শ্রীকৃষ্ণের কি মৃত্যু হয়েছিল, নাকি তিনি স্বশরীরে বৈকুন্ঠে গমন করেছিলেন ?

IMG-20240924-WA0004

আমাদের সমাজে কিছু শাস্ত্রজ্ঞানহীন ভগবৎ-বিদ্বেষী ব্যাক্তি আছে, যারা শ্রীকৃষ্ণকে তাদের মতোই সাধারণ মানুষ মনে করে। অথচ মহাভারত শাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান বলা হয়েছে, স্বয়ং চতুর্ভুজ বিষ্ণু বলা হয়েছে।

অনুগ্রহার্থং লোকানাং বিষ্ণুলোক নমস্কৃতঃ।

বসুদেবাত্তু দেবক্যাং প্রাদুর্ভূতো মহাযশাঃ।।

( মহাভারত, আদিপর্ব, ৫৮/১৩৮ )

অনুবাদ:
ত্রিজগতের পূজনীয় মহাযশস্বী স্বয়ং বিষ্ণু লোকের প্রতি অনুগ্রহ করিবার জন্য বসুদেব-দেবকীতে আবির্ভূত হইয়া ছিলেন।

কিন্তু তার পরেও এ সমস্ত অজ্ঞানী মানুষেরা তাদের আসুরিক মতকে প্রচার করতে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান লীলা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার করতেছে, যা অশাস্ত্রীয়, ঘৃন্য এবং আসুরিক। অথচ মহাভারত শাস্ত্রের মৌষলপর্ব পাঠ করে আমরা সহজে জানতে পারি, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজে তার অন্তর্ধানের সময় নির্ধারন করেছিলেন। তখন তিনি একটি বৃক্ষের উপর চতুর্ভূজ বিষ্ণুরুপে অবস্থান করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছার প্রভাবে শ্রীকৃষ্ণ স্বশরীরে প্রথমে স্বর্গে এবং পরে বৈকুন্ঠ জগতে প্রবেশ করেন।

অসুরেরা যেহেতু মহাভারত শাস্ত্র উক্ত শ্রীকৃষ্ণকে বিষ্ণুরুপে মানে না, পরমেশ্বর ভগবানরুপে মানে না, তাই তারা মহাভারত শাস্ত্রের এসমস্ত জ্ঞান সাধারন মানুষের মাঝে প্রচার না করে এর বিপরীতে অশাস্ত্রীয় ভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্ধান লীলা নিয়ে অপপ্রচার করছে। নিম্নে মহাভারতের মৌষল পর্ব অবলম্বনে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান লীলা রহস্যের সত্য ইতিহাস পরিবেশিত হল….

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান লীলা:

বৃষ্ণিবংশ বা যদুবংশ ধ্বংস হওয়ার পর-

অথাপশ্যদৃযোগযুক্তস্য তস্য নাগং মুখানিঃসরন্তং মহান্তম।শ্বেতং যযৌ সততঃ প্রক্ষ্যমাণো মহাণর্বে যেন মহানুভাব।।

( মহাভারত, মৌষলপর্ব ৪/১৩ )

অনুবাদ:
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দর্শন করলেন যে, যোগপ্রবৃত্ত মহা প্রভাবশালী বলরামের মুখ থেকে একটা শ্বেতবর্ণ বিশাল নাগ( সর্প) নির্গত হচ্ছে। সেই নাগ নিগর্ত (বের) হয়ে মহাসমুদ্রে প্রবেশ করল।

ভগবান বলরামের এরুপ অন্তর্ধানের পর:-

সেনে ততঃ সংত্রয়মনস্য কালং ততশ্চকারেন্দ্রিয়ং নিরোধম।

যথা চ লোকত্রয়পালনার্থং দূর্বাসাবাক্য প্রতিপালনায়।।

( মহাভারত, মৌষলপর্ব ৪/২০ )

অনুবাদ:
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই সময়টিকেই নিজের প্রস্থানের সময় মনে করেছিলেন।পরে তিনি ত্রিভুবন পালন করবার জন্য এবং দূর্বাসা মুনির বাক্য রক্ষা করার নিমিত্তে ইন্দ্রিয়সমূহকে নিরুদ্ধ করেছিলেন।

বিশ্লেষণ:
উপরোক্ত বর্ণনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন দর্শন করলেন বলরাম সমুদ্রে লীন হলেন তখন তিনি সেই সময়টিকেই নিজের প্রস্থানের সময় মনে করেছিলেন। অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই জড় জগত ত্যাগ করার সময় তিনি নিজেই নির্ধারণ করেছিলেন। সুতারাং যারা শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবানরুপে স্বীকার করতে চায় না, তাদের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা, শ্রীকৃষ্ণ যদি পরমেশ্বর ভগবান না হন, তাহলে তিনি কিভাবে জড় জগত ত্যাগের সময় নিজেই নির্ধারণ করতে পারেন? এরপর দেখা যাক, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান লীলার পরবর্তী অংশ।

দেবোহপি সন্দেহবিমোক্ষহেতোনির্ণীত মৈচ্ছৎ সকলার্থতত্ববিৎ। স সং নিরুদ্ধেন্দ্রিয়বাঙ মনাস্তু শিশ্যে মহাযোগমু পেত্য কৃষ্ণঃ।। জরোহথতং দেশমুপাজগাম লুব্ধস্তদানীং মৃগলিপ্সুরুগ্রঃ।স কেশবং যোগযুক্তং শযানং মৃগশঙ্কী লুব্ধুকঃ সাযকেন।।জরাহবিধ্যৎ পাদতলে ত্বরাবাংস্তৎ চাভিতাস্তজ্জিঘৃক্ষুর্জগাম অথাপশ্যৎ পুরুষং যোগযুক্তং পীতাম্বরধরং লুব্ধকোহনেকবাহুম।।

( মহাভারত, মৌষলপর্ব-৪/২১-২৩ )

অনুবাদ:
সকলার্থতত্ত্বজ্ঞ শ্রীকৃষ্ণ সন্দেহ দূর করবার জন্য নিশ্চিত বিষয় কামনা করলেন। তখন কৃষ্ণ মহাযোগ অবলম্বন করে ইন্দ্রিয়,বাক্য ও মনকে নিরুদ্ধ করে ভূতলে শয়ন করলেন।তারপর উগ্রমূর্তি ও হরিণলিপ্সু জরা নামক এক ব্যাধ সেই সময়ে সেই স্থানে আগমন করে এবং মৃগ মনে করে বাণদ্বারা যোগযুক্ত অবস্থায় শায়িত কৃষ্ণের পদতলে বিদ্ধ করে। পরে ত্বরান্বিত হয়ে সেই বিদ্ধ মৃগকে গ্রহণ করতে ইচ্ছা করে তার নিকট গমন করলেন এবং তারপর সে (জরা ব্যাধ) দেখল- অনেক বাহু পীতাম্বরূপ বিধায়ী ও যোগযুক্ত একটি পুরুষ শায়িত রয়েছেন।

অর্থাৎ চতুর্ভুজরুপধারী শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করে…।

মত্বত্মানং ত্বটরাদ্ধং সতস্য পাদৌ জরো জগৃহেশঙ্কিতাত্মা।

আশ্বাসিতং পুণ্যফলেন ভক্তা তথানুতাপাৎ কর্ম্মেনো জন্মনশ্চ।।

( মহাভারত,মৌষলপর্ব-৪/২৪ )

অনুবাদ:
সেই জরা নামক ব্যাধ নিজেকে অপরাধী মনে করে উদ্বিগ্ন হয়ে শ্রীকৃষ্ণের চরণ যুগল ধারণ করলেন,তখন তার (ব্যাধ) পূণ্য ভক্তি,নিজের দূষ্কর্ম ও জন্ম বিষয়ে অনুতাপ করায় শ্রীকৃষ্ণ তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন।

বিশ্লেষণ:
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান লীলার এ অংশে আমরা বুঝতে পারি যে, জরা নামক ব্যাধ শ্রীকৃষ্ণকে মৃগ বা হরিণ মনে করে বাণ নিক্ষেপ করেছিলেন এবং ব্যাধ যখন তীরবিদ্ধ মৃগকে নিতে আসলেন তখন তিনি দেখলেন সেখানে কোন মৃগ নেই বরং সেখানে চর্তুভূজ রূপ ধারী স্বয়ং বিষ্ণু শায়িত আছেন। এখান থেকে স্পষ্ট প্রমানিত হয় যে, শ্রীকৃষ্ণ কখনো কোন সাধারন মানুষ নন, তিনি হলেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণু। সুতারাং অসুরেরা যে প্রচার করছেন যে শ্রীকৃষ্ণ জরা নামক ব্যাধের তীরে মারা গেছেন, প্রকৃতপক্ষে তা হল মিথ্যা প্রচার, কারণ চতুর্ভুজ শ্রীবিষ্ণু, যিনি স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান, তার কখনো মৃত্যু হতে পারে? এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে নিম্নে আলোচনা করা হয়েছে। যাহোক ব্যাধ চতুর্ভুজ শ্রীবিষ্ণুকে ( শ্রীকৃষ্ণ) দর্শন করা মাত্রই নিজের কর্মকে দূষ্কর্ম ও জন্ম বিষয়ে অনুতাপ করলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন। এরপর,

দৃষ্টা তথা দেবমন্তবীর্য্যং দেবৈঃ স্বর্গং প্রাপিতস্ত্যক্তদেহ।গণৈমুনীণাং পূজিতস্তত্র কৃষ্ণো গচ্ছন্নদ্ধং ব্যাপ্য লোকান স লক্ষ্যা।। দিব্যং প্রাপ্তয় বাসবোহথাশ্বণৌ চ রুদ্রাদিত্যা বসবশ্চাথ বিশ্বে।প্রত্যু্যদৃযষুমুর্নয়শ্চাপি সিদ্ধা গন্ধর্বমুখ্যাশ্চ সহাপ্সরোভব।। ততো রাজন! ভগবানুগ্রতেজা নারায়নঃ প্রভবশ্চাব্যয়শ্চ।যোগাচার্য্যো রোদসী ব্যাপ্য লক্ষ্যা স্থাং প্রাপ স্বং মহাত্মহপ্রমেয়ম।।

( মহাভারত, মৌষলপর্ব ৪/২৫-২৭ )

অনুবাদ:
দেবগণ অনন্তবীর্য নারায়ণকে দর্শন করে ব্যাধের দেহকে রেখে ব্যাধকে স্বর্গে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং শ্রীকৃষ্ণ আপন কান্তিদ্বারা জগদব্যাপ্ত করে উর্দ্ধদিকে গমন করতে লাগলেন তখন মুনিগণ শ্রীকৃষ্ণের পূজা করতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণ স্বর্গে উপস্থিত হলে ইন্দ্র,অশ্বিনীকুমারদ্বয়,একাদশ রুদ্র,দ্বাদশ আদিত্য,অষ্টবসু, বিশ্বদেবগণ,সিগ্ধ মুনিগণ এবং অপ্সরাদের সাথে গন্ধর্বশ্রেষ্ট গণ তার (কৃষ্ণের) প্রত্যুদ্গমন (আরাধনা) করেছিলেন। তার পর ভীষণতেজা, জগতের, উৎপাদক, অবিনশ্বর, যোগ শিক্ষক, মহাত্মা ভগবান নারায়ন ( শ্রীকৃষ্ণ) আপন কান্তিদ্বারা স্বর্গ,মর্ত্ত্য ব্যাপ্ত করে সাধারণের অর্জ্ঞেয় স্বকীয় বৈকুণ্ঠধাম গমন করেছিলেন।

বিশ্লেষণ:
উপরোক্ত মহাভারতের আলোচনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চতুর্ভুজরুপ ধারন করে স্বশরীরে প্রথমে স্বর্গ এরপর তার স্বীয় চিন্ময় বৈকুন্ঠ জগতে প্রবেশ করেছিলেন। এ সম্পর্কে ভাগবতেও একই তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে..

লোকাভিরামাং স্বতনুং ধারানাধ্যানমঙ্গলম।

যোগধারনয়াগ্নেয়্যাদগ্ধা ধামাবিশ্য স্বকর্ম।।

( শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ ১১/৩১/০৬ )

অনুবাদ:
সর্বজগতের সর্বাকর্ষক বিশ্রামস্থল, এবং সর্বপ্রকারের ধ্যান ও মননের বিষয়,ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার দিব্য শরীরে আগ্নেয় নামক অলৌকিক ধ্যানের প্রয়োগে দগ্ধ না করে তার স্বীয় ধামে গমন করেছিলেন।

পরিশেষে উপরোক্ত মহাভারত এবং শ্রীমদ্ভাগবতের বর্ণনায় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়,পরমেশ্বর ভগবানরুপে শ্রীকৃষ্ণের কখনো মৃত্যু হয় নি,কারন পরমেশ্বর ভগবান রুপে তার দেহ চিন্ময়।তাই তিনি তার অন্তর্ধানের সময় নিজেই নির্ধারন করেছিলেন,এবং মনুষ্যলোক পরিত্যাগ করে স্বশরীরে প্রথমে স্বর্গ এবং এরপর বৈকুন্ঠ জগতে প্রবেশ করেছিলেন।শ্রীকৃষ্ণ হলেন স্বয়ং বিষ্ণু। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ তার অন্তর্ধানের সময় চতুর্ভূজ রুপ ধারন করেছিলেন তাই তিনি এই চতুর্ভূজ রুপে স্বশরীরে বৈকুন্ঠে ফিরে গিয়েছিলেন।

।। হরে কৃষ্ণ।।

সংকলনে: সদগুণ মাধব দাস

[ বি:দ্র: স্বধর্মম্-এর অনুমোদন ব্যাতীত এই গবেষণামূলক লেখার কোনো অংশ পুনরুৎপাদন, ব্যবহার, কপি পেস্ট নিষিদ্ধ। স্বধর্মম্-এর সৌজন্যে শেয়ার করার জন্য উন্মুক্ত ]

নিবেদক-
° স্বধর্মম্: প্রশ্ন করুন | উত্তর পাবেন °

Ankon Nath

Writer & Admin

3.5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments