দেবী দুর্গা এবং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কি একই তত্ত্ব?
শ্রীল চক্রবর্তী ঠাকুর টীকায় লিখেছেন-
তদেবমিদানীং মদবতারেণ তৃদবতারেণ চ লোকাঃ কেচিদ্ বৈষ্ণবাঃ কেচিচ্ছাক্তাশ্চ ভবিষ্যন্তীতি ভাবঃ।
অনুবাদ:-
এই প্রকারে আমার ও তোমার অবতারহেতু কতক গুলি লোক বৈষ্ণব এবং কতক গুলি লোক শাক্ত হবেন, এটাই বোঝা যায়।”
অবশ্য শুদ্ধ বৈষ্ণব বা শুদ্ধ-শাক্ত কখনও প্রাকৃত কামনা বা বাসনার দাস হয়ে শ্রীভগবানের নিকট তার শ্রীচরণে শুদ্ধভক্তি ব্যতীত অন্য কোন প্রাকৃত কাম-বরাদি প্রার্থনা করেন না।
তাঁদের প্রার্থনা-
ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং কবিতাং বা জগদীশ কাময়ে। মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে ভবতা ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ি ॥
ধন জন নাহি মাগো কবিতা সুন্দরী।
শুদ্ধভক্তি দেহ কৃষ্ণ মোরে কৃপা করি।
ইত্যাদি।
যারা জড় কামনা-বাসনায় আবদ্ধ থাকেন, অর্থাৎ যাদের মন ইন্দ্রিয়সুখ বা দেহগত ভোগলালসায় নিয়ন্ত্রিত, তারাই নানা রকম অস্থায়ী বস্তু ভোগের ইচ্ছা প্রকাশ করে ভগবানকে যেন অস্থির করে তোলে।
সেই সকল সীমাবিশিষ্ট ফলকামী ব্যক্তিকে শ্রীভগবান্ ‘অল্পবুদ্ধি’ বলেছেন-
অন্তবত্তু ফলং তেষাং তদ্ ভবত্যল্পমেধসাম্।
দেবান্ দেবযজো যান্তি মদ্ভক্তা যান্তি মামপি।।
[গীতা ৭।২৩]
অনুবাদ:-
অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিদের আরাধনা লব্ধ সেই ফল অস্থায়ী। দেবোপাসকগণ দেবলোক প্রাপ্ত হন, কিন্তু আমার ভক্তেরা আমার পরম ধাম প্রাপ্ত হন।
শুদ্ধ বৈষ্ণবগণ শ্রীকৃষ্ণের সর্ব্বশক্তির অধিষ্ঠাত্রী শ্রীবার্ষভানবী দেবী (শ্রীমতী রাধারাণী)-র আনুগত্যে কৃষ্ণের আরাধনা করেন বলে তাঁরাই প্রকৃত শুদ্ধ-শাক্ত।
শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দের লীলাপুষ্টিকারিণী চিৎশক্তি যোগমায়া সেই ‘সমস্তের পরা ঠাকুরাণী’ শ্রীরাধারাণীরই অংশ। তিনি ত্রিগুণাতীতা। ত্রিগুণময়ী মহামায়া তাঁহারই ছায়ারূপিণী। যোগমায়া উন্মুখমোহিনী অন্তরঙ্গা শক্তি যিনি জীবকে ভগবানের দিকে আকৃষ্ট করে, আর মহামায়া বিমুখমোহিনী বহিরঙ্গা বা জড়াশক্তি যিনি জীবকে জড় জগতে আবদ্ধ রাখে।
অনেকেই তত্ত্বজ্ঞানহীনতাবশতঃ দুইটি তত্ত্বকেই একাকার
করে বসেন। একই মায়ার অপ্রাকৃত ও প্রাকৃত জগৎ সম্মোহনকার্য্য।
শ্রীল শ্রীজীব গোস্বামিপাদ ব্রহ্মসংহিতা-গ্রন্থের টীকায় লিখেছেন –
কোন কোন স্থানে যোগমায়াকেই যে অষ্টাদশা-ক্ষর কৃষ্ণমন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী এইরূপ বলা হয়েছে,
এই বিষয়টি শক্তিমান ও তাঁর শক্তির অভিন্ন সম্পর্কের দৃষ্টিতেই বুঝতে হবে।
গৌতমীয় কল্পে কথিত আছে-
“যঃ কৃষ্ণঃ সৈব দুর্গা স্যাদ্ যা দুর্গা কৃষ্ণ এব সঃ। অনয়োরন্তরাদর্শী সংসারান্নো বিমুচ্যতে।” ইত্যাদি।
অর্থাৎ যিনি কৃষ্ণ, তিনিই দুর্গা, আবার যিনি দুর্গা তিনিই কৃষ্ণ, ইঁহাদের মধ্যে ভেদদর্শী কখনই মায়িক সংসার-বন্ধন হইতে মুক্ত হইতে পারেন না।
এই যায়গায় শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ংই তার স্বরূপশক্তিরূপে দুর্গা নামধারী, সুতরাং এই দুর্গা মায়াংশভূতা ত্রিগুণময়ী ব্রহ্মাণ্ডভাণ্ডোদরী ভূবনপূজিতা দুর্গার সাথে এক পর্যায়ে গৃহীত হবে না।
সেখানে দুর্গা শব্দের নিরুক্তি এই প্রকার- ‘ক্বচ্ছ্রেণ দুরারাধনাদি বহুপ্রয়াসেন গম্যতে জ্ঞায়তে ইতি’ অর্থাৎ ‘দুরারাধ্য কৃষ্ণের আরাধনা বহু ক্বচ্ছ্র প্রয়াস সাধ্য। বহু কষ্টে তাঁকে জানা যায় -এই জন্যই তিনি দুর্গা নামধারী।
শ্রীনারদ পঞ্চরাত্রে শ্রুতিবিদ্যাসংবাদেও বলা হয়েছে-
একেয়ং প্রেমসর্বস্বস্বভাবা গোকুলেশ্বরী।
অস্যা আবরিকা শক্তির্মহামায়া অখিলেশ্বরী।
অনুবাদ:-
শ্রীগোকুলেশ্বরী যোগমায়া প্রেমসর্ব্বস্বস্বভাবা, তারই আবরিকা শক্তি অখিলেশ্বরী মহামায়া।
অনেকস্থলে বিদ্ধশাক্তগণ শ্রীদুর্গাদেবীকে শ্রীগোবিন্দের ইচ্ছানুবর্তিনী এইরূপ বলার প্রয়াস করেন।
কিন্তু জগদ্গুরু শ্রীব্রহ্মা তাঁর স্তবে বলেছেন-
সৃষ্টি-স্থিতি প্রলয় সাধনশক্তিরেকা
ছায়েব যস্য ভুবনানি বিভর্ত্তি দুর্গা।
ইচ্ছানুরূপমপি যস্য চ চেষ্ঠতে সা
গোবিন্দমাদি পুরুষং তমহং ভজামি।
[ ব্রহ্মসংহিতা ৫।৪৪ ]
অনুবাদ:-
স্বরূপশক্তি বা চিৎশক্তির ছায়াস্বরূপা প্রাপঞ্চিক জগতের সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়সাধিনী মায়াশক্তিই ভুবনপূজিতা দুর্গা। তিনি যাঁর ইচ্ছানুরূপ চেষ্টা করেন, সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।
অবশ্য চিৎশক্তি যোগমায়া ও অ-চিৎশক্তি মহামায়া উভয়েই গোবিন্দের ইচ্ছানুবর্ত্তিনী। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হইতে আরম্ভ করে রাসাদি ব্রজের যাবতীয় লীলা শ্রীযোগমায়া কৃষ্ণেচ্ছানুবর্ত্তিনী হয়ে পুষ্ট করেন। সৃষ্ট্যাদি প্রাপঞ্চিক লীলাও ঐ যোগমায়ার ছায়া স্বরূপিণী মহামায়াই কৃষ্ণেচ্ছানুবর্ত্তিনী হয়ে সম্পাদন করে থাকেন। কিন্তু বহির্মুখ জীবগণকে দণ্ডপ্রদানাদি কতকগুলি অপ্রীতিকর কার্য্য তাঁকে করতে হওয়ায় তিনি কৃষ্ণের সম্মুখবর্ত্তিনী হয়ে দর্শনপথে থাকতে বিলজ্জমানা হন-
বিলজ্জমানয়া যস্য স্থাতুমীক্ষাপথেহমুয়া।
বিমোহিতা বিকত্থন্তে মমাহমিতি দুর্ধিয়ঃ।।
[ শ্রীমদ্ভাগবত ২।৫।১৩ ]
অনুবাদ:-
ভগবানের মায়াশক্তি তাঁর কার্যকলাপের জন্য লজ্জাবোধ করার ফলে ভগবানের সম্মুখে আসতে পারেন না। কিন্তু যে সমস্ত জীব মায়ার দ্বারা মোহিত হয়েছে, তারা সর্বদাই ‘আমি’ এবং ‘আমার’ এই চিন্তায় মগ্ন হয়ে সর্বক্ষণ প্রলাপ করে।
তাই যাঁরা বলে থাকে “শ্রীকৃষ্ণ আর দেবী দুর্গা একই তত্ত্ব” তাঁরা কেবল মাত্র অপপ্রচার করে থাকে মাত্র। তাঁদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। আমাদের উচিত শুদ্ধ ভক্তদের তত্ত্বাবধানে শাস্ত্র অধ্যায়ন করা, তাহলে আমরা বিভ্রান্ত হবো না বা কেউ অপপ্রচার করলে আমরা বুঝতে পারবো।
।।হরে কৃষ্ণ।। প্রণাম।।
প্রচারে: স্বধর্মম্ ™
তথ্যসূত্র:
শ্রীচৈতন্য বানী, ২১বর্ষ, পৃষ্ঠা ১৫৯-১৬০
Views Today : 202
Total views : 118869
Who's Online : 1
Your IP Address : 216.73.216.136