সকল অবতারের মূল কে?

IMG-20250920-WA0045

শ্রীকৃষ্ণ হলেন সকল অবতারের মূল।  কারন পরমেশ্বর ভগবানরুপে শ্রীকৃষ্ণ চিন্ময় জগৎ গোলক বৃন্দাবনে নিত্য বিরাজমান ( গোপালতাপনী উপনিষদঃ পূর্ব ২/৩৫)।তাঁর থেকে আবির্ভূত হন বিষ্ণু।এ বিষয়ে বিভিন্ন সনাতনী শাস্ত্রের ন্যায়  ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ শাস্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে-

দৃষ্টা শূন্যময়ং বিশ্বমলোকঞ্চ ভয়ঙ্করম্।

নির্জন্তু নির্জ্জলং ঘোরং নির্ব্বাতং তমসাবৃতম্।। ১

বৃক্ষ শৈলসমুদ্রাদিবিহীনং বিকৃতাকৃতম্।

নির্মূর্ত্তিকঞ্চ নির্ব্বাতং নিঃশস্যং নিস্তৃণং দ্বিজ ॥২

আলোক্য মনসা সর্ব্বমেক এবাসহায়বান্।

স্বেচ্ছয়া স্রষ্টুমারেভে সৃষ্টিং স্বেচ্ছাময়ঃ প্রভুঃ ॥৩

আবির্ব্বভূবঃ সর্ব্বাদৌ পুংসো দক্ষিণপার্শ্বতঃ।ভবকারণরূপাশ্চ মূর্তিমন্তস্ত্রয়ো গুণাঃ ।। ৪

ততো মহানঙ্কার পঞ্চতন্মাত্রমেব চ।রূপরসগন্ধস্পর্শশব্দশ্চৈবতিসংজ্ঞকম্ ॥ ৫

‎আবির্ব্বভূত তৎপশ্চাৎ স্বয়ং নারায়ণঃ প্রভুঃ

‎শ্যামো যুবা পীতবাসা বনমালী চতুর্ভুজঃ ॥ ৬

‎শঙ্খচক্রগদাপদ্মধরঃ স্মেরমুখাম্বুজঃ।

‎রত্নভূষণভূষাটঃ শাঙ্গী কৌস্তুভভূষণঃ ॥ ৭

‎শ্রীবৎসবক্ষাঃ শ্রীবাসঃ শ্রীনিধিঃ শ্রীবিভাবনঃ।

শারদেন্দুপ্রভামুষ্টমুখেন্দুঃ সুমনোহরঃ ॥ ৮

‎কামদেব প্রভা মুষ্টরূপলাবণ্যসুন্দরঃ।

শ্রীকৃষ্ণপুরতঃ স্থিত্বা তুষ্টাব তং পুটাঞ্জলিঃ ॥ ৯

‎-(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণঃ ব্রহ্মখন্ড৩/১-৯)

অনুবাদঃ হে দ্বিজবর। এরপর সেই স্বেচ্ছাময় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সমগ্র বিশ্বকে প্রাণিশূন্য, জলহীন, নির্ব্বাত ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন, বৃক্ষ, শৈল, সমূদ্রাদিবিহীন শস্য-তৃণ বিবর্জিত ভয়ঙ্কর শূণ্যময় অবলোকন করে মানসিক আলোচনা পূর্ব্বক স্বেচ্ছাক্রমে সৃষ্টি করতে আরম্ভ করলেন। তৎক্ষণাৎ তাঁর দক্ষিণপাশ্ব থেকে সৃষ্টির কারণরূপ মূর্ত্তিমান গুণত্রয় সর্ব্বাগ্রে আবির্ভূত হল। পরে সেই গুণত্রয় হতে মহান্ (মহৎ)ও মহান্ হতে অহঙ্কার এবং অহঙ্কার হতে রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দ এই পঞ্চতন্মাত্রের উৎপত্তি হয়। তারপর পুনরায় তাঁর(শ্রীকৃষ্ণ)থেকে শ্যামকলেবর, যুব’, পীতবসন ও বনমাল্যধারী চতুর্ভুজ প্রভু স্বয়ং নারায়ণ আবির্ভূত হন। তাঁর মুখকমলে হাস্য এবং হস্তচতুষ্টয়ে শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্ম বিরাজ করছে। তিনি রত্নভূষণ ও হার কৌস্তভমণিদ্বারা বিভূষিত এবং শৃঙ্গময় চাপবিশিষ্ট। তাঁর মনোহর মুখকান্তি শরচ্চন্দসদৃশ প্রভাবিশিষ্ট এবং বক্ষঃস্থল শ্রীবৎসচিহ্নে সুশোভিত। সেই শ্রীনিবাসের সুন্দর রূপলাবণ্য কামদেবের তুল্য। তখন তিনি শ্রীকৃষ্ণের সম্মুখীন হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে স্তব করতে আরম্ভ করলেন।

যদিও শ্রীকৃষ্ণ  তার নিত্যধাম গোলক বৃন্দাবনে নিত্য বিরাজমান,তথাপি প্রতিটি ব্রহ্মান্ডে ব্রহ্মার প্রতি কল্পে বা প্রতি দিনে ১ বার অথাৎ মনুষ্যজীবের ১ হাজার চতুর্যুগের মধ্যে একবার অষ্টাবিংশ চতুর্যুগ দ্বাপরের শেষভাগে আবির্ভূত হন।
পূর্ন ভগবান কৃষ্ণ ব্রজেন্দ্রকুমার।
গোলোকে ব্রজের সহ নিত্য বিহার।।
ব্রহ্মার এক দিনে তিহোঁ অবতার।
অবতীর্ণ হঞা করেন প্রকট বিহার।।

‎‎সত্য,ত্রেতা,দ্বাপর,কলি চারিযুগ জানি।

সেই চারিযুগ দিব্য একযুগ মানি।।

একাত্তর চতুর্যুগে এক মন্বন্তর।

চৌদ্ধ মন্বন্তর ব্রহ্মার দিবস ভিতর।।

‎“বৈবস্বত”-নাম এই সপ্তম মন্বন্তর।

সাতাইশ চতুর্যুগ তাহার ভিতর।।

অষ্টাবিংশ চতুর্যুগে দ্বাপরের শেষে।

ব্রজের সহিতে হয় কৃষ্ণের প্রকাশে।।

‎-(শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতঃ আদি.৩/৫-১০)

অনুবাদঃ ব্রজরাজের পুত্র শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। তিনি ব্রজধাম সহ তার নিত্য আলয় গোলক বৃন্দাবনে নিত্য লীলাবিলাস করছেন।ব্রহ্মার একদিনে একবার তিনি তার অপ্রাকৃত লীলা প্রকট করার জন্য এই জড়জগতে অবতীর্ণ হন। আমরা জানি যে সত্য, ত্রেতা,দ্বাপর ও কলি এই চারটি যুগ রয়েছে। এই চারটি যুগকে একত্রে এক দিব্যযুগ বলা হয়। একাত্তরটি দিব্যযুগে এক মন্বন্তর হয়। ব্রহ্মার এক দিনে চৌদ্ধটি মন্বন্তর রয়েছে। বর্তমান সপ্তম মন্বন্তরে মনু হচ্ছেন বৈবস্বত।তার আয়ুষ্কালের সাতাশ দিব্যযুগ গত হয়েছে। অষ্টাবিংশতি দিব্য যুগের দ্বাপর যুগের শেষভাগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার নিত্য ব্রজধামের সমস্ত উপকরণসহ এই জড় জগতে আবির্ভূত হন।

স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ চিন্ময় জগৎ গোলকধাম থেকে   ব্রহ্মার প্রতি কল্পে একবার অথাৎ অষ্টাবিংশ দ্বাপরযুগের শেষের দিকে এই পৃথিবীতে অবতরন করেন, তাই তাঁকে অবতার বলা হয়।যদিও পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অবতাররুপে এই জড় জগতে আবির্ভূত হন, তথাপি তিনি  মৎস্য,কূর্ম,বরাহ, নৃসিংহ, বামন,পরশুরাম, শ্রীরাম ইত্যাদি অবতারের উৎস বা মূল।

‎কেননা শ্রীকৃষ্ণ চিন্ময় জগত গোলকধামে বিষ্ণুরুপে আবির্ভূত হন। সেই একই বিষ্ণু বিরাট পুরুষ/কারণোদকশায়ী বিষ্ণুরুপে কারণসমুদ্রে শয়ন করেন(শ্রীমদ্ভাগবত ১/৩/১) ।তাঁর শ্বাস প্রশ্বাসের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ডের প্রকাশ হয়।

যস্যৈকনিশ্বাসিতকালমথাবলম্ব্য
 জীবন্তি লোমবিলোজা জগাদগুনাথাঃ।

বিষ্ণুর্মহান্ স ইহ যস্য কলাবিশেষো।

‎গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।

-(ব্রহ্মসংহিতাঃ৫/৪৮)

অনুবাদঃ মহাবিষ্ণু, যাঁর মধ্যে অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ড প্রবেশ করছে এবং কেবল মাত্র যাঁর শ্বাস প্রশ্বাসের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেগুলি আবার তাঁর মধ্য থেকে প্রকাশিত হচ্ছে, তিনিও হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের অংশ প্রকাশ।

সেই কারণোদকশায়ী বিষ্ণু তাঁর থেকে প্রকাশিত  ব্রহ্মাণ্ডগুলির প্রতিটির ভিতর  গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুরূপে প্রবেশ করে গর্ভোদকে শয়ন করে যোগনিদ্রা বিস্তার করেন। তাঁর নাভি থেকে একটি পদ্ম বিকশিত হয় এবং সেই পদ্ম থেকেই প্রজাপতিদের পতি ব্রহ্মা জন্মগ্রহণ করেন(শ্রীমদ্ভাগবত ১/৩/২)।এই গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু থেকে বিভিন্ন অবতার প্রকাশিত হয় (শ্রীমদ্ভাগবত ১/৩/৫)।এইভাবে শ্রীকৃষ্ণ হলেন কারণোদকশায়ী বিষ্ণু, যারই প্রকাশ হল গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু, যার থেকে বিভিন্ন অবতারের বিস্তার।শ্রীকৃষ্ণ যেহেতু স্বয়ং গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু, তাই তাঁর থেকে প্রকাশিত নৃসিংহ,পরশুরাম,বামন ইত্যাদি সকল অবতারের মূল হলেন শ্রীকৃষ্ণ।এ বিষয়ে ব্রহ্মসংহিতা শাস্ত্রে বলা হয়েছে –

রামাদিমূর্তিষু কলানিয়মেন তিষ্ঠন্

 নানাবতারমকরোদ্ভুবনেষু কিন্তু ।
কৃষ্ণঃ স্বয়ং সমভবৎ পরমঃ পুমান্ যো
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ॥ ৩৯ ॥

-(ব্রহ্মসংহিতাঃ৫/৩৯)

অন্বয়– যঃ (যে কৃষ্ণ-নামক), পরমঃ পুমান (পরমপুরুষ), রামাদিমূর্তিষু (রামাদি মূর্তিসমূহে), কলানিয়মেন (স্বাংশ-কলাদিরূপে), তিষ্ঠন (অবস্থান করে), ভুবনেষু (ব্রহ্মাণ্ডসমূহে), নানাবতারম্ (বিভিন্নরূপ অবতার) অকরোৎ (প্রকাশ করে থাকেন), কিন্তু (পরন্তু), স্বয়ং (নিজেই), কৃষ্ণঃ সমভবৎ (কৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ হন), তম্ (সেই), আদিপুরুষং (আদিপুরুষ), গোবিন্দম্ (গোবিন্দকে), অহং (আমি), ভজামি (ভজনা করছি)।

অনুবাদঃ যে পরম-পুরুষ  স্বাংশ-কলাদি-নিয়মে শ্রীরাম,নৃসিংহ,বামন ইত্যাদি  মূর্তিতে স্থিত হয়ে জড় জগতে বিভিন্ন অবতার প্রকাশ করেন এবং স্বয়ং কৃষ্ণরূপে আবির্ভূত হন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে অথাৎ শ্রীকৃষ্ণকে  আমি ভজনা করি।।

হরে কৃষ্ণ। প্রনাম।

Sadgun Madhav Dash

Writer & Admin

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments