অপপ্রচার খন্ডন ❌
কিছু ভগবদ্বিদ্বেষী ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণ জন্মখন্ড, অধ্যায় ১০৫ এর ৬০-৬২ নং শ্লোকগুলোর ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার করছে যে রুক্মিনীর সাথে শ্রীকৃষ্ণের বিবাহে নাকি পশুর মাংস খাওয়ানো হয়েছিল, তাই তাঁরা বৈষ্ণবদের দেখাচ্ছে যে পশুর মাংস আহার করা যদি পাপ হয়, তাহলে শ্রীকৃষ্ণের বিবাহে কিভাবে শ্রীকৃষ্ণ এ পশুমাংস আহার করাকে বৈধতা দিল?
এসমস্ত নাস্তিকরা অষ্টাদশ পুরাণকে স্বীকার করে।কিন্তু অষ্টাদশ পুরানের মধ্যে অন্যতম শ্রীমদ্ভাগবত ৫/২৬/১৩ শ্লোকে উল্লেখিত,
যস্ত্বিহ বা উগ্রঃ পশুন পক্ষিণো বা প্রাণত উপরন্ধয়তি তমপকরুণং পুরুষাদৈরপি বিগর্হিতমমূত্র যমানুচরাঃ কুম্ভীপাকে তপ্ততৈলে উপরন্ধয়ন্তি ।। ১৩ ॥
অনুবাদঃ যে সমস্ত নিষ্ঠুর মানুষ তাদের দেহ ধারণের জন্য এবং জিহ্বার তৃপ্তি সাধনের জন্য নিরীহ পশু-পক্ষীকে হত্যা করে রন্ধন করে, সেই প্রকার ব্যক্তিরা নর- মাংসভোজী রাক্ষসদেরও ঘৃণিত। মৃত্যুর পর যমদূতেরা কুন্তীপাক নরকে ফুটন্ত তেলে তাদের পাক করে।
…কথাকে তাঁরা সত্যরূপে স্বীকার করে না। কারণ তারা নিজেদের জিহ্বার তৃপ্তির জন্য অসহায় তৃণভোজী ছাগল, হাঁস, মুরগী, হরিণ ইত্যাদি প্রাণীদের নির্মমভাবে হত্যা করে তাঁর মাংস আহার করে শিবের আরাধনা করে। তাঁরা যেভাবে আরাধনা করে, তাতে আমাদের বিদ্বেষ নেই, কারণ সকলে সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করতে পারবে না। তাই, বলে যারা সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত, তাদের সাত্ত্বিক আহারকে অবৈধ বলে প্রমাণ করার জন্য, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণ জন্মখন্ডের ১০৫/৬০-৬২ শ্লোক কয়টি ব্যবহার করে রুক্মিনীর সাথে শ্রীকৃষ্ণের বিবাহে পশুর মাংস খাওয়ানো হয়েছিল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরণের মিথ্যা প্রচার করা কখনো কোন আর্দশ মনোভাবের পরিচয় হতে পারে না।
বাস্তবে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণ জন্মখন্ড ১০৫/৬০-৬২ শ্লোকে বিবাহে যে পশুর মাংস আহার করার কথা বলা হয়েছে, তা হলো শিশুপালের বিবাহে রান্না করার জন্য।বিবাহ কিন্তু তখনও হয় নি, শুধু পরিকল্পনা করে বলা হয়েছে শিশুপালের বিবাহে হরিণ, ছাগল, মেষ ইত্যাদি পশুর মাংস রান্না করার জন্য। বাস্তবে এই সমস্ত পশুমাংস রান্না করা হয়েছিলো কিনা তাও উক্ত অধ্যায়গুলিতে আলোচনা করা হয় নি। আসুন আমরা প্রকৃত সত্য ঘটনাটিতে আরো বিস্তারিত জানি, যার মাধ্যমে পাঠকগণ বুঝতে পারবেন এসমস্ত নিন্দুক নাস্তিকরা কতটুকু মিথ্যাবাদী।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণ জন্মখন্ড, অধ্যায় ১০৫, ১- ৬২ নং শ্লোকের বর্ণনা অনুসারে, দ্বাপর যুগে বিদর্ভ দেশের ভীষ্মক নামে এক রাজা ছিলেন। সেই রাজার মহালক্ষ্মী স্বরূপিণী রুক্মিণী নাম্নী এক কন্যা ছিলেন। রুক্মিণীর যখন বিবাহ যোগ্যা হলেন তখন তাঁর পিতার রাজ পুরোহিত এবং ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করলেন, বরণের যোগ্য প্রবর, মুনিপুত্র অথবা দেবপুত্র কিংবা অভীপ্সিত নরপতিবর-তনয় কাকে আমার কন্যার বররূপে বরণ করব? মনোহারিণী আমার কন্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি লাভ করছে ; অতএব তাঁর বিবাহ দেওয়া উচিত। শীঘ্র নবযৌবন- সম্পন্ন উপযুক্ত বর অন্বেষণ করুন। সেই বর ধর্মশীল, স্থিতপ্রতিজ্ঞ, নারায়ণ-পরায়ণ, বেদ-বেদাঙ্গবিৎ, পণ্ডিত, সুন্দর, কল্যাণী, শম-দম-ক্ষমা প্রভৃতি গুণশালী, দীর্ঘজীবী, সংকূলপ্রসূত সর্ব্বত্র লব্ধপ্রতিষ্ঠ হওয়া আবশ্যক।
রাজার কথা শ্রবণ করে কুলপুরোহিত শতানন্দ বলতে লাগলেন, নৃপতিবর! তুমি ধার্মিক এবং সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত; তথাপি আমি বলিতেছি শ্রবণ কর। বিধাতারও বিধাতা ব্রহ্মা, শিব এবং অনন্ত কর্তৃক বন্দিত জ্যোতির্ময় সকল জীবগণের পরম পরমাত্মা প্রকৃতি হতে পৃথক্ নির্লিপ্ত নিরীহ সকল কর্মের সাক্ষীস্বরূপী ভক্তগণের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশের নিমিত্ত বিগ্রহধারী পরিপূর্ণতম প্রভু স্বয়ং নারায়ণ ভূভার হরণের নিমিত্তে বসুদেবের পুত্রতা স্বীকার করেছেন। নৃপবর, সেই পরিপূর্ণতম পরমাত্মা গোলোকনাথকে কন্যা সম্প্রদান করে শত পিতৃগণের সাথে গোলোকধামে গমন করবে। কন্যা সম্প্রদান করে পরলোকে গমন কর এবং ইহলোকে সকলের পূজ্য ও বিশ্বগুরুর গুরু হও। হে নরপতে! মহালক্ষ্মীস্বরূপিণী রুক্মিণী লক্ষ্মীনাথকে সমর্পণ করত সেই কন্যাদানের দক্ষিণা সর্ব্বস্ব প্রদান করে পুনর্জন্ম জয় কর। সেই শ্রীকৃষ্ণকে আনয়নের নিমিত্ত দ্বারকা- নগরে ব্রাহ্মণ প্রেরণ কর। সকলের সাথে পরামর্শ – পূর্ব্বক শুভক্ষণ নির্ধারণ করে সেই ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণকে আনয়ন কর।
কুলপুরোহিত শতানন্দের কথা শ্রবণ করে বিদর্ভরাজ ভীষ্মক তাঁর কন্যাকে শ্রীকৃষ্ণের হস্তে সমর্পন করতে রাজী হলেন। কিন্তু তাঁর সন্তান রুক্মী এ সমন্ধে রাজী হন নি। এই ঘটনা দর্শন করে রুক্মী, পিতা এবং বিপ্রকে বলতে লাগলেন, মহারাজ! আমি সত্য কথা বলছি, শ্রবণ করুন। কি আশ্চর্য্য! ভিক্ষুক ব্রাহ্মণগণ কি লোভী, তাদের কথা কখনও বিশ্বাস করবেন না। নর্ত্তক, বেশ্যা, ভট্ট, যাচক, কায়স্থ এবং ভিক্ষুক তারা সর্বদা মিথ্যা কথা বলে মানুষকে প্রতারণা করে। মহারাজ! কৃষ্ণ নিকৃষ্টবুদ্ধি বলে অন্যকে দিয়ে কাল-যবনকে হত্যা করে তার ধন লাভ করেছে। কৃষ্ণ যবনের ধনে দ্বারকায় ধনী হয়েছে। ভাল, সে যদি এতই বীরপুরুষ হয়, তা হলে মহারাজ জরাসন্ধের ভয়ে সমুদ্রের মধ্যে কি নিমিত্তে সে গৃহ নির্মাণ করছে। আমি একাকী শত জরাসন্ধকে সহজে হত্যা করতে সক্ষম। অন্য রাজা কি আমার যুদ্ধে স্থির হতে পারে? রণশাস্ত্রে সুপণ্ডিত আমি দুর্ব্বাসার শিষ্য। নিশ্চয় আমি পাশুপত অস্ত্র দ্বারাই এই বিশ্ব সংহার করতে সমর্থ। আমার সমান বিক্রমী এক পরশুরাম এবং শিশুপাল। আমার প্রিয়সখা বলবান শিশুপাল স্বর্গ জয় করতে সক্ষম এবং আমিও খুব অল্প সময়ে ইন্দ্রকে জয় করতে সমর্থ। মহারাজ! আপনিও কি তা জানেন না? অহঙ্কারে মত্ত হয়ে সেই মুঢ় (শ্রীকৃষ্ণ) যদি অভিলাষিত বিবাহ মানসে আমার গ্রামে উপস্থিত হয়, তাহলে তাকে সেই ক্ষণেই যমভবনে পাঠিয়ে দিব। আহা! কি দুঃখের বিষয়! আপনি কিনা নন্দগোপের গো-রক্ষক, গোপনারীগণের সাক্ষাৎ উপপতি, গোপালক সমূহের উচ্ছিষ্টভোজী, সেই মুঢ়কে ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের বাক্যে রুক্মিনীকে সম্প্রদানের ইচ্ছা করছেন।
কোন গুণে কৃষ্ণকে আপনি রুক্মিণীর পাত্র স্থির করলেন? কৃষ্ণ কি রাজপুত্র, না বীর, না কুলীন, না শুচি, না দাতা, না ধনাঢ্য, না রুক্মিণীর সদৃশ অথবা জিতেন্দ্রিয়? কোন সদ্গুণ তার নেই। মহারাজ, বলে রুদ্রসদৃশ রাজপুত্র সুপাত্র শিশুপালকে কন্যা সম্প্রদান করুন। মহারাজ, নানা দেশীয় নরপতিমণ্ডল, বান্ধবগণ এবং মুনিবরগণকে শীঘ্র পত্রদ্বারা নিমন্ত্রণ করুন। অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, মগধ, সৌরাষ্ট্র, বগুল, গুরু, রাঢ়, বরারেন্দ্র, বঙ্গ, গুজরাটি, পেটর, মহারাষ্ট্র, বিরাট, মুদগল, সুবঙ্গ, ভল্লুক, ভল্লক, খর্স এবং দুর্গ প্রভৃতি দেশে ব্রাহ্মণ প্রেরণ করুন।
ঘৃতকুল্যাসহস্রক মধুকুল্যা সহস্রকম্।
দধিকুল্যা সহস্রঞ্চ দুগ্ধকুল্যা সহস্রকম্ ॥ ৫৭ ভেলকুল্যাপঞ্চশতং গুড়কুল্যাম্বিলক্ষকম্।
শর্করাণাৎ রাশিশতং মিষ্টান্নানাং চতুর্গুণম্। ৫৮ যবগোধূমচূর্ণানাং পিষ্টরাশিশতং ততঃ।
পৃথুকানাং রাশিসক্ষমন্নানাং তচ্চতুগু ণম্ ॥ ৫৯
– (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণঃ শ্রীকৃষ্ণ জন্মখন্ড ১০৫/৫৭-৫৯)
অনুবাদঃ সহস্র ঘৃতকুল্যা, সহস্র মধুকুল্যা, সহস্র দধিকুল্যা, সহস্র দুগ্ধকুল্যা, পঞ্চশত তৈলকুল্যা, দুইলক্ষ গুড়কুল্যা, শত শত রাশ শর্করা, তদপেক্ষা চতুর্গুণ মিষ্টান্ন, যব গোধূমচূর্ণ, শত শত রাশি পিষ্ট, লক্ষরাশি পৃথুক, তদপেক্ষা চতুর্গুণ অন্ন প্রস্তুত করান।
আর রুক্মী এবং শিশুপাল যেহেতু মাংস, মদ আহারী আসুরিক প্রভৃতির ছিল, তাই তাদের মতো বন্ধু-বান্ধবদের বিবাহে আমন্ত্রণ জানাবে, তাই ক্রোধান্বিত রুক্মী শিশুপালের বিবাহে পশুমাংস রান্নার কথা স্পষ্ট ভাবে তার পিতা ভীষ্মককে জানিয়ে দিলেন।
গবাং লক্ষং ছেদনঞ্চ হরিণানাং দ্বিলক্ষকম্।
চতুর্লক্ষং শশানাক কুৰ্ম্মাণাক তথা কুরু।। ৬০।।
দশলক্ষৎ ছাগলানামবীনাং তচ্চতুর্গুণম্।
পর্ব্বণি গ্রামদেব্যৈ চ বলিং দেহি চ ভক্তিতঃ ॥ ৬১।। এতেষাং মাংসপকঞ্চ ভোজনার্থক কারয়।
পরিপূর্ণৎ ব্যঞ্জনানাং সামগ্রীং কুরু ভূমিপ।। ৬২।।
– (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণঃ শ্রীকৃষ্ণ জন্মখন্ড ১০৫/৬০-৬২)
অনুবাদঃ লক্ষ গো (‘গো’ শব্দে গোসাপকে বুঝতে হবে। – পৌরানিক সংহিতা২/৫), দুই লক্ষ হরিণ, চারি লক্ষ শশক এবং কূৰ্ম্মচ্ছেদন করান। দশ লক্ষ ছাগল, তদপেক্ষা চতুর্গুণ মেষ পূর্ণিমা দিনে গ্রাম্যদেবীর নিকটে ভক্তিপূর্ব্বক বলি দান করুন। এই সকলের মাংস ভোজনার্থে পাক করান। হে ভূমি পতে, ব্যঞ্জনসামগ্রী পরিপূর্ণরূপে প্রস্তুত করান।
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনা অনুযায়ী, ভগবদ্বিদেষী যে অপপ্রচার করছে ৬০-৬২ শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণের বিবাহে পশুমাংস খাওয়ানোর কথা বলা হয়েছে, বস্তুত তা সঠিক নয়। বরং তা হলো শিশুপালের বিবাহে রান্না করার জন্য। আবারো বলতে হয় বিবাহ কিন্তু তখনও হয় নি, শুধু ক্রোধান্বিত রুক্মী মুখে মুখে তাঁর পিতা ভীষ্মককে শিশুপালের সাথে রুক্মিনীর বিবাহে হরিণ, ছাগল, মেষ ইত্যাদি পশুর মাংস রান্না করার কথা বলেছিলেন। আমরা জানি, বিবাহের মতো অনুষ্ঠানগুলিতে রান্নার ক্ষেত্রে পরিকল্পনা করা হয় একরকম, কিন্তু পরে গিয়ে তা বহুবার পরিবর্তিত হয়।তাই, এই সমস্ত পশুমাংস রান্না করা হয়েছিল কিনা, তাও উক্ত অধ্যায়গুলিতে আলোচনা করা হয় নি।সুতরাং, ক্রোধান্বিত অসুর স্বভাববিশিষ্ট রুক্মীর মুখে মুখে বিবাহে পশুমাংস খাওয়ানোর কথাকে পরমেশ্বর পরমাত্মা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নামে প্রচার করা কখনো প্রকৃত শৈবের কাজ হতে পারে না।
হরে কৃষ্ণ।প্রনাম
©️ স্বধর্মম্ ™️
গ্রন্থ সহায়তাঃ
১/ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন।
২/শ্রীমদ্ভাগবত -শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ।
Views Today : 213
Total views : 118880
Who's Online : 0
Your IP Address : 216.73.216.136