সৃষ্টিকর্তা সাকার নাকি নিরাকার?!
এক যুক্তিপূর্ণ, বিজ্ঞানভিত্তিক ও শাস্ত্রীয় বিশ্লেষণ…!!!
সৃষ্টিকর্তা- তাঁকে ঈশ্বর, ভগবান, আল্লাহ্, জিওভা, GOD ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
লক্ষ করলে দেখা যাবে প্রত্যেকটি নামই বিশেষণকেন্দ্রিক এবং সবগুলো বিশেষণই কোনো ব্যক্তিকে নির্দেশ করছে, তিনি হলেন সৃষ্টিকর্তা। ঠিক যেমন জলকে কেউ বলে Water, কেউ বলে পানি, কোথাও বলে উজি, কোথাও অ্যাকুয়া। এভাবে বিভিন্ন নামে জল শব্দটি প্রচলিত। কিন্তু যে ভাষাতেই ডাকা হোক না কেন, জলের ধর্মে বা বৈশিষ্ট্যে কোনো পার্থক্য হবে না।
আবার সূর্যকেও বিভিন্ন ভাষায় ডাকা যেতে পারে, সূর্যের অনেক বৈশিষ্ট্যসূচক নামও আছে। এমনকি বাংলাতেও এর সমার্থক শব্দগুলোর একেকটি নাম একেকটি বৈশিষ্ট্যের ওপর আধারিত- যেমন, দিবাকর, প্রভাকর ইত্যাদি। নাম যাই হোক, বস্তু কিন্তু একটাই। তাই তা নিয়ে বিবাদ করার কোনো প্রশ্ন ওঠে না।
কিন্তু সৃষ্টিকর্তাকে সম্বোধন নিয়ে এত বিড়ম্বনা কেন? নামগুলো নিয়ে যেন প্রতিযোগিতার অন্ত নেই। সবাই তার ভাষার নামটাকেই জগৎজুড়ে প্রচার করতে চাইছে। মনে হয় যেন তারা ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্ব। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়?!
এ সকল নামধারী ব্যক্তি কি ভিন্ন ভিন্ন, না একেরই বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যসূচক বা গুণবাচক নাম?! জল, সূর্য বা অন্য বস্তুর ক্ষেত্রে যদি কোনো সমস্যা না থাকে, তবে সৃষ্টিকর্তার বেলায় এমন কেন?! জল সম্বন্ধে বললে যে ভাষাভাষীই হোক না কেন, কেউ কি বলবে জল কঠিন পদার্থ, তার নির্দিষ্ট আকার আছে, জল উর্ধ্বগামী; নাকি সবাই বলবে তা তরল, নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই, জল নিম্নগামী।
তবে জলের একটি রূপ বরফ, তা কঠিন, আরেকটি রূপ বায়বীয় যা নিরাকার। কিন্তু স্বাভাবিক তাপমাত্রায় জল তার নিজস্ব ধর্ম বজায় রাখবে। এটাই তার মূল রূপ।
কিন্তু সৃষ্টিকর্তার বেলায়-কেউ বলে সাকার!! কেউ বলে নিরাকার, তাঁর কোনো আকার নেই!! তিনি নির্বিশেষ ব্রহ্মস্বরূপে ব্যাপ্ত!!
কেউ বলছে জীবই ভগবান!! জীবের মধ্যেই সৃষ্টিকর্তা বিরাজ করেন!!কেউ বলছে তাঁর রূপ আছে, কিন্তু তা আমাদের অদৃশ্য!! কেউ বলছে পরমাত্মাই ভগবান!!
এরকম বিভিন্ন প্রশ্ন মানুষের মাঝে ছড়িয়ে আছে। তবে কোনটি সত্য?! কেন সকলেই সৃষ্টিকর্তা বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না?! কোনটি সঠিক?! তিনি সাকার, নাকি নিরাকার?! যদি সাকারই হন, তবে আমরা তাঁকে দেখতে পাই না কেন?! নানা প্রশ্ন একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে।
প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্তের মধ্যে পার্থক্যের কারণ হলো, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। যেমন, একটি শিশু জানে যে, জল তরল পদার্থ, কিন্তু সে জানে না যে, জলের আরো দুটি রূপ রয়েছে- কঠিন ও বায়বীয়। তারা জলকে স্বীকার করবে, কিন্তু অন্য দুটি রূপকে স্বীকার করবে না, এটাই স্বাভাবিক।
এটা তাদের দোষ নয়, অপূর্ণতা। আবার, যদি কেউ একটিকে স্বীকার করে অন্যটিকে অস্বীকার করে, তবে সেটাও অযৌক্তিক। কারণ, একই পদার্থের তিনটি রূপ। এ প্রবন্ধে এই বিভ্রান্তির সমাধান বিভিন্ন যুক্তি ও শাস্ত্রীয় প্রমাণের ভিত্তিতে আলোচনা করা হলো।
প্রসঙ্গ-১: সৃষ্টিকর্তা সাকার হতে পারেন কি?!
সৃষ্টিকর্তার কথা বলতে গেলেই প্রথম যে কথাটি বলতে হয় তা হলো- তিনি সর্বতোভাবে পূর্ণ। ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে। পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ॥ (ঈশোপনিষদ, আবাহন মন্ত্র) তাঁর মধ্যে কোনো অপূর্ণতা থাকবে না। তাই, যদি বলা হয় সৃষ্টিকর্তা কখনোই সাকার হতে পারেন না। তবে সেটা তার অপূর্ণতারই পরিচায়ক।
আবার তিনি সর্বশক্তিমান। সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় সবকিছুর তিনিই নিয়ন্তা। তাই যদি তাঁর কোনো রূপই না থাকে, তবে কি তাতে তাঁর সর্বশক্তিমত্তা খর্ব হয় না? আবার, আরেক দিক থেকে, আমরা সকলেই সাকার, আমাদের রূপ রয়েছে, আমাদের পিতাদেরও রূপ রয়েছে, তার পিতাদেরও রপ ছিল, এটাই স্বাভাবিক। তবে যিনি সকলের আদি পিতা, তিনি কী করে রূপহীন হবেন? অবশ্যই তাঁরও রূপ রয়েছে।
আবার, সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই তাঁর সৃষ্টি অপেক্ষা কম গুণসম্পন্ন হবেন না। তাই ঈশ্বর, ভগবান, সর্বশক্তিমান, সৃষ্টিকর্তা যাই বলি না কেন, তিনি হবেন সর্বতোভাবে পূর্ণ তাঁর মধ্যে কোনো কমতি বা অভাব থাকবে না। সেজন্য পূর্ণতা হেতু অবশ্যই তাঁর রূপ থাকবে।
প্রসঙ্গ-২: তিনি সাকার নিরাকার উভয়ই তাহলে প্রশ্ন হয়- তিনি কি নিরাকার নন?! যদি তিনি নিরাকার না হন, তবে তিনি কীভাবে এ জগতের সর্বত্র বিরাজ করতে পারেন?! আর যদি তিনি সাকারই হন, তবে কেন আমরা তাঁকে দেখতে পাই না?!
এ প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, যারা ভগবানকে কেবল নিরাকার নির্বিশেষ বলে দাবি করে, তাদের ধারণা ভুল নয়, কিন্তু অপূর্ণ।
কারণ, তারা এটাকেই মূল স্বরূপ বলে মনে করে। যেমন, কোনো ব্যক্তি (যিনি কখনো ট্রেন দেখেননি) দূর থেকে ট্রেনের আলো দেখে মনে করতে পারে যে, ট্রেন এক প্রকার আলো। কিন্তু ব্যক্তিটি যখন প্লাটফর্মে ট্রেনটির কাছাকাছি যাবেন তিনি দেখতে পাবেন ট্রেন হচ্ছে কতগুলো কামড়ার সমষ্টি ও সর্পিলাকার একটি বৃহৎ যানবিশেষ।
আবার যখন ভেতরে প্রবেশ করবেন বা ট্রেনে চড়বেন, তখন তার বাস্তব উপলব্ধি হবে যে, ট্রেন প্রকৃতপক্ষে কী বস্তু। একইভাবে নির্বিশেষবাদী বা নিরাকারবাদীরা মনে করে যে, ভগবানের নির্বিশেষ রূপই সবকিছু। এটা ঠিক দূর থেকে ট্রেনের আলোক দর্শনের মতো।
ভগবানের তিনটি রূপ:
তবে তাঁর নিরাকার স্বরপ কেমন?! সাকার স্বরূপই বা কেমন?! এ ব্যাপারে বেদান্তসূত্রের সম্প্রসারিত ভাষ্য শ্রীমদ্ভাগবতে (১.২.১১) ব্যাসদেব নিজেই প্রমাণ দেখিয়েছেন-
বদন্তি তত্তবিদস্তত্ত্বং যজ্জ্ঞঅনমদ্বয়ং।
ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগবানিতি শব্দ্যতে ॥
“যা অদ্বয় জ্ঞান, এক অদ্বিতীয় বাস্তব বস্তু, তত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতেরা তাঁকেই পরমার্থ বলেন। এই তত্ত্ববস্তু ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভাগবান – এ তিন নামে অভিহিত হন।”
এখানে বলা হচ্ছে তিনি অদ্বয়, মানে তিনি দুই নন, এক। একমেব অদ্বিতীয়ম্। এই অদ্বিতীয় বস্তু তিনটি ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত হন- ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান।
এখন প্রশ্ন হলো ব্রহ্ম কী?!
ব্রহ্ম: ব্রহ্ম ভগবানের অঙ্গনিঃসৃত জ্যোতি এবং তা ভগবানের জ্যোতির্ময় স্বরূপ। যাকে আমরা নিরাকার বলে আখ্যায়িত করে থাকি। যে স্বরূপে তিনি সর্বব্যাপ্ত।
যস্য প্রভা প্রভবতো জগদ-কোটি-
কোটিষ্বশেষবসুধাদিবিভূতিভিন্নম্ ।
তদ্ ব্রহ্ম নিষ্কলমনন্তমশেষভূতং
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ॥
– (ব্রহ্মসংহিতা ৫/৪০)
“যাঁহার প্রভা হইতে উৎপত্তি-নিবন্ধন উপনিষদুক্ত নির্বিশেষব্রহ্ম কোটিব্রহ্মা-গত বসুধাদি বিভূতি হইতে পৃথক হইয়া নিষ্কল অনন্ত অশেষ-তত্ত্বরূপে প্রতীত হন, সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি।”
পরমাত্মা: যে স্বরূপে ভগবান প্রত্যেকটি জীবের হৃদয়ে বিরাজ করেন, তাঁকে বলা হয় পরমাত্মা। পরমাত্মা প্রসঙ্গে ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে-
उपद्रष्टानुमन्ता च भर्ता भोक्ता महेश्वर: ।
परमात्मेति चाप्युक्तो देहेऽस्मिन्पुरुष: पर: ॥
परमात्मेति चाप्युक्तो देहेऽस्मिन्पुरुष: पर: ॥
উপদ্রষ্টানুমন্তা চ ভর্তা ভোক্তা মহেশ্বরঃ।
পরমাত্মেতি চাপ্যুক্তো দেহেহস্মিন্ পুরুষঃ পরঃ॥
– (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৩/২৩)
“এই শরীরে আরেকজন পরম পুরুষ রয়েছেন, যিনি হচ্ছেন উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর এবং তাঁকে পরমাত্মাও বলা হয়।”
দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।
তয়োরণ্যঃ পিপ্পলাং স্বাদ্বত্ত্য অনশ্নন্ন অন্যোহভিচাকশীতি॥
– (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৪/৬)
“একটি গাছে দুটি পাখি আছে। তাদের মধ্যে একটি পাখি গাছে ফলগুলো খাচ্ছে, আর অন্যটি সেই কাজ লক্ষ্য করছে। লক্ষ্যকারী ভগবান এবং ফল ভক্ষণকারী জীবসত্তা।”
ভগবান: যে স্বরূপে তিনি তাঁর নিত্য ধামে নিত্যস্বরূপে সর্বদা বিরাজ করেন, সেটা ভগবান স্বরূপ।
গোলোক এব নিবসত্যখিলাত্মভূতো
গোবিন্দমাদিপুরুষং ত্বমহং ভজামি॥
– (ব্রহ্মসংহিতা ৫/৩৭)
“যে অখিলাত্মভূত (সকল জীবের হৃদয়ে অবস্থানকারী) গোবিন্দ নিত্য স্বীয় গোলোকধামে বাস করেন। সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।”
ভগবদ্গীতায় ভগবান তাঁর ধাম অর্থাৎ তাঁর আবাসস্থল সম্পর্কে বলছেন-
अव्यक्तोऽक्षर इत्युक्तस्तमाहु: परमां गतिम् ।
यं प्राप्य न निवर्तन्ते तद्धाम परमं मम ॥
यं प्राप्य न निवर्तन्ते तद्धाम परमं मम ॥
অব্যক্তেহক্ষর ইত্যুক্তস্তমাহুঃ পরমাং গতিং।
যং প্রাপ্য ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম॥
– (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৮/২১)
“কেউ যখন সেখানে যায়, তখন আর তাঁকে এই জগতে ফিরে আসতে হয় না। সেটিই হচ্ছে আমার পরম ধাম।”
প্রকৃতপক্ষে, এমন নয় যে, ব্রহ্ম, পরমাত্মা, ভগবান- তিনটি আলাদা ব্যক্তিসত্তা। এই তিনটি স্বরূপ একই বস্তুর তিনটি প্রকাশ। তাঁদের মধ্যে সত্তাগত কোনো পার্থক্য নেই, কেবল প্রকাশজনিত পার্থক্য বিদ্যমান। তাই একে বলা হয় অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্ব।
দৃষ্টান্ত-১: রসমালাই একটি সুমিষ্ট আহার্য। প্রথমে আমরা তার গন্ধ অনুভব করতে পারি। তারপর গন্ধ শুকে এর কাছে যেতে পারি এবং তার রূপ দেখতে পারি এবং পরিশেষে তা আহার করতে পারি। রসমালাইয়ের গন্ধ, তার রূপ ও তার স্বাদ আলাদা নয় একই বস্তু থেকে উদ্ভুত।
কেবল তিনটি পর্যায়ে রসমালাই সম্বন্ধে পূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়। কেউ যদি কেবল গন্ধকে, কেউ কেবল গন্ধ ও রূপ দেখে আস্বাদন না করে, তবে সে রসমালাই সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করতে পারবে না। একইভাবে ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান পরমতত্ত্বের তিনটি রূপভেদ। ভগবৎস্বরূপ অস্বীকার করে কেবল ব্রহ্ম ও পরমাত্মার উপলব্ধি অসম্পূর্ণ।
দৃষ্টান্ত-২: দূর থেকে একটি পাহাড়কে দেখলে কেবল একটি ধূসর বৃহৎ স্তুপ বলে মনে হবে। যখনই আমরা তার কাছে যাব, তখন দেখতে পাব পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য গাছপালা আছে। আরো কাছে গেলে দেখতে পাব পাহাড়ের মধ্যে কত বিচিত্র জন্তুর বসবাস, ঝরণা, নদী আরো কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা। কিন্তু দূর থেকে পাহাড় দেখে যদি কেউ পাহাড় সম্বন্ধে সম্যক ধারণা হয়ে গেছে বলে মনে করে, তবে বুঝতে হবে সেটা তার অজ্ঞতারই পরিচায়ক।
দৃষ্টান্ত-৩: আবার সূর্যগোলোক, সূর্যরশ্মি ও সূর্যের তাপ- এই তিনটি কোনো ভিন্ন সত্তা থেকে উৎপন্ন নয়। একই সত্তা থেকেই উৎপন্ন। এই তিনটিকে আলাদা আলাদাভাবে চিন্তা করা যায় না। কেউ যদি সূর্যকে অস্বীকার করে সূর্যরশ্মি বা আলোকেই প্রকৃত স্বরূপ বলে মনে করে, তবুও সেটা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।
দৃষ্টান্ত-৪: আমরা জানি, ভগবান সকল জীবের হৃদয়ে পরমাত্মারূপে বিরাজমান। তবে কোনো ব্যক্তি যখন মারা যায়, তখন কি ঐ দেহে ভগবান অবস্থান করেন? উত্তর হবে না। কেন?! কারণ আত্মা তো দেহ ছেড়ে চলে গেছে। তবে ভগবান যদি সর্বত্র বিরাজমান হন, তিনি কি মৃতদেহে বিরাজ করেন না?! অবশ্যই করেন। কীভাবে?!
এখানে প্রথম ক্ষেত্রে প্রতিটি জীবদেহে ভগবান পরমাত্মারূপে বিরাজ করেন। আর মৃতদেহে ভগবান কেবল ব্রহ্মরূপে বিরাজ করেন। একটি জীবিত দেহে ব্রহ্ম ও পরমাত্মা দুটিই বিরাজ করে। আর মৃত দেহে ভগবান ব্রহ্মরূপে বিরাজ করেন।
তাই সিদ্ধান্ত এই যে, ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান তিনটিই সৃষ্টিকর্তার রূপ। কোনোটিই পৃথক সত্তা নয়। একই সৃষ্টিকর্তার রূপভেদ। এই তিনি তত্ত্বের কেবল একটিকে স্বীকার করে অন্যটিকে অস্বীকার করা ভগবতত্ত্ব সম্বন্ধে অজ্ঞতার পরিচায়ক।
প্রসঙ্গ-৩: তিনি অচিন্ত্য বিরুদ্ধাবিরুদ্ধ ধর্মবিশিষ্ট অচিন্ত্য বিরুদ্ধাবিরুদ্ধ ধর্মের সমাবেশ ছাড়া সর্বশক্তিমান হওয়া সম্ভব নয়। সর্বশক্তিমান না হলে অনন্ত মহিমাও থাকা সম্ভব নয়। বিরুদ্ধ ধর্মের প্রকাশ না হলে কেবল অবিরুদ্ধ বা একপক্ষীয় ধর্ম সর্বশক্তিমত্তার পরিচায়ক হয় না।
যেমন: কোনো ক্ষুদ্র বস্তু যদি বৃহৎ হতে না পারে, তবে তাকে যেমন সর্বশক্তিমান বলা যায় না, তেমনি কোনো বৃহৎ বস্তু ক্ষুদ্র হতে না পারলেও তা সর্বশক্তির পরিচায়ক নয়। যা অসম্ভব, তা-ই সম্ভব হলে তাঁকে বলে অচিন্ত্য বিরুদ্ধাবিরুদ্ধ ধর্ম। যুগপৎ হন, আবার নন।
যেমন, ভগবান সাকার হয়েও নিরাকার হতে পারেন এবং ইচ্ছানুযায়ী যেকোনো রূপ পরিগ্রহ করতে পারেন। এখানেই তাঁর সর্বশক্তিমত্তার পরিচয়।
নিম্নের ভগবানের কয়েকটি বিরুদ্ধাবিরুদ্ধ ধর্ম উল্লেখ করা হলো :
শাস্ত্রীয় প্রমাণ:
- “অণোরণীয়ান্ মহতো মহীয়ান্” (শ্বেতাশ্ব তর উ. ৩/২০) অর্থাৎ পরমেশ্বর ভগবান ক্ষুদ্র থেকেও ক্ষুদ্রতর, বৃহৎ থেকেও বৃহত্তর।
- “অজায়মানো বহুধা বিজায়ত্যে” (পুরুষসূক্ত) অর্থাৎ তিনি জন্মরহিত হয়েও বহু প্রকারে জন্মগ্রহণ করেন।
- “মূর্তঞ্চৈবামূর্তঞ্চ…” (বৃহদারণ্যক) অর্থাৎ তিনি মূর্ত, তিনিই অমূর্ত।
- “দূরাৎ সুদূরে তদিহান্তিকে চ…” (মু-ক উ. ৩/১/৭) অর্থাৎ তিনি দূর থেকেও সুদূরে এবং নিকট থেকেও নিকটে।
- “অপানিপাদো জবনো গ্রহীতা…” (শ্বে. উ. ৩/১১) অর্থাৎ তিনি হস্তপদরহিত হয়েও গমন ও গ্রহণ করেন।
- “সর্বতঃ পাণিপাদং তৎ…” (শ্বে. উ. ৩/১৬) অর্থাৎ সর্বত্র তাঁর হস্ত ও পদ বিস্তৃত। আবার তিনি
- “অপাণিপাদো…” (শ্বে. উ. ৩/১৯) অর্থাৎ হস্ত-পদহীন।
- “পশ্যত্যচক্ষুঃ…” (শ্বে. উ. ৩/১৯) অর্থাৎ তিনি অচক্ষু হয়েও দেখেন। আবার তিনি “সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ।” (শ্বে. উ. ৪/১৪) অর্থাৎ তিনি সহস্র সহস্র শির, চক্ষু ও চরণবিশিষ্ট।
- “অরসনিড়বত্যমগন্ধবচ্চ…” (কঠ উ. ১/৩/১৫) অর্থাৎ তিনি অরস ও গন্ধহীন- তিনি নিত্য। আবার “সর্বগন্ধঃ সর্বরসঃ…” (ছান্দো উ. ৩/১৪/২) অর্থাৎ তিনিই সর্বগন্ধ, সর্বরস।
প্রসঙ্গ-৪: তবে তাঁর মূল স্বরূপ সাকার, নিরাকার তাঁর একটি প্রকাশ
নির্বিশেষ বা নিরাকারবাদীরা বলে থাকে “ব্রহ্মই সকল কিছুর উৎস। ব্রহ্ম থেকেই সকল কিছু প্রকাশিত হয়েছে। ব্রহ্ম যখন কোনো বিশেষ রূপ পরিগ্রহ করেন, তখন তিনি কৃষ্ণ, বিষ্ণু আদি বিভিন্ন অবতাররূপে লীলা করেন। ব্রহ্ম নিরাকার। এই নিরাকার ব্রহ্ম থেকেই অন্যসব প্রকাশসমূহের সৃষ্টি হয়েছে।” কিন্তু তাদের এ ধারণা ভ্রান্ত, অযৌক্তিক ও অশাস্ত্রীয়।
দৃষ্টান্ত-১: যেমন সূর্য সাকার। তার থেকে নির্গত রশ্মি ও তাপ নিরাকার। এখন প্রশ্ন হলো সূর্যরশ্মির উৎস সূর্য; নাকি সূর্যের উৎস সূর্যরশ্মি। আবার প্রদীপ থেকে শিখা নির্গত হয়, বাল্ব থেকে আলো নির্গত হয়। আলো এবং শিখা নিরাকার কিন্তু তার উৎস বাল্ব সাকার।
শক্তিমান থেকেই শক্তির প্রকাশ হয়। তাই শক্তিমান সাকার কিন্তু শক্তি নিরাকার। একইভাবে ভগবানের শক্তি ব্রহ্ম নিরাকার কিন্তু ব্রহ্মের উৎস ভগবান সাকার।
কেউ যদি জিজ্ঞেস করে সূর্য বৃহৎ নাকি তাঁর আলোকমণ্ডল বৃহৎ। স্বভাবতই উত্তর হবে আলোকমণ্ডল বৃহৎ। যেহেতু সূর্যের আলোকমণ্ডল সূর্যের চতুর্দিকে বিস্তৃত; আপাতবিচারে মনে হতে পারে সূর্য অপেক্ষা সূর্যরশ্মির ব্যাপ্তি অধিক এবং তা আলোকমণ্ডলেরই অংশ।
কিন্তু প্রকৃত অর্থে সূর্যের আলোক সূর্যেরই অংশ। তদনুরূপ যেহেতু ব্রহ্ম সর্বব্যাপী এবং ভগবানের নির্দিষ্ট আকার রয়েছে, তাই কেউ কেউ ভগবানকে ব্রহ্মের অংশ বলে মনে করতে পারে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ব্রহ্মের উৎস স্বয়ং ভগবান। তাই ভগবান তাঁর ব্রহ্মস্বরূপে সর্বত্র ব্যাপ্ত হলেও তা ভগবানেরই অঙ্গনিঃসৃত জ্যোতি।
শাস্ত্রীয় প্রমাণ:
हिरण्मयेन पात्रेण सत्यस्यापिहितं मुखम् ।
तत्त्वं पूषन्नपावृणु सत्यधर्माय दृष्टये ॥
तत्त्वं पूषन्नपावृणु सत्यधर्माय दृष्टये ॥
হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্।
তৎ ত্বং পূষন্নপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে॥
– (ঈশোপনিষদ মন্ত্র ১৫)
“হে ভগবান, হে সর্বজীব পালক, আপনার উজ্জ্বল জ্যোতির দ্বারা আপনার প্রকৃত মুখারবিন্দ আচ্ছাদিত। কৃপা করে সেই আচ্ছাদন দূর করুন এবং আপনার শুদ্ধ ভক্তের নিকট নিজেকে প্রদর্শন করুন।”
पूषन्नेकर्षे यम सूर्य प्राजापत्य व्यूह रश्मीन् समूह तेजः।
यत्ते रूपं कल्याणतमं तत्ते
पश्यामि योऽसावसौ पुरुषः सोऽहमस्मि॥
यत्ते रूपं कल्याणतमं तत्ते
पश्यामि योऽसावसौ पुरुषः सोऽहमस्मि॥
পূষন্নেকর্ষে যম সূর্য প্রাজাপত্য
বূহ্য রশ্মীন্ সমূহ তেজো।
যৎ তে রূপং কল্যাণতমং তৎ তে পশ্যামি
যোহসাবসৌ পুরুষঃ সোহহমস্মি॥
– (ঈশোপনিষদ মন্ত্র ১৬)
“হে প্রভু, হে আদি কবি ও বিশ্বপালক, হে যম, শুদ্ধ ভক্তদের পরমগতি এবং প্রজাপতিদের সুহৃদ- কৃপা করে আপনার অপ্রাকৃত রশ্মির জ্যোতি অপসারণ করুন যাতে আপনার আনন্দময় রূপ আমি দর্শন করতে পারি। আপনি সনাতন পুরুষোত্তম ভগবান। সূর্য ও সূর্যকিরণের সম্বন্ধের মতো আপনার সাথে আমি সম্বন্ধযুক্ত।”
ब्रह्मणो हि प्रतिष्ठाहममृतस्याव्ययस्य च ।
शाश्वतस्य च धर्मस्य सुखस्यैकान्तिकस्य च ॥
शाश्वतस्य च धर्मस्य सुखस्यैकान्तिकस्य च ॥
ব্রহ্মণো হি প্রতিষ্ঠাহমমৃতস্যাব্যয়স্য চ।
শাশ্বতস্য চ ধর্মস্য সুখস্যৈকান্তিকস্য চ॥
– (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৪/২৭)
“আমিই নির্বিশেষ ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা বা আশ্রয়। অব্যয় অমৃতের, শাশ্বত ধর্মের এবং ঐকান্তিক সুখের আমিই আশ্রয়।”
এখানে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্ণনা করছেন, যে তিনিই ব্রহ্মের আশ্রয়। অর্থাৎ ব্রহ্ম তাঁর থেকে প্রকাশিত হয়েছে। অনেকের ধারণা যে, ভগবান প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্ম। ব্রহ্মই পরবর্তীতে রূপ বা ব্যক্তিত্ব পরিগ্রহ করেছেন, তাদের অজ্ঞতা সম্পর্কে ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে-
अव्यक्तं व्यक्तिमापन्नं मन्यन्ते मामबुद्धय: ।
परं भावमजानन्तो ममाव्ययमनुत्तमम् ॥
परं भावमजानन्तो ममाव्ययमनुत्तमम् ॥
অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ।
পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্॥
– (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৭/২৪)
“বুদ্ধিহীন মানুষেরা, যারা আমাকে জানে না, মনে করে যে, আমি পূর্বে অব্যক্ত নির্বিশেষ ছিলাম, এখন ব্যক্তিত্ব পরিগ্রহ করেছি। তাদের অজ্ঞতার ফলে তারা আমার অব্যয় ও সর্বোত্তম পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয়।”
सुदुर्दर्शमिदं रूपं दृष्टवानसि यन्मम ।
देवा अप्यस्य रूपस्य नित्यं दर्शनकाङ्क्षिण: ॥
देवा अप्यस्य रूपस्य नित्यं दर्शनकाङ्क्षिण: ॥
সুদুর্দর্শমিদং রূপং দৃষ্টবানসি যন্মম।
দেবা অপ্যস্য রূপস্য নিত্যং দর্শনকাক্সিক্ষণঃ॥
– (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১১/৫২)
“পরমেশ্বর ভগবান বললেনÑ তুমি আমার যে রূপ এখন দেখছ তা অত্যন্ত দুর্লভ দর্শন। দেবতারাও এই রূপের সর্বদা দর্শনাকাক্সক্ষী। ”
এসকল প্রমাণ সত্ত্বেও যারা ভগবানকে ব্যক্তিত্বহীন বলে দাবি করে। তাদের উদ্দেশ্যে ভগবান ভগবদ্গীতায় বলছেন-
नाहं प्रकाश: सर्वस्य योगमायासमावृत: ।
मूढोऽयं नाभिजानाति लोको मामजमव्ययम् ॥
मूढोऽयं नाभिजानाति लोको मामजमव्ययम् ॥
নাহং প্রকাশঃ সর্বস্য যোগমায়াসমাবৃতাঃ।
মূঢ়োহয়ং নাভিজানাতি লোকো মামজমব্যয়ম্॥
– (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৭/২৫)
“আমি মূঢ় ও বুদ্ধিহীন ব্যক্তিদের কাছে কখনো প্রকাশিত হই না। তাদের কাছে আমি আমার অন্তরঙ্গা শক্তি যোগমায়ার দ্বারা আবৃত থাকি। তাই, তারা আমার অজ ও অব্যয় স্বরূপকে জানতে পারে না।”
কোন রূপের আরাধনা করা শ্রেষ্ঠ:
एवं सततयुक्ता ये भक्तास्त्वां पर्युपासते ।
ये चाप्यक्षरमव्यक्तं तेषां के योगवित्तमा: ॥
ये चाप्यक्षरमव्यक्तं तेषां के योगवित्तमा: ॥
এবং সততযুক্তা যে ভক্তাস্ত্বাং পর্যুপাসতে।
যে চাপ্যক্ষরমব্যক্তং তেষাং কে যোগবিত্তমাঃ॥
– (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১২/১)
অর্জুন জিজ্ঞেস করলেন- “এভাবেই নিরন্তর ভক্তিযুক্ত হয়ে যেসমস্ত ভক্তেরা যথাযথ-ভাবে তোমার আরাধনা করেন এবং যাঁরা ইন্দ্রিয়াতীত অব্যক্ত ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তাঁদের মধ্যে কারা শ্রেষ্ঠ যোগী।”
मय्यावेश्य मनो ये मां नित्ययुक्ता उपासते ।
श्रद्धया परयोपेतास्ते मे युक्ततमा मता: ॥
श्रद्धया परयोपेतास्ते मे युक्ततमा मता: ॥
ময্যাবেশ্য মনো যে মাং নিত্যয়ুক্তা উপাসতে।
শ্রদ্ধয়া পরয়োপেতাস্তে মে যুক্ততমা মতাঃ॥
– (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১২/২)
শ্রীভগবান বললেন- “যাঁরা তাঁদের মনকে আমার সবিশেষ রূপে নিবিষ্ট করেন এবং অপ্রাকৃত শ্রদ্ধা সহকারে নিরন্তর আমার উপাসনা করেন, আমার মতে তাঁরাই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।”
क्लेशोऽधिकतरस्तेषामव्यक्तासक्तचेतसाम् ।
अव्यक्ता हि गतिर्दु:खं देहवद्भिरवाप्यते ॥
अव्यक्ता हि गतिर्दु:खं देहवद्भिरवाप्यते ॥
ক্লেশোহধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম্।
অব্যক্তা হি গতির্দুঃখং দেহবদ্ভিরবাপ্যতে॥
– (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১২/৫)
“যাদের মন ভগবানের অব্যক্ত নির্বিশেষ রূপের প্রতি আসক্ত, তাদের ক্লেশ অধিকতর। কারণ, অব্যক্তের উপাসনার ফলে দেহধারী জীবদের কেবল দুঃখই লাভ হয়।”
প্রসঙ্গ-৫: বেদে ভগবানের সাকারত্ত্ব প্রতিপাদিত
प॒रो मात्र॑या त॒न्वा॑ वृधान॒ न ते॑ महि॒त्वमन्व॑श्नुवन्ति ।
उ॒भे ते॑ विद्म॒ रज॑सी पृथि॒व्या विष्णो॑ देव॒ त्वं प॑र॒मस्य॑ वित्से ॥
পরো মাত্রয়া তন্বা বৃধান ন তে মহিত্বমন্বশ্নুবন্তি।
উভে তে বিদ্ম রজসী পৃথিব্যা বিষ্ণো দেব ত্বং পরমস্য বিৎসে॥
– (ঋগ্বেদ-মণ্ডল ৭, সূক্ত ৯৯, মন্ত্র ১)
“হে বিষ্ণু, তুমি মাত্রার অতীত শরীরে বর্ধমান হলে তোমার মহিমা কেউ অনুব্যাপ্ত করতে পারে না, পৃথিবী হতে আরম্ভ করে উভয় লোক আমরা জানি, কিন্তু তুমিই কেবল হে দেব, পরমলোক অবগত আছ।”
स॒हस्र॑शीर्षा॒ पुरु॑षः सहस्रा॒क्षः स॒हस्र॑पात्।
स भूमिं॑ वि॒श्वतो॑ वृ॒त्वात्य॑तिष्ठद्दशाङ्गु॒लम् ॥
সহস্রাশীর্ষা পুরুষাঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রাপাৎ।
স ভূমিং বিশ্বতো বৃহাত্যতিষ্ঠদ্দশাঙ্গুলম্ ॥
– (ঋগ্বেদ১০/৯০/১)
“পুরুষের সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু ও সহস্র চরণ।…”
इ॒दं विष्णु॒र्वि च॑क्रमे त्रे॒धा नि द॑धे प॒दम्।
समू॑ळ्हमस्य पांसु॒रे ॥
ইদং বিষ্ণুর্বি চক্রমে ত্রেধা নিদধে পদং।
সমূলহমস্য পাংসুওে॥
– (ঋগ্বেদ ১/ ২২/ ১৭)
“বিষ্ণু এ জগৎ পরিক্রমা করেছিলেন, তিন প্রকার পদবিক্ষেপ করেছিলেন, তাঁর ধুলিযুক্ত পদে জগৎ আবৃত হয়েছিল।”
त्रीणि॑ प॒दा वि च॑क्रमे॒ विष्णु॑र्गो॒पा अदा॑भ्यः।
अतो॒ धर्मा॑णि धा॒रय॑न् ॥
ত্রীণি পদা বি চক্রমে বিষ্ণু র্গোপা অদাভ্যাঃ।
অতো ধর্মাণি ধারয়ন্॥
– (ঋগ্বেদ ১/ ২২/১৮)
“বিষ্ণু রক্ষক, তাঁকে কেহ আঘাত করতে পারে না, তিনি ধর্ম সমুদয় ধারণ করে তিন পদ পরিক্রমা করেছিলেন।”
तद्विष्णो॑: पर॒मं प॒दं सदा॑ पश्यन्ति सू॒रय॑:।
दि॒वी॑व॒ चक्षु॒रात॑तम् ॥
তদ্বিষ্ণো পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ।
দিবীব চক্ষুরাততম্॥
– (ঋগ্বেদ ১/২২/২০)
“আকাশে সর্বতো বিচারী যে চক্ষু যেরূপ দৃষ্টি করে, বিদ্বানেরা বিষ্ণুর পরমপদ সেরূপ দৃষ্টি করেন।”
तद्विप्रा॑सो विप॒न्यवो॑ जागृ॒वांस॒: समि॑न्धते।
विष्णो॒र्यत्प॑र॒मं प॒दम् ॥
তদ্বিপ্রাসো বিপন্যবো জাগৃবাংসঃ সমিন্ধতে।
বিষ্ণো র্যৎ পরমং পদম॥
– (ঋগ্বেদ ১/২২/২১)
“স্তুতিবাদক ও সদাজাগরূক মেধাবী লোকেরা যে বিষ্ণুর পরমপদ প্রদীপ্ত করেন।”
यः पू॒र्व्याय॑ वे॒धसे॒ नवी॑यसे सु॒मज्जा॑नये॒ विष्ण॑वे॒ ददा॑शति।
यो जा॒तम॑स्य मह॒तो महि॒ ब्रव॒त्सेदु॒ श्रवो॑भि॒र्युज्यं॑ चिद॒भ्य॑सत् ॥
যঃ পূর্ব্যায় বেধসে নবীয়সে সুমজ্জানয়ে বিষ্ণবে দদাশতি।
যঃ জাতমস্য মহতো মহি ব্রবৎ সেদূ শ্রবোভির্যূজ্যং চিদভ্যসৎ॥
– ( ঋগ্বেদ- মণ্ডল ১, সূক্ত ১৫৬, মন্ত্র ২)
“যে মনুষ্য প্রাচীন, মেধাবী, নিত্য নতুন ও সূমজ্জানি বিষ্ণুকে হব্য প্রদান করেন; যিনি মহানুভব বিষ্ণুর পূজনীয় জন্ম (কথা) কীর্তন করেন, তিনিই যুজ্য (ভগবানের ধাম) প্রাপ্ত হন।
উপর্যুক্ত প্রমাণসমূহ নিঃসন্দেহে সৃষ্টিকর্তার সাকারত্ত্ব প্রতিপন্ন করে। প্রকৃতপক্ষে ভগবান হলেন অধোক্ষজ। তাই আমরা জাগতিক বিচার, বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়ের দ্বারা তাঁকে দর্শন বা উপলব্ধি করতে পারবো না। কারণ আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহ ত্রুটিপূর্ণ।
মুণ্ডক উপনিষদ ৩/২/৩– এ বলা হয়েছে-
नायमात्मा प्रवचनेन लभ्यो न मेधया न बहुना श्रुतेन ।
यमेवैष वृणुते तेन लभ्यस्तस्यैष आत्मा विवृणुते तनूं स्वाम् ॥
यमेवैष वृणुते तेन लभ्यस्तस्यैष आत्मा विवृणुते तनूं स्वाम् ॥
নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো ন মেধসা ন বহুনা শ্রুতেন।
যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্য-স্তস্যৈষ আত্মা বিবৃণুতে তনুং স্বাম্॥
“সুদক্ষ বিশ্লেষণের দ্বারা, বিশাল বুদ্ধিমত্তার দ্বারা, এমনকি বহু শ্রবণের দ্বারাও ভগবানকে লাভ করা যায় না। ভগবানকে তিনিই লাভ করতে পারেন, যাঁকে ভগবান কৃপা করেন। তাঁর কাছে তিনি তাঁর স্বরূপ প্রকাশ করেন।”
তাই অযথা সৃষ্টিকর্তার নিরাকারত্ব নিয়ে আস্ফালন না করে শাস্ত্রীয় প্রমাণের ভিত্তিতে তাঁর নিত্য সাকার স্বরূপের আরাধনা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবেই ভগবান আমাদের নিকট তাঁকে প্রকাশ করবেন।
॥হরে কৃষ্ণ॥