অনেকেই এর প্রশ্ন করেন যে, “পরমেশ্বর হচ্ছেন সকল কিছুর উৎস। তিনিই আদিপুরুষ। তবে তাঁর পিতা-মাতা থাকতে পারে কি করে?”
উত্তরঃ দেখুন, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই ভগবদ্গীতায় বলেছেন—
পিতাহমস্য জগতো মাতা ধাতা পিতামহঃ ।
বেদ্যং পবিত্রম্ ওঙ্কার ঋক্ সাম যজুরেব চ ॥
গীতাঃ ৯/১৭
অনুবাদ : আমিই এই জগতের পিতা, মাতা, বিধাতা ও পিতামহ৷ আমি জ্ঞেয় বস্ত্ত, শোধনকারী ও ওঙ্কার৷ আমিই ঋক্, সাম ও যজুর্বেদ।
অর্থাৎ, যদি কেউ তাঁর পিতা হোন, তবে তিনি তাঁর পিতারও পিতা অর্থাৎ পিতামহ।
সেই পরম সত্য আরও দৃঢ়ভাবে স্থাপন করেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ-পিতা বসুদেব। শ্রীকৃষ্ণের কাছে বসুদেব যে প্রার্থনা করেছেন তার দ্বারাই এই তত্ত্ব সহজে হৃদয়ঙ্গম করা যাবে।
শ্রীমদ্ভাগবতে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের কাছে বসুদেবের প্রার্থনা; বেশ কয়েক জায়গায় উল্লেখ আছে। তন্মধ্যে কংসের কারাগারে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের সময় ও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে “সূর্যগ্রহণ” এর সময় যখন কুরু, যাদব, বৃষ্ণিবংশীয় সকলে কুরুক্ষেত্রের পবিত্র তীর্থস্থানে সমবেত হয়েছিলেন তখনও বসুদেব এমন স্তুতি করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণের কাছে।
বসুদেব কতৃক শ্রীকৃষ্ণের স্তুতিঃ শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের ৮৫তম অধ্যায়ে এই ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়।
“কিভাবে শ্রীবলরাম সহ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পিতাকে দিব্য জ্ঞান প্রদান করেছিলেন, তাঁর মাতার মৃত পুত্রদের উদ্ধার করেছিলেন, এই অধ্যায়ে তা বর্ণনা করা হয়েছে।
দর্শনার্থী ঋষিরা শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা করছেন শ্রবণ করে বসুদেব তাঁকে ও বলরামকে তাঁর পুত্ররূপে গণ্য করা থেকে বিরত হয়ে পরমেশ্বর ভগবানরূপে তাঁর সর্বশক্তিমানতা, সর্ববিরাজমানতা ও সর্বজ্ঞতার স্তুতি করলেন। তাঁর পুত্রদ্বয়ের মহিমা কীর্তনের পর বসুদেব শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে পতিত হলেন এবং তিনি যে তাঁর পুত্র, এই ধারণা দূর করার জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করলেন। পরিবর্তে, শ্রীকৃষ্ণ বসুদেবকে ভগবৎ-বিজ্ঞানের শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে সেই ধারণাটির পুনরুদ্ধার করলেন এবং সেই সকল নির্দেশ শ্রবণ করে বসুদেব শান্ত ও সন্দেহমুক্ত হলেন। ”
কৃষ্ণ কৃষ্ণ মহাযোগিন্ সঙ্কর্ষণ সনাতন।
জানে বামস্য যৎ সাক্ষাৎ প্রধানপুরুষৌ পরৌ ॥ ৩ ॥
অনুবাদঃ [বসুদেব বললেন–]হে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ, মহাযোগী, হে সনাতন-স্বরূপ সঙ্কর্ষণ, আমি জানি যে আপনারা দুজন হচ্ছেন ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও সৃষ্টির উপাদান সমূহের কারণ স্বরূপ।
যত্র যেন যতো যস্য যস্মৈ যদ্যদ্যথা যদা।
স্যাদিদং ভগবান্ সাক্ষাৎ প্রধান পুরুষেশ্বরঃ । ৪ ॥
অনুবাদঃ আপনি পরমেশ্বর ভগবান যিনি প্রকৃতি ও প্রকৃতির স্রষ্টা (মহাবিষ্ণু) উভয়ের অধীশ্বররূপে প্রকাশিত হন। যা কিছু বর্তমান, যেভাবে এবং যখনই তা উৎপন্ন হয়, তা আপনার মধ্যে, আপনার দ্বারা, আপনার থেকে, আপনার উদ্দেশ্যে এবং আপনার সম্বন্ধে সৃষ্ট হয়।
এতন্নানাবিধং বিশ্বমাত্মসৃষ্টমধোক্ষজ।
আত্মনানুপ্রবিশ্যাত্মন্ প্রাণো জীবো বিভর্য্যজ ॥ ৫ ॥
অনুবাদঃ হে অধোক্ষজ, আপনার থেকে আপনি এই সমগ্র বিচিত্র বিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন এবং তারপর আপনার পরমাত্মা স্বরূপে তার মধ্যে আপনি প্রবেশ করেছেন। হে জন্মরহিত পরমাত্মা, এইভাবে সকলের প্রাণ ও জ্ঞানরূপে আপনি সৃষ্টিকে পালন করছেন।
অনুবাদঃ প্রাণ ও বিশ্বসৃষ্টির অন্যান্য পদার্থসমূহ যে শক্তিই প্রদর্শন করুক না কেন প্রকৃতপক্ষে তা সকলই পরমেশ্বর ভগবানের নিজ শক্তি কারণ প্রাণ ও বস্তু উভয়ই তাঁর অধীন ও তাঁর উপর নির্ভরশীল এবং পরস্পর হতে ভিন্নও। এইভাবে, জড়জগতে সক্রিয় সমস্ত কিছুই পরমেশ্বর ভগবান দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ৬।।
অনুবাদঃ চন্দ্রের দীপ্তি, অগ্নির তেজ, সূর্যের প্রভা, নক্ষত্রসমূহের ঝিকিমিকি, বিদ্যুতের ঝলকানি, পর্বতের স্থিরত্ব এবং ভূমির আধার শক্তি ও গন্ধ-এই সমস্ত কিছু প্রকৃতপক্ষে আপনি। ৭।।
অনুবাদঃ হে প্রভু, আপনি জল ও জলের স্বাদ এবং তৃষ্ণার তৃপ্তিজনক শক্তি ও জীবন প্রদাতা। আপনি বায়ুর ওজ, বল, চেষ্টা ও গতিরূপে প্রকাশিত হওয়ার মাধ্যমে নিজের শক্তিসমূহ প্রদর্শন করেন। ৮।।
অনুবাদঃ আপনি দিকসমূহ ও তাদের সমন্বয়কারী শক্তি, সর্বব্যাপ্ত আকাশ ও তদাশ্রয় শব্দ-তন্মাত্র। আপনি আদি নাদ, বর্ণ, ওম এবং শ্রাব্য ভাষা যে শব্দ দ্বারা নির্দিষ্ট বিষয়সমূহ বাক্যরূপ প্রাপ্ত হয়। ৯।।
অনুবাদঃ আপনি ইন্দ্রিয়সমূহের বিষয় প্রকাশিকা শক্তি, তাদের অধিষ্ঠাতৃ দেবতা এবং এই সকল দেবতাদের অধিষ্ঠান শক্তি। আপনি বুদ্ধির মীমাংসা শক্তি এবং জীবের যথার্থ প্রতিসন্ধান শক্তি। ১০।।
অনুবাদঃ আপনি জড় উপাদান সমূহের কারণ স্বরূপ তামসিক অহঙ্কার; আপনি দেহজ ইন্দ্রিয়সমূহের কারণ-স্বরূপ রাজসিক অহঙ্কার; আপনি সকল দেবতাদের কারণস্বরূপ সাত্ত্বিক অহঙ্কার এবং আপনি সমস্ত কিছুর ভিত্তিস্বরূপ অপ্রকাশিত সামগ্রিক জড়াশক্তি। ১১।।
অনুবাদঃ মূল বস্তু থেকে প্রস্তুত রূপান্তরিত দ্রব্যের উপাদানসমূহ যেমন অপরিবর্তিত দৃশ্যমান হয়, তেমনই আপনিও এই জগতের সকল নম্বর বস্তুর মধ্যে একমাত্র অবিনশ্বর সত্তা। ১২।।
অনুবাদঃ সত্ত্ব, রজ, তম নামক জড়া প্রকৃতির গুণসমূহ তাদের সামগ্রিক কার্যসমূহ সহ আপনার যোগমায়ার সুবিন্যস্ততা দ্বারা পরমব্রহ্মস্বরূপ আপনার মধ্যে সাক্ষাৎ প্রকাশিত। ১৩।।
অনুবাদঃ এইভাবে এইসকল সৃষ্ট বস্তু, জড়াপ্রকৃতির রূপান্তর সমূহ, একমাত্র যখন জড়াপ্রকৃতি তাদেরকে আপনার মধ্যে প্রকাশ করে তখন ছাড়া বিদ্যমান থাকে না, সেই সময় আপনিও তাদের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করেন। কিন্তু সৃষ্টির এরূপ একান্ত সময় ব্যতীত, আপনিই একমাত্র পরমার্থস্বরূপ রূপে বিরাজিত থাকেন। ১৪।।
অনুবাদঃ এই জগতের জাগতিক গুণাবলীর অনবরত প্রবাহ মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যারা আপনাকে, সমস্ত কিছুর তারা প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞ। পরমাত্মা, তাদের পরম শ্রেষ্ঠ গতিরূপে জানতে ব্যর্থ হয়, তাদের অজ্ঞতার জন্য জাগতিক কর্মবন্ধন এরূপ আত্মাদের জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ভ্রমণ করতে বাধ্য করে। ১৫।।
অনুবাদঃ সৌভাগ্যক্রমে আত্মা এক সুস্থ মানব জীবন প্রাপ্ত হবার দুর্লভ সুযোগ প্রাপ্ত হতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার পক্ষে কোনটি শ্রেয় সেই বিষয়ে যদি সে বিভ্রান্ত হয়, হে ভগবান, আপনার মোহিনী মায়া তার সমগ্র জীবন নষ্ট করার জন্য তাকে প্রভাবিত করবে। ১৬।।
অনুবাদঃ আপনি এই সমগ্র জগতকে স্নেহ রজ্জু দ্বারা বন্ধন করেন আর মানুষ যখন তাদের জড় দেহ বিষয়ে বিবেচনা করে, তারা মনে করে যে “এই আমি” এবং যখন তারা তাদের সন্তান ও অন্যান্য সম্পর্কিত বিষয়ে বিবেচনা করে তারা মনে করে “এই সকলই আমার”। ১৭।।
অনুবাদঃ আপনারা দুইজন বস্তুত আমাদের পুত্র নন, পরন্তু ভূভারভূত ক্ষত্রিয়দের বিনাশার্থ আপনারা প্রকৃতি পুরুষের ঈশ্বর হয়েও মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন, যা আপনি জন্মসময়ে বলেছিলেন। ১৮।।
অনুবাদঃ অতএব, হে দীনবন্ধু, এখন আমি আপনার পাদপদ্মের শরণাগত হয়েছি যে পাদপদ্ম সকল শরণাগতজনের সংসারভয় দূরীভূত করে। যথেষ্ট ইন্দ্রিয় উপভোগের লালসা, যা আমাকে এই মর্ত্যশরীরে আত্মবুদ্ধিযুক্ত করেছে। তাই হে ভগবান, আপনাকে আমার পুত্র বলে মনে করেছি। ১৯।।
অনুবাদঃ প্রকৃতপক্ষে সূতিকাগৃহে অবস্থানের সময়ে আপনি আমাদের বলেছিলেন যে, আপনি জন্মরহিত ভগবান, পূর্ববর্তী যুগেও কয়েকবার আমাদের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আপনার নিজ ধর্ম রক্ষার্থে এই সকল দিব্য দেহসমূহ প্রকাশের পর আপনি তাদের অন্তর্হিত করেন, এইভাবে আপনি মেঘের মতো প্রকাশিত ও অন্তর্হিত হন। হে পরম-বন্দিত সর্বব্যাপ্ত ভগবান, আপনার ঐশ্বর্যময় বিস্তারের অতীন্দ্রিয় মোহিনী-শক্তিকে কে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে? ২০।।
অতএব, শ্রীকৃষ্ণ-পিতা বসুদেব স্বয়ং স্বীকার করলেন যে, প্রকৃতপক্ষে শ্রীকৃষ্ণ তার পুত্র নন, বরং তিনিই সৃষ্টির উৎস, পালক ও সংহারক। একই প্রার্থনা তিনি করেছিলেন কংসের কারাগারে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের সময়। তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের(বসুদেব-দেবকী) পূর্বজন্মের ইতিহাস শুনিয়েছিলেন। কোন্ তপস্যার বলে তাঁরা কৃষ্ণকে তাঁদের পুত্ররূপে লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। যা শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের তৃতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে। আগ্রহী পাঠকগণ তা পড়ে দেখতে পারেন।
এইভাবে প্রমাণিত হলো যে, বসুদেবের পুত্র হলেও শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর ভগবান এবং শ্রীকৃষ্ণ কীভাবে যুগপৎ পিতা ও পিতামহের ভূমিকা পালন করেন।
হরে কৃষ্ণ।
প্রচারেঃ স্বধর্মম্ ™
Views Today : 213
Total views : 118880
Who's Online : 0
Your IP Address : 216.73.216.136