বিরুদ্ধ তর্কের দ্বারা মীমাংসা করিবে না। যেহেতু, শ্রুতি ও স্মৃতি হইতেই ধর্ম স্বয়ং প্রকাশ প্রাপ্ত হইয়াছে।।
– (মনুসংহিতা: ২/১০)
- যে ব্যক্তি প্রতিকূল তর্ক দ্বারা মূলস্বরূপ শ্রুতি ও স্মৃতিশাস্ত্রকে অবমাননা করে, সাধু লোকেরা সেই বেদনিন্দক নাস্তিককে দ্বিজের কর্তব্য কর্ম্ম অধ্যয়নাদি সকল অনুষ্ঠান হইতে বহিস্কৃত করিবেন।
– (মনুসংহিতায়: ২/১১)
- শতপথ ব্রাহ্মণেও (১১/৫/৬/৮) পুরাণের কথা উল্লেখ রয়েছে।
- পুরাণ, ন্যায়, মীমাংসা,ধর্মশাস্ত্র, বেদাঙ্গ (শিক্ষা,কল্প,ব্যাকরণ, নিরুক্ত,জ্যোতিষ, ছন্দ-৬প্রকার), এবং চারি বেদ (সাম,ঋক, যজু,অথর্ব)। – এই ১৪টি(শাস্ত্র) পুরুষার্থ- সাধন জ্ঞান এবং ধর্ম প্রবৃত্তির কারণ।
– (যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা ১/৩)
- “ঋক্, যজুঃ, সাম, অথর্ব – এই চতুর্বেদ এবং ইতিহাস তথা রামায়ণ ও মহাভারত এবং পঞ্চরাত্র—এই সকল ‘শাস্ত্র’ বলিয়া কথিত হইয়াছে ৷ ইহাদের অনুকূল যে সকল গ্রন্থ (পুরাণ, তন্ত্র আদি), তাহা ‘শাস্ত্র’-মধ্যে পরিগণিত৷ এতদ্ব্যতীত যে সকল গ্রন্থ, তাহা শাস্ত্র তো নহে-ই বরং তাহাকে ‘কুবর্ত্ম’ বলা যায়৷”
– (মধ্বভাষ্যধৃত স্কন্দবচন)
অতএব, দেখাই যাচ্ছে যে সর্বজনীন শাস্ত্রসমূহতেও পুরাণের প্রামাণিকতা বর্ণিত রয়েছে। বৈদিকশাস্ত্রে ইতিহাস ও পুরাণকে বেদ তথা পঞ্চম বেদ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও কিছু কিছু নব্য পণ্ডিতরা পুরাণের বিরোধিতা করে মনগড়া ব্যাখ্যা দাড় করিয়ে ঘোষণা দেয় পুরান (অষ্টাদশ পুরাণ) আর ইতিহাস (রামায়ণ+মহাভারত) বলতে এটা বোঝানো হয়নি, ঐটা বোঝানো হয়েছে, ইত্যাদি, ইত্যাদি। অথচ, তাদের এই সমস্ত মনগড়া তথ্যের কোনো ভিত্তি নেই।
তাহলে কোন সিদ্ধান্ত মানা উচিৎ শাস্ত্র সিদ্ধান্ত নাকি তথাকথিত ব্যক্তিবর্গের মনগড়া ব্যাখ্যা?!?