প্রশ্ন: পৌত্তলিকতা! মূর্তিপূজকরাই কি পৌত্তলিক?
উত্তর: ঈশ্বরোপাসনার বিপরীত হিসেবে পৌত্তলিকতার বিষয়টি জড়িত। সহজ ভাষায় পৌত্তলিকতা হচ্ছে- বেদে বর্ণিত ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর উপাসনা করা।
এসম্বন্ধে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় কেবলমাত্র নিম্নোক্ত দুইদলের ব্যক্তিরা মূর্তিতে পূজা করাকেই পৌত্তলিকতা মনে করে।
১) যারা বেদের সিদ্ধান্ত জানেনা।
২) যারা বেদের অপব্যাখ্যাকারী।
তারা বলে থাকে মূর্তিপূজক মানেই হচ্ছে পৌত্তলিক। অথচ শাস্ত্র অনুমোদিত পন্থায় মূর্তিতে পূজা তথা সাকার উপাসনাকারীরা কখনোই পৌত্তলিক নন, তা নিচের আলোচনায় স্পষ্টীকরণ হবে। তবে অননুমোদিত (অনুমোদন ব্যতীত) পন্থায় উপাসনা করাটা সমীচীন নয় এবং মনগড়া কাল্পনিকভাবে কোনো কাল্পনিক স্বরূপের উপাসনা করা নিঃসন্দেহে পৌত্তলিকতা। অথচ, সেইসব দলের লোকজন
🔸পৌত্তলিকতা কি
🔸এর সংজ্ঞা কি?
তা ভালোভাবে না জেনে এবং এর বাস্তবিক বৈশিষ্ট্য বুঝতে না পেরে সর্বজনীনভাবে সকল সবিশেষবাদীদের তথা সাকার উপাসকদের পৌত্তলিক বলে আখ্যা দিয়ে থাকে।
এ সংক্রান্তে শ্রীকেদারনাথ দত্ত কর্তৃক প্রকাশিত “শ্রী শ্রীচৈতন্য_শিক্ষামৃত” গ্রন্থে (৫ম বৃষ্টি, পৃষ্ঠা নং-১১২) খুব সুন্দরভাবে পৌত্তলিক ও পৌত্তলিকতার বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পড়ুন নিম্নরূপ:
“ভক্তদিগের ভগবৎ স্বরূপ প্রতিভূ যে যথাযথ তাহা ভক্তগণ বিশুদ্ধ ভক্তি বৃদ্ধিরূপ ফল দ্বারা অনুক্ষণ পরীক্ষা করিতেছেন। বিদ্যুৎ পদার্থের সহিত বিদ্যুৎ যন্ত্রের যে প্রকৃত সম্বন্ধ তাহা কেবল বিদ্যুৎ ফলকোৎপতি রূপ ফল দ্বারাই লক্ষিত হয়। তদ্বিষয়ে যাহারা অনভিজ্ঞ তাহারা বিদ্যুৎযন্ত্র দেখিলে কি বুঝিবে? যাহাদের হৃদয়ে ভক্তি নাই, তাহারা শ্রীবিগ্রহকে পুত্তলিকা বৈ আর কি বলিতে পারে! ভক্তদিগের সিদ্ধান্ত এই যে শ্রীবিগ্রহ সেবকেরা “পৌত্তলিক নন। তবে পৌত্তলিক কে, ইহার সংক্ষেপ বিচার করা যাউক। ভগবৎ স্বরূপের সহিত সম্বন্ধহীন বস্তুকে যাহারা উপাসনা করে তাহারা পৌত্তলিক।
তাহারা পঞ্চ (০৫) প্রকার-
১। বস্তুজ্ঞানাভাবে যাহারা জড়কে ঈশ্বর বলিয়া পূজা করে।
২। জড়কে তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া জড়-বিপরীত ভাবকে ঈশ্বর বলিয়া যাহারা পূজা করে।
৩। ঈশ্বরের স্বরূপ নাই স্থির করিয়াছে, কিন্তু স্বরূপ ব্যতীত চিন্তার বিষয় পাওয়া যায় না, তজ্জন্য যাহারা উপাসনা সুলভ করিবার জন্য ঈশ্বরের জড়ীয় রূপ কল্পনা করে।
৪। যাহারা চিত্ত বৃত্তির শুদ্ধতা ও উন্নতির জন্য ঈশ্বর কল্পনা করত তাহার একটী কল্পিত মূর্তির ধ্যান করে।
৫। জীবকে যাহারা ঈশ্বর বলিয়া পূজা করে।
🔴 অসভ্য বন্য জাতিগণ, অগ্নি পূজকগণ ও জোভ সেটার্ণ প্রভৃতি গ্রহপূজক গ্রীক দেশীয় ব্যক্তিগণ প্রথম শ্রেণীর পৌত্তলিক। যে সময়ে ঈশ্বরের স্বরূপ উদয় হয় নাই অথচ জীবের ঈশ্বর বিশ্বাস স্বভাবতঃ থাকে, সেই সময় পান বশতঃ যে চাকচিক্য বিশিষ্ট বস্তুতে ঈশ্বর পূজা দেখা যায় তাহাই ঐ শ্রেণীর পৌত্তলিকতা। অধিকার বিচারে ঐ রূপ পৌত্তলিকতার নিন্দা নাই।
🔴 জড়ীয় জ্ঞানের অত্যন্ত আলোচনা ক্রমে যুক্তিদ্বারা সমস্ত জড়ীয় গুণের বিপরীত একটা নির্বিশেষ ভাবকে যখন ঈশ্বর বলিয়া বিশ্বাস হয়, তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর পৌত্তলিকতা উপস্থিত হয়। নিরাকার বাদী মাত্রই ঐ শ্রেণীর পৌত্তলিক। নির্বিশেষ ভাব কখনই ঈশ্বরের স্বরূপ বা স্বরূপ সম্বন্ধীয় ভাব হইতে পারেনা। ঈশ্বরের অনন্ত বিশেষের মধ্যে নির্বিশেষতাকে একটা বিশেষ বলিলে স্বরূপ সম্বন্ধীয় ভাব হইতে পারে। ঈশ্বরের স্বরূপ জড়-বিলক্ষণ বটে, কিন্তু জড়-বিপরীত নয়।
🔴 চরমে নির্বাণকে যাঁহারা লক্ষ্য করিয়া বিষ্ণু, শিব, প্রকৃতি, গণেশ ও সূর্য্যের সগুণমূর্তি সকলকে সাধনের উপায় বলিয়া কল্পনা করেন, তাঁহারা ঈশ্বরের নিত্য স্বরূপ মানেন না, অতএব কল্পিত মূর্তি সেবা করত তৃতীয় শ্রেণীর পৌত্তলিক মধ্যে পরিগণিত হন। আজকাল যাহাকে পঞ্চ উপাসনা বলিয়া বলা যায় তাহা এই শ্রেণীর পৌত্তলিকতা।
🔴 কোন গুণকে অবলম্বন করত তদ্বিপরীত ধর্ম যে গুণশূন্যতা তাহা কিরূপে লভ্য হইতে পারে তাহা বোধ গম্য হয় না। যোগীদিগের কল্পিত বিষ্ণু মূর্তি ধ্যানই চতুর্থ শ্রেণীর পৌত্তলিকতা। তদ্দ্বারা অন্য কোন লাভ হইতে পারে, কিন্তু ভগবানের নিত্য স্বরূপ সাক্ষাৎকার রূপ পরম লাভ হয়না।
🔴 যাঁহারা জীবকে ঈশ্বর বলিয়া পূজা করেন তাঁহারা পঞ্চম শ্রেণীর পৌত্তলিক। শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর শিক্ষা মতে ইহা অপেক্ষা আর বৃহৎ অপরাধ নাই। যে সকল জীব পূজার্হ তাঁহাদিগকে ভগবদ্ভক্ত বলিয়া পুজা করিলে, আর জীবে ঈশ্বর বুদ্ধিরূপ অপরাধ করিতে হয়না।
(শ্রীরাম নৃসিংহাদির স্বরূপ ভজন যে পৌত্তলিক ব্যাপার নয় তাহা মৎকৃত শ্রীকৃষ্ণ সংহিতা পাঠ করিলে বুঝিতে পারিবেন।)
উক্ত পাঁচ প্রকার পৌত্তলিকেরা যে কেবল ভগবৎ স্বরূপের নিন্দা করিয়া থাকে তাহা নয়, তাহারা অকারণ পরস্পরের নিন্দা করে। প্রথম শ্রেণীর পৌত্তলিক জড়ীয় আকাশের সর্ব্বব্যাপিত্ব গুণকেই ঈশ্বরের প্রধান গুণ মনে করিয়া ভগবৎ স্বরূপের অবহেলা করে এবং কল্পিত ও পরিমিত দেবাকার সকলের নিন্দা করিতে থাকে। ইহার মূল তাৎপর্য্য এই যে সমান অধিকারেই সাপত্ন্য ভাবও তজ্জনিত কলহ অনিবার্য্য হইয়া পড়ে। পৌত্তলিক মাত্রেই পৌত্ত-লিকের নিন্দা করেন।
অপৌত্তলিক, স্বরূপলব্ধ, ভগবদ্ভক্তের কোন পৌত্তলিকের প্রতি বিদ্বেষ নাই। তিনি এই মাত্র মনে করেন যে যে পর্যন্ত স্বরূপ লাভ হয় নাই, সে পর্যন্ত কল্পনা বৈ আর কি করিবে? কল্পনা করিতে করিতে সাধু সঙ্গ ক্রমে কল্পনাকে হেয় জ্ঞান করিয়া স্বরূপ জ্ঞান হইবে। তখন আর বিবাদ করিবে না।”
তথ্য উপস্থাপনে
প্রবীর চৈতন্যচন্দ্র দাস
Join with us 👇